Friday, December 6, 2019

সূর্যাস্ত

(১)
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না?" আলতো করে আমার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বলতো সুর্মা। আমি প্রাণভরে ওই স্পর্শের ওমটুকু শুষে নিতাম। আর ছোট্ট করে মাথা নেড়ে বলতাম, "হুম।" লেকের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখা ছিল আমাদের একটা নেশার মতো। সময় পেলেই দুজনে ছুটে আসতাম। সুর্মা ভালোবাসতো সূর্যাস্ত, আর আমি ওকে।

(২)
আজ আবারও আমি এসে বসেছি লেকের ধারের সাদা বেঞ্চে। জলের ওপর অস্তমিত সূর্যের রক্তছটা। প্রকৃতির এক মায়াবিনী ক্যানভাস। দু চোখ মেলে দেখছি এই দৃশ্য। কাল ফিরে গিয়ে সুর্মাকে বলবো। ঠিক যেমন রোজ ওর পাশে বসে ওকে নানান গল্প বলি, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে। সুর্মা দুচোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। নাকে মুখে হাতে গুচ্ছ গুচ্ছ নল। বেডের পাশে রাখা গুচ্ছ গুচ্ছ মনিটর, ওর নিস্তেজ শরীরটার ভাইটাল প্যারামিটার্স মেপে চলেছে প্রতিনিয়ত, বিগত এক বছর ধরে। এক বছর, সেই অভিশপ্ত রাতের এক বছর হয়ে গেল।

(৩)
"সুর্মা, যেয়ো না। আমি একা হয়ে যাবো।" আমি প্রবলভাবে আকুতি জানিয়েছিলাম। সুর্মা ওর সহকর্মীদের সাথে উইকেন্ডে মন্দারমনি যাবে বলেছিল। ওর তেমন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অফিসের ট্রিপ। সেরকম জোর করে না বলতে পারেনি। সারা রাস্তা আমরা হোয়াটসআপে মেসেজে গল্প করে কাটিয়েছি। কখনো ভয়েস নোটও। ওর থেকে পাওয়া আমার শেষ ভয়েস নোটে ও বলেছিল, "এই তো। আমি তো রইলাম। ফোনে আছিই। পাশে আছি। সব সময়।" সহকর্মীরা টি ব্রেকে হাইওয়ের ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যখন চা খাচ্ছে, সুর্মা আমায় ফোন করছে। আমি ওকে সেদিনের সূর্যাস্তের ছবির বর্ণনা দিচ্ছি। কেমন করে জলাভূমির ওপর লালচে আভা পড়ে সবকিছু সুন্দর করে দিয়েছিল। এক ঝাঁক কাক দিনের শেষে ডানা ঝাপটে ফিরে চলেছিল, বাড়ির দিকে।
আর তখনই, ঠিক তখনই পিছন থেকে আসা একটি ট্রাক, ব্রেক ফেল করে ধাক্কা মারলো সুর্মাদের গাড়িতে। চোখের নিমেষে দুমড়ে মুচড়ে সব শেষ। সূর্যাস্তের রক্তিম আভাকে সরিয়ে মঞ্চ দখল করলো ওর বি পিজিটিভ রক্ত।

(৪)
সুর্মার কঠিন অপারেশন হলো। আমি ওটির বাইরে চুপ করে অপেক্ষা করে রইলাম। একবার বসছি, একবার হাঁটছি। শান্তি স্বস্তি কিচ্ছু পাই না। ডাক্তার এলেন। বললেন অপারেশন সাকসেসফুল। এবার শুধু অপেক্ষা। কতক্ষণে ওর জ্ঞান ফেরে।

(৫)
অপেক্ষা এখনো করছি। এক বছর ধরে। প্রতিদিন নিয়ম করে হাসপাতালে যখন যাই, সুর্মার বন্ধ দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই বুঝি পাতা কেঁপে উঠলো। এই বুঝি ওর নরম ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কোনো শব্দ এলো। আমার হাত দিয়ে ওর কপালের ওপর পড়া নরম কালো চুলের গোছা সরিয়ে দিই। ওর সাথে কথা বলি। সব কিছু জানাই ওকে। অফিসের সমস্যা, বাড়ির হাল, নতুন কোনো সিনেমা, দু কলি গান। কিচ্ছু না, কিচ্ছু বাদ যায় না।
ডাক্তাররা আশা ছেড়েই দিয়েছেন। বলেছেন, সুর্মা নাকি প্র্যাকটিক্যালি মৃত। শুধুমাত্র লাইফ সাপোর্টেই ওর নিশ্বাস পড়ছে। আমায় ওঁরা নিয়মিত বোঝান। আর কদিন? আর কতদিন এরকমভাবে চলবে। ওকে তো এবার ছাড়তেই হবে।
আমি ব্যাংক যাই। জমানো পুঁজি নিঃশেষ করে দেওয়ার সংকল্প করি। সুর্মাকে লাইফ সাপোর্ট থেকে সরানো যাবে না। কে বললো ও আর নেই? একদিন হঠাৎ করে সন্ধ্যেবেলা সূর্যাস্তের কথা শুনে ওর নরম আঙ্গুল দিয়ে আমার হাতের আঙ্গুল জড়িয়ে ফেলতেও তো পারে? তখন? সেই আক্ষেপ কি আমার হবে না?

(৬)
"জানো সুর্মা, আজ আকাশ বড়ই মেঘলা। সারাদিন তোমার সূর্যের দেখা প্রায় মেলেনি। তবুও আমি আজ গিয়েছিলাম। লেকের ধারে। বসেছিলাম। অপেক্ষায়। তোমার সূর্য কথা রেখেছে। ঠিক সূর্যাস্তের আগে একবার মুখ দেখিয়েছে। আর তারপর... তারপর? তারপর ম্যাজিক। কালো মেঘের ঘনঘটাকে তুচ্ছ করে মুহূর্তে লাল হয়েছে পশ্চিম আকাশ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য সুর্মা। দাঁড়াও, ছবি দেখাই তোমায়।"
"বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, না?" এই বলে সুর্মা আমার কাঁধে মাথা ঠেকালো। আমি পরম মমতায় ওর চুলে বিলি কাটতে লাগলাম। সুর্মা বললো, "এবার আমি আসি? অনেকদিন তো হলো। এইবারে আমায় যেতে দাও? প্লিজ? মুক্ত হয়ে উড়তে দাও। ওই সূর্যের কাছে আমি যাবো। ডানা মেলে উড়ে যাবো দূরে, আরো দূরে। এবার আসি?"
আমি কিছু বলতে পারি না। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে। ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। আমি দু হাতে ওর মুখ চেপে ধরি। আলতো করে চুম্বন এঁকে দিই ওর কপালে, গালে, ঠোঁটে। ওর দু গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আমার আলিঙ্গন ছাড়িয়ে ও এগিয়ে চলে। হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে। সুদূর দিগন্তের দিকে। এক ঝাঁক পাখি উড়তে থাকে। বাসার দিকে।

(৭)
ফোনের শব্দে ধড়ফড় করে উঠি। বাজতে বাজতে থেমে যায় ফোন। হাতে নিয়ে দেখলাম, হাসপাতাল। জানি ওরা কেন ফোন করেছে। আমি ফোনটা সরিয়ে রাখি বিছানায়। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি। কখন কে জানে চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিল। এখন বেলা পড়ে এসেছে। পশ্চিমের আকাশে লালচে আভা। পাখিরা করছে কূজন। ফিরছে ঘরের পানে। এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এই সেই অপূর্ব দৃশ্য। আমি আলতো আবছা কণ্ঠে বলি, "বিকেলের এই পড়ন্ত সূর্যের আলোটা কী মায়াবী, তাই না? সুর্মা, ভালো থেকো। দেখা হবে কখনো, কোনোখানে... শিগগিরই।"

No comments:

Post a Comment