গ্রিনিচ ভিলেজ। শহরের এই অঞ্চলটা ওয়াশিংটন স্কোয়ারের খানিক পশ্চিমে অবস্থিত। পথঘাট বেশ আঁকা বাঁকা। এই স্থানটি চিত্রশিল্পীদের খুবই প্রিয়। এখানকার পরিবেশ, আলো বাতাস, সবই বেশ প্রশস্ত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে ঘরভাড়া নিতান্তই কম। তাই সবদিক দিয়েই, এই গ্রিনিচ ভিলেজ যেন চিত্রশিল্পীদের স্বর্গ।
সু আর জন্সি, দুই বান্ধবী, দুজনেই শিল্পী। গ্রিনিচে এমনই এক তিনতলা বাড়ির সবচেয়ে ওপরতলায় ওরা থাকে। ওদের বন্ধুত্ব অবশ্য এই গ্রিনিচে এসেই। এমনিতে একজনের বাড়ি মেইনে, অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী। বসন্তের এক মনোরম দিনে এইট্থ স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁয় ওদের দুজনের পরিচয়। আর অল্পক্ষণেই দুজনেই দেখলো দুজনের পছন্দ অপছন্দ অনেকাংশেই মিলে যাচ্ছে। আর তাই ওরা বিশেষ দেরি না করে একসাথে এই বাড়িটিতে থাকা স্থির করলো।
গ্রিনিচ ভিলেজে দিন কেটে যায় আপনমনে। গ্রীষ্ম বর্ষা চলে গিয়ে আসে শীত। সাথে আনে এক নতুন অতিথিকে, নাম তার "নিউমোনিয়া"। এই অতিথি সারা শহরে তার হিমশীতল আঙুলের স্পর্শে একে একে বহু মানুষকে করছে কুপোকাত। শহরের ডাক্তাররা মোটেই খুশি নন একে নিয়ে। যদিও শহরের পূর্বদিকে এর অবাধ গতি, তবু পশ্চিমে, গ্রিনিচের দিকে এই নব্য অতিথি একটু ধীর লয়েই ঘুরছে বটে। অবশ্য তা হলেও, এই অতিথিকে মোটেই সাধুপুরুষ বলা চলে না। বলবোই বা কী করে? কোন ভদ্র ভালো মানুষ কখনও কোন যুবতীকে ব্যতিব্যস্ত করে? এই যে, এই আমাদের অতিথি, তার জ্বালাতনে আমাদের ক্যালিফোর্নিয়া নিবাসী জন্সি ব্যতিব্যস্ত। সে ঠিক নিজের দুষ্ট ঠাণ্ডা আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়েই দিলো মেয়েটিকে। বেচারি জন্সি। বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারে না। পারে না চলতে। সারাদিন শুয়ে থাকে খাটে, জানলার ধারে। আর চেয়ে দেখতে থাকে জানলার বাইরে। এক মনে।
এরই মধ্যে একদিন, জন্সির চিকিৎসক, বেশ চিন্তান্বিত হয়েই সু'কে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা, তোমার বন্ধুর ব্যাপারটা কী বলো তো? ওর কি বাঁচবার এতটুকুও ইচ্ছে নেই?" সু কী উত্তর দেবে, ভেবে পায় না। অনেক কষ্টে বলে, "কেন ডাক্তারবাবু? কী হয়েছে? জন্সির কতদিনের শখ, ইতালি যাবে। সেখানে গিয়ে বে অফ নেপলসের ছবি আঁকবে।" ডাক্তার মাথা নেড়ে বলেন, "উঁহু। দেখো, যে রুগী নিজেই বাঁচতে চায় না, আমি হাজার চেষ্টা করলেও তাকে বাঁচাতে পারবো না। বাঁচবার জন্য ইচ্ছেশক্তি রোগীর নিজের ভিতর থেকে আসতে হবে। বুঝলে? আর সেইটা কিন্তু আমি তোমার বন্ধুর মধ্যে এতটুকুও পাচ্ছি না। খুবই চিন্তার বিষয়।" সু অবাক হয়। কী হলো জন্সির, এরকম আচরণ কেন? কীসের কষ্ট ওর? তবে কি এটা কোন হৃদয়ঘটিত ব্যাপার? কই, ও তো কিছু জানে না। না না, এ হতেই পারে না। ডাক্তার বলেন, "দেখো, জন্সির শরীর অত্যন্ত দুর্বল। আমি আমার দিক থেকে সব রকম চেষ্টা তো করছিই। করবোও। কিন্তু রুগী যদি নিজেই তার বাঁচবার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলে, তাহলে ডাক্তার হিসেবে আমার বিশেষ কিছু আর করার ক্ষমতা থাকে না। দেখো, ওর সাথে গল্প করো। কথা বলে দেখো, ওর কী সমস্যা। আগামীদিনের কথা বলো, নানান পরিকল্পনা করো। শোনো ও কী বলছে। ভবিষ্যতের কথা বললে যদি ও প্রাণশক্তি ফেরত পায়। দেখো।"
ডাক্তারের মুখে বান্ধবীর শরীরের এই অবস্থার কথা শুনে সু মনের দুঃখে ভেঙ্গে পড়ে। পাশের ঘরে বসে নিভৃতে খানিক চোখের জল ফেলে। তারপর মনে পড়ে যায় নিজের দায়িত্ব। নাহ, বন্ধুকে বাঁচাতেই হবে। ওকে ভালো রাখতেই হবে। তাই চোখ মুছে হাসিমুখে, প্রিয় গান গুনগুন করতে করতে রঙ তুলি ক্যানভাস নিয়ে পৌঁছে যায় জন্সির ঘরে। গিয়ে দেখে সেই একই পরিচিত দৃশ্য। জানলার দিকে পাশ ফিরে চুপ করে শুয়ে আছে জন্সি। রোগে জীর্ণ ক্লান্ত জন্সি। ও ঘুমোচ্ছে, পাছে ওর গানের শব্দে ওর ঘুমের ব্যাঘাত হয়, এই ভেবে সু গান থামিয়ে দেয়। তারপর আঁকা নিয়ে বসে।
কাজ করতে করতে সু'র কানে একটি মৃদু শব্দ আসতে থাকে। মিনমিনে রিনরিনে স্বরে যেন কোন কথা বলছে। ও আঁকা ফেলে উঠে যায় জন্সির খাটের পাশে। গিয়ে দেখে, বন্ধুটি জেগে শুয়ে আছে। আর আপন মনে বাইরে তাকিয়ে কী যেন গুনে চলেছে। এবং যে সংখ্যাগুলো বিরবির করছে, তার গুনতি উল্টো। বারো। খানিক থেমে আবারএগারো, দশ। মুহূর্তেই এরপর নয়, আট, সাত... শেষের সংখ্যাগুলো যেন হুড়মুড়িয়ে একের পর এক এসে গেলো।
সু অবাক হয়। জন্সি কী গুনছে? কীই বা আছে গোনার? কৌতূহলী সু জানলার বাইরে তাকায়। চোখে পড়ে পাশের বাড়ির ন্যাড়া দেওয়াল। সেই দেওয়ালের গা বেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লতানে গাছটিতেও শীতের স্পর্শ দৃশ্যমান। ইতিমধ্যেই শীতল হাওয়ায় পাতাঝরা শুরু হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালের সাথে তাল মিলিয়ে সেও যেন ন্যাড়া হওয়ার জন্যই পথ চেয়ে আছে, অপেক্ষায়।
"কী হলো জন্সি?" সু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
জন্সি দুর্বল কন্ঠে উত্তর দেয়, "ছয়... ওই দেখো সু, তিনদিন আগেও ওখানে শয়ে শয়ে ছিলো। তখন গুনতে গুনতে আমার মাথা ব্যথা করতো সু। আর এখন দেখো, সব শেষ। প্রায় সব শেষ। ওই, ওই। ওই যে। আরো একটা। পাঁচ। ওই দেখো। আরো তাড়াতাড়ি যেন কমে যাচ্ছে এখন।"
বন্ধুর এই হাহাকার কিছুই বোধগম্য হয়না সু'র। অবাক হয়েই প্রশ্ন করে, "কী গুনছ জন্সি? কী? পাঁচটা কী?"
কাঁপা কাঁপা স্বরে জন্সি বলে, "পাতা। ওই যে, সামনের গাছটা দেখছো, ওই যে। ওই গাছের পাতাগুলো ঝরতে ঝরতে এখন মোটে পাঁচে এসে ঠেকেছে। যেদিন শেষ পাতাটি ঝরে যাবে সু, সেদিনই, সেদিনই জেনো, আমিও মরে যাবো। ডাক্তার বলেনি তোমায়?"
সু'র ভিতরটা দুঃখে কেঁপে ওঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে পরম মমতাভরে জন্সির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, "ওসব যত বাজে কথা। ওরকম হয় নাকি জন্সি? তুমি ভুল জানো। তাছাড়া তুমি ওই গাছটাকে কত ভালোবাসো বলো তো? ওর সাথে তোমার আয়ু মোটেই জড়িত না। হতেই পারে না। তাছাড়া, সবচেয়ে বড় কথা। এই তো, একটু আগেই আমার ডাক্তারের সাথে কথা হলো। উনি বলেছেন। তোমার শরীর এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। উন্নতি হচ্ছে স্বাস্থ্যের। দেখো, দুর্বলতা তো এখনো রয়েছে। সেটা কাটালেই ব্যস, তুমি পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে। নাও, এখন কিছু খাও দেখি। চাঙ্গা হতে হবে তো? তুমি খেয়ে নাও। তুমি খেয়ে নিলে আমি কাজ নিয়ে বসবো। আঁকা বাকি বেশ কিছু। দেখি, আঁকাগুলো বিক্রি করে তোমার জন্য কী কিনতে পারি।"
জন্সি অবুঝ বালিকার মতো উত্তর দেয়, "না সু। আমি কিচ্ছু খাবো না। আমার জন্য তোমায় কিছু কিনতেও হবে না। দেখো, ওই যে। আরো একটা পাতা ঝরে গেলো। আমি জানি। পরপর সব পাতা ঝরে যাবে। আজ রাতের মধ্যেই সব পাতা ঝরে গাছটা একদম ন্যাড়া হয়ে যাবে। আর কী, সব শেষ। আমিও চলে যাবো। আমারও আয়ু ফুরাবে।"
বন্ধুর এমন ব্যবহারে সু বিহ্বল হয়। কী বলবে ও? কীভাবে শান্ত করবে জন্সিকে? শেষ চেষ্টা করে। কাতরস্বরে বলে, "জন্সি, তুমি এখন একটু শুয়ে থাকো। চোখ বন্ধ করে থাকো। আর বাইরে তাকিয়ো না। দেখো, আমায় আজ রাতের মধ্যে এই কাজটা শেষ করতেই হবে। আলো লাগবে। তাই আর জানলাটা বন্ধ করতে পারছি না। কিন্তু তুমি বাইরে তাকিয়ো না। জন্সি, দোহাই তোমার, একটু ঘুমাও।"
জন্সি জিজ্ঞেস করে, "পাশের ঘরে গিয়ে কাজ করা যায় না?"
সু মাথা নাড়ে। বলে, "না জন্সি। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। আমি চাই না তুমি ওই পাতাগুলোর দিকে তাকাও।"
রোগে ক্লিষ্ট জন্সি অবোধ শিশুর মতোই অবুঝ। বলে, "ঠিক আছে। আমি চোখ বন্ধ করে থাকছি। কিন্তু তুমি কথা দাও। কাজ শেষ করেই আমায় বলবে। আমি বাইরে তাকিয়ে থাকতে চাই। দেখতে চাই পাতাগুলো কীভাবে ঝরে পড়ে। আমার প্রাণও যে ওর সাথে জড়িয়ে আছে। ওই যে, ওই শেষ পাতাটার সাথেই দুলে দুলে পরম আনন্দে আমিও চলে যেতে চাই।"
"জন্সি, তুমি কথা বলো না। দোহাই। আমি আমার আঁকাটা শেষ করি। আজকের মধ্যে এটা করতেই হবে। আঁকায় একটি পুরুষ চরিত্র থাকবে। দেখি, তাকে মিস্টার বারম্যানের মতোই দেখতে আঁকবো। ওঁকে ডেকে আনি। আমি এই যাবো আর এই আসবো। তুমি কথা দাও, জন্সি, নড়াচড়া করবে না এর মধ্যে। কথা দাও ঘুমোবে?"
বারম্যান ওদেরই বিল্ডিঙে থাকেন, ষাটোর্দ্ধ চিত্রশিল্পী। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ওপর উনি ছবি আঁকছেন। মনে সাধ, একদিন কোন দুর্দান্ত ছবি এঁকে বিশ্ববিখ্যাত হবেন। অবশ্য তাঁর আঁকার বিশেষ কদর শিল্পমহলে নেই। টাকার জন্য তাই মাঝেমাঝেই অন্য শিল্পীদের হয়ে মডেলের কাজও করে দেন। যা রোজগার, বেশিরভাগই উড়িয়ে দেন মদের নেশায়। তবুও এত কিছুর মধ্যেও সু আর জন্সির খোঁজখবর নেওয়া, ওদের সাহায্য করাটাকে নিজের পরম কর্তব্য বলেই মনে করেন বারম্যান।
বারম্যানের ঘরে পৌঁছে সু দেখলো, ঘর অন্ধকার। উনি চুপ করে বসে আছেন। ঘরভর্তি মদের গন্ধ। নির্ঘাত নেশা করে আছেন। সু এরই মধ্যে মনের দুঃখে জন্সির অসুখ, দেওয়ালের ধারের শুকনো গাছটার ঝরাপাতা, তার সাথে জন্সির নিজের আয়ুকে জুড়ে নেওয়ার কথা সব বলে ভেঙে পড়ে, "আমি আর পারছি না। কোনদিক যে সামলাই? আঁকাটাও শেষ করতে হবে। আপনি আসবেন মিস্টার বারম্যান? আমার মডেল হয়ে যান দয়া করে।" সব শুনে মিস্টার বারম্যান রাগে ফেটে পড়লেন। চেঁচিয়ে বললেন, "এমন অলুক্ষুণে কথা কে বলে? কে ঢোকাচ্ছে এইসব আবোল তাবোল কথা জন্সির মাথায়? মেয়েটা মরতে বসেছে আর তুমি আমায় বলছো বসে বসে এখন মডেল সেজে বসে থাকতে? যাবো না আমি। এ হয় না।" সু কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, "দোহাই মিস্টার বারম্যান। এরকম বলবেন না। জন্সি দুর্বল। এই দুর্বল চিত্তে ওর মাথায় যত উদ্ভত খেয়াল হচ্ছে। এরই মধ্যে আপনিও সাহায্য না করলে আমি তবে কোথায় যাই?"
মিস্টার বারম্যান এবার শান্ত হয়ে বললেন, "দেখো সু। আমি আসছি। আমি কোথায় বললাম আমি যাবো না। শুধু জন্সি বেচারির জন্য মন কেমন করছে। ওইটুকু একটা মেয়ে, এমন অসুখে ভুগবে কেন? এখানে থাকাই উচিত না তোমাদের। আমাদের। দেখো, আমি একদিন একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু ছবি আঁকবোই। বিখ্যাত হবোই। অনেক খ্যাতি হবে। হবে যশ। আর সেদিন তোমাদের নিয়ে আমি এই বাজে জায়গা থেকে চলে যাবো। অনেক দূরে। দেখো। নাও চলো দেখি, আঁকার জোগাড় করো। আমি আসছি।"
এরপর আর কোন কথা হয় না। দুজনে চুপচাপ নেমে আসে নীচে। জন্সির ঘরে। জন্সি তখন রোগক্লিষ্ট ঘুমে আচ্ছন্ন। পর্দা সরিয়ে জানলা ভেজিয়ে পাশের ঘরে আসে সু আর মিস্টার বারম্যান। সেই ঘরের জানলা দিয়ে দুজনে একবার বাইরে তাকায়। প্রবল ঝড় বইছে, সাথে বৃষ্টি। বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝে নরম বরফকুচি ঝরে পড়ছে। পাতাঝরা লতানে গাছটার দিকে তাকিয়ে দেখে দুজনে, একদৃষ্টে। কোন কথা বেরোয়না ওদের মুখ দিয়ে। তারপর চুপচাপ জায়গায় ফিরে আঁকা শুরু করে সু। প্রায় সারা রাত জেগে কাজটা শেষ করেছে ও। ভোরের দিকে ঘন্টাখানেকের জন্য একটু ঘুমিয়েও পড়েছিল সু। এইবার উঠে পাশের ঘরে যায়, ধীরপায়ে। দেখে, জন্সি জেগে শুয়ে আছে। ব্যাকুল দৃষ্টিতে জানলার পর্দার দিকে চেয়ে। সু'কে দেখে বলে, "পর্দাটা সরিয়ে দাও। আমি দেখতে চাই। আমি দেখতে চাই আমার গাছটাকে। দেখি, পাতাগুলো কেমন আছে।"
সু আস্তে আস্তে জানলা থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেয়। চোখ যায় ন্যাড়া দেওয়ালের গায়ে লতানে গাছটার দিকে। সারা রাত ঝড় বৃষ্টি চলেছে। তবুও, শেষ একটা পাতা এখনও টিকে আছে। শুকনো খয়েরি ডালের ভিতর থেকে। একটা সবুজ পাতা। ধারগুলো অবশ্য ইতিমধ্যেই হলুদ হতে শুরু করেছে। তবুও, একা লড়ে যাচ্ছে, প্রবলভাবে। একটা শেষ সবুজ পাতা। জন্সি দেখে অবাক হয়, বলে, "সারা রাত যা বৃষ্টি হলো, হাওয়া দিলো, আমি ভেবেছিলাম বুঝি... না। আজ আর পারবে না ও। আজ ও ঝরে পড়বেই। আর সাথে আমিও। দেখো সু।" সু ভেবে পায় না কী বলবে এর উত্তরে। যে কিনা নিজেই বাঁচবার শেষ ইচ্ছেটুকু বিসর্জন দিয়েছে, চলে যাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছে, তাকে কীই বা বলে আটকানো যায়? সু অপারগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে বন্ধুকে। অপলকে। ইচ্ছে করে বন্ধুত্বের দোহাই দেবে। কিন্তু জানে, তাতেও কাজ হবে না। যে জীবন থেকে সব মোহ ক্রমশ সরিয়ে ফেলছে, সেখানে বন্ধুত্বের দোহাই বা টিকবে কেন?
দিন কেটে যায়। রাত্রে আবার ঝড় ওঠে। বৃষ্টি। ঘুটঘুট্টে অন্ধকার। তারই মধ্যে ওরা দেখতে পায়, সেই শেষ সবুজ পাতাটা এখনও টিকে আছে। লড়ছে, প্রবল বিক্রমে, সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। একা। বীরদর্পে।
পরদিন সকালে আবার জন্সির আব্দারে জানলার পর্দা সরে যায় ঘরের। দুই বন্ধু দেখে অবাক হয়ে, সেই গতকালের শেষ সবুজ পাতাটা এখনও টিকে গেছে। খানিকক্ষণ সেদিকে দেখে এরপর সু চলে যায় রান্না করতে। জন্সির জন্য পথ্য রান্না করবে ও। জন্সি খানিক তাকিয়ে থাকে বাইরে, তারপর বন্ধুকে বলে, "সু, আমি অনেক ভাবলাম। এই যে পাতাটা টিকে গেলো, কেন জানো? কারণ ও কিছু বলতে চায় আমায়। আমায় বোঝাতে চায় যে এত সহজে হার মানলে চলবে না। আমায় লড়াই করতে হবে। আমি এ কদিন বড় ভুল করেছি, আর এমন করবো না। আমায় বাঁচতে হবে। নতুন উদ্যম নিয়ে। আগে দেখি, একটু আমায় আয়নাটা এনে দাও দেখি। একবার দেখি এ কদিনে কী অবস্থা হয়ে আছে আমার চেহারার।"
সু ওকে খাইয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। জন্সি বসে থাকে বিছানার ধারে। কিছুক্ষণ পরে সুর দিকে তাকিয়ে বলে, "জানো সু, আমি একদিন ঠিক ইতালি যাবো। দেখো। বে অফ নেপলসের ছবি আমি আঁকবোই।" বন্ধুর কথা শুনে সু খুশী হয়। এই তো, এই তো ও আগামীর কথা ভাবছে। এই তো, ফিরছে। ওর জীবনীশক্তি ফিরছে। তাহলে হয়তো এ যাত্রায় বাঁচাতে পারলো বন্ধুকে।
বিকেলের দিকে ডাক্তার আসেন রুগীকে পরীক্ষা করতে। জন্সিকে দেখে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে উনি আজ বেশ সন্তুষ্ট। সুকে বলেন, "তোমার বন্ধুর শারীরিক উন্নতি হয়েছে দেখছি। যত্ন ভালোই করেছো। চালিয়ে যাও। খাওয়া দাওয়া, বিশ্রাম আর যত্ন। এই তিনটিই মূল ওষুধ ওর। ভালো হয়ে যাবে ও। খুব শিগগিরই সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি এখন যাই, ওদিকে ডাক পড়েছে। নতুন রুগী। বারম্যান নাম। মাইকের বয়স হয়েছে। মনে তো হচ্ছে নিউমোনিয়া। ওঁকে সারানো কঠিন। দেখি হাসপাতালে নিয়ে যাই যাতে যতটা কম কষ্ট পায় আর কী।"
পরের দিন আবার ডাক্তার ফিরে আসেন। জন্সির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন। তারপর খুশি হয়ে সু'কে বলেন, "তুমি বড় ভালো সেবা করেছো রুগীর। ও এখন অনেক ভালো আছে। চিন্তার আর কোন কারণ নেই। ঠিক করে খাওয়া দাওয়া করিয়ো। ব্যস। তাহলেই সব ঠিক। "
বেলার দিকে জন্সির কাছে এসে বসে সু। ওকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে বলে, "জন্সি, একটা খবর দেওয়ার ছিল।" জন্সি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় বন্ধুর দিকে। সু বলতে থাকে, "মিস্টার বারম্যান। মিস্টার বারম্যান আর নেই। আজকেই মৃত্যু হয়েছে ওঁর। হাসপাতালে। তবে একটাই ভালো কথা। উনি বেশি ভোগেননি। বেশি কষ্ট পাননি। দুদিনের কষ্ট। প্রথম দিন কেউ একজন ওঁকে নিজের ঘরে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে ডাক্তার ডেকে দেন। ওঁর জামাকাপড় জুতো সব ভিজে। হিমশীতল। কে জানে কী করে? তারপর একটু এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে অবশ্য নজরে আসে একটা আলো। বাইরে নিয়ে যাওয়ার আলো। হয়তো কোথাও বেরিয়েছিলেন। আর পাওয়া যায় কিছু আঁকার সরঞ্জাম। একটু হলুদ রঙ, একটু সবুজ রঙ তখনও লেগে আছে প্যালেটে।"
জন্সি থামিয়ে দেয় বন্ধুকে। বলে, "দেখো সু। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখো। ওই গাছের শেষ পাতাটি দেখছো? দেখেছো কেমন এত ঝড় বৃষ্টিতেও ওটা অটুট আছে। এতটুকু নড়ে পর্যন্ত নি। এবার বুঝছি কেনো। ওই তো, ওই যে, ওইটাই সেদিন রাত্রে মিস্টার বারম্যান এঁকে গিয়েছেন। এতদিনে ওঁর মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। দেখেছো কেমন অদ্ভুত সুন্দর ওই সৃষ্টিটি? এটাই মিস্টার বারম্যানের এঁকে যাওয়া শ্রেষ্ঠ শিল্প। ওঁর গুণের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ওই শেষ সবুজ পাতাটা। শিল্পী মহলে দেখো, অমর হয়ে থাকবে। ওঁর শেষ শিল্প।"
Saturday, February 22, 2020
Monday, February 17, 2020
দ্য গিফট অফ দ্য মাজাই
মোটে এক ডলার সাতাশি সেন্ট? মোটে? ডেলা এই নিয়ে তিনবার গুণে দেখলো। এইটুকু ওর সম্বল। মোটে এইটুকু। রোজের বাজারহাটের খরচ থেকে তিল তিল করে বাঁচানো মোটে এইটুকু। অথচ কালকেই বড়দিন। বেচারি ডেলা আর কীই বা করে, বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই। অগত্যা, ডেলা তাইই করছে।
যতক্ষণ ডেলা একটু শান্ত হচ্ছে, আসুন, ততক্ষণে বরং আমরা বাড়িটা ঘুরে দেখি। অবশ্য বাড়ি বলতে যা বোঝায়, এই আট ডলার প্রতি সপ্তাহের ভাড়ায় আদৌ তা আশা করা যে অনুচিত, তা জানা কথা। কাজেই এই বাড়ি নিয়ে বিশেষ কিছু যে বলার নেই, তা বোধহয় আর বলে দিতে হয় না। বাড়ির সামনে হলে একটা অতি ছোট ডাকবাক্স, যাতে যে কোন চিঠিই আঁটবে না। একটা বৈদ্যুতিক ঘণ্টিও আছে। অবশ্য সেই ঘণ্টি বাজে না। এছাড়া দরজার পাশে একটা ফলকে বড় করে লেখা বাড়ির মালিকের নাম, " মিস্টার জেমস ডিলিংহ্যাম ইয়ং"।
যখন ফলকটি ওখানে বসানো হয়েছিল, তখন মিস্টার জেমস ডিলিংহ্যাম ইয়ং সপ্তাহান্তে তিরিশ ডলার করে মাইনে পেতেন। এখন যখন সেটি কমে কুড়ি ডলারে নেমেছে, তখন বোধকরি ওই এত বড় নামটি নেহাতই বড় ও অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। তবে মিস্টার জেমস ডিলিংহ্যাম ইয়ং যখন এই সজ্জিত ঘরে ঢোকেন, ওঁর নাম হয়ে যায় আরো ছোট। মিসেস জেমস ডিলিংহ্যাম ইয়ং সপ্রেম ওঁর গলা জড়িয়ে ওঁকে "জিম" বলে ডাকেন। মিসেস ইয়ংএর সাথে পরিচয় ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে - ডেলা।
ডেলা খানিকক্ষণ পরে কান্না থামিয়ে মুখ চোখ মুছল। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো বটে, তবে সেদিকে কোথাও কোন মন নেই ওর। আগামীকাল বড়দিন, এদিকে জিমের জন্য উপহার কেনার জন্য হাতে রয়েছে মোটে এক ডলার ও সাতাশি সেন্ট। বহু মাস ধরে অল্প সল্প এদিক ওদিকের খরচ থেকে বাঁচিয়েও এতদিনে সর্বসাকুল্যে রয়েছে মোটে এইটুকু টাকা। সপ্তাহে কুড়ি ডলার দিয়ে সংসার চালানো চারটিখানি কথা না। সবকিছুরই খরচ অনেক বেশি হয়েছে, ভাবনার বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে হিসেব।
এত কিছুর পর দিনের শেষে হাতে রয়েছে কেবলমাত্র এই এক ডলার সাতাশি সেন্ট। এই দিয়ে ওকে জিমের জন্য উপহার কিনতে হবে ভেবেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে ডেলার। অথচ জিমের যোগ্য উপহারের চিন্তায় কত খেয়াল বেখেয়ালি মুহূর্ত ও কাটিয়েছে। এমন কিছু কিনতে হবে যা জিমের জন্য হবে এক্কেবারে যথাযথ, যা জিম ভীষণভাবে ভালোবাসবে, ঠিক সেরকম কিছুর সন্ধানে ডেলা কত সময় ব্যয় করেছে।
দুটি জানলার মধ্যিখানে রয়েছে একটি আয়না। সেইরকম আয়না হয়তো আপনি আগেও দেখেছেন কোন সস্তার বাড়িতে। অত্যন্ত সরু এক ফালি কাঁচ। যদি মানুষটি খুব রোগা হন এবং দ্রুত পদচালনা করতে পারতে পারেন, তবে হয়তো পূর্ণ অবয়ব দেখতে পেতে পারেন এমন আয়নায়। ডেলা নিতান্তই ছিমছাম, বলা চলে রোগা। কাজেই ও সহজেই এই আয়নায় নিজেকে দেখতে পেয়ে যায় সহজেই।
কী মনে হতে, হঠাৎ ডেলা জানলা থেকে সরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। কিছু একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়, আর সেই উত্তেজনায় ডেলার দুই চোখ উজ্জ্বল। তবে মুখখানি বিবর্ণ। তাড়াতাড়ি চুলের খোঁপা খুলে ওর এক ঢাল লম্বা ঘন চুল এলিয়ে দিলো কাঁধ পিঠ বরাবর।
ডিলিংহ্যাম ইয়ং পরিবার তাদের দুই মূল্যবান ঐশ্বর্য নিয়ে অত্যন্ত গর্ব করতেন। প্রথমটা, জিমের সোনার ঘড়ি। এই ঘড়িটি একদা জিমের বাবার সম্পত্তি ছিলো। তারও আগে এটি ছিল ওঁর বাবার সম্পত্তি। বংশানুক্রমে এখন জিমের। দ্বিতীয়ত, ডেলার অপরূপ সুন্দর চুল।
যদি ওদের বাড়ির সামনে কোন সাতমহলা প্রাসাদে কোন রানী বাস করতেন, তবে ডেলা নিয়মিত রানীকে দেখিয়ে দেখিয়ে চুল ধুতো, তারপর সযত্নে কেশবিন্যাস করতো। ডেলা নিশ্চিত, ওর চুল যে কোন সময়ী যে কোন রাজরানীর ঐশ্বর্য ও ধনের চেয়ে বেশি দামী, বেশি গর্বের।
আর যদি কোন মহারাজ থাকতেন, তবে জিম অবশ্যই প্রতিবার দেখা হলেই বারবার নিজের ঘড়িখানি বের করে সময় দেখতো। এমনই ঐশ্বর্য সেই ঘড়িতে। জিম জানে, অমন মূল্যবান সম্পদ কোন রাজার কাছেও নেই।
এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ডেলার লম্বা খয়েরি রেশমি চুল এক ঢাল ঝর্নার জলের মতো পিঠ বরাবর ঢেউ খেলছে। চুল লম্বায় ওর হাঁটু ছাড়িয়ে যায়, ঠিক যেন ওর কোন পোশাক।
ডেলা ক্ষণিকের ইতস্ততা কাটিয়ে ঝটপট নিজের চুল সাজিয়ে ফেললো খোঁপায়। মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা চোখের জল।
এরপর নিজের খয়েরি কোট গায়ে জড়িয়ে, মাথায় জীর্ণ খয়েরি টুপিটা মাথায় পরে বেরিয়ে পড়লো। দু চোখে এখনও লেগে আছে সেই ঔজ্জ্বল্য। ডেলা দ্রুত পায়ে চলতে চলতে এসে পৌঁছল একটি দোকানের সামনে।
দোকানের সামনে রয়েছে একটি ফলক, লেখা, "মিসেস সফ্রোনি। এখানে সব রকম চুলের সরঞ্জামের কারবার হয়।" ডেলা এরপর হড়বড় করে দোতলায় এসে পৌঁছল। হাঁপাচ্ছে। একটু থেমে শ্বাস ঠিক করে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে মিসেস সফ্রোনি। এক বিশালাকার ফ্যাকাশে মুখো মহিলা। ডেলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আমার চুল কিনবেন?"
মিসেস সফ্রোনি একটু তাকালেন ডেলার দিকে। তারপর মেপে মেপে উত্তর দিলেন, "আমি চুল কিনি। দেখি, টুপিটা খোলো, দেখি তোমার চুল কেমন।"
ডেলা খোঁপা খুলে দেখালো। লম্বা খয়েরি রেশমের ন্যায় ওর চুল দেখে মিসেস সফ্রোনি বললেন, "কুড়ি ডলার। হুম, কুড়ি ডলার দিতে পারি।"
ডেলা ব্যস্ত হয়ে বললো, "নিন। আমার চুল নিন। পরিবর্তে আমায় এখুনি কুড়ি ডলার দিন। দয়া করে।"
এরপরের দুঘণ্টা যেন কোথায় উড়ে গেলো। এ দোকান সে দোকান করতে থাকল ডেলা। কিছুতেই যেন কোথাও আর জিমের জন্য পছন্দের কোন উপহার চোখেই পড়ে না ওর।
শহরের সমস্ত দোকান প্রায় চষে বেরানোর পর অবশেষে মিলল সেই বহু কাঙ্খিত উপহারটি। যথার্থই এটি জিমের জন্যই বুঝি বানানো। একেবারে সেরার সেরা।
সোনার এই ঘড়ির বন্ধনীটি অমূল্য। নকশায় বিশেষ কারুকাজ না থাকলেও, ধাতুর বিশুদ্ধতার জন্য এই ঘড়ির বন্ধনীটি এত মহার্ঘ্য। এত দামী। এতই সাধারণ দেখতে, অথচ অসাধারণ সুন্দর। দেখলেই বোঝা যায় এর দাম, এমনই সে সৌন্দর্য।
যাক, এতদিনে জিমের সেই ঘড়িটার জন্য এক্কেবারে যথাযথ বন্ধনী তবে পাওয়া গেলো।
বন্ধনীটি দেখেই ডেলার মনে হলো, জিমের ঘড়ির সাথে এমন মানানসই বন্ধনীরই বুঝি অপেক্ষা ছিল এতদিন। জিমের সাথে দিব্যি মানাবে এটিকে। একদম ওরই মতোন, শান্ত, স্নিগ্ধ। জিমের মতোই মূল্যবান এটি। ও একুশ ডলার দাম দিয়ে কিনে ফেললো। ঘড়ির বন্ধনী ও সাতাশি সেন্ট হাতে নিয়ে ডেলা ফিরে এলো নিজের আট ডলারের সংসারে।
এতদিন বন্ধনীর অভাবে জিম ঘড়িটি লোকসমাজে ব্যবহার করতেই পারতো না। যদিও ঘড়ি হিসেবে ওটি অত্যন্ত সুন্দর, তবুও বন্ধনীর অভাবে লুকিয়ে জামার খোপ থেকে বের করে সময় দেখতে হতো এতদিন। এইবার জিম নিশ্চিন্তে সকলের সামনে যখন ইচ্ছে ঘড়িতে সময় দেখতে পাবে। এইবার ডেলা খুশি, খুব খুশি।
বাড়ি ফিরে ডেলা এইবারে শান্ত হয়ে বসলো। এখন অনেক ভাবনা চিন্তার সময়। এই যে কীর্তিটি ও করলো, এটাকে তো লুকোতে হবে। এই দুঃখী ক্ষতচিহ্নকে যে মুছতে হবে, ঢাকতে হবে। ভালোবাসা ও উদার হৃদয়, দুইয়ে মিলে যে অনেক ক্ষতস্থান সৃষ্টি করে বন্ধু। অবশ্য সেই ক্ষত সহজে জুরোবার নয়।
চল্লিশ মিনিট ধরে ডেলা নিজের অবশিষ্ট চুল নিয়ে নানান কারুকাজ করতে লাগলো, একেক সময় একেক কেশবিন্যাস। কখন কোনটায় ওকে মানিয়ে যায়। এইরকম চেষ্টা করতে করতে অবশেষে যখন ওর মনে হলো নিজেকে একটু ভদ্রস্থ দেখাচ্ছে, আদপে তখন ডেলাকে লাগছিল ঠিক এক দুষ্টু ইশকুল ছাত্রের মতো। বেশ অনেকটা সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো ডেলা। ও নিশ্চিত, জিম বাড়ি ফিরে ওকে এরকম সাজে দেখলে নির্ঘাত মেরেই ফেলবে। আর যদি নাও বা মারে, দ্বিতীয়বার চেয়ে দেখার আগে অবশ্যই বলবে যে ওকে দেখতে লাগছে ঠিক সেইসব মেয়েগুলোর মতো, যারা নেচে আর গান গেয়ে টাকা উপার্জন করে। কিন্তু ডেলা কীই বা করবে নইলে? ওর যে হাতে ছিল মোটে ওই এক ডলার সাতাশি সেন্ট। এই দিয়ে কি আর জিমের জন্য পছন্দসই উপহার কেনা যায়?
সন্ধ্যে সাতটায় জিমের নৈশভোজ তৈরি করে ডেলা অপেক্ষা করতে লাগলো। জিম কোনদিনও এতটুকুও বিলম্ব করে না বাড়ি ফেরায়। সদ্য কেনা ঘড়ির বন্ধনীটা হাতে নিয়ে ডেলা বসে অপেক্ষা করতে লাগলো
দরজার ধারে। সদর দরজা। যেখান দিয়ে জিম রোজ ওদের বাড়ি ঢোকে। মুহূর্তেই ডেলা বাইরে হলে জিমের পায়ের শব্দ পেলো। ভয়ে, চিন্তায় ওর সুন্দর মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ডেলার একটা স্বভাব আছে, ছোট বড় সবকিছু নিয়েই যখন তখন ও ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। এখনও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। ও চুপিচুপি ইশ্বরকে ডেকে বলল, "হে ইশ্বর, দয়া করো, দয়া করে যেন জিম আমায় এখনও সুন্দরী ভাবে।"
যথাসময়ে দরজা খুলে জিম বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, রোগা চেহারা। বেচারা, এই বাইশ বছর বয়সে সংসারের বোঝা টানা, চারটিখানি কথা না। একটা কোট আর এক জোড়া গ্লাভসের খুব প্রয়োজন। দেখেই মায়া হয়।
শিকারি যেমন শিকারের সামনে এসে স্থির হয়ে খানিক থমকে দাঁড়ায়, জিমের অবস্থাও এখন সেরকম। বাড়ি ঢুকে হাঁ করে ডেলার দিকে চেয়ে রইলো। কোন কথা নেই মুখে। এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে ডেলাকে দেখেছে ও। সেই অভিব্যক্তি এতটাই অচেনা ডেলার কাছে, ডেলা বুঝছে না। ও কি ভয় পাবে? জিম কি রেগে গেলো? নাকি চমকে গেলো? বুঝতে পারে না ও।
ডেলা এগিয়ে যায় জিমের দিকে, বলে, "জিম, পায়ে পড়ি, ওরকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়ো না। আমি চুল কেটে তা বিক্রি করেছি। দেখো, কাল বড়দিন। তোমার জন্য উপহার না কিনে কী করে থাকতাম আমি বলো? সেই জন্যই এই কাজ করতে হলো। শোনো, আমার চুল খুব তাড়াতাড়ি লম্বা হয়। তুমি চিন্তা করো না। লক্ষ্মীটি জিম, কাল বড়দিন। এসো, আমরা আনন্দ করি। জানো, তোমার জন্য কী দারুণ সুন্দর একটা উপহার আমি কিনেছি।"
জিম এবার বেশ কষ্ট করে, ধীরে জিজ্ঞেস করে, "চুল কেটে ফেলেছ?" যেন ঘটনাটি বুঝেও বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। মুখে সেই কষ্ট স্পষ্ট।
ডেলা ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিলো, "হ্যাঁ জিম। চুল কেটে তারপর বিক্রি করে ফেলেছি। দেখো জিম, আমি কিন্তু মানুষটা সেই একই আছি। তোমার ডেলা। দেখো জিম। আমায় ভালো লাগছে না? বলো?"
জিম অবিশ্বাসের সাথে চারিদিকে তাকিয়ে আবারও বলে, "চুল কেটে ফেলেছ?"
ডেলা আস্তে আস্তে উত্তর দেয়, "হ্যাঁ জিম। তুমি এদিক ওদিক খুঁজো না। পাবে না। আমি চুল কেটে বিক্রি করে দিয়েছি। দেখো জিম, এটা ছাড়া আমার কাছে আর দ্বিতীয় উপায় ছিল না। কাল বড়দিন। তোমার জন্য উপহার কিনতেই হতো। নাও, এবার মন খারাপ করা বন্ধ করো জিম। দেখো, তোমার জন্য পছন্দসই উপহার কিনেছি। শোনো জিম, আমার চুলের আয়ু সীমিত, ও চুল আবার গজাবে, বাড়বে। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা, সে তো নিখাদ। এসো, আমরা খেয়ে নিই এবার।"
জিম উত্তরে ডেলাকে জড়িয়ে ধরলো। আসুন, এই অল্পক্ষণ, আমরা একটু অন্যদিকে তাকাই। আচ্ছা, সপ্তাহে আট ডলার আর বছরে লক্ষাধিক ডলার। কত পার্থক্য? বুদ্ধিমানেরা এর এক উত্তর দেবেন। তবে, তা মোটেই সঠিক না। ম্যাজাই যারা ছিলেন, তারা বহু দামী উপহার এনেছিলেন। তবে এদের উপহার আলাদা। কীভাবে? শিগগিরই বোঝাবো আমি।
জিম কোটের পকেট থেকে একটি রঙিন কাগজে মোড়া কোন বস্তু বের করে হেলায় খাটে রেখে দিলো। তারপর ডেলাকে বলল, "দেখো ডেলা, তুমি যেমনই দেখতে হও না কেন, যেভাবেই চুল কাটো কি বড় করো, যা ইচ্ছে করো, জেনে রেখো, আমি তোমায় চিরকাল ভালোবাসবো। একই ভাবে ভালোবাসবো। তবে ওই যে, ওই মোড়কটি খুলে দেখলেই বুঝবে আমি এমন হতভম্বের মতো কেন তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে।"
ডেলা ওর ভয়ে দুঃখে ফ্যাকাশে হয়ে আসা আঙ্গুল দিয়ে সযত্নে মোড়াটি খুলল। এবং খুলেই আনন্দের উচ্ছ্বাস। মুহূর্তেই অবশ্য তা বদলে গেলো চোখের জলে। কেন? কারণ ওর সামনে রয়েছে সেই চিরুনি। সেইইই চিরুনি, যা একদিন দোকানে দেখে খুব পছন্দ হলেও, মূল্য দেখে আর কেনা হয়নি। সাধ্যের বাইরেই ছিল ওর শখ। অপূর্ব সুন্দর এই চিরুনি, মণিমুক্তো খচিত। একদম ডেলার মনোরম চুলের সাথে মানানসই। একদা যা শখের ছিল, আজও আছে, আজ সাধ্যেও রয়েছে, এদিকে সেই চুল আর নেই।
বুকে আগলে রেখে খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো ডেলা। তারপর বলল," জিম, আমার চুল খুব শিগগিরই লম্বা হয়। তুমি চিন্তা করো না।"
মুহূর্তেই যেন কী মনে পড়ে গেলো ওর। জিমের জন্য আনা উপহারটি বের করে আনলো ও জিমের সামনে। সোনার বন্ধনীটি যেন সোহাগের আদরে আরো নরম, আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। জিমকে ওটা দেখাতে দেখাতে ডেলা উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "এটা কী দারুণ না জিম? একদম মানানসই হয়েছে তোমার ঘড়ির সাথে জানো, আমি সারা শহর ঘুরে তবে এটা পেয়েছি। দেখি দেখি তোমার ঘড়িখানি দাও দেখি। দেখো তো কেমন দারুণ মানিয়েছে দুটিকে। কই? দাও?'
জিম উত্তর দেয় না। হাসে। তারপর থপ করে বসে পড়ে খাটে। তারপর ডেলাকে ধীরে ধীরে বলে, "ডেলা, এসো, আমরা খেয়ে নিই। আমাদের একে ওপরের জন্য আনা উপহারগুলি বরং এখন তোলা থাক। এখন ব্যবহার করা যাবে না। ওগুলি বড্ড বেশিই সুন্দর। আমি আমার ঘড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি তোমার চুলের চিরুনির জন্য। এসো, আমরা খেয়ে নিই।"
ম্যাজাইরা ছিলেন বুদ্ধিমান লোক। শিশু যীশুর জন্মের পর তাঁরা দূর দূরান্ত থেকে এসে উপহার দিয়েছিলেন যীশুকে। সম্ভবত ওইগুলিই প্রথম বড়দিনের উপহার। তাঁরা ছিলেন বুদ্ধিমান, অগত্যা, ওঁদের আনা উপহারও ছিলো দামী, মূল্যবান ও কার্যকরী। আর আজ যাদের কথা বললাম, তারা বোকা। তাদের উপহারেরও কোন আর মানেই রইলো না। তবে তারা, প্রেমে পাগল হয়ে বোকা। একে অপরকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসে বোকা। নিজেদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি বিক্রি করে অন্যের জন্য উপহার কেনার মতো বোকা। কিন্তু না, আমি বলি কী, যতজন আজ অবধি উপহার দিয়েছে, এই দুজনের মতো বুদ্ধি কারুর নেই। এরাই যথার্থ ম্যাজাই। এরাই আসল বুদ্ধিমান। ভালোবাসামাখা উপহার এরাই দিয়েছে।
Saturday, February 15, 2020
- "যদি বলো হ্যাঁ, বি সি এসে বসে যাবো আমি।" হ্যাঁ, এইটা গুনগুন করতি না তুই কলেজ ক্যান্টিনে?
(চুপ)
- কী রে, কথা নেই কেন মুখে?
- হ্যাঁ মানে..
- মানে মানে করছিস কেন বল তো?
- ইয়ে মানে
- ওই ইয়ে মানে এই করেই যা তুই। যখন প্রেম করতাম, পটানোর দরকার ছিল, তখন কত ডায়লগ, হ্যাঁ? খালি গান আর গান? আর এখন? একটু বললাম আজকে তাড়াতাড়ি আসতে। স্পেশাল ওকেশন। সেলিব্রেট করবো। তা না। আজকের দিনেও তুই লেট। সো নট ডান।
- শোন না। প্লিজ, রাগ করিস না। লক্ষ্মীটি?
- তুই থাম। নেহাৎ পাবলিক প্লেস। তাই আমি চুপ করে আছি। বাড়ি চল। দেখাচ্ছি মজা।
- (নীচু স্বরে) এখনই যা চ্যাঁচাচ্ছিস, এর চেয়েও বেশি? ওরে বাবা রে।
- কী, কী বললি?
- না কিছু না।
- তাই বল। তখন থেকে জিজ্ঞেস করছি, কেন দেরী হলো, তার উত্তর কই?
- আরে সেটাই তো বলার চেষ্টা করছি। বলতে দে।
- বল না। কখন থামালাম?
- সেই তো।
- আবার টন্ট?
- ওই দেখ। কথাই বলতে দিচ্ছিস না।
- তুইই বাজে বকে চলেছিস।
- আমি বাজে বকি?
- না। তবে বেশি বকিস।
- সেই তো। এখন তো আমি বাজে বকি। বেশি বকি।
- ওই দেখ। ও মা, রাগ করেনা সোনা।
- হুহ।
- শোন না। একটা গুড নিউজ আছে। ঐটার জন্যই দেরি হলো।
- কী নিউজ?
- আজ বি সি এসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। তোকে না বলে আমি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। প্রিলি ক্লিয়ার করেছি!
- সত্যিই?
- তিন সত্যি! তোকে বলতাম গান গেয়ে? তুই তখন একবার হ্যাঁ বলেছিলি। তাই...
- মাই গড, এটা দারুণ খবর!
- ওই রেজাল্ট দেখতে গিয়েই দেরি হলো।
- সব মাফ। চল, লেট আস সেলিব্রেট। এর চেয়ে ভালো ভ্যালেন্টাইনস ডে উপহার আর কিছুই হয় না। ইউ কেপ্ট ইয়োর ওয়ার্ডস! থ্যাংক ইউ সো মাচ!
- লাভ ইউ! তুই না থাকলে, ইন্সপায়ার না করলে হতই না!
- লাভ ইউ টু!
(চুপ)
- কী রে, কথা নেই কেন মুখে?
- হ্যাঁ মানে..
- মানে মানে করছিস কেন বল তো?
- ইয়ে মানে
- ওই ইয়ে মানে এই করেই যা তুই। যখন প্রেম করতাম, পটানোর দরকার ছিল, তখন কত ডায়লগ, হ্যাঁ? খালি গান আর গান? আর এখন? একটু বললাম আজকে তাড়াতাড়ি আসতে। স্পেশাল ওকেশন। সেলিব্রেট করবো। তা না। আজকের দিনেও তুই লেট। সো নট ডান।
- শোন না। প্লিজ, রাগ করিস না। লক্ষ্মীটি?
- তুই থাম। নেহাৎ পাবলিক প্লেস। তাই আমি চুপ করে আছি। বাড়ি চল। দেখাচ্ছি মজা।
- (নীচু স্বরে) এখনই যা চ্যাঁচাচ্ছিস, এর চেয়েও বেশি? ওরে বাবা রে।
- কী, কী বললি?
- না কিছু না।
- তাই বল। তখন থেকে জিজ্ঞেস করছি, কেন দেরী হলো, তার উত্তর কই?
- আরে সেটাই তো বলার চেষ্টা করছি। বলতে দে।
- বল না। কখন থামালাম?
- সেই তো।
- আবার টন্ট?
- ওই দেখ। কথাই বলতে দিচ্ছিস না।
- তুইই বাজে বকে চলেছিস।
- আমি বাজে বকি?
- না। তবে বেশি বকিস।
- সেই তো। এখন তো আমি বাজে বকি। বেশি বকি।
- ওই দেখ। ও মা, রাগ করেনা সোনা।
- হুহ।
- শোন না। একটা গুড নিউজ আছে। ঐটার জন্যই দেরি হলো।
- কী নিউজ?
- আজ বি সি এসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। তোকে না বলে আমি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। প্রিলি ক্লিয়ার করেছি!
- সত্যিই?
- তিন সত্যি! তোকে বলতাম গান গেয়ে? তুই তখন একবার হ্যাঁ বলেছিলি। তাই...
- মাই গড, এটা দারুণ খবর!
- ওই রেজাল্ট দেখতে গিয়েই দেরি হলো।
- সব মাফ। চল, লেট আস সেলিব্রেট। এর চেয়ে ভালো ভ্যালেন্টাইনস ডে উপহার আর কিছুই হয় না। ইউ কেপ্ট ইয়োর ওয়ার্ডস! থ্যাংক ইউ সো মাচ!
- লাভ ইউ! তুই না থাকলে, ইন্সপায়ার না করলে হতই না!
- লাভ ইউ টু!
Friday, February 14, 2020
রেডিও
সুচেতনা
(১)
ধুর ধুর, স্কুলের সব বন্ধুরা কী সুন্দর পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি পড়লেই বেড়াতে বেরোয়। আর এদিকে পুপুর সেই সুযোগই নেই। বাবা মায়ের যে কী এমন অদ্ভুত চাকরি। বছরে ওই একবারই যা ওরা কোথাও যায়, শীতকালে। বাকি ছুটিগুলো বড্ড মন খারাপের মধ্যেই কাটে। শনি রবিবারগুলোও তো কখনো সখনো ওদের অফিস থাকে। এবার ছুটিতে ঠাম্মা এসেছে ওদের বাড়ি। বেচারি ঠাম্মা, টিভি সিরিয়াল ছাড়া চলেই না। এদিকে বাবা মায়ের কড়া আদেশ। পুপু যতদিন না আরেকটু বড় হচ্ছে, বাড়িতে কেবিল টিভি আসবেই না। অগত্যা, ঠাম্মার জন্য তড়িঘড়ি লফ্ট থেকে নেমে এলো এই কালো বাক্সটা। ব্যাটারি পাল্টিয়ে খুট করে সুইচ অন করতেই ম্যাজিক। পুপু অবাক। মুগ্ধ। দারুণ ব্যাপার তো। কী দারুণ অনুষ্ঠান সারাদিন ধরে। কত চ্যানেল। নানান প্রোগ্রাম। একটায় আবার বেলায় ইংলিশ ক্লাসিক্স, দুপুরে নাটক, বিকেলে হিন্দি গান। কোনো চ্যানেলে আবার সারাদিনই হিন্দি বাংলা বকবক আর গান। মজার মজার সে বকরবকর। দিব্যি ভালো তো! যাক, ছুটিগুলো বোধহয় আর বোরিং কাটবে না পুপুর।
(২)
চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পেয়ে অর্ক মোটেই খুশি হয়নি। যদিও অফিস পোস্টিং দিয়েছে কলকাতাতেই, তবুও, সেটা বড্ড দূর বাড়ি থেকে। রোজ রোজ যাতায়াত করতে হবে ভাবলেই গায়ে জ্বর এসে যাচ্ছে। এমনিতেই ট্র্যাফিকের যা অবস্থা শহরে, তার ওপর আবার টালা ব্রিজ বন্ধ। তারপর রোজই কোনো না কোনো মিছিল মিটিং। মা বাবাকে একবার বলেই দেখলো প্রস্তাবটা, অফিসের কাছাকাছি কোথাও একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকবে। সুবিধে।
ছেলের মুখে এই প্রস্তাব শুনে মায়ের তো প্রায় মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। চার বছর বাড়ির বাইরে, হোস্টেলে থেকে ছেলে সবে কলকাতা ফিরেছে। আবার এই কদিনেই যদি আবার বাড়ির বাইরে চলে যেতে হয়, তা হলে তো মুশকিল। চার বছরে ছেলেটা ঠিকঠাক যত্ন পায়নি। উঁহু। আর একে হাতের বাইরে মোটেই ছাড়া যাবে না। অর্কর প্ল্যান মা একাই ভেস্তে দিলো। অবশ্য সমাধান দিয়েছে বটে। ছেলে একটু সকাল সকাল উঠে পড়বে। বাস জার্নি করেই যাবে। জার্নিটা লম্বা ঠিকই। কিন্তু কানে গোঁজা থাকবে এফ এম রেডিও।
আজকাল অর্ক বাসেই যাতায়াত করছে। আর জে ও হিন্দি বাংলা গানের কল্যাণে দেড় ঘন্টা যে কীভাবে পেরিয়ে যায়, খেয়ালই পড়ে না আর!
(৩)
মন দিয়ে টেস্ট পেপার থেকে ভেক্টরের অঙ্ক সমাধান করছিল মিথি। আর কদিন বাদেই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। ভেক্টর নিয়ে বেশ জেরবার। গোটা ফিজিক্স নিয়েই জেরবার। টিউশন ক্লাসও শেষ। তবে ওর রিভিশন এখনো চলছে। কয়েকটা অঙ্ক আটকেওছে। টেনশন হচ্ছে। কী যে করে। কে জানে, অংশু এগুলো সলভ করেছে কি না। ও কে জিজ্ঞেস করে লাভ আছে? অন্তত ও না পারলে, ওর দাদাকে ও জিজ্ঞেস করে জানাবে না হয়। দাদাভাই তো ফিজিক্সেরই ছাত্র।
মোবাইল হাতে নিয়ে মিথি মেসেজ করে অংশুকে। "এবারের টেস্ট পেপারের পেজ ২৪১ এর কোয়েশ্চেন ২এ টা মাথায় ঢুকছে না। একটু সলভ করে হোয়াটসআপ করে দে তো।" মুহূর্তেই ব্লু টিক। মেসেজ পড়েই অংশুর উত্তর, ওকে। তুই ততক্ষণ রেডিও শোন। ১০৯.৩ মেগাহার্টজ এ। ভালো গান দিচ্ছে পরপর। আমি ততক্ষণ কোয়েশ্চেনটা দেখছি।"
মিথি রেডিও চালায়। সত্যি তো, বেশ ভালো গান। পরপর দুটো হলো। দুটোই ওর ফেভারিট। অনুরোধের আসর গোছের হচ্ছে। লোকজন মেসেজ করে জানাচ্ছে প্রিয় মানুষদের প্রতি ডেডিকেশন। একেকজন বেশ মজার মজার কথা লিখে পাঠাচ্ছে। মন দিয়েই শুনছিলো মিথি। আর ঠিক তখনই আর জে বললো, "আচ্ছা, আজ কিন্তু কিস ডে। জানেন তো? আর সেই উপলক্ষেই পরের মেসেজ। বেশ ইন্টারেস্টিং। লিখেছে অংশু। মেসেজটা পাঠিয়েছে মিথির জন্য। বলছে, সামনেই আমাদের এইচ এস। আজ দেখাসাক্ষাৎ তো হচ্ছে না। তাই পরের গানটা বিশেষ করে ওর জন্য।
"আজ, ঠোঁটের কোলাজ থামালো কাজ
মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম..." বাঃ, দারুণ তো। তাহলে এই রইলো বিশেষ দিনে, বিশেষ গান। শুনতে থাকো। এনজয়।"
মিথির মুখ সলজ্জ হাসিতে রাঙা হয়।
(আজ বিশ্ব রেডিও দিবস। সেই উপলক্ষে এই পুঁচকি নিবেদন। রেডিও আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। সাথে নিয়ে অনেক মিষ্টি মধুর স্মৃতি। সে মহালয়ার ভোর হোক, বা অনুরোধের আসর। রেডিও আর আমাদের সম্পর্ক আজকের কথা নয়!)
সুচেতনা
(১)
ধুর ধুর, স্কুলের সব বন্ধুরা কী সুন্দর পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি পড়লেই বেড়াতে বেরোয়। আর এদিকে পুপুর সেই সুযোগই নেই। বাবা মায়ের যে কী এমন অদ্ভুত চাকরি। বছরে ওই একবারই যা ওরা কোথাও যায়, শীতকালে। বাকি ছুটিগুলো বড্ড মন খারাপের মধ্যেই কাটে। শনি রবিবারগুলোও তো কখনো সখনো ওদের অফিস থাকে। এবার ছুটিতে ঠাম্মা এসেছে ওদের বাড়ি। বেচারি ঠাম্মা, টিভি সিরিয়াল ছাড়া চলেই না। এদিকে বাবা মায়ের কড়া আদেশ। পুপু যতদিন না আরেকটু বড় হচ্ছে, বাড়িতে কেবিল টিভি আসবেই না। অগত্যা, ঠাম্মার জন্য তড়িঘড়ি লফ্ট থেকে নেমে এলো এই কালো বাক্সটা। ব্যাটারি পাল্টিয়ে খুট করে সুইচ অন করতেই ম্যাজিক। পুপু অবাক। মুগ্ধ। দারুণ ব্যাপার তো। কী দারুণ অনুষ্ঠান সারাদিন ধরে। কত চ্যানেল। নানান প্রোগ্রাম। একটায় আবার বেলায় ইংলিশ ক্লাসিক্স, দুপুরে নাটক, বিকেলে হিন্দি গান। কোনো চ্যানেলে আবার সারাদিনই হিন্দি বাংলা বকবক আর গান। মজার মজার সে বকরবকর। দিব্যি ভালো তো! যাক, ছুটিগুলো বোধহয় আর বোরিং কাটবে না পুপুর।
(২)
চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পেয়ে অর্ক মোটেই খুশি হয়নি। যদিও অফিস পোস্টিং দিয়েছে কলকাতাতেই, তবুও, সেটা বড্ড দূর বাড়ি থেকে। রোজ রোজ যাতায়াত করতে হবে ভাবলেই গায়ে জ্বর এসে যাচ্ছে। এমনিতেই ট্র্যাফিকের যা অবস্থা শহরে, তার ওপর আবার টালা ব্রিজ বন্ধ। তারপর রোজই কোনো না কোনো মিছিল মিটিং। মা বাবাকে একবার বলেই দেখলো প্রস্তাবটা, অফিসের কাছাকাছি কোথাও একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকবে। সুবিধে।
ছেলের মুখে এই প্রস্তাব শুনে মায়ের তো প্রায় মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। চার বছর বাড়ির বাইরে, হোস্টেলে থেকে ছেলে সবে কলকাতা ফিরেছে। আবার এই কদিনেই যদি আবার বাড়ির বাইরে চলে যেতে হয়, তা হলে তো মুশকিল। চার বছরে ছেলেটা ঠিকঠাক যত্ন পায়নি। উঁহু। আর একে হাতের বাইরে মোটেই ছাড়া যাবে না। অর্কর প্ল্যান মা একাই ভেস্তে দিলো। অবশ্য সমাধান দিয়েছে বটে। ছেলে একটু সকাল সকাল উঠে পড়বে। বাস জার্নি করেই যাবে। জার্নিটা লম্বা ঠিকই। কিন্তু কানে গোঁজা থাকবে এফ এম রেডিও।
আজকাল অর্ক বাসেই যাতায়াত করছে। আর জে ও হিন্দি বাংলা গানের কল্যাণে দেড় ঘন্টা যে কীভাবে পেরিয়ে যায়, খেয়ালই পড়ে না আর!
(৩)
মন দিয়ে টেস্ট পেপার থেকে ভেক্টরের অঙ্ক সমাধান করছিল মিথি। আর কদিন বাদেই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। ভেক্টর নিয়ে বেশ জেরবার। গোটা ফিজিক্স নিয়েই জেরবার। টিউশন ক্লাসও শেষ। তবে ওর রিভিশন এখনো চলছে। কয়েকটা অঙ্ক আটকেওছে। টেনশন হচ্ছে। কী যে করে। কে জানে, অংশু এগুলো সলভ করেছে কি না। ও কে জিজ্ঞেস করে লাভ আছে? অন্তত ও না পারলে, ওর দাদাকে ও জিজ্ঞেস করে জানাবে না হয়। দাদাভাই তো ফিজিক্সেরই ছাত্র।
মোবাইল হাতে নিয়ে মিথি মেসেজ করে অংশুকে। "এবারের টেস্ট পেপারের পেজ ২৪১ এর কোয়েশ্চেন ২এ টা মাথায় ঢুকছে না। একটু সলভ করে হোয়াটসআপ করে দে তো।" মুহূর্তেই ব্লু টিক। মেসেজ পড়েই অংশুর উত্তর, ওকে। তুই ততক্ষণ রেডিও শোন। ১০৯.৩ মেগাহার্টজ এ। ভালো গান দিচ্ছে পরপর। আমি ততক্ষণ কোয়েশ্চেনটা দেখছি।"
মিথি রেডিও চালায়। সত্যি তো, বেশ ভালো গান। পরপর দুটো হলো। দুটোই ওর ফেভারিট। অনুরোধের আসর গোছের হচ্ছে। লোকজন মেসেজ করে জানাচ্ছে প্রিয় মানুষদের প্রতি ডেডিকেশন। একেকজন বেশ মজার মজার কথা লিখে পাঠাচ্ছে। মন দিয়েই শুনছিলো মিথি। আর ঠিক তখনই আর জে বললো, "আচ্ছা, আজ কিন্তু কিস ডে। জানেন তো? আর সেই উপলক্ষেই পরের মেসেজ। বেশ ইন্টারেস্টিং। লিখেছে অংশু। মেসেজটা পাঠিয়েছে মিথির জন্য। বলছে, সামনেই আমাদের এইচ এস। আজ দেখাসাক্ষাৎ তো হচ্ছে না। তাই পরের গানটা বিশেষ করে ওর জন্য।
"আজ, ঠোঁটের কোলাজ থামালো কাজ
মন তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম..." বাঃ, দারুণ তো। তাহলে এই রইলো বিশেষ দিনে, বিশেষ গান। শুনতে থাকো। এনজয়।"
মিথির মুখ সলজ্জ হাসিতে রাঙা হয়।
(আজ বিশ্ব রেডিও দিবস। সেই উপলক্ষে এই পুঁচকি নিবেদন। রেডিও আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। সাথে নিয়ে অনেক মিষ্টি মধুর স্মৃতি। সে মহালয়ার ভোর হোক, বা অনুরোধের আসর। রেডিও আর আমাদের সম্পর্ক আজকের কথা নয়!)
Wednesday, February 12, 2020
আলিঙ্গন
(১)
ফেব্রুয়ারির কলকাতা। ঠান্ডাটা এখনো যাবো যাবো করেও যায়নি। জলসা পার্টির জন্য সবচেয়ে যথাযথ সময়। রুমিদের ছাদের গানের আসর তাই জমে গিয়েছে। রুমির দাদা ও তার বন্ধুরা, রুমি ও তার বন্ধুরা, সব্বাই হাজির। গান গল্প আর কাবাব সহকারে শীতের রাত জমে যায়, প্রতি বছর। এতক্ষণ রুমিদের "ব্যান্ড"এর গান হলো। বেশিরভাগই হালফিলের বলিউড আর হলিউড। এখন টুকরো বিরতি। বিরতির অবসরেই পিকলু রুমিকে চোখের ইশারায় ডেকে নিয়ে গেল ছাদের একটা নিরিবিলি কোণে। পিকলু, রুমির দাদা সুবুর বেস্ট ফ্রেন্ড। আবার কলেজ হোস্টেলের একদা রুমমেটও। এখন একই অফিসে চাকরিও করে। রুমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায় পিকলুর দিকে। পিকলু বলে, "গানের গলা তোর এত ভালো। এত স্পষ্ট বাংলা ইংরেজি হিন্দি উচ্চারণ। এদিকে গেয়ে বেড়াস যত হাবিজাবি গান। কেন রে?" রুমি পাল্টা প্রশ্ন করে, "কেন, ভালো হয়নি?" পিকলু জবাব দেয়, "তা না। কিন্তু নিজের গুণকে মর্যাদা দিতে পারিস না এইভাবে।" রুমি কিছু বলে না। হাতের কফি কাপটা নামিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে দেয়ালে হেলান দিয়ে। রাতের কলকাতার ঝিকমিক আলো। মায়াবী। টের পায়, পাশে পিকলুও দাঁড়িয়ে আছে। তবে পিকলুর দৃষ্টি ওরই দিকে স্থির। ওর দিকে না ফিরেই রুমি বলে, "কিছু বলবে?" পিকলু চুপ থাকে। তারপর প্রায় মিনিট দুই পর রুমিকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই বন্ধনে রয়েছে অনেকটা আশ্বাস। ভরসা। ভালোবাসা। গাঢ় কণ্ঠে বলে, "পাগলী, ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি তো যাচ্ছি এই মোটে দু বছরের জন্য। ফিরে তো আসবই। ফিরতে তো আমাকে হবেই। আমার এই পাগলীটা রয়ে গেলো যে এখানে।"
নাঃ। রুমি উত্তরে কিচ্ছু বলতে পারে না। শুধু আরো খানিকক্ষণ পিকলুর শরীরের ওমটুকু শুষে নেয়। তারপর কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় স্টেজের দিকে। গিটার হাতে উঠে গাইতে থাকে, মঞ্চে প্রথমবার, রেট্রো গান। রুমির এ যাবৎ সেরা উপস্থাপনা।
"Paas aiye ki ham nahin
Ayenge baar baar
Bahen gale mein daal ke
Ham ro le zaar-zaar
Ankhoon se phir ye
Pyaar ki barsaat ho na ho
Shayad phir is janam mein
Mulakat ho na ho"
(২)
সারা রাত বীভৎস কেটেছে ওদের। ওদের, মানে, রুমি আর পিকলুর। সাত মাসের মেয়ে পুপুলের সারা রাত জ্বর আর তার জেরে বেচারি একটুও ঘুমোতেই পারেনি। কান্নাকাটি করেই চলেছে। নতুন বাবা মাও তাই দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি এক মুহূর্তও। ভোরের দিকে তাও পুপুল শান্ত হয়ে একটু ঘুমোলে, রুমি ল্যাপটপ খুলে নিজের কাজ নিয়ে বসতে পেরেছে। ইন্টারন্যাশনাল অফিসে আজ ওর খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন, বড়সড় ক্লায়েন্টের জন্য। এটায় ভালো করে ওকে আজ কাজ দেখাতেই হবে। কেরিয়ারের উন্নতি অনেকটাই নির্ভর করে আছে আজকের প্রেজেন্টেশনের ওপর। তার ওপর আবার ছয় মাস ম্যাটারনিটি লীভের পর এটাই বড় মঞ্চ, নিজেকে আবার লাইমলাইটে অ্যানার জন্য। সব মিলিয়ে রুমির জন্য আজকের এই দিন একেবারে "ডু অর ডাই"। এমনই দিনে মেয়ের জন্য সারা রাত জেগে থাকতে হলো। মাঝে মধ্যে যে ও কাজের চেষ্টা করছিল না, তা নয়। পিকলু বরং ওকে বারবার বলছিলও, ওই সামলে নেবে। রুমি যেন কাজে মন দেয়। কিন্তু পুপুল যে এতদিন মায়ের সান্নিধ্যেই অভ্যস্ত। পিকলু সবে দশদিন হলো অফিসের কাজ থেকে বাড়ি ফিরেছে। তাই এখনও মেয়ের সাথে তেমন করে সখ্যতা গজিয়ে ওঠেনি।
আটটার দিকে রুমি ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে পড়লো অফিসের জন্য তৈরি হতে। পিকলুও অন্য ঘরে নিজের অফিসের জন্য তৈরি হতে গিয়েছে। দুজনে একসাথে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়বে কাজে। দুজনের অফিস দুই প্রান্তে। দুটো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাবে দুজন। পুপুল থাকবে ন্যানির কাছে। আজ এর মধ্যেই মেয়ের ন্যানি এসে গিয়েছে। ওকে ওষুধপত্র ঠিকমতো বুঝিয়ে দিয়েছে রুমি। কিছুটা নিশ্চিন্ত। তবুও, মায়ের মন, মেয়েকে ফেলে যেতে মন কেমন করছিল। বেরোতে গিয়ে বারবার ব্যাগ ফেলে এলাম, চাবি ফেলে এলাম, এরকম নানান ছুতো করে পুপুলের কাছে ফিরে যাচ্ছিল রুমি। পিকলু খেয়াল করেছে সেটা। চতুর্থবার যখন রুমি "এই যাহ্, জল খেয়ে এলাম না" বলে আবার ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকতে এগোচ্ছে, পিকলু ওকে দু হাত দিয়ে থামিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে বলল, " শোন, এত প্যানিক করিস না তো। শি উইল বি ফাইন। অ্যাবসোলিউটলি ফাইন। তুই প্রেজেন্টেশনে কন্সেন্ট্রেট কর। পুপুলের কাছে তো সীতা রইলোই।" রুমি ধরা গলায় উত্তর দেয়, "মেয়েটাকে জ্বরের মধ্যে ফেলে রেখে যেতে খুব গিলটি ফিলিং হচ্ছে রে।" পিকলু শক্ত করে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে বলে, "সে তো বুঝছি। কিন্তু শোন, তোকে আজ যে অফিস জেতেই হবে। নইলে কিন্তু বড় হয়ে তোর মেয়ে যদি শোনে যে অর কথা ভেবে তুই এমন চান্স মিস করছিস, শি উইল নেভার ফরগিভ ইউ। কাজেই বলি কী? আমি না হয় আজ ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়ে নিই। তুই নিশ্চিন্তে অফিস যা। ওকে?" রুমি শান্ত হয়ে আকড়ে থাকে পিকলুকে। মুহূর্ত থমকে যায়। এইগুলোই তো প্রাপ্তি, এইটুকুই তো চাওয়া-পাওয়া।
পরিস্থিতিগুলো পাল্টে যায়। কিন্তু পাত্র পাত্রী আর আলিঙ্গন, আর তার সাথে লেগে থাকা ভরসাগুলো এক রয়ে যায়। ফোর এভার।
"Hum ko mili hai aaj
Ye ghadiya naseeb se
Je bhar ke dekh leejiye
Hamako kareeb se"
Tuesday, February 11, 2020
কথা... দিলাম
সচরাচর কোথাও টুকটাক কাছাকাছির মধ্যে যাওয়ার হলে নিজের স্কুটিকেই পছন্দ করে জিনিয়া। কিন্তু আজকে মায়ের কড়া নির্দেশে সেই শাড়ি পরতেই হলো। কাজেই ক্যাফেটা বাড়ির কাছে হলেও স্কুটি নিয়ে বেরোতে প্রথমে সাহস না পেলেও ঠাকুর ঠাকুর করে স্কুটিটা নিয়েই বেরলো। শাড়ি পরতে জিনিয়া ভালোইবাসে। তবুও আজ মোটেই ইচ্ছে ছিল না। আজ প্রথমবার দেবমাল্যর সাথে আলাপ করতে যাচ্ছে। জানে, ফার্স্ট ইম্প্রেশনই লাস্ট ইম্প্রেশন। আর তাই ইচ্ছে করেই শাড়ি পরা লুক নিয়ে যেতে চায়নি জিনিয়া। যেটা ওর দৈনন্দিন জীবনের রুটিন না, সেটাকে যে কেন এমন গ্লোরিফাই করা হবে, মাথায় ঢোকেনা। কিন্তু ওই যে, বাড়িতে সাময়িক শান্তিরক্ষার্থে ওকে শুনতেই হয়েছে। একেই এতদিন বিয়ে নিয়ে ওর যে অ্যালার্জি, তার জেরে বাবা মায়ের সাথে নিত্যনৈমিত্তিক ঝামেলা লেগেই থাকতো। অবস্থা যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে যায়, জিনিয়াকে বাধ্য হয়েই রাজি হতে হয় এই আলাপ পর্বের জন্য। দেবমাল্যর সাথে দেখা করতে। দেবমাল্য সুচাকুরে। বেসরকারি ব্যাঙ্কে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। দক্ষিণ কলকাতায় নিজেদের বাড়ি, গাড়ি। দেখতে শুনতেও ভালো। একেবারে যাকে বলে পারফেক্ট পাত্র। না করার উপায় আর কিছুতেই খুঁজে পায়নি জিনিয়া। তবে ঠিক করেছে, এই যে দেখা করতে যাচ্ছে, এতে শাপে বর হলেও হতে পারে। হয়তো আলাপচারিতার সময় দেবমাল্যর কোন বদগুণ চোখে পড়লো, আর সেটাই হবে ওর তুরুপের তাস। বর ভাগানোর।
এই অবধি পড়ে হয়তো পাঠক ভাবছেন যে এ কেমন মেয়ে রে বাবা। সব ব্যাপারে এমন সিনিকাল কেন? দেবমাল্যকে দেখলই না, আগেই কেন ওকে নাকচ করার চিন্তা। তাহলে কি জিনিয়া দেবীর হৃদয় অন্যত্র সমর্পিত? কোন বিশেষ কারণে হয়তো বাড়িতে জানাতে পারছে না। উঁহু। তা কিছুতেই না। জিনিয়ার মা বাবা মাসি কাকি সবাই ওকে জিজ্ঞেস করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কতবার তাঁরা বলেছেন, "হ্যাঁ রে মা, তোর যদি কাউকে পছন্দ থাকে, আমাদের বলতে পারিস। আমরা অবশ্যই ভেবে দেখবো।" তাহলে কী? আসল কথাটা যে কী করে ও বলবে। এই যে ওর একের পর এক ছেলের সাথে বন্ধুত্ব, ভাব, ভালোবাসা। আর তারপর সব্বাই ওকে টাটা বাই বাই করে অন্যত্র চলে যায়। কেউ কথা রাখে না, এটা যে কী করে ও বোঝাবে? বরং ওর ভয়, এইসব কথা বাড়িতে জানালেই মা প্যানিক করতে শুরু করবে এবং তড়িঘড়ি যাকে পাবে তার সাথেই ওর বিয়েটা দিয়েই ছাড়বে। সবাই ভাবে, বিয়ে বুঝি ওর করতে ইচ্ছে করে না। একদমই না। জিনিয়া অবশ্যই চায় ওর প্রত্যেকটা বন্ধুদের মতো ও ও বিয়ে করে সংসার করবে গুছিয়ে। একটা ভালো বন্ধু পাবে। সাথী পাবে, ওর সব খেয়াল খুশীতে সামিল হওয়ার জন্য। ও নিজেও একজনের জীবনের বিশেষ কেউ হবে। এইসব ওর ইচ্ছে করে। আর এই ইচ্ছে নিয়েই তো পরপর ও রোহণ, সুস্মিত, মেঘনাদ সকলকে বিশ্বাস করে, ভরসা করে নিজের সমস্ত অনুভূতি, ইমোশন ইনভেস্ট করেছিল। কিন্তু রিটার্ন? প্রতিবারই সেই এক। জিরো। বারবার লবডঙ্কা খেতে মোটেই ভালো লাগে না জিনিয়ার। কেউ কথা রাখেনা। প্রত্যেকবার ও নতুন সম্পর্কে জড়ানোর আগে নতুনজনকে সমস্ত বলে, নিজের ভয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাস সবটা বলে। তারা কথা দেয়, ছেড়ে যাবে না। কিন্তু ঠিক ডোবায় শেষমেশ। এইসব কারণেই দেবমাল্যর সাথে আলাপ করতে যাওয়া নিয়ে ওর অনীহা। আচ্ছা, যদি দেবমাল্যকে ওর ভালো লাগে। আর তারপর এই ছেলেও যদি সেরকম করে বসে? তাহলে? ও যে আর নিতে পারবে না এই দুঃখ। উঁহু। জিনিয়া ঠিক করে, আজই ওকে এই সম্বন্ধটা কাটানোর জন্য কোন না কোন কারণ খুঁজে বের করতেই হবে।
যথা সময়ে জিনিয়া পৌঁছয় ক্যাফেতে। রিস্ট ওয়াচে সময় দেখে, ৫:২৫। সময় দেওয়া আছে, ৫ঃ৩০। ও ঠিক ৫ঃ৪০ অবধি গ্রেস দেবে, যদি এর মধ্যে দেবমাল্য না এসে পড়ে, ব্যস, তাহলেই কেল্লা ফতে। নাকচ করার কারণ, এক্কেরে হাতে নাতে পেয়ে যাবে জিনিয়া। লেট লতিফদের ও একদম সহ্য করতেই পারে না। হেলমেটটা খুলে স্কুটির মিররে একবার চুলটা ঠিক জিনিয়া দরজা ঠেলে ঢুকল ভিতরে। একটু ইতস্তত করেই এদিক ওদিক তাকাতে গিয়েই চোখে পড়লো পিছনের দিকে কোণার টেবিলে বসে আছে দেবমাল্য। হ্যাঁ, ছবির সাথে মিল আছেই। আর পরেওছে সেই ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট আর ব্লেজার। চোখে সরু ফ্রেমের চশমা। ক্লিন শেভড। জিনিয়াকে দেখে উঠে আসছে। যাহ্, প্রথম পয়েন্টেই বাদ পড়লো না তাহলে? জিনিয়া মনে মনে একটু হতাশ হলো বটে। তার ওপর আবার এমন শিভালরাস, উঠে এগিয়ে এলো। হুম। বেশ কঠিন। সৌজন্যমূলক নমস্কার প্রতি-নমস্কার পর্ব চলল। এইবার কিছু অর্ডার করার পালা। এইটাও বেশ একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়। সেই যে মুন্নাভাই সিনেমায় দেখিয়েছিল এই টোটকা, ওয়েটারকে কীভাবে ডাকছে, সেই দিয়ে চরিত্র বোঝা যায়। জিনিয়াকে বেশ কোমলস্বরেই দেবমাল্য জিজ্ঞেস করলো, "তাহলে কিছু অর্ডার করা যাক? কী খাবেন? মেনু দেখুন।" জিনিয়া মাথা নেড়ে বলে, "আমার জন্য কোল্ড কফি। আপনি পছন্দসই কিছু দেখুন।" দেবমাল্য এইবার একটু ঘাড় উঁচু করে ওয়েটারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটু জোরে বলল, "এক্সকিউজ মি। অর্ডার করতে চাই।" আহা, অপ্রয়োজনে ইংরেজি বলে না। জিনিয়ার ভালো লাগে। আরো ভালো লাগে যে জিনিয়ার দেখাদেখি নিজের জন্যও একই জিনিস অর্ডার না করে, স্বতন্ত্র পছন্দে টিকে থেকে হট চকলেট বলে। আর অর্ডার দেওয়ার পর ওয়েটারকে থ্যাঙ্ক ইউও বলে।
খাবার আসে। ওরা খেতে শুরু করে। সাথে চলতে থাকে টুকটাক গল্পকথা। কেরিয়ার অ্যাসপিরেশন, চাকরি এইসব নিয়ে কথা শুরু হলেও খুব শিগগিরই কথা ঘুরে যায় বই আর বেড়ানোয়। দুজনেরই কমন গ্রাউন্ড। একে অপরকে পছন্দের বই-লেখক নিয়ে বলে। দেবমাল্য আদ্যোপান্ত বাংলা সাহিত্যের ভক্ত। সমস্ত ক্লাসিক্স প্রায় পড়া। এদিকে জিনিয়া আবার ইংরেজি সাহিত্যেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। আচ্ছা, তাহলে এই বলে কি একে বাতিল করা যায়? ভাবতে থাকে জিনিয়া। দেখাই যাক না। কথা কেমন এগোয়। এইবার সাহিত্য সরণী হয়ে ওরা পৌঁছে যায় পাহাড়ে, সমুদ্রে, জঙ্গলে। কলেজ জীবনে বিদেশে থাকার সুবাদে দেবমাল্য যে নানান জায়গায় অ্যাডভেঞ্চার করেছে, সেই সব গল্প করে জিনিয়াকে। ছেলেটি কথা বলে ভালো। একদম মোহিত হয়ে শোনে জিনিয়া। একটু একটু কি তবে ভালো লাগছে ওকে? জিনিয়ার একটু অস্বস্তি হয়। পরপর দেখছে, সবই ভালো। তাহলে কাটাবে কী করে? আর এমনই সুন্দর কথা বলছে, জিনিয়ার তো বেশ পছন্দই হচ্ছে ওকে।
দেখতে দেখতে ঘন্টা দেড়েক যে কখন পেরিয়ে যায়, খেয়ালই করে না ওরা। কোল্ড কফি আর হট চকলেটও শেষ। এইবার যে উঠতে হয়। বাড়ি ফিরলেই তো মা জিজ্ঞেস করবে, কী ভারডিক্ট? কী যে বলবে? আজ তো কিছুই খুঁজে পেলো না নাকচের কারণ। হয়তো আর এক দুবার দেখা করলে ঠিক মাইনাস পয়েন্ট বেরিয়েই যাবে। আর জিনিয়া জানে, মাইনাসের ঝুলি কিন্তু বেশ বেশ ভারী হতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে, পজিটিভের ঝোলা খুবই শক্তপোক্ত, ভারী। দেবমাল্য বেরনোর সময় দরজা খুলে দেয় ওর জন্য। জিজ্ঞেস করে, ওকে কোথাও ড্রপ করতে হবে কি না। জিনিয়া যে স্কুটি চালিয়ে এসেছে, দেখে ওর চোখ চকচক করে। রীতিমতো শিশুর মতোই উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে, "আমার জানো তো, স্কুটি বাইক এইসব চালানোর শখ খুব। কিন্তু মা বাবা অ্যালাউ করেনি কখনও। আর তারপর তো ফোর উইলারে চলে এলাম। আমায় শেখাবে? আমি কিন্তু সাইকেল চালাতে জানি। ঠিক পারবো।" জিনিয়া অবাক চোখে তাকায় দেবমাল্যর দিকে। আর কখনও দেখা হবে কি না ওদের, তার ঠিক নেই। এদিকে ছেলের আব্দার দেখো? ও সে কথা মজার ছলে বলেও দেবমাল্যকে। মুহূর্তেই দেবমাল্যর মুখের ওপর দিয়ে যেন একটা কালির ছায়া চলে যায়। কিঞ্চিত আহত কন্ঠেই বলে, "এই যাহ্। আমি তাহলে কি এতটাই বোর করলাম তোমায়? ভেরি সরি। আসলে বুঝতে পারি নি।" জিনিয়া কিছু বলে না। এগিয়ে যায় স্কুটির পারকিং লটের দিকে। পিছন থেকে শুনতে পায় দেবমাল্য বলছে, "পৌঁছে একটা মেসেজ করে দিয়ো। দিয়ো কিন্তু। আমি চিন্তায় থাকবো।"
কে জানে কী হলো এই মিটিঙে আজ, জিনিয়া একটু ফুরফুরে মেজাজেই স্কুটি চালিয়ে বাড়ি ফেরে। বাড়ির দরজার মুখেই অবশ্য সেই পুরনো ভয় আবার ফিরে আসে। কী বলবে ও বাড়িতে? হ্যাঁ? নাকি না? ঠাকুর ঠাকুর করে বেল বাজায়। মা দরজা খোলে। মায়ের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করে জিনিয়া। কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা চলে যায় বেডরুমে। দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। রেডিওটা চালায়। ইভনিং শো চলছে। পরপর সেই ঢিঞ্চ্যাক রিমিক্স গান। ফোনটা হাতে নেয়। দেবমাল্যর নম্বরে চ্যাটবক্সটা খোলে। কী লিখবে? ভেবে পায় না। শুধু ছোট করে একটা "রিচড" লিখে ছেড়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দেবমাল্য অনলাইন। মেসেজ ব্লু টিক। তারপর "টাইপিং"। "টাইপিং"। "টাইপিং"। বাবা, এত কী লিখছে? তখন থেকেই "টাইপিং"। মিনিট পাঁচেক পর উত্তর এলো, "বেশ। আমিও।" রাগ হয় জিনিয়ার। এইটুকু লিখতে পাঁচ মিনিট? পরমুহূর্তেই মনে হয়, আচ্ছা, এইটুকু মেসেজ দেখে রাগ হলো কেন ওর? তাহলে কি ও অন্য কিছু আশা করছিল? কে জানে? নিজের মনকে নিজেই বুঝে ওঠে না জিনিয়া। দোনামনা করতে করতে নিজেই আবার মেসেজ পাঠায়, "এইটা লিখতে পাঁচ মিনিট?" সটান উত্তর আসে, "উঁহু। অনেক কিছু লিখেছিলাম। সব ব্যাক্সপেসের আড়ালে চলে গিয়েছে। অভয় দাও তো বলি?" জিনিয়া লেখে, "বলো।" এরপর আবার সেই "টাইপিং" এর অপেক্ষা। মিনিট পাঁচেক পর এইবারে লম্বা মেসেজ। "জিনিয়া, জানি না তোমার আমাকে কেমন লেগেছে। কিন্তু আমার তোমায় খুব পছন্দ হয়েছে। মনে হলো যেন অনেকদিন পর সেই স্কুল কলেজের বন্ধুদের মতো জমিয়ে একটা প্রাণখোলা আড্ডা দিয়েছি। আমাদের মিলের চেয়ে বেশি অমিল। তবুও তার মধ্যেই দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে গল্প তো করলাম। আমাদের বিয়ের কথা এগোবে কি না, জানি না। তোমার ওপরই না হয় ছেড়ে দিলাম। আমার দিক থেকে তো হ্যাঁ। কিন্তু একটা অনুরোধ করি? অন্তত বন্ধু হয়ে থেকো। প্লিজ? আর হ্যাঁ, কথা দিলাম। তোমার বন্ধুত্বকে সব সময় সম্মান করবো। বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়া এই বয়সে এসে, একটু কঠিন। তবে কী জানো, কঠিন কঠিন প্রব্লেম সল্ভ করি তো সারাদিন অফিসে, তাই এইসবের ব্যাপারে আমি কনফিডেন্ট। তুমি প্রশ্রয় দিলেই পারবো। শুধু কথা দিয়ো, আমায় সুযোগ দেবে। আমি প্রমিস করছি, ঠকাবো না। আর কখনো আক্ষেপের জায়গা রাখবো না। এবার, তুমি সুযোগ দেবে কি না, দেখো?"
বেশ কয়েকবার মেসেজটা পড়ে জিনিয়া। বিহ্বল। কী বলবে? কী লিখবে এর উত্তরে?
রেডিওতে হঠাৎ বাজতে থাকে
" I feel love when I look into your eyes
I believe if you move out from my side
I'll be losin'; I'll be losin' grip on you
Grip on you
देखो क़रीब से, मिले हैं नसीब से
आएगा पल ये फिर कहाँ
आज अचानक तुमसे मिले हम
ये तो नहीं है बेवजह
पूछो ज़रा इस दिल से, हम हैं मिले मुश्किल से
कल फिर ना हों हम जो यहाँ
ग़ज़ब का है दिन, सोचो ज़रा
ये दीवानापन देखो ज़रा
तुम हो अकेले, हम भी अकेले
मज़ा आ रहा है, क़सम से, क़सम से"
Monday, February 10, 2020
ভোর পাঁচটার অ্যালারম বাজার সাথে সাথে প্রতিদিনের মতোই মুখ ব্যাজার করে চোখ খোলে পালি। ভুরু কুঁচকে হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে মনে করে নেয় সারাদিনের রুটিন। অবশ্য এতদিনে রুটিন মুখস্থ। এই কোনমতে উঠে স্নান সেরে চা করে ঝটপট নিজের টিফিন তৈরি। তারপর ধ্বনিতের জন্য ব্রেকফাস্ট গুছিয়ে কোনমতে আগের রাত্রের রুটি সব্জি গরম করে মুখে ঠুসে সাড়ে ছটার মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে মেট্রো স্টেশন। সাড়ে সাতটায় স্কুল শুরু। নতুন নিয়মে ক্লাস চলাকালীন একবারও বসতে পারা যাবে না। আজ বৃহস্পতিবার, তার মানে আজ টানা ছয় পিরিয়ড। কপাল খারাপ থাকলে সেভেন্থ পিরিয়ডেও না সাবস্টিটিউটে পাঠিয়ে দেন প্রিন্সিপাল। প্রাইভেট চাকরি, কিচ্ছু বলার উপায় নেই। আর ভালো লাগেনা। প্রতিদিনের এই প্রায় অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে দিন শুরু করে দেওয়া। অথচ কিছু বছর আগে, বিয়ের আগে, যখন ধ্বনিতের সাথে প্রেম পর্ব চলছে, তখন এই সময়টাই ছিল কতটা মধুর। মিষ্টি। পালির মনে পড়ে যায়। একদিন কী জানি কথা প্রসঙ্গে ও বলেছিল ধ্বনিতকে। "জানো ধ্বনিত, আমার ইচ্ছে করে ভোরবেলা ছাদে শুয়ে শুয়ে তারা দেখবো। তারা দেখতে দেখতে কখন জানি আকাশ ফর্সা হয়ে যাবে। কী ভালো লাগবে। তাই না?" সেদিন ধ্বনিত কিছু বলেনি বটে। কিন্তু পরেরদিন
Sunday, February 9, 2020
সম্পর্কের মূর্ছনা
সুচেতনা
রুকু যে গ্র্যান্ড পিয়ানোটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরে, ব্যাপারটা এড়ায়নি শাম্বর চোখে। কিন্তু ওই এইসব দেখার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করা এই মুহূর্তে সম্ভব না ওর। রুকু আর শাম্ব, সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি। মধুচন্দ্রিমায় এসেছে উত্তরবঙ্গের এক চা বাগানে। ম্যানেজার্স কোয়ার্টারকেই এখন সাজিয়ে গুছিয়ে বেশ হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, চড়া দামে। শাম্ব রুকুর মতো নবদম্পতিরা বেশ এখানে এসে নিরিবিলিতে সুন্দর পরিবেশে কটা দিন খুব আনন্দে কাটিয়ে ফিরে যায় নাগরিক সভ্যতায়।
প্রথম দিন এখানে এসেই রাজকীয় ব্যবস্থাপনা দেখে রুকুর চোখে মুখে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক খেলে যাচ্ছিল। শাম্ব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল স্ত্রীর এই খুশী। রুকু আর শাম্ব সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। শাম্বদের বাড়ি থেকে মোটে কয়েকটা বাড়ি পরেই রুকুর মামাবাড়ি। রুকু স্কুলবেলায় মা বাবা দুজনকেই হারানোর ফলে ঠাকুমা দাদুর কাছে মানুষ। তবে পুজোর ছুটি গ্রীষ্মের ছুটিতে মামাবাড়িতেই থাকতো। আর সেই সূত্রেই দুজনের আলাপ। বন্ধুত্ব। এবং বেশ খানিকটা বড় হওয়ার পর বোঝা যে একে অপরকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব। আর তারপরই দুজনের বিয়ে।
শাম্ব আর রুকু দুজনেই চাকরি করে। শাম্ব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। আর রুকু সরকারী কলেজে। বৌভাতের সকালে যখন ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান হয়, শাম্ব তখন বড়দের শিখিয়ে দেওয়া কথার সাথে নিজে থেকে যোগ করে বলে, "আজ থেকে তোর সমস্ত শখ আহ্লাদ পূরণের দায়িত্ব আমার।" রুকু ঘাড় কাত করে হেসেছিল। আসলে শাম্ব জানে, রুকুর ছোটবেলাটা সাদামাটা না হলেও, অসাধারণ ছিল না। ওর অনেক শখ আহ্লাদই আলমারির কোণায় কোণায় ধুলোয় চাপা পড়ে রয়েছে। ওর ইচ্ছে, একে একে ওর সব ইচ্ছেপূরণ ওই করবে। সাধ্য মতো।
রুকুর গানের গলা অসম্ভব ভালো। মিশনারি স্কুলে পিয়ানো বাজিয়ে গান শিখেছে। রীতিমতো স্টেজেও অনুষ্ঠান করেছে। কিন্তু পিয়ানো কেনার সামর্থ্য কখনো হয়ে ওঠেনি ওর। আর তাই এই ম্যানেজার্স কোয়ার্টারে এসে পিয়ানোটার প্রতি ছিল রুকুর আলাদা আকর্ষণ। প্রথমদিন থেকেই ওটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ও। ওদের থাকার তিনদিন, দুবেলা পিয়ানোতে বেশ খানিকটা সময় কাটাতো ওরা। রুকু বাজাতো, গান গাইতো। শাম্ব মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতো সাদা কালো কীয়ের ওপর দিয়ে রুকুর আঙুলের নৃত্য। আর শুনতো ওর মধুর কণ্ঠে গান। আজকেই শেষ এই ট্যুর। কাল সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়া। বাগডোগরা থেকে দুপুরের ফ্লাইটে বাড়ি ফেরা, পরিচিত ছন্দে। আর কাল থেকে এই পিয়ানোটার কাছে বসা হবে না। রুকু যেন আজ একটু বেশিই আঁকড়ে ছিল গ্র্যান্ড পিয়ানোটাকে। আর নিজের অক্ষমতা ভেবে ভেবে মরমে মরে যাচ্ছিল শাম্ব। কিছু একটা করতেই হবে ওকে।
পরেরদিন যথাসময়ে প্লেন ধরে কলকাতা পৌঁছলো ওরা। প্রিপেড ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি। ট্যাক্সিতে এক দুবার কাউকে ফোনে বাড়ির নির্দেশ দিচ্ছিল শাম্ব। রুকুর কানে ইয়ারফোন। ও খেয়াল করেনি। বাড়ি ফিরে শাম্ব ঢুকে পড়ল বাথরুমে। ফ্রেশ হতে। রুকুও পোশাক বদলাবে বলে আলমারি খুলছে, এমন সময় ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা বেজে ওঠে। কে এলো, একটু অবাক হয়। দরজা খুলে দেখে একজন ফুড ডেলিভারি এজেন্ট। হাসিমুখে বলে, "আপনি মিসেস রুক্মিণী তো? আপনার জন্য ডেলিভারি আছে।" রুকু অবাক। ও বলে, "কিন্তু, কিন্তু আমি তো কিছু অর্ডার করিনি।" আর তখনই পাশ থেকে শুনতে পায় শাম্বর কন্ঠ। "আমি অর্ডার করেছি। নিয়ে নাও।" "থ্যাংক ইউ ভাই" বলে ছেলেটিকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢোকে শাম্ব। রুকু টেবিলে কেকের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাক। শাম্ব বলে, "খুলেই দেখ।" রুকু সেলোটেপ কাটে বাক্সের। ঢাকনা খুলে দেখে একটা চকোলেট কেক। ম্যানেজার্স কোয়ার্টারের পিয়ানোটার আদলে। শাম্বর দিকে তাকায়, বিহ্বল হয়ে। শাম্ব গাঢ় স্বরে বলে, "হ্যাপি চকোলেট ডে রুকু। আপাতত ওটা দিয়ে কাজ চালা। আই প্রমিস, টেন্ট এনিভার্সারিতে আসলটা তোকে দেবই।" রুকুর দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে খুশির অশ্রু। শাম্বরও মন তৃপ্তিতে ভরপুর। এইসব ব্যবস্থা করা চারটি খানি কথা ছিল না। সব যে ভালোয় ভালোয় মিটেছে, এইটাই প্রাপ্তি।
সুচেতনা
রুকু যে গ্র্যান্ড পিয়ানোটার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ ধরে, ব্যাপারটা এড়ায়নি শাম্বর চোখে। কিন্তু ওই এইসব দেখার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করা এই মুহূর্তে সম্ভব না ওর। রুকু আর শাম্ব, সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি। মধুচন্দ্রিমায় এসেছে উত্তরবঙ্গের এক চা বাগানে। ম্যানেজার্স কোয়ার্টারকেই এখন সাজিয়ে গুছিয়ে বেশ হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, চড়া দামে। শাম্ব রুকুর মতো নবদম্পতিরা বেশ এখানে এসে নিরিবিলিতে সুন্দর পরিবেশে কটা দিন খুব আনন্দে কাটিয়ে ফিরে যায় নাগরিক সভ্যতায়।
প্রথম দিন এখানে এসেই রাজকীয় ব্যবস্থাপনা দেখে রুকুর চোখে মুখে অনাবিল আনন্দের ঝিলিক খেলে যাচ্ছিল। শাম্ব তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল স্ত্রীর এই খুশী। রুকু আর শাম্ব সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। শাম্বদের বাড়ি থেকে মোটে কয়েকটা বাড়ি পরেই রুকুর মামাবাড়ি। রুকু স্কুলবেলায় মা বাবা দুজনকেই হারানোর ফলে ঠাকুমা দাদুর কাছে মানুষ। তবে পুজোর ছুটি গ্রীষ্মের ছুটিতে মামাবাড়িতেই থাকতো। আর সেই সূত্রেই দুজনের আলাপ। বন্ধুত্ব। এবং বেশ খানিকটা বড় হওয়ার পর বোঝা যে একে অপরকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব। আর তারপরই দুজনের বিয়ে।
শাম্ব আর রুকু দুজনেই চাকরি করে। শাম্ব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। আর রুকু সরকারী কলেজে। বৌভাতের সকালে যখন ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান হয়, শাম্ব তখন বড়দের শিখিয়ে দেওয়া কথার সাথে নিজে থেকে যোগ করে বলে, "আজ থেকে তোর সমস্ত শখ আহ্লাদ পূরণের দায়িত্ব আমার।" রুকু ঘাড় কাত করে হেসেছিল। আসলে শাম্ব জানে, রুকুর ছোটবেলাটা সাদামাটা না হলেও, অসাধারণ ছিল না। ওর অনেক শখ আহ্লাদই আলমারির কোণায় কোণায় ধুলোয় চাপা পড়ে রয়েছে। ওর ইচ্ছে, একে একে ওর সব ইচ্ছেপূরণ ওই করবে। সাধ্য মতো।
রুকুর গানের গলা অসম্ভব ভালো। মিশনারি স্কুলে পিয়ানো বাজিয়ে গান শিখেছে। রীতিমতো স্টেজেও অনুষ্ঠান করেছে। কিন্তু পিয়ানো কেনার সামর্থ্য কখনো হয়ে ওঠেনি ওর। আর তাই এই ম্যানেজার্স কোয়ার্টারে এসে পিয়ানোটার প্রতি ছিল রুকুর আলাদা আকর্ষণ। প্রথমদিন থেকেই ওটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ও। ওদের থাকার তিনদিন, দুবেলা পিয়ানোতে বেশ খানিকটা সময় কাটাতো ওরা। রুকু বাজাতো, গান গাইতো। শাম্ব মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতো সাদা কালো কীয়ের ওপর দিয়ে রুকুর আঙুলের নৃত্য। আর শুনতো ওর মধুর কণ্ঠে গান। আজকেই শেষ এই ট্যুর। কাল সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়া। বাগডোগরা থেকে দুপুরের ফ্লাইটে বাড়ি ফেরা, পরিচিত ছন্দে। আর কাল থেকে এই পিয়ানোটার কাছে বসা হবে না। রুকু যেন আজ একটু বেশিই আঁকড়ে ছিল গ্র্যান্ড পিয়ানোটাকে। আর নিজের অক্ষমতা ভেবে ভেবে মরমে মরে যাচ্ছিল শাম্ব। কিছু একটা করতেই হবে ওকে।
পরেরদিন যথাসময়ে প্লেন ধরে কলকাতা পৌঁছলো ওরা। প্রিপেড ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি। ট্যাক্সিতে এক দুবার কাউকে ফোনে বাড়ির নির্দেশ দিচ্ছিল শাম্ব। রুকুর কানে ইয়ারফোন। ও খেয়াল করেনি। বাড়ি ফিরে শাম্ব ঢুকে পড়ল বাথরুমে। ফ্রেশ হতে। রুকুও পোশাক বদলাবে বলে আলমারি খুলছে, এমন সময় ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা বেজে ওঠে। কে এলো, একটু অবাক হয়। দরজা খুলে দেখে একজন ফুড ডেলিভারি এজেন্ট। হাসিমুখে বলে, "আপনি মিসেস রুক্মিণী তো? আপনার জন্য ডেলিভারি আছে।" রুকু অবাক। ও বলে, "কিন্তু, কিন্তু আমি তো কিছু অর্ডার করিনি।" আর তখনই পাশ থেকে শুনতে পায় শাম্বর কন্ঠ। "আমি অর্ডার করেছি। নিয়ে নাও।" "থ্যাংক ইউ ভাই" বলে ছেলেটিকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢোকে শাম্ব। রুকু টেবিলে কেকের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাক। শাম্ব বলে, "খুলেই দেখ।" রুকু সেলোটেপ কাটে বাক্সের। ঢাকনা খুলে দেখে একটা চকোলেট কেক। ম্যানেজার্স কোয়ার্টারের পিয়ানোটার আদলে। শাম্বর দিকে তাকায়, বিহ্বল হয়ে। শাম্ব গাঢ় স্বরে বলে, "হ্যাপি চকোলেট ডে রুকু। আপাতত ওটা দিয়ে কাজ চালা। আই প্রমিস, টেন্ট এনিভার্সারিতে আসলটা তোকে দেবই।" রুকুর দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে খুশির অশ্রু। শাম্বরও মন তৃপ্তিতে ভরপুর। এইসব ব্যবস্থা করা চারটি খানি কথা ছিল না। সব যে ভালোয় ভালোয় মিটেছে, এইটাই প্রাপ্তি।
Saturday, February 8, 2020
বইমেলা, উৎসর্গ, ইত্যাদি
শহরে বইমেলা চলছে। কিন্তু ঋজুর এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলে কথা। হুট হাট তো আর উইকডেগুলোয় বেরিয়ে পড়া যায় না। গত উইকেন্ডটা কেটেছে মেলবোর্নে, কনফারেন্সে। হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে, আগামী এক দু মাসের মধ্যেই মেলবোর্ন চলে যাবে ঋজু, আপাতত বেশ কিছু বছরের জন্য। কলকাতার পাট চুকিয়ে। আর তাই কলকাতা বইমেলায় আর ফেরা হয়তো হবেনা। সেই জন্যই এই উইকেন্ডে যে কোনোভাবেই হোক, ঋজুকে বইমেলায় যেতেই হবে। অন্তত একবার। হ্যাঁ, ঋজু বইয়ের পোকা বলাই যায়। সেই স্কুলবেলা থেকেই লেখাপড়া কাজের বইপত্রের সাথে সাথে গল্পের বই সব সময় ব্যাগে থাকেই থাকে। এখনও প্রতিদিন রাত্তিরে শোয়ার আগে অন্তত তিরিশ চল্লিশ পাতা না পড়লে ঘুম হয়না ওর। এমন নয় যে বইমেলা ছাড়া কেনা হয়না। কিন্তু তাও, কলকাতা বইমেলার সাথে একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়া কাজ করে ঋজুর। বাবার হাত ধরে ময়দানের বইমেলা হয়ে প্রেমিকাদের সাথে মিলনমেলা প্রাঙ্গন। ঋজু চায় বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা নিজের দুই সন্তানের মধ্যেও সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে। আর তাই আজ বইমেলা যেতেই হবে তাতান ও তিতিরকে নিয়ে।
ঝটপট এগারোটার মধ্যে ব্রাঞ্চ সেরে ওলা চেপে ছেলে মেয়েকে নিয়ে মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে যায় ঋজু। বারোটা বাজতে দশ মিনিট। গেটের বাইরে লম্বা লাইন। এখনো যে বইপ্রেমী মানুষের এত ভিড়, দেখেও ভালো লাগে ঋজুর। একটা সময় যখন কলেজে পড়তো, বইমেলার লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে কত সময় কাটাতো। সেকেন্ড আর থার্ড ইয়ারে তো নিজেদের ম্যাগাজিনও বের করেছিল। কত কাঠখড় পুড়িয়ে। পালা করে নিজেদের টেবিলে বসে থাকতো ঋজু মল্লিকা শামসুর অনিতা মালঞ্চ আর শালুক। শালুক। নামটা মনে করলেই এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে যায় ঋজুর। যেমন মিষ্টি নাম, তেমনি মিষ্টি স্বভাবের ছিল মেয়েটি। প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। কলকাতায় এসেছিল মেধার জোরে। ওদের সাথে আলাপ এই লেখালিখি ম্যাগাজিনের সূত্রেই। বাংলা বিভাগের রত্ন ছিল শালুক।
মেলা খুলতেই ঋজু ছেলে মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে চলে প্রিয় সব স্টলে। খুঁজে খুঁজে ছোটবেলার প্রিয় বইগুলি কিনে দেয় তাতান তিতিরকে। ওরাও রঙ বেরঙের এইসব বই পেয়ে খুশি। কমিক্সই বেশি কিনেছে ঋজু ওদের জন্য। অন্তত আকর্ষক ছবির সূত্র ধরে অন্তত বইয়ের অভ্যেসটা শুরু হোক ওদের। তারপর না হয় অন্য বই কিনবে। এরকমই ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এসে পৌঁছলো ও লিটিল ম্যাগাজিনের টেবিলগুলিতে। পসরা সাজিয়ে সেখানে বসে আছেন অনেকেই। ক্রেতার ভিড় একটু কম। ঋজু ঠিক করলো সময় নিয়ে প্রতিটি টেবিলে যাবে, উল্টে পাল্টে দেখবে বই। পছন্দ হলে কিনবে। এগোতে থাকে ও। বই হাতে নেয়। অনুভব করার চেষ্টা করে একেকটি বইয়ের পিছনে এতগুলো মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমকে। কন্টেন্ট পছন্দ হলে কিনে ফেলে। ইতিমধ্যেই বইয়ের প্যাকেটে দুই হাত ভরে গিয়েছে ঋজুর। ছেলেমেয়েদের হাতেও কিছু প্যাকেট। তবু, এই ভার বয়ায় আনন্দ অপরিসীম। ঘুরতে ঘুরতে একটা টেবিলে একটা বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে একটু থমকে দাঁড়ায় ঋজু। "আমাদের সেইদিন"। লেখিকা শালুক গোস্বামী। আরে, এ যে ওদের শালুক। বইয়ের পিছনে লেখক পরিচিতি পড়ে ঋজু। শালুক এখন লন্ডনে বাংলা পড়ায়। পেশা অধ্যাপনা হলেও নেশা সাহিত্য। বাঃ, ওদের মধ্যে তাহলে একমাত্র শালুকই কথা রাখলো। নিজের বই বের করতে পারলো। মন ভালো হয় ঋজুর। এইবারে সামনের পাতা খোলে। উৎসর্গ পড়ে স্তম্ভিত হয়।
লেখা আছে "ঋজুদাকে। জানি, তুমি ঠিক একদিন এই বই পড়বেই। আমার মন বলছে। তুমি বলতে, 'শালুক, বই বের করতেই হবে তোকে। তোর মধ্যে লেখাটা আছে।' আমি হাসতাম। বলতাম, 'কে পড়বে আমার লেখা?' তুমি বলতে 'আর কেউ পড়ুক না পড়ুক, আমি পড়বই।' আমি বলতাম, 'সে তো তুমি পাণ্ডুলিপি পড়বেই। তুমিই আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি পড়বে। কী, পড়বে তো?' তুমি হাসতে। হ্যাঁ না বলতে না কিছু। আমি পাগলী। ধরেই নিতাম, মৌনতা মানেই সম্মতি। কিন্তু বুঝিনি যে শালুক ফুল ফোটে কেবল পুকুরে। নদী পাহাড় জঙ্গলে তার স্থান নেই। ঋজুদা, জানো তো, আমি এখন থাকি একটা ব্যস্ত শহরে। ভিড়। লোক। ট্র্যাফিক। হট্টগোল। আমার অনেক স্টুডেন্ট। অনেক পরিচিত। বন্ধুবান্ধব। কিন্তু তবুও, কোথায় যেন বড্ড একা। দেখো না, একদিন তোমার এই শালুকফুলকে যদি একটু সময় দাও? দেবে? আমি অপেক্ষায় থাকবো। আমি জানি, তুমি এই লেখা পড়বেই পড়বে। কী করে জানলাম? ওই যে, আমাদের প্রিয়গান, 'তেরা মুঝসে হ্যায় পেহলে কা নাতা কই...' কোনো এক জন্মে আমরা নিশ্চয়ই এক ছিলাম বা হবো। দেখো... এইবারে না। এই জন্মে অন্তত এই উৎসর্গটা স্বীকার করো। ভালো লাগবে আমার।
ভালো থেকো ঋজুদা।"
ঋজু কোনো কথা বলতে পারে না। দু চোখের কোণে জল চিকচিক করে। কোনোমতে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে বইটা ব্যাগে ভরে হনহন করে এগিয়ে যায় মেলার গেটের দিকে। তাতান তিতির অবাক। নানান কথা জিজ্ঞেস করে, আবদার করে আরেকটু ঘুরতে। ঋজু কিছু বলে না। এগিয়ে চলে। ওর যে আজ তাড়া আছে। খুব তাড়া। এ বই ওকে পড়তেই হবে। এক্ষুণি।
লেখা আছে "ঋজুদাকে। জানি, তুমি ঠিক একদিন এই বই পড়বেই। আমার মন বলছে। তুমি বলতে, 'শালুক, বই বের করতেই হবে তোকে। তোর মধ্যে লেখাটা আছে।' আমি হাসতাম। বলতাম, 'কে পড়বে আমার লেখা?' তুমি বলতে 'আর কেউ পড়ুক না পড়ুক, আমি পড়বই।' আমি বলতাম, 'সে তো তুমি পাণ্ডুলিপি পড়বেই। তুমিই আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি পড়বে। কী, পড়বে তো?' তুমি হাসতে। হ্যাঁ না বলতে না কিছু। আমি পাগলী। ধরেই নিতাম, মৌনতা মানেই সম্মতি। কিন্তু বুঝিনি যে শালুক ফুল ফোটে কেবল পুকুরে। নদী পাহাড় জঙ্গলে তার স্থান নেই। ঋজুদা, জানো তো, আমি এখন থাকি একটা ব্যস্ত শহরে। ভিড়। লোক। ট্র্যাফিক। হট্টগোল। আমার অনেক স্টুডেন্ট। অনেক পরিচিত। বন্ধুবান্ধব। কিন্তু তবুও, কোথায় যেন বড্ড একা। দেখো না, একদিন তোমার এই শালুকফুলকে যদি একটু সময় দাও? দেবে? আমি অপেক্ষায় থাকবো। আমি জানি, তুমি এই লেখা পড়বেই পড়বে। কী করে জানলাম? ওই যে, আমাদের প্রিয়গান, 'তেরা মুঝসে হ্যায় পেহলে কা নাতা কই...' কোনো এক জন্মে আমরা নিশ্চয়ই এক ছিলাম বা হবো। দেখো... এইবারে না। এই জন্মে অন্তত এই উৎসর্গটা স্বীকার করো। ভালো লাগবে আমার।
ভালো থেকো ঋজুদা।"
ঋজু কোনো কথা বলতে পারে না। দু চোখের কোণে জল চিকচিক করে। কোনোমতে ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে বইটা ব্যাগে ভরে হনহন করে এগিয়ে যায় মেলার গেটের দিকে। তাতান তিতির অবাক। নানান কথা জিজ্ঞেস করে, আবদার করে আরেকটু ঘুরতে। ঋজু কিছু বলে না। এগিয়ে চলে। ওর যে আজ তাড়া আছে। খুব তাড়া। এ বই ওকে পড়তেই হবে। এক্ষুণি।
Friday, February 7, 2020
রোজ ডে
লাঞ্চের পর একটু কাজ থেকে বিরতি নেয় পাল্কি। এই সময়টাতে একটু টুকটাক সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ঘুরে আসে। বেশিরভাগ দিনই এইসময়ে ও বিভিন্ন গ্রুপে যে লেখালিখির চর্চা হয়, সেইসব পড়ে। তারপর আবার ফিরে আসে কাজের মধ্যে। আজকেও তার ব্যতিক্রম নেই। আজ সর্বত্রই অবশ্য লেখালিখিতে ভালোবাসার গল্প, প্রেমের উচ্ছ্বাস। ডেস্ক ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে খেয়াল পড়লো, ও, আজ তো সাত। ভালোবাসার সপ্তাহ শুরু। আপনমনেই হাল্কা হাসি হাসে পাল্কি। মনে পড়ে যায় ফেলে আসা একটা রোজ-ডের কথা।
তখন সবে ফার্স্ট ইয়ার। অদিতের সাথে আলাপ হয়ে গিয়েছে। এমনই এক রোজ-ডে'তে, এইট বি'তে অটোর লাইনে দুজনে দাঁড়িয়ে। ওরা তখন মেট্রো স্টেশন অবধি একসাথে যায়। তারপর পাল্কি ঢুকে যায় পাতালে, অদিত এগিয়ে যায় ওর কলেজ বাসের দিকে। সারাদিনে এইটুকুই ওদের দেখা। সেদিন রাস্তার ধারের ফুলের দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়। ছেলে মেয়েরা ভিড় করে কিনছে সেই লাল গোলাপ। দুজনেই হাল্কা হাসে এইসব দেখে। অদিত তো আবার আগ বাড়িয়ে বলে, "ভালোবাসার নামে কেমন কমারশিয়ালাইজ করে ফেললো সব কিছু, দেখ? ইমোশনও নাকি বিক্রি হচ্ছে!" অদিত এরকমই। নানান বিষয়ে ওর দৃঢ় মতামত। বিভিন্ন বই পড়ে। আলাপ আলোচনা করে। ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র হয়েও যে কীভাবে এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে জ্ঞান, পাল্কি মুগ্ধ হয়েই অদিতের কথা শোনে। ইচ্ছে থাকলেও, ব্যাগের ভিতরে রাখা সদ্য কেনা লাল গোলাপটা পাল্কি দিতে পারে না অদিতকে। সারাদিন কলেজে, আর তারপর সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পথেও পাল্কির চোখে পড়ে কপোত কপোতীদের ওপর। কী সুন্দর সব গোলাপ দিয়েছে একে অপরকে। সেজেগুজে গল্প খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। ওর মনে কষ্ট হয়, খুব। ব্যাগ থেকে গোলাপটা বের করে পাড়ায় ঢোকার আগে বড় ডাস্টবিনটাতে ফেলে দেয় গোলাপটা। নিজেকে স্তোক দেয়, সবাই তো এক রকম হয় না। অদিতের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ আর পাঁচজনের মতো হয়তো না, তবু পাল্কি জানে, অদিত ওকে ভালোবাসে, খুব। কিন্তু ওই যে, মন মানে না। অনেকক্ষণ নিজেকে আটকে রাখলেও, ঠিক বারোটা বাজার একটু আগে, দিন ফুরানোর আগের মুহূর্তে ছোট্ট একটা এস এম এস করে অদিতকে। "হ্যাপি রোজ ডে। আমি জানি তুই এইসব মানিস না। কিন্তু... আমারও তোকে আজ গোলাপ দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। তাই কিনে রেখেছিলাম। দিতে সাহস পাইনি। কিন্তু উইশটা করে দিলাম..."
পাল্কি অদিতের থেকে যে কোনরকম সাড়া পাবে, ভাবেনি। তাই পরেরদিন সকালে উঠে এস এম এস দেখে একটু অবাকই হয়েছিল। তাতে লেখা, "থ্যাঙ্ক ইউ।" এর যে কী মানে করবে ও, বোঝেনি। শুধু মনের ভিতরে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো, হয়তো ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে কিছু স্পেশাল আয়োজন করবে অদিত। উঁহু, করেনি। উল্টে কথায় কথায় বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে ওর কাছে সব দিনই সমান। আর এইভাবে অনুভূতি নিয়ে ব্যবসা, মোটেই সমরথন করেনা ও।
সেদিন রাত্রে কেঁদেছিল পাল্কি। অনেকক্ষণ। বালিশে মাথা গুঁজে শরীর কেঁপে উঠেছিল ওর কান্নায়। নাইট ল্যাম্পের নীলাভ আলো, ঝমঝমে বৃষ্টি আর একটা রাতজাগা পাখী ছিলো তার সাক্ষী। তারপর পরেরদিন সকালে আবার নিজেকে সামলে নেয়। ওই যে, হৃদয় ভারসাস মস্তিষ্কের লড়াইয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো পাল্কির মস্তিষ্ক জিতে যায়। আবারও।
ফেসবুকের সংসারে এদিক ওদিক করতে গিয়েই অদিতের প্রোফাইলে পৌঁছে থমকে দাঁড়ায় পাল্কি। অদিত এখন বিবাহিত। বিদেশে কর্মরত। ঘোরতর সংসারী। যদিও নিজে এখনও তেমন ভাবে ওই পাব্লিক ডিস্প্লে অফ অ্যাফেকশন করেনা স্ত্রীর প্রতি, কিন্তু মেয়েটি খুব পোস্ট করে। প্রেমে মাখোমাখো ক্যাপশন সহ দুজনের হাসিখুশি মুহূর্তের ছবি। এ দেশ ও দেশ ঘুরে বেড়ানো, নানান কন্সার্ট, সিনেমার চেক-ইন। আজও যেমন মেয়েটি দিয়েছে। অদিতকে ডেডিকেট করেছে এক তোড়া লাল গোলাপে মোড়া ভালোবাসা। উপচে পড়ছে সেখানে শুভেচ্ছাবার্তা। অদিতও স্পষ্টতই গদগদ। প্রেম-ভালোবাসায় সংসারী অদিত।
সেই অতগুলো বছর আগের এইট বি বাস স্ট্যান্ডের ফেলে আসা অদিত হারিয়ে গিয়েছে কোথায় কে জানে। পাল্কি এদিক ওদিক খোঁজে। দেখতে পায় না অদিতকে। হয়তো সবাই এগিয়ে যায়। কিন্তু পাল্কি পারেনি। ও আজও পড়ে রয়েছে সেই একই জায়গায়। ব্যাগ হাতড়ালে আজও হয়তো খুঁজে পাবে সেই না দেওয়া লাল গোলাপটা।
জানলার বাইরে চোখ মেলে পাল্কি। মেঘ করেছে। খুব। যে কোন মুহূর্তে বুঝি আকাশ ভেঙ্গে নামবে বৃষ্টি। আজও। বা হয়তো মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠবে...
Tuesday, February 4, 2020
Sunderbans (complete)
প্রাক-কথা
গত অগস্ট থেকে নভেম্বরের শেষ অবধি ভয়ানক
রকমের ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছি। পি এইচ ডি
থিসিসের কাজকর্ম নিয়ে একেবারে যাকে বলে, ল্যাজে গোবরে অবস্থা। তা যাই হোক, ডিসেম্বরের শুরতে
বাড়ি ফিরলাম। কলকাতা। ভিতরের যাযাবর পোকাটি ভালোমতন নাড়া দিয়ে উঠলো। এদিকে বাড়িতে রাজমিস্ত্রির
কাজ হচ্ছে। মেরামত, রঙ, এইসব। কাজেই, বাবা মা বলেই দিলেন, তাঁরা এই মুহূর্তে কোন বড়
বা মাঝারি ট্রিপেও যেতে পারবেন না। এদিকে আমার মাথায় বেরানোর ভূত চেপেই গিয়েছে। যেতে
তো হবেই। কাঁহাতক আর রোজ সন্ধ্যেয় বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে চা কফি স্ন্যাক্স খেয়ে কাটানো
যায়? হ্যাঁ, বাড়ির বাইরে যাচ্ছি বটে, অথচ বেড়ানো তো হচ্ছে না। তিন বান্ধবী মিলে ঠিক
করলাম, ঘরের কাছে ডায়মন্ড হারবার, সেখানেই একটা ডে ট্রিপ সেরে ফেলি। সেইমতো হোয়াটসঅ্যাপ
গ্রুপ পর্যন্ত তৈরি হয়ে গেলো। কিন্তু নাহ, বুকিং মিলল না। বুকিং মিলল না টাকিতেও। অগত্যা,
দিন পরিবর্তন। এদিকে সেটি কিনা মস্ত কঠিন প্রশ্ন। প্রায় দেশের নিয়ম নীতি বানানোর মতোই
কঠিন ব্যাপার। তিনজনের সুবিধে মতো একটা তারিখ ঠিক করা। অনেক কষ্ট করেও সেই তারিখ আর
জুটলো না। অগত্যা, সেই আবার কফি খেতে যাওয়া। বেড়ানোর আশা এদিকে ছাড়তেও পারছি না। কী
করা যায়? কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায়, এইসব ভাবতে ভাবতে নিজের একটা মেন্টালি
বানানো লিস্টের শরণাপন্ন হলাম। লিস্টের প্রথমেই বেনারস। মাসিকে বললাম, চলো যাই। মাসি
কোন সময় নষ্ট না করেই বারণ করে দিলো। দেশের যা অবস্থা, দুই মহিলা মিলে ইউ পি যাওয়া
নাকি মোটেই সেফ না। নেক্সট ইন লিস্ট, দারজিলিং। এদিকে তখন এইসব সি এ এ, এন আর সি নিয়ে
মারমার কাটকাট অবস্থা। ট্রেন প্লেন নাজেহাল অবস্থা। অগত্যা, সেই গুড়েও বালি। তাহলে? তাহলে আর কী? ঠিক এই সময়ে,
এক্কেরে রক্ষাকর্তার ন্যায় এসে হাজির হলো ফেসবুক। এমনিই একদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে
করতে স্পন্সরড অ্যাডে এলো, সুন্দরবন ভ্রমণের কথা। একটু খোঁজখবর নিলাম। ইতিমধ্যে
রোজ বেরিয়ে বেরিয়ে এমন অবস্থা, যে বাবা মায়ের কাছে তখন “ভ্যাকেশন”এর কথা বলার ঠিক
সাহস নেই। ভরসা তাহলে মাত্র একজন। দায়িত্ব দিলাম কাকার কাছে। চুপিচুপি
হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে দিলাম সমস্ত লিঙ্ক। বললাম, সুন্দরবন যাবে? আমি জানতাম,
কাকা হ্যাঁ বলবেই। কাকারও যে পায়ের তলায় সর্ষে। একা মানুষ। তার ওপর আবার সদ্য
রিটায়ার করছে। কাজেই উত্তরটা যে হ্যাঁ হবেই, সেই বিষয়ে সন্দেহ ছিল না কোন। বললাম,
একটাই শর্ত। প্ল্যানটা যে গোটাটাই আমার মাস্টারমাইন্ড, সেইটা বাবা মা কে জানানো
যাবে না। কাকা বলা বাহুল্য, রাজি। বিকেলের মধ্যেই মায়ের মোবাইলে মেসেজ ঢুকল তার।
‘সুন্দরবন যাবে?’ মা আমায় ডেকে দেখালো, বললও, যাবি? আমি যেন কত সারপ্রাইজড, সেরকম
ভান টান করে মোটামুটি ঝটপট হ্যাঁ বলে দিলাম। ব্যস, আর কী? বাবাকে রাজি করানো গেলো
খুব সহজেই। ওই একটু আমি হম্বি তম্বি, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল টেল করলাম, ব্যস। তারপর
এই অপারেটর ওই অপারেটর এইসব করতে করতে অবশেষে দ্য টেলিগ্রাফে এক রবিবারের বিজ্ঞাপন
দেখে ইকো ট্যুরিজমকে ঠিক করা হলো। সায়েন্স সিটির সামনে থেকে ওদের বাস ছাড়বে।
ওখানেই পিক-আপ, ওখানেই ড্রপ। কলকাতা টু কলকাতা পার হেড ৪৫০০ টাকা প্লাস জি এস টি।
সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার মতো পড়লো জনপ্রতি। ঝটপট সময় নষ্ট না করে অনলাইনে টাকা
ট্রান্সফার করে আমাদের চারজনের জন্য ২৩, ২৪, ২৫ তারিখের ট্রিপ বুক করা হয়ে গেলো।
এবার শুধুই অপেক্ষা। কবে ২৩শে জানুয়ারি আসবে, কবে বেরবো। জোর কদমে চলল পরিকল্পনা,
আলোচনা। কী কী জামাকাপড় নেওয়া হবে, ঠান্ডা কেমন। জুতোই বা কী নেবো? (হ্যাঁ, জুতো
নিয়ে তো আমার বিশেষ ইয়ে আছে, তাই আর কী) বাড়ি থেকে ওই সক্কাল সক্কাল সায়েন্স সিটি
অবধি ক্যাব পাবো কি না। নানান প্রশ্ন। যাই হোক। সবকিছু উত্তর টুত্তর পেয়ে টেয়ে
আমরা অবশেষে ২৩শের সকাল পেলাম। কাকা ইতিমধ্যেই আগের রাত্রে আমাদের বাড়ি চলে এসেছে,
যাতে একসাথেই চারজনে যেতে পারি।
মালপত্র রেডি। রেডি আমরাও। ওলা বুক
হয়ে গিয়েছে। গাড়িও প্রায় এসেই গেলো। এইবার ঠাকুর ঠাকুর করে বেরিয়ে পড়লেই যাত্রা
শুরু।
প্রথম দিন
যাক গে, হইহই করতে করতে (পড়ুন, ক্যাবের
পর ক্যাব ক্যান্সেল করছে, পাশ থেকে মা জননী চিৎকার করছেন, কেন আমরা রেডি হয়েও বসে বসে
ভ্যারান্ডা ভেজেছি এতক্ষণ, কেন এতক্ষণেও ক্যাব বুক করা শুরু করিনি, ইত্যাদি) শেষমেশ
ক্যাবটি এলেন। আমরাও গুটিগুটি পায়ে ডিকিতে অল্প যা লাগেজ ছিল, তুলে দিয়ে গাড়ির ভিতর
বসে পড়লাম। (ইতিমধ্যে আমার খান দুইয়েক সেলফি তোলা হয়ে গিয়েছে, ফেসবুকের জন্য।) ট্যুর
ম্যানেজার রিন্টুর ফোন ঢুকেছে এর মধ্যেই, কাকার মোবাইলে। আমরা কতক্ষণে পৌঁছচ্ছি, জানতে
চেয়ে। বাস নাকি অলরেডি পৌঁছে গিয়েছে। বেশিরভাগ লোকজনও পৌঁছে গিয়েছেন। বাবাহ, বাঙালির
এমন সময়জ্ঞান ভালো, জেনে অবাক। যেহেতু বাসের সিট নির্দিষ্ট ছিল না, আগে এসে আগে বসো
গোছের ভাব, ধরেই নিলাম, পিছনের সিটই আমাদের কপালে নাচছে। এবং হলোও তাই। শেষের ঠিক আগের
রোতে টু-সিটারে আমি আর মা, আর থ্রিসিটারে বাবা আর কাকা এবং আমাদের অল্প লাগেজ বসলো।
বাসের ছাড়ার কথা ছিল (কাগজ অনুযায়ী) সাড়ে সাতটায়। ছাড়ল ঠিক ৮:২৯ এ। আহা। এক ঘন্টাও
তো লেট করেনি। বাঙালি স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী, ঠিকই আছে।
বাস ছাড়তে ছাড়তেই দেখি “আকাশ মেঘলা,
বৃষ্টি এখনও হয়নি”। কে আসবে বলে, কে জানে? সায়েন্স
সিটি থেকেই বাঁ দিকে ঘুরে গেলো বাস। চলতে লাগলো কলকাতা লেদার কমপ্লেক্সের রাস্তাঘাট
দিয়ে। টুকটাক ঝিল, একটু কম উন্নত বাড়িঘর এইসব নিয়েই যাত্রাপথ। রাস্তার ধারের দোকানগুলির
সাইনবোর্ড দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কী নাম জায়গাগুলির। চেনা নাম বলতে, দেখলাম ওই একমাত্র
ভাঙ্গর। আমার এক পিসি ওখানের কলেজে পড়ান। তাই নামটা জানি। ঝিল পুকুর ভাঙা রাস্তা সাইকেল
অটো ভ্যান মানুষজন ছাগল গরু কুকুর বিড়াল সব দেখেত দেখতে বাস চলতে লাগলো। ইতিমধ্যেই
বাস ছাড়তেই হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সুগার অ্যান্ড স্পাইসের বাক্সে ব্রেকফাস্ট। একটা ভেজ
বার্গার, একটা পনীর প্যাটি, একটা কাপ কেক আর একটা শুকনো মিষ্টি। হাঙরের মতো খিদে পেয়ে
গিয়েছিল বাস জার্নির সৌজন্যে। তাই কেক বাদে বাকিগুলি খেয়েই নিলাম। বাস রাস্তা মোটামুটি স্ম্যুদ, তাই
ঝাঁকুনি খুব একটা খাইনি, পিছনের সিটে বসেও। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, বাসটা খুব একটা
পছন্দ হয়নি। জানলার কাঁচ ভালো বন্ধ হচ্ছিলো না। এদিকে যা কনকনে হাওয়া দিচ্ছিল...
ভলভো লেখা থাকলেও এ অরডিনারিই বাস। মোটেই ভলভো নয়। যাই হোক, মাঝে কোন এক জায়গায় পনেরো মিনিটের চা
খাওয়ার ব্রেক দিয়ে টিয়ে বাস পৌঁছল গদখালি। তখন প্রায় বারোটা বাজে। মাঝে বাসন্তী
নামের জায়গার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম যখন, বাসের লোকজন জোক ক্র্যাক করলো। ভীরু নামের
কেউ বোধহয় ওঁদের দলে ছিলেন, তাই তাকে বাসন্তী নিয়ে খ্যাপানো হলো। যাক গে। গদখালি
থেকে আমাদের লঞ্চের জার্নি শুরু হবে। ঘন্টা দেড়-দুইয়ের ব্যাপার। বাসের পারকিং থেকে
লঞ্চঘাট ওই হাঁটাপথে মিনিত তিনেক মতো। গদখালি জায়গাটি অত্যন্ত ভিড়-হট্টগোলের।
একগাদা টাটা ম্যাজিক, অটো দাঁড়িয়ে লোক তুলছে, নামাচ্ছে। ক্যানিং, সোনাখালি এইসব
জায়গার প্যাসেঞ্জার। সেই ভিড়, কাদা পিচ্ছিল রাস্তা পেরিয়ে লঞ্চঘাটে এলাম। সামনে এই
এত বড় আমাদের লঞ্চ দাঁড়িয়ে। নাম তার ‘স্বর্ণময়ী”। আমরা সব মিলিয়ে ছিলাম ৪৫ জন, আর
সাথে রিন্টু। সব্বাই মিলে একে একে গিয়ে উঠলাম লঞ্চে। সিঁড়ির কাছটা বেশ ভালোমতন
পিচ্ছিল ছিল, তাই একটু ভয় করছিল বটে, তবে আমাদের হাত ধরেই প্রায় লঞ্চে উঠিয়ে দিলেন
লঞ্চকর্মীরা। কোন অসুবিধে হয়নি। লঞ্চের নীচের তলায় (একবারও ঢুকিনি, ঢোকা উচিত ছিল)
ওঁরা আমাদের সবার লাগেজ নিয়ে রেখে দিলেন। আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম। ডেক
বরাবর সারি দিয়ে দিয়ে চেয়ার পেতে রাখা। আমরা চারজনে, বাকিদের সাথেই ওই চেয়ারে যে
যার মতো বসে পড়লাম। আমি নিয়েছিলাম ধারের চেয়ার। লঞ্চ ছেড়ে দিলো অল্পক্ষণেই। দেড়
ঘন্টা মতো চলবে। এ এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা আমার জন্য। আগেও কেরলের ব্যাকওয়াটারে
ঘুরেছি, বেরিয়েছি এমন লঞ্চে। বিভিন্ন জায়গায় রিভার বা সি-ক্র্যুজও করেছি। কিন্তু
এরকম দুই ধারে জঙ্গল, এত চওড়া নদী, এর মধ্যে দিয়ে এই প্রথম। বেশ লাগছিল। হাল্কা
দুলুনি পর্যন্ত ছিলো না। বেশ ধীরস্থির জার্নি।
এর মধ্যেই ট্যুরের লোক এসে চা আর
বিস্কিট দিয়ে গেলেন। দু পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল দেখতে দেখতে আমরা চললাম। মেঘলা ভাব
ছিলো, তাই কনকনে স্যাঁতস্যাঁতে দুইই বোধ করছিলাম। ভালো করে টুপি চাদর জড়িয়ে বসলাম।
আমার কাকা বসে ভিডিও তোলা শুরু করে দিলো। আমিও ক্যামেরা বের করে টুকটাক ছবি তুলছি।
বাবা ঝিমোচ্ছে। মা সহযাত্রীদের সাথে এর মধ্যেই বন্ধুত্ব পাতিয়ে গপ্প জুড়ে ফেলেছে। কেউ
কেউ নদিয়া জেলা থেকে এসেছেন, দশজন একসাথে। ওঁদের লিডার জিনি, তিনি কিছুদিন আগে
ঘুরে গিয়েছেন, তাই মোটামুটি সমস্তটাই জানেন। তিনিই আমাদের বলছিলেন, কতক্ষণ লাগবে।
কাল কোথায় যাবো। আজ কোথায় যাব। আদৌ বাঘ দেখতে পাবো কি না। এইসব। এই করতে করতে দয়াপুরে পউছলাম, প্রায় দুটো নাগাদ।
দয়াপুর হলো ওই অঞ্চলের সবচেয়ে দক্ষিণে অবস্থিত লোকালয়। এখানেই অনেক রিসোর্ট রয়েছে।
আমাদের সুন্দরবন ভিউ পয়েন্ট রিসোর্টটিও এখানেই। লঞ্চকে ঘাটে বেঁধে দিলো। আমরা একে
একে নামলাম। মালপত্র সাথে নিয়ে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে কয়েক পা হেঁটেই আমাদের
রিসোর্ট। ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেলো। বেশ সবুজ। জলাশয়ও রয়েছে। দোতলা বাড়ি। চেক-ইন
রেজিস্টারে সই করে ঘরে গেলাম। পাশাপাশি দুটো ঘর আমাদের, একতলায়। ১০৫ আর ১০৬। একটু
ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে বেরোতে হবে।
দুপুরের খাবারটা বেশ ভালোই ছিল। যদিও
অন্যান্য ট্যুর পার্টিদের মেনুতে যেমন ভ্যারাইটি আইটেম লেখা থাকে , মানে ওই চাউমিন
চিলি চিকেন, (ও এখন তো আবার সৃজিত মুখুজ্জের সিনেমার জেরে, চিকেন চাউমিন চিলি ফিস বেশি
পপুলার) বা বিরিয়ানি মাংস ছিল না। তবে টায়ার্ড হয়ে এসে একটু গরম গরম ভাত ডাল কফির তরকারি
পাঁপড় ভাজা কাতলা মাছ চিকেন কারি আর পেঁপের চাটনি খেয়েও মনপ্রাণ তৃপ্ত হলো বইকি। রিন্টু
এর মধ্যেই এসে বলে দিয়েছে, চারটের দিকে সবাই মিলে বেরনো হবে, লঞ্চে চেপে। সবাই যেন
রেডি থাকি। আমরা খেয়ে উঠতে উঠতে প্রায় তিনটে বেজেই গিয়েছিল। ভাবলাম আধ ঘণ্টা একটু পিঠটান
করি। আমি ফোন বাবাজীকে চার্জে বসিয়ে একটু রেস্ট নেবো, এমনটা ভেবে ব্যাগ হাতড়াচ্ছি।
চারজার কই? ও মা, খেয়াল হলো, বাবা মা এবং আমি, তিনজনেই ভেবেছি যে অন্যজন নিয়েছে সেটি।
আর ব্যস, কেউ নিইনি। যদিও সাথে পাওয়ার ব্যাঙ্ক ছিল, তবুও। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেলো।
যাহ্, ফোনের চার্জ কখনো ৮০% এর নীচে নামলেই কেমন একটা ধুকপুকানি হয়। তবে যাই হোক,
এ যাত্রায় রক্ষা করলো কাকা। দখল নিলাম চারজারের। বাবা ঘুম দিলো। কাকা একটু ফোনে এর
তার খোঁজখবর করতে লাগলো। আমি শুলাম বটে, কিন্তু ওই শুয়ে শুয়ে ফেসবুক খুলবার বৃথা চেষ্টা।
নেটওয়ার্ক এতই খারাপ, কিছুই হলো না। বাইরে আওয়াজ পাচ্ছি, মা কোন একটা বাচ্চার সাথে
গল্প জুড়েছে। বেরিয়ে এসে দেখি, রিকো। আমাদেরই সহযাত্রী। ভারী মিষ্টি এই বাচ্চাটি। বছর
তিনেক বয়স, গোলগাল, হাসিখুশি, মিশুকে। রিসোর্টের সামনে ঢালাই করা রাস্তায় কুকুরের পায়ের
ছাপ রয়েছে কয়েকটা। ও সব্বাইকে ডেকে ডেকে দেখিয়ে বলছে, “এই দেখো, বাঘের পায়ের ছাপ।“
সরল শিশু মন। ওর সাথেই খানিক গল্প করতে করতে দেখি চারটে বেজে গেলো। একে একে সবাই যে
যার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। বিকেলের সাইট সিয়িং করার জন্য। আজ যেখানে যাবো, সেখানে
বাঘ টাঘ দেখার কোন গল্প নেই। শুধুই কিছু মাইগ্রেটরি পাখি দেখা। আর সূর্যাস্ত।
সুন্দরবনে পৌঁছনো ইস্তক দেখছি, কেমন
জানি কুয়াশার পাতলা একটা আস্তরন জেন লেপ্টে আছে। আকাশের মুখ ভার না হলেও, বিশেষ প্রসন্ন
নয়। যতক্ষণে আমরা স্বর্ণময়ীতে গিয়ে উঠলাম, সূর্য ঢেকে গিয়েছে মেঘের আড়ালে। এক্কেরে
বিফোর টাইম সূর্যাস্ত। মন খারাপ হলো আমাদের। তবুও আশায় আশায় রওনা দিলাম, যদি…। বোট
বা লঞ্চ, যাই বলি না কেন, সেখানে প্রতিবার চলার সময় আমাদের সারেঙ মশাই বলে দিয়েছিলেন,
দুইদিকের ব্যালেন্স যেন সব সময় বজায় থাকে। নইলে যে কোন সময়ে লঞ্চ উল্টে ভালোরকম বিপদের
সমূহ সম্ভাবনা। তাই লঞ্চ ডেকের দুদিকেই সমানভাবে চেয়ার যেমন পাতা, তেমন করেই আমাদের
বসার নির্দেশ ছিল। কোন জন্তু টন্তু দেখা গেলে উনি যে এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে সক্কলে
দেখতে পাই, এমনটাই বলে আশ্বস্ত করলেন। আমাদের তখন মনে একটাই চিন্তা। আর যাই হোক না
কেন, বাঘ যেন মিস না করি।
এইসব করতে করতে আমাদের লঞ্চ চলতে লাগল।
সেই একই চওড়া নদী। নদীর নাম জানি কি, ঠিক খেয়াল পড়ছে না। আসলে ওঁরাও খুব একটা সেই বিষয়ে
বলেননি। আমাদের ভরসা ছিল গুগল ম্যাপ। নদীর দেখি বিভিন্ন চ্যানেল। খাঁড়ির মতো এদিক ওদিক
জলের ধারা ঢুকে যাচ্ছে। জোয়ারের সময় তাতে জল ভরে যায়। পাড়ের গাছপালাগুলো অনেকটাই ডুবেও
থাকে। আমরা যখন গিয়েছি, তখন ভাটার সময়। তাই পাড়ে দেখলাম ভীষণ কাদা। দুপাশ থেকে গাছেরা
নুয়ে পড়ছে জলে। প্রায় আধ ঘন্টা, কি আর একটু বেশি চলার পর দেখি একটা জায়গায় অনেকগুলো
লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ভাবলাম, কী ব্যাপার? কী দেখছে ওঁরা? বাঘ দেখা গেলো নাকি? মাথার
মধ্যে তো শুধু ওই একটাই চিন্তা। বাঘ মামার দর্শন কি পাবো? নাহ। সে গুঁড়ে বালি ঢেলে
জানলাম, এই জায়গার নাম “জটিরামপুর”। এখানেই আমরা পাখী দেখবো। ওই কাদা কাদা নদীর পাড়ে
তাকিয়ে রইলাম সবাই হাঁ করে। কই? কোন পাখীর দেখা নেই। জানতে পারলাম, পাখিদের আসা এখন
অনেক কমে গেছে। কে জানে? ওরাও হয়তো একই জায়গায় আর প্রত্যেক বছর না এসে বিভিন্ন জায়গায়
জায়গায় ট্যুর করছে। সত্যিই তো, কাঁহাতক আর একই জায়গায় প্রতি বছর ঘুরতে আসা হালো লাগে?
তাই না? যাই হোক, ওই দু তিনটে সাদা বক (পরে অবশ্য দেখে জেনেছি, ওদেরও কিছু গাল ভরা
নাম আছে বই কি) আর একটা দুটো মাছরাঙা। এই ছিলো দেখার ঝুলিতে। মিনিট পনেরো ওখানে অপেক্ষা
করে এবার ফেরার পালা। সূর্যাস্ত দেখা হবে না। মেঘের আড়ালে সূর্যদেব। তাই একদম রিসোর্টে
ফেরা। জন্তু জানোয়ার কিছু তেমন দেখি ছাই না দেখি, লঞ্চে চেপে এই জলভ্রমণ, তাও দু পাশে
ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, এই অভিজ্ঞতাটা কিন্তু বেশ লাগছিল।
ফিরলাম ওই আধ ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের
জার্নির পর। রিন্টু বলল, আজ কালচারাল প্রোগ্রাম আছে। স্থানীয় কোন দল এসে নাচ গান পরিবেশন
করবে। সেই দেখতে দেখতেই চা-পকোড়া সহযোগে সন্ধ্যেটা ভালোই কাটল। ওঁদের স্থানীয় গানে
প্রতি লাইনে যেন সুন্দরবনের জীবনযাত্রার কথা, সুখ দুঃখের গল্প, প্রাত্যহিক লড়াইয়ের
গল্প ফুটে উঠছিল। আমরাও দর্শকাসন থেকে একবার গিয়ে নাচের তালে পা মেলালাম। ছবি টবিও
উঠলো। এইসব শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা। সক্কলেই আমরা ভীষণ ক্লান্ত। নটার দিকে ডিনার
পরিবেশন করলো। ভাত রুটি ডাল তরকারি পাঁঠার মাংস আর চাটনি। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম। পরেরদিন
সকাল সকাল বেড টি দেবে। আর সাথে দেবে গরম জল। সেই যে, জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমার সংলাপের
মতো, “রানিং হট ওয়াটার”। কাল সারাদিনের লম্বা জার্নি। ভালো করে একটা এইবারে ঘুম দরকার।
দ্বিতীয় দিন
সক্কাল সক্কাল ওই ছটা সোয়া ছটার দিকে
বেড টি আর সাথে বিস্কিট দিয়ে আমাদের ঘরে ঘরে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলো। তারপর সাথে সাথেই
শুরু হলো গরম জল দেওয়া। ওই বালতি করে করে দিয়ে যাচ্ছিল হোটেলের ছেলেরাই। একটা সেন্ট্রাল
জাউগায় বিশাল হাঁড়িতে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে জল ফুটছিলো। জানিনা সেই জলের সোর্স কী, পাশেই
বয়ে চলা নালা না কি? জলের রঙ কিন্তু বেশ ঘোলাটে। যাই হোক, কীই বা করা। যা পাচ্ছি, তাই
দিয়েই কাজ চালাই। খুব যে ইলাবোরেট করে স্নান করবো, সেই উপায় নেই। কারণ ঠান্ডা মন্দ
না। যাই হোক, সাতটার মধ্যে সকলে তৈরি হয়ে নিলাম বটে। তাও ওই বোট ছাড়তে ছাড়তে সেই আটটাই
বেজে গেলো কারণ ওই এক দুজনের লেট লতিফ আচরণ।
আজকে অনেকগুলো জায়গায় যাওয়ার কথা, বেশ
লম্বা জার্নি। আর কপালে যদি বাঘ দেখা যায়, তো সে আজকেই হবে। আমাদের দয়াপুর আইল্যান্ডের
থেকে বলা যায় প্রায় ওই মিনিট দশেকের জার্নিতেই (লঞ্চে অবশ্যই) পৌঁছে যাওয়া যায় সজনেখালি।
সজনেখালি হলো সুন্দরবন অঞ্চলের মূল দ্বীপ বা সেন্টার। সরকারি কাজকর্ম, ট্যুর গাইড ইত্যাদি
সব এখান থেকেই পাওয়া যায়। আমাদের লঞ্চ সজনেখালির ঘাটে দাঁড়ালো, তবে আমরা নামলাম না।
বরং সরকার স্বীকৃত একজন ট্যুর গাইড আমাদের লঞ্চে উঠলেন। নামটা ঠিক খেয়াল পড়ছে না। ধরে
নিলাম, মাধব বাবু। উনি উঠেই আমাদের সুন্দরবনে স্বাগত জানালেন। নিজের পরিচয় দিলেন। এবং
জানালেন যে আমরা যতক্ষণ এই রিজার্ভ ফরেস্টের ভিতর দিয়ে চলবো, ততক্ষণ গাইডের সাথে থাকাটা
বাধ্যতামূলক। উনিই প্রতিপদে আমাদের সাথে থাকবেন। জঙ্গলের নিয়মকানুন সমস্ত কিছু বলবেন।
জানাবেন এখানকার মানুষজনের কথা।
সুন্দরবন অঞ্চলের টোটাল এরিয়া কত,
তার কত শতাংশ ভারতে (একজ্যাক্ট সংখ্যা মনে নেই) আর কতটা বাংলাদেশে (ওখানেই বেশি
এরিয়া ভারতের তুলনায়) সমস্ত বিষয়ে জানালেন। এও জানালেন যে এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট
ইউনেস্কো স্বীকৃত হেরিটেজ সাইট। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৈশিষ্ট্য আমরা ছোটবেলায়
স্কুলের বইতে পড়েছি। এই লম্বা মোটা কান্ড, ওপর দিকে পাতার “ক্যানোপি”। শিকড় বেশ
শক্তপোক্ত, মাটি আঁকড়ে থাকে। হতেই হবে, নইলে প্রতিনিয়ত এই যে নদীর পাড় ভাঙছে, তার থেকে বাঁচবে কী করে?
ইয়া লম্বা লম্বা সে শিকড়, এক্কেবারে পাড় অবধি এসে পৌঁছে গিয়েছে। আন্তরজাল সৃষ্টি
করে প্রায়। আবার কিছু কিছু গাছে শ্বাসমূল থাকে, যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি,
“নিউম্যাটোফোর”। এই নিউম্যাটোফোরের বৈশিষ্ট্য এদিন সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও লঞ্চ
থেকে আমি বুঝিনি, তবে ভালো করে পরেরদিন দেখেছিলাম। কাজেই সেই নিয়ে কথা পরে হবে।
ছবি অবশ্য আগেই আপনাদের দেখিয়েছি।
আমাদের প্রথম ডেস্টিনেশন,
সুধন্যখালি। পৌঁছে গেলাম অল্পক্ষণেই। সুধন্যখালিতে দেখার বলতে ওয়াচ টাওয়ার। লঞ্চ
ঘাটে এসে ভিড়লো। আমাদের নামার আগে মাধব বাবু বলে দিলেন, সকলে যেন ওনার সাথে সাথেই
থাকি, হারিয়ে যেন না যাই। আমরা এক ঘাটে নামবো, উঠবো অন্য ঘাট থেকে। তাই এই
সাবধানতা। কাদা পিচ্ছিল ঘাটে আমরা সবাই নামলাম এক এক করে। বড় করে গেট, লেখা
সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ার। ভিতরে ঢুকেই একটা অফিস মতো। রিন্টু সেখানে গিয়ে পারমিটের
ব্যবস্থা করলো। তারপর আমরা সবাই চলতে লাগলাম। অল্প কিছুটা জায়গা জুড়ে ওই
সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানীয় গাছ, যেমন গরান, গেঁয়ো, হেতাল, সুন্দরী আলাদা করে
রাখা, জালের আড়ালে। এ ছাড়াও আরো বিভিন্ন গাছপালা রয়েছে। চেনা অচেনা। সেইসব দেখতে
দেখতেই পৌঁছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে। তিনতলা উঁচু। সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। খোলা জায়গা বেশ
অনেকখানি দেখা যায় ওখান থেকে। কাদা মাটি মতো খোলা জায়গা। আসলে জন্তুর দেখা পাওয়া
যায় বলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু রাস্তা করে দেওয়া, যাতে অনেকটা দূর অবধি দেখা
যায়। যদিও জাল দিয়ে রাখা (বাঘের জন্য), তবুও, জানা কথা, এখানে বাঘ আসে না। দেখতে
পেলে ম্যাক্সিমাম ওই হরিণ। তা, তাই বা মন্দ কী? আই আই টিতে থাকাকালীন হরিণের মাথায়
হাত বুলিয়ে আদর করেছি, নিজের হাতে ওদের খাইয়েছি। সে আলাদা অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই
জঙ্গলের পরিবেশে ওদের দেখাও কম আনন্দের নয়। তাই ওই হরিণ দেখতে পাবো ভেবেই একটু মনে
উৎসাহ। আর তারই মধ্যে রব উঠলো। ওই তো হরীন। ওই যে, আরে ওই তো। সোওওওজা তাকালেই, ওই
যে, কাদার মধ্যে মিশে গেছে রঙ। দলের একটি ছেলে আমার ক্যামেরার জ্যুম লেন্স তাক করে
সেটিকেই বেশ দূরবীন বানিয়ে দেখে টেখে আমায় দেখতে দিলো বটে। তবে পোড়া কপাল, কিছুই
বুঝলাম না। শুধু ওই ওয়াচ টাওয়ারের ব্যাকড্রপে ছবি তুল্লাম গোটাকয়েক। নীচে নেমে
এলাম। সেখানে দেখি সিমেন্টের বসার জায়গা পাতা,কাকা বসে জিরোচ্ছে। পাশেই জাল দেওয়া।
জালে বেশ কয়েকটা বাঁদর হুটোপুটি করছে। শুনলাম, ওখান থেকে হরিণ ভালো দেখা যাচ্ছে।
লেখাপড়ায় যতটা মনোনিবেশ করলে আজ আমি নোবেল পেয়ে যেতাম, তার চেয়েও বেশি মন দিয়ে
তাকিয়ে রইলাম। অবশেষে, হ্যাঁ অবশেষে, দেখা মিলল। হরিণের। স্পটেড ডিয়ার। তিন চারজন
ছিলো। রোদ পোহাচ্ছিল। ওদের দেখার জন্য আমাদের হুড়োহুড়ি দেখে ওরাও বোধহয় আমোদ পেয়ে
দুবার উঠে একটু হাঁটা চলা করলো। তাতে আমাদেরই লাভ হলো। একটা মুভমেন্ট দেখতে পেয়ে
সঠিক লোকেশনটা অনেকেই বুঝলাম। তারপর ক্যামেরার লেন্স তাক করেই খচাৎ। বেশি খচাত
দেখতে দেখতে পাশের বাঁদরগুলো খিচখিচ শুরু করে দিতেই দে ছুট। ইতিমধ্যেই রিন্টু আর
মাধব বাবুও আমাদের তাড়া দিতে এসে গিয়েছেন। সদলবলে সব ভালো ছেলেপুলের মতো আমরা অন্য
ঘাটে বাঁধা লঞ্চে এসে উঠে পড়লাম।
লঞ্চ চলতে লাগলো। লুচি ছোলার ডাল
আর ডিম সিদ্ধ প্লাস্টিকের প্লেটে সাজিয়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট দেওয়া হলো। লঞ্চে আপাতত
দুলুনি নেই। কাজেই খেতে অসুবিধে নেই। এরপরের গন্তব্য, পঞ্চমুখ। অনেকটা রাস্তা।
প্রায় দেড় ঘন্টা তো বটেই। গোটা রাস্তা মাধব বাবু নানান গল্প নিয়ে চললেন আমাদের
সাথে। যাত্রাপথটিও বেশ ইন্টারেস্টিং।
মাধব বাবুর কাছে আমাদের সকলেরই এক প্রশ্ন।
বাঘের দেখা কি মিলবে? শুধু মাধব বাবুই না, বরং রিন্টু সহ রিসোর্টের বাদ বাকি প্রায়
যাকেই দেখছি তাকেই জিজ্ঞেস করছি। এক কথা। আপনি বাঘ দেখেছেন? লাস্ট কবে দেখেছেন? আর
আমরা কি দেখতে পাবো? প্রতি ট্যুরিস্ট দল এই এক প্রশ্ন করেই চলে এঁদের কাছে। মাধব বাবু
শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য ধরতে না পেরে বলেই দিলেন, “আপনারা যে এই বছরে একদিন দুদিনের জন্য
আসেন। এসেই বাঘ বাঘ করেন? অত কি সোজা? তাছাড়া এই বাঘ দেখতে আপনারা হয়তো খুব উৎসাহী,
খুশিও হবেন। কিন্তু জানেন কি, এই বাঘের জন্য এখানকার সাধারণ লোকের জীবনযাত্রা কতটা
কঠিন?” আমরা এইবারে সকলেই চুপ। হতভম্ব। উনি আরো বলতে লাগলেন, এই সব অঞ্চলে শুধুই যে
বাঘের থেকে ভয়, তা না। কুমীরের ভয়ও সাঙ্ঘাতিক। একদম ওই যাকে বলে জলে কুমীর, ডাঙ্গায়
বাঘ। ওই রকম। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন সুন্দরবন অঞ্চলে কাঁকড়া ধরা পড়ে খুব। জোয়ারের সময় এই
বিভিন্ন খালের ভিতর যখন জলের তোড় আসে, কাঁকড়াগুলো সব ভেসে ওঠে। তখনই ওদের ধরতে
বেরোয় কাঁকড়া চাষিরা। এবার মন দিয়ে তাঁরা কাঁকড়া ধরছেন, জালে টান পড়লো কি না,স
এইসবেই বেশি মনোযোগ, আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, কিচ্ছু খেয়াল নেই। এই সুযোগেই কী
হয়, পাড়ের ধার দিয়ে হেঁটেচলে বেড়ানো বাঘ এক লাফে নৌকোয় এসে একজনকে ধরে, টুঁটি চিপে
নিয়ে চলে যায়। বাঘ অতি সজাগ, সচেতন। এবং চতুর। শিকারের টার্গেট মিস হবে না জেনেই
তখনই ও নামে। আর কী করে ও এতটা শিয়োর হয়? বাঘ যেটা করে, ও কয়েকদিন ধরে আড়াল থেকে
লক্ষ্য রাখে। কখন কোথায় লোকগুলো যাচ্ছে, কী করছে। কখন সজাগ, কখন অমনোযোগী। পুরো
কেস হিস্ট্রির মতো ব্যাপারটাকে ও নোট করে। তারপর কয়েকদিন সমস্ত অব্জারভ করে একদম
সুযোগ বুঝে কোপ মারে। এবং শতকরা একশো বারই ঠিক করে। আমাদের ঘুরতে যাওয়ার ঠিক
সপ্তাহ খানেক আগেই এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। স্বামী স্ত্রী নৌকো করে এইসব কাঁকড়া ধরতে
গিয়েছেন। বাঘ এসে হামলা করেছে। লোকটিকে ধরে ফেলেছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে। স্ত্রীর
এতটাই “প্রেজেন্স অফ মাইন্ড”, ওই অবস্থায় উনি টেনে হিঁচড়ে বাঘের সাথে লড়াই করে
স্বামীর বডি বাঁচিয়েছেন। বাঘ শেষ পর্যন্ত লোকটিকে ছেড়ে চলে যায় বটে। কিন্তু ততক্ষণে
তিনি মৃত। এবার যেহেতু এরা বেআইনি ভাবে মাছ না কাঁকড়া কী বেশ ধরতে গিয়েছিল,
পারমিসিবল জোনের বাইরে, অগত্যা, বন দপ্তর জানতে পারলে নির্ঘাত জেল। তাই ওই অবস্থায়
স্ত্রী স্বামীর দেহটিকে নৌকোর ভিতরের ঘরে কোনমতে চাপাচুপি দিয়ে রেখে ছেলেকে ফোন
করে জানায় ব্যাপারটা। ছেলে পঞ্চায়েত হ্যানা ত্যানা নানারকমের চেষ্টা করে টরে
অবশেষে মিটিয়ে ফেলে ব্যাপারটা। সাজা হয় না। মাধব বাবু কথাগুলো বলছেন, আর আমরা অবাক
হয়ে শুনছি। বিহ্বল হয়ে। সত্যিই, কী কঠিন জীবন এদের। মধু জোগাড় করতে যায় যারা,
তাদেরও জঙ্গলের মধ্যে সমূহ বিপদ। বাঁচার জন্য মানুষের মুখোশ মাথার পিছনে পরে যায়,
যাতে বাঘ বুঝতে না পারে যে লোকগুলো আসলে কোনদিকে তাকিয়ে। ডাঙ্গার ধারে বসে জেলে
নৌকো থেকে নেমে কাপড় কাচতে গিয়ে কতজনকে কুমীরে টেনে নিয়ে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। বাঘ
দেখবো বাঘ দেখবো বলে আমরা লাফাই বটে, কিন্তু আসলে বাঘ এলে সাধারণের যে কতটা অসুবিধে,
জানার পর থেকে সত্যিই খারাপ লাগছিল। সবাই প্রায় চুপ করে থেকেই এবার লঞ্চের বাইরে
তাকিয়ে দেখছিলাম। ইতিমধ্যে দুই পাড়ে বেশ কিছু মাছরাঙা, বক জাতীয় পাখি দেখেছি। দেখা
মিলেছে অনেক বাঁদরের। একটা জায়গায় দু তিনটে স্পটেড ডিয়ারও দেখেছি। দেখেছি বুনো
শুয়োর। ধারের জঙ্গলে মোটামুটি কম বেশি জাল দেওয়া। বাঘের জন্যই। নাইলনের জাল হলেও,
জাল ব্যাপারটা নাকি বাঘেদের ক্ষেত্রে সাইকোলজিকাল এফেক্ট প্লে করে।
এর মধ্যেই বেলা বাড়তে লাগলো। যদিও
রোদের তেজ ছিলো ভালোই, তবুও হাওয়া দিচ্ছিলো বেশ কনকনে। তারই মধ্যে আমরা এগোলাম
পঞ্চমুখের দিকে। এখানে পাঁচটি নদী এসে মিশেছে। পাঁচটি নদীর নাম আমি মনে করে এখন
বলতে পারবো না। মাধব বাবুও খুব কনফিডেন্টলি বলেননি। পাঁচ নদীর মিলনের ফলে অনেকটা
জায়গা জুড়ে সে কী প্রবল ঢেউ ও দুলুনি। লঞ্চে আমরা ভালো করে শক্ত করে বসেছিলাম।
জায়গাটা দেখে সমুদ্র বলেও ভুল হতে পারে, এতটাই চওড়া আর এতটা ঢেউ। তার ওপর বুঝি
জোয়ারের সময়। সব মিলিয়ে ভয় ভয় করছিলোই। নদীর জলে আরো কিছু কিছু লঞ্চ দেখতে
পাচ্ছিলাম। বেশিরভাগই টুরিস্ট নিয়ে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু লঞ্চ আসছে হলদিয়া পোর্ট
থেকে, ফ্লাই অ্যাশ নিয়ে। যাবে বাংলাদেশ।
পঞ্চমুখ থেকে এবার চলতে লাগলাম
দোবাকি। দোবাকিও ওই সজনেখালি সুধন্যখালির মতোই।ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওখানে এক ঘাটে
নামা, অন্য ঘাটে ওঠা। অগত্যা, সতর্কবার্তা ছিলোই। সব সময় এক সাথে থাকতে হবে। পরপর
চলতে হবে। দোবাকিতে ঢোকার ঠিক আগে দেখতে পেলাম রোদ পোহাচ্ছে একটি কুমীর, দূরের এক
পাড়ে। হইহই করে ছবি ওঠানো হলো। দোবাকি
গিয়ে দেখলাম সেই একই ওয়াচ টাওয়ার যেখান থেকে কিছুই দেখতে পাওয়া যায়নি। শুধু ওখানে
একটা বেশ বড় ক্যানোপি ওয়াক ছিল, ওটা খুব এঞ্জয় করেছি। উঁচু দিয়ে অনেকটা রাস্তা,
দুদিক জাল দিয়ে ঘেরা। দেখে মনে হবে যেন খাঁচার ভিতর দিয়ে হাঁটছি। আর পাশে খোলা
ভূমি, যেখানে নাকি বন্যপ্রাণীদের চরাচরের জায়গা। টুকটাক গাছের ছবি আর নিদের ছবি
ছাড়া দোবাকিতে ঠিক কিছুই ছবি তোলা গেলো না। ফিরলাম আবার লঞ্চে। লঞ্চে উঠে সমস্ত
যাত্রীরা মিলে অনুরোধ করলাম সারেঙকে, যদি ঝড়খালি নিয়ে যান। ওই ঘন্টা দুয়েক বাড়তি
সময় লাগবে। যা বাড়তি টাকা লাগবে, সবাই মিলে দিয়ে দেবো। ঝড়খালিতে আসলে রেস্কিউ করা
দুটো বাঘ রয়েছে। সেই দেখতাম না হয়। কিন্তু সারেঙ রাজি হলেন না। হয়তো পারমিশনের
ব্যাপার। ফেরার পথে ততক্ষণে সকলেই বেশ ক্লান্ত। চুপচাপ যে যার চেয়ারে বসে পড়েছি।
পঞ্চমুখে এসে আবারও সেই দুলুনি। তারপর আরো ঘন্টা দেড়েকের জার্নির পর আমরা ফিরলাম
দয়াপুর। প্রায় আড়াইটে বাজে। হাত মুখ ধুয়ে সঙ্গে সঙ্গে লাঞ্চ। গরম ভাত, ডাল, পাঁপড়
ভাজা, মিক্সড সব্জি, ভেটকি মাছের ঝাল আর কাতলা মাছ। সাথে আমসত্ত্ব খেজুরের চাটনি।
খেয়েদেয়ে একটু ঘুমের পালা, অন্তত আধ ঘন্টার পাওয়ার ন্যাপ। বিকেলে সোয়া চারটের দিকে
গ্রাম দেখতে বেরনোর কথা।
চারটের একটু আগেই মা বাবা আর আমি বেরোলাম।
সকলে তখনও রেডি হয়নি। কাজেই গ্রাম দেখতে যাওয়া একটু দেরি আছে। আমরা সামনেটা এদিক ওদিক
হেঁটে চলে বেড়ালাম খানিক। রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই একটা মুরগির
পোলট্রি। সেখানে ভর্তি মুরগি রয়েছে। তারই উল্টোদিকে বাচ্চা মুরগিগুলোর জন্য আলাদা
ঘর। বাল্বের আলোয় তাদের গরম রাখা হয়। তাপ পায়। একটু বড় হলে বুঝি “সিনিয়র স্কুলে”
প্রবেশ হবে। নদীর ধার দিয়ে উঁচু পাড়ের মতো রাস্তা। মেঠো পথ। হেঁটে যেতে মজা।
কুকুর, ছাগল সব ঘুরছে। ছানা সহ। তাদের সাথেও খানিক আদর আহ্লাদ করলাম। একটু এগিয়ে
দেখলাম এক ভদ্রলোক গরুদের খেতে দিচ্ছেন। জল নিচ্ছেন কল থেকে, কাপড় দিয়ে ছেঁকে।
ওঁকে জিজ্ঞেস করা হলো কারণ, উনি কিছু বললেন না। নির্ঘাত ব্যস্ততার মধ্যে শহুরে
মানুষের এসব বাড়তি প্রশ্ন পছন্দ নয়। কয়েকটি বাচ্চা খেলছিল পাশে, ওরা জানালো। জল খুবই ঘোলা
পায়। কাজেই কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিতেই হয়। তারপরেও ফুটিয়ে নিয়ে তবেই এই জল পানীয়যোগ্য হয়।
সূর্যের তেজ যখন কমে এসেছে, তখন আস্তে আস্তে রিসোর্ট থেকে অনেকেই এলো। সাথে রিন্টু।
আমরা গ্রামের ভিতরের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম। বাড়িগুলোতে বেশিরভাগেই সুন্দর নিজেদের
খাওয়ার মতো পরিমাণে অন্তত সব্জি চাষ করা হয়েছে। এ ছাড়া পুকুর আছে। হাঁস মুরগিও রয়েছে।
শীতের বাহারি ফুল ফুটে আলাদাই সৌন্দর্য। বাড়ি, স্কুল, মাঠ, দোকানপাট পেরিয়ে আমরা হাঁটতে
লাগলাম। পৌঁছলাম জেটিতে। সেখানে তখন নতুন জেটির কাজ চলছে। ব্যস, এইটুকুই গ্রামের মধ্যে
দেখার। আগেরদিন হাট বসেছিল। তাই আজ বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ। খোলা থাকলেও, দোকানী বন্ধুবান্ধব
নিয়ে বসে তাস খেলছেন। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। থুড়ি,
রিসোর্টে। আবার এক রুটিন। চা পকোড়া। ইতিমধ্যে সকলেই সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত।
আর তাই কোন এক্টিভিটি নেই। যে যার ঘরে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নেওয়ার পালা। তারপর রাত
নটা সাড়ে নটার দিকে ডিনার সেরে ঘুম। আবার পরেরদিন সকাল ছটার দিকে বেড টি ও রানিং হট
ওয়াটার দিয়ে ঘুম ভাঙানো।
আজকেই ফেরা। তবে তার আগে সজনেখালি ওয়াচ
টাওয়ার থেকে ঘুরে আসা। ব্রেকফাস্ট করেই বেরোনো হবে। ঘুরে বেরিয়ে আসতে আসতে সাড়ে দশটা এগারোটা। এসেই
লাঞ্চ সেড়ে বেরিয়ে পরা। গদখালির উদ্দেশ্যে। সেই মতো সবাই স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট
করে লঞ্চে উঠে পড়লাম। সজনেখালি তো প্রথম দিনেই বলেছিলাম, দয়াপুর থেকে ওই মিনিত
দশেকের জলপথ। পৌঁছে ঘাটে নামলাম। আজ আর মাধব বাবু নেই। রিন্টু আর রিসোরট থেকে একজন
আমাদের গাইড হয়ে চললেন। ওখানে ঢুকেই পারমিট করাতে গেলো রিন্টু। পাশেই মধু বিক্রির
কাউন্টার ছিলো। দলের অনেকেই মধু কিনে নিলেন। তারপর এগোনো হলো। সামনেই একটা বড়
পুকুর মতো। সেখানে বুঝি টারটেল আছে। তা তিনি বাবাজী আমাদের দর্শন দিলেন না। জলে
ডুবেই থাকলেন। কেবলমাত্র তার কালো পিঠ দেখতে পেলাম। তারপর এগোলাম ওয়াচ টাওয়ারে।
তিন তলা। সবাই যারা নামছিলো, তাদের জিজ্ঞেস করে জেনে নেওয়া হল যে কিছুই দেখা
যাচ্ছে না। কাকার হাঁটুতে খুব ব্যথা, তাই ওপরে গেলো না। মা বাবা আমি গেলাম। দোতলায়
একটা বেশ সুন্দর দেখতে মৌচাক দেখলাম। ব্যস। ওপর থেকে কোন আলাদা ভিউ নেই। শুধুই ওই
সুইট ওয়াটার পন্ড। সুন্দরবন অঞ্চলে এমনিতেই এত নোনা জল ও মাটি যে আলাদা করে পশুদের জন্য সল্ট লিক এর ব্যবস্থা করতে হয়
না অন্যান্য ফরেস্টের মতো। উল্টে এই মিষ্টি জলের ব্যবস্থা রাখা। এখানেই জন্তুরা জল
খেতে আসবে। আর টুরিস্ট ওয়াচ টাওয়ার থেকে দেখবে তাদের। এই প্ল্যান। কিন্তু ওই আর
কী, কিচ্ছুটি চোখে পড়লো না।
সেখান থেকে নেমে এবারের গন্তব্য
মিজিয়াম। সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর সমস্ত রকম তথ্য ছবি ও মডেল সহ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা।
দেখলাম। বিল্ডিং এর ঠিক বাইরেই একটা সুন্দরী গাছ রয়েছে। আর উল্টোদিকে চিলড্রেন্স
পার্ক। সেই পার্কে সাজানো বাঘ হরিণ দেখেই এবারের মতো চোখ জুরালাম। আর একটু এগিয়ে
গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগের বাংলো। কাঠের। দোতলা। ঘন সবুজ। সামনেই পুকুর। আর
সারি দিয়ে সুন্দরী গাছ। এইবারে তাদের শ্বাসমূল দেখলাম ভালো করে। মিলিয়ে নিলাম
পাঠ্যবইয়ের সাথে। ব্যস। সজনেখালিতে আর দেখার কিচ্ছু নেই। আবার যে যার মতো লঞ্চে
উঠে রিসোর্টে ফেরত। ফিরেই লাঞ্চ। খিদে নেই, সবে ব্রেকফাস্ট করা। তাই অল্প একটু
মুখে দেওয়া হলো। এবার আবার সেই দেড় ঘন্টার জার্নি। দয়াপুর আর এই রিসোর্টকে টাটা
বাই বাই করে লঞ্চে ফিরলাম। আজ অবশ্য সকাল থেকে “স্বর্ণময়ী” নেই। সে গেছে পরের
পার্টিকে গদখালি থেকে আনতে। আজ তাই দুটো ছোট লঞ্চে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। সবার
বাড়ি ফেরার চিন্তা, তারই মধ্যে গল্পগুজব। এই করতে করতে গোসাবা পৌঁছলাম, দেড়টার
দিকে। গোসাবাতে দর্শনীয় বলতে বেকন বাংলো ও হ্যামিল্টন বাংলো। ঘাট থেকে হেঁটে
গেলাম। রবিবার। হাটবার। খুব ভিড়। আমাদের বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, যেন হারিয়ে
না যাই।
একটা খোলা মাঠ। তার ভিতরে একটা
লজঝড়ে চেহারার কাঠের বাংলো। রক্ষণাবেক্ষণের বালাই নেই। ভেঙ্গে গিয়েছে যেখানে
সেখানে। এটাই নাকি রবিন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজরিত বাংলো। সামনে ওঁর একটি বড়
স্ট্যাচু। ব্যস। সেখানে দাঁড়িয়ে সবাই ছবি তুলছে। কাঠফাটা গরম, রোদ। তার মধ্যে
এগিয়ে যাওয়া হলো হ্যামিল্টন বাংলোতে। হ্যামিল্টন সাহেব সুন্দরবন অঞ্চলের উন্নতির
জন্য অনেক কাজ করেছেন। উনি যেই বাংলোটিতে থাকতেন, সেটিই দর্শনীয়। বাইরে থেকেই
দেখতে হলো, কারণ ভিতরে তালা দেওয়া। সবুজ রঙের একটা বাড়ি। দেখে টেখে এবার ফেরার
পালা। আবার লঞ্চ। নদীর ও পাড়েই গদখালি। মালপত্র নিয়ে নেমে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম
সবাই। আমাদের বাস দাঁড়িয়ে। তবে বাকিরা বাসে চলে গেলেও, আমরা ফিরবো ক্যানিং থেকে
ট্রেনে। সময় কম লাগবে, আর যাদবপুর কাছে হবে বলে। একটা রুটের টাটা ম্যাজিকের ভিতরের
আটটি সিট রিজারভ করলাম, ৪০০ টাকা দিয়ে। দেড় ঘন্টার পথে পৌঁছলাম ক্যানিং। সেখান
থেকে মিনিট সাতেক হেঁটে ক্যানিং স্টেশন। তারপর?
তারপর আর কী? ট্রেন এলো। উঠলাম।
ট্রেন ছাড়ল। যাদবপুর পৌঁছলাম। অখান থেকে রিকশা করে বাড়ি।
আমার গল্পটি এইবার ফুরলো।
Saturday, February 1, 2020
Sunderban 4
দ্বিতীয় দিন
সক্কাল সক্কাল ওই ছটা সোয়া ছটার দিকে বেড টি আর সাথে বিস্কিট দিয়ে আমাদের ঘরে ঘরে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলো। তারপর সাথে সাথেই শুরু হলো গরম জল দেওয়া। ওই বালতি করে করে দিয়ে যাচ্ছিল হোটেলের ছেলেরাই। একটা সেন্ট্রাল জাউগায় বিশাল হাঁড়িতে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে জল ফুটছিলো। জানিনা সেই জলের সোর্স কী, পাশেই বয়ে চলা নালা না কি? জলের রঙ কিন্তু বেশ ঘোলাটে। যাই হোক, কীই বা করা। যা পাচ্ছি, তাই দিয়েই কাজ চালাই। খুব যে ইলাবোরেট করে স্নান করবো, সেই উপায় নেই। কারণ ঠান্ডা মন্দ না। যাই হোক, সাতটার মধ্যে সকলে তৈরি হয়ে নিলাম বটে। তাও ওই বোট ছাড়তে ছাড়তে সেই আটটাই বেজে গেলো কারণ ওই এক দুজনের লেট লতিফ আচরণ।
আজকে অনেকগুলো জায়গায় যাওয়ার কথা, বেশ লম্বা জার্নি। আর কপালে যদি বাঘ দেখা যায়, তো সে আজকেই হবে। আমাদের দয়াপুর আইল্যান্ডের থেকে বলা যায় প্রায় ওই মিনিট দশেকের জার্নিতেই (লঞ্চে অবশ্যই) পৌঁছে যাওয়া যায় সজনেখালি। সজনেখালি হলো সুন্দরবন অঞ্চলের মূল দ্বীপ বা সেন্টার। সরকারি কাজকর্ম, ট্যুর গাইড ইত্যাদি সব এখান থেকেই পাওয়া যায়। আমাদের লঞ্চ সজনেখালির ঘাটে দাঁড়ালো, তবে আমরা নামলাম না। বরং সরকার স্বীকৃত একজন ট্যুর গাইড আমাদের লঞ্চে উঠলেন। নামটা ঠিক খেয়াল পড়ছে না। ধরে নিলাম, মাধব বাবু। উনি উঠেই আমাদের সুন্দরবনে স্বাগত জানালেন। নিজের পরিচয় দিলেন। এবং জানালেন যে আমরা যতক্ষণ এই রিজার্ভ ফরেস্টের ভিতর দিয়ে চলবো, ততক্ষণ গাইডের সাথে থাকাটা বাধ্যতামূলক। উনিই প্রতিপদে আমাদের সাথে থাকবেন। জঙ্গলের নিয়মকানুন সমস্ত কিছু বলবেন। জানাবেন এখানকার মানুষজনের কথা।
সুন্দরবন অঞ্চলের টোটাল এরিয়া কত, তার কত শতাংশ ভারতে (একজ্যাক্ট সংখ্যা মনে নেই) আর কতটা বাংলাদেশে (ওখানেই বেশি এরিয়া ভারতের তুলনায়) সমস্ত বিষয়ে জানালেন। এও জানালেন যে এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ইউনেস্কো স্বীকৃত হেরিটেজ সাইট। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৈশিষ্ট্য আমরা ছোটবেলায় স্কুলের বইতে পড়েছি। এই লম্বা মোটা কান্ড, ওপর দিকে পাতার “ক্যানোপি”। শিকড় বেশ শক্তপোক্ত, মাটি আঁকড়ে থাকে। হতেই হবে, নইলে প্রতিনিয়ত এই যে নদীর পাড় ভাঙছে, তার থেকে বাঁচবে কী করে? ইয়া লম্বা লম্বা সে শিকড়, এক্কেবারে পাড় অবধি এসে পৌঁছে গিয়েছে। আন্তরজাল সৃষ্টি করে প্রায়। আবার কিছু কিছু গাছে শ্বাসমূল থাকে, যাকে ইংরেজিতে আমরা বলি, “নিউম্যাটোফোর”। এই নিউম্যাটোফোরের বৈশিষ্ট্য এদিন সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও লঞ্চ থেকে আমি বুঝিনি, তবে ভালো করে পরেরদিন দেখেছিলাম। কাজেই সেই নিয়ে কথা পরে হবে। ছবি অবশ্য আগেই আপনাদের দেখিয়েছি।
আমাদের প্রথম ডেস্টিনেশন, সুধন্যখালি। পৌঁছে গেলাম অল্পক্ষণেই। সুধন্যখালিতে দেখার বলতে ওয়াচ টাওয়ার। লঞ্চ ঘাটে এসে ভিড়লো। আমাদের নামার আগে মাধব বাবু বলে দিলেন, সকলে যেন ওনার সাথে সাথেই থাকি, হারিয়ে যেন না যাই। আমরা এক ঘাটে নামবো, উঠবো অন্য ঘাট থেকে। তাই এই সাবধানতা। কাদা পিচ্ছিল ঘাটে আমরা সবাই নামলাম এক এক করে। বড় করে গেট, লেখা সুধন্যখালি ওয়াচ টাওয়ার। ভিতরে ঢুকেই একটা অফিস মতো। রিন্টু সেখানে গিয়ে পারমিটের ব্যবস্থা করলো। তারপর আমরা সবাই চলতে লাগলাম। অল্প কিছুটা জায়গা জুড়ে ওই সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানীয় গাছ, যেমন গরান, গেঁয়ো, হেতাল, সুন্দরী আলাদা করে রাখা, জালের আড়ালে। এ ছাড়াও আরো বিভিন্ন গাছপালা রয়েছে। চেনা অচেনা। সেইসব দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে। তিনতলা উঁচু। সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। খোলা জায়গা বেশ অনেকখানি দেখা যায় ওখান থেকে। কাদা মাটি মতো খোলা জায়গা। আসলে জন্তুর দেখা পাওয়া যায় বলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটু রাস্তা করে দেওয়া, যাতে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়। যদিও জাল দিয়ে রাখা (বাঘের জন্য), তবুও, জানা কথা, এখানে বাঘ আসে না। দেখতে পেলে ম্যাক্সিমাম ওই হরিণ। তা, তাই বা মন্দ কী? আই আই টিতে থাকাকালীন হরিণের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছি, নিজের হাতে ওদের খাইয়েছি। সে আলাদা অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই জঙ্গলের পরিবেশে ওদের দেখাও কম আনন্দের নয়। তাই ওই হরিণ দেখতে পাবো ভেবেই একটু মনে উৎসাহ। আর তারই মধ্যে রব উঠলো। ওই তো হরীন। ওই যে, আরে ওই তো। সোওওওজা তাকালেই, ওই যে, কাদার মধ্যে মিশে গেছে রঙ। দলের একটি ছেলে আমার ক্যামেরার জ্যুম লেন্স তাক করে সেটিকেই বেশ দূরবীন বানিয়ে দেখে টেখে আমায় দেখতে দিলো বটে। তবে পোড়া কপাল, কিছুই বুঝলাম না। শুধু ওই ওয়াচ টাওয়ারের ব্যাকড্রপে ছবি তুল্লাম গোটাকয়েক। নীচে নেমে এলাম। সেখানে দেখি সিমেন্টের বসার জায়গা পাতা,কাকা বসে জিরোচ্ছে। পাশেই জাল দেওয়া। জালে বেশ কয়েকটা বাঁদর হুটোপুটি করছে। শুনলাম, ওখান থেকে হরিণ ভালো দেখা যাচ্ছে। লেখাপড়ায় যতটা মনোনিবেশ করলে আজ আমি নোবেল পেয়ে যেতাম, তার চেয়েও বেশি মন দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। অবশেষে, হ্যাঁ অবশেষে, দেখা মিলল। হরিণের। স্পটেড ডিয়ার। তিন চারজন ছিলো। রোদ পোহাচ্ছিল। ওদের দেখার জন্য আমাদের হুড়োহুড়ি দেখে ওরাও বোধহয় আমোদ পেয়ে দুবার উঠে একটু হাঁটা চলা করলো। তাতে আমাদেরই লাভ হলো। একটা মুভমেন্ট দেখতে পেয়ে সঠিক লোকেশনটা অনেকেই বুঝলাম। তারপর ক্যামেরার লেন্স তাক করেই খচাৎ। বেশি খচাত দেখতে দেখতে পাশের বাঁদরগুলো খিচখিচ শুরু করে দিতেই দে ছুট। ইতিমধ্যেই রিন্টু আর মাধব বাবুও আমাদের তাড়া দিতে এসে গিয়েছেন। সদলবলে সব ভালো ছেলেপুলের মতো আমরা অন্য ঘাটে বাঁধা লঞ্চে এসে উঠে পড়লাম।
লঞ্চ চলতে লাগলো। লুচি ছোলার ডাল আর ডিম সিদ্ধ প্লাস্টিকের প্লেটে সাজিয়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট দেওয়া হলো। লঞ্চে আপাতত দুলুনি নেই। কাজেই খেতে অসুবিধে নেই। এরপরের গন্তব্য, পঞ্চমুখ। অনেকটা রাস্তা। প্রায় দেড় ঘন্টা তো বটেই। গোটা রাস্তা মাধব বাবু নানান গল্প নিয়ে চললেন আমাদের সাথে। যাত্রাপথটিও বেশ ইনটারেস্টিং।
Subscribe to:
Posts (Atom)