Wednesday, December 11, 2019

মডার্ন পেরেন্টিং (৩)
সুচেতনা

কে জানে কী মনে হতে স্কুলের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটা খুলল রিমঝিম। স্কুল বলতে, মেয়ে রুনির স্কুলের। রুনির সবে ক্লাস ওয়ান। বাড়ির কাছেই নামকরা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। বম্বেতে এটাই নিয়ম। স্কুল হতে হবে বাড়ির কাছাকাছি। এই জিনিসটা রিমঝিমের ভারী পছন্দ। কলকাতায় থাকতে নিজের বন্ধুদের তো কত দেখেছে, সেই দমদম, সল্ট লেক থেকে যাদবপুর আসতো নামী স্কুলে পড়বে বলে, বা সেই বেহালা থেকে আসতে হতো বালিগঞ্জ। কম কষ্ট নাকি বাচ্চাদের? এখন দিনকাল কত পালটে গিয়েছে। আগে যেমন ওই স্কুলের বাইরে ভিড় করে থাকা বাবা মায়েরা, বিশেষ করে মায়েরা জটলা পাকিয়ে স্কুলের শেষে হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার সিলেবাস, টিউশন ক্লাসের হদিস পেতো, এখন সেইসব হয় ভার্চ্যুয়ালি। whatsapp গ্রুপে চ্যাটে। রিমঝিম দেখলো, আজ নাকি অনেকের ডায়েরিতে নোটিস পড়েছে। পেরেন্টস কল। কে জানে, রুনিরও হলো কি না। বাড়ি ফিরে দেখতে হবে। যা দস্যি মেয়ে।
দস্যি বটে, তবে একদিক দিয়ে রিমঝিম মনে মনে মেয়েকে নিয়ে খুব খুশি। স্কুলে ইতিমধ্যেই গুড টাচ ব্যাড টাচ নিয়ে শিখিয়ে তো দিয়েছে। মা হিসেবেও রিমঝিম ওর দায়িত্ব পালন করেছে। নিজে একটা ছুটির দিনে বসে ভালো করে যত্ন সহকারে মেয়েকে ভালো মন্দ বলেছে। আর সাথে এটাও বলেছে, কেউ কখনো "হার্ট" করতে গেলেই তাইকন্ডো ক্লাসে শেখা কয়েকটা ডেমো দিয়ে দিতে। তাহলে আর সহজে ঘাঁটতে পারবে না। রুনি কিন্তু মায়ের বাধ্য মেয়ে। স্কুলে এরপর বার দুইয়েক স্পোর্টস চলাকালীন ক্লাসের কিছু দুষ্টু ছেলে ওর পিছনে লাগছিলো, দিয়েছে দুই ঘা। রিমঝিম মনে মনে বেশ প্রাউড ফিল করে। যেমন দিন পড়েছে, তেমন করেই মানুষ করতে হবে।
বাড়ি ফিরে রিমঝিম অবাক। মানতুদির কাছে শুনলো, রুনি নীচে খেলতে যায়নি। স্কুল থেকে ফিরেছে বেশ চুপচাপ। খাওয়া নিয়ে রোজের মতো একটুও ঝামেলা পাকায়নি। খুঁটে খুঁটে অল্প একটু খেয়ে উঠে গিয়েছে। টিভিও চালায়নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। রিমঝিম শুনে বেশ চিন্তিত হলো। কী ব্যাপার, মেয়ের এরকম আমূল পরিবর্তন কেন? জানতে ওকে হবেই। ও হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট রুনির ঘরে গেল। মেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কোলবালিশ আঁকড়ে শুয়ে। গাল বেয়ে চোখের জল, শুকিয়ে দাগ হয়ে গিয়েছে। আহা রে, মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কী হলো? রিমঝিম একটু ভয় পায়। দিনকাল এত খারাপ। শিউরে ওঠে। রুনির কোনো ক্ষতি হলো না তো? সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকতে হয়।
রিমঝিম স্নেহের বশে মেয়েকে জাপ্টে ওর পাশে শুয়ে পড়ে। মাথায় হাত বোলাতে থাকে। মেয়ের ভয় কাটিয়ে ওর কথা শুনতে হবে। দেখতে হবে কী সমস্যা হয়েছে ওর। মায়ের স্পর্শে রুনির ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলর ড্যাবড্যাব করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্ষণিকের ভেবলে যাওয়াটা কাটিয়ে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। শান্ত করার চেষ্টা করে। স্নেহের সাথে বলে, "কাঁদে না সোনা। বলো আমায়, কী হয়েছে?" রুনি কান্না বন্ধ করার কোনো চেষ্টাই করেনা। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে তুলতে যা বলে, তার সারমর্ম এই। ওর ক্লাসের এক বন্ধু, অঙ্কিত নাকি ওকে আজ টিফিন ব্রেকে ওর হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওকে বলেছে, "আমি তোকে খুব ভালোবাসি। আজ থেকে তুই আমার গার্লফ্রেন্ড আর আমি তোর বয়ফ্রেন্ড। অন্য কোনো ছেলের সাথে আর কথা বলবি না।" এই বলে নাকি আবার রুনির গালে চুমু খেয়েছে। রুনি নিজেকে বাঁচাতে অবশ্য অঙ্কিতকে ধরে দিয়েছে পেটে একটা ঘুঁষি। কিন্তু ভীষণভাবে বিড়ম্বিত। ও কিছুতেই আর অঙ্কিতের সাথে কথা বলতে চায় না।
রিমঝিম হতভম্ব। এইটুকু বাচ্চা। এরা আবার প্রেম ভালোবাসা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড এসবের কী বোঝে? যত আজেবাজে সিরিয়াল সিনেমার প্রকোপ। কেন যে বাবা মায়ের যা খুশি টিভিতে দেখতে দেয় এদের। রুনিকে শান্ত করে। বলে, " আমি অঙ্কিতের মাকে বলবো। এরকম আর রিপিট হবে না। গ্লোরিয়া মিসকেও বলবো কালকেই। তুমি চিন্তা করো না মাম্মাম। আর রিপিট হবে না। কিন্তু বাই চান্স যদি হয়, ডু ওয়াট ইউ ডিড টুডে। কেউ তোমায় অস্বস্তিতে ফেললেই সেলফ ডিফেন্স যা শিখেছো, এপ্লাই করবে। আর হ্যাঁ, কান্নাকাটি তুমি করবে না মা একদম। দোষ যে করেছে, সে অঙ্কিত। নট ইউ। হি শুড বি এশেমড অফ হিমসেলফ। হি শুড বি পিনালাইজড। বুঝেছো?"
রুনি মাথা নাড়ে। রিমঝিম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সাময়িক মিটমাট। কিন্তু কাল অবশ্যই ক্লাস টিচারকে জানাতে হবে। আর খানিকক্ষণ পর, অঙ্কিতের মাকে। ক্লাস ওয়ানের বাচ্চারাও নাকি প্রপোজ করছে। ভাবা যায়? আর এদিকে ওকে পুরো কলেজ লাইফ অবধি হা পিত্যেস করে থাকতে হলো, কবে সুমিত ওকে প্রপোজ করবে। হা ঈশ্বর।

No comments:

Post a Comment