উত্তর কলকাতার গলি, তস্য গলির ভিতর দুই শতাব্দী প্রাচীন রঙ ওঠা পলেস্তারা খসা বাড়ির ঘরগুলিতে যেমন আলো ঢোকেনা, ঠিক তেমনই বাড়ির বাসিন্দাদের মনও কোন অন্ধকারেই পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এ বাড়ির মানুষগুলো এখনো মনুস্মৃতি আগলে চলে, এরাই প্রকৃত "মনুর সন্তান"।
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নয়, নেহাত বাল্যবিবাহ আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গৌরিদান প্রথা বন্ধ হলেও এ বাড়ির মেয়েরা বা বউরা কেউই তাদের স্কুল পাসের পর কলেজে যায়না বা যায়নি। সৎপাত্র দেখে কোনো এক ফাল্গুনী সন্ধ্যায় বা গ্রীষ্মের দাবদহে রিক্ত গোধূলি লগ্নে বিয়ে হয়ে যায় এদের, সব আশা আকাঙ্খা বিসর্জন দিয়ে। বা বলা যেতে পারে, এদের আর কোনো শখের স্বপ্ন দেখতে শেখানো হয়না ছোট থেকে।
এমনই এক বাসন্তী দিনে এ বাড়িতে এসেছিল সুরমা। বাপ মা মরা মেয়ে, মামাবাড়িতে বড় আদরে মানুষ। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো মাথা, কিন্তু সামাজিক নিয়মের বেড়ায় গত কুড়ি বছর তার আর কোনো প্রথাগত শিক্ষা লাভ হয়নি। তবে ছেলে মেয়েকে নিয়ম করে পড়তে বসাতে গিয়ে কোন ফাঁকে যে তরতর করে নিজেরও পড়া হয়ে যেত খানিক, বাড়ির কেউই জানেনি।
আজ সকাল থেকে বড্ড ভয় ভয় করছে সুরমার। ছেলের সাহায্যে প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষা দিয়েছিল। গত দুই বছর ফার্স্ট ক্লাস মিস হয়েছে একটুর জন্য। আজ ফাইনালের রেজাল্ট। ফার্স্ট ক্লাসটা হয় কি না, এটা দেখার। সুরমা জানে ওর এই ডিগ্রির কথা হয়তো বড় মুখ করে বাড়ির কাউকেই বলতে পারবেনা ও, নিজের স্বামী দীপককেও না। তবুও যাই হোক, নিতান্তই আত্মতুষ্টির একটা ব্যাপার থেকেই যায়।
আজ আবার ছেলে অম্বরীশেরও জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট।
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক দশটা বাজলো। হুড়মুড়িয়ে বাবা ছেলে কম্পিউটারের সামনে। অধীর আগ্রহে রেজাল্ট দেখতে। আশাতীত ভালো ফল করেছে অম্বরীশ, মেধাতালিকায় প্রথম দশে নাম।
"কই গো শুনছো? ছেলে আমাদের দারুণ করেছে পরীক্ষায়। মিষ্টি আনাও। বাড়ি বাড়ি পাঠাবো।" দীপকের গমগমে গলায় আজ আনন্দ।
"বাবা আমার এই ভালো রেজাল্টের একটা পুরস্কার চাই। বলো কী দেবে?"
"তুই যা চাইবি, আমি তাই দেবো। কথা দিলাম।"
ছেলের মুখে হাসি ফুটলো। মাকে ডেকে আনল ঘরে। তারপর মা বাবার সামনে অন্য ট্যাবে খুলল মায়ের পরীক্ষার রেজাল্ট পেজ। জ্বলজ্বল করছে সেখানে
"সুরমা ঘোষাল। অঙ্ক অনার্স। প্রাপ্ত নম্বর পঁয়ষট্টি শতাংশ।"
"বাবা, প্লিজ মাকে এবারে বি এড পড়তে দাও। এটাই আমার পুরস্কার।"
সুরমার দুই চোখ ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। দীপক হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে, বিহ্বলতা কাটাতে দেরি আছে। অবাক হয়ে একবার স্ত্রী আর একবার ছেলের দিকে বারবার তাকাচ্ছেন।
আজ বাড়িতে হইহই রব। বাড়ির ছেলে ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছে। বংশে এই প্রথম।
একই সাথে একদা "অনুর্দ্ধা কুড়ি, কুলীন ব্রাহ্মণ, গৌরবর্ণা, গৃহকর্মে নিপুনা, অতীব সুশ্রী পাত্রী" আজ বেরোচ্ছেন বি এড পড়তে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এও কম বিস্ময়ের না, বংশে এই প্রথম।
একই সাথে একদা "অনুর্দ্ধা কুড়ি, কুলীন ব্রাহ্মণ, গৌরবর্ণা, গৃহকর্মে নিপুনা, অতীব সুশ্রী পাত্রী" আজ বেরোচ্ছেন বি এড পড়তে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এও কম বিস্ময়ের না, বংশে এই প্রথম।
No comments:
Post a Comment