উপহার বুঝি এমন একটা জিনিস যেটা পেতে এবং দিতে, দুইই ভালো লাগে। কাউকে কোন উপলক্ষ্যে বা এমন কী, কারণ ছাড়াই উপহার দিতে ইচ্ছে হলে, অনেক ভেবেচিন্তে দিই, তাঁর কী ভালো লাগতে পারে, কাজে লাগতে পারে, ইত্যাদি ভাবনাচিন্তা করেই। নিজেও তাই যখন পাই, একটা আশা থাকে যে অনেক ভাবনা চিন্তা করেই কেউ আমায়ও দেবে। অনেকেই দেন, আবার অনেকেই সেই একঘেয়ে স্টোনডাস্টের মূর্তি বা পার্কার পেন দিয়ে কাজ সাড়েন। যদিও কেউ হয়তো ওই মূর্তির শিল্পকলা খুবই ভালোবাসেন, আমি অবশ্য চারুকলা বিষয়ে এক্কেবারে আকাট মূর্খ। তাই হাজার চেষ্টা করেও উপহারের মর্যাদা দিতে পারিনা যথাযথ। এই মুহূর্তে বসে আমার সবচেয়ে পছন্দের উপহার বলতে গেলে বলব বই। গোগ্রাসে গিলে ফেলতে পারি। যত পাবো, তত ভালো। আশ মিটবেনা। আমার পাওয়া কিছু উপহারের কথা বলি এই প্রসঙ্গে।
প্রথম মুখ দেখা, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে ঠাকুমা দিদিমা মাসির কাছ থেকে পেয়েছি কিছু সোনার গয়না। তখন সেগুলোর তেমন কিছু বুঝতাম না। এখনো বুঝিনা বিশেষ। শুধু পুরনো দিনের সোনা আর কিছু সাবেকি ডিজাইন বলে দেখতে ভালো লাগে। থাকে তো সেই লকারেই।
যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন জন্মদিনে মাসি আমায় একটা টাইমেক্সের ঘড়ি দিয়েছিল। ওই প্রথম রিষ্ট ওয়াচ। সেই থেকে,হাতঘড়ির ওপর দুর্বলতা শুরু। ঘড়ি পরে রোজ স্কুলে যেতাম। ওই ঘড়িটা পরে মাধ্যমিক পরীক্ষাও দিই। একটা কালো সিন্থেটিক ব্যান্ডের ওপর কালো গোল ডায়ালের ঘড়ি। ইলেভেনে উঠতে জন্মদিনে বাবা মায়ের থেকে পেলাম তখনকার স্টাইল আইকন, একটি ফাস্ট ট্র্যাক ঘড়ি। সেই ঘড়ি আমি বোধহয় গত বছর অবধি ব্যবহার করেছি। দারুণ টেকসই ছিল।
ক্লাস এইট। ফাইনাল পরীক্ষায় রেজাল্ট আনতে গিয়েছি। বাবা বাইরে অপেক্ষা করছে পেট্রোল পাম্পে। গেট থেকে বেরোলাম হাসিমুখে। বাবা জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে। আমি শুধু হাসিমুখে তর্জনী দেখালাম। অর্থাৎ কিনা, প্রথম হয়েছি ক্লাসে। বাবা তখন সদ্য এটিএম কার্ড ব্যবহার শুরু করেছে। পাশেই একটা আইসিয়াইসিয়াই বা এইচডিএফসি কিছুর এটিএম থেকে একশো টাকা তুলে আমায় উপহার দিলো। সে কী আনন্দ আমার!
মনে পড়ে গেল, কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে থাকাকালীন বোস ইন্সটিটিউতে ক্যুইজ কম্পিটিশন হয়েছিল। আমরা সেকেন্ড হয়েছিলাম। আমাদের তখন ডিপারট্মেন্টাল হেড, উডিতা দি, ভীষণ খুশী হয়ে খামে ভরে একশো টাকা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন "যা ইচ্ছে কিনে নিয়ো। আমার পক্ষে তো সম্ভব হয়নি।" দিদি উইলচেয়ারেই যাতায়াত করতেন, চলাফেরায় ছিল অনেক অসুবিধে। তবুও সেই প্রতিবন্ধকতাকে বাঁধা হতে না দিয়ে ঠিক আমাদের জন্য উপহার এনেছিলেন মনে করে, বিরাট প্রাপ্তি। ওই টাকাটি আজও খরচা করিনি। সযত্নে তুলে রেখেছি।
এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেটিরিয়ালিস্টিক উপহার পেয়েছি। কখনো জন্মদিনে, কখনো রেজাল্ট ভালো করলে, ইত্যাদি। ইলেভেনে উঠলে ক্যালকুলেটর লাগবে বলে সেই বছর জন্মদিনে মা সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটর দিয়েছিল। সযত্নে রয়েছে। বড় হওয়ার সাথে সাথে যেন উপহারগুলো অনেকটা দরকার, তাই কিনতে হবে, জন্মদিন আসছে, তাহলে জন্মদিনের উপহার হোক, এই ভাবে কেনা। রিসার্চ শুরু করার পর এক্সটারনাল হার্ড ডিস্ক কেনার খুব দরকার থাকায়, জন্মদিনে মা বাবা এক টিবির হার্ড ডিস্ক দিল। সে বছর আমি কিনলাম একটি কিন্ডল। হস্টেলে বই রাখার জায়গা নেই। তাই এই অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা।
টাকা উপার্জন করতে শুরু করার পর আমি নিজেও নিজেকে বেশ কিছু পছন্দসই উপহার দিয়েছি। কন্টেন্ট রাইটিং করে টাকা জমিয়ে প্রথম স্মার্ট ফোন কিনি। সেই সাথে কিনি একটি নিকন কুলপিক্স ক্যামেরা। দুটোই পি এইচ ডি এডমিশন পাওয়ার আনন্দে কেনা। সেই বছরই জন্মদিনে আবার নিজেকে একটি টাইটান রাগা উপহার দিই। তখন সায়েন্স কলেজের স্কলারশিপের সামান্য টাকা বাঁচিয়ে ওইটা কিনতে পারার মধ্যে সে কী আনন্দ।
পি এইচ ডির স্টাইপেন্ড পাওয়ার পর থেকে উপহার দেওয়ার বহর বেড়েছে। এখন দরকার অদরকারে মাঝে মাঝেই নিজেকে বিভিন্ন বই উপহার দিই। ব্যাগ কিনি। সুগন্ধী কিনি। গত বছর নিজেকে একটা ডি এস এল আর আর আরেকটা ঘড়ি (আমার প্রিয় রোজ গোল্ড) উপহার দিয়েছি। উপলক্ষয় বানিয়ে নিই ঠিকই।
আচ্ছা, এবারে একটু নন-মেটিরিয়ালিস্টিক কিছু উপহারের কথা বলি?
বাবা মায়ের কথা আসবেই আসবে এই প্রসঙ্গে। সারা জীবন তাদের ভালোবাসা পেয়েছি, সহযোগিতা পেয়েছি প্রতিমুহূর্তে। এর চেয়ে বড় উপহার কী হতে পারে? যে বছর বি এস সি পরীক্ষায় জঘন্য রেজাল্ট করলাম, সাঙ্ঘাতিকভাবে মুষড়ে পড়েছি। বাবা মায়ের আমার ওপর ভরসা ছিল ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ উপহার। জানতাম যে কেউ থাকুক না থাকুক, তারা আছেই। আর তাদের জন্যই আমায় ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মনোবল পেতাম তাদের ভরসায়। বাবা বেশী করে আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে দিত। সব সময় প্রেরণা পেয়েছি।
যখনই মন খারাপ করে, সেই খারাপ লাগা গুলো শেয়ার করে মন হাল্কা করাটা তো খুব দরকার। সেটা করার জন্য কিছু খুব কাছের মানুষেরা আছে আমার জীবনে। তাদেরই একজনের সাথে গতকাল কথা হচ্ছিল। কিছুদিন আগে হঠাৎ করে বিশ্রী একটা ডিপ্রেশন গ্রাস করেছিল আমায়। তখন রাত জেগে কথা বলে অনেকটা আরাম পাই। আর কাল তার সাথে কথা প্রসঙ্গে একটা ভারি দামী কথা শুনলাম। " এই যে, তোমায় সক্কলে এত ভালোবাসে। আর এদিকে রাত বিরেতে তোমার মন খারাপ হয়। উল্টোপাল্টা চিন্তা করো। এরকম করবে না। জেনে রেখো, আর কেউ কী ভাবল না ভাবল, পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমরা থাকি না কেন, সব সময় এই একজন আছেই যে তোমায় সব সময় ভালবাসবে আর তোমার কথা ভাববে।" (একটু প্যারাফ্রেজ করলাম, কিন্তু বক্তব্যটা এটাই।) এর চেয়ে ভালো কিছু কী হয়?
No comments:
Post a Comment