Thursday, December 27, 2018

ক্রিসমাস চিঠি

১।
চিঠিটা আরেকবার পড়ে খামে ভরলেন ভদ্রমহিলা। তারপর সেটাকে একটা লাল বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। ক্রিসমাস আসতে আর বেশিদিন নেই। তার আগেই এটাকে পৌঁছতে হবে গন্তব্যে।



২।
ক্রিসমাসের সকাল। প্যানকেক, ব্লুবেরি সস, স্মোকড পোট্যাটো আর স্মোকড সামন দিয়ে ব্রেকফাস্ট সবে শেষ হয়েছে। ঠাকুমাকে আদর করে "মেরি ক্রিসমাস" জানিয়ে জিনা ছুট্টে গিয়েছে ওদের ক্রিসমাস ট্রিয়ের সামনে। সারি সারি বাক্স, বিভিন্ন সাইজে, বিভিন্ন রঙে। ফায়ারপ্লেসের ওপর ওর স্টকিংটা পেট মোটা হয়ে উপচে পড়ছে। এই বছরও জিনা বাধ্য মেয়ে ছিল। স্যান্টা ওর জন্য অনেক কিছু এনেছে। বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু জিনা কিছুতেই সাহস করে এগোতে পারছে না ওইদিকে। কিছুতেই না। এক দুইবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফায়ারপ্লেস অবধি পৌঁছে আবার ফেরত এলো। অজানা এক আতঙ্ক। কী জানি, কী আছে ওতে?


ডিসেম্বরের ছুটিটার জন্য যখন স্কুলের সব বাচ্চারা মুখিয়ে থাকে, জিনার মনে তখন গ্রাস করে আসে এক রাশ দুঃখ। ভিলেজের আর পাঁচটা বাড়ির মতো যদিও আভেন থেকে সদ্য বের করা প্লাম কেকের সৌরভে গোটা বাড়ি ম-ম করে, মাংসের নানান সুস্বাদু পদ রাঁধা হয়, সাজানো হয় রঙ বেরঙের টাটকা শীতের সব্জি ও ফল দিয়ে স্যালাড, লিভিং রুমে ইয়া বড় ক্রিসমাস ট্রিও আসে, সাজানো হয় কনফেটি আর আলো দিয়ে, ট্রিয়ের নীচে বাক্স বাক্স উপহার রাখা থাকে, তবুও জিনার ইচ্ছেই করেনা হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরতে। ঐশ্বর্য ও বৈভবের কোন রকম অভাব না থাকলেও ওর বন্ধুদের বাড়ির মতো সেখানে থাকেনা বাবা মায়ের আদরমাখা উষ্ণতা, থাকেনা হই হই করে একটা প্রাণভরা উৎসবের আনন্দ।

জিনাদের বাড়িতে থাকেন ওর বয়স্কা ঠাকুমা, জিল আর জিনার গভর্নেস, শেলী। মারগারেট এসে রান্না বানা করে দিয়ে যায়। ক্রিসমাস ইভে এই চারজনে এক সাথে এলাহি ডিনার সারে। তারপর ঠাকুমা জিলের কিনে আনা স্টকিংটাকে সযত্নে লিভিং রুমের ফায়ারপ্লেসটার ওপর শেলীর সাহায্যে টাঙ্গিয়ে জিনা চুপটি করে লেপের তলায় ঢুকে যায় বাধ্য মেয়ের মতো। জিনার যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, এই একই ব্যবস্থাই সে দেখে আসছে। মা বাবা বলতে শুধুই একদম জন্মের কিছু মাস অবধি সময়ের ছবিতেই তাঁরা সীমাবদ্ধ।

ঠাকুমাকে খুব জিজ্ঞেস করত আগে ওঁদের কথা। জিল চোখ ছলছল করে নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন না কিছুই। কোথায় জিনার মা বাবা? কেনই বা তাঁরা আসেন না তাদের এই মিষ্টি মেয়েটিকে দেখতে কখনও, কোনরকম যোগাযোগও করেন না। এই রহস্যের উত্তর জানতে চেয়ে কত রাত ছোট্ট জিনা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে। জিল কিছুই বলতে পারেননি। শুধু একবার বলেছিলেন, "জিনা, সোনা মেয়ে। কেঁদো না। দেখো, তোমার জন্য তোমার সমস্ত পছন্দের উপহার রয়েছে। খেলা করব তো আমরা এইগুলি নিয়ে। মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করো না।" ঠাকুমার আর্তিতেও জিনা গলেনি, ও আবারও জিজ্ঞেস করতেই থেকেছে, "আমার মা বাবা কোথায়?" অসহায় জিল তখন ঝোঁকের বসেই বলে ফেলেন, "যেদিন তুমি জীবনের পঞ্চাশতম ক্রিসমাস উপহার পাবে, সেইদিন জানতে পারবে বাবা মায়ের কথা।" জিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ঠাকুমার মুখের দিকে। সপ্রশ্ন নেত্রে। খানিক চুপ করে থেকে বলে, "কী করে জানবো?" জিল উত্তর দেন, "তোমার স্টকিং এর ভিতর থাকবে হদিশ। নাও ডার্লিং, এইবারে ঘুমিয়ে পড়ো।"
সেই রাত্তিরটা ঠাকুমা ও নাতনি প্রায় কেউই ঘুমোতে পারেনি। সারা রাত জিল এ পাশ ও পাশ করে গিয়েছেন। কী করে বলবেন এই ফুটফুটে শিশুটিকে ওর গুণধর বাপ মায়ের কথা? সেই বাবা মা যারা এই ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটির জন্মের পর থেকে কোন রকম দায় দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি ওর। শুধু বছরের এই একটা সময়ে মেয়ের নামে উপহার পাঠিয়ে দেয় একাধিক। জিলের স্বামী, মরগানের টাকার অভাব ছিল না, তাই কখনও অর্থকষ্টে ভুগতে হবে না ওদের, এইটুকু যা ভরসা। এমনিতেই জিলের অবর্তমানে জিনার কী হবে, সেই ভেবেই ভয় পান, তার ওপর আজ এই পরিস্থিতি। নেহাত বাচ্চা মেয়েটিকে সাময়িক স্তোক বাক্য দিলেন। কিন্তু কতদিন?
জিনার মনে সেইদিন থেকে শুরু হয়ে যায় এক অজানা উৎকণ্ঠা। কী জানবে ও? সেই খবর সুখের হবে তো? জিল বা শেলীর অজান্তেই সেই ক্রিসমাস সকালেই জিনা ওর এ যাবত পাওয়া সমস্ত উপহারের ফিরিস্তি করতে থাকে, ওর ছোট্ট পকেট ডায়েরিতে। একদম ছোটবেলার কথা মনে নেই, কিন্তু জিলের ডায়রি লেখার অভ্যেসের সুবাদে সেই সমস্যাও মিটে গেল।

জিনা গুনে দেখেছে। গতকালই। জিলের সামনে বসে। গত ক্রিসমাস অবধি ও আটচল্লিশটা উপহার পেয়েছে। আজ ওর স্টকিংটা উপচে পড়ছে। তার মানে আজ সেই উপহারের সংখ্যা পঞ্চাশ পেরিয়ে যাবেই। তার মানে তো ঠাকুমার কথা অনুযায়ী আজকেই ও জানতে পারবে ওর বাবা মায়ের হদিশ।

"কী হলো সোনা মেয়ে, স্টকিংটা দেখবে না? দেখো কী কী গিফটস আছে ওতে?" ঠাকুমার আদুরে কণ্ঠস্বরে জিনার সম্বিত ফেরে। ফ্যাকাশে মুখ করে জিনা বলে, "ঠাকুমা, আজ যে আমি আমার পঞ্চাশতম ক্রিসমাস গিফটটি পাবো। মনে আছে, তুমি বলেছিলে সেই কত বছর আগে?"
পলকেই জিলের মুখটা পার্চমেন্ট পেপারের মতো শুকিয়ে গেল। সেদিন কথায় কথায় ওরকম বলেছিলেন। মনেও ছিল না। এইবারে কী বলবেন? নাতনি এখন টিনএজার। মিছে স্তোকবাক্যে ভোলানো মুস্কিল। তবে কি...
"ঠাকুমা, আমার ভয় করছে। নার্ভাস লাগছে। তুমি প্লিজ খুলে দেখাও কী আছে।" কাঁপা কাঁপা গলায় জিনা বলল।
নিরুপায় হয়ে জিল স্টকিংটা নামালেন। ভিতর থেকে এক এক করে বের করলেন নিজের হাতে কেনা জিনার পছন্দের উপহার। আর তার সাথে আরেকটা লাল বাক্স। ছোট্ট। এসেছে প্রতি বছরের মতোই, জিনার বাবা মায়ের থেকে।
"ওটা কি বাবা মায়ের পাঠানো বক্স?" জিনা জিজ্ঞেস করে।
"হুম।" জিল উত্তর দেন।
"ওটাই আগে খোলো প্লিজ।" এক অদ্ভুত আকুতি মিশিয়ে বলে জিনা।
আস্তে আস্তে সভয়ে জিল ফিতেটা খোলেন। বাক্সের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা চিঠি। জিনাকে উদ্দেশ্য করে। লেখা রয়েছে...


No comments:

Post a Comment