অনেকদিন পর এত বেলা করে ঘুম ভাঙল রেবার। অথচ কী আশ্চর্য, কোনদিকে তেমনভাবে কোনো ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি কিচ্ছুটি টের পাচ্ছে না ও। হলো টা কি? অন্যদিন তো সকাল থেকে এমনিতেই এই স্নেহালয় এপার্টমেন্টে হয় হট্টগোল লেগেই থাকে। সাতটার মধ্যেই ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে কাজের লোকেরা চলে আসে। উঠোন ঝাঁট দেওয়ার ওই কর্কশ শব্দ, বাসনের ঝংকার, বাড়ির ছেলেদের "কই গো, বাজারের ফর্দ দাও", মায়েদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর ব্যস্ততা। দোতলার ফ্ল্যাটে বেডরুমে শুয়ে শুয়ে প্রতিদিন রেবার ঘুম ভেঙে যায় ওই শব্দে। এমনিতে রেবার সারা রাত ঘুম আসে না, ওষুধ খেয়েও। ভোরের দিকেই যা একটু চোখে ঘুম নেমে আসে, তবে প্রত্যেকদিন এই ভোরের আওয়াজ মেলায় বিচ্ছিরি ভাবে ঘুম ভাঙে ওর। আর ব্যস, সারাদিন মাথা ধরে থাকা। এই নিয়ে সারাদিন গজগজ গজগজ করতে থাকে রেবা। "ঈশ্বর, কালা করে দাও না আমায়। আর এই এত আওয়াজ, সহ্য করতে পারিনা।"
রেবা বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গেলো। ব্যাপারটা কী, বুঝতে। দেখলো, বাহাদুর সিং এপার্টমেন্টের উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে, রাজু বিশ্বাসদের গাড়ি ধুচ্ছে। বাসন্তী হড়বড় করে গেট ঠেলে ঢুকলো এই মাত্র। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটুও শব্দ নেই কেন? অন্যদিন এই গেটের আওয়াজের ঠ্যালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায়। জলের বালতি দুবার উল্টায়। আজকে যেন মনে হচ্ছে, টিভি দেখছে, মিউট করে। অবাক হয় রেবা। কানের কোনো সমস্যা হলো নাকি? বার কয়েক কান খোঁচায়, ইয়ার বাড বের করে। তাতেও কিছু উপকার হয়না। অদ্ভুত ব্যাপার।
দিন গড়াতে থাকে। রেবার অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়না। ছেলে মেয়েরা বারবার ফোন করে করে সাড়া পায়না। হোয়াটসআপে মেসেজ পেয়ে তাদের শান্ত করে রেবা, কিন্তু ঘটনাটা কিচ্ছু জানায়না। আজ আবার বড়দিন। ডাক্তার বদ্যিও পাবেনা। কাল ই এন টি দেখাবে স্থির করে রেবা। সারাদিন নিজের মতো কাজ নিয়ে থাকে। মন্দ কাটেনা শব্দবিহীন। বেশ যেন স্তব্ধতা, শান্তি। বই পড়ে ঘরের কাজ করে দিন কাটে। শুধু একটাই আক্ষেপ, ক্রিসমাস ক্যারল শোনা হলো না ওর। ফোনেও গল্প হলো না। নাতি নাতনীদর মিষ্টি কলকাকলিও শোনা হয়না। রাত্রে শোয়ার আগে রেবা ভাবতে বসে, সারাদিন কেমন গেল। মন্দ নয়, কিন্তু এই কি ভালো? একটুও শব্দ নেই, পাখির গান নেই, রেডিওর বকবক নেই, রোজের জীবন যেন নীরস। নাঃ, ঘুম হয়তো ভালো হবে, বা হবে না। কিন্তু দিন মোটেই ভালো যায়নি। কে জানে, কাল ডাক্তার কী বলেন। ভাবতে ভাবতে রেবা শুয়ে পড়ে। রাত্রে স্বপ্নে স্যানটা বুড়ো হাজির। হাসিমুখে বলে, "কী? খুব তো শখ ছিল কালা হওয়ার, ভালো লাগেনি তো? কাল সকালে উঠে দেখবে সব আবার আগেরমত। আর হ্যাঁ, বুঝেশুনে উইশ করো। বুঝলে রেবারানী?"
No comments:
Post a Comment