Sunday, December 8, 2019

মডার্ন পেরেন্টিং (১)

অফিসে সাঙ্ঘাতিক কাজের চাপ। লাঞ্চ পর্যন্ত করার সুযোগ পায়নি গার্গী। এরই মধ্যে হঠাৎ মোবাইলে ফোন এলো। বুবুলের স্কুলের নম্বরটা স্ক্রিনে ভেসে উঠতে একটু অবাক হলো বটে। কী হলো, কী কান্ড ঘটালো? রেজাল্ট খারাপ নাকি? পেরেন্টস কল? একটু ইতস্তত করেই ফোনটা ধরলো।
- হ্যালো?
- মিসেস চক্রবর্তী বলছেন?
- হ্যাঁ। বলুন।
- মিসেস চক্রবর্তী, আমি অর্কর ক্লাস টিচার, হেমশীলা।
- হ্যাঁ বলুন ম্যাম।
- মিসেস চক্রবর্তী আপনাকে এখন একটু স্কুলে আসতে হবে।
- এক্ষুণি? কেন? সামথিং আর্জেন্ট?
- এখুনি আসতেই হবে।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। দেখছি।
- দেখছি না। আসুন। আমরা অপেক্ষা করে আছি।
- ওকে।

গেলো আজ কাজের বারোটা বেজে। গার্গী কম্পিউটারে খোলা ডকুমেন্টস সেভ করে ব্যাগ আর গাড়ির চাবি হাতে নিয়ে বেরোয়। বেরোনোর আগে পাশের কিউবিকলের মিসেস ঘোষকে বলে গেল। "দেখি, শমন এলো কেন। যাই।"

স্কুলে পৌঁছে গার্গী হেমশীলাকে ফোন করলো। প্রিন্সিপালের ঘরে ওর ডাক পড়লো। উফ। ওই ঘরটা মোটেই ভালো লাগে না গার্গীর। কেমন ঠান্ডা, স্যাঁতস্যাঁতে পুরোনো আদ্যিকালের ঘর। আর তেমনি আদ্যিকালের চিন্তাধারা প্রিন্সিপালের। আগে একবার এসে ভালো মতো মতানৈক্য হয়েছিল। স্কুলের টিফিন আইটেম মেনু নিয়ে। নাকি নন ভেজ কিচ্ছু আনা যাবে না। ম্যাগি নেওয়া যাবে না। গার্গী ভাবতেই পারে না এসব। ওরা ছোট থেকে বড় হয়ে গেল ম্যাগি স্যান্ডউইচ খেয়ে। আর এদের নাকি এইসব নিয়ম। নেহাৎ সেইবার সাথে শুভ্র ছিল। তাই মাথা গরম করলেও বাড়াবাড়ি হয়নি। আজ কে জানে কপালে কী আছে। শুভ্রও আজ কলকাতায় নেই। শান্ত হও গার্গী, শান্ত হও। নিজেকে বারবার বলতে থাকে গার্গী।

হন্তদন্ত হয়ে প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে পড়ে গার্গী। গুড আফটারনুন উইশ করে চেয়ার টেনে বসে। প্রিন্সিপাল ঠিক যেন ওই এনিড ব্লাইটনের গল্পের স্ট্রিক্ট দিদিমণি। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, "মিসেস চক্রবর্তী, আপনার ছেলে আজ সাংঘাতিক কান্ড ঘটিয়েছে। ওর ক্লাসমেট সৌকর্যকে প্রচন্ড মারধর করেছে। উই হ্যাড টু ইন্টার্ভিন।" গার্গী চমকে ওঠে। অর্ক শান্ত ছেলে। ও তো সহজে এরকম করার পাত্র না। তা হলে? কী হলো? ও হেমশীলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "ম্যাম, অর্ক কোথায়? ও ঠিক আছে? ওর সাথে কথা বলতে চাই।" হেমশীলা কিছু বলার আগেই প্রিন্সিপাল মাঝখান থেকে বলে দেন, "ইয়েস, অর্ক ইজ ফাইন। ওর সাথে দেখা করবেন। কিন্তু উই মাস্ট ওয়ার্ন ইউ। ইউ হ্যাভ টু টক টু ইয়োর চাইল্ড। সি দ্যাট হি ইজ নট রিপইটিং সাচ এ বিহেভিয়ার।"
গার্গী মাথা নাড়ে। নীচুস্বরে বলে, "সে তো ঠিক আছে। কিন্তু কারণটা কী, জানেন কিছু আপনারা?"
হেমশীলাকে আবারও কিছু বলতে না দিয়ে প্রিন্সিপাল উত্তর দেন, "দেখুন মিসেস চক্রবর্তী, ক্লাস সিক্স সেভেনের বাচ্চাদের আবার কারণ তেমন সিরিয়াস কিছু হয় নাকি। মাস্ট বি সামথিং পেটি। ইউ প্লিজ হ্যান্ডল ইট। এন্ড প্লিজ টেক দিস ওয়ার্নিং সিরিয়াসলি।" গার্গী হ্যাঁ তে মাথা নেড়ে উঠে পড়ে। হেমশীলা ইতিমিধ্যে বাইরে বুবুলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুবুলের চোখে মুখে ভয়। একেই প্রিন্সিপাল টিচারের কাছে বকুনি খেয়েছে। তার উপর পেরেন্টস কল। চুপচাপ, একটা কথাও না বলে ও মায়ের হাত ধরে বেরিয়ে গাড়িতে বসে। গার্গীও কোনো কথা বলে না। পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে সোজা চলে যায় কাছের শপিং মলে। লাঞ্চ হয়নি এখনো।বুবুলেরও মন ভালো নেই। তাই ফুড কোর্টে গিয়ে বুবুলের পছন্দের চিকেন স্যান্ডউইচ মিল্ক শেক আর নিজের জন্য নুডলস অর্ডার করে বসলো। যতক্ষণ না খাবার আসে, গার্গী বুবুলকে এই নিয়ে একটাও কথা বলেনি। বরং স্কুলের হোমওয়ার্ক আসন্ন পরীক্ষার সিলেবাস, এইসব নিয়েই আলোচনা করলো। এতে হলো কী, বুবুল অনেকটাই শান্ত ও নিশ্চিন্ত হলো। ইতিমধ্যে খাবারের ডাক এসে পড়েছে। গার্গী দুই হাতে দুটো ট্রেতে দুজনের খাবার নিয়ে এসে বসলো।খাবারগুলো এত সুন্দর সাজিয়ে সার্ভ করে, ছবি না তুললেই নয়। ছেলের সাথে খাবারের সাথে সেলফি তুললো ও। সোশ্যাল মিডিয়াতে দেবে।
এইবার ও বুবুলের দিকে তাকিয়ে নরমভাবে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যাঁ রে, কী হয়েছিল আজ স্কুলে?"
বুবুল একটু আমতা আমতা করে বললো, "মাম, বিলিভ মি। আমি কিন্তু আগে মারতে চাইনি।"
- কন্টিনিউ।
- সৌকর্য আমায় প্রভোক করে।
- কীভাবে?
- ও আমার ওয়াটার বোতল নিয়ে ফেলে দেয়।
- কেন? হঠাৎ?
- এর আগে ওর সাথে আমার ডোরেমন নিয়ে একটু তর্ক হচ্ছিল। তাই রাগ করে ও আমার বোতলটা নিয়ে ফেলে দেয়।
- তারপর?
- আমি ওকে বললাম, এরকম কেন করলি?
- ও কী বললো?
- ও কিছু বলেনি। জাস্ট হাসলো।
- দেন?
- দেন আই আসকড হিম। বাড়িতে আমি কী বলবো? এরকম ভেঙে গেল যে.. ও বলে সে আমি জানি না।
- আর অমনি তুমি মারলে?
- না না।
-তাহলে?
- আমি ওকে বললাম আমি কিন্তু আন্টিকে বলে দেব।
- বলেছো?
- পরে। তো ও তাতে বললো যে ওসব বলে লাভ নেই। তুই একটা বোতল কিনে নিস। কত টাকা দাম, বলে দিস। টাকাটা দিয়ে দেব।
- বাবাঃ। এত বুকনি!
- ওকে তখন বললাম, এটা মিল্টনের ছিল। অনেক দাম। কোথায় টাকা পাবি?
- ও তখন বললো, পকেট মানি পাই। তোর মত নাকি, পুওর নই।
- বললো, আর অমনি তুমি রেগে গিয়ে মাথা গরম করলে?
- করবো না? এরকম কেন বলবে? আগে তো আমার বোতল ভাঙলো। তারপর পুওর বললো।
- ও পুওর বলায় তোমার কী আসে যায় বুবুল?
- না। কেন বলবে?
- তোমার কি কখনো ফিজ দিতে লেট হয়েছে? স্কুলে টিউশন ক্লাসে যখন যা লেগেছে, পাওনি?
- হ্যাঁ।
- বন্ধুদের জন্মদিনে গিফ্টস দাওনি?
-হুম।
- তোমার বার্থডে সেলিব্রেট হয় না? যখন যা প্রয়োজন, পাওনি?
-হ্যাঁ।
- তাহলে? ও পুওর বললো আর তোমার গায়ে লেগে গেলো?
-হুম।
- নট রাইট। তোমায় যখন তখন যে ইচ্ছে এসে প্রভোক করলেই তুমি যদি এরকম react করো, তাহলে তো স্কুলে টিকতে পারবে না।
- কিন্তু তুমিই তো বলেছো, টু ফাইট বুলিজ।
- এগ্রিড। কিন্তু, ইউ মাস্ট চুজ ইয়োর এনিমিস রাইট। এই যে সৌকর্যর সাথে ফাইট করলে, এতে ও কি শাস্তি পেলো? পেলো না। বাট তুমি বকুনি খেলে। পেরেন্টস কল হলো। তোমার বদনাম হলো।
- তাহলে কী করতাম?
- নেক্সট টাইম এরকম হলে আগে ক্লাসটিচার কে বলবে। দেখো উনি কী বলেন, করেন। আমায়ও বাড়ি এসে বলবে। তারপর আমরা দেখবো।
-হুম।
- যতক্ষণ না তোমায় কেউ ফিজিকালি এটাক করছে, তুমি কোনো মারপিট করবে না। ক্লিয়ার?
-হ্যাঁ।
- আর যেন এর রিপিটেশন না হয়। বুঝেছো?
-বুঝেছি। সরি মা।
-ইট ইজ ওকে। উই লার্ন ফ্রম মিসটেকস। কি
- শিখলাম।
- যাক গে। যা হয়ে গেছে, গেছে। বল, এরপর কী খাবি? Let us have an icecream to raise a toast to our learning today...
- ইয়ে!!!

গার্গী আর বুবুল এগোলো ওদের প্রিয় আইসক্রিম পার্লারের দিকে। গার্গী মনে মনে ভাবে, সত্যিই, কত বদলে গিয়েছে পেরেন্টিং। কত পাল্টেছে মা বাবা ও সন্তানের সমীকরণ।

No comments:

Post a Comment