Friday, June 1, 2018

ভালোবাসা ভালো থেকো

ভালোবাসা ভালো থেকো

১।

কলকাতা এয়ারপোর্টের লাগেজ বেল্টে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বারবার ঘড়ির দিকে নজর চলে যাচ্ছিল শ্রেয়ার। একই সাথে ব্যাঙ্গালোর আর ইম্ফলের ফ্লাইটের লাগেজই পাঁচ নম্বর বেল্টে দেওয়ায় কতক্ষণে স্যুটকেস হাতে পাবে, এই চিন্তা। একেই ফ্লাইট লেট করেছে,কখন যে বেরোতে পারবে, অধৈর্য লাগছে শ্রেয়ার। বেল্টের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটার পর একটা লাল কালো বেগুনী ট্রলি ব্যাগের আসা যাওয়া দেখছে ও, সবেতেই ইম্ফলের ট্যাগ লাগানো। আশেপাশে থেকে বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি, ধুপধাপ উল্টে পড়া - আজকালকার মা বাবারা হয়েছে এক, সব অকর্মণ্য। আরে বাচ্চাগুলোকে সামলা, তা না। এই এক্ষুনি একটা বছর তিনেকের মেয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ছিল কনভয় বেল্টের ওপর। কী কেলেঙ্কারি কাণ্ডই না হতো! নিজেদের ছোটবেলাতে এমন কাণ্ড ভাবতেই পারেনা শ্রেয়া। দিনকাল বদলাচ্ছে।

এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হ্যান্ডব্যাগের ভিতর থেকে মোবাইল ফোন বেজে উঠল। প্রত্যূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরোদের শব্দে এদিক ওদিক থেকে কয়েকজন তাকালো ওর দিকে। হয় বাবা, নয় সোমক। সোমক ঘোষ, ব্যাঙ্গালোরেই কর্মরত, আর ঠিক দশদিন পর শ্রেয়ার সাথে ওর বিয়ে। ও গতকাল এসেছে কলকাতা। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি পৌঁছনোর দায়িত্ব তাই এইবারে ও নিয়েছে। প্রতিবার কিন্তু এখনো যাওয়া আসা সবসময়েই বাবা থাকে সাথে। বিয়ের ফুল ফুটল কি ফুটল না, ওমনি কীরকম সব যেন পালটাতে থাকলো। অদ্ভুত লাগে ভাবতেই।

ফোনের স্ক্রিনে দেখল, বাবার নম্বর। রিসিভ করে ,"হ্যাঁ বাবা, লাগেজের অপেক্ষায় আছি" জানালো শ্রেয়া।

"হ্যাঁ, সে বুঝেছি। অগ্নি ট্র্যাক করছিল ফ্লাইট। ও বলল।"

"অগ্নি? ও আবার কোত্থেকে এলো?"

"না, না। ও ফোন করেছিল তোর মাকে। তখন বলছিল।"

"বাব্বাহ, শনিবার সকাল সকাল তিনি জেগেও গিয়েছেন?"

"তাই তো দেখছি। ছেলের মতিগতি বদলাচ্ছে।"

"সেই। আচ্ছা বাবা, এবার আমাদের লাগেজ দেওয়া শুরু হয়েছে। আমি এখন রাখি। বেরিয়ে ফোন করছি।"

"বেশ। সোমককে জানিয়েছিস?"

"না। ও নিশ্চয়ই বাইরে বোর্ড দেখতে পাচ্ছে। আবার মেসেজ কলের দরকার কী?"

"তবুও..."

"কোন কিছু না। বাবা বাই।"

মিনিট পনেরো পর ট্রলিতে দুটো ঢাউস স্যুইটকেস আর কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ আর একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে শ্রেয়া বেরোল গেট 3A থেকে। ফোনটা বের করে সোমকের নম্বরে কল করতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে বান্দা হাজির। নীল জিন্স প্যান্ট আর সাদা টিশার্ট, চোখে স্টাইলিশ সরু ফ্রেমের চশমা পরে এক গাল হাসি হেসে বলল, "ফ্লাইট কমফোর্টেবল ছিল তো?"

ভারি আড়াই ঘণ্টার ডোমেস্টিক ফ্লাইট, তার আবার কমফোর্টেবল আনকমফোর্টেবল। এইসব লোক দেখানি বাড়াবাড়ি রকমের সৌজন্যবোধ কেমন একটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। যতসব।

"ওই, যেমন থাকে।" বলে হাল্কা হাসল শ্রেয়া। কদিন বাদে যার সাথে বিয়ে, তার প্রতি কেন যে এখনো একটুও অনুরাগ জন্মায়নি ওর, মাঝে মাঝে বেশ অবাক লাগে ওর। অন্য বন্ধুবান্ধবদের তো দেখেছে, আরেঞ্জেড হোক কি লাভ, বিয়ের আগে আগে সব প্রেমে হাবুডুবু খায় তারা। অথচ এমনও না যে আবেগ কম ওর। বন্ধুবান্ধবদের প্রিয়, সকলের ব্যাপারে মোটামুটি সহানুভূতিশীল সব সময়।

চিন্তার জাল কাটল আবারও সোমকের গলায়।

"কী হল? এনিথিং রং?"

"না। চলো।"

ট্রলিটা নিজে ঠেলতে ঠেলতে একটু এগিয়ে ধার ঘেঁষে রাখল সোমক।

"তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি প্রিপেডের লাইনে দাঁড়াই। বুকিং করে রেখেছি।"

২।

গাড়ি চলছে। শ্রেয়ার চোখ জানলার বাইরে। ছয় মাস পর ও নিজের শহরে এলো। অথচ এবারে যেন সবকিছুই কীরকম অন্যরকম লাগছে। অতি পরিচিত সাদা নীল রেলিঙগুলো রাস্তার ধারে যেন ভীষণভাবে চোখে লাগছে। রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে ফুটে ওঠা ওর অতি প্রিয় কাগজ ফুলও বিরক্তিকর। মেঘলা আকাশ, যে কোন সময়ে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হবে। শনিবার দুপুর হলেও, রাস্তায় অল্পবিস্তর জ্যাম লেগেই আছে। রুবি কানেক্টরে গাড়ি আটকে আছে যখন, মায়ের ফোন এলো।

"কী রে কতদূর?"

"কেন এটা তোমাদের অগ্নি ট্র্যাক করতে পারছেনা? জানায়নি?"

"ধুত্তেরি। সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দিস না কেন রে?"

"সরি। মেজাজ খিঁচরে আছে। রুবি।"

"কেন, কী হল? খিদে পেয়েছে নির্ঘাত?"

"হুম।"

"আমি ঠিক বুঝেছি। মেয়েটা আমার এত বড় হয়ে গেলো, অথচ দেখো। খিদে পেলে সেই বাচ্চাদের মতো করে যাবে। কবে বড় হবি?"

"খুব কি দরকার?"

"ওমা, কথা শোনো মেয়ের! যাক গে, তোরা আয়। বাবা তো গেটে দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে। মেয়ে জামাইকে ওয়েলকাম করবে বলে।"

"কী খাওয়াবে আমায়?"

"আয়ই না। কতদূর এলি?"

"গড়িয়াহাট মোড়।"

"চলে আয়। সোনা মা।"

"কাকু কাকিমা খুব এক্সাইটেড তোমায় এতদিন বাদে দেখবেন বলে।"

"এতদিন কই? এই তো গত মাসেই ঘুরে গেল ব্যাঙ্গালোর থেকে।"

"হুম, কিন্তু কাল ওদের দেখলাম তো। খুব এক্সাইটেড।"

"তুমি কাল আবার কখন দেখলে?"

"রাত্রে দেখা হল।"

"ও।"

শ্রেয়ার যে মুড বিশেষ ভালো না, সোমক ঠিক বুঝেছে, তাই আর কথা বাড়াল না। এমনিতে সদা হাসিখুশি ছেলেটা ঘাঁটাতে সাহস পেলো না, কী দরকার, ফোঁস করে গেলে? দুদিন বাদে বিয়ে, এখন থেকেই বেশ তোয়াজ করে চলতে হবে দেখছে। দাদা বৌদি ম্যারেড বন্ধু বান্ধবদের দেখে এইটুকু শিক্ষা পেয়ে গিয়েছে ও এতদিনে।

৩।

ঋত্বিকা শ্রেয়ার একদম ছোটবেলার বন্ধু। চাকরি করে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে। শ্বশুরবাড়িতে খুব কাছের আত্মীয়ের বিয়ে আর শ্রেয়ার বিয়ে একই দিনে পড়ায় অত্যন্ত খারাপ লাগা নিয়েও ওকে ওই সময় পাটনায় যেতে হচ্ছে। তাই আগেভাগে এসে প্রাণের বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রথমে ঠিক ছিল বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া হবে, কিন্তু দুদিন আগে শ্রেয়া প্ল্যান ক্যান্সেল করে সাউথ সিটিতে ডেকে নিল। শেষ মুহূর্তের কিছু শপিং আর প্রিয় বেঞ্জারং রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সারবে বলে।

দুপুর একটা নাগাদ শ্রেয়া পৌঁছল সাউথ সিটির সামনে। পরনে একটা হলুদ চিকন সালওয়ার কামিজ। চোখে রোদ চশমা। যথারীতি ঋত্বিকা আগে থেকেই চলে এসেছে। ও পরেছে জিন্স আর টপ। বরাবরের মতোই সুন্দর লাগছে ওকে।

"আসুন ম্যাডাম। পৌনে একটা বলে একটা বাজালেন সেই!"

"উফ, আগে একটা হাগ তো দে। তারপর কমপ্লেইন করবি।" বলে হেসে দুই বন্ধু একে অপরকে আলিঙ্গন করল।

"বল তো শ্রেয়া, ব্যাপারটা কী?"

"কীসের কী?"

"হুঠ করে বাড়ির লাঞ্চ ক্যান্সেল করলি। কিছু নিশ্চয়ই গভীর আলোচনার ব্যাপার আছে যেটা আঙ্কল আন্টির সামনে করতে পারবি না। তাইই বাড়ির বাইরে আনলি। আমায় বল।"

" অ্যান্ড দ্যাটস ওয়াই আই লাভ ইয়ু সো মাচ ঋতু। তুই ঠিক বুঝেছিস। বলবো বলবো। সব বলবো। আগে চল, খাবারটা অর্ডার করি।"

বেঞ্জারঙে প্রিয় থাই রেড চিকেন কারি আর গুং পাও অর্ডার করল ওরা। লেমন মোয়িতোতে হাল্কা চুমুক দিয়ে শ্রেয়া বলল, " শোন না। আমি পালাতে চাই। আমায় একটু সাহায্য করবি?"

শ্রেয়া বরাবরের যাকে বলে "ছিটগ্রস্থ", উতপটাং সিদ্ধান্ত নিতে ওস্তাদ। স্কুল কলেজ জীবনে বহু উদাহরণ আছে ওর হঠকারিতার। এমনকি চাকরির ট্রেইনিং চলাকালীনও সাঙ্ঘাতিক রিস্ক নিয়ে ছুটি না নিয়ে গপ্প ফেঁদে মাইসোর থেকে কলকাতায় পালিয়ে এসেছে পুজোয় বাড়ির জন্য মন কেমন করেছে বলে। ওর থেকে এমন কথা শুনে খুব একটা অবাক হয়নি তাই ঋত্বিকা। বিয়ের মতো একটা বড় ব্যাপার, এর আগে সাধারণ লোকজনই ভয় পায়, নার্ভাস হয়ে যায়। শ্রেয়ারও যে কিছু একটা এমন হবে, এটাই স্বাভাবিক। বরং শান্তিতে নির্বিঘ্নে বিয়েটা মিটলে ও বরং ওর বর সুদীপ্তর কাছে বেটে হারত। সুদীপ্তকে তো শ্রেয়ার বিয়ের খবর শোনার পরই প্রথম কথা বলেছিল, "দেখো, ও মেয়ে শিয়োর কোন না কোন কাণ্ড বাধাবে। ওর বিয়েটা একটা মেমোরেবল ঘটনা হবেই।"

"তা পালাবিটা কেন শুনি? বিয়েতে তো নিজেই মত দিয়েছিলি বলেছিলি।"

"হ্যাঁ, তা দিয়েছিলাম বটে। কিন্তু সেটা আট মাস আগে।"

" শ্রেয়া তুই কি পাগল হলি? এক সপ্তাহ পর বিয়ে আর এখন বলছিস পালাবি? ইয়ার্কি নাকি?"

"আমার সোমককে বিয়ে করতে ইচ্ছে করছেনা।"

"ইচ্ছে করছেনা মানে? অমন ভালো ছেলে। এক্কেবারে যাকে বলে রাম মিলায়ে জোড়ি তোদের। দুজনেই ব্যাঙ্গালোরে, ভালো চাকরি করিস। বেড়াতে ভালোবাসিস। ও কত কালচারালি ওরিয়েন্টেড বল তো? নাটক করে রেগ্যুলারলি। প্যাশন আছে। দেখতে শুনতে ভালো। প্লাস..."

"উফ থাম তো। মায়েদের মতো বলে যাচ্ছে।"

"সত্যি যা, তাই তো বলছি শ্রেয়া।"

কথোপকথনে মৃদু ব্যাঘাত ঘটল গুং পাওয়ের আগমনে। বড় সুস্বাদু এই ডিশটি, চিংড়ির তৈরি। ব্যাঙ্গালোরে থাকতে বহুবার অগ্নির সাথে খেতে গিয়ে এটা খেয়েছে। শুরুতে ভালো না লাগলেও, একওয়ারড টেস্ট। চিংড়িতে কামড় দিয়ে আবার চলল ওদের কথা।

"তুই বুঝছিস না ঋতু। আই ডোন্ট ফিল হ্যাপি আরাউন্ড সোমক।"

"ডোন্ট ফিল হ্যাপি মানেটা কী? ছয় মাস ধরে তো দিব্যি ডেট করলি। তখন তো সোমকের প্রশংশায় পঞ্চমুখ।"

"মোটেই পঞ্চমুখ না। হি ইজ গুড, বাট নট একজ্যাক্টলি মাই টাইপ।"

"তা তোমার টাইপটা কী শুনি?"

"হাসিখুশি হবে, অথচ সারাক্ষণ ওই হ্যাহ্যা হিহি না। সোমককে তো মাঝে মাঝে মনে হয় প্রফেশনাল কমেডিয়ান। একটু নারড। বই পড়তে ভালোবাসবে। ঘন্টার পর যার সাথে বই গান নিয়ে গল্প করতে পারব।"

"তাহলে অগ্নি যখন প্রপোজ করল, ওকে না বললি কেন? তোর পুরো ডেসক্রিপশন কিন্তু অগ্নির মতোই হল।"

"বেস্ট ফ্রেন্ড ও আমার। এইসব বিয়ে টিয়ে করে ঘেঁটে দিতে চাইনা।"

"শোন, লোকে নিজেদের কপাল ভালো মনে করে বেস্ট ফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে পারলে। আর তুই কিনা এরকম বোকাবোকা কারণ বলছিস? অদ্ভুত মেয়ে তুই। যখন গত বছর ও তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিল, আমায় তো অন্য কারণ বললি কাটানোর। কি নাকি ও খুব সন্দেহপ্রবণ, প্রাচীনপন্থী। আর এখন বলছিস বেস্ট ফ্রেন্ড? তা এমন ছেলে যার সাথে জীবন কাটাতে পারবে না, সে বেস্ট ফ্রেন্ড হয় কী করে?"

"না, ওটা মিথ্যে বলেছিলাম। আসল কারণ এটাই যেটা বললাম এখন। তোদের বা মা বাবাকে বললে ওরা মানত না। হেসে উড়িয়ে দিত। ও খুবই ভালো ছেলে। কিন্তু দেখ, ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার যাবতীয় যা ঝগড়া ঝামেলা যেখানে যা হয়, দিনের শেষে ওর কাছে বলতেই হয়। ও পেশেন্টলি শুনে আমায় ভরসা দেয়। এবার ওকে বিয়ে করলে আমি কার কাছে দাম্পত্য কলহ নিয়ে যাবো?"

"তুই আস্ত পাগল শ্রেয়া। ইট ইস সো ক্লিয়ার, ইয়ু লাভ অগ্নি। মিছিমিছি তুই সোমকের সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিস। আই ক্যান সি ইট ইন ইয়োর আইজ।"

"আমি অগ্নিকে ভালোবাসি? ধ্যাত না। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ব্যস।"

"আরে না রে বাবা। চুপ করে ভাব। ঠিক নিজে বুঝবি।"

ঋত্বিকার সাথে কথা বলতে বলতে যেন নিজেই ধাক্কা খেল শ্রেয়া একটা বড়। তবে কি সত্যি ও অগ্নিকেই ভালোবাসে? কিন্তু কই কখনো তো অগ্নির সাথে দেখা করলে বা কথা বলতে গেলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় করেনি, ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন বাজেনি। এটাকে প্রেম বলা যায় না।

নাকি যায়? প্রেম কী? এই যে সর্বক্ষণ একে অপরের জন্য রইল, যখন তখন একে অপরকে জ্বালানো, পিছনে লাগা, ঠাট্টা ইয়ার্কি, মন খারাপের ডালি নিয়ে বসে কথা বলে দিনের শেষে মন ভালো হয়ে যাওয়া, এগুলো তাহলে কী? নিছকই বন্ধুত্ব? এত ভালো লাগে অগ্নির সাথে সময় কাটাতে, এতদিনের এত বছরের বন্ধুত্ব। সেই স্কুল লাইফ থেকে বেস্ট ফ্রেন্ডস। অনেক তো ঝগড়া হয়েছে। তা বলে কি আর মিটমাট হয়নি? বিয়ে করলে পর ঝামেলা হলে সেটাই বা মিটবে না কেন? বড় ভুল হয়ে গেল না তো ওকে না বলাটা?

"কী বুঝছিস?"

"শোন না। আই থিঙ্ক ইয়ু আর রাইট। আই মেড আ হিউজ মিস্টেক।"

"আবাউট?"

"অগ্নি।"

"কী?"

"আমার মনে হয় আই ডু লাভ হিম। ওর সাথে সারা জীবনটা হয়তো কাটাতে পারলে ভালো হত।"

'তাহলে এবার?"

"তুই প্লীজ কিছু বল। আমার মাথা কাজ করছেনা।"

"টেনশন করিসনা। বিয়েটা এখনো হয়নি। এক সপ্তাহ আছে হাতে। ভাগ্যিস লাস্ট মোমেন্টে রিয়েলাইজ করলি। বিয়েটা ক্যান্সেল হতেই পারে সোমকের সাথে এখনো।"

"কিন্তু ও কী ভাববে? বাবা মা, সোমকের বাবা মা। এতগুলো লোক ইনভল্ভড যে। কে কী বলবে। প্লাস মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি, অগ্নি? ও রাজি হবে?"

"কে কী বলবে বলে সারাজীবন স্যাক্রিফাইস করবি? একটা ভুল সম্পর্কে বেঁধে রাখবি নিজেকে?"

"কত লোকই তো বিয়ের পর প্রেম করে, ভালোবাসে। আমিও নাহয় নিয়তি মেনে নেব।"

"এক থাপ্পড় মারব। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আছিস নাকি? এমন নেকুপুশু গোছের কথা মানায়না তোকে শ্রেয়া।"

"তো কী করব?"

"তুই এখুনি বাড়ি গিয়ে আঙ্কল আন্টির সাথে কথা বল।"

"বকুনি খাবো।"

"অন্তত সারাজীবন পস্তাবি না।"

খানিক ভেবে শ্রেয়া বলল, "তুই পাটনা কবে যাচ্ছিস?"

"পরশু রাত্রে।"

"ঠিক আছে। তোকে মেসেজ করছি খানিক পর।"

৪।

পরের দিন সকাল এগারোটা, সাউথ সিটির ফুড কোর্টে সকলে উপস্থিত। সকলে বলতে শ্রেয়া, ওর মা বাবা, সোমক, ওর মা বাবা, ঋত্বিকা আর একটা ল্যাপটপে স্কাইপ খুলে তাতে অগ্নি।

সকলের মুখে চোখে উদ্বেগ, হলোটা কী, মেয়ে এমন তড়িঘড়ি সকলকে এই সক্কাল সক্কাল এখানে ডেকে এনেছে। ঋত্বিকার চেহারায় আলাদা টেনশন।

গলা খাঁকরি দিয়ে শ্রেয়া শুরু করল কথা বলা।

"তোমরা সকলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ এখানে এরকম ভাবে আনায়। আসলে আমার কিছু কথা বলার ছিল। বাড়িতে আরো লোকজন আছে চেনাজানা। তাই বাড়িতে হত না। অগত্যা এখানে। তোমাদের যে কথাগুলো বলার আছে, খুব জরুরি। মন দিয়ে শুনো।"

ল্যাপ্টপ থেকে অগ্নি বলে উঠল, "তাড়াতাড়ি প্লীজ। আর কিন্তু আধ ঘন্টা পর আমার ফ্লাইট। মিস করলে তুই নেক্সট ফ্লাইটের টিকিট পাঠাবি। তোর বিয়ে মিস করতে পারছিনা আমি।"

শ্রেয়া, অন্যদিন হলে রিএক্ট করত। আজ একবার ল্যাপ্টপ স্ক্রিনে চোখ দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে কথা চালাতে লাগল।

"আমি প্রথমেই ক্ষমা চাইছি সোমক আর আন্টি আঙ্কলের কাছে। আমি এই বিয়েটা করতে পারছিনা। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমাদের ঠিক জমবে না। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। এই বিয়েটা হতে দিয়ে আমি তোমাদের ঠকাতে চাই না। প্লীজ, আই এম ভেরি সরি। এই রিয়েলাইজেশনটা কাল এসেছে আমার। ঋত্বিকা সাক্ষী।"

সোমকের মুখ এক্কেবারে হাঁ। ওর মা বাবারও মুখ চোখ ভালো না। আর সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য শ্রেয়ার মা বাবা।

"তুই কী বলছিস এসব মামণি? তোর মাথা ঠিক আছে? কাকে ভালোবাসিস? কী বলছিস এখন এসব?"

"মা, আমি জানি আমার এই সিদ্ধান্তে তোমরা যারপরনাই বিরক্ত, ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু কিছু করার নেই আমার মা। আমি অগ্নিকে ভালোবাসি। আমি সোমককে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না। প্লীজ এই বিয়ে ক্যান্সেল করো।

অগ্নি, আমি জানি। খুব অবাক লাগছে হয়তো তোর। এক বছর আগে যখন তুই আমায় প্রপোজ করলি, আমি আসলে তখন খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়েতে হ্যাঁ বললে আমাদের এই সুন্দর বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যাবে। দাম্পত্যের চক্রব্যূহে তাই তোকে নিয়ে যেতে চাইনি। তাই তোকে না বলেছি। কিন্তু এখন আমি বুঝেছি। নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে জীবন কাটাতে পারার সৌভাগ্য সকলের হয় না। আমি পেয়েও সেটা হারিয়েছি, নিজের দোষে। জানি, খুব লেটে বুঝেছি, ঋত্বিকা সাক্ষী। ক্ষমা করিস প্লীজ। "

চারিদিক চুপ। এই অবধি বলে টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে ঢক ঢক করে জল খেলো শ্রেয়া। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, "তাহলে? বিয়েটা ক্যান্সেল্ড তো?"

শ্রেয়ার মা বলে উঠলেন বেশ রাগি মুখ করেই, "কীসের ক্যন্সেল? দোষ করেছ, মাসুল দিতেই হবে। বিয়ে তোমায় করতেই হবে।"

"এত কিছুর পরেও?"

আর তখনই উপস্থিত সক্কলে, স্কাইপের পর্দা থেকে অগ্নি সহ, অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল।

অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে অগ্নি বলল, "শোন শ্রেয়া, আমার ফ্লাইট মিস হবে। আমি উঠছি। পারলে এয়ারপোর্টে আয়, নইলে এক্কেবারে মঙ্গলবার মন্ডপে দেখা হচ্ছে। মুয়াহ।"

শ্রেয়ার মুখ হাঁ। কিছুই বুঝছেনা। ইতিমধ্যে সোমকের বাবা সকলের জন্য আইস্ক্রিম নিয়ে হাজির।

"নাও, মিষ্টি মুখ করো। শুভদিনে। "

"বাবা, মা। আমি কিছু বুঝছিনা। কেসটা কী হল?"

"কেস কিছুই না। বলছি। আগে মায়ের থেকে দু হাজার টাকা নিই। তিনি বেটে হারলেন। তার ধারণা ছিল আমাদের প্ল্যান বি লাগবে।"

"মানে?"

"মানে আর কিছুই না। যেদিন অগ্নিকে তুই রিজেক্ট করলি, ও আমায় জানাল। তারপর আমি আর তোর বাবা মিলে আলোচনা করলাম। বুঝলাম আমাদের মেয়ে গাড়ল। হাজার হাজার লাইন কোড লিখতে পারলেও, জীবনের এল্গোরিদমে জিরো। তাই কিছু একটা ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। সিনে এন্ট্রি নিলো সোমক। সুরঞ্জনাদি আমাদের লাইব্রেরিতুতো দিদি। জানতাম ওঁর ছেলে ব্যাঙ্গালোরে আছে, নাটকে উৎসাহী। ব্যস, শুরু হল স্ক্রিপ্ট লেখা। অভিনয়পর্ব। ঋত্বিকাও আছে এই নাটকে। আমি ভাবিনি প্ল্যান এ-তেই তুই কুপোকাত হবি। তাই প্ল্যান বি সি ডি ছিল।"

৫।

আর কী, মঙ্গলবার গোধূলি লগ্নে শ্রীমান অগ্নি সেনের সাথে কুমারী শ্রেয়া চ্যাটারজীর শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হল। নাচগান হইহল্লা খাওয়াদাওয়া সব মিলিয়ে বিয়েবাড়ি জমজমাট। বাসরে এক প্রস্থ গানবাজনার ফাঁকে যখন রেস্ট চলছে, তখন ঝটপট রাহুলকে ফোন লাগালো অগ্নি। রাহুল ওর ফ্ল্যাটমেট। ছুটি না পাওয়ায় বিয়েতে আসতে পারেনি।

" ভাই, ফাইনালি শ্রেয়ার সাথে বিয়েটা হল। পেটিএম কর দু হাজার। বেটটা হারলি।"

"তুইও আমাদের বিয়ে নিয়ে বেট ফেলেছিলি??" কপট রাগি স্বরে কথাগুলো বলতে বলতে হাল্কা করে অগ্নির কান মুলে দিল শ্রেয়া।

আর এইভাবেই শুরু হল এই নব দম্পতির টক ঝাল মিষ্টি দাম্পত্য।

*********************

(অনেকদিন পর নিখাদ প্রেমের গল্প লিখলাম। মতামত জানাবেন। নামকরণ করেছি একটি সিনেমার গান থেকে। "ঘরে এন্ড বাইরে" ছবির "তারা খসে পড়ে" থেকে।)

No comments:

Post a Comment