Saturday, March 3, 2018

ভালোবাসাবাসি ২

"আমি না তোকে খুব ভালোবাসি। তুইও কী বাসিস?" এক্সেল শিটে টাকাপয়সার হিসেব করতে বসে দোয়েলের প্রশ্নে একটু অবাকই হয়েছিল নীল। এ আবার কেমন প্রশ্ন, নীল আর দোয়েল তো সেই কোন ছোট্টবেলার বন্ধু, গলায় গলায় ভাব, "পারটনারস ইন ক্রাইম" গোছের। দোয়েল বরাবরই একটু গেছো ধরণের, অনেকটা কুছ কুছ হোতা হ্যায়তে প্রথমার্ধে কাজলের চরিত্রের মত। তার কাছ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে, তাও হঠাৎই কলেজ ফেস্টের মিটিং করতে গিয়ে, একদম ভাবতেই পারেনি। একটু থতমত খেয়ে নীল বলেছিল, "এ আবার কী প্রশ্ন? বেস্ট ফ্রেন্ড না তুই আমার? তোকে তো ভালবাসবোই।" দোয়েল কিচ্ছু বলেনি, হাল্কা হেসে কোনরকমে সেদিনের মত কাজ শেষ করে চলে গিয়েছিল। এরপর ফেস্টের নানান কাজের ব্যস্ততার অছিলায় আর পরে ফাইনাল পরীক্ষা, কোচিং ক্লাস সব মিলিয়ে নীল আর দোয়েলের একসাথে তেমন ভাবে আর কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। ক্যাটে ভালো রেজাল্ট করে দুজনেই এম বি এ পড়তে চলে গেল এদিক সেদিক, একজন শিলং, আরেকজন রাঁচি। যোগাযোগটা রয়ে গিয়েছিল কেবলমাত্র ফেসবুকেই।
পড়া শেষ, তারপর শুরু হল চাকরিজীবন। কপাল জোরে দুজনেই পোস্টিং পেলো চেন্নাইতে। মাঝে ঝিমিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বটাও পেলো নতুন অক্সিজেন। সপ্তাহান্তে দেখাসাক্ষাৎ, সিনেমা, রেস্টুরেন্ট। কখনো বা লঙ উইকেন্ডে পন্ডিচেরি বা ইয়ারকাড। দিব্যি চলছিল।  তবুও কোথায় যেনসব আগের মত হয়েও যেন ঠিক তা না। দোয়েল এখন অনেক হিসেবি। হাসলে চোখের কোণে ভাঁজ পড়েনা, হাসতে হাসতে পেটে ব্যথাই করেনা। খুনসুটি তো ভুলেই গিয়েছে! নীলও ঘাঁটায় না। বন্ধুত্বের মধ্যে একটা ব্যর্থ প্রেমের প্রচেষ্টা এসে গেলে যেন কেমন তাল কাটা, বেসুরো হয়ে যায় গোটা ব্যাপারটাই। আগের মত সেই প্রাণখোলা ভাবটাই যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।
কর্পোরেট জীবনে নিঃশ্বাস ফেলার জো নেই, দুজনের যোগাযোগও একটু কমেছে। প্রায় মাস খানেকের ওপর কথাবার্তা হয়নি দুজনের। হঠাৎ দোয়েলের ফোনে একটা ছোট্ট মেসেজ ঢুকল, "কেমন আছিস রে? আমি তো গত সাত দিন ধরে গৃহবন্দী। জ্বর।" দোয়েল অনেকদিন পর একটু ফুরসৎ পেয়ে ওর রঙের সরঞ্জাম নিয়ে সবে বসেছিল, বহু সপ্তাহ আগে এঁকে রাখা একটা ছবিতে রঙ বাকি। নীলের মেসেজ পেয়ে সব ফেলে কোনক্রমে চুলে চিরুনি চালিয়ে, হ্যান্ডব্যাগ আর ফোন সাথে নিয়ে দৌড়ে নীচে নেমে অটো ধরল। "আন্না, পেরাঙ্গুডি।"
ট্রাফিক জ্যাম পেরিয়ে যখন রাত্তির দশটা নাগাদ দোয়েল পৌঁছল নীলের বাড়ি, ভয়ে চিন্তায় ও তখন ঠকঠক করে কাঁপছে।  দুবার বেল বাজানোর পর দরজার ওপারে দেখল নীলকে। অবিন্যস্ত চুল, মুখে কদিনের না কাটা দাড়ি। কপালে হাত দিয়ে জোর ছ্যাঁকা খেয়ে "আগে জানাতে পারিসনি হতভাগা?" বলে নীলের বুকের ওপর মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠল দোয়েল।
"আচ্ছা, হয়েছে। ঠিক আছি আমি। তুই থাম এবার।"
"জ্বরে গা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে। ওষুধ খেয়েছিস?"
"হুম, সবে। সময় লাগবে। ডাক্তার বলেছেন, চিন্তার কারন নেই। ভাইরাল।"
পরম যত্ন সহকারে এরপর দোয়েল নীলের কপালে জলপট্টি দিয়ে ওর জ্বরটা নামাল। আরাম পেয়ে নীলের দু চোখ জুড়ে এলো রাজ্যের ঘুম। ঘুমন্ত নীলের মুখে এক অপার শান্তির হাসি, পরম পরিতৃপ্তি। দোয়েল নীলের খাটের পাশেই বসে রাতটা কাটাবে ঠিক করল। কোন এক সময়ে ওর দু চোখেও নেমে এসেছিল ঘুম। ভোরের আলো ফুটতে চোখ মেলে উঠতে গিয়ে দোয়েল খেয়াল করল, নীল শক্ত করে ওর হাতটা নিজের মুঠোর ভিতর রেখেছে। ছাড়াতে গেলে টের পেল, পারছেনা। নীলের দিকে তাকাতে দেখল, ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখে সেই আগের মত দুষ্টু হাসি।
"কী রে, ছাড় হাতটা। উঠতে দে।"
"দেবো, আগে একটা কথার উত্তর দে?"
"কী?"
"তুই কী এখনো আমায় ভালোবাসিস?"
দোয়েলের মুখে নেমে আসে বিশাদের ছাপ। কিচু বলেনা উত্তরে।
"বল না প্লীজ?"
"নীল, অনেকগুলো বছর পার হয়ে গিয়েছে। এখনো?"
"আমি তো সেটাই জানতে চাইছি দোয়েল, এখনো?"
"যদি বলি না?"
"তাহলে ইমিডিয়েটলি বই লেখা শুরু করবো। দ্য বিগেস্ট রিগ্রেট ইন মাই লাইফ নাম দিয়ে।"  
"আর যদি বলি হ্যাঁ?"
"বলেই দেখ না!"
"বেশ, এবারের মত বই লেখা থেকে নিস্তার।"
"আমি একটা মস্ত বড় ইডিয়ট। গাধার মত চোখের সামনে থাকা হীরে ফেলে আমি নুড়ি পাথর কুড়োচ্ছিলাম এতদিন। অনেক হয়েছে, আর ছেড়ে যাস না আমায়। প্লীজ? থাকবি তো? আর হ্যাঁ, ক্ষমা করিস এ কবছরের জন্য। আমি একটা মর্কট।"
"হ্যাঁ, সে আর বলতে!"
"কী? আমি মর্কট?"
"ও মা তুই নিজেই তো এক্ষুনি বললি!"
..................

ওদের খুনসুটি, হাসি, পিলো ফাইটের তুলো সব মিলিয়ে তখন আকাশ বাতাস মুখরিত।  

No comments:

Post a Comment