হিমাচল প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম কসোল। পাহাড়ের কোলে এই গ্রাম। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে পার্বতী নদী, আপন মনে। কিছু বছর হলো পর্যটকদের অতি প্রিয় জায়গা হয়েছে কসোল। যার ফলে গ্রামবাসীরা অনেকেই তাই ট্যুরিজমকে করে নিয়েছে জীবিকা। অনেকেই এখন নিজেদের বাড়ির দু তিনটে ঘরকে সাজিয়ে গুছিয়ে হোম -স্টে হিসেবে ভাড়াও দিচ্ছে।
বিশ্বনাথ ভার্মা বয়স সত্তরের ওপর। এক কালে কুলুতে সরকারি হোটেলে ম্যানেজারি কাজ করেছেন। এখন অবসর জীবন কাটাতে গ্রামে ফিরে এসেছেন। স্ত্রী মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগেই। এখন ছেলে বৌমা আর নয় বছরের নাতিকে নিয়েই সংসার। ছেলেও বাপের মতোই চাকরি করে, শিমলাতে। নামী হোটেলের খাস বাবুর্চি। নামডাক ভালোই। রোজগারপাতি মন্দ নয়। ছেলের পাঠানো টাকা, নিজের পেনশন এই দিয়েই দিব্যি সংসার চলে যায়। বৌমা লক্ষ্মী নামেও লক্ষ্মী, কাজেও তাই। নিজের হাতে সংসারটা যত্ন করে রেখেছে, গুছিয়ে ঘরকন্না করে। নাতি অর্জুন ঠাকুর্দার ন্যাওটা।
দোতলা কাঠের বাড়ির বারান্দায় এক চিলতে রোদ এসে পড়ে সকাল থেকেই। ঠান্ডা কাটাতে বিশ্বনাথ সকল হতেই সোয়েটার টুপি মোজাতে নিজেকে ভালো করে মুড়ে বসে থাকেন সেই রোদে। রোদের ওমটুকু শুষে নিতে। লক্ষ্মী ঠিক সময়মতো হয় নিজে নয় অর্জুনের হাত দিয়ে নাস্তা, কয়েক কাপ চা পাঠিয়ে দেয় ওপরে। পাশে রাখা পুরোনো টেবিলে ততোধিক পুরোনো রেডিওতে বিবিধ ভারতী চ্যানেলে হিন্দি গান চলতে থাকে। খবরের কাগজ, টুকটাক বই পড়া আর রাস্তা দিয়ে চেনাপরিচিত কেউ গেলে দুটো কথা বলা। এই করতেই সকালটা দিব্যি কেটে যায় বিশ্বনাথের।
আজ অবশ্য রুটিনে একটু ব্যাঘাত ঘটেছে। অন্যন্যদিন যখন ঠিক সকাল আটটার সমাচার প্রভাতী শুরু হয়, তখনই বৌমা দিনের প্রথম চায়ের কাপ এসে পৌঁছে যায় বিশ্বনাথের কাছে। আজ সমাচার শেষ। শুরু হয়ে গিয়েছে স্থানীয় সংবাদ। কিন্তু চায়ের দেখা নেই। অথচ বৌমা তো সেই কোন সকাল থেকে উঠে রান্নাঘরে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। টুকটাক টুংটাং শব্দ পেয়েছেন বিশ্বনাথ। অর্জুনেরও ঘুম কখন ভেঙে গিয়েছে। হুটোপুটি করছে। তাহলে, চাটা এলো না কেন এখনো? একবার হাঁক পাড়বেন? নাকি নিজেই নামবেন? ভাবতে থাকেন বিশ্বমনাথ। বেলা গড়ায়। শিউনাথ, হরকিষেন সবাই কাজেকর্মে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তা থেকে বিশ্বনাথকে হাত জোড় করে প্রভাতী শুভেচ্ছা জানায়।
বিশ্বনাথ ভাবেন, কী হলো ব্যাপারটা, সরেজমিনে দেখতে হবে। লাঠি হাতে টুকটুক করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলেন, ধীরে ধীরে। লাঠি ও পায়ের শব্দ শুনে অর্জুন আর লক্ষ্মী দৌড়ে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, "কী হলো বাবুজি, আপনি নীচে নামছেন কেন? কিছু সমস্যা?" অর্জুন এগিয়ে এসে দাদুর হাত ধরে ওঁকে নামতে সাহায্য করে। বিশ্বনাথ একটা চেয়ারের ওপর বসেন। একটু হাঁফ ছেড়ে বললেন, "লক্ষ্মী বেটি, আজ চা পাঠালি না? ব্যস্ত?" শুনেই লক্ষ্মী দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে, ঘড়ির কাঁটা নটা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বেশ লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে লক্ষ্মী উত্তর দেয়, " মাফ করবেন বাবুজি। একদম খেয়াল করিনি। আমি এক্ষুণি চায় নাস্তা আনছি। আসলে রান্নাঘরে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম..." বিশ্বনাথ বলেন, "আরে ঠিক আছে। এক আধ দিন হতেই পারে। তুই ধীরে সুস্থে নিজের সুবিধে মতো কর। কিন্তু বল, আজ রান্নাঘরে বিশেষ ব্যস্ততা কেন রে?" লক্ষ্মী মুচকি হেসে উত্তর দেয়, "আপনার মনে নেই বাবুজি? আজ কত তারিখ?" বিশ্বনাথ খানিক চুপ থাকেন। তারপর মনে পড়ে যায়। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, "আরে, আজ তো একত্রিশ। আজ তো বিষ্ণু বেটার আসার কথা। আমি ভুলেই গিয়েছি!" লক্ষ্মী হাসি হাসি মুখে বলে, "হ্যাঁ বাবুজি। ওই জন্যই একটু খাস নাস্তা বানাচ্ছি। ওর তো দশটার বাসে আসার কথা। এসে যাতে ওর সবচেয়ে পসন্দের খাবার পায়, তাই ক্ষীর, পুরি আর সব্জি করছি। আপনাকে গরম গরম ভেজে দিচ্ছি এক্ষুণি। একটু ততক্ষণ চায় বিস্কিট খান।" অর্জুন মাকে হাতে হাতে কাজে সাহায্য করে। ভালো ছেলে তৈরি হয়েছে ও। ও রান্নাঘরের তাক থেকে বিস্কুটের টিন নামিয়ে দাদুর জন্য কয়েকটা মিষ্টি বিস্কুট বের করে প্লেটে সাজায়। লক্ষ্মী চায়ের জল গরম বসায়। বিশ্বনাথ বলেন, "বেটা, তুই আমার জন্য তাড়াহুড়ো করিস না। এই তো চা খাবো। ওষুধটা খেয়ে নেব এরপরেই। তারপর বিষ্ণু এলে একসাথে বসে চারজনে নাস্তা করবো। কী বলিস অর্জুন বেটা?" বিশ্বনাথ হাসিমুখে নাতির পানে চেয়ে থাকেন। লক্ষ্মী "জী ঠিক আছে" বলে ঝটপট কাজে লেগে যায়।
বিশ্বনাথ চায়ের কাপ হাতে বসে থাকেন রান্নাঘরের সামনে দাওয়ায়। সকালের নরম রোদ এসে পড়ে গায়ে। বুড়ো হাড়ে ভালোই আরাম লাগে। আয়েশ করে দেখতে থাকেন সুখের সংসারে। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানান প্রতিনিয়ত। কামনা করেন পরিবারের সুস্বাস্থ্যের। এমন সময় রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে নাতি অর্জুন। হাতে ছোট্ট বাটিতে একটু ক্ষীর। দাদুর হাতে ধরিয়ে বলে, "মা বললো একটু চেখে দেখতে। মিঠা ঠিক আছে কি না বলো।" বিশ্বনাথ নাতির হাত থেকে বাটি নিয়ে বলেন, "তুমিই বলো দাদুভাই। তুমি খাও।" অর্জুন মাথা নেড়ে বলে, "নাঃ। তুমি খাও। জলদি জলদি খাও। তাহলে একটা সিক্রেট বলবো। বাবা বারণ করেছে বলতে। বলেছে তোমায় সারপ্রাইজ দেবে।" রান্নাঘর থেকে ছেলের কথা শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসে লক্ষ্মী। ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলে, "আরে আরে, বাবা বলেছে না সিক্রেট। তুই বলে দিলে আর সারপ্রাইজ কী করে হবে?" বিশ্বনাথ বেশ আমোদ পান এতে। হাসিখুশি মুখে বলেন, "কী সিক্রেট বেটি যা বলবি না আমায়?" লক্ষ্মী মাথা নিচু করে বলে, "ও আপনার ছেলে এসে বলবে বলেছে। আমরা বলে দিয়েছি জানলে রাগ করবে।" এই বলে লক্ষ্মী রান্নাঘরে ফেরত যায়। বিশ্বনাথ চামচ করে পায়েসের স্বাদ নেন। আঃ। যেন অমৃত। বৌমাকে রান্নার প্রশংসা জানান। অর্জুন বাটি নিয়ে চলে যায়। বিশ্বনাথ চোখ বুজে রোদের আরাম নেন। ভাবতে থাকেন, কী হতে পারে সারপ্রাইজ। নির্ঘাত ছেলে কোনো বড় চাকরি পেয়েছে। বাঃ। খুব ভালো হয় তাহলে। মাইনে বাড়বে। ইজ্জত বাড়বে। অর্জুন বড় হচ্ছে। খরচা বাড়ছে সংসারের। বিষ্ণু যদি এর মধ্যে ভালো চাকরি পায়, খুব আনন্দের। তবে একটাই আক্ষেপ। হয়তো আরো দূরে চলে যেতে হবে। এখন যেমন মাসে একবার আসে, তখন হয়তো সেটা কমে যাবে। মন কেমন করে বিশ্বনাথের। যত বয়স বাড়ছে, তত যেন বেশি করে পরিবারকে আঁকড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সব সময় মনে হয়, সব্বাই মিলে একসাথে থাকতে পারলে, কী ভালোই না হতো।
সোয়া দশটার দিকে হইহই করে বিষ্ণু বাড়ি ফেরে। অর্জুন তো বাবাকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। এই ঘর ওই ঘর দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ি মাত করে ফেলে ও মুহূর্তেই। লক্ষ্মীর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। হবেই তো। কত মাস পরে বাড়ি এলো বিষ্ণু। সেই পনেরই আগস্টের পর একবার এসেছিল। তারপর আর ছুটি পায়নি। এই সময়টা ঘোর টুরিস্টের মরসুম। হোটেলে মেলা কাজ। তাই ছুটিও বিরল। বিষ্ণু এসে তার বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কুশলবার্তা জানতে চায়। বাবুজির পায়ের ব্যথা, হাঁপানি সব কেমন আছে, ওষুধে কাজ হচ্ছে কি না, সব। লক্ষ্মী তাড়া দেয় এর মধ্যে, "গরম জল করে দিয়েছি। আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন শিগগিরই। একসাথে নাস্তা করবো সবাই। বাবুজি না খেয়ে বসে আছেন। আপনার অপেক্ষায়।" বিষ্ণু বাবাকে বলে, "কেন বাবুজি? তুমি খেয়ে নাওনি কেন? এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে হয়?" বিশ্বনাথ ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, "বেটা, এই তো একদিনই এরকম করছি। কতদিন পর দেখা হলো। একসাথে খাই। সব্বাই মিলে। ভালো লাগে।"
বিষ্ণু তড়িঘড়ি পোশাক পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নীচে চলে আসে। লক্ষ্মী ইতিমধ্যে খাবার বেড়ে রেখেছে। অনেকদিন পর সপরিবারে একসাথে খেতে বসা। গরম গরম পুরি ক্ষীর পেয়ে বিষ্ণু খুব খুশি। অর্জুনও এতদিন পর বাবার সান্নিধ্য পেয়ে মহানন্দে। বিশ্বনাথ পুরির টুকরো মুখে পুরে বলেন, "হ্যাঁ রে অর্জুন। তুই যে বললি তোর বাপ কী সিক্রেট সারপ্রাইজ দেবে আমায়, কই, এখনো কিছু বুঝলাম না তো?" বিষ্ণু ক্ষীরের চামচ চেটে নামিয়ে বাবার দিকে তাকায়। বলে, "সত্যিই কিছু বোঝোনি?" বিশ্বনাথ অবাক হয়ে বলেন, "কই না তো। কী?" বিষ্ণু এইবার একবার লক্ষ্মী, একবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তারপর বাবার দিকে ফিরে বলে, "দেখলে না এই এত লটবহর নিয়ে ফিরলাম? সব মালপত্র নিয়ে চলে এলাম। বাবা, চাকরিটা ছেড়েই দিয়েছি। আর তোমাদের ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। পারছিলামও না।" হতভম্ব বিশ্বনাথ ভেবে পান না কী বলবেন। খানিক চুপ করে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করেন, "তাহলে? এরপর?" বিষ্ণু উত্তর দেয়, "অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম। তোমার আমার যা অভিজ্ঞতা ট্যুরিজম নিয়ে, আর লক্ষ্মীর যা হাতযশ, কসোলের হোম-স্টে ব্যবসায় আমরাও নেমে পড়ি। নাকি?" বিশ্বনাথ বলেন, "কিন্তু তার জন্য তো অনেক ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। পারমিশনের ব্যাপারও আছে। সেগুলো?" বিষ্ণু বলে, "এক মিনিট", উঠে হাত ধুয়ে ব্যাগ থেকে বের করে একটা গোলাপি ফাইল। ওপরে জ্বলজ্বল করছে লেখা, "ভার্মা এন্ড সন হোম-স্টে, কসোল"। বিশ্বনাথের হাতে ধরিয়ে বলে, "এই যে। সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। নতুন বছরে এটাই তোমাকে আমার গিফট। ঠিক যেমন তুমি আমায় দিতে, ছোট থেকে?"
বিশ্বনাথ আনন্দে বিহ্বল। কী বলবে, কিচ্ছু বোঝে না। আনন্দে আত্মহারা। দুই চোখ ছলছল করে আনন্দে। আজ উনি এক গর্বিত পিতা। সপরিবারে একসাথে থাকার এই যে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা, এর চেয়ে ভালো নববর্ষের উপহার বুঝি আর কিচ্ছুটি হয় না। সত্যিই আজ "হ্যাপি নিউ ইয়ার।"
Sunday, December 29, 2019
Monday, December 23, 2019
মিউট জীবন।
অনেকদিন পর এত বেলা করে ঘুম ভাঙল রেবার। অথচ কী আশ্চর্য, কোনদিকে তেমনভাবে কোনো ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি কিচ্ছুটি টের পাচ্ছে না ও। হলো টা কি? অন্যদিন তো সকাল থেকে এমনিতেই এই স্নেহালয় এপার্টমেন্টে হয় হট্টগোল লেগেই থাকে। সাতটার মধ্যেই ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কাজের লোকেরা চলে আসে। উঠোন ঝাঁট দেওয়ার ওই কর্কশ শব্দ, বাসনের ঝংকার, বাড়ির ছেলেদের "কই গো, বাজারের ফর্দ দাও", মায়েদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর ব্যস্ততা। দোতলার ফ্ল্যাটে বেডরুমে শুয়ে শুয়ে প্রতিদিন রেবার ঘুম ভেঙে যায় ওই শব্দে। এমনিতে রেবার সারা রাত ঘুম আসে না, ওষুধ খেয়েও। ভোরের দিকেই যা একটু চোখে ঘুম নেমে আসে, তবে প্রত্যেকদিন এই ভোরের আওয়াজ মেলায় বিচ্ছিরি ভাবে ঘুম ভাঙে ওর। আর ব্যস, সারাদিন মাথা ধরে থাকা। এই নিয়ে সারাদিন গজগজ গজগজ করতে থাকে রেবা। "ঈশ্বর, কালা করে দাও না আমায়। আর এই এত আওয়াজ, সহ্য করতে পারিনা।"
রেবা বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গেলো। ব্যাপারটা কী, বুঝতে। দেখলো, বাহাদুর সিং এপার্টমেন্টের উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, রাজু বিশ্বাসদের গাড়ি ধুচ্ছে। বাসন্তী হড়বড় করে গেট ঠেলে ঢুকলো এই মাত্র। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটুও শব্দ নেই কেন? অন্যদিন এই গেটের আওয়াজের ঠ্যালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। জলের বালতি দুবার উল্টায়। আজকে যেন মনে হচ্ছে, টিভি দেখছে, মিউট করে। অবাক হয় রেবা। কানের কোনো সমস্যা হলো নাকি? বার কয়েক কান খোঁচায়, ইয়ার বাড বের করে। তাতেও কিছু উপকার হয়না। অদ্ভুত ব্যাপার।
দিন গড়াতে থাকে। রেবার অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়না। ছেলে মেয়েরা বারবার ফোন করে করে সাড়া পায়না। হোয়াটসআপে মেসেজ পেয়ে তাদের শান্ত করে রেবা, কিন্তু ঘটনাটা কিচ্ছু জানায়না। আজ আবার বড়দিন। ডাক্তার বদ্যিও পাবেনা। কাল ই এন টি দেখাবে স্থির করে রেবা। সারাদিন নিজের মতো কাজ নিয়ে থাকে। মন্দ কাটেনা শব্দবিহীন। বেশ যেন স্তব্ধতা, শান্তি। বই পড়ে ঘরের কাজ করে দিন কাটে। শুধু একটাই আক্ষেপ, ক্রিসমাস ক্যারল শোনা হলো না ওর। ফোনেও গল্প হলো না। নাতি নাতনীদর মিষ্টি কলকাকলিও শোনা হয়না। রাত্রে শোয়ার আগে রেবা ভাবতে বসে, সারাদিন কেমন গেল। মন্দ নয়, কিন্তু এই কি ভালো? একটুও শব্দ নেই, পাখির গান নেই, রেডিওর বকবক নেই, রোজের জীবন যেন নীরস। নাঃ, ঘুম হয়তো ভালো হবে, বা হবে না। কিন্তু দিন মোটেই ভালো যায়নি। কে জানে, কাল ডাক্তার কী বলেন। ভাবতে ভাবতে রেবা শুয়ে পড়ে। রাত্রে স্বপ্নে স্যানটা বুড়ো হাজির। হাসিমুখে বলে, "কী? খুব তো শখ ছিল কালা হওয়ার, ভালো লাগেনি তো? কাল সকালে উঠে দেখবে সব আবার আগেরমত। আর হ্যাঁ, বুঝেশুনে উইশ করো। বুঝলে রেবারানী?"
রেবা বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গেলো। ব্যাপারটা কী, বুঝতে। দেখলো, বাহাদুর সিং এপার্টমেন্টের উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, রাজু বিশ্বাসদের গাড়ি ধুচ্ছে। বাসন্তী হড়বড় করে গেট ঠেলে ঢুকলো এই মাত্র। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটুও শব্দ নেই কেন? অন্যদিন এই গেটের আওয়াজের ঠ্যালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। জলের বালতি দুবার উল্টায়। আজকে যেন মনে হচ্ছে, টিভি দেখছে, মিউট করে। অবাক হয় রেবা। কানের কোনো সমস্যা হলো নাকি? বার কয়েক কান খোঁচায়, ইয়ার বাড বের করে। তাতেও কিছু উপকার হয়না। অদ্ভুত ব্যাপার।
দিন গড়াতে থাকে। রেবার অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়না। ছেলে মেয়েরা বারবার ফোন করে করে সাড়া পায়না। হোয়াটসআপে মেসেজ পেয়ে তাদের শান্ত করে রেবা, কিন্তু ঘটনাটা কিচ্ছু জানায়না। আজ আবার বড়দিন। ডাক্তার বদ্যিও পাবেনা। কাল ই এন টি দেখাবে স্থির করে রেবা। সারাদিন নিজের মতো কাজ নিয়ে থাকে। মন্দ কাটেনা শব্দবিহীন। বেশ যেন স্তব্ধতা, শান্তি। বই পড়ে ঘরের কাজ করে দিন কাটে। শুধু একটাই আক্ষেপ, ক্রিসমাস ক্যারল শোনা হলো না ওর। ফোনেও গল্প হলো না। নাতি নাতনীদর মিষ্টি কলকাকলিও শোনা হয়না। রাত্রে শোয়ার আগে রেবা ভাবতে বসে, সারাদিন কেমন গেল। মন্দ নয়, কিন্তু এই কি ভালো? একটুও শব্দ নেই, পাখির গান নেই, রেডিওর বকবক নেই, রোজের জীবন যেন নীরস। নাঃ, ঘুম হয়তো ভালো হবে, বা হবে না। কিন্তু দিন মোটেই ভালো যায়নি। কে জানে, কাল ডাক্তার কী বলেন। ভাবতে ভাবতে রেবা শুয়ে পড়ে। রাত্রে স্বপ্নে স্যানটা বুড়ো হাজির। হাসিমুখে বলে, "কী? খুব তো শখ ছিল কালা হওয়ার, ভালো লাগেনি তো? কাল সকালে উঠে দেখবে সব আবার আগেরমত। আর হ্যাঁ, বুঝেশুনে উইশ করো। বুঝলে রেবারানী?"
(৫)
- তখন ফোনটা রেখে দিলি কেন?
- ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে চলেছিস, ফোন ধরে থেকে কী করবো? এখন আর জিও টু অন্য নেটওয়ার্ক ফ্রি নেই রে।
- তা বলে তুই ফোন ছেড়ে দিবি?
- আহা, ফোনই তো ছেড়েছি, তোকে তো আর না।
- একদম বাটারিং করবি না। আমি সব জানি। সব বুঝি।
- হ্যাঁ, আমার সমঝদার ম্যাডাম এসেছেন। একদিন ঝগড়া হলো, তারপর দশদিন মুখ দেখাদেখি, কথা বলাবলি সব বন্ধ?
- তুইও তো ফোন করিসনি। আমার মেসেজের উত্তর দিসনি।
- ফাইনালি কল তো আমিই করলাম কাল। তুই তারপর কাঁদতে শুরু করে দিলি। আমি কোথায় যাই?
- ঝগড়া করবো তোর সাথে। জমিয়ে ঝগড়া করবো। অনেক অনেক পেন্ডিং আছে। প্রায়োরিটি লিস্টে আমি কেন এত নীচে, সেটা জানতে চাইতেই অমনি ওরকম করবি? কার না কার ওপর রাগ, তার গোঁসা আমার ওপর দেখবি? ইয়ার্কি না? ওইসব চলবে না।
- আচ্ছা। সরি।
- ইউ বেটার বি। কালকেই ঝগড়া করতাম। কিন্তু তার মধ্যে কেঁদে ফেলতাম অবধারিত। জানিসই তো, আই ক্রাই এট দ্য ড্রপ অফ আ হ্যাট।
- সে জানি।
- কাল ওরকম হলে অমনি ডাকওয়ার্থ লুইসের দোহাই দিয়ে আমি জিতেছি বলে অপবাদ দিতি।
- সে দিতাম। কিন্তু তুই বল, কী করে শিওর হলি যে তুইই জিততি?
- এখনো সন্দেহ আছে?
- তা আছে।
- হয়ে যাক তাহলে। এমনিও প্রচুর রাগ জমে আছে আমার। অনেক অনেক পয়েন্টস। লিখে রেখেছি।
- আপাতত শীতকাল। ওইসব তোলা থাক বরং। এখন না হয় একটু নলেন গুড়ের মতো মাখোমাখো প্রেম করি? ঝগড়াগুলো গ্রীষ্মের জন্য তোলা থাক? কেমন?
- হতভাগা। ঠিক সেই ম্যানেজ দিয়ে ফেলিস।
-হারকে জিতনে ওয়ালো কো বাজীগর কেহতে হ্যায়, গুরু বলে গেছেন! আমি হলাম তাই।
- ঢং যত্তসব।
- ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে চলেছিস, ফোন ধরে থেকে কী করবো? এখন আর জিও টু অন্য নেটওয়ার্ক ফ্রি নেই রে।
- তা বলে তুই ফোন ছেড়ে দিবি?
- আহা, ফোনই তো ছেড়েছি, তোকে তো আর না।
- একদম বাটারিং করবি না। আমি সব জানি। সব বুঝি।
- হ্যাঁ, আমার সমঝদার ম্যাডাম এসেছেন। একদিন ঝগড়া হলো, তারপর দশদিন মুখ দেখাদেখি, কথা বলাবলি সব বন্ধ?
- তুইও তো ফোন করিসনি। আমার মেসেজের উত্তর দিসনি।
- ফাইনালি কল তো আমিই করলাম কাল। তুই তারপর কাঁদতে শুরু করে দিলি। আমি কোথায় যাই?
- ঝগড়া করবো তোর সাথে। জমিয়ে ঝগড়া করবো। অনেক অনেক পেন্ডিং আছে। প্রায়োরিটি লিস্টে আমি কেন এত নীচে, সেটা জানতে চাইতেই অমনি ওরকম করবি? কার না কার ওপর রাগ, তার গোঁসা আমার ওপর দেখবি? ইয়ার্কি না? ওইসব চলবে না।
- আচ্ছা। সরি।
- ইউ বেটার বি। কালকেই ঝগড়া করতাম। কিন্তু তার মধ্যে কেঁদে ফেলতাম অবধারিত। জানিসই তো, আই ক্রাই এট দ্য ড্রপ অফ আ হ্যাট।
- সে জানি।
- কাল ওরকম হলে অমনি ডাকওয়ার্থ লুইসের দোহাই দিয়ে আমি জিতেছি বলে অপবাদ দিতি।
- সে দিতাম। কিন্তু তুই বল, কী করে শিওর হলি যে তুইই জিততি?
- এখনো সন্দেহ আছে?
- তা আছে।
- হয়ে যাক তাহলে। এমনিও প্রচুর রাগ জমে আছে আমার। অনেক অনেক পয়েন্টস। লিখে রেখেছি।
- আপাতত শীতকাল। ওইসব তোলা থাক বরং। এখন না হয় একটু নলেন গুড়ের মতো মাখোমাখো প্রেম করি? ঝগড়াগুলো গ্রীষ্মের জন্য তোলা থাক? কেমন?
- হতভাগা। ঠিক সেই ম্যানেজ দিয়ে ফেলিস।
-হারকে জিতনে ওয়ালো কো বাজীগর কেহতে হ্যায়, গুরু বলে গেছেন! আমি হলাম তাই।
- ঢং যত্তসব।
(শেষ)
#অগ্নি-রুমুন
#সীজন২
#সীজন২
Sunday, December 22, 2019
(৪)
হাতে কফির কাপ। উদাসিনী বেশে, বারান্দায় বসে। নিজের হাতে গড়া সবুজালির মধ্যে, একটু মনকে শান্ত করতে। ঠিক এমন সময় হাতে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। চেনা রিংটোনে। এতদিন পর। ফোনের ভাইব্রেশনের সাথে বুকের ধুকপুকানি রেসোনেট করছে। সত্যিই কি তাহলে অগ্নি ফোন করলো? কাঁপা কাঁপা হাতে সবুজ আইকনটা স্লাইড করলো রুমুন। বললো,
- হ্যালো?
- বলছি শোন, আমি কিন্তু খুব ভালো চিকেন মোমো আর থুপ্পা বানাতে পারি।
- কী?
- বলছি যে আমি মোমো আর থুপ্পাটা ভালোই রাঁধতে পারি।
- হঠাৎ?
- না মানে আজ ওলা শেয়ারে আসতে আসতে শুনলাম একজন আরেকজনকে ফোনে বলছে, তার খুব আক্ষেপ। তার বর রাঁধতে পারেনা কিছু। এমনকী চা পর্যন্ত পারে না। গরম জলে টিব্যাগ চুবিয়ে চা খায়!
- সো?
- সো, আই এম এশিউরিং ইউ। বিয়ের পর তোর কোনো সমস্যা হবে না। আমি তোকে দিব্যি রেঁধে বেড়ে খাওয়াতে পারবো। হয়তো হ্যাঁ, আমার মায়ের মতো ভালো পোলাউ বানাতে পারবো না, বা কাকিমার মতো চিতল পেটিও না। কিন্তু জ্বর হলে স্যুপ থুপ্পা সব যত্ন সহকারে রেঁধে খাওয়াতে পারবো। কাজেই, ইউ আর ইন গুড হ্যান্ডস।
-
- কীরে কিছু বল?
-
- কীরে রুমুন?
-
- ওমা, কাঁদছিস কেনো? ধুর পাগলী। এই, এই রুমুন...
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
আচ্ছা ধরুন আগামী দুইদিন আপনার প্রচন্ড কাজের চাপ, অসংখ্য ডেডলাইনসের পিছনে ছুটতে হবে। আপনি কী করবেন? নিশ্চয়ই সেইসব কাজকর্মই করবেন, তাই না? কিন্তু আমি? আমি হলাম সে যে তখন উশখুশ করবে, কখন কয়েক লাইন লিখে ফেলি। সে প্রেমের গল্প হোক বা মজার কিছু। রোজ কিছু না কিছু না লিখলে হজম হবে না।
আচ্ছা, রাস্তাঘাটে এমন কখনো হয়েছে যে আপনি কাউকে দেখে হাসলেন, কথা বললেন, খুব চেনাও লাগলো। কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারলেন না? আমি ঠিক ওই স্যাম্পল। এত বেশি বকি, এত বকি, এতজনের সাথে আলাপ, জাস্ট ট্র্যাক রাখতে পারিনা আর!
এই বকবকের সূত্রেই বলে রাখি বাপু, বন্ধুমহলে agony aunt হিসেবেও কিন্তু খুব খ্যাতি। আবার প্রচুর পজিটিভ ভাইবস ছড়াতেও এক্সপার্ট। বেসিকালি, প্রিয় রঙ হলুদের মতোই আমিও সব সময় ঝকঝকে, হাসিখুশি প্রাণবন্ত থাকতে ভালোবাসি।
এই তো, অনেক বললাম। আর বাকিটা চিনতে হলে, আলাপ বাঞ্ছনীয়। কী, হবে নাকি একসাথে এক কাপ কফি?
আচ্ছা, রাস্তাঘাটে এমন কখনো হয়েছে যে আপনি কাউকে দেখে হাসলেন, কথা বললেন, খুব চেনাও লাগলো। কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারলেন না? আমি ঠিক ওই স্যাম্পল। এত বেশি বকি, এত বকি, এতজনের সাথে আলাপ, জাস্ট ট্র্যাক রাখতে পারিনা আর!
এই বকবকের সূত্রেই বলে রাখি বাপু, বন্ধুমহলে agony aunt হিসেবেও কিন্তু খুব খ্যাতি। আবার প্রচুর পজিটিভ ভাইবস ছড়াতেও এক্সপার্ট। বেসিকালি, প্রিয় রঙ হলুদের মতোই আমিও সব সময় ঝকঝকে, হাসিখুশি প্রাণবন্ত থাকতে ভালোবাসি।
এই তো, অনেক বললাম। আর বাকিটা চিনতে হলে, আলাপ বাঞ্ছনীয়। কী, হবে নাকি একসাথে এক কাপ কফি?
Friday, December 20, 2019
3
মায়ের শাড়ি শাল ধার করে বিয়েবাড়ির সাজগোজ সম্পূর্ণ করলো রুমুন। আজ ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী, কস্তুরীর রিসেপশন। মা বাবারও নেমন্তন্ন রয়েছে, তবে ওঁরা যাচ্ছেন না। মাকে সাজটা দেখাতে গেলো রুমুন। অবশ্য মায়ের যে কী রিঅ্যাকশন হবে, সেটা মোটামুটি ও জানতো। মায়ের মুখ গম্ভীর। বক্তব্য এই যে, সব্বাই দিব্যি বিয়ে করে থিতু হয়ে যাচ্ছে। ও কবে করবে। মা বাবাকে এখনও পুরো ব্যাপারটা ভালো করে বলেইনি রুমুন। তাই ওঁরাও দ্বিধায়, দ্বন্দ্বে। অবশ্য, বলবেই বা কী? ও কি নিজেই আদৌ জানে? অগ্নির সাথে সম্পর্কটা এখন কোথায় গিয়ে যে দাঁড়িয়েছে...
বিয়েবাড়িতে ভারী মজা হলো। বরপক্ষের বেশ কিছু নিমন্ত্রিতদের সাথে বিয়ের দিনেই আলাপ হয়েছিল রুমুনের। বিশেষ করে বাসর রাত জাগার সময় সবাই মিলে দারুণ আনন্দ করেছিল। আজ বৌভাতের অনুষ্ঠানেও সেই আলাপ ঝালিয়ে নিয়েছিল রুমুন আর ওর বাকি বান্ধবীরা। তাই সন্ধ্যের অনুষ্ঠানেও খাতির যত্ন আলাপ আড্ডা কোনটারই অভাব হলো না। বরের বন্ধুদের মধ্যে সঙ্কল্প বলে ছেলেটি, ডাক্তার, বেশ মিশুকে। তার সাথে রুমুনের ভালোই বন্ধুত্বপূর্ণ খুনসুটি চলেছে। বাসরের রাতে গান বাজনাও ভালোই হয়েছে। রিসেপশনে দেখা হতেই এক গাল হাসি। "বাঃ, তোমাকে তো বেশ লাগছে দেখতে!" রুমুন একটু ব্লাশ করেই ধন্যবাদ জানায়। বান্ধবীরা কিন্তু কেউ মিস করেনি এই কথা। সারা সন্ধ্যে তারা লক্ষ্য করে গেলো, সঙ্কল্প যেন রুমুনের চারিদিকেই থাকার সঙ্কল্প নিয়েছে। কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। সারাক্ষণ ওদের সাথেই রইলো। একসাথে ছবি টবিও উঠলো। হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ারও হলো, স্টেটাসও হলো।
ফিরতি পথে রুমুন আর ঋত্বিকা একটা ওলা ধরলো। ঋত্বিকা জমিয়ে রুমুনের পিছনে লাগতে থাকল। "কী রে, তাহলে সঙ্কল্প?"
রুমুন একবার তাকায় বান্ধবীর দিকে, কিছু বলেনা। কিন্তু বান্ধবী, সেই কোন ছোট্টবেলার। মুখ চোখ দেখেই বুঝে যায় সব। বলে, "এখনও মিটলো না তোদের?" রুমুন মাথা নাড়ে উত্তরে। ঋত্বিকা প্রশ্ন করে, "তোদের হলো টা কী?" রুমুন বলে, "জানি না রে। আই অ্যাম স্টিল সারচিং ফর অ্যান আনসার।" ঋত্বিকা কথা বাড়ায় না। শুধু বন্ধুর হাতটা স্নেহের পরশে চেপে ভরসা জোগায়। ওর বাড়ি এসে গেলে, ও নেমে পড়ে। রুমুন চলতে থাকে ক্যাবে।
ক্যাবে তখন বাজছে
"Kaisi Teri Khudgarzi
Na Dhoop Chune Na Chhaaon
Kaisi Teri Khudgarzi
Kisi Thor Tike Na Paaon...
Ban Liya Apna Paigambar
Tar Liya Tu Saat Samandar
Phir Bhi Sookha Mann Ke Andar
Kyun Reh Gaya
Re Kabira Maan Jaa
Re Faqeera Maan Jaa
Aaja Tujhko Pukaare Teri Parchhaaiyan
Re Kabira Maan Ja..."
একবার ফোনটা হাতে বের করে। হোয়াটসঅ্যাপে খোলে অগ্নির চ্যাটটা। মেসেজ করবে? কী লিখবে?
বোঝে না। আবার ফোন বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দেয়।
****************
অগ্নি প্রতিদিনের মতো চ্যাট উইন্ডো দেখে। রুমুন অনলাইন। অপেক্ষায় থাকে মেসেজের। আসে না...
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
Thursday, December 19, 2019
(২)
"কীরে, চুপ করে বসে কেন? ফোনের অপেক্ষা নাকি?" বন্ধু অমৃতর ডাকে অগ্নি পিছন ফিরে তাকালো। মাথা নেড়ে না বললো ও। ফোন? কেই বা করবে? বাবা মা জানে ওরা এখন পার্টি করছে। আজকের মত কথা হয়ে গিয়েছে। আর করবে না। অফিসের কলও নেই। উইকেন্ড মোডে সকলে। কেই বা আর করবে ওকে ফোন?
কোরমঙ্গলায় অমৃতর ব্যাচেলর্স প্যাডে আজ ওদের পাঁচ বন্ধুর গেট টুগেদার। অমৃত, অগ্নি, শুভঙ্কর, পল্লব আর সম্রাট। সেই স্কুলবেলার বন্ধু। আজ কর্মসূত্রে একেক শহরে একেকজন। অনেকদিন পর ওরা পঞ্চ পাণ্ডব এক হয়েছে। উদ্দেশ্য তাই আজ সারা রাত জেগে চুটিয়ে গল্প, আড্ডা। অমৃতই সমস্ত আয়োজন করেছে। সকাল থেকে ফ্ল্যাটটা সাজিয়েছে আলো দিয়ে। খাবার দাবার আনানো হয়েছে। পানীয়ও রয়েছে। গল্পের ফোয়ারা বইছে। স্পিকারে বেজে চলেছে পরপর কিছু রেট্রো গান। কিশোর আশা লতা রফি মান্না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে উইস্কির গ্লাস হাতে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়েছিল অগ্নি। দূরে ব্যাঙ্গালোর শহরের ঝাঁ চকচকে রাস্তা, স্ট্রিট লাইট, ঝড়ের বেগে ছুটে চলা গাড়ি। এমন সময়ে কানে এলো, আশা ভোঁসলে গাইছেন,
"তু রুঠা তো ম্যায় রো দুঙ্গি সনম
আজা মেরে, বাহো মে আ।।"
মুহূর্তে একটা পরিচিত কণ্ঠের কাতর অনুনয় মাখা হোয়াটসআপ ভয়েস নোট মনে পড়ে গেলো। ফোনে ঢুকেছিলো গত সপ্তাহে। হ্যাঁ। ঠিক গত বৃহস্পতিবার, রাত দশটা পঁচিশে। যেই মেসেজটি রোজ কম করে অন্তত দশবার শোনে ও। অথচ, মেসেজের রিপ্লাই দেয়নি।
"কীরে অগ্নি, ভিতরে আসবি না? বাইরে কেন? আয়।"
এইবারে আর সম্রাটের ডাককে অগ্রাহ্য করেনা অগ্নি। হাতের মুঠো থেকে ফোনটা পকেটে ভরে রেখে ঘরে ঢোকে। হোয়াটসআপটা খোলাই থেকে যায়।
কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে বসে রুমুন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে চ্যাট উইন্ডোতে। 'অনলাইন'। কিন্তু 'টাইপিং' আসে না।
#রুমুন_অগ্নি
#সিজন২
1
ট্যাক্সিতে উঠে সশব্দে দরজা বন্ধ করে রুমুন বললো, "চলুন দাদা।" গাড়িতে এফ এম চলছে। রেট্রো গান। কিন্তু রুমুনের এখন সেইসব দিকে কান যাচ্ছে না। টানা আটচল্লিশ ঘন্টা অফিসে কাজ করে ও বিধ্বস্ত। কাল ক্লায়েন্ট মিটিং, এদিকে এখনো টীম প্রেজেন্টেশন নিয়ে তৈরি না। রুমুন ওদের ফোনে সাপোর্ট দেবে এই আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফিরছে। ওর ক্লান্ত শরীরে আর দিচ্ছেনা। এরই মধ্যে অবিনাশের ফোন এলো। রুমুন যথাসাধ্য নির্দেশ দিলো ওকে। এরপর ফোনটা ছেড়ে জানলার কাঁচে মাথাটা এলিয়ে দিলো ও। আড়চোখে দেখতে পেলো শহরের রাস্তা। গভীর রাত। শুনশান রাজপথ। একটা দুটো গাড়ি সোঁ সোঁ করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। হলুদ নিয়নের আলোর আলাদা মাদকতা। রুমুন ট্যাক্সির সীটে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে।
এতক্ষণে কানে ঢোকে এফ এম স্টেশনের গান।
"hum Ko Mili Hai Aaj
ye Ghadiya Naseeb Se
jee Bhar Ke Dekh Leejiye
humko Kareeb Se
phir Apke Naseeb Mein
ye Baat Ho Na Ho
shayad phir Is Janaam Mein
mulakaat Ho Na Ho"
বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে একটা মুখ। বহু পরিচিত, বড় আপন, বড্ড কাছের সেই জন। কতদিন দেখেনি সেই মানুষটাকে, মনে পড়ে যায় রুমুনের। দু চোখ ভরে আসে জলে।
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
ট্যাক্সিতে উঠে সশব্দে দরজা বন্ধ করে রুমুন বললো, "চলুন দাদা।" গাড়িতে এফ এম চলছে। রেট্রো গান। কিন্তু রুমুনের এখন সেইসব দিকে কান যাচ্ছে না। টানা আটচল্লিশ ঘন্টা অফিসে কাজ করে ও বিধ্বস্ত। কাল ক্লায়েন্ট মিটিং, এদিকে এখনো টীম প্রেজেন্টেশন নিয়ে তৈরি না। রুমুন ওদের ফোনে সাপোর্ট দেবে এই আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফিরছে। ওর ক্লান্ত শরীরে আর দিচ্ছেনা। এরই মধ্যে অবিনাশের ফোন এলো। রুমুন যথাসাধ্য নির্দেশ দিলো ওকে। এরপর ফোনটা ছেড়ে জানলার কাঁচে মাথাটা এলিয়ে দিলো ও। আড়চোখে দেখতে পেলো শহরের রাস্তা। গভীর রাত। শুনশান রাজপথ। একটা দুটো গাড়ি সোঁ সোঁ করে পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। হলুদ নিয়নের আলোর আলাদা মাদকতা। রুমুন ট্যাক্সির সীটে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে।
এতক্ষণে কানে ঢোকে এফ এম স্টেশনের গান।
"hum Ko Mili Hai Aaj
ye Ghadiya Naseeb Se
jee Bhar Ke Dekh Leejiye
humko Kareeb Se
phir Apke Naseeb Mein
ye Baat Ho Na Ho
shayad phir Is Janaam Mein
mulakaat Ho Na Ho"
বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে একটা মুখ। বহু পরিচিত, বড় আপন, বড্ড কাছের সেই জন। কতদিন দেখেনি সেই মানুষটাকে, মনে পড়ে যায় রুমুনের। দু চোখ ভরে আসে জলে।
#রুমুন_অগ্নি
#সীজন২
Monday, December 16, 2019
চুরমুর
বেশ একটা ফুরফুরে মন নিয়েই রুমুন বেরিয়েছিল বিকেলে। উদ্দেশ্য একটাই, একটু সেন্ট্রাল পার্কে কয়েক চক্কর কেটে তারপর ফুচকাওয়ালার সামনে ভিড় ঠেলে কুড়ি টাকার চুরমুর কিনে বাড়ি ফেরা। বাড়িতে সদ্য লাইব্রেরি থেকে আনা শঙ্কু সমগ্র পড়তে পড়তে জমিয়ে চা সহযোগে সান্ধ্য আহার হয়ে যাবে। ভাবতেই জিভে জল এসে যায় রুমুনের।
গেট থেকে বেরোতেই এক প্রৌঢ় ব্যক্তি ও সাথে খুব সম্ভবত তাঁর স্ত্রীর মুখোমুখি। ভদ্রলোকের পরনে অতি সাধারণ ফতুয়া পাজামা, গায়ে ওই মলিন খয়েরিই বোধহয়, চাদর। চুল একটু কোঁকড়া, উস্কোখুস্কো না হলেও, যত্নের ছাপ স্পষ্ট। সাথে ভদ্রমহিলার পরনে ডুরে শাড়ি, গায়ে তেমনই এক জীর্ণ চাদর। ক্ষণিকের ইতস্ততা কাতিয়ে মলিন হাসিমুখে রুমুনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "মা, আপনি কি এই এখানেই থাকেন?" রুমুন ভাবল, হয়তো কোন বাড়ির নির্দেশিকা খুঁজছেন। ও ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ভদ্রমহিলা এবার একটু সাহস করেই এগিয়ে এসে বললেন, "একটু ওষুধ দিয়ে সাহায্য করবেন মা?" রুমুন এবারে অবাক হয়েই ওঁকে জরিপ করে। কোনো চোট আঘাত নাকি? হয়তো ব্যান্ড এড ডেটল জাতীয় কিছু চাইবেন। ও বলে, "বলুন।" ভদ্রলোক এবার এগিয়ে এসে বললেন, "আসলে গত ছয় মাস ধরে আমার চাকরি নেই। আমার স্ত্রী, সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট। তাই..." ভদ্রমহিলা বললেন কাতর কন্ঠে, "একশোটা টাকা দিলেও হবে। একটু সাহায্য করলে... আমার ওষুধ... আপনি কাছেই থাকেন কি? তাহলে যদি এনে দেন।"
রুমুন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। না বলতে পারে না। আবার যা দিনকাল, কাকে কতটা কী বিশ্বাস করবে, বুঝে ওঠে না। ওয়ালেটে কড়কড়ে তিনটে পাঁচশো আর বেশ কয়েকটা একশোর নোট থাকলেও বের করতে দ্বিধা হয়। মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। ওঁরা পিছন থেকে কিছু বলতে থাকেন, আশায়... রুমুন হয়তো মত বদলাবে। রুমুন এগিয়ে যায়। ও জানে, এইসব পরিস্থিতে পিছনে ফিরে তাকাতে নেই। ক্ষণিকের জন্য হলেও হাতের টিফিন বাক্সটা একটু ভারী লাগে। তবুও এগিয়ে যায় ও।
ফুচকাওয়ালার সামনে আলু সিদ্ধ, পিঁয়াজ লঙ্কা কুঁচি, তেঁতুল জলের আলাদা সুগন্ধ। সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেটে যায় ও। "দিন তো, কুড়িটা টাকার চুরমুর" বলে এগিয়ে দেয় টিফিন বাক্স। চুরমুর তৈরি হয়। রুমুন বাড়ি ফেরে। প্রফেসর শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষা করে আছে। ভালোই কাটবে সন্ধ্যেটা। একটাই আফশোস, পার্কে কয়েক রাউন্ড হাঁটা হলো না।
রুমুন আজ যথার্থই নাগরিক।
গেট থেকে বেরোতেই এক প্রৌঢ় ব্যক্তি ও সাথে খুব সম্ভবত তাঁর স্ত্রীর মুখোমুখি। ভদ্রলোকের পরনে অতি সাধারণ ফতুয়া পাজামা, গায়ে ওই মলিন খয়েরিই বোধহয়, চাদর। চুল একটু কোঁকড়া, উস্কোখুস্কো না হলেও, যত্নের ছাপ স্পষ্ট। সাথে ভদ্রমহিলার পরনে ডুরে শাড়ি, গায়ে তেমনই এক জীর্ণ চাদর। ক্ষণিকের ইতস্ততা কাতিয়ে মলিন হাসিমুখে রুমুনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "মা, আপনি কি এই এখানেই থাকেন?" রুমুন ভাবল, হয়তো কোন বাড়ির নির্দেশিকা খুঁজছেন। ও ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। ভদ্রমহিলা এবার একটু সাহস করেই এগিয়ে এসে বললেন, "একটু ওষুধ দিয়ে সাহায্য করবেন মা?" রুমুন এবারে অবাক হয়েই ওঁকে জরিপ করে। কোনো চোট আঘাত নাকি? হয়তো ব্যান্ড এড ডেটল জাতীয় কিছু চাইবেন। ও বলে, "বলুন।" ভদ্রলোক এবার এগিয়ে এসে বললেন, "আসলে গত ছয় মাস ধরে আমার চাকরি নেই। আমার স্ত্রী, সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট। তাই..." ভদ্রমহিলা বললেন কাতর কন্ঠে, "একশোটা টাকা দিলেও হবে। একটু সাহায্য করলে... আমার ওষুধ... আপনি কাছেই থাকেন কি? তাহলে যদি এনে দেন।"
রুমুন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। না বলতে পারে না। আবার যা দিনকাল, কাকে কতটা কী বিশ্বাস করবে, বুঝে ওঠে না। ওয়ালেটে কড়কড়ে তিনটে পাঁচশো আর বেশ কয়েকটা একশোর নোট থাকলেও বের করতে দ্বিধা হয়। মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। ওঁরা পিছন থেকে কিছু বলতে থাকেন, আশায়... রুমুন হয়তো মত বদলাবে। রুমুন এগিয়ে যায়। ও জানে, এইসব পরিস্থিতে পিছনে ফিরে তাকাতে নেই। ক্ষণিকের জন্য হলেও হাতের টিফিন বাক্সটা একটু ভারী লাগে। তবুও এগিয়ে যায় ও।
ফুচকাওয়ালার সামনে আলু সিদ্ধ, পিঁয়াজ লঙ্কা কুঁচি, তেঁতুল জলের আলাদা সুগন্ধ। সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেটে যায় ও। "দিন তো, কুড়িটা টাকার চুরমুর" বলে এগিয়ে দেয় টিফিন বাক্স। চুরমুর তৈরি হয়। রুমুন বাড়ি ফেরে। প্রফেসর শঙ্কুর অ্যাডভেঞ্চার অপেক্ষা করে আছে। ভালোই কাটবে সন্ধ্যেটা। একটাই আফশোস, পার্কে কয়েক রাউন্ড হাঁটা হলো না।
রুমুন আজ যথার্থই নাগরিক।
Saturday, December 14, 2019
পার্ক
হাঁপানির কষ্টটা শীতকালে ভীষণ জ্বালায়। তাই মর্নিং ওয়াকে প্রতিমা বেরোন একটু বেলা করেই। তা প্রায় আটটা বেজেই যায়। ততক্ষণে অবশ্য সেন্ট্রাল পার্কের বাকি মর্নিং ওয়াকারের দল প্রায় সবাই ফিরে যান, বা ফেরার পথে। প্রতিমা রিটায়ার্ড। পার্ক লাগোয়া ফ্ল্যাটে একা থাকেন। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি বৌমা জামাই প্রত্যেকেই দেশে বিদেশে যে যার মতো আছে, প্রতিমার এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা। মর্নিং ওয়াকে এসে কিছু বন্ধু বান্ধবী জুটিয়ে ফেলেছেন। তাঁরাও প্রায় ওঁরই মতোই। ঝাড়া হাত পা। হোয়াটসআপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানেই রোজ লেখালিখি চলে। সময় মিলিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রত্যেকেই। একইসাথে হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম চলে। তারপর খানিকক্ষণ বসে গল্প। এরপর আস্তে আস্তে টুকটুক করে যে যার নিজের নিজের ডেরায় ফেরা।
আজ অবশ্য প্রতিমা আর শ্যমলবাবু ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ বেড়াতে গিয়েছে, কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, ছেলে মেয়েদের কাছে। আবার কয়েকজন অসুস্থ। শীতকালের সিজন চেঞ্জে কাবু। শ্যমলবাবু ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। প্রতিমাও ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কাজেই দুজনের কথার বিষয়ের অভাব কখনোই হয় না। এমন কি, দুজনেরই বেশ ভালোই লাগে একে অপরের উপস্থিতি। বাকিদের চেয়ে একটু বেশিই যেন একে অপরের সাথে কথা বলতে মনের খোরাক পায়। সাম্প্রতিক বাজারের পিঁয়াজের মহার্ঘ্য অবস্থার কথাই আলোচনা করছিলেন দুজনে, হাতে মাটির ভাঁড়ে গরম চা। পার্কের চার পাক হেঁটে এই চা যেন বড়ই আরামের। আয়েশ করে চায়ের ভাঁড়ে এক চুমুক দিয়ে সবে শ্যমলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় প্রতিমা হাত তুলে ইশারায় ওঁকে থামতে বললেন। শ্যমলবাবু একটু অবাক। কী হলো, জানতে চাইলেন। প্রতিমা ওঁকে চুপ করে বসে একটু কান পাততে বললেন। শ্যামলবাবু এবার কান খাড়া করলেন। এবং তারপরেই শুনতে পেলেন। ওঁদের বসার জায়গা থেকে একটু দূরেই বসে আছে এক যুবক যুবতী। দেখে মনে হয় সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। পরনে ওই জিন্স টিশার্ট আর জ্যাকেট। পিঠে ব্যাকপ্যাক। একটু উত্তেজিত দুজনেই, তাই কথাবার্তা চলছে উচ্চস্বরেই।
- শোন, এই লাস্ট মোমেন্টে এসে এরকম কিন্তু কিন্তু করলে কী করে হবে?
- না মানে...
- না মানে কী?
- ভয় করছে।
- ভয়? কীসের ভয়?
- বাড়ির থেকে যদি জানতে পারে..
- জানলে জানবে।
- জানলে জানবে আবার কী?
- মানেটা খুব সিম্পল। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। আমরা দুইজনেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আমাদের ভালো মন্দ নিয়ে। কাজেই আমরা যদি মনে করি আমরা একসাথে কোথাও বেড়াতে যাবো, এতে কীসের যে এত ভয় পাচ্ছ তুমি, আমি জাস্ট বুঝছি না।
- আরে, বাড়িতে নাইটস্টের কথা বলবো কী করে?
- কী আবার, বলবি ক্লাসের পিকনিক। তাজপুর। আমি বলবো কিছু বন্ধুদের কথা। সিম্পল। ওরা জানবে আমরা তাজপুর যাচ্ছি। সেটা সত্যিই। কিন্তু কার সাথে, সেটা জাস্ট চেপে যাবো। তাহলেই হলো। ওরা তো কেউ গোয়েন্দা লাগাতে যাবে না রে বাবা
- তুমি জানো না। আমার বাবা খুব স্ট্রিক্ট।
- ডি ডি এল জের অমৃশ পুরীর মতো?
- কয়েক ধাপ বেশি।
- তাহলে তো আরো ভালো। বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। (সুর করে) লে জায়েঙ্গে লে জায়েঙ্গে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।
- তুমি সবেতেই বড্ড ইয়ার্কি করো।
- আর তুই সবেতেই এক্সট্রা টেনশন নিয়ে নিস।
- কী করবো। ছোট থেকে বাড়িতে যেরকম ভাবে বড় হয়েছি...
- ওই হলো, গেল আমাদের যাওয়া। এত কষ্ট করে সব প্ল্যান করলাম। তুই ভেস্তে দিলি।
- সরি। কিন্তু সত্যি বলছি। আমিই তাল তুলেছিলাম বটে। কিন্তু, দেখো, বাড়িতে পারমিশন পাবো না। উল্টে এর পরে বেরোতে গেলে হয়তো সন্দেহ করে নজরদারি শুরু হবে। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক...
- মানে এই কলেজের নামে এই পার্ক ওই মল?
- হুম। আপাতত। তারপর তুমি আর আমি দুজনে নিজের পায়ে দাঁড়াই। ব্যস। একদম নির্ভয়ে বাড়িতে বলে বুক ফুলিয়ে বেরোতে পারবো।
- বেশ। তাহলে নিউ সী হক ক্যানসেল। চলো, অন্তত সাগরদ্বীপে যকের ধন দেখি। দেখি, কটার শো।
- চলো, যাওয়া যাক।
প্রতিমা আর শ্যামল লক্ষ্য করে, এই দুই যুবক যুবতী কিঞ্চিৎ বিমর্ষচিত্তে এগিয়ে যায়। শ্যামল প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বলেন, "কী বুঝলেন?"
প্রতিমা হেসে উত্তর দেয়, "কড়া বাপ মা যুগে যুগে প্রেমে ভিলেন হয়েই রইলো। আর কী!"
শ্যামল আর প্রতিমা দুজনেই হো হো করে হাসে খানিকক্ষণ। তারপর হাসির দমক একটু কম হতে শ্যমলবাবু প্রতিমার দিকে ফিরে বেশ একটা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললেন, "তা, আমাদের দুজনেরই জীবনে ভিলেন বলতে কেউ নেই। আমাদেরও ভিলেনের পার্ট প্লে করা হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন তা হলে সী হকে যাবো নাকি? মালিকের একটা বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেল। ভাবলেও খারাপ লাগে।" মিথ্যে কাঁচুমাচু মুখ করে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়? ফিক করে হেসে ফেললেন। প্রতিমাও কপট রাগ পুষে না রেখে হেসে উত্তর দিলেন, "ও, পেটে পেটে এতদূর? তা চলুন। ঘুরেই আসি।"
হাঁপানির কষ্টটা শীতকালে ভীষণ জ্বালায়। তাই মর্নিং ওয়াকে প্রতিমা বেরোন একটু বেলা করেই। তা প্রায় আটটা বেজেই যায়। ততক্ষণে অবশ্য সেন্ট্রাল পার্কের বাকি মর্নিং ওয়াকারের দল প্রায় সবাই ফিরে যান, বা ফেরার পথে। প্রতিমা রিটায়ার্ড। পার্ক লাগোয়া ফ্ল্যাটে একা থাকেন। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি বৌমা জামাই প্রত্যেকেই দেশে বিদেশে যে যার মতো আছে, প্রতিমার এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা। মর্নিং ওয়াকে এসে কিছু বন্ধু বান্ধবী জুটিয়ে ফেলেছেন। তাঁরাও প্রায় ওঁরই মতোই। ঝাড়া হাত পা। হোয়াটসআপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানেই রোজ লেখালিখি চলে। সময় মিলিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রত্যেকেই। একইসাথে হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম চলে। তারপর খানিকক্ষণ বসে গল্প। এরপর আস্তে আস্তে টুকটুক করে যে যার নিজের নিজের ডেরায় ফেরা।
আজ অবশ্য প্রতিমা আর শ্যমলবাবু ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ বেড়াতে গিয়েছে, কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, ছেলে মেয়েদের কাছে। আবার কয়েকজন অসুস্থ। শীতকালের সিজন চেঞ্জে কাবু। শ্যমলবাবু ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। প্রতিমাও ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কাজেই দুজনের কথার বিষয়ের অভাব কখনোই হয় না। এমন কি, দুজনেরই বেশ ভালোই লাগে একে অপরের উপস্থিতি। বাকিদের চেয়ে একটু বেশিই যেন একে অপরের সাথে কথা বলতে মনের খোরাক পায়। সাম্প্রতিক বাজারের পিঁয়াজের মহার্ঘ্য অবস্থার কথাই আলোচনা করছিলেন দুজনে, হাতে মাটির ভাঁড়ে গরম চা। পার্কের চার পাক হেঁটে এই চা যেন বড়ই আরামের। আয়েশ করে চায়ের ভাঁড়ে এক চুমুক দিয়ে সবে শ্যমলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় প্রতিমা হাত তুলে ইশারায় ওঁকে থামতে বললেন। শ্যমলবাবু একটু অবাক। কী হলো, জানতে চাইলেন। প্রতিমা ওঁকে চুপ করে বসে একটু কান পাততে বললেন। শ্যামলবাবু এবার কান খাড়া করলেন। এবং তারপরেই শুনতে পেলেন। ওঁদের বসার জায়গা থেকে একটু দূরেই বসে আছে এক যুবক যুবতী। দেখে মনে হয় সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। পরনে ওই জিন্স টিশার্ট আর জ্যাকেট। পিঠে ব্যাকপ্যাক। একটু উত্তেজিত দুজনেই, তাই কথাবার্তা চলছে উচ্চস্বরেই।
- শোন, এই লাস্ট মোমেন্টে এসে এরকম কিন্তু কিন্তু করলে কী করে হবে?
- না মানে...
- না মানে কী?
- ভয় করছে।
- ভয়? কীসের ভয়?
- বাড়ির থেকে যদি জানতে পারে..
- জানলে জানবে।
- জানলে জানবে আবার কী?
- মানেটা খুব সিম্পল। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। আমরা দুইজনেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আমাদের ভালো মন্দ নিয়ে। কাজেই আমরা যদি মনে করি আমরা একসাথে কোথাও বেড়াতে যাবো, এতে কীসের যে এত ভয় পাচ্ছ তুমি, আমি জাস্ট বুঝছি না।
- আরে, বাড়িতে নাইটস্টের কথা বলবো কী করে?
- কী আবার, বলবি ক্লাসের পিকনিক। তাজপুর। আমি বলবো কিছু বন্ধুদের কথা। সিম্পল। ওরা জানবে আমরা তাজপুর যাচ্ছি। সেটা সত্যিই। কিন্তু কার সাথে, সেটা জাস্ট চেপে যাবো। তাহলেই হলো। ওরা তো কেউ গোয়েন্দা লাগাতে যাবে না রে বাবা
- তুমি জানো না। আমার বাবা খুব স্ট্রিক্ট।
- ডি ডি এল জের অমৃশ পুরীর মতো?
- কয়েক ধাপ বেশি।
- তাহলে তো আরো ভালো। বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। (সুর করে) লে জায়েঙ্গে লে জায়েঙ্গে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।
- তুমি সবেতেই বড্ড ইয়ার্কি করো।
- আর তুই সবেতেই এক্সট্রা টেনশন নিয়ে নিস।
- কী করবো। ছোট থেকে বাড়িতে যেরকম ভাবে বড় হয়েছি...
- ওই হলো, গেল আমাদের যাওয়া। এত কষ্ট করে সব প্ল্যান করলাম। তুই ভেস্তে দিলি।
- সরি। কিন্তু সত্যি বলছি। আমিই তাল তুলেছিলাম বটে। কিন্তু, দেখো, বাড়িতে পারমিশন পাবো না। উল্টে এর পরে বেরোতে গেলে হয়তো সন্দেহ করে নজরদারি শুরু হবে। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক...
- মানে এই কলেজের নামে এই পার্ক ওই মল?
- হুম। আপাতত। তারপর তুমি আর আমি দুজনে নিজের পায়ে দাঁড়াই। ব্যস। একদম নির্ভয়ে বাড়িতে বলে বুক ফুলিয়ে বেরোতে পারবো।
- বেশ। তাহলে নিউ সী হক ক্যানসেল। চলো, অন্তত সাগরদ্বীপে যকের ধন দেখি। দেখি, কটার শো।
- চলো, যাওয়া যাক।
প্রতিমা আর শ্যামল লক্ষ্য করে, এই দুই যুবক যুবতী কিঞ্চিৎ বিমর্ষচিত্তে এগিয়ে যায়। শ্যামল প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বলেন, "কী বুঝলেন?"
প্রতিমা হেসে উত্তর দেয়, "কড়া বাপ মা যুগে যুগে প্রেমে ভিলেন হয়েই রইলো। আর কী!"
শ্যামল আর প্রতিমা দুজনেই হো হো করে হাসে খানিকক্ষণ। তারপর হাসির দমক একটু কম হতে শ্যমলবাবু প্রতিমার দিকে ফিরে বেশ একটা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললেন, "তা, আমাদের দুজনেরই জীবনে ভিলেন বলতে কেউ নেই। আমাদেরও ভিলেনের পার্ট প্লে করা হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন তা হলে সী হকে যাবো নাকি? মালিকের একটা বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেল। ভাবলেও খারাপ লাগে।" মিথ্যে কাঁচুমাচু মুখ করে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়? ফিক করে হেসে ফেললেন। প্রতিমাও কপট রাগ পুষে না রেখে হেসে উত্তর দিলেন, "ও, পেটে পেটে এতদূর? তা চলুন। ঘুরেই আসি।"
Wednesday, December 11, 2019
মডার্ন পেরেন্টিং (৩)
সুচেতনা
কে জানে কী মনে হতে স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটা খুলল রিমঝিম। স্কুল বলতে, মেয়ে রুনির স্কুলের। রুনির সবে ক্লাস ওয়ান। বাড়ির কাছেই নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বম্বেতে এটাই নিয়ম। স্কুল হতে হবে বাড়ির কাছাকাছি। এই জিনিসটা রিমঝিমের ভারী পছন্দ। কলকাতায় থাকতে নিজের বন্ধুদের তো কত দেখেছে, সেই দমদম, সল্ট লেক থেকে যাদবপুর আসতো নামী স্কুলে পড়বে বলে, বা সেই বেহালা থেকে আসতে হতো বালিগঞ্জ। কম কষ্ট নাকি বাচ্চাদের? এখন দিনকাল কত পালটে গিয়েছে। আগে যেমন ওই স্কুলের বাইরে ভিড় করে থাকা বাবা মায়েরা, বিশেষ করে মায়েরা জটলা পাকিয়ে স্কুলের শেষে হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার সিলেবাস, টিউশন ক্লাসের হদিস পেতো, এখন সেইসব হয় ভার্চ্যুয়ালি। whatsapp গ্রুপে চ্যাটে। রিমঝিম দেখলো, আজ নাকি অনেকের ডায়েরিতে নোটিস পড়েছে। পেরেন্টস কল। কে জানে, রুনিরও হলো কি না। বাড়ি ফিরে দেখতে হবে। যা দস্যি মেয়ে।
দস্যি বটে, তবে একদিক দিয়ে রিমঝিম মনে মনে মেয়েকে নিয়ে খুব খুশি। স্কুলে ইতিমধ্যেই গুড টাচ ব্যাড টাচ নিয়ে শিখিয়ে তো দিয়েছে। মা হিসেবেও রিমঝিম ওর দায়িত্ব পালন করেছে। নিজে একটা ছুটির দিনে বসে ভালো করে যত্ন সহকারে মেয়েকে ভালো মন্দ বলেছে। আর সাথে এটাও বলেছে, কেউ কখনো "হার্ট" করতে গেলেই তাইকন্ডো ক্লাসে শেখা কয়েকটা ডেমো দিয়ে দিতে। তাহলে আর সহজে ঘাঁটতে পারবে না। রুনি কিন্তু মায়ের বাধ্য মেয়ে। স্কুলে এরপর বার দুইয়েক স্পোর্টস চলাকালীন ক্লাসের কিছু দুষ্টু ছেলে ওর পিছনে লাগছিলো, দিয়েছে দুই ঘা। রিমঝিম মনে মনে বেশ প্রাউড ফিল করে। যেমন দিন পড়েছে, তেমন করেই মানুষ করতে হবে।
বাড়ি ফিরে রিমঝিম অবাক। মানতুদির কাছে শুনলো, রুনি নীচে খেলতে যায়নি। স্কুল থেকে ফিরেছে বেশ চুপচাপ। খাওয়া নিয়ে রোজের মতো একটুও ঝামেলা পাকায়নি। খুঁটে খুঁটে অল্প একটু খেয়ে উঠে গিয়েছে। টিভিও চালায়নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রিমঝিম শুনে বেশ চিন্তিত হলো। কী ব্যাপার, মেয়ের এরকম আমূল পরিবর্তন কেন? জানতে ওকে হবেই। ও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট রুনির ঘরে গেল। মেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোলবালিশ আঁকড়ে শুয়ে। গাল বেয়ে চোখের জল, শুকিয়ে দাগ হয়ে গিয়েছে। আহা রে, মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কী হলো? রিমঝিম একটু ভয় পায়। দিনকাল এত খারাপ। শিউরে ওঠে। রুনির কোনো ক্ষতি হলো না তো? সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতে হয়।
রিমঝিম স্নেহের বশে মেয়েকে জাপ্টে ওর পাশে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বোলাতে থাকে। মেয়ের ভয় কাটিয়ে ওর কথা শুনতে হবে। দেখতে হবে কী সমস্যা হয়েছে ওর। মায়ের স্পর্শে রুনির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলর ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্ষণিকের ভেবলে যাওয়াটা কাটিয়ে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। শান্ত করার চেষ্টা করে। স্নেহের সাথে বলে, "কাঁদে না সোনা। বলো আমায়, কী হয়েছে?" রুনি কান্না বন্ধ করার কোনো চেষ্টাই করেনা। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে তুলতে যা বলে, তার সারমর্ম এই। ওর ক্লাসের এক বন্ধু, অঙ্কিত নাকি ওকে আজ টিফিন ব্রেকে ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওকে বলেছে, "আমি তোকে খুব ভালোবাসি। আজ থেকে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমি তোর বয়ফ্রেন্ড। অন্য কোনো ছেলের সাথে আর কথা বলবি না।" এই বলে নাকি আবার রুনির গালে চুমু খেয়েছে। রুনি নিজেকে বাঁচাতে অবশ্য অঙ্কিতকে ধরে দিয়েছে পেটে একটা ঘুঁষি। কিন্তু ভীষণভাবে বিড়ম্বিত। ও কিছুতেই আর অঙ্কিতের সাথে কথা বলতে চায় না।
রিমঝিম হতভম্ব। এইটুকু বাচ্চা। এরা আবার প্রেম ভালোবাসা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এসবের কী বোঝে? যত আজেবাজে সিরিয়াল সিনেমার প্রকোপ। কেন যে বাবা মায়ের যা খুশি টিভিতে দেখতে দেয় এদের। রুনিকে শান্ত করে। বলে, " আমি অঙ্কিতের মাকে বলবো। এরকম আর রিপিট হবে না। গ্লোরিয়া মিসকেও বলবো কালকেই। তুমি চিন্তা করো না মাম্মাম। আর রিপিট হবে না। কিন্তু বাই চান্স যদি হয়, ডু ওয়াট ইউ ডিড টুডে। কেউ তোমায় অস্বস্তিতে ফেললেই সেলফ ডিফেন্স যা শিখেছো, এপ্লাই করবে। আর হ্যাঁ, কান্নাকাটি তুমি করবে না মা একদম। দোষ যে করেছে, সে অঙ্কিত। নট ইউ। হি শুড বি এশেমড অফ হিমসেলফ। হি শুড বি পিনালাইজড। বুঝেছো?"
রুনি মাথা নাড়ে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সাময়িক মিটমাট। কিন্তু কাল অবশ্যই ক্লাস টিচারকে জানাতে হবে। আর খানিকক্ষণ পর, অঙ্কিতের মাকে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারাও নাকি প্রপোজ করছে। ভাবা যায়? আর এদিকে ওকে পুরো কলেজ লাইফ অবধি হা পিত্যেস করে থাকতে হলো, কবে সুমিত ওকে প্রপোজ করবে। হা ঈশ্বর।
দস্যি বটে, তবে একদিক দিয়ে রিমঝিম মনে মনে মেয়েকে নিয়ে খুব খুশি। স্কুলে ইতিমধ্যেই গুড টাচ ব্যাড টাচ নিয়ে শিখিয়ে তো দিয়েছে। মা হিসেবেও রিমঝিম ওর দায়িত্ব পালন করেছে। নিজে একটা ছুটির দিনে বসে ভালো করে যত্ন সহকারে মেয়েকে ভালো মন্দ বলেছে। আর সাথে এটাও বলেছে, কেউ কখনো "হার্ট" করতে গেলেই তাইকন্ডো ক্লাসে শেখা কয়েকটা ডেমো দিয়ে দিতে। তাহলে আর সহজে ঘাঁটতে পারবে না। রুনি কিন্তু মায়ের বাধ্য মেয়ে। স্কুলে এরপর বার দুইয়েক স্পোর্টস চলাকালীন ক্লাসের কিছু দুষ্টু ছেলে ওর পিছনে লাগছিলো, দিয়েছে দুই ঘা। রিমঝিম মনে মনে বেশ প্রাউড ফিল করে। যেমন দিন পড়েছে, তেমন করেই মানুষ করতে হবে।
বাড়ি ফিরে রিমঝিম অবাক। মানতুদির কাছে শুনলো, রুনি নীচে খেলতে যায়নি। স্কুল থেকে ফিরেছে বেশ চুপচাপ। খাওয়া নিয়ে রোজের মতো একটুও ঝামেলা পাকায়নি। খুঁটে খুঁটে অল্প একটু খেয়ে উঠে গিয়েছে। টিভিও চালায়নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রিমঝিম শুনে বেশ চিন্তিত হলো। কী ব্যাপার, মেয়ের এরকম আমূল পরিবর্তন কেন? জানতে ওকে হবেই। ও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট রুনির ঘরে গেল। মেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোলবালিশ আঁকড়ে শুয়ে। গাল বেয়ে চোখের জল, শুকিয়ে দাগ হয়ে গিয়েছে। আহা রে, মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কী হলো? রিমঝিম একটু ভয় পায়। দিনকাল এত খারাপ। শিউরে ওঠে। রুনির কোনো ক্ষতি হলো না তো? সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতে হয়।
রিমঝিম স্নেহের বশে মেয়েকে জাপ্টে ওর পাশে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বোলাতে থাকে। মেয়ের ভয় কাটিয়ে ওর কথা শুনতে হবে। দেখতে হবে কী সমস্যা হয়েছে ওর। মায়ের স্পর্শে রুনির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলর ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্ষণিকের ভেবলে যাওয়াটা কাটিয়ে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। শান্ত করার চেষ্টা করে। স্নেহের সাথে বলে, "কাঁদে না সোনা। বলো আমায়, কী হয়েছে?" রুনি কান্না বন্ধ করার কোনো চেষ্টাই করেনা। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে তুলতে যা বলে, তার সারমর্ম এই। ওর ক্লাসের এক বন্ধু, অঙ্কিত নাকি ওকে আজ টিফিন ব্রেকে ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওকে বলেছে, "আমি তোকে খুব ভালোবাসি। আজ থেকে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমি তোর বয়ফ্রেন্ড। অন্য কোনো ছেলের সাথে আর কথা বলবি না।" এই বলে নাকি আবার রুনির গালে চুমু খেয়েছে। রুনি নিজেকে বাঁচাতে অবশ্য অঙ্কিতকে ধরে দিয়েছে পেটে একটা ঘুঁষি। কিন্তু ভীষণভাবে বিড়ম্বিত। ও কিছুতেই আর অঙ্কিতের সাথে কথা বলতে চায় না।
রিমঝিম হতভম্ব। এইটুকু বাচ্চা। এরা আবার প্রেম ভালোবাসা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এসবের কী বোঝে? যত আজেবাজে সিরিয়াল সিনেমার প্রকোপ। কেন যে বাবা মায়ের যা খুশি টিভিতে দেখতে দেয় এদের। রুনিকে শান্ত করে। বলে, " আমি অঙ্কিতের মাকে বলবো। এরকম আর রিপিট হবে না। গ্লোরিয়া মিসকেও বলবো কালকেই। তুমি চিন্তা করো না মাম্মাম। আর রিপিট হবে না। কিন্তু বাই চান্স যদি হয়, ডু ওয়াট ইউ ডিড টুডে। কেউ তোমায় অস্বস্তিতে ফেললেই সেলফ ডিফেন্স যা শিখেছো, এপ্লাই করবে। আর হ্যাঁ, কান্নাকাটি তুমি করবে না মা একদম। দোষ যে করেছে, সে অঙ্কিত। নট ইউ। হি শুড বি এশেমড অফ হিমসেলফ। হি শুড বি পিনালাইজড। বুঝেছো?"
রুনি মাথা নাড়ে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সাময়িক মিটমাট। কিন্তু কাল অবশ্যই ক্লাস টিচারকে জানাতে হবে। আর খানিকক্ষণ পর, অঙ্কিতের মাকে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারাও নাকি প্রপোজ করছে। ভাবা যায়? আর এদিকে ওকে পুরো কলেজ লাইফ অবধি হা পিত্যেস করে থাকতে হলো, কবে সুমিত ওকে প্রপোজ করবে। হা ঈশ্বর।
Monday, December 9, 2019
মডার্ন পেরেন্টিং (২)
"নিজের বই কোথায় ফেলে আসো, খেয়াল থাকে না কেন?" এই বলে রুকুর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলো পিউ। রুকু কাঁদলো না। তবে মুখটা কাঁচুমাচু করে চলে গেল নিজের ঘরে।
অফিস টাইমে এই ভিড় মেট্রো চেপে ফিরতে ফিরতে একেই মাথা গরম হয়ে থাকে। তার ওপর এই যদি ফিরে এসেই শুনতে হয় আগামী সপ্তাহে যে সাবজেক্টের পরীক্ষা, তার বই হারিয়েছে ছেলে, মেজাজ সামলে রাখা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে বটে। পিউয়ের খারাপ লাগে। আজকাল বড্ড মেজাজ হারাচ্ছে। কারণে অকারণে বকুনি দিচ্ছে রুকুকে। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে, পারে না।
হিন্দি সাবজেক্টটা নিয়ে এমনিই হিমশিম খায় ওরা মা ছেলেতে। অনেক কষ্টে বন্ধু বান্ধবদের ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে নানান কাঠখড় পুড়িয়ে তবে কিনা সমস্ত সিলেবাস শেষ করিয়েছিল। যত ওয়ার্ক শিট, সব সলভ করিয়েছিল। আর এখন, পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে যদি রুকু এসে বলে যে বইটা খুঁজে পাচ্ছে না, কী করে চলে? হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে, নিরুপায় হয়ে নতুন আরেকটা বই কিনে আনতে হবে ঠিকই। কিন্তু ওই সলিউশনগুলো? পিউ নিজে বরাবর হিন্দিতে কাঁচা। কখন ওই করেগা আর কখন করেগি, এই নিয়ে চিরকাল জেরবার। আবার ওই অফিসের সৌরভকে ধরতে হবে। এমনিতেই ওকে তেমন পছন্দ নয় পিউয়ের। কিন্তু কী আর করা, হিন্দি মাদার টাং। ও ছাড়া এই লাস্ট মোমেন্টে কেই বা হেল্প করবে। ভাবছে সামনের বছর থেকে একটা টিউটর রাখবে হিন্দির জন্য। ওর পক্ষে এই জোড়াতাপ্পি দিয়ে চালানো বেশ কঠিন।
রুকুর মুখটা ভেবে মায়া হলো পিউয়ের। ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, অঙ্ক খাতা নিয়ে বসেছে। যাক অন্তত একটা বকুনি খেয়ে বাকি আর কিছুর জন্য বকতে হয়নি। এমনিই নিজে থেকেই বসে গিয়েছে পড়তে। হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো পিউ। ফ্রিজ থেকে একটু চিকেন সিদ্ধ বের করলো। অল্প পিঁয়াজ ক্যাপসিকাম কেটে ফ্রায়িং প্যানে দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটা টস কারি গোছের রেঁধে ফেললো। ব্রেড টোস্ট করে তাতে হালকা চিজ মাখিয়ে মা ও ছেলে, দুজনের জন্য চিকেন এন্ড টোস্ট নিয়ে রুকুর ঘরে এলো। রুকু পিউয়ের পায়ের শব্দে মাথা তুললো, কিছু না বলে আবার অঙ্ক খাতায় মনোনিবেশ করলো। পিউ ওর সামনে টেবিল পেতে তাতে দুজনের প্লেট রেখে রুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, "সরি। তখন পুরো ঘটনা না শুনে তোকে মারা উচিত হয়নি আমার। খেয়ে নে।"
রুকু পেন্সিল নীচে নামিয়ে রাখলো। খাতা খোলা। মায়ের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে বললো, "মা, সত্যি বলছি। আমার মনে নেই আমি কোথায় রেখেছি বইটা।"
পিউ বললো, "সে তো বুঝলাম। কিন্তু মনে না করলে খুঁজে পাবে কী করে বলো? পরীক্ষাতে কী করবে?"
রুকু উত্তর বলে, "মা, অবিনাশকে ফোন করবো? ওর বইটা যদি ও লেন্ড করে। তুমি জেরক্স করে নেবে।"
পিউ খেতে খেতে মাথা নাড়লো। তারপর বলল, "আচ্ছা, অবিনাশকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ না। ওর বইয়ের সাথে চলে যায় নি তো? পাশাপাশি বসিস।" রুকু শুনে একটু মাথা নাড়লো। হুম। হতেই পারে। একসাথেই তো ওরা বসে। বইপত্র সব এক টেবিলে থাকে। ও বলে, "মা, তুমি আন্টির নম্বরে কল করো একবার। আমি বলি।"
পিউ মোবাইল বের করে। অবিনাশের মায়ের ফোনে কল করে। অবিনাশ কোচিং ক্লাসে গিয়েছে। তাই পিউই ওর মাকে বলে, "মিসেস বসু, আমার ছেলের হিন্দি বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। একবার প্লিজ দেখবেন অবিনাশের ব্যাগে ওর বইয়ের সাথে চলে গিয়েছে কি না?" উল্টোদিক থেকে ঝাঁঝালো উত্তর আসে, "অবি কেন স্বস্তিকের বই নিয়ে আসবে?"
পিউ একটু নরম স্বরেই বলে, "না না, সেটা না। আসলে ওরা পাশাপাশি বসে। তাই ভাব্লাম। বাই মিস্টেক... যাই হোক, আপনি প্লিজ দেখবেন। আই এম শিয়োর, থাকলে আপনি ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। খুবই উপকার হয়।" অবিনাশের মা একটু ঠান্ডা গলায় বলে, "হুম। ঠিক আছে। ও ক্লাস থেকে ফিরুক। আমি দেখবো।" এই বলে ফোন ছেড়ে দেয়। পিউ আর বই জেরক্সের কথা বলতে পারে না। রুকুকে বলে, "শোন, একজ্যামের এখন ওয়ান উইক বাকি। একটু দেখ কাল অবিনাশ আনে কি না। আর পরশু তো স্কুলে লস্ট প্রপার্টি আছে। দেখ অপেক্ষা করে। যদি পাস। নইলে আমি ব্যবস্থা করছি। হয় নতুন বই, নয় কারুর থেকে জেরক্স। মিসেস বসুকে তো মনে হল না কথা শুনে যে বই ধার দেবে। আমাকেই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।"
রুকু প্লেট রেখে হাত মুখ ধুয়ে এসে অঙ্ক খাতা নিয়ে বসলো। পিউ সাংসারিক কাজে মন দিলো।
পরের দিন স্বাভাবিকভাবেই রুকু স্কুলে গেলো। পিউ ওকে একবার মনে করিয়ে দিলো, অবিনাশকে বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে। বিকেলে ফিরে রুকু জানালো, অবিনাশ বএলছে, ওর কাছে বই নেই। লস্ট প্রপার্টির জন্য এখন আর একদিন অপেক্ষা।
লস্ট প্রপার্টিতেও বই পাওয়া গেলো না। পিউ এবার একটু চিন্তিত। বই জেরক্স কেউ কি আদৌ করতে দেবে? অবিনাশের মাকেই কি বলবে? দ্বিধা করতে থাকে। স্কুলে আর তো কেউ নেই। এই বছর সেকশন চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় কারুর ফোন নম্বর নেই পিউয়ের কাছে। একবার কি তাহলে কাল স্কুলের পর হিন্দি মিসের সাথে দেখা করবে? নতুন বই নিয়ে গেলে যদি একটু হেল্প করে দেন? সেই আশা অবশ্য কম। এইসব টিচাররা যে যার প্রাইভেট টিউশানি করতে এতই ব্যস্ত। প্রাইভেট স্কুলের হাইফাই ব্যাপার। পিউ কিছুতেই মেলাতে পারে না এইসব, নিজের শৈশবের সাথে। ওরাও তো ভালো স্কুলে পড়েছে, মাঝেসাঝে কামাইও হয়েছে। সব সময় তো বন্ধুরা সাহায্য করেছে। পিউয়ের মনে পড়ে, ওর যখন ক্লাস সেভেন, সেবার সেকেন্ড টার্মের ঠিক আগে ওর সে কী টায়ফয়েড। স্কুলের মিস, ক্লাসের বন্ধুরা সব্বাই মিলে ওকে নোটস বানিয়ে দিত। আর এখন কে জানে এত কম্পিটিশন কেন।
রুকুর স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে পিউ। রুকুর ডায়েরিতে ও লিখে দিয়েছিল, হিন্দি মিসের সাথে দেখা করার কথা। যদি উনি হ্যাঁ বলেন, তাহলে দেখা করবে। রুকু বেরিয়েই এক গাল হাসি হেসে মাকে বলল, "মা, আর মিসের সাথে দেখা করতে হবে না। হিন্দি বইটা আমি পেয়ে গিয়েছি।"
পিউ খানিক অবাক হয়েই বলল, "তাই? বাহ। ভালো তো। তা পেলি কোথায়?"
রুকু হেসে বলল, "অবিনাশের কাছেই ছিল। ওর ব্যাগের ভিতর। ও বলল, এই কদিন নাকি ও খেয়াল করেনি। আমি বলেছিলাম না মা? ওর ব্যাগেই নিশ্চয়ই চলে গিয়েছে। আমি হারাইনি?"
পিউ আর কিছু বলেনা। রুকুর হাত ধরে রাস্তা পার হয়। উল্টো দিকে অটোর লম্বা লাইন। তাড়াতাড়ি না গেলে সেখানেও ভিড় হবে। সর্বত্র কম্পিটিশন, র্যাট রেস। ভাল্লাগেনা।
বাড়ি ফিরে রুকুকে পড়তে বসিয়ে কী জানি কী মনে হতে পিউ হিন্দি বইটা খোলে। উলটে পালটে দেখতে গিয়ে একটা ছোট্ট চিরকুট বেরিয়ে পড়ে। অচেনা হাতের লেখায় কিছু পেজ নম্বর লেখা। আর সাথে লেখা, 'এক কপি'। কৌতূহলবশত ওই পাতাগুলোতে যায় পিউ। গত টার্মের সিলেবাসের কঠিনতম চ্যাপ্টারগুলি। কত কাঠখড় পুড়িয়ে যা সল্ভ করেছিল পিউ। সেইগুলিই জেরক্স হয়েছে। হঠাৎ করেই পুরো ঘটনাটা বুঝতে পারে পিউ। শিউরে ওঠে। এই র্যাট রেসে এমনভাবে ছেলে মেয়েগুলোও নেমে পড়লো? কী দিনকাল। কীসব পেরেন্টিং...
অফিস টাইমে এই ভিড় মেট্রো চেপে ফিরতে ফিরতে একেই মাথা গরম হয়ে থাকে। তার ওপর এই যদি ফিরে এসেই শুনতে হয় আগামী সপ্তাহে যে সাবজেক্টের পরীক্ষা, তার বই হারিয়েছে ছেলে, মেজাজ সামলে রাখা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে বটে। পিউয়ের খারাপ লাগে। আজকাল বড্ড মেজাজ হারাচ্ছে। কারণে অকারণে বকুনি দিচ্ছে রুকুকে। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে, পারে না।
হিন্দি সাবজেক্টটা নিয়ে এমনিই হিমশিম খায় ওরা মা ছেলেতে। অনেক কষ্টে বন্ধু বান্ধবদের ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে নানান কাঠখড় পুড়িয়ে তবে কিনা সমস্ত সিলেবাস শেষ করিয়েছিল। যত ওয়ার্ক শিট, সব সলভ করিয়েছিল। আর এখন, পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে যদি রুকু এসে বলে যে বইটা খুঁজে পাচ্ছে না, কী করে চলে? হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে, নিরুপায় হয়ে নতুন আরেকটা বই কিনে আনতে হবে ঠিকই। কিন্তু ওই সলিউশনগুলো? পিউ নিজে বরাবর হিন্দিতে কাঁচা। কখন ওই করেগা আর কখন করেগি, এই নিয়ে চিরকাল জেরবার। আবার ওই অফিসের সৌরভকে ধরতে হবে। এমনিতেই ওকে তেমন পছন্দ নয় পিউয়ের। কিন্তু কী আর করা, হিন্দি মাদার টাং। ও ছাড়া এই লাস্ট মোমেন্টে কেই বা হেল্প করবে। ভাবছে সামনের বছর থেকে একটা টিউটর রাখবে হিন্দির জন্য। ওর পক্ষে এই জোড়াতাপ্পি দিয়ে চালানো বেশ কঠিন।
রুকুর মুখটা ভেবে মায়া হলো পিউয়ের। ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, অঙ্ক খাতা নিয়ে বসেছে। যাক অন্তত একটা বকুনি খেয়ে বাকি আর কিছুর জন্য বকতে হয়নি। এমনিই নিজে থেকেই বসে গিয়েছে পড়তে। হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো পিউ। ফ্রিজ থেকে একটু চিকেন সিদ্ধ বের করলো। অল্প পিঁয়াজ ক্যাপসিকাম কেটে ফ্রায়িং প্যানে দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটা টস কারি গোছের রেঁধে ফেললো। ব্রেড টোস্ট করে তাতে হালকা চিজ মাখিয়ে মা ও ছেলে, দুজনের জন্য চিকেন এন্ড টোস্ট নিয়ে রুকুর ঘরে এলো। রুকু পিউয়ের পায়ের শব্দে মাথা তুললো, কিছু না বলে আবার অঙ্ক খাতায় মনোনিবেশ করলো। পিউ ওর সামনে টেবিল পেতে তাতে দুজনের প্লেট রেখে রুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, "সরি। তখন পুরো ঘটনা না শুনে তোকে মারা উচিত হয়নি আমার। খেয়ে নে।"
রুকু পেন্সিল নীচে নামিয়ে রাখলো। খাতা খোলা। মায়ের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে বললো, "মা, সত্যি বলছি। আমার মনে নেই আমি কোথায় রেখেছি বইটা।"
পিউ বললো, "সে তো বুঝলাম। কিন্তু মনে না করলে খুঁজে পাবে কী করে বলো? পরীক্ষাতে কী করবে?"
রুকু উত্তর বলে, "মা, অবিনাশকে ফোন করবো? ওর বইটা যদি ও লেন্ড করে। তুমি জেরক্স করে নেবে।"
পিউ খেতে খেতে মাথা নাড়লো। তারপর বলল, "আচ্ছা, অবিনাশকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ না। ওর বইয়ের সাথে চলে যায় নি তো? পাশাপাশি বসিস।" রুকু শুনে একটু মাথা নাড়লো। হুম। হতেই পারে। একসাথেই তো ওরা বসে। বইপত্র সব এক টেবিলে থাকে। ও বলে, "মা, তুমি আন্টির নম্বরে কল করো একবার। আমি বলি।"
পিউ মোবাইল বের করে। অবিনাশের মায়ের ফোনে কল করে। অবিনাশ কোচিং ক্লাসে গিয়েছে। তাই পিউই ওর মাকে বলে, "মিসেস বসু, আমার ছেলের হিন্দি বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। একবার প্লিজ দেখবেন অবিনাশের ব্যাগে ওর বইয়ের সাথে চলে গিয়েছে কি না?" উল্টোদিক থেকে ঝাঁঝালো উত্তর আসে, "অবি কেন স্বস্তিকের বই নিয়ে আসবে?"
পিউ একটু নরম স্বরেই বলে, "না না, সেটা না। আসলে ওরা পাশাপাশি বসে। তাই ভাব্লাম। বাই মিস্টেক... যাই হোক, আপনি প্লিজ দেখবেন। আই এম শিয়োর, থাকলে আপনি ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। খুবই উপকার হয়।" অবিনাশের মা একটু ঠান্ডা গলায় বলে, "হুম। ঠিক আছে। ও ক্লাস থেকে ফিরুক। আমি দেখবো।" এই বলে ফোন ছেড়ে দেয়। পিউ আর বই জেরক্সের কথা বলতে পারে না। রুকুকে বলে, "শোন, একজ্যামের এখন ওয়ান উইক বাকি। একটু দেখ কাল অবিনাশ আনে কি না। আর পরশু তো স্কুলে লস্ট প্রপার্টি আছে। দেখ অপেক্ষা করে। যদি পাস। নইলে আমি ব্যবস্থা করছি। হয় নতুন বই, নয় কারুর থেকে জেরক্স। মিসেস বসুকে তো মনে হল না কথা শুনে যে বই ধার দেবে। আমাকেই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।"
রুকু প্লেট রেখে হাত মুখ ধুয়ে এসে অঙ্ক খাতা নিয়ে বসলো। পিউ সাংসারিক কাজে মন দিলো।
পরের দিন স্বাভাবিকভাবেই রুকু স্কুলে গেলো। পিউ ওকে একবার মনে করিয়ে দিলো, অবিনাশকে বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে। বিকেলে ফিরে রুকু জানালো, অবিনাশ বএলছে, ওর কাছে বই নেই। লস্ট প্রপার্টির জন্য এখন আর একদিন অপেক্ষা।
লস্ট প্রপার্টিতেও বই পাওয়া গেলো না। পিউ এবার একটু চিন্তিত। বই জেরক্স কেউ কি আদৌ করতে দেবে? অবিনাশের মাকেই কি বলবে? দ্বিধা করতে থাকে। স্কুলে আর তো কেউ নেই। এই বছর সেকশন চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় কারুর ফোন নম্বর নেই পিউয়ের কাছে। একবার কি তাহলে কাল স্কুলের পর হিন্দি মিসের সাথে দেখা করবে? নতুন বই নিয়ে গেলে যদি একটু হেল্প করে দেন? সেই আশা অবশ্য কম। এইসব টিচাররা যে যার প্রাইভেট টিউশানি করতে এতই ব্যস্ত। প্রাইভেট স্কুলের হাইফাই ব্যাপার। পিউ কিছুতেই মেলাতে পারে না এইসব, নিজের শৈশবের সাথে। ওরাও তো ভালো স্কুলে পড়েছে, মাঝেসাঝে কামাইও হয়েছে। সব সময় তো বন্ধুরা সাহায্য করেছে। পিউয়ের মনে পড়ে, ওর যখন ক্লাস সেভেন, সেবার সেকেন্ড টার্মের ঠিক আগে ওর সে কী টায়ফয়েড। স্কুলের মিস, ক্লাসের বন্ধুরা সব্বাই মিলে ওকে নোটস বানিয়ে দিত। আর এখন কে জানে এত কম্পিটিশন কেন।
রুকুর স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে পিউ। রুকুর ডায়েরিতে ও লিখে দিয়েছিল, হিন্দি মিসের সাথে দেখা করার কথা। যদি উনি হ্যাঁ বলেন, তাহলে দেখা করবে। রুকু বেরিয়েই এক গাল হাসি হেসে মাকে বলল, "মা, আর মিসের সাথে দেখা করতে হবে না। হিন্দি বইটা আমি পেয়ে গিয়েছি।"
পিউ খানিক অবাক হয়েই বলল, "তাই? বাহ। ভালো তো। তা পেলি কোথায়?"
রুকু হেসে বলল, "অবিনাশের কাছেই ছিল। ওর ব্যাগের ভিতর। ও বলল, এই কদিন নাকি ও খেয়াল করেনি। আমি বলেছিলাম না মা? ওর ব্যাগেই নিশ্চয়ই চলে গিয়েছে। আমি হারাইনি?"
পিউ আর কিছু বলেনা। রুকুর হাত ধরে রাস্তা পার হয়। উল্টো দিকে অটোর লম্বা লাইন। তাড়াতাড়ি না গেলে সেখানেও ভিড় হবে। সর্বত্র কম্পিটিশন, র্যাট রেস। ভাল্লাগেনা।
বাড়ি ফিরে রুকুকে পড়তে বসিয়ে কী জানি কী মনে হতে পিউ হিন্দি বইটা খোলে। উলটে পালটে দেখতে গিয়ে একটা ছোট্ট চিরকুট বেরিয়ে পড়ে। অচেনা হাতের লেখায় কিছু পেজ নম্বর লেখা। আর সাথে লেখা, 'এক কপি'। কৌতূহলবশত ওই পাতাগুলোতে যায় পিউ। গত টার্মের সিলেবাসের কঠিনতম চ্যাপ্টারগুলি। কত কাঠখড় পুড়িয়ে যা সল্ভ করেছিল পিউ। সেইগুলিই জেরক্স হয়েছে। হঠাৎ করেই পুরো ঘটনাটা বুঝতে পারে পিউ। শিউরে ওঠে। এই র্যাট রেসে এমনভাবে ছেলে মেয়েগুলোও নেমে পড়লো? কী দিনকাল। কীসব পেরেন্টিং...
Sunday, December 8, 2019
মডার্ন পেরেন্টিং (১)
অফিসে সাঙ্ঘাতিক কাজের চাপ। লাঞ্চ পর্যন্ত করার সুযোগ পায়নি গার্গী। এরই মধ্যে হঠাৎ মোবাইলে ফোন এলো। বুবুলের স্কুলের নম্বরটা স্ক্রিনে ভেসে উঠতে একটু অবাক হলো বটে। কী হলো, কী কান্ড ঘটালো? রেজাল্ট খারাপ নাকি? পেরেন্টস কল? একটু ইতস্তত করেই ফোনটা ধরলো।
- হ্যালো?
- মিসেস চক্রবর্তী বলছেন?
- হ্যাঁ। বলুন।
- মিসেস চক্রবর্তী, আমি অর্কর ক্লাস টিচার, হেমশীলা।
- হ্যাঁ বলুন ম্যাম।
- মিসেস চক্রবর্তী আপনাকে এখন একটু স্কুলে আসতে হবে।
- এক্ষুণি? কেন? সামথিং আর্জেন্ট?
- এখুনি আসতেই হবে।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। দেখছি।
- দেখছি না। আসুন। আমরা অপেক্ষা করে আছি।
- ওকে।
গেলো আজ কাজের বারোটা বেজে। গার্গী কম্পিউটারে খোলা ডকুমেন্টস সেভ করে ব্যাগ আর গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরোয়। বেরোনোর আগে পাশের কিউবিকলের মিসেস ঘোষকে বলে গেল। "দেখি, শমন এলো কেন। যাই।"
স্কুলে পৌঁছে গার্গী হেমশীলাকে ফোন করলো। প্রিন্সিপালের ঘরে ওর ডাক পড়লো। উফ। ওই ঘরটা মোটেই ভালো লাগে না গার্গীর। কেমন ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে পুরোনো আদ্যিকালের ঘর। আর তেমনি আদ্যিকালের চিন্তাধারা প্রিন্সিপালের। আগে একবার এসে ভালো মতো মতানৈক্য হয়েছিল। স্কুলের টিফিন আইটেম মেনু নিয়ে। নাকি নন ভেজ কিচ্ছু আনা যাবে না। ম্যাগি নেওয়া যাবে না। গার্গী ভাবতেই পারে না এসব। ওরা ছোট থেকে বড় হয়ে গেল ম্যাগি স্যান্ডউইচ খেয়ে। আর এদের নাকি এইসব নিয়ম। নেহাৎ সেইবার সাথে শুভ্র ছিল। তাই মাথা গরম করলেও বাড়াবাড়ি হয়নি। আজ কে জানে কপালে কী আছে। শুভ্রও আজ কলকাতায় নেই। শান্ত হও গার্গী, শান্ত হও। নিজেকে বারবার বলতে থাকে গার্গী।
হন্তদন্ত হয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে পড়ে গার্গী। গুড আফটারনুন উইশ করে চেয়ার টেনে বসে। প্রিন্সিপাল ঠিক যেন ওই এনিড ব্লাইটনের গল্পের স্ট্রিক্ট দিদিমণি। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, "মিসেস চক্রবর্তী, আপনার ছেলে আজ সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়েছে। ওর ক্লাসমেট সৌকর্যকে প্রচন্ড মারধর করেছে। উই হ্যাড টু ইন্টার্ভিন।" গার্গী চমকে ওঠে। অর্ক শান্ত ছেলে। ও তো সহজে এরকম করার পাত্র না। তা হলে? কী হলো? ও হেমশীলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "ম্যাম, অর্ক কোথায়? ও ঠিক আছে? ওর সাথে কথা বলতে চাই।" হেমশীলা কিছু বলার আগেই প্রিন্সিপাল মাঝখান থেকে বলে দেন, "ইয়েস, অর্ক ইজ ফাইন। ওর সাথে দেখা করবেন। কিন্তু উই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ। ইউ হ্যাভ টু টক টু ইয়োর চাইল্ড। সি দ্যাট হি ইজ নট রিপইটিং সাচ এ বিহেভিয়ার।"
গার্গী মাথা নাড়ে। নীচুস্বরে বলে, "সে তো ঠিক আছে। কিন্তু কারণটা কী, জানেন কিছু আপনারা?"
হেমশীলাকে আবারও কিছু বলতে না দিয়ে প্রিন্সিপাল উত্তর দেন, "দেখুন মিসেস চক্রবর্তী, ক্লাস সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের আবার কারণ তেমন সিরিয়াস কিছু হয় নাকি। মাস্ট বি সামথিং পেটি। ইউ প্লিজ হ্যান্ডল ইট। এন্ড প্লিজ টেক দিস ওয়ার্নিং সিরিয়াসলি।" গার্গী হ্যাঁ তে মাথা নেড়ে উঠে পড়ে। হেমশীলা ইতিমিধ্যে বাইরে বুবুলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুবুলের চোখে মুখে ভয়। একেই প্রিন্সিপাল টিচারের কাছে বকুনি খেয়েছে। তার উপর পেরেন্টস কল। চুপচাপ, একটা কথাও না বলে ও মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে গাড়িতে বসে। গার্গীও কোনো কথা বলে না। পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে সোজা চলে যায় কাছের শপিং মলে। লাঞ্চ হয়নি এখনো।বুবুলেরও মন ভালো নেই। তাই ফুড কোর্টে গিয়ে বুবুলের পছন্দের চিকেন স্যান্ডউইচ মিল্ক শেক আর নিজের জন্য নুডলস অর্ডার করে বসলো। যতক্ষণ না খাবার আসে, গার্গী বুবুলকে এই নিয়ে একটাও কথা বলেনি। বরং স্কুলের হোমওয়ার্ক আসন্ন পরীক্ষার সিলেবাস, এইসব নিয়েই আলোচনা করলো। এতে হলো কী, বুবুল অনেকটাই শান্ত ও নিশ্চিন্ত হলো। ইতিমধ্যে খাবারের ডাক এসে পড়েছে। গার্গী দুই হাতে দুটো ট্রেতে দুজনের খাবার নিয়ে এসে বসলো।খাবারগুলো এত সুন্দর সাজিয়ে সার্ভ করে, ছবি না তুললেই নয়। ছেলের সাথে খাবারের সাথে সেলফি তুললো ও। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেবে।
এইবার ও বুবুলের দিকে তাকিয়ে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যাঁ রে, কী হয়েছিল আজ স্কুলে?"
বুবুল একটু আমতা আমতা করে বললো, "মাম, বিলিভ মি। আমি কিন্তু আগে মারতে চাইনি।"
- কন্টিনিউ।
- সৌকর্য আমায় প্রভোক করে।
- কীভাবে?
- ও আমার ওয়াটার বোতল নিয়ে ফেলে দেয়।
- কেন? হঠাৎ?
- এর আগে ওর সাথে আমার ডোরেমন নিয়ে একটু তর্ক হচ্ছিল। তাই রাগ করে ও আমার বোতলটা নিয়ে ফেলে দেয়।
- তারপর?
- আমি ওকে বললাম, এরকম কেন করলি?
- ও কী বললো?
- ও কিছু বলেনি। জাস্ট হাসলো।
- দেন?
- দেন আই আসকড হিম। বাড়িতে আমি কী বলবো? এরকম ভেঙে গেল যে.. ও বলে সে আমি জানি না।
- আর অমনি তুমি মারলে?
- না না।
-তাহলে?
- আমি ওকে বললাম আমি কিন্তু আন্টিকে বলে দেব।
- বলেছো?
- পরে। তো ও তাতে বললো যে ওসব বলে লাভ নেই। তুই একটা বোতল কিনে নিস। কত টাকা দাম, বলে দিস। টাকাটা দিয়ে দেব।
- বাবাঃ। এত বুকনি!
- ওকে তখন বললাম, এটা মিল্টনের ছিল। অনেক দাম। কোথায় টাকা পাবি?
- ও তখন বললো, পকেট মানি পাই। তোর মত নাকি, পুওর নই।
- বললো, আর অমনি তুমি রেগে গিয়ে মাথা গরম করলে?
- করবো না? এরকম কেন বলবে? আগে তো আমার বোতল ভাঙলো। তারপর পুওর বললো।
- ও পুওর বলায় তোমার কী আসে যায় বুবুল?
- না। কেন বলবে?
- তোমার কি কখনো ফিজ দিতে লেট হয়েছে? স্কুলে টিউশন ক্লাসে যখন যা লেগেছে, পাওনি?
- হ্যাঁ।
- বন্ধুদের জন্মদিনে গিফ্টস দাওনি?
-হুম।
- তোমার বার্থডে সেলিব্রেট হয় না? যখন যা প্রয়োজন, পাওনি?
-হ্যাঁ।
- তাহলে? ও পুওর বললো আর তোমার গায়ে লেগে গেলো?
-হুম।
- নট রাইট। তোমায় যখন তখন যে ইচ্ছে এসে প্রভোক করলেই তুমি যদি এরকম react করো, তাহলে তো স্কুলে টিকতে পারবে না।
- কিন্তু তুমিই তো বলেছো, টু ফাইট বুলিজ।
- এগ্রিড। কিন্তু, ইউ মাস্ট চুজ ইয়োর এনিমিস রাইট। এই যে সৌকর্যর সাথে ফাইট করলে, এতে ও কি শাস্তি পেলো? পেলো না। বাট তুমি বকুনি খেলে। পেরেন্টস কল হলো। তোমার বদনাম হলো।
- তাহলে কী করতাম?
- নেক্সট টাইম এরকম হলে আগে ক্লাসটিচার কে বলবে। দেখো উনি কী বলেন, করেন। আমায়ও বাড়ি এসে বলবে। তারপর আমরা দেখবো।
-হুম।
- যতক্ষণ না তোমায় কেউ ফিজিকালি এটাক করছে, তুমি কোনো মারপিট করবে না। ক্লিয়ার?
-হ্যাঁ।
- আর যেন এর রিপিটেশন না হয়। বুঝেছো?
-বুঝেছি। সরি মা।
-ইট ইজ ওকে। উই লার্ন ফ্রম মিসটেকস। কি
- শিখলাম।
- যাক গে। যা হয়ে গেছে, গেছে। বল, এরপর কী খাবি? Let us have an icecream to raise a toast to our learning today...
- ইয়ে!!!
গার্গী আর বুবুল এগোলো ওদের প্রিয় আইসক্রিম পার্লারের দিকে। গার্গী মনে মনে ভাবে, সত্যিই, কত বদলে গিয়েছে পেরেন্টিং। কত পাল্টেছে মা বাবা ও সন্তানের সমীকরণ।
- হ্যালো?
- মিসেস চক্রবর্তী বলছেন?
- হ্যাঁ। বলুন।
- মিসেস চক্রবর্তী, আমি অর্কর ক্লাস টিচার, হেমশীলা।
- হ্যাঁ বলুন ম্যাম।
- মিসেস চক্রবর্তী আপনাকে এখন একটু স্কুলে আসতে হবে।
- এক্ষুণি? কেন? সামথিং আর্জেন্ট?
- এখুনি আসতেই হবে।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। দেখছি।
- দেখছি না। আসুন। আমরা অপেক্ষা করে আছি।
- ওকে।
গেলো আজ কাজের বারোটা বেজে। গার্গী কম্পিউটারে খোলা ডকুমেন্টস সেভ করে ব্যাগ আর গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরোয়। বেরোনোর আগে পাশের কিউবিকলের মিসেস ঘোষকে বলে গেল। "দেখি, শমন এলো কেন। যাই।"
স্কুলে পৌঁছে গার্গী হেমশীলাকে ফোন করলো। প্রিন্সিপালের ঘরে ওর ডাক পড়লো। উফ। ওই ঘরটা মোটেই ভালো লাগে না গার্গীর। কেমন ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে পুরোনো আদ্যিকালের ঘর। আর তেমনি আদ্যিকালের চিন্তাধারা প্রিন্সিপালের। আগে একবার এসে ভালো মতো মতানৈক্য হয়েছিল। স্কুলের টিফিন আইটেম মেনু নিয়ে। নাকি নন ভেজ কিচ্ছু আনা যাবে না। ম্যাগি নেওয়া যাবে না। গার্গী ভাবতেই পারে না এসব। ওরা ছোট থেকে বড় হয়ে গেল ম্যাগি স্যান্ডউইচ খেয়ে। আর এদের নাকি এইসব নিয়ম। নেহাৎ সেইবার সাথে শুভ্র ছিল। তাই মাথা গরম করলেও বাড়াবাড়ি হয়নি। আজ কে জানে কপালে কী আছে। শুভ্রও আজ কলকাতায় নেই। শান্ত হও গার্গী, শান্ত হও। নিজেকে বারবার বলতে থাকে গার্গী।
হন্তদন্ত হয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে পড়ে গার্গী। গুড আফটারনুন উইশ করে চেয়ার টেনে বসে। প্রিন্সিপাল ঠিক যেন ওই এনিড ব্লাইটনের গল্পের স্ট্রিক্ট দিদিমণি। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, "মিসেস চক্রবর্তী, আপনার ছেলে আজ সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়েছে। ওর ক্লাসমেট সৌকর্যকে প্রচন্ড মারধর করেছে। উই হ্যাড টু ইন্টার্ভিন।" গার্গী চমকে ওঠে। অর্ক শান্ত ছেলে। ও তো সহজে এরকম করার পাত্র না। তা হলে? কী হলো? ও হেমশীলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "ম্যাম, অর্ক কোথায়? ও ঠিক আছে? ওর সাথে কথা বলতে চাই।" হেমশীলা কিছু বলার আগেই প্রিন্সিপাল মাঝখান থেকে বলে দেন, "ইয়েস, অর্ক ইজ ফাইন। ওর সাথে দেখা করবেন। কিন্তু উই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ। ইউ হ্যাভ টু টক টু ইয়োর চাইল্ড। সি দ্যাট হি ইজ নট রিপইটিং সাচ এ বিহেভিয়ার।"
গার্গী মাথা নাড়ে। নীচুস্বরে বলে, "সে তো ঠিক আছে। কিন্তু কারণটা কী, জানেন কিছু আপনারা?"
হেমশীলাকে আবারও কিছু বলতে না দিয়ে প্রিন্সিপাল উত্তর দেন, "দেখুন মিসেস চক্রবর্তী, ক্লাস সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের আবার কারণ তেমন সিরিয়াস কিছু হয় নাকি। মাস্ট বি সামথিং পেটি। ইউ প্লিজ হ্যান্ডল ইট। এন্ড প্লিজ টেক দিস ওয়ার্নিং সিরিয়াসলি।" গার্গী হ্যাঁ তে মাথা নেড়ে উঠে পড়ে। হেমশীলা ইতিমিধ্যে বাইরে বুবুলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুবুলের চোখে মুখে ভয়। একেই প্রিন্সিপাল টিচারের কাছে বকুনি খেয়েছে। তার উপর পেরেন্টস কল। চুপচাপ, একটা কথাও না বলে ও মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে গাড়িতে বসে। গার্গীও কোনো কথা বলে না। পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে সোজা চলে যায় কাছের শপিং মলে। লাঞ্চ হয়নি এখনো।বুবুলেরও মন ভালো নেই। তাই ফুড কোর্টে গিয়ে বুবুলের পছন্দের চিকেন স্যান্ডউইচ মিল্ক শেক আর নিজের জন্য নুডলস অর্ডার করে বসলো। যতক্ষণ না খাবার আসে, গার্গী বুবুলকে এই নিয়ে একটাও কথা বলেনি। বরং স্কুলের হোমওয়ার্ক আসন্ন পরীক্ষার সিলেবাস, এইসব নিয়েই আলোচনা করলো। এতে হলো কী, বুবুল অনেকটাই শান্ত ও নিশ্চিন্ত হলো। ইতিমধ্যে খাবারের ডাক এসে পড়েছে। গার্গী দুই হাতে দুটো ট্রেতে দুজনের খাবার নিয়ে এসে বসলো।খাবারগুলো এত সুন্দর সাজিয়ে সার্ভ করে, ছবি না তুললেই নয়। ছেলের সাথে খাবারের সাথে সেলফি তুললো ও। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেবে।
এইবার ও বুবুলের দিকে তাকিয়ে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যাঁ রে, কী হয়েছিল আজ স্কুলে?"
বুবুল একটু আমতা আমতা করে বললো, "মাম, বিলিভ মি। আমি কিন্তু আগে মারতে চাইনি।"
- কন্টিনিউ।
- সৌকর্য আমায় প্রভোক করে।
- কীভাবে?
- ও আমার ওয়াটার বোতল নিয়ে ফেলে দেয়।
- কেন? হঠাৎ?
- এর আগে ওর সাথে আমার ডোরেমন নিয়ে একটু তর্ক হচ্ছিল। তাই রাগ করে ও আমার বোতলটা নিয়ে ফেলে দেয়।
- তারপর?
- আমি ওকে বললাম, এরকম কেন করলি?
- ও কী বললো?
- ও কিছু বলেনি। জাস্ট হাসলো।
- দেন?
- দেন আই আসকড হিম। বাড়িতে আমি কী বলবো? এরকম ভেঙে গেল যে.. ও বলে সে আমি জানি না।
- আর অমনি তুমি মারলে?
- না না।
-তাহলে?
- আমি ওকে বললাম আমি কিন্তু আন্টিকে বলে দেব।
- বলেছো?
- পরে। তো ও তাতে বললো যে ওসব বলে লাভ নেই। তুই একটা বোতল কিনে নিস। কত টাকা দাম, বলে দিস। টাকাটা দিয়ে দেব।
- বাবাঃ। এত বুকনি!
- ওকে তখন বললাম, এটা মিল্টনের ছিল। অনেক দাম। কোথায় টাকা পাবি?
- ও তখন বললো, পকেট মানি পাই। তোর মত নাকি, পুওর নই।
- বললো, আর অমনি তুমি রেগে গিয়ে মাথা গরম করলে?
- করবো না? এরকম কেন বলবে? আগে তো আমার বোতল ভাঙলো। তারপর পুওর বললো।
- ও পুওর বলায় তোমার কী আসে যায় বুবুল?
- না। কেন বলবে?
- তোমার কি কখনো ফিজ দিতে লেট হয়েছে? স্কুলে টিউশন ক্লাসে যখন যা লেগেছে, পাওনি?
- হ্যাঁ।
- বন্ধুদের জন্মদিনে গিফ্টস দাওনি?
-হুম।
- তোমার বার্থডে সেলিব্রেট হয় না? যখন যা প্রয়োজন, পাওনি?
-হ্যাঁ।
- তাহলে? ও পুওর বললো আর তোমার গায়ে লেগে গেলো?
-হুম।
- নট রাইট। তোমায় যখন তখন যে ইচ্ছে এসে প্রভোক করলেই তুমি যদি এরকম react করো, তাহলে তো স্কুলে টিকতে পারবে না।
- কিন্তু তুমিই তো বলেছো, টু ফাইট বুলিজ।
- এগ্রিড। কিন্তু, ইউ মাস্ট চুজ ইয়োর এনিমিস রাইট। এই যে সৌকর্যর সাথে ফাইট করলে, এতে ও কি শাস্তি পেলো? পেলো না। বাট তুমি বকুনি খেলে। পেরেন্টস কল হলো। তোমার বদনাম হলো।
- তাহলে কী করতাম?
- নেক্সট টাইম এরকম হলে আগে ক্লাসটিচার কে বলবে। দেখো উনি কী বলেন, করেন। আমায়ও বাড়ি এসে বলবে। তারপর আমরা দেখবো।
-হুম।
- যতক্ষণ না তোমায় কেউ ফিজিকালি এটাক করছে, তুমি কোনো মারপিট করবে না। ক্লিয়ার?
-হ্যাঁ।
- আর যেন এর রিপিটেশন না হয়। বুঝেছো?
-বুঝেছি। সরি মা।
-ইট ইজ ওকে। উই লার্ন ফ্রম মিসটেকস। কি
- শিখলাম।
- যাক গে। যা হয়ে গেছে, গেছে। বল, এরপর কী খাবি? Let us have an icecream to raise a toast to our learning today...
- ইয়ে!!!
গার্গী আর বুবুল এগোলো ওদের প্রিয় আইসক্রিম পার্লারের দিকে। গার্গী মনে মনে ভাবে, সত্যিই, কত বদলে গিয়েছে পেরেন্টিং। কত পাল্টেছে মা বাবা ও সন্তানের সমীকরণ।
Friday, December 6, 2019
সূর্যাস্ত
(১)
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না?" আলতো করে আমার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলতো সুর্মা। আমি প্রাণভরে ওই স্পর্শের ওমটুকু শুষে নিতাম। আর ছোট্ট করে মাথা নেড়ে বলতাম, "হুম।" লেকের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা ছিল আমাদের একটা নেশার মতো। সময় পেলেই দুজনে ছুটে আসতাম। সুর্মা ভালোবাসতো সূর্যাস্ত, আর আমি ওকে।
(২)
আজ আবারও আমি এসে বসেছি লেকের ধারের সাদা বেঞ্চে। জলের ওপর অস্তমিত সূর্যের রক্তছটা। প্রকৃতির এক মায়াবিনী ক্যানভাস। দু চোখ মেলে দেখছি এই দৃশ্য। কাল ফিরে গিয়ে সুর্মাকে বলবো। ঠিক যেমন রোজ ওর পাশে বসে ওকে নানান গল্প বলি, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে। সুর্মা দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। নাকে মুখে হাতে গুচ্ছ গুচ্ছ নল। বেডের পাশে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ মনিটর, ওর নিস্তেজ শরীরটার ভাইটাল প্যারামিটার্স মেপে চলেছে প্রতিনিয়ত, বিগত এক বছর ধরে। এক বছর, সেই অভিশপ্ত রাতের এক বছর হয়ে গেল।
(৩)
"সুর্মা, যেয়ো না। আমি একা হয়ে যাবো।" আমি প্রবলভাবে আকুতি জানিয়েছিলাম। সুর্মা ওর সহকর্মীদের সাথে উইকেন্ডে মন্দারমনি যাবে বলেছিল। ওর তেমন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অফিসের ট্রিপ। সেরকম জোর করে না বলতে পারেনি। সারা রাস্তা আমরা হোয়াটসআপে মেসেজে গল্প করে কাটিয়েছি। কখনো ভয়েস নোটও। ওর থেকে পাওয়া আমার শেষ ভয়েস নোটে ও বলেছিল, "এই তো। আমি তো রইলাম। ফোনে আছিই। পাশে আছি। সব সময়।" সহকর্মীরা টি ব্রেকে হাইওয়ের ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন চা খাচ্ছে, সুর্মা আমায় ফোন করছে। আমি ওকে সেদিনের সূর্যাস্তের ছবির বর্ণনা দিচ্ছি। কেমন করে জলাভূমির ওপর লালচে আভা পড়ে সবকিছু সুন্দর করে দিয়েছিল। এক ঝাঁক কাক দিনের শেষে ডানা ঝাপটে ফিরে চলেছিল, বাড়ির দিকে।
আর তখনই, ঠিক তখনই পিছন থেকে আসা একটি ট্রাক, ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারলো সুর্মাদের গাড়িতে। চোখের নিমেষে দুমড়ে মুচড়ে সব শেষ। সূর্যাস্তের রক্তিম আভাকে সরিয়ে মঞ্চ দখল করলো ওর বি পিজিটিভ রক্ত।
(৪)
সুর্মার কঠিন অপারেশন হলো। আমি ওটির বাইরে চুপ করে অপেক্ষা করে রইলাম। একবার বসছি, একবার হাঁটছি। শান্তি স্বস্তি কিচ্ছু পাই না। ডাক্তার এলেন। বললেন অপারেশন সাকসেসফুল। এবার শুধু অপেক্ষা। কতক্ষণে ওর জ্ঞান ফেরে।
(৫)
অপেক্ষা এখনো করছি। এক বছর ধরে। প্রতিদিন নিয়ম করে হাসপাতালে যখন যাই, সুর্মার বন্ধ দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই বুঝি পাতা কেঁপে উঠলো। এই বুঝি ওর নরম ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কোনো শব্দ এলো। আমার হাত দিয়ে ওর কপালের ওপর পড়া নরম কালো চুলের গোছা সরিয়ে দিই। ওর সাথে কথা বলি। সব কিছু জানাই ওকে। অফিসের সমস্যা, বাড়ির হাল, নতুন কোনো সিনেমা, দু কলি গান। কিচ্ছু না, কিচ্ছু বাদ যায় না।
ডাক্তাররা আশা ছেড়েই দিয়েছেন। বলেছেন, সুর্মা নাকি প্র্যাকটিক্যালি মৃত। শুধুমাত্র লাইফ সাপোর্টেই ওর নিশ্বাস পড়ছে। আমায় ওঁরা নিয়মিত বোঝান। আর কদিন? আর কতদিন এরকমভাবে চলবে। ওকে তো এবার ছাড়তেই হবে।
আমি ব্যাংক যাই। জমানো পুঁজি নিঃশেষ করে দেওয়ার সংকল্প করি। সুর্মাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে সরানো যাবে না। কে বললো ও আর নেই? একদিন হঠাৎ করে সন্ধ্যেবেলা সূর্যাস্তের কথা শুনে ওর নরম আঙ্গুল দিয়ে আমার হাতের আঙ্গুল জড়িয়ে ফেলতেও তো পারে? তখন? সেই আক্ষেপ কি আমার হবে না?
(৬)
"জানো সুর্মা, আজ আকাশ বড়ই মেঘলা। সারাদিন তোমার সূর্যের দেখা প্রায় মেলেনি। তবুও আমি আজ গিয়েছিলাম। লেকের ধারে। বসেছিলাম। অপেক্ষায়। তোমার সূর্য কথা রেখেছে। ঠিক সূর্যাস্তের আগে একবার মুখ দেখিয়েছে। আর তারপর... তারপর? তারপর ম্যাজিক। কালো মেঘের ঘনঘটাকে তুচ্ছ করে মুহূর্তে লাল হয়েছে পশ্চিম আকাশ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য সুর্মা। দাঁড়াও, ছবি দেখাই তোমায়।"
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, না?" এই বলে সুর্মা আমার কাঁধে মাথা ঠেকালো। আমি পরম মমতায় ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। সুর্মা বললো, "এবার আমি আসি? অনেকদিন তো হলো। এইবারে আমায় যেতে দাও? প্লিজ? মুক্ত হয়ে উড়তে দাও। ওই সূর্যের কাছে আমি যাবো। ডানা মেলে উড়ে যাবো দূরে, আরো দূরে। এবার আসি?"
আমি কিছু বলতে পারি না। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। আমি দু হাতে ওর মুখ চেপে ধরি। আলতো করে চুম্বন এঁকে দিই ওর কপালে, গালে, ঠোঁটে। ওর দু গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আমার আলিঙ্গন ছাড়িয়ে ও এগিয়ে চলে। হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে। সুদূর দিগন্তের দিকে। এক ঝাঁক পাখি উড়তে থাকে। বাসার দিকে।
(৭)
ফোনের শব্দে ধড়ফড় করে উঠি। বাজতে বাজতে থেমে যায় ফোন। হাতে নিয়ে দেখলাম, হাসপাতাল। জানি ওরা কেন ফোন করেছে। আমি ফোনটা সরিয়ে রাখি বিছানায়। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি। কখন কে জানে চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। এখন বেলা পড়ে এসেছে। পশ্চিমের আকাশে লালচে আভা। পাখিরা করছে কূজন। ফিরছে ঘরের পানে। এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এই সেই অপূর্ব দৃশ্য। আমি আলতো আবছা কণ্ঠে বলি, "বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না? সুর্মা, ভালো থেকো। দেখা হবে কখনো, কোনোখানে... শিগগিরই।"
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না?" আলতো করে আমার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলতো সুর্মা। আমি প্রাণভরে ওই স্পর্শের ওমটুকু শুষে নিতাম। আর ছোট্ট করে মাথা নেড়ে বলতাম, "হুম।" লেকের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা ছিল আমাদের একটা নেশার মতো। সময় পেলেই দুজনে ছুটে আসতাম। সুর্মা ভালোবাসতো সূর্যাস্ত, আর আমি ওকে।
(২)
আজ আবারও আমি এসে বসেছি লেকের ধারের সাদা বেঞ্চে। জলের ওপর অস্তমিত সূর্যের রক্তছটা। প্রকৃতির এক মায়াবিনী ক্যানভাস। দু চোখ মেলে দেখছি এই দৃশ্য। কাল ফিরে গিয়ে সুর্মাকে বলবো। ঠিক যেমন রোজ ওর পাশে বসে ওকে নানান গল্প বলি, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে। সুর্মা দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। নাকে মুখে হাতে গুচ্ছ গুচ্ছ নল। বেডের পাশে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ মনিটর, ওর নিস্তেজ শরীরটার ভাইটাল প্যারামিটার্স মেপে চলেছে প্রতিনিয়ত, বিগত এক বছর ধরে। এক বছর, সেই অভিশপ্ত রাতের এক বছর হয়ে গেল।
(৩)
"সুর্মা, যেয়ো না। আমি একা হয়ে যাবো।" আমি প্রবলভাবে আকুতি জানিয়েছিলাম। সুর্মা ওর সহকর্মীদের সাথে উইকেন্ডে মন্দারমনি যাবে বলেছিল। ওর তেমন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অফিসের ট্রিপ। সেরকম জোর করে না বলতে পারেনি। সারা রাস্তা আমরা হোয়াটসআপে মেসেজে গল্প করে কাটিয়েছি। কখনো ভয়েস নোটও। ওর থেকে পাওয়া আমার শেষ ভয়েস নোটে ও বলেছিল, "এই তো। আমি তো রইলাম। ফোনে আছিই। পাশে আছি। সব সময়।" সহকর্মীরা টি ব্রেকে হাইওয়ের ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন চা খাচ্ছে, সুর্মা আমায় ফোন করছে। আমি ওকে সেদিনের সূর্যাস্তের ছবির বর্ণনা দিচ্ছি। কেমন করে জলাভূমির ওপর লালচে আভা পড়ে সবকিছু সুন্দর করে দিয়েছিল। এক ঝাঁক কাক দিনের শেষে ডানা ঝাপটে ফিরে চলেছিল, বাড়ির দিকে।
আর তখনই, ঠিক তখনই পিছন থেকে আসা একটি ট্রাক, ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারলো সুর্মাদের গাড়িতে। চোখের নিমেষে দুমড়ে মুচড়ে সব শেষ। সূর্যাস্তের রক্তিম আভাকে সরিয়ে মঞ্চ দখল করলো ওর বি পিজিটিভ রক্ত।
(৪)
সুর্মার কঠিন অপারেশন হলো। আমি ওটির বাইরে চুপ করে অপেক্ষা করে রইলাম। একবার বসছি, একবার হাঁটছি। শান্তি স্বস্তি কিচ্ছু পাই না। ডাক্তার এলেন। বললেন অপারেশন সাকসেসফুল। এবার শুধু অপেক্ষা। কতক্ষণে ওর জ্ঞান ফেরে।
(৫)
অপেক্ষা এখনো করছি। এক বছর ধরে। প্রতিদিন নিয়ম করে হাসপাতালে যখন যাই, সুর্মার বন্ধ দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই বুঝি পাতা কেঁপে উঠলো। এই বুঝি ওর নরম ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কোনো শব্দ এলো। আমার হাত দিয়ে ওর কপালের ওপর পড়া নরম কালো চুলের গোছা সরিয়ে দিই। ওর সাথে কথা বলি। সব কিছু জানাই ওকে। অফিসের সমস্যা, বাড়ির হাল, নতুন কোনো সিনেমা, দু কলি গান। কিচ্ছু না, কিচ্ছু বাদ যায় না।
ডাক্তাররা আশা ছেড়েই দিয়েছেন। বলেছেন, সুর্মা নাকি প্র্যাকটিক্যালি মৃত। শুধুমাত্র লাইফ সাপোর্টেই ওর নিশ্বাস পড়ছে। আমায় ওঁরা নিয়মিত বোঝান। আর কদিন? আর কতদিন এরকমভাবে চলবে। ওকে তো এবার ছাড়তেই হবে।
আমি ব্যাংক যাই। জমানো পুঁজি নিঃশেষ করে দেওয়ার সংকল্প করি। সুর্মাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে সরানো যাবে না। কে বললো ও আর নেই? একদিন হঠাৎ করে সন্ধ্যেবেলা সূর্যাস্তের কথা শুনে ওর নরম আঙ্গুল দিয়ে আমার হাতের আঙ্গুল জড়িয়ে ফেলতেও তো পারে? তখন? সেই আক্ষেপ কি আমার হবে না?
(৬)
"জানো সুর্মা, আজ আকাশ বড়ই মেঘলা। সারাদিন তোমার সূর্যের দেখা প্রায় মেলেনি। তবুও আমি আজ গিয়েছিলাম। লেকের ধারে। বসেছিলাম। অপেক্ষায়। তোমার সূর্য কথা রেখেছে। ঠিক সূর্যাস্তের আগে একবার মুখ দেখিয়েছে। আর তারপর... তারপর? তারপর ম্যাজিক। কালো মেঘের ঘনঘটাকে তুচ্ছ করে মুহূর্তে লাল হয়েছে পশ্চিম আকাশ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য সুর্মা। দাঁড়াও, ছবি দেখাই তোমায়।"
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, না?" এই বলে সুর্মা আমার কাঁধে মাথা ঠেকালো। আমি পরম মমতায় ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। সুর্মা বললো, "এবার আমি আসি? অনেকদিন তো হলো। এইবারে আমায় যেতে দাও? প্লিজ? মুক্ত হয়ে উড়তে দাও। ওই সূর্যের কাছে আমি যাবো। ডানা মেলে উড়ে যাবো দূরে, আরো দূরে। এবার আসি?"
আমি কিছু বলতে পারি না। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। আমি দু হাতে ওর মুখ চেপে ধরি। আলতো করে চুম্বন এঁকে দিই ওর কপালে, গালে, ঠোঁটে। ওর দু গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আমার আলিঙ্গন ছাড়িয়ে ও এগিয়ে চলে। হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে। সুদূর দিগন্তের দিকে। এক ঝাঁক পাখি উড়তে থাকে। বাসার দিকে।
(৭)
ফোনের শব্দে ধড়ফড় করে উঠি। বাজতে বাজতে থেমে যায় ফোন। হাতে নিয়ে দেখলাম, হাসপাতাল। জানি ওরা কেন ফোন করেছে। আমি ফোনটা সরিয়ে রাখি বিছানায়। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি। কখন কে জানে চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। এখন বেলা পড়ে এসেছে। পশ্চিমের আকাশে লালচে আভা। পাখিরা করছে কূজন। ফিরছে ঘরের পানে। এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এই সেই অপূর্ব দৃশ্য। আমি আলতো আবছা কণ্ঠে বলি, "বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না? সুর্মা, ভালো থেকো। দেখা হবে কখনো, কোনোখানে... শিগগিরই।"
Subscribe to:
Posts (Atom)