Saturday, June 30, 2018

আকস্মিক

"কীরে, তুই আসবি কখন, স্ক্রিপ্ট শোনাবি বললি। আমি কখন থেকে বসে আছি বল তো?"

অম্বরীশদার মেসেজ ঢুকল ফোনে। কব্জি ঘুরিয়ে দেখলাম সাড়ে বারোটা বাজে। ইশ, বিচ্ছিরি রকমের দেরি হয়ে গিয়েছে। বলেছিলাম সাড়ে এগারোটা থেকে পৌনে বারোটায় পৌঁছে যাব। আসলে উবার শেয়ারটা এত দেরি করল, তার উপর ঘুরে ঘুরে চলছে। দাদার কাছে বকা না খাই। যা কড়া ধাঁচের মানুষ। একটু ভয় ভয় মুখ নিয়েই পৌনে একটা নাগাদ যখন পরিচালক অম্বরীশ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ঢুকলাম, ঘরে শুনলাম মৃদুস্বরে দেবব্রত বিশ্বাস "আষাঢ় কোথা হতে আজ এলি" গাইছেন। আর সাথে গুনগুন করছে দাদা।


"সরি দাদা, ক্যাব পেতে প্রব্লেম হচ্ছিল। ভেরি সরি।"

হাসিমুখে অম্বরীশদা ডান হাত তুলে আশ্বস্ত করে বসতে বলল, "নো প্রব্লেম। বোস। আসলে তোদের বৌদি একটু বেরিয়েছে। ও ফিরলে আমাদের একসাথে শপিং করতে যাওয়ার কথা। মিমির জন্মদিন সামনের সপ্তাহে। ওর জন্য গিফট কিনতে হবে। তাই আর কী তাড়াহুড়ো করছি।"


"বেশী সময় লাগবেনা দাদা। আমি জাস্ট স্ক্রিপ্ট ডিসকাস করবো। ছোট্ট স্ক্রিপ্ট।"

"হ্যাঁ, বল।"

"দেখো আমি একটা মিনিট দুই তিনের কিছু করতে চাই। টপিক হল "আকস্মিক"। ভাবলাম আকস্মিক মৃত্যুর চেয়ে বেশী তো আকস্মিক কিছু হয় না। তাই ওরকম কিছু করবো ভাবছিলাম। কিন্তু এগোতে পারছিনা।"

"কীরকম ভেবেছিস, বল?"

"ধরো একটা মেয়ে, ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হাসিখুশি। হঠাৎ পিছন থেকে একটা বাস এসে ধাক্কা মেরে দিয়ে গেলো।"

"এটা তো কলকাতা পুলিশের ক্যাম্পেন হয়ে গেলো। Where is the drama? নাটকীয়তা চাই রে।"

"তাও ঠিক। একটু কিছু সাজেস্ট করো।"

"ব্যাপারটা পুরো ডায়লগবিহীন হবে। শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ওপর চলবে। তাই পাওারফুল কাউকে নিবি।"

"ঠিক আছে। বলো তুমি।"


"ধর, দেখা একটা বছর কুড়ি বাইশের মেয়ে। বেশ সকাল সকাল সাজগোজ করে তৈরি হচ্ছে। কোথাও একটা যাবে বলে। তখন পিছনে ওরকম প্লেজ্যান্ট ম্যুজিক দিবি। তারপর দেখা ওরকমই হাসি মুখে কানে ইয়ারফোন লাগিয়েছে। সাইকেল চেপে কোথাও যাচ্ছে। কানে গানের সাথে সাথে নিজেও মোটামুটি বেসুরো গলায় গাইছে। এইবার বেসুরোটা কীভাবে বোঝাবি, সেটা ভাবতে হবে। ওর গলা শোনাবি, নাকি ব্যাকগ্রাউন্ডটাই ওরকম কিছু করবি। তারপর দেখা খানিকক্ষণ ও সাইকেল চালাচ্ছে। শট নিবি এমন, সামনে লম্বা রাস্তা। সুদৃশ্য। বেশ একটা মোনোটনি আসব আসব করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা বিকট শব্দ। স্ক্রিন ব্ল্যাংক। তারপর ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট। কালো পিচঢালা রাস্তা। সাইকেল উল্টে আছে। মেয়েটা মুখ থুবরে পড়ে। আস্তে আস্তে লাল রক্তের সরু রেখা ক্রমশ মোটা হচ্ছে। ক্যামেরা জুম আউট করবি। ব্যস শেষ।"


"দারুণ! থ্যাঙ্ক ইউ অম্বরীশদা। কী সুন্দর বলে দিলে।"
"তোর কপাল ভালো, তোর বৌদি ফেরার আগেই হয়ে গেলো। নইলে বেরোতে হত আমায় মাঝপথে।"

জলতরঙ্গের মিষ্টি সুরে আমাদের কথা থামল। অম্বরীশদার ল্যান্ডফোনের রিংটোন।


কলার আইডিতে চেনা নম্বর দেখে মুখে খেলে গেলো এক টুকরো হাসি।
"ওই দেখ, তোর বৌদির ফোন। এই এখন বেরোতে হবে।"

অম্বরীশদা ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, "হ্যাঁ মিনু, তুমি রেডি? আমি বেরোই?"

ওই দিকে কী যে শুনল, দেখলাম দাদার ভুরু কুঁচকে গেলো।

"কে বলছেন? আপনার কাছে এই ফোন কোথা থেকে এলো?"

খানিক শোনার পর, ধপ করে দাদা সোফায় বসে পড়ল।

"কী হয়েছে দাদা? কার ফোন?"

ফ্যালফ্যাল করে দাদা তখন আমার দিকে তাকিয়ে।

"তোর বৌদি..."
"কী হয়েছে বৌদির?"
দাদা কিছুই বলছেনা। আমি ভয়ে ভয়ে ফোনটা কানে দিলাম। ও প্রান্তে তখন ডায়লিং টোন...


*সমাপ্ত*

Friday, June 29, 2018







একদিন মিলে যাবে এই পৃথিবীর সকল লেফট হ্যান্ড সাইড আর রাইট হ্যান্ড সাইড।
মিটে যাবে দুনিয়ার যাবতীয় সমস্যা।
ফিকে হয়ে যাবে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির কালিমা।
 
আর সেইদিন আমি পাড়ি দেবো এক স্বপ্ন উড়ানে...
পৌঁছে যাব কোন এক অপার সুখের ময়দানে।

Tuesday, June 26, 2018

হলো তো অনেক বাকবিতণ্ডা,
পড়লো ঝরে কত টাটকা ফুল।
ভাঙল না তবু কারুর দম্ভ,
মার্জনা পেলো না হৃদয়ের ভুল।।
তারপর, চাওয়া পাওয়ার ব্যালেন্স শীটে পড়লো এলোমেলো আঁচড়,
সাঁঝের আলোয় সুখ বোঝাই তরীখানি খুলে দিলো নোঙর।।
সাদা পালে নীল সমুদ্র বড়ই শান্তিময়।
সুখ আসে, দুখ যায়, আনন্দ বিস্তৃত এ ধরায়।।
অস্ত রবির লালিমায় আজ বর্ণাভ সান্ধ্য আকাশ।
জরা জ্বালা ভুলি পক্ষী কলরবে মুখরিত এ বাতাস।।
নীল আকাশে নেইকো মেঘের খোঁজ।
আসবে বলেও তাই এলো না সেই মহার্ঘ্য বৃষ্টি।।
খোঁজ নেবে ওর কি হজম হলো না কালকের মহাভোজ?
নইলে জুন মাসে নেই রেন, এ কী অনাসৃষ্টি!!

রেজাল্ট

রেজাল্ট
উত্তর কলকাতার গলি, তস্য গলির ভিতর দুই শতাব্দী প্রাচীন রঙ ওঠা পলেস্তারা খসা বাড়ির ঘরগুলিতে যেমন আলো ঢোকেনা, ঠিক তেমনই বাড়ির বাসিন্দাদের মনও কোন অন্ধকারেই পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এ বাড়ির মানুষগুলো এখনো মনুস্মৃতি আগলে চলে, এরাই প্রকৃত "মনুর সন্তান"।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নয়, নেহাত বাল্যবিবাহ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গৌরিদান প্রথা বন্ধ হলেও এ বাড়ির মেয়েরা বা বউরা কেউই তাদের স্কুল পাসের পর কলেজে যায়না বা যায়নি। সৎপাত্র দেখে কোনো এক ফাল্গুনী সন্ধ্যায় বা গ্রীষ্মের দাবদহে রিক্ত গোধূলি লগ্নে বিয়ে হয়ে যায় এদের, সব আশা আকাঙ্খা বিসর্জন দিয়ে। বা বলা যেতে পারে, এদের আর কোনো শখের স্বপ্ন দেখতে শেখানো হয়না ছোট থেকে।
এমনই এক বাসন্তী দিনে এ বাড়িতে এসেছিল সুরমা। বাপ মা মরা মেয়ে, মামাবাড়িতে বড় আদরে মানুষ। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো মাথা, কিন্তু সামাজিক নিয়মের বেড়ায় গত কুড়ি বছর তার আর কোনো প্রথাগত শিক্ষা লাভ হয়নি। তবে ছেলে মেয়েকে নিয়ম করে পড়তে বসাতে গিয়ে কোন ফাঁকে যে তরতর করে নিজেরও পড়া হয়ে যেত খানিক, বাড়ির কেউই জানেনি।
আজ সকাল থেকে বড্ড ভয় ভয় করছে সুরমার। ছেলের সাহায্যে প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা দিয়েছিল। গত দুই বছর ফার্স্ট ক্লাস মিস হয়েছে একটুর জন্য। আজ ফাইনালের রেজাল্ট। ফার্স্ট ক্লাসটা হয় কি না, এটা দেখার। সুরমা জানে ওর এই ডিগ্রির কথা হয়তো বড় মুখ করে বাড়ির কাউকেই বলতে পারবেনা ও, নিজের স্বামী দীপককেও না। তবুও যাই হোক, নিতান্তই আত্মতুষ্টির একটা ব্যাপার থেকেই যায়।
আজ আবার ছেলে অম্বরীশেরও জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট।
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক দশটা বাজলো। হুড়মুড়িয়ে বাবা ছেলে কম্পিউটারের সামনে। অধীর আগ্রহে রেজাল্ট দেখতে। আশাতীত ভালো ফল করেছে অম্বরীশ, মেধাতালিকায় প্রথম দশে নাম।
"কই গো শুনছো? ছেলে আমাদের দারুণ করেছে পরীক্ষায়। মিষ্টি আনাও। বাড়ি বাড়ি পাঠাবো।" দীপকের গমগমে গলায় আজ আনন্দ।
"বাবা আমার এই ভালো রেজাল্টের একটা পুরস্কার চাই। বলো কী দেবে?"
"তুই যা চাইবি, আমি তাই দেবো। কথা দিলাম।"
ছেলের মুখে হাসি ফুটলো। মাকে ডেকে আনল ঘরে। তারপর মা বাবার সামনে অন্য ট্যাবে খুলল মায়ের পরীক্ষার রেজাল্ট পেজ। জ্বলজ্বল করছে সেখানে
"সুরমা ঘোষাল। অঙ্ক অনার্স। প্রাপ্ত নম্বর পঁয়ষট্টি শতাংশ।"
"বাবা, প্লিজ মাকে এবারে বি এড পড়তে দাও। এটাই আমার পুরস্কার।"
সুরমার দুই চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। দীপক হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে, বিহ্বলতা কাটাতে দেরি আছে। অবাক হয়ে একবার স্ত্রী আর একবার ছেলের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন।

আজ বাড়িতে হইহই রব। বাড়ির ছেলে ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছে। বংশে এই প্রথম।
একই সাথে একদা "অনুর্দ্ধা কুড়ি, কুলীন ব্রাহ্মণ, গৌরবর্ণা, গৃহকর্মে নিপুনা, অতীব সুশ্রী পাত্রী" আজ বেরোচ্ছেন বি এড পড়তে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এও কম বিস্ময়ের না, বংশে এই প্রথম।
Between "মা খুব গরম লাগছে"র উত্তরে সুবল কাকুর সেলুন থেকে ন্যাড়া হয়ে ফেরা" to "মা ভীষণ গরম। এসিটা amazonএ অর্ডার করেই দিলাম", we all grew up..

জুতো উপাখ্যান

জুতো উপাখ্যান
বা
Size matters
পরম করুণাময় ঈশ্বর যখন আমার শারীরিক গঠনের ব্লুপ্রিন্ট সৃষ্টি করেন, তখন অন্যমনস্কতাবশত (কে জানে কী করছিলেন। তখন তো ফুটবল বিশ্বকাপও শুরু হয়নি। তিন মাস বাকি ছিল। হতে পারে পয়লা বৈশাখ হালখাতা এসবের সাইড এফেক্ট চলছিল) আমার পা দুটিকে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকার বানান। যার ফলে এই তিন দশক পেরিয়ে এসেও আমায় বেশিরভাগ সময়ই কিডস সেকশন থেকে লাল নীল আলো জ্বলা প্যাঁ পো শব্দ করা জুতোর ভিড় থেকে এক কোণে বসে থাকা নিতান্ত শান্ত শিষ্ট সুশীলা লাল কালো বা গোলাপী নীল এক পাটি কিটো কিনতে হয়। আবার এই তথাকথিত (জনশ্রুতি) "মা লক্ষ্মীর মতো পা দুটি" আবার বেশ সেনসিটিভ। সব রকম জুতো চলেনা। হিল পরতে গেলে গেলো গেলো রব ওঠে। আর ফ্ল্যাট পরলেও সব চলেনা। স্পেসিফিক মডেল চাইই। কী জেদ। না পেলে পায়ে কড়া পড়ে একশা কান্ড।
এ হেন মাস্টারপিস পায়ের মাপে মানানসই জুতো কেনা তাই আমার কাছে বিরাট ঝক্কির কথা। সচরাচর আমি অনলাইন শপিং বেশি পছন্দ করলেও জুতোর ব্যাপারে অনেকদিন অবধি সাহস পাইনি। তারপর একদিন কী মনে হতে (আসলে সাংঘাতিক সস্তা অফারের মোহ) প্যুমার একটি স্নিকার কিনলাম। প্রথম দুদিন খুব আনন্দ পেলাম। তৃতীয় দিন থেকে আর মাটিতে পা পড়ে না। সে প্যুমার গর্বে না। সাংঘাতিক plantar fasciitis। বাবা রে, সে কী ব্যথা মা গো মা। ততদিনে কঠিন সংকল্প করে ফেলেছি। না। আর অনলাইনে জুতো কিনবো না। অবশ্য ইতিমধ্যে আরেক পিস বাটার walking shoe এসে গিয়েছে। সেটি কিনেছিলাম এই ভরসায় যে যাক, অন্তত এই এক মডেল পরি, সাইজ জানি। অসুবিধে হবেনা। কপাল খারাপ থাকলে কী আর করা। সে জুতোও পায়ে সইলো না। অজ্ঞাত কারণে।
বহু মাস অনলাইন তাই কিনিনি। যেটুকু দরকার পড়েছে, দোকানে গিয়ে কষ্টে সিষ্টে কিনেছি। মানে ডিজাইন নিয়ে আপোষ করেছি। তা যাই হোক। হালে ফ্যাশন আর স্টাইল নিয়ে বেশ ওয়াকিবহাল হয়েছি। সাজুগুজুতে নজর পড়েছে। ইচ্ছে হলো জুতোর কিছু ব্যবস্থা করি। ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙ্গে। আমি সব কঠোর কঠিন পণ ভেঙে সেই আবার আমাজনে লগিন করলাম। এবং কপাল কপাল। ঠিক সাইজ তিনে সুন্দর কালো ছোটখাটো মিষ্টি দেখতে একটা হিল জুতো পেয়ে গেলাম। দুদিনে ডেলিভারি পেলাম। পায়ে মাপে ঠিক হলো। কিন্তু ডিফেক্টিভ প্রোডাক্ট, রিটার্ন করলাম। ভাবলাম যাহ, আবার সেই অনলাইনের বাধা। নাহ। এবার দোকানেই যাবো। বড় সংকল্প করে স্টোরে গেলাম। এবং স্বাভাবিকভাবেই সাইজে পেলাম না। এদিকে জুতো খুব দরকার। (জুতোর অভাবে কিনা লাউঞ্জ বারের প্ল্যান ক্যানসেল করে দিয়েছিলাম!) অগত্যা আবার বাবা আমাজন ভরসা। যাই হোক, শেষমেশ এটার ডেলিভারি পেলাম। নিজের ওপর বেশ একটা ইয়ে ইয়ে ভাব এলো। ওভার কনফিডেন্স। সাক্সেসফুলি জুতো কেনা চারটিখানি কথা না।
ওভার কনফিডেন্ট হয়ে এবার ফ্ল্যাট জুতো কিনবার বিশেষ শখ হলো। এবং তাও woodland এর। এদিকে ওই ব্র্যান্ডের জুতো সাত জন্মে পরিনি। মাপ জানিনা। অগত্যা আবার অফলাইন ভরসা। তা গেলাম জুতো কিনতে। পথে আগে বাটার দোকান পেলাম। woodland এর চেয়ে সস্তা হবে ভেবে অনেক ঝাড়াই বাছাই করে এক খান নিলাম। আমার সাইজ তিন (হাওয়াই চটি এক সাইজেরও পরি অবশ্য)। তিন নম্বর সাইজের জুতো পায়ে ফিট করলো। তবে একটু চাপ। চার নিলাম। হালকা লুজ। দোকানদার বললো তিন নিতে। নাকি ছেড়ে যাবে। আমিও নাচতে নাচতে কিনে এলাম। বিকেলে পরে হাঁটতে বেরিয়ে পায়ে ফোস্কা পড়ে যা তা অবস্থা। এক সপ্তাহ পর আবার কাল পায়ে দিলাম। সেই এক অবস্থা। জানিনা এটা আদৌ পরা হবে কি না। এদিকে এটির খুব দরকার। হয়তো সেই woodland এই যেতে হবে। মাঝখান থেকে টাকা বাঁচাতে গিয়ে বাড়তি খরচ হলো।
এখন মনে হচ্ছে ঠিকঠাক সাইজ বড্ড জরুরি।
আর হ্যাঁ, সস্তার তিন অবস্থা।
এখন আবার আমার জুতো কেনায় ভীতি ফিরে এসেছে।

radio

অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিল এই ছবিটার ক্যাপশন হিসেবে... কিন্তু লিখতে গিয়ে কেমন সব অক্ষরেরা ঘেঁটে গেল, শব্দরা পালিয়ে গেল।
আসলে রেডিয়ো তো আমার কাছে শুধুমাত্র একটা কালো রঙের জাদুবাক্স না, রেডিয়ো বোধহয় আমার ছোটবেলা থেকে আজ অবধি টিকে থাকা গুটিকয়েক বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অন্যতম।
এর হাত ধরেই বহির্বিশ্বের সাথে পরিচয়। বিনোদন জগতের সাথে মোলাকাত। অসংখ্য মণিমাণিক্য খচিত বিশ্ব সাহিত্যের রসাস্বাদন।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে, এটি সেই কিশোরীর বেস্ট ফ্রেন্ড। একলা দুপুরগুলিতে আকবরের শাসন ব্যবস্থার গুণাগুণ মুখস্থর ফাঁকে, বা প্রথম বাড়ির বাইরে যাওয়ার মন খারাপের গভীর রাতে অজানা ভাষায় চেনা সুরের নরম স্পর্শে ঘুমের আবেশে। অথবা ঘরে ফেরাকে উদযাপন করতে ক্যাবে প্রিয় RJদের অনর্গল বকবকে। বা মেঘলা দুপুরে এয়ারপোর্টে একটা বিষণ্ণ কোণে ইয়ারফোন লাগিয়ে বাড়ি ছাড়ার দুঃখটাকে কিছুটা হলেও লাঘব করতে...
প্রযুক্তির সাহায্যে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু কিছু ফেসবুক লাইভ দেখতে পেলেও প্রিয় শহরের প্রিয় চ্যানেলের প্রিয় অনুষ্ঠানগুলি নব ঘোরালেই শুনতে পাওয়াটাকে ভীষণ ভীষণ মিস করি। আজকের সকালটা বড্ড বিষণ্ণভাবে শুরু হল, যখন বুঝলাম যে চাইলেও তখন সকালম্যান মীরের হাই কলকাতা শুনে দিন শুরু করতে পারবো না...
প্রিয় বন্ধুর সাথে আপাতত তাই লঙ ডিস্ট্যান্সই চলুক...

Image may contain: phone

Friday, June 15, 2018

An Ode to Yellow

Yellow...

The rays of the sun after a week long dreary weather..
Those bubbly floating ducks that the baby so loves...
The bright bloom of the pretty Gulmohur strewn across the slate gray lanes...
The plumage of the beautiful bird on the  Jamrul tree cooing on a lazy afternoon...
The walls of our childhood house...
The memories on our lab coat from Chemistry classes
The musur daal on the steaming white rice...


Yet all that matters to me is
The glow on your face when you wear your favourite colour..

মুক্তি

ইদানীং কিছু মানুষজনের সাথে কথা বলে বুঝেছি যে আমাদের মধ্যে বেশীরভাগই সাংঘাতিক অবসাদে ভুগই। সেই অবসাদ হতাশার কারণ একেকজনের জন্য একেকরকম। মানসিক সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত কাম্য। আশেপাশে কাউকে অবসাদগ্রস্ত দেখলে বাড়িয়ে দিন সাহায্যের হাত। কিছু করতে না পারলে, নিদেনপক্ষে শুনুন তার কথা। তাকে ভরসা দিন। পাশে থাকুন। সাহস জোগান।




সকাল আটটা। অ্যালার্ম বাজছে ফোনে গত এক ঘণ্টা ধরে, সমানে স্নুজ করে চলেছে অরিঞ্জয়। আবার একটা সোমবার। একটা আস্ত সপ্তাহ সামনে। সেই এক ভয়ঙ্কর অফিস, সারাক্ষণ স্যারের কড়া কথা, কলিগদের অসহযোগিতা। ভালোই লাগেনা। সবে তেইশ। এই প্রথম বাড়ির থেকে এত দূরে আছে অরিঞ্জয়। বাড়ি ছাড়ার আগে ভেবেছিল স্বাধীন জীবন কাটাবে, বন্ধুরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যেমন কাটাত, সারাক্ষণ হই হুল্লোড় করবে। শাসন থাকবেনা। হ্যাঁ, মায়ের দিক থেকে শাসন নেই বটে। কিন্তু আনন্দ উপভোগ করার ইচ্ছেটাই সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছে। তেইশেই এক্কেবারে শুকিয়ে গেছে অরিঞ্জয়। নামকরা অফিস, দারুণ মাইনে। কিন্তু পরিবেশ ভালো না। বিশেষ করে ওর মতো ফ্রেশারসদের জন্য। অমানুষিক কাজের চাপ, অবাস্তব কাজের ডেডলাইন, টার্গেট। সব মিলিয়ে ঘেঁটে থাকে। বন্ধুবান্ধবও তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি অফিসে। একেই মুখচোরা, তার উপর বেশীরভাগ জুনিয়র কলিগরাও ওরই মতো অবসাদে ভুগছে। অফিস যেতে ইচ্ছে করেনা, কাজ নিয়ে অযথা চাপ সারাক্ষণ পরিশ্রান্ত রাখে, রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় বারবার। একটা দীরঘকালস্থায়ী ক্লান্তি ঘিরে রেখেছে ওকে। আজ ইচ্ছে আছে একবার বসের কাছে ছুটি চাইবে। মা বারবার বলছে, কটাদিনের জন্য বাড়ি থেকে ঘুরে যেতে, মন ভালো লাগতে পারে হয়তো। দেখা যাক পায় কি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে একটা প্রেজেন্টেশন শেষ করেছে, মনে তো হয় ভালোই করেছে। বসের পছন্দ হলে ছুটির কথাটা তুলতে সুবিধে হয়। অন্তত সাতদিন।


সোয়া আটটা নাগাদ অবশেষে বিছানা ছেড়ে শানান সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেরোল অরিঞ্জয়। ওর পিজির বাইরেই একটা ঠ্যালাগাড়িতে সকালের নাস্তা বিক্রি হয়। বিসি বেলে বাথ খেলো। মেঘলা দিনে বাড়ির খিচুরির কথা মনে করিয়ে দেয় এটি ওকে। বাস স্ট্যান্ডে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বাস পেয়ে সিল্ক বোর্ডের ট্রাফিক টপকে যতক্ষণে অফিস পৌঁছল, পারকিং লটে দেখল বসের নীল অ্যাক্সেন্ট গাড়ি দাঁড়িয়ে। মনটা তেতো হয়ে গেল অরিঞ্জয়ের। ডেস্কে এসে বসতে না বসতেই দেখল নোট রাখা টেবিলে, "See me in my office NOW"। বাবা রে, ক্যাপিটাল লেটারে নাউ লেখা, নির্ঘাত আবার কিছু নিয়ে একটা বলবে বস। কপাল করে এসেছে অরিঞ্জয়, উঠতে বসতে শুধু বসের চোখ রাঙানি। এক ঢোঁক জল খেয়ে কাঁচের দরজা দিয়ে বসের কেবিনে ঢুকতেই, "করেছো টা কী এসব অরিঞ্জয়? এটা কোন প্রেজেন্টেশন হয়েছে? কলেজে কী শিখেছ? একটা কাজও যদি প্রফেশনালি করতে পারো..."

"সরি স্যার, আমায় বলে দিন কোথায় কী চেঞ্জ করতে হবে। আমি এক্ষুনি করে আনছি।"

"অনেক হয়েছে। তোমায় যে কী করে চাকরিটা দিয়েছিল আমি জানিনা। ইউজলেস ইনেফিশিয়েন্ট ফেলো।"

একদা স্কুল কলেজ টপার, কর্মক্ষেত্রে তথাকথিত "ইনেফিশিয়েন্ট" অরিঞ্জয়ের চোখে জল এসে গেল কথাগুলো শুনে। কান লাল হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, বসের আরো কোন কথা আছে কি শোনার জন্য।

"দাঁড়িয়ে আছো কী করতে? নাউ গেট গোয়িং। শ্রুতিকে বলেছি এটা মডিফাই করতে। তুমি ওকে অ্যাসিস্ট করবে। গো। আর একবার কোন কমপ্লেন শুনলে তোমায় টারমিনেট করে দেবো আমি। বি ভেরি কেয়ারফুল অরিঞ্জয়।"


যন্ত্রের মতো শ্রুতির ডেস্কে গেলো অরিঞ্জয়। শ্রুতি ওরই ক্লাসমেট। কলেজে বিশাল কিছু না হলেও এই অফিসে এসে নিজের নামডাক ভালোই জমিয়ে ফেলেছে। বরাবর স্যারেদের, বন্ধুদের প্রিয় পাত্র আজ "ইউজলেস", "ইনেফিশিয়েন্ট"। চাকরি যে কোন মুহূর্তে চলে যাবে। তখন বাবা মা আত্মীয় বন্ধুদের কী বলবে ও?

"অরি, স্লাইডসগুলো মোটামুটি পুরো রিডু করতে হবে। আমি কিছু পয়েন্টারস মেল করে দিচ্ছি তোকে। আমার আগে থেকে লাঞ্চ প্ল্যান আছে রিয়ার সাথে। স্ট্র্যাটেজি টক। তুই কাজটা শুরু করে দিস, আমি এসে দেখে নিচ্ছি। ওকে?"

"হুম ওকে।"


শ্রুতির ইমেলের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে কী মনে হতে অরিঞ্জয় একবার ফোনে ফেসবুক স্ক্রল করা শুরু করল। শুধুই হাসি মুখ। "ফ্রেন্ডশিপ গোলস", "কাপল গোলস", "ভেকেশন প্ল্যান্স" এইসব হ্যাশট্যাগ। মেজাজটা খিঁচরে গেলো। এত ফ্রাস্ট্রেশন। ওর চেয়ে কম ভালো ছেলেমেয়েরা দিব্যি একটু কম ভালো অফিসে চাকরিতে ঢুকে জীবনটাকে কী সুন্দর আনন্দে কাটাচ্ছে, আর ওর এই অবস্থা। কেন যে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে গিয়েছিল এত বছর। মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই ওর এখন।

মেল এলো। পাওয়ারপয়েন্ট খুলে স্লাইডগুলো নিয়ে বসতে যাবে, এমন সময়ে মায়ের ফোন।

দুবার ধরল না। পাশের টেবিল থেকে শঙ্কর একবার উঁকি মারল।

"What da? pick up. Whose call are you avoiding?"

আশেপাশের লোকজন এত সবার সব বিষয়ে নাক গলায়, বিরক্তিকর। কাজের কাজ কেউ করে সাহায্য করবেনা, শুধু মুখরোচক গসিপের সন্ধানে।

দশ মিনিট পর আবার ফোন বাজতে খানিকটা বিরক্ত হয়েই ফোনটা ধরে বারান্দার দিকে গেল।

"মা ফোন ধরছিলাম না মানে নিশ্চয়ই ব্যস্ত ছিলাম। বার বার কল করছ কেন?"

"সরি বাবু। আসলে তোর কথা খুব মনে হচ্ছিল। এখানে মেঘ করেছে। আমি খিচুরি আর ডিম ভাজা বানালাম। ভীষণ মিস করছি রে তোকে। ছুটি চাইলই? কবে আসবি বাড়ি?"

গলার কাছে একটা অসম্ভব কান্না দলা পাকিয়ে উঠল অরিঞ্জয়ের। কী করে বলে মা কে যে ছুটি পেলে হয় চিরতরে পাবে, নইলে না? মা যে পথ চেয়ে বসে আছে ওর জন্য। ক্লাস এইটে বাবাকে হারানোর পর থেকে মায়ের জন্য শুধুই ছেলে আর ছেলের জন্য শুধুই মা, এই ছিল ওদের জীবন। কলকাতার কলেজ থেকে একদম ব্যাঙ্গালোর, দুজনকেই ভীষণভাবে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু ছেলের কেরিয়ারের কথা ভেবে রুণা কিছু বলেননি।


"কী রে। কী বলল তোর স্যার?"


"ছুটি দেয়নি মা। মা, আমি আর পারছিনা এখানে। ভীষণ চাপ। ভীষণ মন খারাপ। আমার একদম ভালো লাগেনা এখানে। এই চাকরি আমি করবো না মা"

"চুপ কর সোনা। ওরকম বলেনা। চাকরি করবো না কোন কথা হল? সব জায়গায় কোন না কোন প্রেশার থাকে। দাঁতে দাঁত চিপে কাজ কর, ঠিক পারবি। মন খারাপ করিস না। দেখি আমি ছুটি ম্যানেজ করতে পারি কি না।"

"মা আমি বুবাইদিদির বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে চেয়েছিলাম। সবার সাথে দেখা হত। কতদিন দেখিনা কাউকে।"

"হবে হবে। ঠিক একদিন হবে। বিয়ের এখনো দশদিন বাকি। তুই দেখ চেষ্টা করে।"

"হবেনা মা, হবেনা।"


"Boss gave you some work to do and here you are chitchatting...Arinjoy, careful man.." শঙ্করের কোথায় সম্বিৎ ফিরল অরিঞ্জয়ের। আবার সেই গসিপের ধান্দায় ঘুরছে।

'ইয়া, আই অ্যাম কামিং।"


"মা, ফোন রাখছি। কাজে ডাকছে।"

"ভালো থাকিস সোনা।"


ফোনটা রেখে বাইরের আকাশের দিকে তাকালো অরিঞ্জয় খানিকক্ষণ। কালো মেঘ। যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। এক সময় কী ভালোই না লাগতো ওর এই বর্ষা। স্কুল ছুটি, মাঠে কাদায় ফুটবল। ছোট্ট ছোট্ট লাল নীল কাগজের নৌকো। রঙ্গন ফুলের গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। খিচুরি ডিমভাজা। আহা। কোথায় সে দিন। কী করছে ও। কেনই বা পড়ে আছে। থেকে কী হবে। এই বেঁচে থাকার মানে কী? মুক্তি নেই। পালাবার পথ নেই। কোথাও যাওয়ার নেই। সুখ নেই। শান্তি নেই।

শুধু নেই নেই আর নেই।


পনেরোতলার বারান্দা থেকে নীচে কী ছোট্ট লাগছে পারকিং লটের গাড়িগুলো। বৃষ্টি নেমেছে। ভিজছে গাড়ি। ভিজছে নেড়িকুকুরগুলো। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটার সাথে টাটকা রক্তের লাল রঙ ক্রমশ বাড়ছে। লোকজনের ভিড় হচ্ছে ধীরে, কারুর কারুর ফোনের ভিডিয়ো ক্যামেরা খোলা। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে কিছুজনের। "এই নিয়ে এই বছরে চার নম্বর সুইসাইড কেস। কোম্পানির এইচ আরের সিরিয়াসলি কিছু করা উচিত।" ইত্যাদি। ইত্যাদি। কোন কিছুই কানে যাচ্ছেনা নীল অ্যাক্সেন্টের সামনে মুখ থুবরে পড়ে থাকা এক টুকরো পরাজিত সত্ত্বার, এক হেরে যাওয়া প্রাণের নিথর দেহের। সে এখন মুক্ত। খাঁচার থেকে বেরিয়ে সেই মুক্ত পাখি এখন উড়ছে অনেক উঁচুতে, যেখানে সে সব দুঃখ কষ্টের ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। মৃত্যুই তাকে এনে দিয়েছে সেই পরম মমতার স্পর্শ, সেই বহু কাঙ্ক্ষিত শান্তি। সে এখন অনেক শান্ত।



************************************************************





Wednesday, June 13, 2018

বর্ষা oneliner

ভিজুক আমার লাল ছাতা আজ বর্ষাদিনের রঙে।
কালো মেঘের ঘনঘটা মাঝে অনুভূতিরা জাগে।।

Tuesday, June 12, 2018

ডায়েরির পাতার আঁচড়গুলো আজ অবহেলায় ধুয়ে মুছে যাক।

বর্ষাদিনে আজকে বরং খুশীর নৌকো পাল তুলে বেড়াক।।

Thursday, June 7, 2018

মন খারাপের বিকেলে কেউ গলা সাধে না

অত্যন্ত অগোছালো লেখা। মন ভালো না থাকলে যা হয় আর কী।
(মন খারাপের কোন কারণ নেই। আমার বরাবর বাইরে বৃষ্টি পড়লে ভিতরটা কেমন মুচড়ে ওঠে।)



মন খারাপের বিকেলে


১।


আকাশ যত কালো হয়, আমার মনেও পাল্লা দিয়ে ততই মেঘেরা জোট বাঁধে।

তফাত শুধু বাইরে বৃষ্টি পড়লেও আমার অভিমানগুলো জমাই পড়ে থাকে।।



২।


শুনেছি কবিদের যন্ত্রণা নাকি তাদের সৃজনশীল করে তোলে?

আমি বুঝি তবে কবি নই?

আমার তো কই চারটে ব্যাকস্পেস আর দু কাপ কফি ছাড়া দীর্ঘশ্বাসটুকুও ফেল করে।।



৩।


মনের হদিস না পেলে যখন তাকে ম্যাপে খুঁজতে যাই।

ঠিকানাটা যেন বারবার ওই রাগ সেহরাতেই পাই।।



৪।


মাঝে মাঝেই এক বুক অভিমান আমায় বড়ই কষ্ট দেয়।

কিন্তু, "অনেক কিছু বলার ছিল"র আড়ালে আবার তারাই গুটি পায়ে মুখ লুকায়।।



৫।


মন তুই নিজের ভালো নিজেই বুঝতে শেখ।

যে যা বলে বুঝবি তুই তার অধিকাংশই ভেক।।



৬।


কান্না পেলে কেঁদে নে তুই, অনেক হাল্কা হবি।

গা ঝেড়ে আবার যে তুই স্যুটেড বুটেড হবি।।

কর্পোরেটের এই জঙ্গলে নেই আবেগের স্থান।

ওর জায়গা বুকের মাঝের পুরনো ক্ষতস্থান।।





Tuesday, June 5, 2018

অতঃ স্টুলিশ কথা

সবে গলা গলা ভাত আর আলুনি ট্যালটেলিয়া মাংসের ঝোল খেয়ে ঘরে ঢুকতে যাবো, ওমনি রুদ্র খপাং করে ধরল, "ভাই, ভালো ফ্রেশ জিনিস আছে। চল চল। আমাদের রুমে চলে আয়। হেব্বি মস্তি করবো।" পাশ থেকে সৌরভ, বিলু আর শঙ্খও "হ্যাঁ ভাই চল চল। ট্রেলার দেখেই চমকে গেছি। এ জিনিস পুরো সেইইইই। মিস করিস না। তোর রানিং কমেন্ট্রি ছাড়া জমবেনা" বলে সম্মিলিত কাকুতি মিনতি করতে লাগল। এরা পারেও বটে! কাল কিনা সেমেস্টারের সবচেয়ে কঠিন সাবজেক্টের পরীক্ষা। Heat and Mass transfer। এখনো তার আদ্ধেক ফর্মুলা ডেরিভেশন মুখস্থ হয়নি, এই এত্ত এত্ত পড়া বাকি। ইন্টারনালে ভালো মার্কস নেই এটায়। সিজিপিএ বিচ্ছিরিভাবে ঘেঁটে যাবে এটায় ছড়ালে, চাকরির বাজার এক্কেবারে ফাটা কলসী। এখন নাকি পড়াশোনা ছেড়ে এদের সাথে এসব ভুলভাল জিনিস দেখবো। হিট এবং মাস পরে সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে ট্রান্সফার করলেও চলবে। আগে কালকে পাস করি। ভাবতে পারল কী করে এরা? নিজদের পড়া নিয়ে চাপ নেই। জানে এখন হাজার চেষ্টা করলেও সিজিপিএ ইম্প্রুভ করবেনা, তা বলে পরীক্ষার আগের রাত্তিরটা তো ছাড়!!! মা ঠিকই বলে, পরীক্ষার কদিন মেসে না থেকে ছোটপিসির বাড়ি থেকে যাতায়াত করলে কাজে দিত। অন্তত শান্তিতে পড়তে পারতাম মন দিয়ে।
"না রে ভাই। এখনো চারটে চ্যাপ্টার পড়া বাকি। আজ হোল নাইট করতে হবে। তোরা যা। কাল পরীক্ষার পর জমিয়ে মস্তি করবো।" এই বলে কাটিয়ে ঘরে এলাম। সাড়ে নটা বেজে গিয়েছে। ঝটপট মাকে একটা ফোন সেরে নিয়ে পড়তে বসলাম। পৌনে দশটা। পনেরো মিনিট একটু ফেসবুকে ঘুরে আসি, তারপর একদম টানা ছটা অবধি পড়ব। আট ঘণ্টা। চারটে চ্যাপ্টার। একদম পারফেক্ট। আটটা অবধি একটু তারপর ঘুমিয়ে পরীক্ষা দিতে চলে যাব। পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। মনে করে আটটা, আটটা দশ, আটটা পনেরো, আটটা কুড়িতে অ্যালার্ম লাগালাম। অ্যালার্ম টোনে পল্টুর করা এস কে ডি স্যারের মিমিক্রি। ওই চিলচিৎকার শুনে শিয়োর ঘুম ভাঙবেই, মেক্যানিকালের প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী যারা কিনা দেশের বাইরে থাকে, তারাও বোধহয় ওই আওয়াজের ঠেলায় উঠে পড়বে, এমনই এফেক্টিভ।
ফেসবুক খুলতেই প্রথমেই চোখ আটকে গেল অপালার ছবিতে। ডিপি পালটেছে। কী সুন্দর লাগছে। একটা লাল রঙের বেশ আকর্ষক ড্রেস পরেছে, অপূর্ব লাগছে। ঠোঁটের রং জামার রং এক। কোনদিকে যে তাকাই। ""Enjoying the summer at Shimla, P.C. Shubhro"। ও, পরীক্ষা শেষ, গরমের ছুটিতে সিমলা গিয়েছে। বেশ বেশ। মনোরম পরিবেশ, দারুণ লাগছে। কিন্তু এই শুভ্রটি কে? ওর ভাইয়ের নাম তো মুকুল। তাহলে এ কে? দেখি তো।
যতক্ষণে আমার এফ বি আই কে হার মানিয়ে দেওয়া স্টকিং স্কিলের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে জানতে পারলাম যে শুভ্র হল কাকু, মানে অপালার বাবার কোলিগের ছোট ছেলে, সবে ক্লাস টুয়েলভ, ওদের ফ্যামিলিও বেড়াতে গিয়েছে একসাথে, শুভ্রর প্রিয় শিল্পী রূপম আর বন্ধুমহলে ভালো ডিপি তুলে দেওয়ার জন্য বেশ বিখ্যাত (হ্যাঁ, এই ডিপিটা কিন্তু দারুণ তুলেছে। অবশ্য অপালাকে দেখতেই এত মিষ্টি, নোকিয়ার VGA ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেও এমনই অপ্সরাই লাগতো) ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটা ছুঁইছুঁই। নাহ, আর না। মেক্যানিকালে তিন তিনটে বছর কাটিয়ে দিলাম এই মরুভূমিতে, ওয়েসিসের সন্ধান না হয় কাল করবো। পরীক্ষা মিটুক। এইবারে বাড়ি গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। অপালা আমার পাড়ার মেয়ে। আজ অবধি কোনদিনও তেমনভাবে কথা হয়নি সামনাসামনি। তবে ফ্রেন্ডলিস্টে আছে ফেসবুকে। যদিও চ্যাটবক্সেও ওই প্রথমদিন হাই হেলো ছাড়া কথা বলিনি, কিন্তু রেগ্যুলারওর ছবিতে লাইক করি। আজকাল তো আবার লাভ ছাড়া দিইনা। তা অমন সুন্দরী ও বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ের পোস্টে লাভ ছাড়া কিছু মানায় না যে, কী করবো আমি।
যাই হোক, নিজেকে সংযত করে বেশ গুছিয়ে খাতা কলম বই নিয়ে পড়তে বসলাম। একটা চ্যাপ্টার দেখলাম দুঘণ্টায় নামিয়েও ফেলেছি। নিজেই নিজের প্রোগ্রেসে খুব খুশী, ভাবলাম একবার একদা সাইলেন্ট ফোনটি দেখি। কোন মেসেজ এলো কি না।  ওরে বাবা, স্টুলিশে একটা মেসেজ নোটিফিকেশন দেখি। খুব উৎসাহ নিয়ে খুললাম। ইন থিং বলে বন্ধুদের মতো আমিও ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে মাস খানেক আগে খুলেছিলাম অ্যাকাউন্ট। প্রথম চার পাঁচদিন বন্ধুরাই প্রচুর খিস্তি খেউর করেছিল। তারপর একদম ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতই সব শান্ত। এই অ্যাপ যে এখনো ফোনে আছে, সেটাই আর খেয়াল ছিলনা। এই এতদিন বাদে কে কী মেসেজ করল, দেখি।

"Hi! I know you stalk me on social media. Even though we have never spoken, but I wait intently for your reactions. I hope one day we will surely meet and talk.
P.S. Single তো?"

কেস করেছে! এরকম পারফেক্ট ইংরেজি। কে? রুদ্র দীপু এরা তো কেউ এমন পরিষ্কার ইংরেজি লিখতে পারেনা। তাহলে? শিয়োর কোন বন্ধুই হবে। ইচ্ছে করে। পিছনে লাগছে। কিন্তু কে? অনেক ভেবেও মাথায় কিছুই এলোনা। থাক, পরে ভাবা যাবে। আগে তো পড়া শেষ করি। কালকের পেপারটা উৎরোতেই হবে।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলেছে। রাত দুটো। কনভেক্টিভ হিট ট্রান্সফার নিয়ে বসে আছি সেই কখন থেকে। মাথায় ঢুকছেনা। ধুর ছাই। ফ্লাস্কে রাখা কফি খেলাম এক কাপ। মাথাটা একটু চাঙ্গা হল। দেড়টা নাগাদ বুঝলাম এতক্ষণ ধরে সেকেন্ড অর্ডার ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনে কন্সট্যান্ট বসাইনি। প্রতিবারের মতোই। আর তাই আবারও মেলাতে পারছিলাম না হিসেব। যাই হোক।

বই খুলে বসে আছি। একেকটা প্রব্লেম নিয়ে এমন ফাঁসান ফাঁসছি, অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশী সময় লাগছে। আরে মাথার আর দোষ কী? ফর্মুলা ভাবতে গেলে যে ""Single তো?" ভাসছে সমানে। আচ্ছা অপালা না তো? আমি যে রেগ্যুলারলি ওর প্রোফাইল রীতিমতো স্টক করি, সেটা যে কেউ বুঝবে। ও বোকা নাকি যে বোঝেনা? এই তো সেমিস্টার শুরুর আগে বাড়ি থেকে ফিরছিলাম যখন, বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল। বন্ধুবান্ধব নিয়ে। আমাকে দেখেই বান্ধবীগুলো তো অপালার গায়ে পড়ে পড়ে যাচ্ছিল। বাবা রে। সে কী ফুসুরফুসুর, ফিসফাস। অপালাকে কি একটু হেসেছিল? সলজ্জ হাসি? ব্লাশ করেছিল?

ধুর ধুর। অঙ্ক মেলাতে পারছিনা খাতায়, রাত তিনটের সময় এদিকে মাথার মধ্যে এই চলছে। সত্যি বাবা, আমাদের মেক্যানিকালের ছেলেদের বড় জ্বালা। নারী মনও বুঝিনা। অঙ্ক নিয়েও হিমশিম।

রাস্তার কুকুরগুলো মাঝেমাঝে চিৎকার করছে। এছাড়া সব শুনশান। একবার বাইরে বেরোলাম। রুদ্রদের ঘরে আর আলো জ্বলছেনা। জোরে হাসাহাসির শব্দও নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। কী করে যে এত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে ওরা কে জানে।

ঘরে ফিরলাম। অস্থির অস্থির লাগছে। যত মনকে প্রবোধ দিই, কালকের পরীক্ষাটা উৎরে যাই, তারপর গোয়েন্দাগিরি করবো, মন মানে না। ফেসবুক খুলে সিধে মেসেঞ্জার লিস্ট। চেনাজানা কেউ তেমনভাবে অনলাইন নেই। আদার ফোল্ডারেও কোন মেসেজ নেই। অপালার লাস্ট সিন ওই সাড়ে নটায়। ডিপিতে কারুর কমেন্টে লাইক করেছিল। ধ্যাত্তেরি। কাল পরীক্ষা শেষ করে সোজা বাড়ি। নিজের না। আগে অপালার। স্ট্রেট প্রশ্ন করবো। তারপর যা হবে, দেখা যাবে। এরকম ভাবে হয়না।
ভগবান, এতগুলো চ্যাপ্টার বাকি। সময় নেই। সাড়ে চারটে বেজে গেছে। ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে। আজ আর ঘুমটা হবেনা। পরীক্ষার হলে না ছড়াই। সাপ্লি খেলেই শেষ। ফার্স্ট ইয়ারে মনে আছে হোল নাইট করে একজ্যাম হলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচ্ছা আজও তাই হলে? এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই? না থাক। আধ ঘণ্টা। অ্যালার্ম দিলাম পাঁচটার। একটু হেড ডাউন করলাম।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম সিমলার টাউন হলের সামনে বরফ। সেখানে একটা লাল জ্যাকেট নীল জিন্স আর কালো টুপি পরে আমি আর আমার পাশে লাল ড্রেস পরে অপালা। আমরা বরফ নিয়ে খেলছি। ব্যাকগ্রাউন্ডে "yeh haseen waadiyaa" চলছে। আহা, কী মিষ্টি। গানটা চলতে চলতে হঠাৎ যেন তাল কেটে গেলো। সেই টেপ রেকর্ডারের ফিতে জড়িয়ে গিয়ে যেমন হয়, ওরকম। একটা বিটকেল শব্দ, ""Wake up, wake up". তারস্বরে কে চেঁচাচ্ছে। কষ্ট করে চোখ খুলে হাতড়ে হাতড়ে চশমা চোখে দিয়ে দেখি পল্টুর গলার আওয়াজের অ্যালার্ম। মরেছে রে। সোয়া আটটা বাজে। নটায় একজ্যাম। পড়ি কি মরি হয়ে ছুটলাম। হলে পৌঁছে স্বাভাবিকভাবেই এক্সপিরিয়েন্স ভালো ছিল না। কোনোমতে টায়টুয়ে পাস মার্ক উঠবে হয়তো মনে হল।

মন মেজাজ ভালো ছিলনা। বাড়ি ফিরে অপালাদের বাড়ি গিয়ে দেখি, তালা ঝুলছে। বুঝলাম এখনো ফেরেনি। মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ পাঠালাম। স্টুলিশের স্ক্রিনশট নিয়ে।
"এটা তুমি পাঠিয়েছ তো? কবে ফিরছ? সিসিডি যাবে ফিরে?"
দেখলাম মেসেজ সঙ্গে সঙ্গে সিন। কোন উত্তর নেই।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। পেজ রিফ্রেশ করলাম। তাও কিছু নেই।

"আছো?"
মেসেজ সিন হলো না আর।
সার্চ বক্সে অপালা সেন লিখে সার্চ করলাম। পেলাম না। ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে খুঁজলাম। এখানেও পেলাম না। বুঝলাম ব্লক করে দিয়েছে।

হায় রে। পরীক্ষাও গেলো। মেয়েও পটলো তো না-ই, উল্টে ভেগেই গেলো।

হায় মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার!!!!

রাত্রেই স্টুলিশ আনইন্সটল করলাম। অনেক হয়েছে। আর না। এই প্রতিজ্ঞা করলাম। স্টুলিশ বাবাজির এক ভক্ত কমে গেলো।


জানতে পারলাম না আরেক ভক্তও ওইদিনেই কমেছে। রুদ্র। ক্লাস টপার সোনালীকে একটা "থ্যাংকস রে মেসেজ কম্পোজ করে দিলি বলে। কাজ হাসিল" এস এম এস পাঠিয়ে নিজের ফোন থেকে ও ও স্টুলিশ উড়িয়ে দিল। কত জোট গড়ল, ভাঙল স্টুলিশের চক্করে, কিছুই জানতে পারলাম না। 

Friday, June 1, 2018

ভালোবাসা ভালো থেকো

ভালোবাসা ভালো থেকো

১।

কলকাতা এয়ারপোর্টের লাগেজ বেল্টে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বারবার ঘড়ির দিকে নজর চলে যাচ্ছিল শ্রেয়ার। একই সাথে ব্যাঙ্গালোর আর ইম্ফলের ফ্লাইটের লাগেজই পাঁচ নম্বর বেল্টে দেওয়ায় কতক্ষণে স্যুটকেস হাতে পাবে, এই চিন্তা। একেই ফ্লাইট লেট করেছে,কখন যে বেরোতে পারবে, অধৈর্য লাগছে শ্রেয়ার। বেল্টের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটার পর একটা লাল কালো বেগুনী ট্রলি ব্যাগের আসা যাওয়া দেখছে ও, সবেতেই ইম্ফলের ট্যাগ লাগানো। আশেপাশে থেকে বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি, ধুপধাপ উল্টে পড়া - আজকালকার মা বাবারা হয়েছে এক, সব অকর্মণ্য। আরে বাচ্চাগুলোকে সামলা, তা না। এই এক্ষুনি একটা বছর তিনেকের মেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ছিল কনভয় বেল্টের ওপর। কী কেলেঙ্কারি কাণ্ডই না হতো! নিজেদের ছোটবেলাতে এমন কাণ্ড ভাবতেই পারেনা শ্রেয়া। দিনকাল বদলাচ্ছে।

এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হ্যান্ডব্যাগের ভিতর থেকে মোবাইল ফোন বেজে উঠল। প্রত্যূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরোদের শব্দে এদিক ওদিক থেকে কয়েকজন তাকালো ওর দিকে। হয় বাবা, নয় সোমক। সোমক ঘোষ, ব্যাঙ্গালোরেই কর্মরত, আর ঠিক দশদিন পর শ্রেয়ার সাথে ওর বিয়ে। ও গতকাল এসেছে কলকাতা। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি পৌঁছনোর দায়িত্ব তাই এইবারে ও নিয়েছে। প্রতিবার কিন্তু এখনো যাওয়া আসা সবসময়েই বাবা থাকে সাথে। বিয়ের ফুল ফুটল কি ফুটল না, ওমনি কীরকম সব যেন পালটাতে থাকলো। অদ্ভুত লাগে ভাবতেই।

ফোনের স্ক্রিনে দেখল, বাবার নম্বর। রিসিভ করে ,"হ্যাঁ বাবা, লাগেজের অপেক্ষায় আছি" জানালো শ্রেয়া।

"হ্যাঁ, সে বুঝেছি। অগ্নি ট্র্যাক করছিল ফ্লাইট। ও বলল।"

"অগ্নি? ও আবার কোত্থেকে এলো?"

"না, না। ও ফোন করেছিল তোর মাকে। তখন বলছিল।"

"বাব্বাহ, শনিবার সকাল সকাল তিনি জেগেও গিয়েছেন?"

"তাই তো দেখছি। ছেলের মতিগতি বদলাচ্ছে।"

"সেই। আচ্ছা বাবা, এবার আমাদের লাগেজ দেওয়া শুরু হয়েছে। আমি এখন রাখি। বেরিয়ে ফোন করছি।"

"বেশ। সোমককে জানিয়েছিস?"

"না। ও নিশ্চয়ই বাইরে বোর্ড দেখতে পাচ্ছে। আবার মেসেজ কলের দরকার কী?"

"তবুও..."

"কোন কিছু না। বাবা বাই।"

মিনিট পনেরো পর ট্রলিতে দুটো ঢাউস স্যুইটকেস আর কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ আর একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে শ্রেয়া বেরোল গেট 3A থেকে। ফোনটা বের করে সোমকের নম্বরে কল করতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে বান্দা হাজির। নীল জিন্স প্যান্ট আর সাদা টিশার্ট, চোখে স্টাইলিশ সরু ফ্রেমের চশমা পরে এক গাল হাসি হেসে বলল, "ফ্লাইট কমফোর্টেবল ছিল তো?"

ভারি আড়াই ঘণ্টার ডোমেস্টিক ফ্লাইট, তার আবার কমফোর্টেবল আনকমফোর্টেবল। এইসব লোক দেখানি বাড়াবাড়ি রকমের সৌজন্যবোধ কেমন একটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। যতসব।

"ওই, যেমন থাকে।" বলে হাল্কা হাসল শ্রেয়া। কদিন বাদে যার সাথে বিয়ে, তার প্রতি কেন যে এখনো একটুও অনুরাগ জন্মায়নি ওর, মাঝে মাঝে বেশ অবাক লাগে ওর। অন্য বন্ধুবান্ধবদের তো দেখেছে, আরেঞ্জেড হোক কি লাভ, বিয়ের আগে আগে সব প্রেমে হাবুডুবু খায় তারা। অথচ এমনও না যে আবেগ কম ওর। বন্ধুবান্ধবদের প্রিয়, সকলের ব্যাপারে মোটামুটি সহানুভূতিশীল সব সময়।

চিন্তার জাল কাটল আবারও সোমকের গলায়।

"কী হল? এনিথিং রং?"

"না। চলো।"

ট্রলিটা নিজে ঠেলতে ঠেলতে একটু এগিয়ে ধার ঘেঁষে রাখল সোমক।

"তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি প্রিপেডের লাইনে দাঁড়াই। বুকিং করে রেখেছি।"

২।

গাড়ি চলছে। শ্রেয়ার চোখ জানলার বাইরে। ছয় মাস পর ও নিজের শহরে এলো। অথচ এবারে যেন সবকিছুই কীরকম অন্যরকম লাগছে। অতি পরিচিত সাদা নীল রেলিঙগুলো রাস্তার ধারে যেন ভীষণভাবে চোখে লাগছে। রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে ফুটে ওঠা ওর অতি প্রিয় কাগজ ফুলও বিরক্তিকর। মেঘলা আকাশ, যে কোন সময়ে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হবে। শনিবার দুপুর হলেও, রাস্তায় অল্পবিস্তর জ্যাম লেগেই আছে। রুবি কানেক্টরে গাড়ি আটকে আছে যখন, মায়ের ফোন এলো।

"কী রে কতদূর?"

"কেন এটা তোমাদের অগ্নি ট্র্যাক করতে পারছেনা? জানায়নি?"

"ধুত্তেরি। সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দিস না কেন রে?"

"সরি। মেজাজ খিঁচরে আছে। রুবি।"

"কেন, কী হল? খিদে পেয়েছে নির্ঘাত?"

"হুম।"

"আমি ঠিক বুঝেছি। মেয়েটা আমার এত বড় হয়ে গেলো, অথচ দেখো। খিদে পেলে সেই বাচ্চাদের মতো করে যাবে। কবে বড় হবি?"

"খুব কি দরকার?"

"ওমা, কথা শোনো মেয়ের! যাক গে, তোরা আয়। বাবা তো গেটে দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে। মেয়ে জামাইকে ওয়েলকাম করবে বলে।"

"কী খাওয়াবে আমায়?"

"আয়ই না। কতদূর এলি?"

"গড়িয়াহাট মোড়।"

"চলে আয়। সোনা মা।"

"কাকু কাকিমা খুব এক্সাইটেড তোমায় এতদিন বাদে দেখবেন বলে।"

"এতদিন কই? এই তো গত মাসেই ঘুরে গেল ব্যাঙ্গালোর থেকে।"

"হুম, কিন্তু কাল ওদের দেখলাম তো। খুব এক্সাইটেড।"

"তুমি কাল আবার কখন দেখলে?"

"রাত্রে দেখা হল।"

"ও।"

শ্রেয়ার যে মুড বিশেষ ভালো না, সোমক ঠিক বুঝেছে, তাই আর কথা বাড়াল না। এমনিতে সদা হাসিখুশি ছেলেটা ঘাঁটাতে সাহস পেলো না, কী দরকার, ফোঁস করে গেলে? দুদিন বাদে বিয়ে, এখন থেকেই বেশ তোয়াজ করে চলতে হবে দেখছে। দাদা বৌদি ম্যারেড বন্ধু বান্ধবদের দেখে এইটুকু শিক্ষা পেয়ে গিয়েছে ও এতদিনে।

৩।

ঋত্বিকা শ্রেয়ার একদম ছোটবেলার বন্ধু। চাকরি করে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। শ্বশুরবাড়িতে খুব কাছের আত্মীয়ের বিয়ে আর শ্রেয়ার বিয়ে একই দিনে পড়ায় অত্যন্ত খারাপ লাগা নিয়েও ওকে ওই সময় পাটনায় যেতে হচ্ছে। তাই আগেভাগে এসে প্রাণের বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রথমে ঠিক ছিল বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া হবে, কিন্তু দুদিন আগে শ্রেয়া প্ল্যান ক্যান্সেল করে সাউথ সিটিতে ডেকে নিল। শেষ মুহূর্তের কিছু শপিং আর প্রিয় বেঞ্জারং রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারবে বলে।

দুপুর একটা নাগাদ শ্রেয়া পৌঁছল সাউথ সিটির সামনে। পরনে একটা হলুদ চিকন সালওয়ার কামিজ। চোখে রোদ চশমা। যথারীতি ঋত্বিকা আগে থেকেই চলে এসেছে। ও পরেছে জিন্স আর টপ। বরাবরের মতোই সুন্দর লাগছে ওকে।

"আসুন ম্যাডাম। পৌনে একটা বলে একটা বাজালেন সেই!"

"উফ, আগে একটা হাগ তো দে। তারপর কমপ্লেইন করবি।" বলে হেসে দুই বন্ধু একে অপরকে আলিঙ্গন করল।

"বল তো শ্রেয়া, ব্যাপারটা কী?"

"কীসের কী?"

"হুঠ করে বাড়ির লাঞ্চ ক্যান্সেল করলি। কিছু নিশ্চয়ই গভীর আলোচনার ব্যাপার আছে যেটা আঙ্কল আন্টির সামনে করতে পারবি না। তাইই বাড়ির বাইরে আনলি। আমায় বল।"

" অ্যান্ড দ্যাটস ওয়াই আই লাভ ইয়ু সো মাচ ঋতু। তুই ঠিক বুঝেছিস। বলবো বলবো। সব বলবো। আগে চল, খাবারটা অর্ডার করি।"

বেঞ্জারঙে প্রিয় থাই রেড চিকেন কারি আর গুং পাও অর্ডার করল ওরা। লেমন মোয়িতোতে হাল্কা চুমুক দিয়ে শ্রেয়া বলল, " শোন না। আমি পালাতে চাই। আমায় একটু সাহায্য করবি?"

শ্রেয়া বরাবরের যাকে বলে "ছিটগ্রস্থ", উতপটাং সিদ্ধান্ত নিতে ওস্তাদ। স্কুল কলেজ জীবনে বহু উদাহরণ আছে ওর হঠকারিতার। এমনকি চাকরির ট্রেইনিং চলাকালীনও সাঙ্ঘাতিক রিস্ক নিয়ে ছুটি না নিয়ে গপ্প ফেঁদে মাইসোর থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসেছে পুজোয় বাড়ির জন্য মন কেমন করেছে বলে। ওর থেকে এমন কথা শুনে খুব একটা অবাক হয়নি তাই ঋত্বিকা। বিয়ের মতো একটা বড় ব্যাপার, এর আগে সাধারণ লোকজনই ভয় পায়, নার্ভাস হয়ে যায়। শ্রেয়ারও যে কিছু একটা এমন হবে, এটাই স্বাভাবিক। বরং শান্তিতে নির্বিঘ্নে বিয়েটা মিটলে ও বরং ওর বর সুদীপ্তর কাছে বেটে হারত। সুদীপ্তকে তো শ্রেয়ার বিয়ের খবর শোনার পরই প্রথম কথা বলেছিল, "দেখো, ও মেয়ে শিয়োর কোন না কোন কাণ্ড বাধাবে। ওর বিয়েটা একটা মেমোরেবল ঘটনা হবেই।"

"তা পালাবিটা কেন শুনি? বিয়েতে তো নিজেই মত দিয়েছিলি বলেছিলি।"

"হ্যাঁ, তা দিয়েছিলাম বটে। কিন্তু সেটা আট মাস আগে।"

" শ্রেয়া তুই কি পাগল হলি? এক সপ্তাহ পর বিয়ে আর এখন বলছিস পালাবি? ইয়ার্কি নাকি?"

"আমার সোমককে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছেনা।"

"ইচ্ছে করছেনা মানে? অমন ভালো ছেলে। এক্কেবারে যাকে বলে রাম মিলায়ে জোড়ি তোদের। দুজনেই ব্যাঙ্গালোরে, ভালো চাকরি করিস। বেড়াতে ভালোবাসিস। ও কত কালচারালি ওরিয়েন্টেড বল তো? নাটক করে রেগ্যুলারলি। প্যাশন আছে। দেখতে শুনতে ভালো। প্লাস..."

"উফ থাম তো। মায়েদের মতো বলে যাচ্ছে।"

"সত্যি যা, তাই তো বলছি শ্রেয়া।"

কথোপকথনে মৃদু ব্যাঘাত ঘটল গুং পাওয়ের আগমনে। বড় সুস্বাদু এই ডিশটি, চিংড়ির তৈরি। ব্যাঙ্গালোরে থাকতে বহুবার অগ্নির সাথে খেতে গিয়ে এটা খেয়েছে। শুরুতে ভালো না লাগলেও, একওয়ারড টেস্ট। চিংড়িতে কামড় দিয়ে আবার চলল ওদের কথা।

"তুই বুঝছিস না ঋতু। আই ডোন্ট ফিল হ্যাপি আরাউন্ড সোমক।"

"ডোন্ট ফিল হ্যাপি মানেটা কী? ছয় মাস ধরে তো দিব্যি ডেট করলি। তখন তো সোমকের প্রশংশায় পঞ্চমুখ।"

"মোটেই পঞ্চমুখ না। হি ইজ গুড, বাট নট একজ্যাক্টলি মাই টাইপ।"

"তা তোমার টাইপটা কী শুনি?"

"হাসিখুশি হবে, অথচ সারাক্ষণ ওই হ্যাহ্যা হিহি না। সোমককে তো মাঝে মাঝে মনে হয় প্রফেশনাল কমেডিয়ান। একটু নারড। বই পড়তে ভালোবাসবে। ঘন্টার পর যার সাথে বই গান নিয়ে গল্প করতে পারব।"

"তাহলে অগ্নি যখন প্রপোজ করল, ওকে না বললি কেন? তোর পুরো ডেসক্রিপশন কিন্তু অগ্নির মতোই হল।"

"বেস্ট ফ্রেন্ড ও আমার। এইসব বিয়ে টিয়ে করে ঘেঁটে দিতে চাইনা।"

"শোন, লোকে নিজেদের কপাল ভালো মনে করে বেস্ট ফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে পারলে। আর তুই কিনা এরকম বোকাবোকা কারণ বলছিস? অদ্ভুত মেয়ে তুই। যখন গত বছর ও তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিল, আমায় তো অন্য কারণ বললি কাটানোর। কি নাকি ও খুব সন্দেহপ্রবণ, প্রাচীনপন্থী। আর এখন বলছিস বেস্ট ফ্রেন্ড? তা এমন ছেলে যার সাথে জীবন কাটাতে পারবে না, সে বেস্ট ফ্রেন্ড হয় কী করে?"

"না, ওটা মিথ্যে বলেছিলাম। আসল কারণ এটাই যেটা বললাম এখন। তোদের বা মা বাবাকে বললে ওরা মানত না। হেসে উড়িয়ে দিত। ও খুবই ভালো ছেলে। কিন্তু দেখ, ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার যাবতীয় যা ঝগড়া ঝামেলা যেখানে যা হয়, দিনের শেষে ওর কাছে বলতেই হয়। ও পেশেন্টলি শুনে আমায় ভরসা দেয়। এবার ওকে বিয়ে করলে আমি কার কাছে দাম্পত্য কলহ নিয়ে যাবো?"

"তুই আস্ত পাগল শ্রেয়া। ইট ইস সো ক্লিয়ার, ইয়ু লাভ অগ্নি। মিছিমিছি তুই সোমকের সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিস। আই ক্যান সি ইট ইন ইয়োর আইজ।"

"আমি অগ্নিকে ভালোবাসি? ধ্যাত না। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ব্যস।"

"আরে না রে বাবা। চুপ করে ভাব। ঠিক নিজে বুঝবি।"

ঋত্বিকার সাথে কথা বলতে বলতে যেন নিজেই ধাক্কা খেল শ্রেয়া একটা বড়। তবে কি সত্যি ও অগ্নিকেই ভালোবাসে? কিন্তু কই কখনো তো অগ্নির সাথে দেখা করলে বা কথা বলতে গেলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় করেনি, ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন বাজেনি। এটাকে প্রেম বলা যায় না।

নাকি যায়? প্রেম কী? এই যে সর্বক্ষণ একে অপরের জন্য রইল, যখন তখন একে অপরকে জ্বালানো, পিছনে লাগা, ঠাট্টা ইয়ার্কি, মন খারাপের ডালি নিয়ে বসে কথা বলে দিনের শেষে মন ভালো হয়ে যাওয়া, এগুলো তাহলে কী? নিছকই বন্ধুত্ব? এত ভালো লাগে অগ্নির সাথে সময় কাটাতে, এতদিনের এত বছরের বন্ধুত্ব। সেই স্কুল লাইফ থেকে বেস্ট ফ্রেন্ডস। অনেক তো ঝগড়া হয়েছে। তা বলে কি আর মিটমাট হয়নি? বিয়ে করলে পর ঝামেলা হলে সেটাই বা মিটবে না কেন? বড় ভুল হয়ে গেল না তো ওকে না বলাটা?

"কী বুঝছিস?"

"শোন না। আই থিঙ্ক ইয়ু আর রাইট। আই মেড আ হিউজ মিস্টেক।"

"আবাউট?"

"অগ্নি।"

"কী?"

"আমার মনে হয় আই ডু লাভ হিম। ওর সাথে সারা জীবনটা হয়তো কাটাতে পারলে ভালো হত।"

'তাহলে এবার?"

"তুই প্লীজ কিছু বল। আমার মাথা কাজ করছেনা।"

"টেনশন করিসনা। বিয়েটা এখনো হয়নি। এক সপ্তাহ আছে হাতে। ভাগ্যিস লাস্ট মোমেন্টে রিয়েলাইজ করলি। বিয়েটা ক্যান্সেল হতেই পারে সোমকের সাথে এখনো।"

"কিন্তু ও কী ভাববে? বাবা মা, সোমকের বাবা মা। এতগুলো লোক ইনভল্ভড যে। কে কী বলবে। প্লাস মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি, অগ্নি? ও রাজি হবে?"

"কে কী বলবে বলে সারাজীবন স্যাক্রিফাইস করবি? একটা ভুল সম্পর্কে বেঁধে রাখবি নিজেকে?"

"কত লোকই তো বিয়ের পর প্রেম করে, ভালোবাসে। আমিও নাহয় নিয়তি মেনে নেব।"

"এক থাপ্পড় মারব। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আছিস নাকি? এমন নেকুপুশু গোছের কথা মানায়না তোকে শ্রেয়া।"

"তো কী করব?"

"তুই এখুনি বাড়ি গিয়ে আঙ্কল আন্টির সাথে কথা বল।"

"বকুনি খাবো।"

"অন্তত সারাজীবন পস্তাবি না।"

খানিক ভেবে শ্রেয়া বলল, "তুই পাটনা কবে যাচ্ছিস?"

"পরশু রাত্রে।"

"ঠিক আছে। তোকে মেসেজ করছি খানিক পর।"

৪।

পরের দিন সকাল এগারোটা, সাউথ সিটির ফুড কোর্টে সকলে উপস্থিত। সকলে বলতে শ্রেয়া, ওর মা বাবা, সোমক, ওর মা বাবা, ঋত্বিকা আর একটা ল্যাপটপে স্কাইপ খুলে তাতে অগ্নি।

সকলের মুখে চোখে উদ্বেগ, হলোটা কী, মেয়ে এমন তড়িঘড়ি সকলকে এই সক্কাল সক্কাল এখানে ডেকে এনেছে। ঋত্বিকার চেহারায় আলাদা টেনশন।

গলা খাঁকরি দিয়ে শ্রেয়া শুরু করল কথা বলা।

"তোমরা সকলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ এখানে এরকম ভাবে আনায়। আসলে আমার কিছু কথা বলার ছিল। বাড়িতে আরো লোকজন আছে চেনাজানা। তাই বাড়িতে হত না। অগত্যা এখানে। তোমাদের যে কথাগুলো বলার আছে, খুব জরুরি। মন দিয়ে শুনো।"

ল্যাপ্টপ থেকে অগ্নি বলে উঠল, "তাড়াতাড়ি প্লীজ। আর কিন্তু আধ ঘন্টা পর আমার ফ্লাইট। মিস করলে তুই নেক্সট ফ্লাইটের টিকিট পাঠাবি। তোর বিয়ে মিস করতে পারছিনা আমি।"

শ্রেয়া, অন্যদিন হলে রিএক্ট করত। আজ একবার ল্যাপ্টপ স্ক্রিনে চোখ দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে কথা চালাতে লাগল।

"আমি প্রথমেই ক্ষমা চাইছি সোমক আর আন্টি আঙ্কলের কাছে। আমি এই বিয়েটা করতে পারছিনা। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের ঠিক জমবে না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। এই বিয়েটা হতে দিয়ে আমি তোমাদের ঠকাতে চাই না। প্লীজ, আই এম ভেরি সরি। এই রিয়েলাইজেশনটা কাল এসেছে আমার। ঋত্বিকা সাক্ষী।"

সোমকের মুখ এক্কেবারে হাঁ। ওর মা বাবারও মুখ চোখ ভালো না। আর সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য শ্রেয়ার মা বাবা।

"তুই কী বলছিস এসব মামণি? তোর মাথা ঠিক আছে? কাকে ভালোবাসিস? কী বলছিস এখন এসব?"

"মা, আমি জানি আমার এই সিদ্ধান্তে তোমরা যারপরনাই বিরক্ত, ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু কিছু করার নেই আমার মা। আমি অগ্নিকে ভালোবাসি। আমি সোমককে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না। প্লীজ এই বিয়ে ক্যান্সেল করো।

অগ্নি, আমি জানি। খুব অবাক লাগছে হয়তো তোর। এক বছর আগে যখন তুই আমায় প্রপোজ করলি, আমি আসলে তখন খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়েতে হ্যাঁ বললে আমাদের এই সুন্দর বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে। দাম্পত্যের চক্রব্যূহে তাই তোকে নিয়ে যেতে চাইনি। তাই তোকে না বলেছি। কিন্তু এখন আমি বুঝেছি। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে জীবন কাটাতে পারার সৌভাগ্য সকলের হয় না। আমি পেয়েও সেটা হারিয়েছি, নিজের দোষে। জানি, খুব লেটে বুঝেছি, ঋত্বিকা সাক্ষী। ক্ষমা করিস প্লীজ। "

চারিদিক চুপ। এই অবধি বলে টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে ঢক ঢক করে জল খেলো শ্রেয়া। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, "তাহলে? বিয়েটা ক্যান্সেল্ড তো?"

শ্রেয়ার মা বলে উঠলেন বেশ রাগি মুখ করেই, "কীসের ক্যন্সেল? দোষ করেছ, মাসুল দিতেই হবে। বিয়ে তোমায় করতেই হবে।"

"এত কিছুর পরেও?"

আর তখনই উপস্থিত সক্কলে, স্কাইপের পর্দা থেকে অগ্নি সহ, অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল।

অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে অগ্নি বলল, "শোন শ্রেয়া, আমার ফ্লাইট মিস হবে। আমি উঠছি। পারলে এয়ারপোর্টে আয়, নইলে এক্কেবারে মঙ্গলবার মন্ডপে দেখা হচ্ছে। মুয়াহ।"

শ্রেয়ার মুখ হাঁ। কিছুই বুঝছেনা। ইতিমধ্যে সোমকের বাবা সকলের জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে হাজির।

"নাও, মিষ্টি মুখ করো। শুভদিনে। "

"বাবা, মা। আমি কিছু বুঝছিনা। কেসটা কী হল?"

"কেস কিছুই না। বলছি। আগে মায়ের থেকে দু হাজার টাকা নিই। তিনি বেটে হারলেন। তার ধারণা ছিল আমাদের প্ল্যান বি লাগবে।"

"মানে?"

"মানে আর কিছুই না। যেদিন অগ্নিকে তুই রিজেক্ট করলি, ও আমায় জানাল। তারপর আমি আর তোর বাবা মিলে আলোচনা করলাম। বুঝলাম আমাদের মেয়ে গাড়ল। হাজার হাজার লাইন কোড লিখতে পারলেও, জীবনের এল্গোরিদমে জিরো। তাই কিছু একটা ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। সিনে এন্ট্রি নিলো সোমক। সুরঞ্জনাদি আমাদের লাইব্রেরিতুতো দিদি। জানতাম ওঁর ছেলে ব্যাঙ্গালোরে আছে, নাটকে উৎসাহী। ব্যস, শুরু হল স্ক্রিপ্ট লেখা। অভিনয়পর্ব। ঋত্বিকাও আছে এই নাটকে। আমি ভাবিনি প্ল্যান এ-তেই তুই কুপোকাত হবি। তাই প্ল্যান বি সি ডি ছিল।"

৫।

আর কী, মঙ্গলবার গোধূলি লগ্নে শ্রীমান অগ্নি সেনের সাথে কুমারী শ্রেয়া চ্যাটারজীর শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হল। নাচগান হইহল্লা খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে বিয়েবাড়ি জমজমাট। বাসরে এক প্রস্থ গানবাজনার ফাঁকে যখন রেস্ট চলছে, তখন ঝটপট রাহুলকে ফোন লাগালো অগ্নি। রাহুল ওর ফ্ল্যাটমেট। ছুটি না পাওয়ায় বিয়েতে আসতে পারেনি।

" ভাই, ফাইনালি শ্রেয়ার সাথে বিয়েটা হল। পেটিএম কর দু হাজার। বেটটা হারলি।"

"তুইও আমাদের বিয়ে নিয়ে বেট ফেলেছিলি??" কপট রাগি স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে হাল্কা করে অগ্নির কান মুলে দিল শ্রেয়া।

আর এইভাবেই শুরু হল এই নব দম্পতির টক ঝাল মিষ্টি দাম্পত্য।

*********************

(অনেকদিন পর নিখাদ প্রেমের গল্প লিখলাম। মতামত জানাবেন। নামকরণ করেছি একটি সিনেমার গান থেকে। "ঘরে এন্ড বাইরে" ছবির "তারা খসে পড়ে" থেকে।)