আমার রবিবার
রবিবার মানেই মনে পড়ে যায় অনেক ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে রিক্সা চেপে গীতালি আন্টির নাচের স্কুলে যাওয়া। কী জঘন্যই না লাগত বাবা রে। ওই সক্কাল সক্কাল কত্থকের বোলের তালে তালে নাচা। একদম ভালো লাগত না।
এরপরে নাচের ব্যাপারে আমার চরম অনীহা টের পেয়ে মা বাবা ভাবলেন মেয়েকে তাহলে নাচ থেকে মুক্তি দেওয়াই যায়। আমি ভাবলাম বুঝি যাক বাঁচা গেলো। রবিবার, আনন্দে কাটবে। টিভিতে মহাভারত, স্কুল ডেজ দেখা যাবে। ও মা, সে কপালে নেই। বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ি। তাঁরা ঠিক করলেন, আঁকার স্কুলে ভর্তি করবেন। ব্যস, শুরু হল বাড়ির কাছেই, বকুল আর্ট স্কুলে প্রত্যেক রবিবার আঁকার ক্লাস। সেও যেতে ভালো লাগত না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম। রিক্সা করে যদি পিউ যেত, তাহলে আমি যেতাম। নইলে ডুব! কিছু মাসের মধ্যে অবশ্য সেখান থেকেও মুক্তি পেয়েছিলাম। তবে রবিবারে মানেই কিছু না কিছুর টিউশান লেগেই থাকতো।
সেই টিউশান ক্লাস শুরু হয়েছিল ক্লাস নাইন থেকে। চলল টুয়েলভ অবধি। লাইফ সায়েন্স ক্লাস। শুরু হতো সকাল নটায়, চলতো একটা দেড়টা অবধি। যদিও ক্লাস করতে খুবই ভালো লাগত, তবুও সকাল সকাল ব্রেকফাস্টে কয়েকটা লুচি দিয়ে ছোলার ডাল খেয়ে এসে সাড়ে বারোটার পর থেকে পেট চুঁইচুঁই করতে লাগত। তার ওপর মাথার মধ্যে ঘুরত, বাড়ি গিয়ে মাংসের ঝোল ভাত রয়েছে। সেই সব মাথায় নিয়ে কী আর ফটোসিন্থেসিস, রেস্পিরেশন, গ্রোথ, এসব মাথায় ঢোকে?
রবিবার মানেই ভালো খাবার। ব্রেকফাস্টে অন্যদিন যখন পাউরুটি মাখন আর সাথে অম্লেট নয়তো সন্দেশ, তখন রবিবার স্পেশাল। মায়ের সাথে হাতে হাতে লুচি বেলা আর ভাজা। মনে আছে, আমার একটা নিজস্ব ছোট্ট বাটি ছিল, ওটাতেই আমার জন্য ছোলার ডাল বা ঘুগনি যাই হতো না কেন, সেটাতে পরিবেশন করা হত। এখনো বাড়ি গেলে তাতেই হয়। দুপুরবেলা মাংসের ঝোল ভাত যেন ম্যান্ডেটরি। প্রেশার কুকারে মা বানাতেন, আলু আর কাঁচা পেঁপে দিয়ে পাতলা ঝোল। প্রেশারের ঢাকনা খুললেই একটা বিটকেল গন্ধ বেরোত, ঠাকুমা বলতেন "বাথ্রুমের গন্ধ"। বিকেল হলে বাবাকে রাজি করিয়ে পাড়ার রোলের দোকান (সে দোকান কখনো আবার খাবো, কখনো তাঞ্জোর, কখনো জায়ন জেস্ট) থেকে ঝাল ঝাল প্রচুর কাঁচা পিঁয়াজ দেওয়া আর অনেকটা টমেটো আর চিলি সস দেওয়া এগ রোল খাওয়া। সন্ধ্যেবেলা সেসব খেয়ে অবধারিতভাবেই রাত্রে কম খিদে। আর তাই অল্প করে একটু ভাত আর সাথে সকালের বানানো মাংসের এক টুকরো আর ঝোল। কখনো কখনো আবার রবিবার বিকেলগুলো যেতাম পিউদের বাড়ি। ওর সাথে খেলতাম। ওর ঠাকুমার ঘরে, খাটের পাশে বসে, বারান্দায় চলতো আমাদের লুকোচুরি খেলা, রান্নাবাটিও। ওদের তখন কেবিল টিভি। কখনো বসে টিভিও দেখতাম। জানিনা কেন, তবুও খালি মনে আছে, রাজু চাচা সিনেমাটা দেখেছিলাম খানিকটা। ওর বাবা চিকেন পকোড়া আনতেন আমাদের জন্য, সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
ইলেভেন টুয়েলভে উঠে টিউশানের বহর বাড়ল। সকালের লাইফ সায়েন্স টিউশান তো ছিলই। তার সাথে যোগ হল বিকেলবেলা করে পাথফাইন্ডারে গিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রিপারেশন নেওয়া। সেই সব দিন, ওরে বাবা। ভাবলেই ভয় লাগে। প্রত্যেক রবিবার গিয়ে পরীক্ষা দেওয়া। তার সাথে সাথে আগেরদিনের পরীক্ষার নম্বর পাওয়া। সেই ঝুলিতে বেশিরভাগ দিনই মাইনাসে নম্বর। সেই সব খাতা লুকিয়ে রাখা। গ্রেড শিট ব্যাগের কোণে ফেলে রাখা। রবিবার মানে যেন তখন লুকোচুপি।
ভাগ্যিস তারপর রবিবারগুলো আর টিউশন থাকত না। তখন সারা দুপুর লম্বা ভাতঘুম দিয়ে বিকেল চারটে বাজলে ডি ডি বাংলা চালিয়ে সাদা কালোতে উত্তম সুচিত্রা দেখার পালা। সুপারহিট মুকাব্লা দেখতাম। দেখতাম স্কুল ডেজ, কেন জানিনা শক্তিমান দেখার তেমনভাবে কখনোই ইচ্ছে হতনা। পরবর্তীকালে বাড়িতে যখন কেবিল এলো (আমার বি এস সি তে ভর্তির পর), তখন সারা দিন সাব টিভিতে তারক মেহতা কা উলটা চশমা দেখা। সে নেশা এখনো আছে। কলকাতায় থাকাকালীন এরপর রবিবারগুলো মোটামুটি একঘেয়েই কাটত। পরেরদিনের কোন হোমওয়ারক থাকে সেগুল শেষ করা, কলেজে মান্ডে টেস্ট থাকলে তার পড়া তৈরি করা।
চেন্নাই আসার পর, এই একটিমাত্র দিন যেদিন ছুটি। যখন ইচ্ছে ঘুম থেকে ওঠো, হোস্টেল জীবন। কেউ কিছু বলার নেই। আর তাই শনিবার অনেক রাত অবধি জেগে জেগে হয় গল্পের বই পড়তাম, নয় সিনেমা দেখতাম। তারপর কোনমতে নটায় ঘুম থেকে উঠে নীচে নেমে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার আরেক প্রস্থ ঘুম। এখন তো তাও করিনা। যখন ঘুম ভাঙ্গার, ভাঙ্গে। ঘরে খুচখাচ খাবার রাখি। মেসেও যাইনা আদ্ধেক রবিবার। এখন রবিবার সকালগুলো কাটে বন্ধুদের সাথে স্কাইপ, বাড়িতে দু তিনবার ফোন আর এমনিই ল্যাধ খেয়ে।খুব কম দিন কাজের চাপ থাকলে খানিকক্ষণ ল্যাবেও যেতে হয়। নইলে সারাদিন এত ঝিমোই, গল্পের বইয়ের হয়তো চল্লিশ পাতাও পড়া হয়না। খুব পছন্দের কোন সিনেমা রিলিজ করলে সকাল সকাল সিনেমা হলে চলে যাই, দেখে আসি। নইলে কখনো বা ল্যাপটপে কোন প্রিয় সিরিজ (যেমন ফ্রেন্ডস) দেখি। বই পড়ি বা ফেসবুকে লোকজনের লেখালিখি যখন পড়ি, ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলতেই থাকে। আসলে তাতে একটা বেশ বাড়ি বাড়ি ভাব আসে। খুব ইচ্ছে হলে দুপুরে কোথাও খেতে যাই। বিকেল হলেই কেমন একটা মন কেমনিয়া ভাব এসে যায়। সেটা কাটাতে মাঝে মাঝে হাঁটাহাঁটি করি। আমাদের ক্যাম্পাসটা খুব সুন্দর তো, বেশ লাগে। খুব কম বার, কিন্তু কিছু রবিবার কাছে পিঠে ঘুরতেও গিয়েছি।
এই তো এমনভাবেই রবিবারগুলো কেটে যায়। বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন জায়গায় রবিবার কাটানোর সরঞ্জাম পালটায় বটে। তবে কিছু মূল জিনিস এক থেকে যায়। ঘুম। আরাম। খাওয়াদাওয়া। কখনো কখনো কোন পেন্ডিং কাজ থাকলে সেগুলো সেরে ফেলা। সোশ্যালাইজ করা। তারপর আর কী, আবার পরের রবিবারের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকা।
No comments:
Post a Comment