Wednesday, December 20, 2017

বছর শেষের হিসেব নিকেশ

ওরে বাবা, ভাবতেই পারছিনা, এই সেই টুংটাং করে ফোনে মেসেজ ঢুকছিল এত হ্যাপি ন্যু ইয়ার বলে, তারপরে ৩৫৪ দিন শেষ? কী কাণ্ড, এত তাড়াতাড়ি শেষ হল কি করে এই একটা আস্ত বছর, কে জানে বাবা। কত কিছু করব বলে গত বছর এমন সময়ে লম্বা লিস্ট করলাম, তার তো বোধহয় সিকিভাগও পুরণ হয়নি। এখনো রোগা হওয়াটা বাকি। ওজন কমা তো দূর অস্ত, উল্টে কিলো পাঁচেক অন্তত বেড়েছে। (এবার সেটা বুদ্ধি না ফ্যাট, টু বি ভেরি স্পেসিফিক, বার বার কিলো কিলো চকোলেট, সেটা নিয়ে আমার এখনো সন্দেহ আছে যথেষ্ট পরিমাণে।) এখনো একটা পাব্লিকেশন হলো না ফার্স্ট অথরে। (শুনুন, পি এইচ ডি স্টুডেন্ট, তায় ফিফথ ইয়ার চলছে, এই সময়ে এইসব ভাবনা আপনা আপনি না চাইতেই মাথায় আসে।) ম্যানুয়াল মোডে ডি এস এল আর চালানো শিখলাম না (এদিকে যতক্ষণ না কিনছিলাম, ততক্ষণ নিজেকে রঘু রাইয়ের মাস্টার ভাবছিলাম। কিছু কিছু লোককে কচুপোড়া দেখিয়ে একটা পৈশাচিক হাসি হাসতে পারলাম না (ওটা আমার হেব্বি সখ, কী করব)। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স যেমন ছিল, বাড়ে তো নি, বরং আরো কমেছে (গরীব রিসার্চ স্কলার। আমাদের ওইসব পে কমিশন হ্যান কমিশন কিচ্ছু হয় না)। বছর শেষ হচ্ছে ভাবতে বসেই যদি এতগুলো হা পিত্যেশ মাথায়া সে প্রথমে, না জানি ব্যালেন্স শিট বানাতে বসলে কি দাঁড়াবে। না মানে জানি, না পাওয়াগুলো অনেক অনেক বেশী হবে সংখ্যায়। চেষ্টা করি মাস ধরে ধরে একটু হিসেব নিকেশ করার (আমি আদপে একটুও হিসেবী না হলেও...)।

গত বছর শেষ করেছিলাম হাতে ভালো মতো চোট পেয়ে। তাই নতুন বছরকে স্বাগত করি হাতে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে! বেশ বিরক্ত লাগত, হুটহাট লেগে যেত হাতে, ব্যথা পেতাম। তারই মধ্যে পুণা গেলাম কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করতে। আই আই টি তে আসার পর আমার স্বভাবের বেশ পরিবর্তন হয়েছে। যে আমি কি না এক সপ্তাহ বাকি থাকতে সব পেন্ডিং কাজ সেরে ফেলতাম এক কালে, সেই আমিই কি না আজকাল সব ইলেভেন্থ আওয়ার অবধি মিনিমাম ফেলে রাখি। তা হয়েছে কি, পোস্টার প্রিন্ট করতে গিয়ে যারপরনাই বিচ্ছিরি অবস্থায় পড়েছিলাম। একদম হিসেবের বাইরে ছিল যে তামিল নাড়ুতে পোঙ্গাল রীতিমতো বিরাট উৎসব যখন দোকান পাট সব বন্ধ থাকে।  লাস্ট মোমেন্টে কোনমতে সুপারভাইসারের সাথে কম কারেকশনের রফা করে যা হোক করে দোকান বন্ধ হয়ে যাবে, আর ছাপানোর সময় পাবো না, ইত্যাদি ইত্যাদি করে কোনমতে তো পোস্টার সহ গেলাম পুণাতে। তা কনফারেন্সে আগেই বলে রেখেছিল যে ওরাল টকের জন্যও প্রস্তুত হয়ে আসতে, বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তেও পারে। আমি কে আমি, এত কনফিডেন্স নিজের ওপর, ধরেই নিলাম। এই তো ভারী কাজ করেছি, নেহাত সরকারি টাকায় দেশভ্রমণ হবে, তাই যাচ্ছি। আমি তো জেতার ধারেকাছেও থাকবনা। তার উপর আবার এরকম জঘন্য ভাবে শেষ মুহূর্তে বানানো পোস্টার। তাই কোনরকম  প্রস্তুতি না নিয়েই এমনিই গিয়েছিলাম। কেলোটা করল কনফারেন্সের তৃতীয় দিন। দুইদিন পোস্টারের পর তারা রেজাল্টে হঠাৎ করেই আমার নাম ঘোষণা করে দিলেন, নাকি টক দিতে হবে। খুব নার্ভাস হয়ে গিয়ে সেই টক তো দিলামও। আবার ভগবান জানেন কি করে, সেখানে আবার প্রথম পুরস্কারও পেয়ে গেলাম। আমার সুপারভাইজার তো শুনে হতবাক, ফোনে জানাতে উনি প্রথম যে কথাটি বলেন, " সে কী? কেউ আদৌ এসছিল তোমার কাজ নিয়ে শুনতে? কি করে জিতলে? যাই হোক, কংগ্র্যাটস।" বছরের শুরুতেই একটা মোক্ষম শিক্ষা পেলাম। বা বলা চলে, নিজের সম্বন্ধে জানলাম। টেনশন না করে কাজ করলে, বেশী এক্সপেক্টেশন না রাখলে অনেক কিছু প্রাপ্তি হয়। এখন পদে পদে তা মানার চেষ্টা করলেও ম্যাক্সিমাম সময়েই মানতে পারিনা। সামান্য কিছুতেই হাত পা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যায়। তাও যাই হোক, বছর শুরু হল বেশ কাজের স্বীকৃতি পেয়ে। দিব্যি মন খুশি। এক্সট্রা খুশি হলাম তারপর যখন একটা মোটামুটি ভালো জারনালে সেকেন্ড অথরে পেপার বেরোলো মার্চ মাসে। যারা রিসারচের সাথে যুক্ত নন, তাদের বলি। এই পেপার পাব্লিশ করাটা অনেকটা সাধারণের সরকারি চাকরি পাওয়ার মতো বলা চলে। ফার্স্ট অথর মানে ওই আই এ এস, আই এফ এস। আর সেকেন্ড অথর মানে হয়তো স্টেট ব্যাঙ্কের পি ও। নিজে রিসারচার বলে লেখায় মাঝে মাঝে এই প্রসঙ্গ আসতে পারে। আগাম ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
এপ্রিল মাস, আমার জন্ম মাস। আমার ক্যাম্পাসের ভাই বোনদের কথা তো আগে ম্যাড্রাস প্রসঙ্গে লেখায় বলেছি। তা এবার হলো কি, ভাইরা মিলে সব আমার জন্মদিন পালন করল। মাঝরাতে, ক্যাম্পাসের বেশ একদম মধ্যমা জায়গায় আমায় মধ্যমণি করে চলল সেলিব্রেশন। বয়স হচ্ছে, জীবনে কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা। এইসব ভাবতে ভাবতে আমার কেন জানিনা নিজের জন্মদিনটা বড্ড মন খারাপ মন কেমন করা লাগে। জন্মদিনের আগেরদিন থেকেই কেমন অকারণে ডিপ্রেশন হয়। গতবারে বাবা মায়ের সাথে মুন্নারে পালিয়েছিলাম। এইবারে মন খারাপ নিয়ে ছিলাম যে জন্মদিনে মা বাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। তবে ভাইগুলো এক্কেবারে ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করে দারুন সুন্দর করে আমার জন্মদিন পালন করল। সারাদিন বেশ খাওয়াদাওয়া, ছবি তোলা, কেক কাটা, উপহার পাওয়া, সব মিলিয়ে খুব ভালো কেটেছিল। মানে অভাবনীয় ভালোই বলা চলে। প্রবাসে আত্মীয়তা পেলে যা হয় আর কী।
মে মাসটা আমার খুব খারাপ কেটেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু মানুষের সাথে চরম মতানৈক্য হওয়ার ফলে নিজের অত্যন্ত একটা প্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে চিরতরে সরিয়ে নিই। খুব খুব কষ্ট হয়েছিল, বেশ অনেক রাত কেঁদেকেটে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু ওই যে বলে না, অন্ধকারের পরে আলোর উৎস আছেই। সব কিছু ভালোর জন্য হয়। তা আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এই অভিশপ্ত দিনগুলির মন খারাপ করা কাটাতে আমি লেখালিখিতে অনেক অনেক বেশী মনোযোগ দিতে লাগলাম। আগে যেটা সপ্তাহে একটা কি আরো কম লিখতাম, সেই আমি হঠাৎ শুরু করলাম প্রায় রোজ নতুন নতুন লেখার। রসেবশে বলে একটা গ্রুপে লিখতাম। অনেকের ভালোবাসা পেয়েছি। প্রচুর গুণীজনের সান্নিধ্যও পেয়েছিলাম। কিন্তু বাঙ্গালী একসাথে দুইজন থাকলেই অন্তত তিনটে দুর্গাপুজো হয়, বেশিদিন রসেবশেতে থাকতে পারিনি। অর্ণবের হাত ধরে এসছিলাম বছরের মাঝামাঝি আত্মপ্রকাশে। খুচখাচ লিখতে লিখতে তারপরে কখন যে এত আত্মীয় পেয়ে গেলাম, এই বছরের একটা বিরাট প্রাপ্তি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। সেই একই সাথে সাথে এলো আমার নিজস্ব একটি পেজ, সাম্পান। সাম্পান নামে আমার বাবা তাঁর কলেজ জীবনে লিটল ম্যাগাজিন চালাতেন। কয়েকটা সংখ্যাই বেরিয়েছিল। যখন নিজের পেজ বানাই, তাই নাম নিয়ে ভাবতে দুইবারের বেশী চিন্তা করতে হয়নি। বাবার ম্যাগাজিনের লিগ্যাসি চালানোর চেষ্টা করে চলেছি প্রতিনিয়ত। সাম্পান সন্তানসম প্রিয়।

এই করতে করতে এসে গেলো পুজোর কটাদিন। আগের লেখাতেই বলেছি। চেন্নাইতে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার পুজো কাটালাম। একটাবারের জন্যও মনে হয়নি পরিবারের থেকে দূরে আছি। আসলে রক্তের সম্পর্ক দিয়েই তো সব সময় আত্মীয়তা হয় না। মনের টান, প্রাণের টান লাগেই। এটা আমি খুব বিশ্বাস করি। এবং আমার জীবনে এর বহু বহু উদাহরণ। পুজো দারুণ কাটিয়েছি। বিশাল প্রাপ্তিস্বরুপ নতুন করে বানানো এখানে অনেকের সাথে আত্মীয়তা।

"কান্না হাসির দোল দোলানো
পৌষ ফাগুনের পালা।"
এত আনন্দের মধ্যে তারপর হঠাৎ একদিন আমার অতি নিকটাত্মীয়ার অকাল মৃত্যু সংবাদ সাঙ্ঘাতিকভাবে নাড়িয়ে দিলো আমায়। শোকের থেকে নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশী সময় নিতে পারিনি। কারণ সাথে যোগ হয়েছিল বাড়তি কিছু দায়িত্ব, দায়বদ্ধ্বতা, পরিবারের প্রতি।

এই করতে করতে এসে গেলো শীত। মানে মোটামুটি আপনাদের সকলের শীতকাল। আমাদের এখানে অল্প গরম। আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছি বেশ কিছু মাস পরে। তারপরে শনিবারে বেড়াতে যাবো রাজস্থান, বাবা মায়ের সাথে। বছর দুই পরে আবার সপরিবারে আমাদের বেরানো। একটা সময়ে বছরে অন্তত দুইবার বেরানো হতোই হত। চেন্নাই আসার পর থেকে সেটা বন্ধ হতেই বসেছিল। তাই এই বেরানো নিয়ে খুব উদ্গ্রীব হয়ে আছি।

এই যে, লিখতে লিখতে বেশ একটা আত্মসমীক্ষণও হয়ে গেল। বছরের শুরুতে যেমন করে কাটাব ভেবেছিলাম, অবশ্যই তা মেলেনি। তাই মিললে বোধহয় জীবন থেকে সারপ্রাইজ এলিমেন্ট চলে যেত। একটা গতে বাঁধা জীবন কাটাতে হত। নিজেকে রোবট মনে হত। বরং এই বেশ ভালো। জীবন প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছি। যতটা পেরেছি মোকাবিলা করেছি। অনেক অনেক কিছু শেখা বাকি। অনেক কিছু একমপ্লিশ করা বাকি। সামনের বছরের রেজোল্যুশনে সেসব থাকবে। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, সামনের বছর যেন এরকম সময়ে বসে এই বছরের মতই বলতে পারি, ভালো মন্দ মিশিয়ে কাটলেও, মূলত ভালোর ওপর দিয়েই সব গিয়েছে। এইটুকুই আশা। আপনাদের সকলের জন্যও এইটুকুই প্রার্থনা রইলো। আগামী বছর খুব ভালো কাটুক।

Tuesday, December 12, 2017

তিতিরের ফেরা।

১।

অক্টোবরের শেষ। কিন্তু তবুও আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। অকালের বৃষ্টি। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে তিতির আনমনে তাকিয়ে রয়েছে পাশের বাড়ির নিমগাছের দিকে। ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়ছে পাতাগুলির থেকে। জানলার গ্রিলে জলের ফোঁটারা আলপনা দিচ্ছে যেন। পাশের ফ্ল্যাট থেকে দেবব্রত বিশ্বাস, সাগর সেন, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একে এক করে ভেসে আসছে বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, আহা আজি এ বসন্তে, হৃদয় বসন্তবনে। মাঝে মাঝে তাতে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে মেঘেদের গুরুগম্ভীর ডাক। সামনের কাঞ্চনগাছটাতে একটা কাক সেই কখন থেকে বসে ভিজেই চলেছে। রাস্তার ওপারের নেড়িটা বন্ধ দোকানের শাটারের তলায় কোনমতে ঘুপচি করে বসেছে। আজ সোমবার। পাড়ার সব দোকান বন্ধ। আর দুপুর বলে রাস্তায় এমনিও অনেক লোক কম। ক্রমশ বৃষ্টিটা বাড়ছে। লোক চলাচলও কমে আসছে।
" ও বৌদি, ভাতটা নামিয়ে নেবে? আমি বাকি সব রেঁধে টেবিলে গুছিয়ে এসছি। ভাতটা নামানো অবধি থাকতে গেলে একটার ট্রেনটা মিস করবো।"
রান্নার লোক মলয়ার কন্ঠস্বরে চমকে উঠলো তিতির।
" অ্যাঁ? ও হ্যাঁ। ঠিক আছে। আমি ভাতটা নামিয়ে নেবো। তুমি এসো। কাল কামাই করোনা কিন্তু। আমার কাল একটু বেরোনোর আছে। "
" হ্যাঁ হ্যাঁ, কামাই করবোনি। এবার যাই। "
" যাই না। বলো আসি। "
" হ্যাঁ, আসছিইইইইই।"
 একটা সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি পড়ে এসছিল আজ মলয়া। বৃষ্টির মরসুম বলেই বোধহয়। ছোটবেলা থেকে তিতির মা কে দেখত, বর্ষাকালে অফিস করতে যেত গার্ডেনের দোকান থেকে কেনা সুন্দর সুন্দর প্রিন্টের সিন্থেটিক শাড়িগুলো পড়ে। কী নরম হত, মায়ের আঁচলে মুখ ঢেকে কত খেলাই খেলত ও। মায়ের শাড়ির কালেকশান অতুলনীয়। আলমারি ভর্তি ভর্তি ঢাকাই, জামদানি, বিভিন্ন প্রদেশের নানান সিল্কের নানান ডিসাইনের নানান রঙের শাড়ি। মা চলে যাওয়ার পর বাবা একবার ডেকে আলমারির চাবি হাতে তুলে দিয়ে ওকে পছন্দসই শাড়ি বেছে নিতে বলেছিলও তিতিরকে। কিন্তু তিতির শাড়ি পড়েনা। শাড়িতে স্বচ্ছন্দবোধ করেনা। কাজের জায়গায় তো বটেই, এমনকি অনুষ্ঠানবাড়িতেও জিন্স কুর্তি নইলে চুড়িদার কুর্তা। এই এখন ঘরে রয়েছে, একটা সাদা খয়েরি ছাপা লঙ স্কারট আর সাদা এমব্রয়ডারি করা টপ। তাই মায়ের বিয়ের বেনারসি আর দু তিনটে সিল্ক ছাড়া একটাও কিছু নেয়নি সে। বাবাকে বলেছিল মাসতুতো বৌদিদের ডেকে দিয়ে দিতে। কিন্তু তিতির জানে। বাবা সেগুলো দেয়নি। এখনো আগলে বসে আছে। বসার ঘরে জানলার ধারের ওর প্রিয় জায়গা থেকে উঠে রান্নাঘরে গেল তিতির। চামচ দিয়ে একটু ভাত তুলে দেখে নিলো হয়েছে কি না, তারপর গ্যাসটা অফ করে দিলো। রান্নাঘরের ঘড়িতে চোখ যেতে তিতির খেয়াল করল প্রায় একটা বাজতে যায়, এখনো স্নান হয়নি ওর। চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বাড়িতে থাকতে থাকতে সব রুটিন ভেস্তে গিয়েছে। 



২।

" কি রে মিলু তুই আবার নামতা ভুল করেছিস? তেরোর নামতা এখনো মুখস্থ হয়নি? কাল বাদে পরশু পরীক্ষা না তোর?" কোন ভোরবেলা বেরিয়ে সারাদিন শহরের দাদা বৌদিদের হেঁসেল ঠেলে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে মলয়ার প্রথম কাজই হল সাত বছরের ছেলে মিলন আর পাঁচ বছরের মেয়ে সোনালীর স্কুলের খাতাগুলোতে চোখ বোলানো। মলয়া নিজে গ্রামের স্কুলে ক্লাস টেন অবধি লেখাপড়া করেছিল, খুব যে ভালো মাথা ছিল, তা না। কিন্তু পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল। তবে অবশ্য বাপ মা মরা মেয়ে, তায় মামাবাড়িতে মামীর দয়ায় মানুষ। মামা নিজে ওর স্কুল ছাড়িয়ে পাশের গ্রামের এক জুটমিল  করমচারীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় মলয়ার। রঞ্জিত, ওর স্বামী, ওর থেকে অন্তত দশ বছরের বড়। বিয়ের পর ওর লেখাপড়ায় ইচ্ছে আছে জেনে খুশি হয়ে আবার নাইট স্কুলে ভর্তি করার কথা বলেছিল বটে রঞ্জিত। কিন্তু স্বামীর সংসার আর ছেলে মেয়ে মানুষ করতে করতে মলয়ার আর লেখাপড়ার সময় হল না। দিব্যি চলছিল সংসার। তারপর হঠাৎ শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি একদিন এক অজানা জ্বরের কবলে পড়ল রঞ্জিত।  এক সপ্তাহ যমে মানুষে টানাটানি করেও আর ওকে বাঁচানো গেলোনা। জমানো টাকা যেটুকু ছিল, তা শেষ হওয়ার মুখে। অগত্যা মলয়াকে শহরে বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ নিতে হল। সেই ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে উঠে ছেলেমেয়ে আর নিজের জন্য অল্প পান্তা ভাতের ব্যবস্থা করে ওদের স্কুলের জন্য রেডি করে নিজে ছোটে ছটার ট্রেন ধরতে। আর তারপর সারা সকাল চার বাড়ি রেঁধে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি এসে আবার শুরু জীবনযাপন। মলয়ার খুব সখ ছেলে মেয়ে দুটোকে অনেক দূর পড়াবে, ওরা মস্ত বড় মানুষ হবে। নিজের যেটুকু সাধ্য, সেই দিয়ে একটু আধটু ওদের দেখিয়ে দেয় ও। আজও তাই করতে বসে অঙ্কর খাতাতে একগাদা ভুল দেখে ছেলেকে মৃদু বকা দিল ও।
" মা দাদা না নামতা খালি ভুল করছিল। আমার অঙ্কও দেখাতে গিয়ে ভুল করে। আমি ঠিক করে দিলাম।" সোনালীর কথায় অবাক হয়ে মলয়া জিজ্ঞেস করে মিলনকে। "হ্যাঁ রে? সত্যি?"
মিলু খানিক চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মায়ের ক্রমশ রাগ হচ্ছে টের পেয়ে এক ছুটে সদর দরজা দিয়ে দৌড় লাগায়।
" মিলুউউউউ। ফেরত আয়।" মলয়ার ডাকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করেই মিলু ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যায় পুকুরের ধারে। ওইদিকটা নির্জন একটু। খানিক গাছের ছায়ায় বসে কাটিয়ে তারপর মায়ের রাগ কমলে ঘরে ফেরার কথা ভাবে মিলু। মা কিছুতেই যে কেন বুঝতে চায় না কে জানে। এইসব একগাদা নম্বর, হিসেব নিকেশ একদম ঢোকেনা ওর পুচকে মাথাটায়। অনেক চেষ্টা করেছে। তাও হয়না। মা খালি রেগে যায় আর পিটুনি দেয়। ভালো লাগেনা। কই বাবা থাকতে তো এমন হতনা। বাবা কী সুন্দর গুছিয়ে বসে গল্পের ছলে বুঝিয়ে দিতো সব।
কিছুক্ষণ পরে সোনালী গুটিগুটি পায়ে এসে বসলো মিলুর পাশে, গাছের ছায়ায়। নরম হাতদুটো  ওর হাতে রেখে বলল, "দাদা চল। মা ডাকছে। খাবার বেড়ে দিয়েছে। "
" আমি যাবো না। তুই যা। "
" ওরকম বললে হয় নাকি দাদা? চল চল। তুই না খেলে আমরা কেউ খেতে বসতে পারছিনা। "
" মা কেন খালি বকে আমায়? আমি যাবো না। তুইই বা কেন মা কে বলতে গেলি? "
" আচ্ছা আর বলব না। নে কান ধরছি। এবার আয়। "
খানিক বোনের দিকে তাকিয়ে মায়াভরা চোখদুটির আকুতিতে সারা দিয়ে মিলু ফেরত চলল মায়ের কাছে।


৩।

বারান্দায় দড়িতে গামছাটা মেলে ঘরে ঢোকে তিতির। আয়নার সামনে টুলটা টেনে বসে। হাতে চিরুনি। টুপটুপ টুপটুপ করে জল পড়ছে চুল থেকে। ছোটবেলা থেকেই তিতিরের এই সমস্যা। হাজার চেষ্টা করেও কিছুতেই ও কোনদিনও মাথা মুছতে পারেনা ভালো করে। আগে দিদিমা যত্ন করে ও স্নান সেরে বেরোলে মাথা মুছিয়ে দিত। তারপর একদিন দিদিমা চলে গেল। ও তখন ক্লাস টুয়েলভ। মা অফিস সামলাতে হিমসিম খায়। মেয়ের পিছনে সময় দেওয়ার মত বিলাসিতা কখনোই করতে পারেনি। ভেজা চুল থেকে সমানে সর্দি কাশি হতে থাকত ওর। সেই বছর পুজোর ছুটি পড়তে পার্লারে গিয়ে একদিন তিতির নিজের কোমর ছাপানো চুলগুলো কেটে একেবারে বয়কাট করে এলো। মায়ের কাছে খুব বকুনি খেয়েছিল। বাবা তাও ওর হয়ে ওকালতি করেছিলও মায়ের কাছে, কিন্তু বরাবরের মতোই মায়ের কাছে কেউই টিকতে পারেনি। সেই থেকে আজ বারো বছর হয়ে গেল, তিতিরের চুল কখনো কাঁধ ছাড়ায়নি আর। অথচ চুল নিয়ে স্টাইল করা, নানান এক্সপিরেমেন্ট করা ছিল তিতিরের সখ। কলেজ জীবনেও বন্ধুরা ওঁর কাছে আসত হেয়ার স্টাইল করতে কোন অনুষ্ঠানের আগে। মনের ভিতরে সুপ্ত বাসনা ছিল, কোনদিনও নিজের কন্যাসন্তান হলে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবে। নিজের ছোটবেলায় মায়ের কাছে যে আদর পায়নি, সেই ভালোবাসায় মুড়ে রাখবে মেয়েকে। সপ্তর্ষি যেদিন ল্যাব থেকে এলো প্রেগ্নেন্সি রিপোর্টটা হাতে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় তিতির।
" দেখো সপ্তর্ষি, আমাদের মেয়ে হবে। আমার একটা জ্যান্ত পুতুল হবেই। দেখো। আমার এতদিনের সখ।"
" আচ্ছা বাবা, তাইই হবে। তবে ছেলে হক বা মেয়ে, দুজনেই আমাদের কাছে কিন্তু সমান ভালোবাসা পাবে। তাই না তিতির? "
" হুম। কিন্তু আমার মেয়েই হবে। "
তিতিরের প্রেগ্নেন্সিটা বেশ কমপ্লিকেটেড হয়ে যায়। তৃতীয় মাস থেকে ডাক্তারের পরামর্শে ছুটি নিতে চেয়েছিল, ছুটি পেলোনা। বাধ্য হল চাকরিটা ছাড়তে। তখন সারাদিন অফুরন্ত সময়। শ্বশুরবাড়ির দিকেও ওর কোন কাছের আত্মীয়া নেই। মা নেই। এই ক'মাস তিতিরের নিজেকে বড় একা লাগত। যদিও সপ্তর্ষি চেষ্টা করতও যথাসাধ্য ওকে সাহচর্য দেওয়ার। কিন্তু কর্পোরেট চাকরি। কাজের প্রেশার। চাইলেও বিশেষ সুবিধে হতনা। তিতিরের বাবা এসে ছিল কিছু দিন ওর কাছে। সারাদিন বাবা মেয়েতে বসে গল্প করে টিভি দেখিয়ে কাটিয়ে দিত। সাথে চলত টুকটাক উল বোনা। উল বুনতে তিতির জানত না। স্কুলেও শেখেনি। কিন্তু মাতৃত্ব মানুষকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। তিতিরও তার ব্যাতিক্রম না। ইয়ুট্যুব খুলে দেখে শিখে আস্তে আস্তে বুনতে শুরু করল। প্রথমে মোজা, তারপরে টুপি, তারপর শুরু করেছিল একটা বেবি পিঙ্ক রঙের সোয়েটার। সাত মাস পূর্ণ হতে, একদিন দুপুরে হঠাৎ শুরু হল সাংঘাতিক পেটে ব্যথা। সাথে ব্লিডিং। তড়িঘড়ি নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হল তিতিরকে। কিন্তু বাঁচানো গেলনা ওর ফুটফুটে কন্যাসন্তানকে। তিতির ঢলে পড়ল সাংঘাতিক ডিপ্রেশনে। শুরু হল থেরাপি। এখন বছরখানেক থেরাপি চলার পর অবস্থা কিছুটা হলেও সামলেছে ওরা। কিন্তু সপ্তর্ষি আর তিতিরের জীবন আর এক থাকেনি। তিতির নিজের চারিপাশে একটা বিশাল দেওয়াল তুলে নিয়েছে। খুব দরকার ছাড়া ওই দেওয়ালের বাইরে বেরোয়না ও। দিন রাত চুপচাপ থাকে। গান চলে। টিভি চলে। কিন্তু কোনদিকেই মন থাকেনা। যন্ত্রের মত দিনযাপন করে তিতির। সপ্তর্ষিও অফিসের কাজে নিজেকে পুরোদমে ডুবিয়ে দিয়েছে। সকাল নটায় বেরিয়ে রাত দশটার আগে ফেরেনা। এই কমাসে এত কাজ করেছে যে খুব সহজেই দুই ধাপ পেরিয়ে প্রোমোশন পেয়ে গিয়েছে। বসেদের প্রিয়পাত্র এখন ও। হবে নাই বা কেন, এত করমপ্রিয় যে আর কেউ নেই।
ভিজে চুলে চিরুনি চালিয়ে তিতির ধীর পায়ে ডাইনিং রুমে এলো। ঘড়ির কাঁটায় আড়াইটে। টেবিলে মলয়ার রেখে যাওয়া রান্নার বাসনের ঢাকনা খুলে খুলে দেখে একটা থালায় অল্প ভাত আর খানিকটা ডাল ঢেলে নিলো তিতির। সাথে নিলো একটা বাটিতে কেটে রাখা স্যালাড। খাবারটা নিয়ে আবার নিজের প্রিয় জায়গা, জানলার ধারে এসে বসল তিতির। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে ইতিমধ্যে। রোদ উঠে গিয়েছে। ঝলমল করছে চারিদিক।
পাশের বাড়ির রেডিয়োতে তখন চলছে নাটক। হাল্কা আবছা সংলাপ শোনা যাচ্ছে। একটা সময়ে নাটক শুনতে খুব ভালোবাসতো তিতির। সপ্তর্ষি আর ও মাঝে মাঝেই রবিবার করে একাডেমী, মধুসূদন মঞ্চ চলে যেত নতুন নাটকের সন্ধানে। শেষ কবে গিয়েছে, মনে পড়েনা।
কাকটা গাছের ডালে বসে ওর ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। রোজের অভ্যেস। জানে চুপ করে বসে থাকলে তিতির ওকে খেতে দেবেই। কপাল ভালো থাকলে (যা ইদানীং প্রায়ই হচ্ছে), পুরো থালাটাই ওর কপালে নাচছে। দু চামচ মুখে তুলল তিতির। তারপর "আয়, খেয়ে যা" বলে কাকটিকে দিয়ে দিল সমস্তটা।


৪।

" বৌদি, আজ একটু তাড়াতাড়ি যাব। ছেলেটাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। "
" ডাক্তার? কেন কী হলো? "
" ওর পেটে খুব ব্যথা হচ্ছে কদিন ধরে। খাওয়াদাওয়া করতে পারেছেনা। গ্রামের হাসপাতালে বলল শহরে দেখাতে। "
" কোথায় নিয়ে যাবে? ডাক্তার ঠিক করেছো? "
" ভাঙ্গরে নিয়ে যাবো। গ্রামের সবাই বলছিল, নাকি ভালো। "
" যেতে পারো। তবে আমি বলি কী, পিজিতেও যেতে পারো। বেশী ভালো হবে। "
" সে কোথায় বৌদি? "
" ভবানীপুর ছাড়িয়ে। আমি বাসের নম্বর বলে দেবো। "
" ঠিক আছে বৌদি। তাহলে তাই যাই। "
" আর হ্যাঁ শোনো, যাওয়ার আগে আমার থেকে টাকা নিয়ে যেয়ো। "
" আচ্ছা বৌদি। "
" আর সোনালীকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হবেনা। ও আমার এখানে থাকুক। ফেরার পথে ওকে নিয়ে যেয়ো। "
লাজুক সোনালীর দিকে তাকিয়ে ওর মা বলল, " ও কি রাজি হবে বৌদি? আমায় বা মিলুকে ছাড়া থাকতেই চায় না। "
" না সোনালী, ওই রুগীর ভিড়ে তোমায় যেতে হবেনা। আমার কাছে থেকো। আমরা ভালো থাকব। তোমার খারাপ লাগবেনা। দেখো। "
" তাহলে ওই কথাই রইলো বৌদি। আমরা বেরোই। সোনা মামীকে বিরক্ত করবি না একদম " সোনালীকে তিতিরের জিম্মায় রেখে ঘন্টাখানেক বাদে মিলুকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল মলয়া।

ওদের ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। বাড়ি এসে মলয়া দেখে, সোনালী আর তিতির বারান্দায় বসে। ওদের সামনে নানান রঙিন বই ছড়িয়ে রাখা। সেই বইয়ের পাতায় চোখ দুজনেরই। চিরুনি হাতে চুল আঁচড়ে বেঁধে দিচ্ছে তিতির। দুজনে খুব গল্প করতে ব্যস্ত, হাসির কলকাকলিতে ভরপুর ওদের বারান্দা। কে বলবে লাজুক মেয়ে সোনালির সাথে আজই পরিচয় হয়েছে তিতিরের।

" এই, তুই বৌদিকে বিরক্ত করছিস কেন সোনালী? " মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরলও সোনালীর। হরফর করে উঠে দাঁড়ালো।
" না মলয়া দি। ও একটুও আমায় জ্বালাতন করেনি। বরং ও থাকায় আমার খুব ভালো সময় কেটেছে। মাঝে মাঝে ওকে আনবে আমার কাছে। ডাক্তার কী বলল? "
" পেটের ফটক তুলল। কিছু ওষুধ দিল। আবার এক সপ্তাহ পর আসতে বলেছে। "
"  ঠিক আছে। সেদিনও সোনালিকে এখানে রেখে যেয়ো। কি রে, থাকবি তো? "
" হ্যাঁ মামী। বাকি গল্প শুনতে হবে তো। এই দাদা জানিস তো মামী আমায় কি সহজে অঙ্ক কষা শিখিয়েছে। তোকে বলে দেব। দেখবি তুইও আর ভুল করবিনা। "

 মলয়া ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে ল্যাপটপ খুলে বসলো তিতির। আজ যেন অনেকদিন পর ওর সারাদিনটা ভালো কেটেছে। প্রাণ খুলে হেসেছে। কথা বলেছে। গল্প করে লেখাপড়া শিখিয়েছে। ইচ্ছে করছে, ঠিক এরকম করেই যদি প্রতি দিন কাটানো যায়। খানিক ভেবে তারপর গুগুল খুলে তাই তিতির সার্চ করল কাছাকাছির মধ্যে কোন স্কুলে বা মন্টেসরিতে চাকরি আছে কি না। নিজের ডিগ্রিটা নইলে মর্চে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল যে। তিতিরকে যে ফিরতেই হবে স্বাভাবিক জীবনে। তিতিরদের হারতে নাই, হারিয়ে যেতে নেই।



Sunday, December 10, 2017

সখ পূরণ

১।

ছায়া ঘনাইছে বনে বনে।

গগনে গগনে ডাকে দেয়া।

গাড়িতে স্টার্ট দিতেই শুরু হয়ে গেল শ্রীকান্ত আচার্যর গলায় আমার অন্যতম প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতটি শুরু হল। আমার প্রতিদিনের অভ্যেস, গাড়ি চালিয়ে অফিস পৌঁছনো অবধি রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার চাইই চাই। শুনতে শুনতে গুনগুন করি, মন মেজাজ ভালো থাকলে আর রাস্তায় ট্রাফিক না পেলে গলা ছেড়ে গাইও। দক্ষিণীর স্টুডেন্ট আমি, একটা সময় অনেক স্টেজ শো করেছি। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে লন্ডনের থেকে একটু দূরে আমি থাকি, চাকরি করি একটি ব্যাঙ্কে। সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেরোই, ঘন্টাখানেকের পথ। তার মধ্যেই হ্যান্ডসফ্রিতে চলে বাড়িতে কথাবার্তা। সারাদিন অফিসে কাজের চাপ, সামলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা। এসেই কোনমতে খেয়ে দেয়ে আবার পরেরদিনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি। এই গতে বাঁধা জীবনের খপ্পরে পড়ে আমি গান গাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছি। কলেজে পড়াকালীন সখের লেখালিখি একটু যা করতাম, তাও আর হয়ে ওঠে না। এই জীবনে হাঁপিয়ে যাই তো বটেই। কিন্তু তখনই মনে হয়, এমন জীবনই তো চেয়েছিলাম, সেই ছোট থেকে। মস্ত চাকরি করব, আমার গর্বে গরবিনী হবে আমার মা। বিদেশে থাকব, প্রচুর নাম ডাক হবে, অনেক অনেক টাকা রোজগার করব, মায়ের সমস্ত স্বপ্নপূরণ করব। এই তো চাইতাম ছোট হেকে। আর তাই যখন স্কলারশিপের টাকায় বিদেশে এলাম, তখন মনে হয়েছিল। এই তো সুযোগ তিতির। এইবারে এর পুরো সদ্ব্যবহার করে সমস্ত সখ আহ্লাদ পূর্ণ করব। এম এসের পরে লন্ডনের চাকরিটা তখন ছিল আমার কাছে আমার স্বপ্নের জগতের ভিসা। আসলে ছোট থেকে দেখে এসেছি, মা কত কষ্ট করে একা হাতে আমায় বড় করেছে। কখনো কোন স্বাদ আহ্লাদ পূরণ করতে কমতি রাখেনি বটে, কিন্তু আমি বুঝতাম। দিনের পর দিন স্কুলে পড়িয়ে, তারপর বাড়তি রোজগারের জন্য ট্যুটোরিয়ালে ক্লাস করিয়ে ক্লান্ত মা ফিরত বাড়ি। কত করে তখন বলতাম মা কে ছুটি নিতে, কিন্তু তাহলে আমার স্কুলের ফিজ, গানের স্কুলের ফিজ আটকে যেত, এই বলে মা আমার খেটে চলত অমানুষিক ভাবে। আমার সেই ইচ্ছা এখন সবটাই পূর্ণ হয়েছে। এখন প্রতি মাসে যত পাউন্ড পাঠাই মা কে, তার মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় অনেকটাই। মা কে আর পরিশ্রম করতে হয় না। নিজের মতো করে একটা এন জি ওর সাথে যুক্ত হয়ে কিছু অভাবী মেধাবী ছেলেমেয়েদের পড়ায়, স্কুল থেকেও রিটায়ার করেছে। সবই হয়েছে, শুধু কোথায় যেন নিজের বলে যেটুকু সখ আহ্লাদ ছিল, সেগুলি আর নেই। কোথায় কোন বিজনেস মিটিং, ক্লায়েন্ট কলের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে। কবিতার ছন্দ লুকিয়েছে পাওয়ার পয়েন্টের স্লাইডে। আর গান? সে এই বাড়ি থেকে অফিসের পথটুকুতে, নীরবে, নিভৃতে।

২।

গাড়িটা পার্ক করতে গিয়ে দেখলাম পাশেই অন্তরা। অন্তরা ছাড়াও আমার অফিসে বেশ কয়েকজন ভারতীয় চাকরি করে, তাদের সাথে তেমন বাড়াবাড়ি রকমের অন্তরঙ্গতা না থাকলেও অন্তরার সাথে আমার খুব জমে। ও ভারী মিশুকে হাসিখুশি মেয়ে। গল্প করে আপন করে নিতে ওস্তাদ। আমার আগে থেকে লন্ডন অফিসে আছে। ওই আমায় এখানে প্রথম দিন থেকেই এমন আপন করে দিয়েছে যে হোম সিকনেসটা আমার খুব কম হয়। পারকিং লট থেকে বেরোতে বেরোতে এক ছুট্টে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল ও। "কী সুন্দর লাগছে তোমায় আজ তিতির দি।" হ্যাঁ, ও এরকমই পাগল। প্রতিদিনের মতোই আজও বিজনেস স্যুট পড়েই এসেছি। চুলও একইভাবে টপনট করে রাখা, তাও যে কি করে আমায় আজ সুন্দর দেখে, ওই জানে। "পাগলি!" বলে হেসে উত্তর দিলাম। অন্তরা আর আমি পাশাপাশি ডেস্কে বসি, নিজের নিজের জায়গায় এসে কম্প্যুটার লগ ইন করতে করতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম আজকের টু ডু লিস্টটাতে। বেশ লম্বা আজ, অনেকক্ষণ টানা কাজ করতে হবে। মেইল চেক করে দিন শুরু হয় আমার। ইনবক্স ভর্তি বিভিন্ন দরকারি অদরকারি মেলে। পরপর সাব্জেক্ট দেখে দেখে স্ক্যান করতে করতে একটা সাব্জেক্টে এসে চোখ আটকে গেলো। এইচ আর থেকে এসেছে, ন্যু ইয়ার ব্যাশ হবে অফিসে। থিম ইন্টারন্যাশ্নাল ফ্লেভার। একত্রিশ তারিখ লাঞ্চ পার্টি হবে অফিসের সকলের, আর ওই দিন সকলকে যার যার নিজের দেশের পোশাক পড়ে আসতে হবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের স্লটের জন্যও বলেছে।

" তিতির দি। দেখলে এইচ আরের মেইল?" পাশের ডেস্ক থেকে অন্তরার ডাকে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "হ্যাঁ রে। তাই তো দেখছিলাম। ভালোই হল। পুজোয় যে শাড়িটা পড়েছিলাম, সেটাই না হয় পড়ে নেবো। "

" আরে সে তো পড়বেই। কিন্তু তার আগে তুমি কালচারালে নাম লেখাও। সাহেবগুলো একটু শুনুক তো আমাদের গান। সারাক্ষণ ওই কি যে অপেরা অপেরা আর কয়ের করে চলে। কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমাদের মিষ্টি গান শুনিয়ে ওদের তাক করে দাও তো দিদি।"

"আরে ধুর, গানের রিহার্সাল নেই কতদিন। এখন কি আর পারব নাকি?"

" হাতে কম করেও এক মাস সময় আছে। তুমি রোজ প্র্যাক্টিস করো। ঠিক পারবে। "

" না রে অন্তরা। সত্যি বলছি। সময় নেই। পরশু মা আসছে এখানে। মায়ের সাথে সময় কাটাবো না গানের রেওয়াজ করব?"

" আরে কাকিমা খুব কন্সিডারেট। কিছু মনে করবে না। আমি তোমার নাম দিয়ে দিচ্ছি। "

" না রে। প্লীজ। সোনা আমার।"

" নো সোনা মোনা তিতির দি। আমি রিকিকে বলে দেবো যে তুমি গাইবে। এ কী, ইন্ডিয়ান কন্টিনজেন্টকে রিপ্রেসেন্ট করতে হবে তো! "

" মোহিনী নাচুক। আমি কেন?"

" মোহিনী দি ও নাচুক। তুমিও গাইবে। ব্যস। আর কোন কথা শুনব না। "

৩।

অন্তরার জোরাজুরি আর পাগলামির ফলে সেই আমায় গানের জন্য নাম লেখাতে হল। স্লট পেয়েছি দশ মিনিটের। জানিনা দশ মিনিটে কী গাইব। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া তো কিছুই বুঝি না। গাইতেই পারি না। অথচ ওরা কি আদৌ সেটার মাহাত্ম্য বুঝবে? কীভাবে যে প্রেসেন্ট করা যায় ওদের সামনে, লেখা আর গানের সংমিশ্রণ, কিছু একটা এরকম করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে আমি এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। আজ মা আসছে আমার কাছে। মাস চারেক থাকবে। তারপরে এপ্রিলে জন্মদিন পালন করতে আমরা সুইজারল্যান্ড যাবো। এটা আমার পুরনো সখ। ছোটবেলায় এটলাস বের করে ইয়ুরোপের ম্যাপ খুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। যাদবপুরের ভাড়ার বাড়িটায় আমার পড়ার ডেস্কে একটা গ্লোব ছিল। দশ বছরের জন্মদিনে মাসি কিনে দিয়েছিল। খালি খালি গ্লোব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আঙুল থমকে যেত ইয়ুরোপের ওপর। আল্পস পর্বতমালা, ফ্রান্স, ব্রিটেন এইসব জায়গা যেন মনে হত স্বপ্ন। চাকরিসূত্রে ব্রিটেন ফ্রান্স ঘুরে ফেললেও আল্পস দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। মা খুব বেড়াতে ভালোবাসে। কিন্তু তখন সামর্থ্য বলতে ওই পুরী দীঘা দার্জিলিং। একবার মামাবাড়ির সবাই মিলে গিয়েছিলাম হরিদ্বার মুসৌরি দেহরাদুন। ব্যস। আর কোথাও না। যেতে পারতাম না ঠিকই। কিন্তু লাইব্রেরি থেকে ভ্রমণ পত্রিকা এনে মা মেয়ে মিলে গোগ্রাসে গিলে ফেলতাম। এখন সামর্থ্য থাকলেও সময়ের অভাব। সারাক্ষণ অফিস অফিস করেই পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাও তার মধ্যেই মা এখানে আসছে বলে প্ল্যান করা। জানি না কেমন কি হয়। এপ্রিল আসতে ঢের দেরি। তার আগে সামনেই অনুষ্ঠান। শিরে সংক্রান্তি অবস্থা আমার। কী যে করি, কী যে করি।

এরাইভালে দেখাচ্ছে দিল্লি থেকে মায়ের ফ্লাইটটা ল্যান্ড করেছে। ব্যস, আর খানিক্ষনের অপেক্ষা। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরব। এক বছর পর মা কে দেখব। কাছে পাব। ভাবতেই মন ভালো হয়ে যায়। ওই তো মা। একটা হলুদ সিল্কের শাড়ী পড়েছে। পিছন দিক করে চুলটা টেনে একটা খোঁপা করা। কপালে ছোট্ট টিপ, মেরুন রঙের। এক ঝটকায় যেন স্কুলের দিনগুলিতে চলে গেলাম। স্কুল ছুটির সময়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ঘেমে নেয়ে সারাদিন স্কুলে বাচ্চা পড়িয়ে তাঁতের শাড়ি পড়া আমার মা আসত, আমায় বাড়ি ফেরাতে। তখনের মতোই আমি আজও দৌড়ে গেলাম মায়ের কাছে। জড়িয়ে ধরলাম। প্রাণভরে নিলাম মা মা গন্ধটা। আহ! কী আরাম।

৪।

" তিতির দি, কেমন চলছে রিহার্সাল? "

" ভালো না রে অন্তরা। গান সিলেক্ট করেছি। তবে শিয়োর না। জানিনা সবাই বুঝবে কি না। "

" কী নিয়ে করবে ভেবেছ?"

" আমি ভাবছিলাম রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর চেতনা নিয়ে যদি কয়েকটা গান করি। মাঝে ইংরেজিতে কিছু কিছু লাইন বলে দেবো। "

" ধুর। ওরা ওসব বুঝবেই না। এমন সুন্দর লিরিক ওরা মানেই বুঝবে না। "

" তাহলে? "

" আমি যদিও তোমার মতো পারদর্শী না। কিন্তু একটা আইডিয়া দিতে পারি তোমায়। "

" কী বল? "

" বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বিদেশী সুর থেকে অনুপ্রাণিত। তুমি সেই অরিজিনাল আর বাংলা, দুটোই গাও না। গানগুলির রচনার ইতিহাস বলো। তুমি নিশ্চয়ই পারবে সেগুলো জোগাড় করতে। "

" হ্যাঁ, নট আ ব্যাড আইডিয়া। বাট..."

" নো বাট অ্যান্ড নো ইফ। তুমি শুরু করো প্র্যাক্টিস। "

" হুম। দেখছি। মাকেও জিজ্ঞেস করব। মার এসব ব্যাপারে সেন্স বেশ ভালো। "

" হ্যাঁ হ্যাঁ করো। দেখো, এই সাহেবগুলোকে দেখিয়ে দিতে হবে। ওদের ওই অপেরার চেয়ে কত রিচ আমাদের সঙ্গীত। "

" তোর যে কেন অপেরার ওপর এত শত্রুতা কে জানে। ওটা এক ধরণের শিল্প, আমাদেরটা আমাদের। তুলনা হয় কেন? দুটোই দুইভাবে সুন্দর। "

" তিতির দি, ওই সব জ্ঞানের কথা ছাড়ো। যাও গান গাও। "

" পাগলি! এখন অনেক কাজ আছে। রাত্রে বাড়ি গিয়ে করব। "

" কোন হেল্প লাগলে বলো। "

"একদম।"

৫।

অবশেষে আজ সেই বহুকাঙ্খিত দিনটি এসেই পড়েছে। কাল সারা সন্ধ্যে মা আর অন্তরার সাথে ঝগড়া করে করে শেষমেশ আজকের ড্রেস সিলেক্ট করেছি। আমি যত বলি সাদা শাড়ী রঙিন পাড় পড়বো, গানের স্কুলের অনুষ্ঠানগুলির মতো, তত এরা রেগে যায়। "এইটুকু মেয়ে সাদা পড়বে কেন।" "দি তুমি কিছুতেই ঢাকাই পড়বেনা। সিল্ক পড়ো।" ইত্যাদি। ইত্যাদি। এই সব শুনতে শুনতে শেষে তিনজনে মিলে রফা করে একটা হাল্কা ঘি রঙের তসর যার পাড় আর আঁচলে মেরুন রঙের রেশমি সুতো দিয়ে গুজরাটি স্টিচের কাজ ফাইনাল হয়েছে। কাল রাত্তিরটা অন্তরা আমার এখানে ছিল, সকালে আমায় সাজাবে বলে। সকাল ছটা বাজতেই উঠে পড়লাম। কোনমতে কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে স্নান সেরে এসে নিজেকে তুলে দিলাম মা আর অন্তরার হাতে। এক ঘণ্টা পরে যখন নিজেকে আয়নার সামনে দেখলাম, সত্যি বলছি, নিজেই চমকে গিয়েছি। একটু ঘষামাজা করলে যে আমিও সুন্দর দেখতে লাগতে পারি, এ যেন ভুলতে বসেছিলাম। সাড়ে সাতটা নাগাদ রওনা দিলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। সাথে মা ছিল। স্পেশাল অনুষ্ঠান বলে পরিবারের লোকজন আজ আমন্ত্রিত।

অফিসটাকে আজ দারুণ সুন্দর করে সাজিয়েছে, বেলুন, স্ট্রিমার, রিবন দিয়ে। বিভিন্ন দেশের পতাকা দিয়ে একটা গ্লোবের আকৃতি বানানো রয়েছে অডিটোরিয়ামের ঠিক বাইরে। যথসময়ে আমিও গেলাম স্টেজে। একটু ভয় ভয় করছে। এর আগেই মোহিনী এক্কেবারে ভুবনমোহিনী পারফরমেন্স করে উপস্থিত সকলকে মাতিয়ে দিয়েছে। মাইকে হাল্কা টোকা মেরে শুরু করলাম আমার বক্তব্য। "Drink to me only with" গানটির ইতিহাস বললাম। তারপরে একই সুরে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত "কতবার ভেবেছিনু" গানটির উল্লেখ করলাম। যতটা সম্ভব সহজ করে গানের মানে বোঝালাম। তারপর দুটো গান গেয়ে শোনালাম। গোটা হল হাততালিতে কাঁপিয়ে দিল। মাঝের সাড়িতে দেখলাম মা আর অন্তরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। আমার তখন দুই চোখ ঝাপসা হওয়ার জোগাড়। অনুষ্ঠান শেষে এইচ আর ম্যানেজার এসে করলেন সারপ্রাইজ এনাউন্সমেন্ট। অনুষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ তিন প্রতিযোগী পাবে পুরস্কার। আমি পেলাম যুগ্ম প্রথম, কেনিয়ার একটি মেয়ে, রওয়ান্ডার সাথে। পুরস্কার হিসেবে পেলাম স্কটল্যান্ডের এক ক্যাসলে তিন দিন দুই রাত্তিরের ছুটির ভাউচার।

হঠাৎ করেই সব ইচ্ছে যেন একে একে পূরণ হয়ে গেলো আমার। একটা সব পেয়েছির আনন্দ আচ্ছন্ন করে দিল আমায়। আহ্লাদে আটখানা হয়ে মায়ের সাথে অন্তরার সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে হবে এখন। বাড়ি ফিরেও অনেক কাজ। প্যাকিং করতে হবে যে। পরশুদিনই বেরোনো।

Sunday, December 3, 2017

খাইয়ে সুখ

কড়াইতে তেল গরম করতে দিয়ে ঝটপট লুচিগুলো বেলতে লাগল অঙ্গনা। প্রায় দেড়শো লুচি ভাজতে হবে, হাতে সময় খুব কম। সেপ্টেম্বর মাসের ভ্যাপ্সা গরম, এই আদ্যিকালের পুরনো বাড়ির রান্নাঘরটাতে হাওয়া চলাচল প্রায় নেই বলাই চলে, কিন্তু থামার কোন উপায় নেই। ঘামতে জোরে হাত চালাতে থাকে ও। প্রথম লুচিটা তেলে ছাড়তে ছাড়তেই প্রায় ফুলে উঠল, ব্যস, এবারে বাকী সবগুলোও এমন ফুলকো হলে নিশ্চিন্ত হয় অঙ্গনা। পাশের গ্যাসে ফুটতে থাকে ফুলকপি আলুর ডালনাটা। কখনো ওটা নাড়তে থাকে, কখনো লুচির কড়াইয়ে ভাজতে থাকে। সমান তালে চলতে থাকে বেলা।
" বৌদি, আমি বরং তরকারিটা গরম করছি। তুমি লুচি সামলাও। "
" না না পারো, আমি ম্যানেজ করে ফেলব। তুই বরং ততক্ষণে মাংসটা ম্যারিনেট করে রাখ। আমি বলে বলে দিচ্ছি। লুচিটা নামিয়েই মাংসটা ধরতে হবে। "
" আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমায় পর পর বলতে থাকো। "
" ওই তো তোর আন্দাজ মতো মাপ দিস। মোটামুটি মাপ করেই রেখেছি। "
" হ্যাঁ ঠিক আছে। কতটা মাংস আছে? "
" ছয় কিলো রে। নে ওই টক দই আদা রসুন বাটা, নুন হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো, পিঁয়াজ বাটা, অল্প করে গরম মসলা গুঁড়ো আর খানিকটা সর্ষের তেল দিয়ে মাখিয়ে রাখ। "
" নুন চিনি? "
" চিনি লাগবে না। নুন ভালো করে খেয়াল রাখিস কতটা দিলি। কষানোর সময় কিন্তু তোকে ডাকব নুনের মাপ বুঝতে। "
" বেশ। "
গরমটা আজ বেশ ভালো মতোই পড়েছে। তার সাথে যোগ হয়েছে টেনশন। অঙ্গনার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী ও না। দায়িত্ব নিয়েছে যখন, ভালো ভাবে কাজটা করতেই হবে। বসু মল্লিক বাড়ির একমাত্র বৌমা, অঙ্গনা আর ওর ননদ, পারোমিতা, মাস তিনেক হল  নিজেদের বাড়ি থেকেই জয়েন্ট ভেঞ্চারে শুরু করেছে ওদের নতুন ব্যবসা, "খেয়ে সুখ"। নিয়মিত কিছু বাড়িতে দুবেলার খাবার ডেলিভারির সাথে সাথে ছোটখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানের খাবার সরবরাহ করাটাও ওদের সার্ভিস, এমনই লিখে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ওরা। তবে তিন মাস পর এই প্রথম ওরা এমন একটি অর্ডার পেয়েছে। পাড়াতেই একটি বাচ্চার জন্মদিনের পার্টি, পঞ্চাশ প্লেট ডিনার ওদের দায়িত্বে।

শ্বশুর শাশুড়ি দেশের বাড়ি ছেড়ে আসবেন না। আর স্বামী মিহির চাকরি করে সেলসে, মাসের মধ্যে আদ্ধেকেরই বেশী সময় বাইরে বাইরে ঘুরে বেরিয়ে কাজ।  পারোমিতারও কলেজ শেষ। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবে নেবে করছে।  সারাদিন বাড়িতে বসে বসে ননদ বৌদি চরম বোরডমে আক্রান্ত। সারাক্ষণ ওই ফেসবুক আর টিভি আর শপিং করতে করতে যখন একঘেয়ে অবস্থা, তখন হঠাৎ লোকাল কেবিল টিভির এক চ্যানেলে কিছু না ভেবেই অংশগ্রহণ করেছিল অঙ্গনা আর পারোমিতা। বিষয় ছিল, রোজগেরে গিন্নি। ঘরকন্নার বিভিন্ন কাজ ঝটপট সারতে পারলেই প্রাইজ, মোটা অঙ্কের টাকা। অঙ্গনা-পারোর জুটি অনুষ্ঠানে পায় দ্বিতীয় স্থান। তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কারের সদ্ব্যবহার কীভাবে করা যায়, ভাবতে ভাবতেই "খেয়ে সুখ"এর জন্ম। বরাবরই রান্নার হাত ভালো অঙ্গনার, তার সাথে ছিল পারোর উৎসাহ। এবারে পুরস্কারের টাকাটাকে ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট ধরে অনেক চেষ্টা করে, ফেসবুক পেজ খুলে, লোকাল টিভিটে বিজ্ঞাপন দিয়ে এখন তিন মাস পর ওদের  খাবারের নিয়মিত কাস্টোমারের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। এর সাথে সাথে পেল আজকের এই জন্মদিনের পার্টির অর্ডার। যা শুনেছে বেশ কিছু প্রভাবশালী মানুষ নিমন্ত্রিত এই পার্টিতে। আর তাই এটা ভালোয় ভালোয় সামলে দিতে পারলে ওদের ব্যবসার পক্ষে একটা দারুণ বুস্ট হবে।

যত্ন করে শেষ লুচিটা থেকে তেল ঝরিয়ে গামলায় রাখল অঙ্গনা। পারো মাংসটা করছে। বেশ সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে, আর খানিকটা সিদ্ধ হলেই ওপর থেকে একটু গরম মসলা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই রেডি হয়ে যাবে। যাক, তিনটে আইটেম বাকি ছিল, হয়ে এলো। ফ্রিজ থেকে গতকাল রাত্রে বানিয়ে রাখা চালের পায়েসের বাসনটা বের করতে করতে মোবাইলে ফোন এলো।
" হ্যাঁ, মিসেস রায়, অঙ্গনা বলছি।"
" "
" হ্যাঁ, রান্না অলমোস্ট ডান। আমরা এবার প্যাক করে এক ঘন্টার মধ্যে রেডি করে ফেলব। আপনি চিন্তা করবেন না। আটটার মধ্যে ঠিক ঢুকে যাব আপনার ওখানে। "

" হ্যাঁ রে পারো, আর কতক্ষন তোর? "
" এই আর মিনিট পাঁচেক বৌদি। তুমি লুচি আর নাগেটগুলো প্যাক করা শুরু করো। "
" হ্যাঁ, তুই মাংসটা নামিয়ে ফ্যানের তলায় রাখিস। ফুল স্পিডে চালাবি। ঠাণ্ডা না হলে প্যাক করতে পারব না। "
" ঠিক আছে। তুমি করো বাকিগুলো, আমি এদিকটা দেখছি। "
" কে জানে কেমন হয়েছে রান্না। ওদের পছন্দ হলে হয়। জানিস তো খুব টেনশন হচ্ছে আমার। "
" ধুর টেনশনের কিছু নেই। দিব্যি ভালো হয়েছে, টেস্ট করলাম তো। "
" বলছিস? "
" হুম। "
" আচ্ছা বেশ। যা এবার গ্যাসটা অফ কর। হয়ে গিয়েছে মাংস। "
" হ্যাঁ, আমি ফ্যানের তলায় ওটা রেখে এসে তোমায় প্যাকিঙে সাহায্য করতে আসছি। "


চল্লিশ মিনিট পর যখন সুন্দর করে এলুমিনিয়াম ফয়েল আর প্লাস্টিক বক্সে করে পঞ্চাশজনের খাবার প্যাক শেষ হল অবশেষে, অঙ্গনা আর পারোর মুখে বিশ্বজয়ের পরিতৃপ্তি। অঙ্গনা শিল্পী মানুষ, ইচ্ছে হল, রেগুলার কেটারারের থেকে একটু আলাদা হবে। খাবারের সাথে সাথে যোগ করবে একটা কিছু বাড়তি জিনিস। কী করা যায়, কী করা যায়, ভাবতে ভাবতে টুক করে মাথায় খেলে গেলো একটা আইডিয়া। যেমন ভাবা তেমন কাজ। কোনমতে হাওয়াই চপ্পলটা পায়ে গলিয়ে ছুটল পাশের স্টেশনারি দোকানে। ঢুকল কিচু চার্ট পেপার আর রঙিন কলম নিয়ে। আর তারপর নিজের ছাপার মতো হাতের লেখায় টুকরো টুকরো কাগজে লিখল,

" ভ্যাপ্সা গরম, তাই বলে কি খাবার খাবেন না?
চেখে তো দেখুন, আমি বলছি, হতাশ হবেন না।
সাদা সাদা ফুলকো লুচি, মাংস ভাজা আর সাথে ফুলকপি,
মাটন আছে, আছে পায়েস, আরো আছে কি কি?
শেষ পাতে আমসত্ত্ব খেজুর কিশমিশের পায়েস।
এবার বলুন, "খেয়ে সুখ", করবেন তো আয়েশ?
যদি হয় পছন্দ,
করবেননা তো দ্বন্দ্ব?
আমরা আছি এই ঠিকানায়,
আসুন একদিন মোদের বাসায়।
"খেয়ে সুখ"।  চৌদ্দর দুই ভূপতি বোস লেন।।
সব রকম অনুষ্ঠানের জন্য অর্ডার নেওয়া হয়।। "


"এগুলো কী করবে বৌদি? "
" প্রত্যেকটা প্যাকের ওপর তুই সাঁটিয়ে দে। "
" লেখাটা ভালো হয়েছে। কিন্তু কী হবে? লোকে তো পড়ে খেয়ে ফেলে দেবে। "
" সে দিক। কিন্তু পড়বে তো। মাথায় খানিক হলেও রেজিস্টার করবে। "
" বলছ? "
" হুম। অ্যাড দেওয়া, আর কিছু না। "
" দাদার থেকে ভালোই সেলস শিখছো। "
" নে রিক্সা এসে গিয়েছে। তুই গিয়ে বোস। আমি এক এক করে প্যাকেটগুলো তুলে দিই। পৌঁছে দিয়ে আসি চল। "
" চলো। অল ইজ ওয়েল! "
"একদম।"

বলাই বাহুল্য, সেদিনের অর্ডার একেবারে সুপারহিট।


তিন মাস পর।

" নমস্কার, খেয়ে সুখ। আপনার রিকয়ারমেন্টস বলুন "
" "
" হ্যাঁ হ্যাঁ। আমরা পঞ্চাশজনের অর্ডার ইজিলি হ্যান্ডল করব। আপনি মেন্যুটা ডিস্কাস করতে বরং আজ চলে আসুন।"
" "
" হ্যাঁ, কাল আসুন তাহলে। বেশী দেরি করবেন না। আমাদের ওইদিনে অন্য বুকিং এসে গেলে কিন্তু আপনারটা আর নিতে পারব না। "

" "
" হ্যাঁ, থ্যাঙ্ক ইয়ু। আসুন। "


"খেয়ে সুখ" এখন পাড়ার গন্ডি ছাড়িয়ে এলাকায় বেশ নাম করেছে। অঙ্গনা আর পারোমিতা এখন দুই "সাক্সেস্ফুল অন্ত্রেপ্রেন্যোর"।




Wednesday, November 29, 2017

ভালোবাসাবাসি

১।
আজ কপালটা ভালো বলতে হয়, স্টপে আসতে না আসতেই ২৩৪/১টা ঠিক পেয়ে গেলো তিতির। আর কী সৌভাগ্য, লেডিজ সীট সব ফাঁকা। ভেবেচিন্তে টু-সিটারে জানলার ধারটাতে এসে বসল ও। এই কাঠের বাসগুলির একটাই সমস্যা, যতই ছোটবেলার নস্টালজিয়া মাখা থাকুক না কেনো, জানলার ধার বড্ড কম। যাই হোক, আজ অন্তত আমহারস্ট স্ট্রিট থেকে গলফগ্রীন এবার ঘন্টা খানেকের জন্য কানে ইয়ারফোন গুঁজে বেশ আনন্দেই কাটানো যাবে। সারাদিন ইয়ুনিভারসিটিতে হাজার একটা টেনশান, কাজের প্রেশার সব মিলিয়ে বেশ নাস্তানুবুদ অবস্থা হয় তিতিরের। তারপর বাড়ি ফিরেই রান্নাঘরে ছোটো। রিসার্চ করে দেশ উদ্ধার করো আর যাই করো, বাড়ির বৌ হয়ে এসছো, সন্ধ্যে হলে রান্নাঘরে শাশুড়ির সাথে সাথে থাকতে হবে, এটাই বাড়ির নিদান। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো তিতিরের। মা বাবার কাছে থাকাকালীন বাস পেয়েই মাকে জানিয়ে রাখলেই বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই হাতে পছন্দের রুহ আফজার গেলাসটা ঠিক পেয়ে যেতো। তারপরে তিনজনে মিলে চলত চা জলখাবার সহযোগে টিভি চালিয়ে রাজ্যের গল্প করা। পি এইচ ডি শেষ না করে বিয়ে করার এক্টুও ইচ্ছা ছিল না ওর। ল্যাবের কাজরীদিকে ল্যাজেগোবরে হতে দেখেই এমনটা ভেবেছিল। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। পিসিমণির আনা "হীরের টুকরো" ছেলেকে হাতছাড়া করা উচিৎ না বলে গত মাঘেই সায়নের সাথে তিতিরের বিয়েটা হয়ে গেলো। হ্যাঁ, সায়ন হীরের টুকরোই বটে। বরাবর স্কুলের টপার। রামকৃষ্ণ মিশন, আই আই টি বম্বে, জার্মানি থেকে স্কুল, বিটেক, মাস্টারস আর পি এইচ ডি করে এখন এন আই টি দুর্গাপুরে পড়ায়। শুক্রবার সন্ধ্যের বাস ধরে কলকাতা আসে, আবার সোমবার সক্কাল হতে না হতেই ফেরত চলে যায়। উইকেন্ডের দাম্পত্যটুকু বেশ চলে। সারা সপ্তাহের জমানো ভালোবাসা, আদর, সব ওই দুটো দিনেই লুটেপুটে নেয় দুজনেই। কিন্তু তারপরে সারা সপ্তাহের বিরহ। শ্বশুর শাশুড়ি টিভি সংসার নিয়ে ব্যস্ত। তিতিরের সাথে তেমনভাবে দুটো কথা বলারও কেউ নেই। পি এইচ ডিটা শেষ হলে ও ও চেষ্টা করবে দুর্গাপুরে চাকরির। সোজা না, তাও।
 পি এইচ ডির ফিফথ ইয়ার চলছে, থিসিস লেখা শুরু করবে করবেও হচ্ছেনা, ল্যাবে গাইডের মুখ ঝামটা, এক্সপেরিমেন্ট ফেল করার যন্ত্রণা, কাজ করতে করতে দেরি হয়ে গেলে বাড়ি এসে শাশুড়ির বাংলার পাঁচের মতো মুখ, সব মিলিয়ে যে থমথমে পরিবেশের মধ্যে আজকাল কাটে তিতিরের, তার মধ্যে যেন এক ঝাঁক ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো কাটে এই বাসের জার্নিটা। গান শুনতে শুনতে কখনো কখনো পাশে সহযাত্রী না থাকলে গুনগুন করেও ওঠে ও। আজও তাই করছিল, এমন সময় বাসটা হাজরার মোড়ে থামতে হন্তদন্ত হয়ে উঠল যে, তাকে দেখে এক ধাক্কায় তিতির পিছিয়ে গেলো অনেকগুলো বছর। 

২।
সালটা ২০০৪। সবে মাধ্যমিক দিয়েছে। এখনো রেজাল্ট বেরোয়নি। কিন্তু ট্যুশন ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তিতির আর ওর স্কুলের বান্ধবী সোহিনী সাদারন এভিন্যুতে অঙ্ক করতে আসে দিলীপ স্যারের ক্লাসে। ক্লাসের দ্বিতীয় দিন সেখানে এলো রোহিত। বালিগঞ্জ গভরমেন্ট স্কুলের টপার। কী শান্তশিষ্ট নিরীহ ছেলেটি। প্রথম দেখাতেই এক্কেবারে লাট্টুর মতো অবস্থা হয়ে যায় তিতিরের। একটু বড় মাথা (ঠিক যেমন পাথফাইন্ডারের ব্রোশ্যারগুলোতে টপারদের ছবিতে হয়), চৌকো সরু ফ্রেমের চশমা নাকের ডগার ওপর খালি এসে এসে পড়ে। তেমন ভাবে কারুর সাথে মিশত না শুরুর দিকে, শুধু নিজের স্কুলের দুই তিনজন ছাড়া। তবে আস্তে আস্তে সোহিনীর পাল্লায় পড়ে ওরা সবাই ভীষণ ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। সোহিনী, তিতির, রোহিত, সৌম্য, ত্রিদিব। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর তিতির আর রোহিত দুজনে ওদের অঙ্ক ক্লাসের সবার মধ্যে টপ করায় পাঁচজনে মিলে সেলিব্রেট করতে বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা খেতে গিয়েছিল। 
ক্লাস চলতে লাগল ক্লাসে মতো। সারডস ইন্ডিসেসের সাথে সাথে তখন তিতির একই সাথে "রাধার কি হইল পূর্বরাগ" সিন্ড্রোমেও আক্রান্ত। লাজুক ছেলে রোহিত, যে কিনা রেজাল্টের দিন "সাকসেস" লেখা টিশার্ট পড়ে এসেছিল আর তারপর হ্যান্ডশেক করে তিতিরকে "কনগ্রাটস, আমি ৭৩০, তুমি?"  বলেছিল বলে বাড়ি ফিরে দিদির সাথে কী হাসিটাই না হেসেছিল তিতির, সেই মেয়ে গিয়ে পড়ল এই ছেলেরই প্রেমে। তারপর আর কী, প্রতি ক্লাসে হাঁ করে রোহিতের দিকে তাকিয়ে থাকা, তারপরে ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে সটান প্রিয় বান্ধবী রাকাকে ফোন করে, "উফ, আজ কী দারুণ লাগছিল রে। বটল গ্রিন টিশার্ট, বেইজ কালারের প্যান্টে, ওরে না রে"র বন্যা বয়ে যেত। তবে ব্যাপারটা যে ছিল সম্পূরণভাবেই একতরফা, তা বুঝতে বেশিদিন লাগেনি তিতিরের। ইলেভেনের পুজোর ছুটির পরে পরেই সোহিনীর কথায় শুধু কনফার্মেশনটি পেয়েছিল। হ্যাঁ, রোহিত ভালোবাসে সোহিনীকে। প্রোপোজ করেছিল ওকে পুজোয়, ম্যাডক্স স্কোয়ারে গিয়ে। তিন রাত্তির কেঁদে কেটে ঘুমোতেই পারেনি প্রায় তিতির, ফোঁপাতে ফোঁপাতে রাকার কাছে সান্ত্বনা বাণী শুনেছে কত। তারপর আস্তে আস্তে দিন কেটেছে। ইলেভেন থেকে ট্যুএল্ভ, উচ্চ মাধ্যমিক, জয়েন্ট, বি এস সিতে প্রেসিডেন্সি, মাস্টার্সে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ। সেই সব গন্ডি পেরিয়ে তিতির এখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে কেমিস্ট্রিতে পি এইচ ডি ফাইনাল ইয়ার। সাথে সাথে ডঃ সায়ন চক্রবর্তীর প্রেমে ভরপুর আদুরে স্ত্রী। 

৩।
রোহিতের সাথে আজ এক ভদ্রমহিলা, স্ত্রী কিনা জানা নেই। সোশ্যাল মিডিয়াতে নেই বলে তিতির আর যোগাযোগ রেখে ওঠেনি রোহিতের সাথে। এতগুলো বছর পরেও অবশ্য তাও ওকে চিনে নিতে অসুবিধে হলো না। সেই একইরকম রয়েছে, শুধু বয়সের সাথে সাথে মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হয়েছে। আজও পড়েছে সেই বটল গ্রিন রঙেরই একটা শার্ট আর ক্রিম কালারের প্যান্ট। চোখের চশমার ফ্রেমটা একটু মোটা হয়েছে। আর সামনের দিকের চুল অল্প পাতলা হওয়ার দিকে। 
বাসে ইতিমধ্যে ভিড় হয়েছে, রোহিত ও মেয়েটি সামনের দিকে দাঁড়িয়েছিল। বাস যখন টালিগঞ্জ থানা পৌঁছল, দেখল, রোহিত বসার জায়গা পেয়েছে, সামনের দিকে সিনিয়র সিটিজেনের সিটে। তিতির একবার ভাবল, কথা বলবে না কি? কিন্ত অদ্ভুত ভাবে বেশিক্ষণ এই দোলাচলটা টিকল না, আনোয়ার শার মোড়ে পৌঁছতেই তিতির উঠে গেল সামনের দিকে। 
" আরে রোহিত না? কেমন আছিস বল।"
মুহূর্তের জন্য কি রোহিত ভ্যাবাচ্যাকা খেলো? খেলেও খুব দক্ষতার সাথে মেকআপ দিয়ে উত্তর দিল, " তিতির যে! ভালো। তুই কেমন আছিস? এদিকে কোথায়?"
ভাগ্যিস লরডসের মোড় অবধি তারপর বাসটা লম্বা জ্যামে পড়ল। দুই বন্ধুতে চলল কত পুরনো স্মৃতি রোমন্থন। রোহিত এখন একটি সরকারি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, মাস তিনেক আগে বিয়ে হয়েছে। ওর স্ত্রী সুকন্যা একটি বেসরকারি স্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। ওরা থাকে ভবানীপুরেই, সুনন্দার বাপের বাড়ি লেক গারডেন্স যাচ্ছিল। ভাগ্যিস কোন ক্যাব পায়নি সেদিন, তাই তো বাসে উঠতে হল আর দেখা হয়ে গেলো। নামার আগে নম্বর এক্সেঞ্জ করতে ভুলল না কেউই। 
ওরা নেমে যাওয়ার পর তিতির ওদের দুজনকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। ভারী মিষ্টি মেয়ে সুনন্দা। রোহিতের সাথে খুব মানিয়েছে। সোহিনীকে জানাতে হবে ওদের সাথে দেখা হয়েছে যে। সোহিনী এখন বুদ্ধর সাথে হ্যাপিলি ম্যারিড, ইয়ু কে তে থাকে। একটা সময়ে যে রোহিতের সাথে কথা বলতে বুকের মধ্যে দুরুদুরু করত, যার জন্য সোহিনীর সাথে বন্ধুত্ত্বের ভাঙ্গন ধরেছিল, আজ একটুও তো কিছু হল না। না বাজল ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন, না হাত পা ঠান্ডা হল। দিন আসে, দিন যায়। সময়ের সাথে সাথে কেমন সব সমীকরণ পাল্টে গিয়েছে, ভাবলেও হাসি পায়। 

নিজের নির্ধারিত স্টপে নেমে আবার আজ ডিনারে কী রাঁধতে হবে, পটলের ডালনা নাকি বর্বটির চচ্চড়ি ভাবতে ভাবতে তিতির ফ্ল্যাটের বেল বাজালো। পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় আজ মন ভালো, চোখে মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে আছে। যদিও চাবি নিয়ে বেরোয়, তাও বাড়ির ভিতর থেকে টিভির আওয়াজ পেয়ে আর তা বের করেনি। তবে একটু অবাক লাগল ওর, ঘর অন্ধকার। মিনিট তিনেক অপেক্ষার পর দরজা খুলতে সায়নকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেল তিতির।
" এ কী, তুমি?"
" কী? সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম বলো? "
" তার মানে আমি ল্যাব থেকে বেরিয়ে যখন ফোন করলাম, তখন তুমি এখানেই? "
" আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি তখন তোমার জন্য ডিনার বানাচ্ছিলাম। "
" ডিনার? মা বাবা কোথায়? "
" ওরা দিভাইয়ের ওখানে গিয়েছে। এক সপ্তাহ থেকে ফিরবে। আর তাই আমি এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসছি। আমার বউটার সাথে একটু সংসার সংসার খেলতে। "
" মা বাবা তার মানে এইসব জানতো? "
" তোমার মা বাবাও। সবাই জানে, এক্সেপ্ট ইয়ু।"
" হায় কপাল। পুরো ভেব্লু হয়ে গেলাম? "
" তা ভেব্লু সুন্দরী, মাঝে মাঝে এমনটা হওয়া ভালো কিন্তু। থিসিস লেখা তাড়াতাড়ি শুরু করো। তার আগে রসদ জোগাতে এলাম। "

গ্লাসে করে শরবৎ এনে তিতিরের হাতে ধরাতে ধরাতে সায়ন বলল, " তা তোমায় আজ যে বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছিল। আই হোল দিয়ে দেখলাম। এই যে অন্যদিন মুখ ব্যাজার করে বাড়ি আসো, আজ কী ব্যাপার? আমি আসছি, টের পেয়েছিলে নাকি?"
" আরে তা না। আজ বাসে অনেক বছর পর রোহিতের সাথে দেখা হল গো। তাই। "
" রোহিত? সে আবার কে? আমার সতান? "
" সতান আবার কী শব্দ? "
" ওই শয়তান আর সতীন মিলিয়ে একটা বানিয়ে ফেল্লুম! "
" ধ্যাত। রোহিত মোটেই শয়তান না। "
" তাহলে অন্তত মেল সতীন?"
" উফ। হিংসুটে কোথাকার। "
" আহা, একেই আমার বউটা আমার থেকে এত দূরে থাকে, এমনিতেই আমি কমপ্লেক্সে ভুগি। বিরহে থাকি। হুঠহাঠ এমন ফিল্মি নামধাম শুনলে ভিরমি খাব না? "
" আরে বাবা।বলছি ওর গল্প পরে। আগে বলো কী খাওয়াবে ডিনারে? ভেরি হাংরি! "
" চিজ চিকেন অগ্রাতা।"
"ওয়াও! চিইইইইইইজ।"
" হ্যাঁ, আরো খাও। আর আরো ভেব্লু হও।" বলতে বলতেই দুজনেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল সোফায়। 

সায়ন আর তিতিরের হঠাৎ পাওয়া এই দাম্পত্যের শুরুটা সেদিন নেহাৎ চিজি রোমান্টিক ভাবেই শুরু হল।  



"আমার  অনেক দিনের আকাশ-চাওয়া   আসবে ছুটে দখিন-হাওয়া,
                   হৃদয় আমার আকুল করে সুগন্ধধন লুটবে " - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

Sunday, November 26, 2017

রুক্মিনীর কথা।

কিছুতেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাজটুকু পছন্দ হচ্ছেনা তিতিরের। অর্ঘ্যর অফিস পার্টি, বেশ কিছু বছর পরে যাচ্ছে তিতির। অর্ঘ্য বসুর এই অফিসে সাম্প্রতিক এক বিশেষ ডিল ক্র্যাক করা উদযাপন করতে এই সারপ্রাইজ পার্টি, তাই মিসেস বসুকে অবশ্য করেই যেতে হচ্ছে। ফিটফাট হয়ে না গেলে ওই রাগারাগি করবে, অন্তত আগে তাই হত। কেন লাল কালো সিল্ক পড়েছে, কমলা নীল পড়েনি থেকে শুরু করে কেন সোনার গয়না পড়েছে যেখানে তখন হাল ফ্যাশনের কস্ট্যুম জ্যুয়েলারি পড়ে পার্টি মাতায় অর্ঘ্যর সব ফিমেল কলিগরা ও বন্ধুদের সঙ্গিনীরা, সেই নিয়ে চলত বিস্তর রাগারাগি, মন কষাকষি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে অনেকখানি। তবুও আজ তিতিরের খুব ইচ্ছে করছে এমনভাবে সাজতে যেন রাজরাণী লাগে ওকে। সারা সকাল দুপুর ধরে আলমারি থেকে কাপড় বের করে গায়ে ফেলে ফেলে দেখে অবশেষে পছন্দ করেছে লাল রেশমের শাড়ীটি। খুব স্পেশ্যাল এইটা ওর কাছে। অর্ঘ্য পাটিয়ালা থেকে এনেছিল ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে। অসম্ভব সুন্দর দেখতে শাড়ীটি পেয়ে তিতিরের সে কী আনন্দ। অর্ঘ্যর এস্থেটিক সেন্স বরাবরই চমৎকার। সেই ছিল বিয়ের পরে অর্ঘ্যর প্রথম অফিস ট্যুরে যাওয়া, বছরে এক থেকে দুইবারের ট্যুরগুলো থেকে ফিরত যখন, প্রত্যেকবার তিতিরের জন্য আসত বাহারি উপহার।  এখন ট্যুরের সংখ্যা মাসে একাধিক হলেও উপহারের ঝুলি শূন্য। প্রথম যৌবনের প্রেম বুঝি এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে, আর তাই কমতে কমতে এখন তলানিতে ঠেকেছে তার উচ্ছ্বাস, বহিঃপ্রকাশ।

ছটা নাগাদ উবার ডেকে চৌরঙ্গীর অফিসের দিকে রওনা দিল তিতির। কথামতো মিঃ চক্রবর্তী ওকে রিসিভ করে নিয়ে গেলেন স্টেজের পিছনের ঘরে। বললেন খানিক অপেক্ষা করতে। অনুষ্ঠান শুরু হলেই ডেকে নিয়ে যাবেন। তিতির বুঝল ওকে গ্রিন্রুমে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, বেশ কিছু ছেলে মেয়েকে দেখল অনুষ্ঠানের আগের ফাইনাল টাচ আপ করছে।

"ও হ্যালো, আপনি নিশ্চয়ই মিসেস বসু? আমি অন্তরা, অন্তরা সিংহ।" তিতির মন দিয়ে একটি মেয়ের খোঁপা বাঁধা দেখছিল। আজ অবধি হাজার চেষ্টা করেও কোন হেয়ারস্টাইল ঠিক করে করতে পারেনি। সাজগোজ, কিচ্ছুটি পারেনা। চমকে উঠল ও অন্তরার কন্ঠস্বরে।
"আমি অর্ঘ্যর পার্টনার। আরে? চমকে গেলেন যে? পার্টনার বলতে, এই ডিভিশনে আমিও সেম পোস্ট হোল্ড করি। আমরা একসাথেই হ্যান্ডল করি সব।"
" ও আচ্ছা। নমস্কার। আমি মণিকর্ণিকা বসু।"
" বাহ! কী সুন্দর নাম তোমার। এই যাহ্‌, দেখুন তুমি করে বলে ফেললাম। সো সরি। আসলে অর্ঘ্যর সাথে আমার সম্পর্কটা এমনই ক্লোজ যে..."
" কোন ব্যাপার না। নিশ্চিন্তে তুমি বলুন।"
" মণি, তুমি বসো। আমি একটু অর্ঘ্যকে দেখে আসি। ওকে এখানে আনার দায়িত্ব তো আমায়ই দিয়েছে চক্রবর্তীদা। তোমার সাথে পরে কথা বলছি। এমন মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি, ভালো করে আলাপ করতে হবে।"
তিতির হাল্কা হাসি হেসে প্রতিনমস্কার করল অন্তরাকে। অন্তরা সিংহ, নামটা খুব চেনা ওর। অর্ঘ্যর ফোনে বহুবার দেখেছে এই নাম। খেতে বসে, টিভি দেখতে গিয়ে, স্পেন্সারসে শাক সবজি বাছতে গিয়ে, যখনই ফোনে এই নামটি দেখেছে, অর্ঘ্য, "ইয়ু ক্যারি অন। দিস উইল টেক সাম টাইম" বলে সরে গিয়েছে। ড্রউইং রুমে বসে বারান্দা থেকে ভেসে আসা হাসির উচ্ছ্বাস, "ও স্যুইটহার্ট, স্টপ ফিলিং ডাউন, লেটস হ্যাভ আ ড্রিঙ্ক টুনাইট", এসবই তাহলে এই রমণীর জন্য। আচ্ছা, কী এমন আছে ওর মধ্যে যা তিতিরের নেই? কেন আজকাল আর ওদের বিবাহিত জীবনে সেই আগের মতো ভালোবাসা নেই? সবকিছুই কেন অভ্যেসে এসে ঠেকেছে?

" ম্যাডাম, সো সরি। আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রেখেছি। অর্ঘ্যর আসতে আরেকটু দেরি আছে। অন্তরা গিয়েছে ওকে ডাকতে। হঠাৎ কিছু লাস্ট মোমেন্ট ডিস্কাশান মনে পড়েছে ওর, খানিক বাদে আসছে। অন্তরা আমায় মেসেজ করে জানালো। আপনার জন্য কফি বলি?"
" না না। ঠিক আছে। অসুবিধে নেই। "
" তাহলে চলুন আপনাকে বরং অফিসটা দেখিয়ে দিই একটু, ঘুরবেন চলুন। "
" ইটস ওকে মিঃ চক্রবর্তী। আমি আগে এসেছি এই অফিসে। "
" ও তাই? আপনাকে কক্ষনো দেখিনি কোন ফ্যামিলি ডে বা পার্টিতে। অর্ঘ্যকে বললেই বলত হয় আপনার শরীর ভালো নেই, নয় আপনি বাপের বাড়ি গিয়েছেন। অবশ্য আমি সবে দুই বছর এসেছি এই ব্রাঞ্চে। "
" হ্যাঁ, আমি অনেকদিন পরে এলাম। ইন ফ্যাক্ট আপনি এত করে বললেন, তাই এলাম আর কী। "

তিতিরের সাথে মিঃ চক্রবর্তী এক এক করে বেশ কিছু অফিস স্টাফের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নানান কথাবার্তা চলছিল। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে অন্তরা এলেন গ্রিন্রুমে।
" চক্রবর্তী দা, অর্ঘ্যকে আনছি নীচে এবারে। সব রেডি কি না দেখতে ছুটে এলাম। "
" হ্যাঁ, অন্তরা। আনো। আমি মিসেস বসুকে নিয়ে যাচ্ছি।"


অনুষ্ঠান শুরু হল অর্ঘ্যকে সংবর্ধনা দিয়ে। তারপর অন্তরা খানিকক্ষণ বক্তব্য রাখল ওর আর অর্ঘ্যর পার্টনারশিপ নিয়ে। তারপর একে একে আরো বিশিষ্ট লোকজন এলেন স্টেজে, অর্ঘ্যর স্তুতিতে। ডায়াসে বসে পাশাপাশি অর্ঘ্য আর অন্তরা। আশেপাশে অফিসের বেশ কিছু কর্মকর্তাও আছেন, কিন্তু ওদের দুজনের থেকে যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা, তিতির মন্ত্রমুগ্ধের মতো (নাকি অবাক বিস্ময়ে) হাঁ করে দেখছে ওদের দুজনকে। কী দারুণ কেমিস্ট্রি, একসাথে হাসছে, কথা বলছে, মাঝে মাঝে তো হাসির চোটে একে অপরের ওপর প্রায় ঢলে পড়ছে। হাজার চেষ্টা করেও তিতির মনে করতে পারল না, শেষ কবে ও আর অর্ঘ্য এত হেসেছে একসাথে।

একবার নিজের দিকে দেখল তিতির, হ্যাঁ, এখন বোঝে মায়ের পইপই করে বলা কথাগুলো। শরীরের দিকে নজরই দেয়নি। দিনদিন মোটা হয়েছে বয়সের সাথে সাথে। অথচ অন্তরাকে দেখো, কী ছিমছাম ফিটফাট চেহারা, বয়স কম না, অথচ বয়সের ছাপ নেই এতটুকু, মেদবিহীন। শাড়ীটা পড়েছে কী দারুণ, নির্ঘাত কোন ডিসাইনারের বিশাল দামী প্রোডাক্ট, ব্লাউজটার দামই অন্তত হাজার তিন চারেক হবে, সেটাও ডিসাইনার। ওর সুতন্বী চেহারাকে দারুণভাবে বাড়তি সৌন্দর্য দিয়েছে। চুলের স্টাইলও দামী। গ্রিন্রুমে ও যখন তিতিরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, পারফ্যুমের সুগন্ধে মাতোয়ারা হওয়ার জোগাড় ওর। একেবারে যাকে বলে ওয়েল গ্রুমড, যে কোন পুরুষকে মাতিয়ে রাখার মতো মোহিনী চেহারা। তার উপরে আবার ডিভোর্সি, চক্রবর্তীর থেকে যা জেনেছে, থাকে বয়স্কা মা ছাড়া তিন কূলে কেউ নেই। জীবনের কোন ঝঞ্ঝাট নেই। বাড়িতে রান্নার লোকের পিছনে, ঠিকে ঝির পিছনে পিছনে সর্বক্ষণ টিকটিক করে যেতে হয়না। অফিস আর রূপচর্চা করেই সময় কাটে। তিতির বিয়ের দশ বছর কাটিয়ে দিল শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করে, সেই চক্করে নিজের ভালোবাসার জিনিসগুলো যে কখন ওর জীবন থেকে চলে গিয়েছে, টেরই পায়নি। কিছুদিন আগে চিলেকোঠার ঘরটা সাফাই করতে গিয়ে পুরোনো গানের খাতাগুলো দেখল, ড্যাম্প লেগে কালিগুলো আবছা হয়ে গিয়েছে, ঠিক যেন ওর জীবনের মতোই, বর্ণহীন।  অর্ঘ্যকে দোষ দেয় কিভাবে ও? পেহলে দর্শনধারি, ফির গুণ বিচারি সমাজে যে মেয়ের এত চটক, তার প্রতি আকর্ষণটাই কি স্বাভাবিক না? এই তো আজকেও এত ভাবল ভালো করে সেজেগুজে আসবে, তাও কি পারল? ঠিক শেষ মুহূর্তে ইয়ুট্যুবে দেখা হেয়ারস্টাইলটা ফেইল করল, সেই চিরাচরিত হাতখোঁপা করেই এলো। ক্যাব এসে যাওয়ায় সেন্টটাও লাগাতে ভুলে গেল। ছোট থেকেই তিতির এমন, সাজগোজের প্রতি একদম নজর নেই। মায়ের কাছে কম কথা শোনেনি এই জন্য, কিন্তু তার মাশুল যে এইভাবে দিতে হবে, অকল্পনীয় ছিল ওর কাছে। অর্ঘ্য তো ওকে দেখে খুব যে খুশি হয়েছে, মনে হল না। কেমন একটা দায়সারা ভাবে স্টেজে ওর সাথে পোজ দিয়ে ছবি তুলল। বরং তারপর অন্তরার পাশে বসেই ওর মুখের হাসি ফিরল।


"আজকাল তেরে মেরে প্যার কে চরচে হর জুবান পর
সবকো মালুম হ্যায় অউর সবকো খবর হো গয়ি।"


চিন্তার জাল কাটল তিতিরের স্টেজের গানে। সারা অডিটরিয়াম তখন অন্ধকার। স্পটলাইটের নীচে তখন অন্তরা। কী গলা! কী স্টেজ প্রেসেন্স! এই মেয়ে এক্কেবারে স্টার! গাইতে গাইতে সমান তালে নেচেও গেল, আর প্রথম সারির থেকে বেশ কিছু লোককে তুলে নাচালোও বটে। ওকে আর অর্ঘ্যকেও নাচতে স্টেজে তুলল বটে, কিন্তু তিতিরের বরাবরই স্টেজে উঠলেই কোল্ড ফিট হয়, এক পাও নাচতে পারেনা। একটু কষ্ট করে হাত পা নেড়ে ও সরে এলো, বুঝল যে ওইটুকুতেই অর্ঘ্য বিরক্ত। হবে নাই বা কেনো? সামান্য একটা পার্টিতে নাচতেও পারেনা তিতির? কেনো? শুধুই ঘরকন্না করলেই হয়? আজকের যুগে অন্তত? অর্ঘ্যর কি ইচ্ছে করে না নাকি কোন স্মার্ট সাথী পায়? অন্তরা তো প্রতিপদে প্রতিক্ষেত্রে অর্ঘ্যর সাথে সমান তালে চলতে পারে, সেখানে তিতিরের জায়গা কোথায়? নাহ, এ মিড লাইফ ক্রাইসিস না। এটা বরং তিতিরেরই পারসোনালিটির এক্সিস্টেন্সের ক্রাইসিস। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মডার্ন হতে পারলো না, এখনো ১৫/১ শ্যাম পুকুর লেনের মানসিকতা আঁকড়ে রইলো বলে সাউথ সিটির তিরিশ তলায় থাকতে পারলেও বোধহয় খাপ খাওয়াতে পারলনা। আর অর্ঘ্য? ও কি করবে? ঘরে যে সুখ পেলো না, সেই সুখের সন্ধানে অন্যত্র যাবে না কেনো? তিতির নিজে ওই জায়গায় থাকলে কি তা করত না? করতো? প্রশ্নের উত্তর পায় না তিতির। শুধু ভেসে আসে সারা সন্ধ্যের কিছু কিছু মুহূর্ত, সিনেমার মতো।

দু চোখ ভরে আসে জলে। কোনমতে অডিটোরিয়ামের বাইরে এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফেরে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় খোলা হাওয়ায়। জীবনের সব জমে থাকা দুঃখ হঠাৎ একসাথে যেন ওর গলা টিপে দিচ্ছে।  চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, নিজের ভাগ্যের ওপর। গলার কাছে একটা বড্ড বড় রকমের কান্নার দলা পাকিয়ে ওঠে ওর। হাতে ব্লেড নিয়ে একবার ভাবে শেষ করে দেয় সব যন্ত্রণা, সব দুঃখ কষ্ট এক মুহূর্তে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও চাপ দিতে পারেনা ব্লেডে। বড্ড ভিতু যে। এই পরীক্ষায়ও হেরে যায় তিতির, সবের মতোই। সেই "গুড ফর নাথিং"ই রয়ে যায়।







Wednesday, November 22, 2017

আমি ও সানগ্লাস

১।

" পইপই করে তোকে বলেছি, রোদের মধ্যে বেরোস যখন, সানগ্লাসটা পড়ে নিবি। এবার বোঝ! মাথা ব্যথা কী করে কমবে, আমি জানিনা। গ্লোনইন খেয়ে দেখ। " (মা জননীর পরম প্রতাপান্বিত চিৎকার)
" হ্যাঁ, পড়েছি তো। " ( মিনমিনে রিনরিনে গলায় অধমের উত্তর)
" সে তো এখন, আগে পড়লে এই মাথা ব্যথাটা হত না। এত বছর বয়স হয়ে গেলো, তবু নিজের ভালো নিজে বুঝতে শিখলো না। " ( অত্যন্ত বিরক্তি, "এর আর কিছু হল না" ভাব সহ মা জননী) 



২।

" মা আসছি। ক্যাব এসে গিয়েছে। " ছলছল চোখ, মায়ের ও মেয়ের, দুজনেরই। ক্যাবে ওঠার মুখে কিন্তু মেয়ের কক্ষনো ভুল হয় না সানগ্লাসটা পড়ে নিতে, সে রোদ হোক কি না হোক। সেটা যে তখন এক বিরাট পর্দা।




৩।

পণ্ডিচেরি প্ল্যান চেকলিস্টঃ

ফ্লোরাল প্রিন্টের ড্রেস :  ✓
বিচ স্যান্ডাল : ✓
সানস্ক্রিন লোশন : ✓
সানগ্লাস ( লেটেস্ট স্টাইলের) : ✓




৪।

তেল মাখা মাথা, কোন হেয়ারস্টাইলই যখন ভালো লাগছে না, মাথার পিছনে সব চুলগুলোকে টেনে এনে একটা দলা পাকিয়ে খোঁপা। চোখে বড় সানগ্লাস, ঠোঁটে হাল্কা লিপগ্লস। পারফেক্ট! এক্কেবারে নাল্লা ইড়কা!!!

Tuesday, November 21, 2017

গানের ওপারে

হেমন্তের বিকেল। পড়ন্ত সূর্যের ম্লান আলো এসে পড়েছে হিমানীর ফ্যাকাশে গালে। কাঠের জানলার পাল্লা ধরে বসে থাকে ও এই সময়ে, সারাদিনের মতোই। সামনের লেকের ওপর সূর্যাস্ত ওর খুব প্রিয়, আর একটু পরেই শুরু হয়ে যাবে আশেপাশের বাড়িগুলি থেকে পরিণত অপরিণত কণ্ঠে সরগমের রেওয়াজ। বড় ভালো লাগে হিমানীর। মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার দিনগুলি। সন্ধ্যেবেলা খেলার মাঠ থেকে ফিরেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসাতো মা, শিবানী আর ও, ওরা দুই বোন গলা খুলে গাইত গান। দুই বোনেরই অসামান্য গানের গলা। পাড়ার ক্লাবে, স্কুলে সমস্ত অনুষ্ঠানে ওরা দুজনে মাটিয়ে রাখতো ওদের কোকিলের কলতানে।

" বৌদি এসো। তোমায় রেডি করে দিই। দাদা আবার নইলে আমায় বকবে দেরি হলে।"

হিমানী কিছু বলে না, ঠায় তাকিয়ে থাকে জানলার বাইরে। পশ্চিমের আকাশ এখন হাল্কা বেগুনী, সার দিয়ে একে একে সব পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের বাসায়। আজকের মতো সমস্ত সংগ্রাম শেষ, আবার কাল ঊষার নতুন আলোয় শুরু হবে দিনযাপনের যুদ্ধ।

" কী গো? এসো? কোন শাড়িটা পড়বে, বলো।"
রমার কথায় সম্বিৎ ফেরে হিমানীর। আস্তে আস্তে বিছানায় বসে আলমারিতে রাখা শাড়িগুলোর দিকে তাকায়। কত দামী দামী পোশাক, এক কালে রজতের সাথে পার্টিগুলোতে যেত যখন সেজেগুজে, এক্কেবারে রাজরানী লাগত। কত বছর পর আবার আজ একটা পার্টি হতে চলেছে বাড়িতে। চায়নি ও একদম, কিন্তু রজতকে বলতে পারল কই? বিয়ের পঁচিশ বছর উদযাপন করবে বলে নাছোড়বান্দা সে।

 বাঁ হাত দিয়ে পছন্দের হলুদ বেনারসিটা দেখায় রমাকে।
" ওই হলদে শাড়িটা? ঠিক তো? "
মাথা নাড়ে হিমানী।

রমা ওকে সাজাতে সাজাতে করে চলে রাজ্যের গল্প, টিভি সিরিয়াল থেকে শুরু করে হাউজিং কমপ্লেক্সের খুঁটিনাটি। গত দশ বছর ধরে ও আছে হিমানীর দেখাশোনা করার জন্য। একেবারে ছায়ার মত থেকে আগলে আগলে রাখে ওকে। যখন প্রথম আসে এ বাড়িতে নার্সের কাজ নিয়ে, তখন দেখত সারাদিন পুরনো ফটো এলবাম হাতে নিয়ে হিমানী পড়ে পড়ে কাঁদত, দুই চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে নেমে আসত অঝোর অশ্রুধারা। কিন্তু একটা শব্দ বের হত না। অমন লক্ষ্মীপ্রতিমার ন্যায় চেহারার মানুষটাকে কান্নাকাটি করতে দেখতে কোমলহৃদয়ের রমা ভেঙ্গে পড়ত।

এখন আর বৃষ্টি পড়েনা, চারিদিক শান্ত, স্তব্ধ। গাড়ির ভয়াবহ এক্সিডেন্ট আর তাতে  ছেলের অকালমৃত্যু নির্বাক করে দেয় হিমানীকে। বহু চেষ্টা করেও আর বাণী ফেরাতে পারেনি ওর কণ্ঠে কেউ। রজত নিজের অফিস, ব্যবসা সব মিলিয়ে অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে। বহির্বিশ্বের সাথে নিত্য কেজো সম্পর্কের ফলে আর সূক্ষ্ম অনুভূতি, দুঃখ কষ্টরা বুঝি কবেই বিদায় নিয়েছে, বুকের মাঝে একটা বিশাল ফাঁক সেও অনুভব করে, তবে হিমানীর মত না।

" কী সুন্দর লাগছে তোমায় দেখতে গো বৌদি। আহা, ঠিক যেন মা লক্ষ্মী। " রমার কথায় ম্লান হাসে ও।

" কই গো, এসো। লোকজন যে আসা শুরু করে দিয়েছে। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার। চলো। "
রজতের এগিয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে হিমানী বেরোয় নিজের ঘর থেকে। আজ এতগুলো বছর পরে ও বাড়ির ছাদে এলো। সেই ছাদ, যেখান থেকে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত ওর প্রিয় শহরটিকে। ধোঁয়ায় ঢাকা রাতের আকাশে তারারা গরহাজির। কিন্তু ফেয়ারি লাইটস দিয়েছে কৃত্রিম সৌন্দর্য।  ম্যুজিক সিস্টেমে লো ভল্যুমে চলছে কিশোর রফি লতার রেট্রো। রঙিন পানীয় আর হরেকরকম সুখাদ্যের গন্ধে সন্ধ্যে জমজমাট।

আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সাথে সৌজন্যের হাসি হেসে কেটে গেল সারা সন্ধ্যেটা। রাত্রে রমার ছুটি করে দিয়ে রজত হিমানীকে নিয়ে গেলো নিজেদের বেডরুমে। ঘর অন্ধকার।
" দাঁড়াও, এক মিনিট। " এই বলে রজত চট করে একটা কাপড়ের ফালি এনে হিমানীর চোখ বেঁধে আস্তে আস্তে ঘে ঢুকল ওর হাত ধরে। হিমানী টের পেল ঘরের আলো জ্বলে উঠেছে। রজত ওর চোখ থেকে ফিতে খুলতেই,
" সারপ্রাইজ! দেখো তো? পছন্দ হল তো? "
ওর সামনে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো, ঠিক যেমনটা পঁচিশ বছর আগে হানিমুনে ইংরেজ আমলের চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে দেখে দুই চোখ চিকচিক করে উঠেছিল হিমানীর।

আজ আবার হিমানীর দুই চোখ ছলছল করছে। এত বছরে, এত ঝড়ঝাপটাতেও রজত ভোলেনি ওর এই ইচ্ছাটিকে। খুব সন্তর্পণে ও এসে বসল পিয়ানোতে। বাংলোতে বাজানো গানটাই আবার বাজিয়ে গাইল ও আজ, নাই বা শুনতে পাক ওর গলার স্বর আজ কেউ। হিমানীর আঙুলের ছোঁয়ায় তখন পিয়ানো থেকে যে সুরঝঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে, রজত যেন তাতেই ডুবে যাচ্ছে, আরো প্রেমে, আরো প্রেমে।






Monday, November 20, 2017

ব্যাকস্পেসঃ একটি কাল্পনিক কথোপকথন

ইভেন্টের সাথে সামঞ্জস্য আছে কি না, বুঝছিনা। থিম, যেটা নিয়ে লিখছি আর কি, সেটাও কিছুই নতুন না। এই ব্যাকস্পেসের আড়ালে জমে থাকে অনেক অনেক অজানা গল্প। অনেক কিছুই আমরা ভাবি, এমনটা হলে বা এমনটা বলতে পারলে, কী ভালোই না হতো। কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে মনে হয় রিওয়াইন্ড বাটনটা প্রেস করতে পারলে, অনেক কিছু অন্যরকম ভাবে করা যেত। তেমনই এক কাল্পনিক কথোপকথন তুলে ধরলাম। আপনি আমি সক্কলে কোন না কোন দিন এমন অবস্থায় পড়েছি বা পড়ব যেখানে " কেমন আছিস" এর উত্তরে লম্বা করে নিজের দুঃখের কথা লেখার চেয়ে এক বুক অভিমান নিয়ে "হ্যাঁ, ভালো" বলাটা অনেক বেশী সহজ। নীচের লেখাটিও কিছুটা ওই ধাঁচেরই।


ডিসক্লেমারঃ ইভেন্টের নামের সাথেই ম্যাচ করিয়ে, "সব চরিত্র কাল্পনিক। Any resemblance to any person living or dead is purely coincidental."


এক "ভালো" মেয়ের কথা



- ওই, আমার ওপর রাগ হয়েছে নাকি? কদিন এক্কেবারে কথা বলছিস না যে?

- না না, তোর ওপর রাগ হবে কেন? আমি কে? কী রাইট আছে আমার বল তোর ওপর রাগ করার? তুই কি না এখন সেলিব্রিটি, তোর নামে গোটা মিডল স্কুল ফ্ল্যাট, ফ্যান ক্লাব হয়ে গেলো তোর। সেখানে আমি কে না কে কোন হরিদাস পাল যে তোর ওপর রাগ করব? স্বরলিপিতে যখন তোর এগেন্সটে বিলুরা এত নোংরামি করল, তখন না হয় আমি একটু তোকে সাপোর্ট দিয়েছি। তা দেবো না কেন, তুই কি না আমার এত্ত ভালো বন্ধু। তার মানে তো এই না যে তোর ওপর আমার রাগ করার অধিকার হবে, তাই না? স্বরলিপি ছেড়ে বৈতালিকে এলি, শুরুতে তোকে ব্যান্ডে চান্সই দিলো না। তাতে কী? আমরা একসাথে তারপরে গান গাইলাম, সেই সুবাদে তুই আবার সোলো গাইলি। তখন এত্ত লোকে তোর ওই গান শুনে ফ্ল্যাট হয়ে গেলো। তারপর স্কুল ফেস্টে তোর ওই পারফরমেন্সটা রে, যার জন্য আমি এত গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে পাবলিসিটি করলাম, ওটায় যে অসামান্য সাড়া পেলি, ওই চিয়ারিং করা তো আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল, তাই না? আমি কি না তোর সেই কবেকার বন্ধু, বন্ধুর জন্য এইটুকু করতে পারিনা? করবোই তো, আমি না ভালো মেয়ে? বাবা, এখন তুই কত বড় মাপের সিঙ্গার সংরাইটার বল,কীসব আবার শুকনো খেজুরগুড় হাম্বা গাম্বা লেভেলের গান লিখিস, আমার এইটুকু মাথায় ঢোকেই না। মাঝে মাঝে তো দেখি আবার অনু মলিকের মত ওইসব আরবি পার্সি সব গানের সুর থেকেও অনুপ্রেরণা পাস। সেদিনের তোর ওই গানটারে, ওই যে রে, ল্যাভেন্ডার নিয়ে যে গানটা সেদিন রিলিজ করলি, তার সুরটা তো ভীষণভাবে আমার এক চাইনিজ পিয়ানিস্টের একটা পিসের কথা মনে করাল। তারপরে দেখলাম তোর ভিডিওতে ভর্তি ভর্তি লাইক আর লাভ, কমেন্ট আর শেয়ার। কে জানে, এতজন যখন প্রশংসা করল, এত স্তাবক, সকলে কত বুদ্ধিমান, নিশ্চয়ই খুব মৌলিক হয়েছিল। আমার নেহাত কাঁচা মাথা। এসব বুঝিনি তাই, এপ্রিশিয়েট করতেই পারিনি উল্টে ভাবলাম কিনা তুই টুকলি করেছিস। যাই হোক, সরি রে। না না। এরকম ভাবা আমার ভুল হয়েছে। তোর ওপর রাগ করাটাও ভুল হয়ে গিয়েছিল। এক্সট্রিমলি সরি রে। প্লীজ তোর ফ্যানক্লাবে আমায় স্থান দে, অন্তত পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে? ইয়ে দোস্তি হাম কভি না তোড়েঙ্গে। প্লীজ প্লীজ? জানি খুব ট্যালামার্কা শোনাচ্ছি, কিন্তু কি করব, আমি যে এরকমই, প্যালা হাঁদা গঙ্গারাম। তোর মত চৌকশ থোড়িই। আর রাগ করব না। এবার থেকে সারাক্ষণ তোর স্তুতি গাইবো, তোর ভালোটুকুই দেখবো। পদে পদে আমায় যখন অবহেলা করিস, সেগুলো দেখেও না দেখার ভান করব। আমি কি না ভালো ভদ্র মেয়ে। আমার কি আর ঝগড়া আসে বল?



(অনেকগুলো ব্যাকস্পেস টেপার শব্দ)

- ধুর, না রে। একটু ব্যস্ত ছিলাম রে। অনেকগুলো পেন্ডিং এসাইনমেন্ট ছিল, ওই নিয়ে...

- তাই বল। ইয়ুটিউবে একটা নতুন গান পোস্ট করেছি এবার। শুনে বলিস কেমন লাগল। আর একটু প্রোমোট করে দিস, পিপলস চয়েসের প্রাইজটা টার্গেট করেছি।

- হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ভালো তো হবেই, তুই করেছিস কি না!

- হুম। প্রোমোট করতে ভুলিস না।
- চল বাই।
- বাই।







Tuesday, November 14, 2017

স্নেহ

- হ্যালো?
- মিতু কী করছিস বাবু?
- সকাল সকাল কী করব বলো? এই তো ক্যাম্পে বসে আছি।
- এখনো কোন পেশেন্ট আসেনি?
- এসছে তো, ওই তিন চার জন।
- কতক্ষণ চলবে?
- বিকেল পাঁচটা অবধি।
- সবে এগারোটা বাজে। বলছি ব্রেকফাস্ট করেছিস?
- না, সময় হয়নি।
- সে কী? কতবার বলব ব্রেকফাস্ট স্কিপ করবি না?
- উফ মা, সময় পাইনি বলছি তো।
- সময় পাইনিটা কোন কথা হল? শরীর খারাপ হয় জানিস?
- মা পাঁচ বছর ধরে কষ্ট করে ডাক্তারিটা না আমি পাস করেছি মা, তুমি না। তাই প্লীজ আমার ব্যাপারটা আমায় বুঝতে দাও।
- ধুর বাবা, ভালো লাগেনা। তোকে কিছু বলতে গেলেই এমনভাবে রিএক্ট করিস আমার ভীষণ খারাপ লাগে।
- বলতে আসোই বা কেনো বলো তো? কাজের সময় ফোন করে জ্ঞান দিতে এলে আমি কিভাবে উত্তর দেবো?
- ছাড়। আমি রাখছি।
- হ্যাঁ রাখো।


মনটা তেতো হয়ে গেলো মিতু, অর্থাৎ ডঃ মিতালি দাসশর্মার। একেই কাল রাত্তির থেকে  হবু বর সুপ্রিয়র সাথে এক প্রস্থ ঝগড়া চলছে। মিতু ওর ফাইনাল ইয়ার থেকে একটি এন জি ওর সাথে যুক্ত। দুই মাস অন্তর অন্তর ও তাদের সাথে আসে সাঁওতাল পরগণার এই ছোট গ্রামে। স্থানীয় মানুষজনের চিকিৎসার জন্য।  বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় থেকেই সুপ্রিয় জানে এই ব্যাপারটা, শুরুতে এই নিয়ে কোনরকম মনোমালিন্য হয়নি। কিন্তু ইদানীং মিতু দেখছে, বিয়ে যত এগিয় আসছে, সুপ্রিয়র যেন দুই চোখের বিষ হয়ে উঠছে মিতুর এই ক্যাম্প। কাল রাত্রে অনেকক্ষণ কথা কাটাকাটির পর দুজনেই পরেরদিন কাজ আছে এই অজুহাতে ঝগড়া স্থগিত রেখেছে, তাই মুড অফ। এর মধ্যে মায়ের ফোন আসায় বেচারির উপর চোটপাট করে দিল। কিই বা করে মিতু, এই নিয়ে সকাল থেকে দুবার ফোন, পাঁচবার মেসেজ হয়ে গিয়েছে মায়ের সাথে, তারপরেও বার বার ফোন এলে বিরক্ত হবে না? এক কথা শুনতে ভালো লাগে? ও নিজেও জানে, ব্রেকফাস্ট মিস করা খারাপ। কিন্তু মুড ভালো নেই। ইচ্ছে করছেনা। জোর করে খাবে নাকি? মা যেন কিচ্ছু বুঝতে চায় না। ধুর, পেশেন্টও আসছেনা কোন।
নিজের মেকশিফট চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাইরেটা দেখল মিতু। আশেপাশে তেমন লোকজন নেই ক্যাম্পের ওরা কয়েকজন ছাড়া। রাঙ্গারও দেখা নেই।

প্রতিবার ও যখন ক্যাম্পে আসে, রাঙ্গা আর ওর ছেলে বিশু এসে ওর সাথে দেখা করে যায়। পুলের পাশেই ওদের ঘর। গত বর্ষায় কোন বিষাক্ত পোকার কামড় খেয়ে বিশুর অবস্থা যায় যায় প্রায়। রাঙ্গা কাঁদতে কাঁদতে প্রায় হাতে পায়ে ধরে ক্যাম্প থেকে মিতুকে নিয়ে যায় ওদের ঘরে। প্রাথমিক চিকিৎসা করে তারপর এম্ব্যুলেন্স করে সদর হাসপাতালে গিয়ে বিশুর চিকিৎসা চলে দুদিন। পুরোপুরি যতক্ষণ ও সুস্থ না হয়, মিতু ওখানেই ছিল। তারপর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বিশুকে আর রাঙ্গাকে ওদের ঘরে পৌঁছে ওর ছুটি হয়েছিল। সেই থেকে রাঙ্গা আর বিশু প্রতিবার এসে ওদের ডাক্তার দিদির সাথে দেখা করে যায় ক্যাম্প বসলেই। বড় ভালো লাগে এই গ্রামের মানুষগুলোকে মিতুর, কী সরল, কী ভালো। শহুরে আধুনিকতা যতদিন না ওদের ছুঁতে পারে, ততদিনই ওদের মঙ্গল। নইলে তো সেই সব একেকটা স্বার্থপর জীব হবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই মিতু দেখল দূরে হলুদ শাড়ী পরে রাঙ্গা। সাথে হাত ধরে দৌড়তে দৌড়তে আসছে বিশু।
- ও দিদি, কেমন আছো?
- ভালো রাঙ্গা। তুমি?  এই বিশু কেমন আছিস?
- ভালো পিসি।
- তোমাদের আজ দেরি হল? আমি ভাবছিলাম এখনো আসলে না কেন?
- আজ বিশুর ইস্কুলে ডেকেছিল। ওখান হতে এলাম।
- কেন রে বিশু? লেখাপড়া করছিস না নাকি?
- না পিসি। আমি ফার্স্ট হয়েছি ক্লাসে। তাই মা কে ডেকে বলল।
- বাহ! খুব ভালো। দাঁড়া, তোকে কী দিই?
- কিচ্ছু দিয়োনি দিদি। ছেলেটা খুব বদমাশ হচ্ছে।
- কেন রাঙ্গা?
- কোন কথা শোনেনা। সকাল থেকে জানো খায়নি কিচ্ছু। না খেয়ে ইস্কুলে পালায়, খেলবে বলে। তুমি ওকে একটু বকে দাও না দিদি।

মনে পড়ে গেল মায়ের কথা। মায়েদের চিন্তা বোধহয় স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে এক থাকে। সাঁওতাল পল্লীর অশিক্ষিত রাঙ্গা হোক কী দক্ষিণ কলকাতার নামী কলেজের প্রিন্সিপাল মলয়া, নিজের সন্তানের সুস্বাস্থ্য ছাড়া মায়েদের জীবনে বোধহয় আর কিচ্ছু বড় না। হঠাৎই তাই সকাল বেলা মায়ের ওপর চোটপাট করার জন্য একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল মিতুর। চেম্বার থেকে নিজের হাতব্যাগটা এনে, সেখান থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে বিশুকে দিতে দিতে বলল, " এই বিশু পাগল, আমি যেন পরেরবার এসে মায়ের কাছে তোর নামে কোন নালিশ না শুনি। ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া করবি। মা কে জ্বালাতন করলেই শহরে নিয়ে যাব। বুঝবি ঠ্যালা তখন! "

শহরের নামেই বিশুর গায়ে জ্বর আসে, আর তাই এইবারে যে মোক্ষম ডোজটা পড়েছে, বুঝল মিতু। " যা বাড়ি গিয়ে স্নান করে শিগগিরি খা কিছু। রাঙ্গা নিয়ে যাও ওকে। ভালো থেকো। "
" দিদি তুমিও ভালো থেকো। আবার এসো।"

মিতুর চোখের সামনে দিয়ে মায়ের হাতে বিস্কুটের প্যাকেটটা দিয়ে, মুখে একটা পুরে, তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে চলল আট বছরের বিশু, এক হাতে মায়ের হাত শক্ত করে জাপ্টে ধরে; এর চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় আর তো দুটো হয় না। এই বোধও হয়তো দেশ কাল সবকিছুর বাধা ছাড়িয়ে যায় এসে যায় মানব মনে। চোখের কোণের জল রুমালে মুছে মিতু চলল ফোন বের করতে। মা কে একটা সরি বলতেই হবে, এখুনি।

Thursday, November 9, 2017

সোনার ছেলে

মাদ্রাস নিয়ে লিখছি, সেখানে বলব যাদের কথা, তাদেরই একজনের কথা আজ বলি আলাদা করে। ওর জীবনটা হয়তো অনেকের সাথেই মিলে যাবে, আবার নাও মিলতে পারে, কিন্তু আমি যতজনকে চিনেছি আজ অবধি, এইরকম অধ্যাবসায় বোধহয় কারুর দেখিনি।
সকাল থেকে রাত অবধি সাঙ্ঘাতিকভাবে লেখাপড়ার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। অনেক সময় রাতের পর রাত জেগেও কাজ করে। শরীর খারাপ হয়ে যাবে, একটু বিরতি নে বললেও কথা শোনেনা; কারুর সাথে নিজের রিসার্চের কাজের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে দুই চোখ চকচক করে ওঠে।  কোন কিছু করবে ভাবলে এক অদম্য জেদের সাথে শেষ দেখেই ছাড়ে। আমরা যখন ওকে বলি যে এত অমানুষিক পরিশ্রম করছিস কেন, তার উত্তর পাই, আমাকে অনেকটা বড় হতে হবে। জীবনে দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। তোমরা বুঝবে না।
সত্যিই তাই। ওর জীবনের স্ট্রাগলের কথা যতদিন জানিনি, ততদিন ভাবতে পারতাম না, ওর এত খাটুনির পিছনের আসল উদ্দেশ্যটা কী। আসলে যখন ছোট থেকে বড় হয়েছে ও, দুই চোখে ছিল এক স্বপ্ন, সে স্বপ্ন একদিন অনেক বড় হবে, দূর হবে জীবনের বাধা।
মেদিনীপুর শহরের এক বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের ছেলে ও। বড় হয়েছে দারিদ্র্য ও অভাবের মধ্যে। তবে কখনোই তা মুছে ফেলতে পারেনি ওর দুই চোখের এই স্বপ্নকে। বরং প্রতি মুহূর্তে ওকে এই অভাব অনটনের সংসার মনে করিয়ে দিতো যে আর পাঁচটা ছেলে মেয়ের থেকে ওকে যে অনেক বেশী খাটতে হবে। স্কুলে পড়াকালীন আই আই টি জয়েন্টের কথা জানত না, তাই স্টেট জয়েন্ট ছাড়া অন্য কোন পরীক্ষায় বসেনি। এবং সেখানেও অসম্ভব ভালো র‍্যাঙ্ক করে যাদবপুরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙে চান্স পায়। অর্থনৈতিক সচ্ছ্বলতা না থাকায় ট্যুশন করে নিজের খরচ চালাত। বছর দেড়েক চাকরি করে টাকা জমিয়ে এখন ও আই আই টিতে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিঙে রিসার্চ করছে। ও আমাদের সকলের গর্ব।  যেখানেই যায় নিজের কাজ প্রেসেন্ট করতে, প্রথম স্থান পেয়ে আসে। ও আমাদের সোনার ছেলে। সমস্ত ফ্যাকাল্টিদের, সিনিয়রদের আর জুনিয়রদের ও প্রিয়পাত্র।
আমার খুব গর্ব হয় ওকে চিনি বলে। ওর থেকে প্রতি মুহূর্তে শিখি যে অদম্য ইচ্ছা আর সাহস থাকলে, কঠিন অধ্যাবসায়ের মারফত কীভাবে মানুষ তার স্বপ্ন সফল করতে পারে। যেভাবে ওর কেরিয়ার এখনও অবধি চলছে, আমি হলফ করে বলতে পারি, অদূর ভবিষ্যতে ও একাডেমিক ফিল্ডে খুব নাম করবে।

শুধু লেখাপড়াতেই ওর গুণ সীমিত না। ভীষণ ভাবে ভালো মনের একটা মানুষ, কোনরকম বিপদে আপদে এগিয়ে যায়। যথাসাধ্য সাহায্যও করে। এছাড়া বড় ভালো ছবি আঁকে, গান গায়, লেখালিখি করে। গিটার বাজায়। এই প্রসঙ্গে বলি, ওকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে চিনি। গিটার বাজাতো আমি গান গাইলে, তখন ওকে গানের কর্ড দিয়ে দিতে হতো। কিন্তু এই কবছরে নিজের চেষ্টায় গিটারটাকে ভালোমতোই রপ্ত করে ফেলেছে, নিজে নিজে সুর বানায়, বাজায়।

গর্ব হয় প্রতি মুহূর্তে আমার ওর জন্য। ও আমার সবচেয়ে প্রিয় ভাই, চন্দন বোস। 


Thursday, November 2, 2017

নাম তো সুনা হোগা

পুজোর ছুটির পর স্কুল খুলেছে আজ প্রায় এক মাস পরে। এইট বির ক্লাসরুমে আজ এক নতুন মুখ। লাস্ট বেঞ্চের একটা কোণে চুপ করে বসে আছে ছেলেটা। মিষ্টি দেখতে, চোখে চশমা না থাকলে অনেকটা রাহুলের মতো দেখতে। আরে রাহুল, কুচ কুচ হোতা হ্যায়? সেই রাহুল।  ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাস টিচার মহুয়া মিস রোল কলের সময় ছেলেটির সাথে সারা ক্লাসের পরিচয় করিয়েছিলেন বটে, কিন্তু রূপসা তখন চকপিস আনতে অফিসে গিয়েছিল, তাই নামটা জানা হয়নি। রূপসার তো কী বিশাল ক্রাশ এস আর কের উপর। প্রথম তিন পিরিয়ড ধরে ক্লাস চলাকালীন তাই বারবার চোখ গেছে ছেলেটির দিকে। বেশ একটা অগোছালো ভাব চেহারার মধ্যে, শার্টের কলারটা একদিকে উঠে আছে, টাইটাও ল্যুজ। নেহাত হেডস্যার এখনো এইদিকে আসেননি, নইলে ঠিক প্রথমদিনেই ছেলেটা পানিশমেন্ট পেত। রূপসা ঠিক করল, টিফিন ব্রেকের সময় একবার গিয়ে আলাপ করবে আর তখন ওকে স্কুলের আদবকায়দা নিয়ে বলবে। এই সবে সরখেল স্যার ম্যাথস ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। টাইম এন্ড ডিস্টেন্সের কিছু বাঁশ বাঁশ অঙ্ক করতে করতে আজ সারা ক্লাস বিদ্ধ্বস্ত, সবাই প্রায় যে যার মত চুপচাপ টিফিন বক্স বের করছে। নতুন ছেলেটি ছাড়া আর কেউই তেমন সপ্রতিভ নেই আর। ছেলেটিই বরং প্রত্যেকটা অঙ্ক স্যারের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে করে যাচ্ছিল। রূপসা ভাবল, এই সুযোগ। অঙ্ক বোঝাও হবে, সাথে সাথে আলাপটাও ঝালিয়ে আসবে। নইলে ওর মতো গুডি গুডি মেয়ে হঠাৎ যেচে যেচে নতুন ছেলের সাথে আলাপ করতে যাচ্ছে, ইমেজের সাথে যায়না। বন্ধুরাও আওয়াজ দেবে।
"হাই, আমি রূপসা। লাস্ট যে অঙ্কটা স্যার আদ্ধেক হিন্টস দিয়ে চলে গেলেন না, ডু ইয়ু মাইন্ড এক্সপ্লেইনিং ইট টু মি?"
" শিয়োর! এই দেখো, এইখানে রিলেটিভ ভেলোসিটি ধর এক্স, প্ল্যাটফর্মের লেন্থ তো বলেই দিয়েছে ... "

মিনিট দশেক ধরে অঙ্কটা ভালো করে বুঝেটুঝে বহুবার থ্যাঙ্ক ইউ বলে রূপসা এবার নিজের ডেস্কের দিকে যেতে গেলো। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে এত কাণ্ডের মধ্যে, ওর নামটাই তো জানা হয়নি।
" হ্যাঁরে। তোর নাম কী রে? সেটাই তো জানলাম না। "
উত্তর এলো, " রাহুল, নাম তো সুনা হোগা! "
ঠোঁটের কোণের এক কুচি হাসিটা...

Monday, October 30, 2017

আজি দখিন দুয়ার খোলা ৪ঃ জীবন যেমন চলছে চলুক

আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, ছোট থেকেই বন্ধুবান্ধবদের মুখে তাদের ভাই বোন দাদা দিদিদের কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হত,আমার নিজের একখানা দাদা/দিদি/ভাই/বোন থাকলে তো বেশ হয়। তারপরে আই আই টিতে এসে যখন দেখলাম এই সিব্লিং পাতানোর স্যাম্পল সাইজটা বেশ বেশ ভালো এবং বড়, আমি আর বেশী দেরি করিনি। বোনের সংখ্যা একটু কম (সবচেয়ে বেশী যাদের নাম বলব, ভাস্বতী আর অনিন্দিতা। অমৃতার কথা আগের পর্বেই বলেছি।  এছাড়া সায়ন্তীর কথা না বললেই না। মেয়েটা আমায় এত ভালোবাসে, এত যত্ন করে আমার, খুব খেয়াল রাখে। গত শীতে আমি সাইকেল থেকে উল্টে চিতপটাং যখন, ও ছিল সাক্ষাৎ আমার সান্টা ক্লজ।), দাদা দিদি প্রায় নেইই বলা চলে (এর কারণ হল আমি নিজেই তো প্রায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ, এখানে আমার চেয়ে বয়সে বড় খুব বেশী লোকজন নেই, থাকলেও চেনা না।) । তবে ভাইয়ের সংখ্যা এত বেশীমাত্রায় অধিক যে আমার চারপাশে মাঝেমধ্যেই "দিদি দিদি" বলে হাঁকপাঁক শোনা যায়। এবং সেই ডাক এতটাই জোরে হয় যে দুই হাজার কিমি দূরে বসেও মানুষ কাজ করতে করতে একবার ভেবে ফেলেন, নিশি ডাকল নাকি।
ক্যাম্পাসে আমাদের একটি বাঙালি এসোসিয়েশন আছে, নাম দিগন্ত। দিগন্ততে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গিয়েই মূলত এদের সাথে আলাপ। অয়ন, চন্দন, ঋতেন্দু, শরণ্য এরা হচ্ছে যাকে বলে একদম প্রাণাধিক প্রিয়। এদের সাথে উঠতে বসতে যেমন ঝগড়া হয়, তেমনি এরা না থাকলে মনে হয় কিছু একটা মিসিং। আমার যত দাবী ওদেরই কাছে আর ওদেরও যত আবদার আমার কাছে। যেমন তেড়ে ঝগড়া করি, তেমনি আবার চোখ বন্ধ করে ভরসা করে মন খারাপ হলেই দুঃখর ঝাঁপি ওদের কাছেই পেশ করি। এছাড়া আরো আছে কয়েকজন, যেমন সৌরভ, নীলাঞ্জন, দেবজ্যোতি। একসাথে এদের অনেকের সাথেই  খুচখাচ বেড়াতে টেরাতে (ইয়েলাগিরি, কোল্লি হিলস, পন্ডিচেরি, মহাবলিপুরম) গিয়েওছি। ওদের সাথে এই হৃদ্যতা বাড়ে আরো বেশী করে বন্যার সময়ে।
২০১৫ সালে ডিসেম্বর মাস নাগাদ আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরে  ভারী বৃষ্টি হয়ে রাস্তাঘাট জলমগ্ন, সাবস্টেশন জলে ডুবে বলে কম্পালসরি পাওয়ার কাট। বাহাত্তর ঘণ্টা আমরা বিনা বিদ্যুতে ছিলাম। আই আই টিতে হোস্টেলগুলির নাম সব নদীর নামে। যেমন কৃষ্ণা, কাবেরি, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, তুঙ্গ-ভদ্রা, সরযূ, সবরমতি, অলকানন্দা, যমুনা, গঙ্গা (কখনো কোন দরকারে গঙ্গা জল লাগবে শুনলে প্রথম যে পিজেটা মাথায় আসে, গঙ্গা হোস্টেলের কলের জল আনলেই হয়!!) ইত্যাদি।  আমার হোস্টেল সবরমতি। পরিচিতা থাকত অন্য হোস্টেলে, সরযূতে। যেহেতু আমরা বাকি মেয়েরা থাকতাম সবরমতিতে, ও তাই আমাদের এখানে চলে এসেছিল। বাইরে যখন হোস্টেলগুলি নিজেদের নামের মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যস্ত  (ভালোমতো স্রোতস্বিনী নদী বইত) , তখন আমরা হস্টেলের ভিতরে ব্যস্ত রাজ্যের গল্প নিয়ে। পি এন পি সি থেকে শুরু করে গভীর জীবনদর্শন কিচ্ছুটি বাদ যায়নি। কারেন্ট নেই, রাস্তাঘাটে জল থইথই, ওই অবস্থায় তো আর ল্যাবে যাওয়া যায়না। কাজেই হঠাৎ পাওয়া ছুটি। সকাল হতে হতেই আমরা কোনোমতে মেসে ব্রেকফাস্ট করে বেরোতাম এডমিন বিল্ডিং। সারা ক্যাম্পাসে তখন শুধুই ওখানে এমারজেন্সি পাওয়ার থাকত, উদ্দেশ্য ফোনটা একটু চার্জ দেওয়া। এবং কষ্টেসৃষ্টে যদি একটু ফোনের টাওয়ার পাওয়া যায়, তাহলে বাড়িতে কথা বলা। মোবাইলে সিগন্যাল পাওয়া ভারী দুষ্কর ছিল, ল্যান্ডফোন ওই কটাদিন দারুণ সার্ভিস দিয়েছিল। সারা বছর হোস্টেলের ল্যান্ডলাইনে কোন রিং শোনা যায়না, আর ওই কদিন একের পর এক শুধু ফোন এসে যাচ্ছে। কখনো ৪৩২, কখনো ৪৪০। যেই ধরছে, যার জন্য ফোন তাকে ডেকে দিচ্ছে। ভাগ্যক্রমে আমার বি এস এন এল কানেকশন থেকে এস এম এস যাচ্ছিল, বাড়িতে ওইভাবেই যোগাযোগ রেখেছিলাম। অন্যান্যদিনে মেসে যেই উপমা দেখলে নাক সিটকে চলে যাই, বন্যার সময় ওই কটাদিন সেই খাবারই সোনামুখ করে খেতাম। প্রতিটা মিল খেতে যাওয়ার সময় ভাবতাম, কে জানে এরপরেরটা পাবো কি না। একেই তো বৃষ্টি থামার কোন সিন নেই, তার উপর দোকান বাজার বন্ধ, মেসেই বা কোথা থেকে খাবার আসবে। ওই ডাল ভাত আর আঁচার পেলেই তখন কী খুশী। পাওয়ার নেই, পাম্পে জল উঠবে না, তাই স্নান করা নিয়েও প্রায় রেস্ট্রিকশন, এর মধ্যেও দেখতাম কিছু লোকজন কোমরছাপানো লম্বা চুল শ্যাম্পু করছে, বালতি বালতি জামাকাপড় কাচছে, সত্যি বাবা, কত বিভিন্ন ধরণের মানুষ যে হতে পারে, হোস্টেল লাইফ না হলে বোঝা যায় না।
তো যাই হোক, যা বলছিলাম, আমি এত এক কথা বলতে অন্য কথায় চলে যাই, কি বলি। ক্ষমা করে দেবেন মাঝে মাঝে। হ্যাঁ, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একদিন হয়েছে কি, আমার ভারী চিন্তা শুরু হয়েছে, আমার ভাইগুলো সব ঠিক আছে তো? কোন খবর পাচ্ছিনা, ফোনে কথা হচ্ছেনা, হোস্টেলের নাম জানি, কিন্তু রুম নম্বর জানিনা, অগত্যা ওই চত্বরে ঘুরে ফিরে এলাম, বাই চান্স যদি দেখা পাই আর খবর পাই। কপাল খারাপ, কারুর সাথেই দেখা হলো না। পরেরদিন কিভাবে, এখন আর মনে নেই, যোগাযোগ হল। তারপর ঠিক হল, অমুক জায়গায় অমুক সময়ে সকলের জমায়েত হবে। আর হলও তাই। তারপর গান গল্প এই করেই কাটত সন্ধ্যেগুলো। অন্ধকার হয়ে এলে টর্চ হাতে করে ওরা আমাদের হোস্টেল অবধি পৌঁছে যেত, আমার ভাইগুলো খুব শিভাল্রাস কিন্তু! ইতিমধ্যে একদিন খুব হিড়িক পড়ল লোকের, দল বেঁধে সব ভাইজাগ ব্যাঙ্গালোর চলে যাবে, বড় বড় বাসে ক্যাম্পাস ভরে গেল, নাকি দুদিনের ওপর কারেন্ট নেই, আর রিস্ক নেওয়া যায়না। বাইরে অবস্থা খুব খারাপ। সকলের বাড়ি থেকে খবর আসছে, টিভিতে ভয়াবহ সব চিত্র দেখাচ্ছে, আমরা তো ক্যাম্পাসে অনেকটাই নিরাপদে ছিলাম। ওই কারেন্ট ছিল না আর জল ভেঙ্গে এদিক ওদিক করছিলাম আর মেসের (অমৃত) খাবার খাচ্ছিলাম। আমরা তাই ঘটনার ভয়াবহতা অতটা আন্দাজ করতে পারিনি, কিন্তু যখন একটা মাস এক্সোডাস শুরু হল, আমরা তখন যেন একটু হলেও চিন্তা করতে শুরু করলাম, উৎকণ্ঠা হতে লাগল। যে যার বন্ধুবান্ধবরা আছে ব্যাঙ্গালরে, খবর নেওয়া শুরু করলাম, একটু আশ্রয় পাওয়া যাবে কি না গেলে। বাড়ির থেকে অবশ্যই বারবার বলছিল যে ক্যাম্পাসের মত সেফ আর কোত্থাও না, যেয়ো না হ্যানাত্যানা। এদিকে আমাদের তখন হঠাৎ করেই যেন ভয় বেড়ে গিয়েছে, ক্যাম্পাস খালি হয়ে যাচ্ছে, ঘুটঘুট্টি অন্ধকার, এক বন্ধুর তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, সব মিলিয়ে সকলেই টেন্সড। এমনিতেই আমাদের ক্যাম্পাস যেহেতু জঙ্গলের মধ্যে, হাজার একটা পোকামাকড় আছে, বৃষ্টির জমা জলে যে কত সাপখোপ, বিছে ইত্যাদি থাকছে, ভাবলেইগা শিরশির করে উঠছে। এমন অবস্থায় এমারজেন্সি পাওয়ার দিয়ে হঠাৎ পুরো "Let there be light" বলে যেন আলো এলো, সেই আলো দেখে প্রচণ্ড কলরব শুরু হল। যে যার নিজের নিজের ঘরে তখন ছোটো, ফোনে চার্জ দাও, অথচ চার্জ দিয়ে বা কি হবে, টাওয়ার বাবাজীর দেখা আসতে আরো দিন দুইএক লেগেছিল। ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হল,তারপরে ইন্টারনেট আসতে খবরের মাধ্যমে দেখলাম, সত্যি, এমন সব ভিস্যুয়ালস, বাড়ির লোক ভয় পাবে না কেন!
এই বন্যার সময়েই চেন্নাই বেঙ্গলী ফেসবুক গ্রুপের অন্যতম মেম্বার, পুন্ডরিকদা একটা whatsapp গ্রুপ বানিয়েছিল, উদ্দেশ্য ছিল ম্যাক্সিমাম লোককে একসাথে রাখা, সকলের খবর যাতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকে তখন একে অপরকে যতটা পেরেছে সাহায্যও করেছে, কোথায় জল নেমেছে, কার বাড়িতে খুব জল, তাই অন্যের বাড়ি এসে থাকার আমন্ত্রণ, এটিএমে টাকা কোথায় আছে, আরও কত কিছু।
২০১৬ ডিসেম্বরে এলো সাইক্লোন Vardah, জনজীবনের সেইভাবে ক্ষতি করতে পারেনি খুব বেশী, আসলে বন্যার পর সকলেই মোটামুটি প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আমার সাধের ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। ঝড়ে এত গাছ পড়েছিল, জায়গায় জায়গায় ন্যাড়া দেখলে এখনো মন খারাপ হয়। নভেম্বর ডিসেম্বর আসলে North East Monsoon বা Retreating Monsoonএর সময়, তাই এই কটা মাস চেন্নাইবাসী বেশ তটস্থ থাকি আমরা। এই যেমন গত কয়েকদিন তুমুল বৃষ্টি হল, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চেন্নাই বেঙ্গলী ফেসবুক পেজ সক্রিয় হয়ে গেল। যে যেখান থেকে পারছে (মোটামুটি) জেনুইন তথ্য সরবরাহ করতে থাকে, মুহূর্তে মুহূর্তে। আমরা আসলে ঘরপোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই, আকাশ একটু কালো হতেই শুকনো খাবার স্টক করি, এখনো ফোন প্রায় সর্বক্ষণ চার্জে বসিয়ে রাখি।
এই চেন্নাই বেঙ্গলী (সিবি বলেই বেশী পরিচিত) গ্রুপ হল একটা অন্যতম ব্যাপার যার জন্য আমার চেন্নাইতে থাকাটা খুবই সুখকর হয়েছে এ যাবৎ। ২০১৩ সালে তেমনভাবে কাউকেই চিনতাম না, তাই আমি সেইবারে পুজোয় খুব মনমরা ছিলাম। রিম্পা অর্ক (ওদের কথা একেবারে শুরুতে বলেছিলাম, মনে আছে? বাবা রে, ওদের বিয়েটা হয়েছিল একদম বন্যার পরেপরে। ওরা কত এডভেঞ্চার করে চেন্নাই থেকে ব্যাঙ্গালোর হয়ে তারপরে হায়দ্রাবাদ থেকে ফ্লাইট পেয়ে কলকাতা গিয়েছিল বিয়ে করতে!!) সুজাতা অরিজিতা কস্তূরী এদের সাথে এঞ্জয় করলেও সেই কলকাতার ফিলটা আসেনি। তাই সেইবারে পণ করেছিলাম, দাঁতে দাঁত চিপে সারা বছর ছুটি না নিয়ে পুজোয় বাড়ি যাবো। তবে এবার ছুটি নিইনি পুজোয়, কিন্তু এই বছর এই চেন্নাই বেঙ্গলীর সূত্রে এত বন্ধু পেলাম, সকলে মিলে প্রচণ্ড আনন্দ করে পুজো কাটিয়েছি, মানে আমি নিজে ভাবতেই পারিনি যে পুজোটা চেন্নাইতে বসেও এত ভালো করে উপভোগ করা যায়। প্রায় ১৪-১৫টা পুজো হয়, অবশ্যই সব কটা বিশাল কিছু না। বড় বড়গুলোর মধ্যে ওই হাতে গোনা কয়েকটা, বেসন্ত নগরে একটা, টি নগর বেঙ্গল এসোসিয়েশনের একটা। এছাড়া নাভালুরেও হয়, তবে সেটা এত বেশী দূর বলে সুজয় দার (সুজয় দার সাথেও পরিচয় এই চেন্নাই বেঙ্গলী গ্রুপেরই সূত্রে, সজ্জন মানুষ, দাদাসুলভ ) বহু নিমন্ত্রণ সত্ত্বেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মনে আছে পুজোয় বাড়ি যাচ্ছিনা বলে যখন খুব মন খারাপ, তখন তৃণাদি আশ্বাস দিয়েছিল, সবাই মিলে দারুণ কাটবে,আর সত্যিই হলোও তাই! সুজয় দা, রূপম দা, তৃণা দি, বিভেন্দু দা, ধ্রুব দা, রজত, ঈপ্সিতা, কাকীমা (মানে তৃনাদির মা), প্রিয়াঙ্কা  সকলে মিলে খুব খুব আনন্দ করেছি। চারটে গাড়ি করে পুজো পরিক্রমা, প্যান্ডেলে আড্ডা, খাওয়া।
 পুজোর কিছুদিন আগে হয়েছিল সিবি গ্রুপের এন্যুয়াল ফাংশান, সাগরিকা। গত বছর দর্শক হলেও এবারে মূলত তৃণাদির উদ্যোগেই আমিও একটু আধটু অংশ নিলাম। রিহার্সালের দিনগুলো ভারী আনন্দে কাটত, সত্যি বলছি, সারাদিন সারা সপ্তাহ এই রিসার্চের চক্করে পড়ে এইসবই একটু নিঃশ্বাস ফেলার রসদ যোগায়। নতুন করে কত বন্ধু পেলাম, তৈরি হল স্মৃতি।
 এই তো, এই করেই চার চারটে বছর কাটিয়ে দিলাম এখানে। প্রথম এসেছিলাম যখন, শহরটা ছিল দুই চোখের বিষ। খালি কলকাতা ভালো, ব্যাঙ্গালোর ভালো এই করে যেতাম। এখন যেন মনে হয়, এ শহর আমার দ্বিতীয় বাড়ি, আমার ঠিকানা। বন্ধু বান্ধব হই হুল্লোড় ঘুরে বেড়ানো (প্রচুর জায়গা আছে এখান থেকে বেড়ানোর, অন্যতম হল শহরের মধ্যে কয়েকটা বিচ, যেমন বিশ্ববিখ্যাত মেরিনা বিচ; এছাড়া তো ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট মহাবলিপুরম, কাঞ্চীপুরম, পন্ডিচেরি,  টাডা ফলস, তিরুপতি, হরস্লে হিলস, ইয়ারকাড, ইয়েলাগিরি, কোল্লি হিলস; একটু দূরে গেলে ওইয়ানাড, মুন্নার, ব্যাঙ্গালোর, মাইসোর, উটি, কোদাইকানাল) সিনেমা দেখা (বাংলা সিনেমা পর্যন্ত চারটে এখানে স্ক্রিন হয়েছে, যার মধ্যে একটি, প্রাক্তন , আনানোর দলে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলাম এই আমি আর ইয়েতি অভিযান দেখেছিলাম গোটা হলে শুধুমাত্র দুইজন দর্শক আমরা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা বটে।), দুর্গা পুজো, ইলিশ (হ্যাঁ সিজনে সেটাও ভালো মতই পাওয়া যায়, দাম অবশ্যই বেশী, কিন্তু পাওয়া যায়) সব মিলিয়ে চেন্নাই সত্যি সত্যি হয়ে উঠেছে "নাম্মা চেন্নাই", অর্থাৎ, আমার চেন্নাই। এই শহরকে বন্যা সাইক্লোনের সময়ে দেখেছি কীভাবে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে বিপর্যয়ের মুখে, তেমনি প্রিয় আম্মার মৃত্যুতে কেঁদেও ভাসিয়েছে এই শহর, এই শহরের মধ্যে যেমন আছে বহু প্রাচীন মন্দিরের ঐতিহ্য, তেমনি রয়েছে ফিনিক্স মলের মতো আধুনিকতা, মার্সিডিজ বি এম ডাব্লিউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলে ঠ্যালাগাড়ি নিয়ে "তাতা" (দাদু) ফুল বিক্রি করতে করতে, সন্ধ্যে হলে মন্দির থেকে ভেসে আসে পবিত্র ধূপের গন্ধ, আবার অন্যদিকে সমুদ্রের মিষ্টি হাওয়া জুড়িয়ে দেয় প্রাণকে।

এই শহর দিয়েছে অনেক কিছু, নিয়েছেও কিছু, তবে পাওয়ার ঝুলিটাই কানায় কানায় ভরে আছে। আর তাই, গর্ব করে বলতে পারি, আমি এই শহরে থেকেছি, আমি চেন্নাইবাসী।