Monday, December 9, 2019

মডার্ন পেরেন্টিং (২)

"নিজের বই কোথায় ফেলে আসো, খেয়াল থাকে না কেন?" এই বলে রুকুর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারলো পিউ। রুকু কাঁদলো না। তবে মুখটা কাঁচুমাচু করে চলে গেল নিজের ঘরে।

অফিস টাইমে এই ভিড় মেট্রো চেপে ফিরতে ফিরতে একেই মাথা গরম হয়ে থাকে। তার ওপর এই যদি ফিরে এসেই শুনতে হয় আগামী সপ্তাহে যে সাবজেক্টের পরীক্ষা, তার বই হারিয়েছে ছেলে, মেজাজ সামলে রাখা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে বটে। পিউয়ের খারাপ লাগে। আজকাল বড্ড মেজাজ হারাচ্ছে। কারণে অকারণে বকুনি দিচ্ছে রুকুকে। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে সামলাতে, পারে না।

হিন্দি সাবজেক্টটা নিয়ে এমনিই হিমশিম খায় ওরা মা ছেলেতে। অনেক কষ্টে বন্ধু বান্ধবদের ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে নানান কাঠখড় পুড়িয়ে তবে কিনা সমস্ত সিলেবাস শেষ করিয়েছিল। যত ওয়ার্ক শিট, সব সলভ করিয়েছিল। আর এখন, পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে যদি রুকু এসে বলে যে বইটা খুঁজে পাচ্ছে না, কী করে চলে? হ্যাঁ, বাধ্য হয়ে, নিরুপায় হয়ে নতুন আরেকটা বই কিনে আনতে হবে ঠিকই। কিন্তু ওই সলিউশনগুলো? পিউ নিজে বরাবর হিন্দিতে কাঁচা। কখন ওই করেগা আর কখন করেগি, এই নিয়ে চিরকাল জেরবার। আবার ওই অফিসের সৌরভকে ধরতে হবে। এমনিতেই ওকে তেমন পছন্দ নয় পিউয়ের। কিন্তু কী আর করা, হিন্দি মাদার টাং। ও ছাড়া এই লাস্ট মোমেন্টে কেই বা হেল্প করবে। ভাবছে সামনের বছর থেকে একটা টিউটর রাখবে হিন্দির জন্য। ওর পক্ষে এই জোড়াতাপ্পি দিয়ে চালানো বেশ কঠিন।
রুকুর মুখটা ভেবে মায়া হলো পিউয়ের। ওর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো, অঙ্ক খাতা নিয়ে বসেছে। যাক অন্তত একটা বকুনি খেয়ে বাকি আর কিছুর জন্য বকতে হয়নি। এমনিই নিজে থেকেই বসে গিয়েছে পড়তে। হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো পিউ। ফ্রিজ থেকে একটু চিকেন সিদ্ধ বের করলো। অল্প পিঁয়াজ ক্যাপসিকাম কেটে ফ্রায়িং প্যানে দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটা টস কারি গোছের রেঁধে ফেললো। ব্রেড টোস্ট করে তাতে হালকা চিজ মাখিয়ে মা ও ছেলে, দুজনের জন্য চিকেন এন্ড টোস্ট নিয়ে রুকুর ঘরে এলো। রুকু পিউয়ের পায়ের শব্দে মাথা তুললো, কিছু না বলে আবার অঙ্ক খাতায় মনোনিবেশ করলো। পিউ ওর সামনে টেবিল পেতে তাতে দুজনের প্লেট রেখে রুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, "সরি। তখন পুরো ঘটনা না শুনে তোকে মারা উচিত হয়নি আমার। খেয়ে নে।"
রুকু পেন্সিল নীচে নামিয়ে রাখলো। খাতা খোলা। মায়ের হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে বললো, "মা, সত্যি বলছি। আমার মনে নেই আমি কোথায় রেখেছি বইটা।"
পিউ বললো, "সে তো বুঝলাম। কিন্তু মনে না করলে খুঁজে পাবে কী করে বলো? পরীক্ষাতে কী করবে?"
রুকু উত্তর বলে, "মা, অবিনাশকে ফোন করবো? ওর বইটা যদি ও লেন্ড করে। তুমি জেরক্স করে নেবে।"
পিউ খেতে খেতে মাথা নাড়লো। তারপর বলল, "আচ্ছা, অবিনাশকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ না। ওর বইয়ের সাথে চলে যায় নি তো? পাশাপাশি বসিস।" রুকু শুনে একটু মাথা নাড়লো। হুম। হতেই পারে। একসাথেই তো ওরা বসে। বইপত্র সব এক টেবিলে থাকে। ও বলে, "মা, তুমি আন্টির নম্বরে কল করো একবার। আমি বলি।"
পিউ মোবাইল বের করে। অবিনাশের মায়ের ফোনে কল করে। অবিনাশ কোচিং ক্লাসে গিয়েছে। তাই পিউই ওর মাকে বলে, "মিসেস বসু, আমার ছেলের হিন্দি বইটা খুঁজে পাচ্ছি না। একবার প্লিজ দেখবেন অবিনাশের ব্যাগে ওর বইয়ের সাথে চলে গিয়েছে কি না?" উল্টোদিক থেকে ঝাঁঝালো উত্তর আসে, "অবি কেন স্বস্তিকের বই নিয়ে আসবে?"
পিউ একটু নরম স্বরেই বলে, "না না, সেটা না। আসলে ওরা পাশাপাশি বসে। তাই ভাব্লাম। বাই মিস্টেক... যাই হোক, আপনি প্লিজ দেখবেন। আই এম শিয়োর, থাকলে আপনি ফেরত পাঠিয়ে দেবেন। খুবই উপকার হয়।" অবিনাশের মা একটু ঠান্ডা গলায় বলে, "হুম। ঠিক আছে। ও ক্লাস থেকে ফিরুক। আমি দেখবো।" এই বলে ফোন ছেড়ে দেয়। পিউ আর বই জেরক্সের কথা বলতে পারে না। রুকুকে বলে, "শোন, একজ্যামের এখন ওয়ান উইক বাকি। একটু দেখ কাল অবিনাশ আনে কি না। আর পরশু তো স্কুলে লস্ট প্রপার্টি আছে। দেখ অপেক্ষা করে। যদি পাস। নইলে আমি ব্যবস্থা করছি। হয় নতুন বই, নয় কারুর থেকে জেরক্স। মিসেস বসুকে তো মনে হল না কথা শুনে যে বই ধার দেবে। আমাকেই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।"
রুকু প্লেট রেখে হাত মুখ ধুয়ে এসে অঙ্ক খাতা নিয়ে বসলো। পিউ সাংসারিক কাজে মন দিলো।

পরের  দিন স্বাভাবিকভাবেই রুকু স্কুলে গেলো। পিউ ওকে একবার মনে করিয়ে দিলো, অবিনাশকে বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে। বিকেলে ফিরে রুকু জানালো, অবিনাশ বএলছে, ওর কাছে বই নেই। লস্ট প্রপার্টির জন্য এখন আর একদিন অপেক্ষা।
লস্ট প্রপার্টিতেও বই পাওয়া গেলো না। পিউ এবার একটু চিন্তিত। বই জেরক্স কেউ কি আদৌ করতে দেবে? অবিনাশের মাকেই কি বলবে? দ্বিধা করতে থাকে। স্কুলে আর তো কেউ নেই। এই বছর সেকশন চেঞ্জ হয়ে যাওয়ায় কারুর ফোন নম্বর নেই পিউয়ের কাছে। একবার কি তাহলে কাল স্কুলের পর হিন্দি মিসের সাথে দেখা করবে? নতুন বই নিয়ে গেলে যদি একটু হেল্প করে দেন? সেই আশা অবশ্য কম। এইসব টিচাররা যে যার প্রাইভেট টিউশানি করতে এতই ব্যস্ত। প্রাইভেট স্কুলের হাইফাই ব্যাপার। পিউ কিছুতেই মেলাতে পারে না এইসব, নিজের শৈশবের সাথে। ওরাও  তো ভালো স্কুলে পড়েছে, মাঝেসাঝে কামাইও হয়েছে। সব সময় তো বন্ধুরা সাহায্য করেছে। পিউয়ের মনে পড়ে, ওর যখন ক্লাস সেভেন, সেবার সেকেন্ড টার্মের ঠিক আগে ওর সে কী টায়ফয়েড। স্কুলের মিস, ক্লাসের বন্ধুরা সব্বাই মিলে ওকে নোটস বানিয়ে দিত। আর এখন কে জানে এত কম্পিটিশন কেন।

রুকুর স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে পিউ। রুকুর ডায়েরিতে ও লিখে দিয়েছিল, হিন্দি মিসের সাথে দেখা করার কথা। যদি উনি হ্যাঁ বলেন, তাহলে দেখা করবে। রুকু বেরিয়েই এক গাল হাসি হেসে মাকে বলল, "মা, আর মিসের সাথে দেখা করতে হবে না। হিন্দি বইটা আমি পেয়ে গিয়েছি।"
পিউ খানিক অবাক হয়েই বলল, "তাই? বাহ। ভালো তো। তা পেলি কোথায়?"
রুকু হেসে বলল, "অবিনাশের কাছেই ছিল। ওর ব্যাগের ভিতর। ও বলল, এই কদিন নাকি ও খেয়াল করেনি। আমি বলেছিলাম না মা? ওর ব্যাগেই নিশ্চয়ই চলে গিয়েছে। আমি হারাইনি?"
পিউ আর কিছু বলেনা। রুকুর হাত ধরে রাস্তা পার হয়। উল্টো দিকে অটোর লম্বা লাইন। তাড়াতাড়ি না গেলে সেখানেও ভিড় হবে। সর্বত্র কম্পিটিশন, র‍্যাট রেস। ভাল্লাগেনা।

বাড়ি ফিরে রুকুকে পড়তে বসিয়ে কী জানি কী মনে হতে পিউ হিন্দি বইটা খোলে। উলটে পালটে দেখতে গিয়ে একটা ছোট্ট চিরকুট বেরিয়ে পড়ে। অচেনা হাতের লেখায় কিছু পেজ নম্বর লেখা। আর সাথে লেখা, 'এক কপি'। কৌতূহলবশত ওই পাতাগুলোতে যায় পিউ। গত টার্মের সিলেবাসের কঠিনতম চ্যাপ্টারগুলি। কত কাঠখড় পুড়িয়ে যা সল্ভ করেছিল পিউ। সেইগুলিই জেরক্স হয়েছে। হঠাৎ করেই পুরো ঘটনাটা বুঝতে পারে পিউ। শিউরে ওঠে। এই র‍্যাট রেসে এমনভাবে ছেলে মেয়েগুলোও নেমে পড়লো? কী দিনকাল। কীসব পেরেন্টিং...

No comments:

Post a Comment