Friday, June 15, 2018

মুক্তি

ইদানীং কিছু মানুষজনের সাথে কথা বলে বুঝেছি যে আমাদের মধ্যে বেশীরভাগই সাংঘাতিক অবসাদে ভুগই। সেই অবসাদ হতাশার কারণ একেকজনের জন্য একেকরকম। মানসিক সুস্বাস্থ্য অত্যন্ত কাম্য। আশেপাশে কাউকে অবসাদগ্রস্ত দেখলে বাড়িয়ে দিন সাহায্যের হাত। কিছু করতে না পারলে, নিদেনপক্ষে শুনুন তার কথা। তাকে ভরসা দিন। পাশে থাকুন। সাহস জোগান।




সকাল আটটা। অ্যালার্ম বাজছে ফোনে গত এক ঘণ্টা ধরে, সমানে স্নুজ করে চলেছে অরিঞ্জয়। আবার একটা সোমবার। একটা আস্ত সপ্তাহ সামনে। সেই এক ভয়ঙ্কর অফিস, সারাক্ষণ স্যারের কড়া কথা, কলিগদের অসহযোগিতা। ভালোই লাগেনা। সবে তেইশ। এই প্রথম বাড়ির থেকে এত দূরে আছে অরিঞ্জয়। বাড়ি ছাড়ার আগে ভেবেছিল স্বাধীন জীবন কাটাবে, বন্ধুরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যেমন কাটাত, সারাক্ষণ হই হুল্লোড় করবে। শাসন থাকবেনা। হ্যাঁ, মায়ের দিক থেকে শাসন নেই বটে। কিন্তু আনন্দ উপভোগ করার ইচ্ছেটাই সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছে। তেইশেই এক্কেবারে শুকিয়ে গেছে অরিঞ্জয়। নামকরা অফিস, দারুণ মাইনে। কিন্তু পরিবেশ ভালো না। বিশেষ করে ওর মতো ফ্রেশারসদের জন্য। অমানুষিক কাজের চাপ, অবাস্তব কাজের ডেডলাইন, টার্গেট। সব মিলিয়ে ঘেঁটে থাকে। বন্ধুবান্ধবও তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি অফিসে। একেই মুখচোরা, তার উপর বেশীরভাগ জুনিয়র কলিগরাও ওরই মতো অবসাদে ভুগছে। অফিস যেতে ইচ্ছে করেনা, কাজ নিয়ে অযথা চাপ সারাক্ষণ পরিশ্রান্ত রাখে, রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় বারবার। একটা দীরঘকালস্থায়ী ক্লান্তি ঘিরে রেখেছে ওকে। আজ ইচ্ছে আছে একবার বসের কাছে ছুটি চাইবে। মা বারবার বলছে, কটাদিনের জন্য বাড়ি থেকে ঘুরে যেতে, মন ভালো লাগতে পারে হয়তো। দেখা যাক পায় কি না। কাল অনেক রাত অবধি জেগে একটা প্রেজেন্টেশন শেষ করেছে, মনে তো হয় ভালোই করেছে। বসের পছন্দ হলে ছুটির কথাটা তুলতে সুবিধে হয়। অন্তত সাতদিন।


সোয়া আটটা নাগাদ অবশেষে বিছানা ছেড়ে শানান সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেরোল অরিঞ্জয়। ওর পিজির বাইরেই একটা ঠ্যালাগাড়িতে সকালের নাস্তা বিক্রি হয়। বিসি বেলে বাথ খেলো। মেঘলা দিনে বাড়ির খিচুরির কথা মনে করিয়ে দেয় এটি ওকে। বাস স্ট্যান্ডে খানিক দাঁড়িয়ে থেকে বাস পেয়ে সিল্ক বোর্ডের ট্রাফিক টপকে যতক্ষণে অফিস পৌঁছল, পারকিং লটে দেখল বসের নীল অ্যাক্সেন্ট গাড়ি দাঁড়িয়ে। মনটা তেতো হয়ে গেল অরিঞ্জয়ের। ডেস্কে এসে বসতে না বসতেই দেখল নোট রাখা টেবিলে, "See me in my office NOW"। বাবা রে, ক্যাপিটাল লেটারে নাউ লেখা, নির্ঘাত আবার কিছু নিয়ে একটা বলবে বস। কপাল করে এসেছে অরিঞ্জয়, উঠতে বসতে শুধু বসের চোখ রাঙানি। এক ঢোঁক জল খেয়ে কাঁচের দরজা দিয়ে বসের কেবিনে ঢুকতেই, "করেছো টা কী এসব অরিঞ্জয়? এটা কোন প্রেজেন্টেশন হয়েছে? কলেজে কী শিখেছ? একটা কাজও যদি প্রফেশনালি করতে পারো..."

"সরি স্যার, আমায় বলে দিন কোথায় কী চেঞ্জ করতে হবে। আমি এক্ষুনি করে আনছি।"

"অনেক হয়েছে। তোমায় যে কী করে চাকরিটা দিয়েছিল আমি জানিনা। ইউজলেস ইনেফিশিয়েন্ট ফেলো।"

একদা স্কুল কলেজ টপার, কর্মক্ষেত্রে তথাকথিত "ইনেফিশিয়েন্ট" অরিঞ্জয়ের চোখে জল এসে গেল কথাগুলো শুনে। কান লাল হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, বসের আরো কোন কথা আছে কি শোনার জন্য।

"দাঁড়িয়ে আছো কী করতে? নাউ গেট গোয়িং। শ্রুতিকে বলেছি এটা মডিফাই করতে। তুমি ওকে অ্যাসিস্ট করবে। গো। আর একবার কোন কমপ্লেন শুনলে তোমায় টারমিনেট করে দেবো আমি। বি ভেরি কেয়ারফুল অরিঞ্জয়।"


যন্ত্রের মতো শ্রুতির ডেস্কে গেলো অরিঞ্জয়। শ্রুতি ওরই ক্লাসমেট। কলেজে বিশাল কিছু না হলেও এই অফিসে এসে নিজের নামডাক ভালোই জমিয়ে ফেলেছে। বরাবর স্যারেদের, বন্ধুদের প্রিয় পাত্র আজ "ইউজলেস", "ইনেফিশিয়েন্ট"। চাকরি যে কোন মুহূর্তে চলে যাবে। তখন বাবা মা আত্মীয় বন্ধুদের কী বলবে ও?

"অরি, স্লাইডসগুলো মোটামুটি পুরো রিডু করতে হবে। আমি কিছু পয়েন্টারস মেল করে দিচ্ছি তোকে। আমার আগে থেকে লাঞ্চ প্ল্যান আছে রিয়ার সাথে। স্ট্র্যাটেজি টক। তুই কাজটা শুরু করে দিস, আমি এসে দেখে নিচ্ছি। ওকে?"

"হুম ওকে।"


শ্রুতির ইমেলের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে কী মনে হতে অরিঞ্জয় একবার ফোনে ফেসবুক স্ক্রল করা শুরু করল। শুধুই হাসি মুখ। "ফ্রেন্ডশিপ গোলস", "কাপল গোলস", "ভেকেশন প্ল্যান্স" এইসব হ্যাশট্যাগ। মেজাজটা খিঁচরে গেলো। এত ফ্রাস্ট্রেশন। ওর চেয়ে কম ভালো ছেলেমেয়েরা দিব্যি একটু কম ভালো অফিসে চাকরিতে ঢুকে জীবনটাকে কী সুন্দর আনন্দে কাটাচ্ছে, আর ওর এই অবস্থা। কেন যে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করতে গিয়েছিল এত বছর। মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই ওর এখন।

মেল এলো। পাওয়ারপয়েন্ট খুলে স্লাইডগুলো নিয়ে বসতে যাবে, এমন সময়ে মায়ের ফোন।

দুবার ধরল না। পাশের টেবিল থেকে শঙ্কর একবার উঁকি মারল।

"What da? pick up. Whose call are you avoiding?"

আশেপাশের লোকজন এত সবার সব বিষয়ে নাক গলায়, বিরক্তিকর। কাজের কাজ কেউ করে সাহায্য করবেনা, শুধু মুখরোচক গসিপের সন্ধানে।

দশ মিনিট পর আবার ফোন বাজতে খানিকটা বিরক্ত হয়েই ফোনটা ধরে বারান্দার দিকে গেল।

"মা ফোন ধরছিলাম না মানে নিশ্চয়ই ব্যস্ত ছিলাম। বার বার কল করছ কেন?"

"সরি বাবু। আসলে তোর কথা খুব মনে হচ্ছিল। এখানে মেঘ করেছে। আমি খিচুরি আর ডিম ভাজা বানালাম। ভীষণ মিস করছি রে তোকে। ছুটি চাইলই? কবে আসবি বাড়ি?"

গলার কাছে একটা অসম্ভব কান্না দলা পাকিয়ে উঠল অরিঞ্জয়ের। কী করে বলে মা কে যে ছুটি পেলে হয় চিরতরে পাবে, নইলে না? মা যে পথ চেয়ে বসে আছে ওর জন্য। ক্লাস এইটে বাবাকে হারানোর পর থেকে মায়ের জন্য শুধুই ছেলে আর ছেলের জন্য শুধুই মা, এই ছিল ওদের জীবন। কলকাতার কলেজ থেকে একদম ব্যাঙ্গালোর, দুজনকেই ভীষণভাবে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু ছেলের কেরিয়ারের কথা ভেবে রুণা কিছু বলেননি।


"কী রে। কী বলল তোর স্যার?"


"ছুটি দেয়নি মা। মা, আমি আর পারছিনা এখানে। ভীষণ চাপ। ভীষণ মন খারাপ। আমার একদম ভালো লাগেনা এখানে। এই চাকরি আমি করবো না মা"

"চুপ কর সোনা। ওরকম বলেনা। চাকরি করবো না কোন কথা হল? সব জায়গায় কোন না কোন প্রেশার থাকে। দাঁতে দাঁত চিপে কাজ কর, ঠিক পারবি। মন খারাপ করিস না। দেখি আমি ছুটি ম্যানেজ করতে পারি কি না।"

"মা আমি বুবাইদিদির বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে চেয়েছিলাম। সবার সাথে দেখা হত। কতদিন দেখিনা কাউকে।"

"হবে হবে। ঠিক একদিন হবে। বিয়ের এখনো দশদিন বাকি। তুই দেখ চেষ্টা করে।"

"হবেনা মা, হবেনা।"


"Boss gave you some work to do and here you are chitchatting...Arinjoy, careful man.." শঙ্করের কোথায় সম্বিৎ ফিরল অরিঞ্জয়ের। আবার সেই গসিপের ধান্দায় ঘুরছে।

'ইয়া, আই অ্যাম কামিং।"


"মা, ফোন রাখছি। কাজে ডাকছে।"

"ভালো থাকিস সোনা।"


ফোনটা রেখে বাইরের আকাশের দিকে তাকালো অরিঞ্জয় খানিকক্ষণ। কালো মেঘ। যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। এক সময় কী ভালোই না লাগতো ওর এই বর্ষা। স্কুল ছুটি, মাঠে কাদায় ফুটবল। ছোট্ট ছোট্ট লাল নীল কাগজের নৌকো। রঙ্গন ফুলের গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। খিচুরি ডিমভাজা। আহা। কোথায় সে দিন। কী করছে ও। কেনই বা পড়ে আছে। থেকে কী হবে। এই বেঁচে থাকার মানে কী? মুক্তি নেই। পালাবার পথ নেই। কোথাও যাওয়ার নেই। সুখ নেই। শান্তি নেই।

শুধু নেই নেই আর নেই।


পনেরোতলার বারান্দা থেকে নীচে কী ছোট্ট লাগছে পারকিং লটের গাড়িগুলো। বৃষ্টি নেমেছে। ভিজছে গাড়ি। ভিজছে নেড়িকুকুরগুলো। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটার সাথে টাটকা রক্তের লাল রঙ ক্রমশ বাড়ছে। লোকজনের ভিড় হচ্ছে ধীরে, কারুর কারুর ফোনের ভিডিয়ো ক্যামেরা খোলা। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে কিছুজনের। "এই নিয়ে এই বছরে চার নম্বর সুইসাইড কেস। কোম্পানির এইচ আরের সিরিয়াসলি কিছু করা উচিত।" ইত্যাদি। ইত্যাদি। কোন কিছুই কানে যাচ্ছেনা নীল অ্যাক্সেন্টের সামনে মুখ থুবরে পড়ে থাকা এক টুকরো পরাজিত সত্ত্বার, এক হেরে যাওয়া প্রাণের নিথর দেহের। সে এখন মুক্ত। খাঁচার থেকে বেরিয়ে সেই মুক্ত পাখি এখন উড়ছে অনেক উঁচুতে, যেখানে সে সব দুঃখ কষ্টের ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। মৃত্যুই তাকে এনে দিয়েছে সেই পরম মমতার স্পর্শ, সেই বহু কাঙ্ক্ষিত শান্তি। সে এখন অনেক শান্ত।



************************************************************





No comments:

Post a Comment