মামার অভাবের সংসারে বড় হওয়া মেয়ে শ্যামলী। বাবার মৃত্যুর পর মা মেয়ের ঠাই হয়েছিল এই সংসারে কেবলমাত্র দিদিমার কৃপায়। খুব একটা সুখে তো বড় হয়ইনি শ্যামলী, সাচ্ছ্বল্য কাকে বলে, তা বুঝতেই পারেনি। মা দিন রাত দাদার সংসারে কায়িক পরিশ্রম করে নিজেদের খরচা দিত। শ্যামলীও একদম চুপচাপ থাকত, কোনদিনও কোন সখ আহ্লাদের কথা মুখেও আনেনি। সরকারী স্কুলে কোনোমতে টুয়েলভ পাস করতে না করতেই মামীর তাড়াহুড়োয় বিয়ে হয়ে গেল ওর কৃষ্ণকান্তর সাথে। মা বা মেয়ে কেউই বারণ করতে সাহস পায়নি। কৃষ্ণকান্তও বাপ মা মরা ছেলে। কাকার সংসারে মানুষ। তবে কপাল জোরে লেখাপড়ায় মাথা ছিল ভালো, তাই স্কলারশিপ পেয়ে বি এ পাস করে এখন গ্রামের সরকারী স্কুলের এসিস্টেন্ট টিচার। বয়সে দশ বারো বছরের ছোট মেয়েটিকে যখন বিয়ে করে নিজের ছোট্ট বাড়িতে আনেন, বড় মায়া পড়ে যায় ওর ওপর। নিজের তেমনভাবে সখ আহ্লাদ কোনদিনও মেটেনি বলে শ্যামলীর অবস্থাটাও ভালোই আন্দাজ করতে পারতেন। আর তাই, ফুলসজ্জার দিনেই কথা দেন স্ত্রীকে। সমস্ত সখ আহ্লাদ পূরণ করবেন।
শ্যামলী মুখচোরা মেয়ে। একেই ছোট থেকে চুপচাপ যেটুকু লোকের দয়ায় পায়, তাই দিয়ে কাজ চালিয়ে মানুষ। তার ওপর বয়সের পার্থক্য। স্বামী বহুবার জিজ্ঞেস করলেও কিছুতেই মুখ খোলেনি নিজের চাহিদা বা আবদারের কথা বলতে। রান্নাঘরে বসে তরকারি যখন কড়াইতে ফুটতে থাকে, তখন যে গুনগুন করে গান গায়, ইচ্ছে তো করতোই মামাতো বোন চিনুর মত হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইবে। গলাও ভালো। স্কুলে তো প্রতিবার প্রাইজ পেত শ্যামলী। কিন্তু বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে সেই সব রুদ্ধ। তাই সারাদিন একলা বাড়িতে রেডিয়োতে নতুন পুরনো গান শুনে নিজের মনে গুনগুন করে কাটিয়েই বেশ চলছিল। কোন কোন দিন অবশ্য কৃষ্ণকান্ত বাড়ি এসে চা চাইতে গিয়েছে, সাড়া পায়নি। কী হল, কোথায় গেলো, দেখতে গিয়ে দেখেন রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে রেডিয়োর সাথে তাল মিলিয়ে মনের আনন্দে গান গাইছে শ্যামলী। দুই চোখ বন্ধ। কী নিষ্ঠা। ওই তন্ময়ী রূপ দেখে ওকে তখন থামাতে ইচ্ছেই করেনি। গান থামতে "বাহ, ভারী সুন্দর গলা তো তোমার। গান গাও না কেন আরো?" শুনে লজ্জা পেয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায় শ্যামলী।
আজ দোসরা ফাল্গুন। বিয়ের সময়ে কুষ্ঠি দেখে কৃষ্ণকান্ত জানতে পারে ওইদিন শ্যামলীর জন্মদিন। রোজের মতোই স্কুলে বেরিয়ে যান কৃষ্ণকান্ত। সবে দুপুরের খাবারের থালা বাসন ধুয়ে রান্নাঘর গুছিয়ে শ্যামলী একটু শুতে যাবে, এমন সময় শুনতে পেল স্বামীর হাঁকডাক। "কই গো, কোথায় গেলে? একবার এসো বাইরে।" শ্যামলী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে রিকশা থেকে একটা মাঝারি মাপের কাঠের বাক্স নামাচ্ছেন তার স্বামী। "এই নাও, জন্মদিনের উপহার। এই হারমোনিয়াম। আজ থেকে তুমি গলা ছেড়ে গান গাইবে। আর বিধু মাস্টারকে বলে এসছি। এবার থেকে রবিবারগুলো সকালে তুমি ওনার ক্লাসে যাবে। গান শিখবে।"
আনন্দে আপ্লুত অভিভূত শ্যামলী ঢিপ করে স্বামীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল আর বলল, "আমার আরেকটা আবদার আছে। যদি পূরণ হয়। আমায় কলেজে ভর্তি করে দেবে? আমার লেখাপড়া করারও খুব ইচ্ছা।"
" অবশ্যই। এ ভারি ভালো কথা। আমি কালকেই যাব, খোঁজখবর নিতে। শিক্ষার চেয়ে ভালো উপহার আর কিছু হয় না কি?"
No comments:
Post a Comment