পার্ক
হাঁপানির কষ্টটা শীতকালে ভীষণ জ্বালায়। তাই মর্নিং ওয়াকে প্রতিমা বেরোন একটু বেলা করেই। তা প্রায় আটটা বেজেই যায়। ততক্ষণে অবশ্য সেন্ট্রাল পার্কের বাকি মর্নিং ওয়াকারের দল প্রায় সবাই ফিরে যান, বা ফেরার পথে। প্রতিমা রিটায়ার্ড। পার্ক লাগোয়া ফ্ল্যাটে একা থাকেন। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি বৌমা জামাই প্রত্যেকেই দেশে বিদেশে যে যার মতো আছে, প্রতিমার এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা। মর্নিং ওয়াকে এসে কিছু বন্ধু বান্ধবী জুটিয়ে ফেলেছেন। তাঁরাও প্রায় ওঁরই মতোই। ঝাড়া হাত পা। হোয়াটসআপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানেই রোজ লেখালিখি চলে। সময় মিলিয়ে বেরিয়ে পড়েন প্রত্যেকেই। একইসাথে হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম চলে। তারপর খানিকক্ষণ বসে গল্প। এরপর আস্তে আস্তে টুকটুক করে যে যার নিজের নিজের ডেরায় ফেরা।
আজ অবশ্য প্রতিমা আর শ্যমলবাবু ছাড়া আর কেউ নেই। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ বেড়াতে গিয়েছে, কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়েছে, ছেলে মেয়েদের কাছে। আবার কয়েকজন অসুস্থ। শীতকালের সিজন চেঞ্জে কাবু। শ্যমলবাবু ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ছিলেন। প্রতিমাও ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরি করেছেন। কাজেই দুজনের কথার বিষয়ের অভাব কখনোই হয় না। এমন কি, দুজনেরই বেশ ভালোই লাগে একে অপরের উপস্থিতি। বাকিদের চেয়ে একটু বেশিই যেন একে অপরের সাথে কথা বলতে মনের খোরাক পায়। সাম্প্রতিক বাজারের পিঁয়াজের মহার্ঘ্য অবস্থার কথাই আলোচনা করছিলেন দুজনে, হাতে মাটির ভাঁড়ে গরম চা। পার্কের চার পাক হেঁটে এই চা যেন বড়ই আরামের। আয়েশ করে চায়ের ভাঁড়ে এক চুমুক দিয়ে সবে শ্যমলবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় প্রতিমা হাত তুলে ইশারায় ওঁকে থামতে বললেন। শ্যমলবাবু একটু অবাক। কী হলো, জানতে চাইলেন। প্রতিমা ওঁকে চুপ করে বসে একটু কান পাততে বললেন। শ্যামলবাবু এবার কান খাড়া করলেন। এবং তারপরেই শুনতে পেলেন। ওঁদের বসার জায়গা থেকে একটু দূরেই বসে আছে এক যুবক যুবতী। দেখে মনে হয় সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। পরনে ওই জিন্স টিশার্ট আর জ্যাকেট। পিঠে ব্যাকপ্যাক। একটু উত্তেজিত দুজনেই, তাই কথাবার্তা চলছে উচ্চস্বরেই।
- শোন, এই লাস্ট মোমেন্টে এসে এরকম কিন্তু কিন্তু করলে কী করে হবে?
- না মানে...
- না মানে কী?
- ভয় করছে।
- ভয়? কীসের ভয়?
- বাড়ির থেকে যদি জানতে পারে..
- জানলে জানবে।
- জানলে জানবে আবার কী?
- মানেটা খুব সিম্পল। আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। আমরা দুইজনেই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আমাদের ভালো মন্দ নিয়ে। কাজেই আমরা যদি মনে করি আমরা একসাথে কোথাও বেড়াতে যাবো, এতে কীসের যে এত ভয় পাচ্ছ তুমি, আমি জাস্ট বুঝছি না।
- আরে, বাড়িতে নাইটস্টের কথা বলবো কী করে?
- কী আবার, বলবি ক্লাসের পিকনিক। তাজপুর। আমি বলবো কিছু বন্ধুদের কথা। সিম্পল। ওরা জানবে আমরা তাজপুর যাচ্ছি। সেটা সত্যিই। কিন্তু কার সাথে, সেটা জাস্ট চেপে যাবো। তাহলেই হলো। ওরা তো কেউ গোয়েন্দা লাগাতে যাবে না রে বাবা
- তুমি জানো না। আমার বাবা খুব স্ট্রিক্ট।
- ডি ডি এল জের অমৃশ পুরীর মতো?
- কয়েক ধাপ বেশি।
- তাহলে তো আরো ভালো। বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। (সুর করে) লে জায়েঙ্গে লে জায়েঙ্গে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে।
- তুমি সবেতেই বড্ড ইয়ার্কি করো।
- আর তুই সবেতেই এক্সট্রা টেনশন নিয়ে নিস।
- কী করবো। ছোট থেকে বাড়িতে যেরকম ভাবে বড় হয়েছি...
- ওই হলো, গেল আমাদের যাওয়া। এত কষ্ট করে সব প্ল্যান করলাম। তুই ভেস্তে দিলি।
- সরি। কিন্তু সত্যি বলছি। আমিই তাল তুলেছিলাম বটে। কিন্তু, দেখো, বাড়িতে পারমিশন পাবো না। উল্টে এর পরে বেরোতে গেলে হয়তো সন্দেহ করে নজরদারি শুরু হবে। তার চেয়ে যেমন চলছে চলুক...
- মানে এই কলেজের নামে এই পার্ক ওই মল?
- হুম। আপাতত। তারপর তুমি আর আমি দুজনে নিজের পায়ে দাঁড়াই। ব্যস। একদম নির্ভয়ে বাড়িতে বলে বুক ফুলিয়ে বেরোতে পারবো।
- বেশ। তাহলে নিউ সী হক ক্যানসেল। চলো, অন্তত সাগরদ্বীপে যকের ধন দেখি। দেখি, কটার শো।
- চলো, যাওয়া যাক।
প্রতিমা আর শ্যামল লক্ষ্য করে, এই দুই যুবক যুবতী কিঞ্চিৎ বিমর্ষচিত্তে এগিয়ে যায়। শ্যামল প্রতিমার দিকে তাকিয়ে বলেন, "কী বুঝলেন?"
প্রতিমা হেসে উত্তর দেয়, "কড়া বাপ মা যুগে যুগে প্রেমে ভিলেন হয়েই রইলো। আর কী!"
শ্যামল আর প্রতিমা দুজনেই হো হো করে হাসে খানিকক্ষণ। তারপর হাসির দমক একটু কম হতে শ্যমলবাবু প্রতিমার দিকে ফিরে বেশ একটা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললেন, "তা, আমাদের দুজনেরই জীবনে ভিলেন বলতে কেউ নেই। আমাদেরও ভিলেনের পার্ট প্লে করা হয়ে গিয়েছে। আমরা দুজন তা হলে সী হকে যাবো নাকি? মালিকের একটা বুকিং ক্যানসেল হয়ে গেল। ভাবলেও খারাপ লাগে।" মিথ্যে কাঁচুমাচু মুখ করে আর কতক্ষণই বা থাকা যায়? ফিক করে হেসে ফেললেন। প্রতিমাও কপট রাগ পুষে না রেখে হেসে উত্তর দিলেন, "ও, পেটে পেটে এতদূর? তা চলুন। ঘুরেই আসি।"
No comments:
Post a Comment