Tuesday, June 5, 2018

অতঃ স্টুলিশ কথা

সবে গলা গলা ভাত আর আলুনি ট্যালটেলিয়া মাংসের ঝোল খেয়ে ঘরে ঢুকতে যাবো, ওমনি রুদ্র খপাং করে ধরল, "ভাই, ভালো ফ্রেশ জিনিস আছে। চল চল। আমাদের রুমে চলে আয়। হেব্বি মস্তি করবো।" পাশ থেকে সৌরভ, বিলু আর শঙ্খও "হ্যাঁ ভাই চল চল। ট্রেলার দেখেই চমকে গেছি। এ জিনিস পুরো সেইইইই। মিস করিস না। তোর রানিং কমেন্ট্রি ছাড়া জমবেনা" বলে সম্মিলিত কাকুতি মিনতি করতে লাগল। এরা পারেও বটে! কাল কিনা সেমেস্টারের সবচেয়ে কঠিন সাবজেক্টের পরীক্ষা। Heat and Mass transfer। এখনো তার আদ্ধেক ফর্মুলা ডেরিভেশন মুখস্থ হয়নি, এই এত্ত এত্ত পড়া বাকি। ইন্টারনালে ভালো মার্কস নেই এটায়। সিজিপিএ বিচ্ছিরিভাবে ঘেঁটে যাবে এটায় ছড়ালে, চাকরির বাজার এক্কেবারে ফাটা কলসী। এখন নাকি পড়াশোনা ছেড়ে এদের সাথে এসব ভুলভাল জিনিস দেখবো। হিট এবং মাস পরে সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে ট্রান্সফার করলেও চলবে। আগে কালকে পাস করি। ভাবতে পারল কী করে এরা? নিজদের পড়া নিয়ে চাপ নেই। জানে এখন হাজার চেষ্টা করলেও সিজিপিএ ইম্প্রুভ করবেনা, তা বলে পরীক্ষার আগের রাত্তিরটা তো ছাড়!!! মা ঠিকই বলে, পরীক্ষার কদিন মেসে না থেকে ছোটপিসির বাড়ি থেকে যাতায়াত করলে কাজে দিত। অন্তত শান্তিতে পড়তে পারতাম মন দিয়ে।
"না রে ভাই। এখনো চারটে চ্যাপ্টার পড়া বাকি। আজ হোল নাইট করতে হবে। তোরা যা। কাল পরীক্ষার পর জমিয়ে মস্তি করবো।" এই বলে কাটিয়ে ঘরে এলাম। সাড়ে নটা বেজে গিয়েছে। ঝটপট মাকে একটা ফোন সেরে নিয়ে পড়তে বসলাম। পৌনে দশটা। পনেরো মিনিট একটু ফেসবুকে ঘুরে আসি, তারপর একদম টানা ছটা অবধি পড়ব। আট ঘণ্টা। চারটে চ্যাপ্টার। একদম পারফেক্ট। আটটা অবধি একটু তারপর ঘুমিয়ে পরীক্ষা দিতে চলে যাব। পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। মনে করে আটটা, আটটা দশ, আটটা পনেরো, আটটা কুড়িতে অ্যালার্ম লাগালাম। অ্যালার্ম টোনে পল্টুর করা এস কে ডি স্যারের মিমিক্রি। ওই চিলচিৎকার শুনে শিয়োর ঘুম ভাঙবেই, মেক্যানিকালের প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রী যারা কিনা দেশের বাইরে থাকে, তারাও বোধহয় ওই আওয়াজের ঠেলায় উঠে পড়বে, এমনই এফেক্টিভ।
ফেসবুক খুলতেই প্রথমেই চোখ আটকে গেল অপালার ছবিতে। ডিপি পালটেছে। কী সুন্দর লাগছে। একটা লাল রঙের বেশ আকর্ষক ড্রেস পরেছে, অপূর্ব লাগছে। ঠোঁটের রং জামার রং এক। কোনদিকে যে তাকাই। ""Enjoying the summer at Shimla, P.C. Shubhro"। ও, পরীক্ষা শেষ, গরমের ছুটিতে সিমলা গিয়েছে। বেশ বেশ। মনোরম পরিবেশ, দারুণ লাগছে। কিন্তু এই শুভ্রটি কে? ওর ভাইয়ের নাম তো মুকুল। তাহলে এ কে? দেখি তো।
যতক্ষণে আমার এফ বি আই কে হার মানিয়ে দেওয়া স্টকিং স্কিলের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে জানতে পারলাম যে শুভ্র হল কাকু, মানে অপালার বাবার কোলিগের ছোট ছেলে, সবে ক্লাস টুয়েলভ, ওদের ফ্যামিলিও বেড়াতে গিয়েছে একসাথে, শুভ্রর প্রিয় শিল্পী রূপম আর বন্ধুমহলে ভালো ডিপি তুলে দেওয়ার জন্য বেশ বিখ্যাত (হ্যাঁ, এই ডিপিটা কিন্তু দারুণ তুলেছে। অবশ্য অপালাকে দেখতেই এত মিষ্টি, নোকিয়ার VGA ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেও এমনই অপ্সরাই লাগতো) ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটা ছুঁইছুঁই। নাহ, আর না। মেক্যানিকালে তিন তিনটে বছর কাটিয়ে দিলাম এই মরুভূমিতে, ওয়েসিসের সন্ধান না হয় কাল করবো। পরীক্ষা মিটুক। এইবারে বাড়ি গিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। অপালা আমার পাড়ার মেয়ে। আজ অবধি কোনদিনও তেমনভাবে কথা হয়নি সামনাসামনি। তবে ফ্রেন্ডলিস্টে আছে ফেসবুকে। যদিও চ্যাটবক্সেও ওই প্রথমদিন হাই হেলো ছাড়া কথা বলিনি, কিন্তু রেগ্যুলারওর ছবিতে লাইক করি। আজকাল তো আবার লাভ ছাড়া দিইনা। তা অমন সুন্দরী ও বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ের পোস্টে লাভ ছাড়া কিছু মানায় না যে, কী করবো আমি।
যাই হোক, নিজেকে সংযত করে বেশ গুছিয়ে খাতা কলম বই নিয়ে পড়তে বসলাম। একটা চ্যাপ্টার দেখলাম দুঘণ্টায় নামিয়েও ফেলেছি। নিজেই নিজের প্রোগ্রেসে খুব খুশী, ভাবলাম একবার একদা সাইলেন্ট ফোনটি দেখি। কোন মেসেজ এলো কি না।  ওরে বাবা, স্টুলিশে একটা মেসেজ নোটিফিকেশন দেখি। খুব উৎসাহ নিয়ে খুললাম। ইন থিং বলে বন্ধুদের মতো আমিও ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে মাস খানেক আগে খুলেছিলাম অ্যাকাউন্ট। প্রথম চার পাঁচদিন বন্ধুরাই প্রচুর খিস্তি খেউর করেছিল। তারপর একদম ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতই সব শান্ত। এই অ্যাপ যে এখনো ফোনে আছে, সেটাই আর খেয়াল ছিলনা। এই এতদিন বাদে কে কী মেসেজ করল, দেখি।

"Hi! I know you stalk me on social media. Even though we have never spoken, but I wait intently for your reactions. I hope one day we will surely meet and talk.
P.S. Single তো?"

কেস করেছে! এরকম পারফেক্ট ইংরেজি। কে? রুদ্র দীপু এরা তো কেউ এমন পরিষ্কার ইংরেজি লিখতে পারেনা। তাহলে? শিয়োর কোন বন্ধুই হবে। ইচ্ছে করে। পিছনে লাগছে। কিন্তু কে? অনেক ভেবেও মাথায় কিছুই এলোনা। থাক, পরে ভাবা যাবে। আগে তো পড়া শেষ করি। কালকের পেপারটা উৎরোতেই হবে।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলেছে। রাত দুটো। কনভেক্টিভ হিট ট্রান্সফার নিয়ে বসে আছি সেই কখন থেকে। মাথায় ঢুকছেনা। ধুর ছাই। ফ্লাস্কে রাখা কফি খেলাম এক কাপ। মাথাটা একটু চাঙ্গা হল। দেড়টা নাগাদ বুঝলাম এতক্ষণ ধরে সেকেন্ড অর্ডার ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনে কন্সট্যান্ট বসাইনি। প্রতিবারের মতোই। আর তাই আবারও মেলাতে পারছিলাম না হিসেব। যাই হোক।

বই খুলে বসে আছি। একেকটা প্রব্লেম নিয়ে এমন ফাঁসান ফাঁসছি, অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশী সময় লাগছে। আরে মাথার আর দোষ কী? ফর্মুলা ভাবতে গেলে যে ""Single তো?" ভাসছে সমানে। আচ্ছা অপালা না তো? আমি যে রেগ্যুলারলি ওর প্রোফাইল রীতিমতো স্টক করি, সেটা যে কেউ বুঝবে। ও বোকা নাকি যে বোঝেনা? এই তো সেমিস্টার শুরুর আগে বাড়ি থেকে ফিরছিলাম যখন, বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল। বন্ধুবান্ধব নিয়ে। আমাকে দেখেই বান্ধবীগুলো তো অপালার গায়ে পড়ে পড়ে যাচ্ছিল। বাবা রে। সে কী ফুসুরফুসুর, ফিসফাস। অপালাকে কি একটু হেসেছিল? সলজ্জ হাসি? ব্লাশ করেছিল?

ধুর ধুর। অঙ্ক মেলাতে পারছিনা খাতায়, রাত তিনটের সময় এদিকে মাথার মধ্যে এই চলছে। সত্যি বাবা, আমাদের মেক্যানিকালের ছেলেদের বড় জ্বালা। নারী মনও বুঝিনা। অঙ্ক নিয়েও হিমশিম।

রাস্তার কুকুরগুলো মাঝেমাঝে চিৎকার করছে। এছাড়া সব শুনশান। একবার বাইরে বেরোলাম। রুদ্রদের ঘরে আর আলো জ্বলছেনা। জোরে হাসাহাসির শব্দও নেই। ঘুমিয়ে পড়েছে মনে হয়। কী করে যে এত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে ওরা কে জানে।

ঘরে ফিরলাম। অস্থির অস্থির লাগছে। যত মনকে প্রবোধ দিই, কালকের পরীক্ষাটা উৎরে যাই, তারপর গোয়েন্দাগিরি করবো, মন মানে না। ফেসবুক খুলে সিধে মেসেঞ্জার লিস্ট। চেনাজানা কেউ তেমনভাবে অনলাইন নেই। আদার ফোল্ডারেও কোন মেসেজ নেই। অপালার লাস্ট সিন ওই সাড়ে নটায়। ডিপিতে কারুর কমেন্টে লাইক করেছিল। ধ্যাত্তেরি। কাল পরীক্ষা শেষ করে সোজা বাড়ি। নিজের না। আগে অপালার। স্ট্রেট প্রশ্ন করবো। তারপর যা হবে, দেখা যাবে। এরকম ভাবে হয়না।
ভগবান, এতগুলো চ্যাপ্টার বাকি। সময় নেই। সাড়ে চারটে বেজে গেছে। ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে করছে। আজ আর ঘুমটা হবেনা। পরীক্ষার হলে না ছড়াই। সাপ্লি খেলেই শেষ। ফার্স্ট ইয়ারে মনে আছে হোল নাইট করে একজ্যাম হলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আচ্ছা আজও তাই হলে? এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই? না থাক। আধ ঘণ্টা। অ্যালার্ম দিলাম পাঁচটার। একটু হেড ডাউন করলাম।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম সিমলার টাউন হলের সামনে বরফ। সেখানে একটা লাল জ্যাকেট নীল জিন্স আর কালো টুপি পরে আমি আর আমার পাশে লাল ড্রেস পরে অপালা। আমরা বরফ নিয়ে খেলছি। ব্যাকগ্রাউন্ডে "yeh haseen waadiyaa" চলছে। আহা, কী মিষ্টি। গানটা চলতে চলতে হঠাৎ যেন তাল কেটে গেলো। সেই টেপ রেকর্ডারের ফিতে জড়িয়ে গিয়ে যেমন হয়, ওরকম। একটা বিটকেল শব্দ, ""Wake up, wake up". তারস্বরে কে চেঁচাচ্ছে। কষ্ট করে চোখ খুলে হাতড়ে হাতড়ে চশমা চোখে দিয়ে দেখি পল্টুর গলার আওয়াজের অ্যালার্ম। মরেছে রে। সোয়া আটটা বাজে। নটায় একজ্যাম। পড়ি কি মরি হয়ে ছুটলাম। হলে পৌঁছে স্বাভাবিকভাবেই এক্সপিরিয়েন্স ভালো ছিল না। কোনোমতে টায়টুয়ে পাস মার্ক উঠবে হয়তো মনে হল।

মন মেজাজ ভালো ছিলনা। বাড়ি ফিরে অপালাদের বাড়ি গিয়ে দেখি, তালা ঝুলছে। বুঝলাম এখনো ফেরেনি। মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ পাঠালাম। স্টুলিশের স্ক্রিনশট নিয়ে।
"এটা তুমি পাঠিয়েছ তো? কবে ফিরছ? সিসিডি যাবে ফিরে?"
দেখলাম মেসেজ সঙ্গে সঙ্গে সিন। কোন উত্তর নেই।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। পেজ রিফ্রেশ করলাম। তাও কিছু নেই।

"আছো?"
মেসেজ সিন হলো না আর।
সার্চ বক্সে অপালা সেন লিখে সার্চ করলাম। পেলাম না। ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে খুঁজলাম। এখানেও পেলাম না। বুঝলাম ব্লক করে দিয়েছে।

হায় রে। পরীক্ষাও গেলো। মেয়েও পটলো তো না-ই, উল্টে ভেগেই গেলো।

হায় মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার!!!!

রাত্রেই স্টুলিশ আনইন্সটল করলাম। অনেক হয়েছে। আর না। এই প্রতিজ্ঞা করলাম। স্টুলিশ বাবাজির এক ভক্ত কমে গেলো।


জানতে পারলাম না আরেক ভক্তও ওইদিনেই কমেছে। রুদ্র। ক্লাস টপার সোনালীকে একটা "থ্যাংকস রে মেসেজ কম্পোজ করে দিলি বলে। কাজ হাসিল" এস এম এস পাঠিয়ে নিজের ফোন থেকে ও ও স্টুলিশ উড়িয়ে দিল। কত জোট গড়ল, ভাঙল স্টুলিশের চক্করে, কিছুই জানতে পারলাম না। 

No comments:

Post a Comment