Sunday, December 29, 2019

হ্যাপি নিউ ইয়ার

হিমাচল প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম কসোল। পাহাড়ের কোলে এই গ্রাম। পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে পার্বতী নদী, আপন মনে। কিছু বছর হলো পর্যটকদের অতি প্রিয় জায়গা হয়েছে কসোল। যার ফলে গ্রামবাসীরা অনেকেই তাই ট্যুরিজমকে করে নিয়েছে জীবিকা। অনেকেই এখন নিজেদের বাড়ির দু তিনটে ঘরকে সাজিয়ে গুছিয়ে হোম -স্টে হিসেবে ভাড়াও দিচ্ছে।

বিশ্বনাথ ভার্মা বয়স সত্তরের ওপর। এক কালে কুলুতে সরকারি হোটেলে ম্যানেজারি কাজ করেছেন। এখন অবসর জীবন কাটাতে গ্রামে ফিরে এসেছেন। স্ত্রী মারা গিয়েছেন বছর দশেক আগেই। এখন ছেলে বৌমা আর নয় বছরের নাতিকে নিয়েই সংসার। ছেলেও বাপের মতোই চাকরি করে, শিমলাতে। নামী হোটেলের খাস বাবুর্চি। নামডাক ভালোই। রোজগারপাতি মন্দ নয়। ছেলের পাঠানো টাকা, নিজের পেনশন এই দিয়েই দিব্যি সংসার চলে যায়। বৌমা লক্ষ্মী নামেও লক্ষ্মী, কাজেও তাই। নিজের হাতে সংসারটা যত্ন করে রেখেছে, গুছিয়ে ঘরকন্না করে। নাতি অর্জুন ঠাকুর্দার ন্যাওটা।

দোতলা কাঠের বাড়ির বারান্দায় এক চিলতে রোদ এসে পড়ে সকাল থেকেই। ঠান্ডা কাটাতে বিশ্বনাথ সকল হতেই সোয়েটার টুপি মোজাতে নিজেকে ভালো করে মুড়ে বসে থাকেন সেই রোদে। রোদের ওমটুকু শুষে নিতে। লক্ষ্মী ঠিক সময়মতো হয় নিজে নয় অর্জুনের হাত দিয়ে নাস্তা, কয়েক কাপ চা পাঠিয়ে দেয় ওপরে। পাশে রাখা পুরোনো টেবিলে ততোধিক পুরোনো রেডিওতে বিবিধ ভারতী চ্যানেলে হিন্দি গান চলতে থাকে। খবরের কাগজ, টুকটাক বই পড়া আর রাস্তা দিয়ে চেনাপরিচিত কেউ গেলে দুটো কথা বলা। এই করতেই সকালটা দিব্যি কেটে যায় বিশ্বনাথের।

আজ অবশ্য রুটিনে একটু ব্যাঘাত ঘটেছে। অন্যন্যদিন যখন ঠিক সকাল আটটার সমাচার প্রভাতী শুরু হয়, তখনই বৌমা দিনের প্রথম চায়ের কাপ এসে পৌঁছে যায় বিশ্বনাথের কাছে। আজ সমাচার শেষ। শুরু হয়ে গিয়েছে স্থানীয় সংবাদ। কিন্তু চায়ের দেখা নেই। অথচ বৌমা তো সেই কোন সকাল থেকে উঠে রান্নাঘরে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। টুকটাক টুংটাং শব্দ পেয়েছেন বিশ্বনাথ। অর্জুনেরও ঘুম কখন ভেঙে গিয়েছে। হুটোপুটি করছে। তাহলে, চাটা এলো না কেন এখনো? একবার হাঁক পাড়বেন? নাকি নিজেই নামবেন? ভাবতে থাকেন বিশ্বমনাথ। বেলা গড়ায়। শিউনাথ, হরকিষেন সবাই কাজেকর্মে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তা থেকে বিশ্বনাথকে হাত জোড় করে প্রভাতী শুভেচ্ছা জানায়।

বিশ্বনাথ ভাবেন, কী হলো ব্যাপারটা, সরেজমিনে দেখতে হবে। লাঠি হাতে টুকটুক করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলেন, ধীরে ধীরে। লাঠি ও পায়ের শব্দ শুনে অর্জুন আর লক্ষ্মী দৌড়ে এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, "কী হলো বাবুজি, আপনি নীচে নামছেন কেন? কিছু সমস্যা?" অর্জুন এগিয়ে এসে দাদুর হাত ধরে ওঁকে নামতে সাহায্য করে। বিশ্বনাথ একটা চেয়ারের ওপর বসেন। একটু হাঁফ ছেড়ে বললেন, "লক্ষ্মী বেটি, আজ চা পাঠালি না? ব্যস্ত?" শুনেই লক্ষ্মী দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখে, ঘড়ির কাঁটা নটা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বেশ লজ্জা পেয়ে জিভ কেটে লক্ষ্মী উত্তর দেয়, " মাফ করবেন বাবুজি। একদম খেয়াল করিনি। আমি এক্ষুণি চায় নাস্তা আনছি। আসলে রান্নাঘরে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম..." বিশ্বনাথ বলেন, "আরে ঠিক আছে। এক আধ দিন হতেই পারে। তুই ধীরে সুস্থে নিজের সুবিধে মতো কর। কিন্তু বল, আজ রান্নাঘরে বিশেষ ব্যস্ততা কেন রে?" লক্ষ্মী মুচকি হেসে উত্তর দেয়, "আপনার মনে নেই বাবুজি? আজ কত তারিখ?" বিশ্বনাথ খানিক চুপ থাকেন। তারপর মনে পড়ে যায়। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, "আরে, আজ তো একত্রিশ। আজ তো বিষ্ণু বেটার আসার কথা। আমি ভুলেই গিয়েছি!" লক্ষ্মী হাসি হাসি মুখে বলে, "হ্যাঁ বাবুজি। ওই জন্যই একটু খাস নাস্তা বানাচ্ছি। ওর তো দশটার বাসে আসার কথা। এসে যাতে ওর সবচেয়ে পসন্দের খাবার পায়, তাই ক্ষীর, পুরি আর সব্জি করছি। আপনাকে গরম গরম ভেজে দিচ্ছি এক্ষুণি। একটু ততক্ষণ চায় বিস্কিট খান।" অর্জুন মাকে হাতে হাতে কাজে সাহায্য করে। ভালো ছেলে তৈরি হয়েছে ও। ও রান্নাঘরের তাক থেকে বিস্কুটের টিন নামিয়ে দাদুর জন্য কয়েকটা মিষ্টি বিস্কুট বের করে প্লেটে সাজায়। লক্ষ্মী চায়ের জল গরম বসায়। বিশ্বনাথ বলেন, "বেটা, তুই আমার জন্য তাড়াহুড়ো করিস না। এই তো চা খাবো। ওষুধটা খেয়ে নেব এরপরেই। তারপর বিষ্ণু এলে একসাথে বসে চারজনে নাস্তা করবো। কী বলিস অর্জুন বেটা?" বিশ্বনাথ হাসিমুখে নাতির পানে চেয়ে থাকেন। লক্ষ্মী "জী ঠিক আছে" বলে ঝটপট কাজে লেগে যায়।

বিশ্বনাথ চায়ের কাপ হাতে বসে থাকেন রান্নাঘরের সামনে দাওয়ায়। সকালের নরম রোদ এসে পড়ে গায়ে। বুড়ো হাড়ে ভালোই আরাম লাগে। আয়েশ করে দেখতে থাকেন সুখের সংসারে। ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানান প্রতিনিয়ত। কামনা করেন পরিবারের সুস্বাস্থ্যের। এমন সময় রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে নাতি অর্জুন। হাতে ছোট্ট বাটিতে একটু ক্ষীর। দাদুর হাতে ধরিয়ে বলে, "মা বললো একটু চেখে দেখতে। মিঠা ঠিক আছে কি না বলো।" বিশ্বনাথ নাতির হাত থেকে বাটি নিয়ে বলেন, "তুমিই বলো দাদুভাই। তুমি খাও।" অর্জুন মাথা নেড়ে বলে, "নাঃ। তুমি খাও। জলদি জলদি খাও। তাহলে একটা সিক্রেট বলবো। বাবা বারণ করেছে বলতে। বলেছে তোমায় সারপ্রাইজ দেবে।" রান্নাঘর থেকে ছেলের কথা শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসে লক্ষ্মী। ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বলে, "আরে আরে, বাবা বলেছে না সিক্রেট। তুই বলে দিলে আর সারপ্রাইজ কী করে হবে?" বিশ্বনাথ বেশ আমোদ পান এতে। হাসিখুশি মুখে বলেন, "কী সিক্রেট বেটি যা বলবি না আমায়?" লক্ষ্মী মাথা নিচু করে বলে, "ও আপনার ছেলে এসে বলবে বলেছে। আমরা বলে দিয়েছি জানলে রাগ করবে।" এই বলে লক্ষ্মী রান্নাঘরে ফেরত যায়। বিশ্বনাথ চামচ করে পায়েসের স্বাদ নেন। আঃ। যেন অমৃত। বৌমাকে রান্নার প্রশংসা জানান। অর্জুন বাটি নিয়ে চলে যায়। বিশ্বনাথ চোখ বুজে রোদের আরাম নেন। ভাবতে থাকেন, কী হতে পারে সারপ্রাইজ। নির্ঘাত ছেলে কোনো বড় চাকরি পেয়েছে। বাঃ। খুব ভালো হয় তাহলে। মাইনে বাড়বে। ইজ্জত বাড়বে। অর্জুন বড় হচ্ছে। খরচা বাড়ছে সংসারের। বিষ্ণু যদি এর মধ্যে ভালো চাকরি পায়, খুব আনন্দের। তবে একটাই আক্ষেপ। হয়তো আরো দূরে চলে যেতে হবে। এখন যেমন মাসে একবার আসে, তখন হয়তো সেটা কমে যাবে। মন কেমন করে বিশ্বনাথের। যত বয়স বাড়ছে, তত যেন বেশি করে পরিবারকে আঁকড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সব সময় মনে হয়, সব্বাই মিলে একসাথে থাকতে পারলে, কী ভালোই না হতো।

সোয়া দশটার দিকে হইহই করে বিষ্ণু বাড়ি ফেরে। অর্জুন তো বাবাকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। এই ঘর ওই ঘর দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ি মাত করে ফেলে ও মুহূর্তেই। লক্ষ্মীর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক স্পষ্ট। হবেই তো। কত মাস পরে বাড়ি এলো বিষ্ণু। সেই পনেরই আগস্টের পর একবার এসেছিল। তারপর আর ছুটি পায়নি। এই সময়টা ঘোর টুরিস্টের মরসুম। হোটেলে মেলা কাজ। তাই ছুটিও বিরল। বিষ্ণু এসে তার বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কুশলবার্তা জানতে চায়। বাবুজির পায়ের ব্যথা, হাঁপানি সব কেমন আছে, ওষুধে কাজ হচ্ছে কি না, সব। লক্ষ্মী তাড়া দেয় এর মধ্যে, "গরম জল করে দিয়েছি। আপনি হাত মুখ ধুয়ে আসুন শিগগিরই। একসাথে নাস্তা করবো সবাই। বাবুজি না খেয়ে বসে আছেন। আপনার অপেক্ষায়।" বিষ্ণু বাবাকে বলে, "কেন বাবুজি? তুমি খেয়ে নাওনি কেন? এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে হয়?" বিশ্বনাথ ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন, "বেটা, এই তো একদিনই এরকম করছি। কতদিন পর দেখা হলো। একসাথে খাই। সব্বাই মিলে। ভালো লাগে।"

বিষ্ণু তড়িঘড়ি পোশাক পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে নীচে চলে আসে। লক্ষ্মী ইতিমধ্যে খাবার বেড়ে রেখেছে। অনেকদিন পর সপরিবারে একসাথে খেতে বসা। গরম গরম পুরি ক্ষীর পেয়ে বিষ্ণু খুব খুশি। অর্জুনও এতদিন পর বাবার সান্নিধ্য পেয়ে মহানন্দে। বিশ্বনাথ পুরির টুকরো মুখে পুরে বলেন, "হ্যাঁ রে অর্জুন। তুই যে বললি তোর বাপ কী সিক্রেট সারপ্রাইজ দেবে আমায়, কই, এখনো কিছু বুঝলাম না তো?" বিষ্ণু ক্ষীরের চামচ চেটে নামিয়ে বাবার দিকে তাকায়। বলে, "সত্যিই কিছু বোঝোনি?" বিশ্বনাথ অবাক হয়ে বলেন, "কই না তো। কী?" বিষ্ণু এইবার একবার লক্ষ্মী, একবার অর্জুনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তারপর বাবার দিকে ফিরে বলে, "দেখলে না এই এত লটবহর নিয়ে ফিরলাম? সব মালপত্র নিয়ে চলে এলাম। বাবা, চাকরিটা ছেড়েই দিয়েছি। আর তোমাদের ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। পারছিলামও না।" হতভম্ব বিশ্বনাথ ভেবে পান না কী বলবেন। খানিক চুপ করে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করেন, "তাহলে? এরপর?" বিষ্ণু উত্তর দেয়, "অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম। তোমার আমার যা অভিজ্ঞতা ট্যুরিজম নিয়ে, আর লক্ষ্মীর যা হাতযশ, কসোলের হোম-স্টে ব্যবসায় আমরাও নেমে পড়ি। নাকি?" বিশ্বনাথ বলেন, "কিন্তু তার জন্য তো অনেক ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। পারমিশনের ব্যাপারও আছে। সেগুলো?" বিষ্ণু বলে, "এক মিনিট", উঠে হাত ধুয়ে ব্যাগ থেকে বের করে একটা গোলাপি ফাইল। ওপরে জ্বলজ্বল করছে লেখা, "ভার্মা এন্ড সন হোম-স্টে, কসোল"। বিশ্বনাথের হাতে ধরিয়ে বলে, "এই যে। সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। নতুন বছরে এটাই তোমাকে আমার গিফট। ঠিক যেমন তুমি আমায় দিতে, ছোট থেকে?"

বিশ্বনাথ আনন্দে বিহ্বল। কী বলবে, কিচ্ছু বোঝে না। আনন্দে আত্মহারা। দুই চোখ ছলছল করে আনন্দে। আজ উনি এক গর্বিত পিতা। সপরিবারে একসাথে থাকার এই যে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা, এর চেয়ে ভালো নববর্ষের উপহার বুঝি আর কিচ্ছুটি হয় না। সত্যিই আজ "হ্যাপি নিউ ইয়ার।"

No comments:

Post a Comment