Monday, January 29, 2018

প্রাক বিয়েবাড়ি কথোপকথন

- কী রে এখনো রেডি হতে পারলি না? কখন বেরবো?
- আরে দাঁড়া না। সবে তো ছটা বাজে। এত তাড়া কিসের?
- ও মা, তাড়া দেবো না? রেডিয়োতে শুনলি না? কত জ্যাম গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারে?
- অফিস টাইম। মঙ্গলবার। জ্যাম হবে না তো কী হবে?
- হ্যাঁ সেই জন্যই তো তাড়াতাড়ি বেরোনো উচিত।
- চিল তাতান! তাড়াহুড়ো করে এখন বেরিয়েও সেই সাড়ে আটটার আগে পৌঁছবি না। তার চেয়ে একটু রয়ে সয়ে সাড়ে সাতটার পর বেরোই। ঠিক নটায় পৌঁছে যাব।খামোখা রাস্তায় আটকে থেকে কী হবে বল তো?
- তুই বুঝছিস না দীপু। আধ ঘণ্টা। আধ ঘণ্টায় কতগুলো পকোড়া আর কত বোল স্যুপ খেতে পারতাম। নটায় সময় গেলে আবার দশটার মধ্যে বেরোনোর তাড়া থাকবে, আয়েস করে খেতে পারবো না। স্টারটার মিস হবে।
- আরে ওই পকোডা তুই মেন কোর্সের জায়গায় পেয়ে যাবি। জাস্ট অন্য নামে।
- বললেই হল?
- অফ কোর্স! কাবাবের নামে ওই ওগুলোকেই হাল্কা মডিফাই করে ছাড়ে।
- আর স্যুপ?
- ওই পানসে জলীয় পদার্থটা না খেলেই নয়?
- তো তোর মতে বিয়েবাড়িতে গিয়ে খাবো কী? স্যুপ পানসে, পকোড়া আর মেইন কোর্সের কাবাব সমগোত্রীয়, এরপর বলবি বিরিয়ানি না ভাত ভাজা।
- কেন? গরম গরম রসগোল্লা খাবি। শোন, শীতের বিয়ে। আই এম শিয়োর নলেন গুঁড়ের আইটেম থাকবেই।
- তাও তো একটার বেশী দুটো মুখে দিতে দিবি না!
- অবশ্যই! আয়নায় একবার নিজের ভুঁড়িখানা দেখেছিস তাতান?
- আয়নার সামনে দাঁড়ানোর ফুরসৎ আছে নাকি? আদৌ আয়নাটা ফাঁকা থাকে কখনো? সারাক্ষণ তো তুই একটার পর একটা ড্রেস বের করে পোজ দিয়ে নিজেই নিজেকে চেক আউট করিস।
- আহ, বিয়েবাড়িতে গিয়ে ভালো ভালো ছবি উঠবে। গ্রুপফি, সেলফি, গ্রুপ ফটো। ফেসবুকে ডিপি পালটাবো। একটু প্র্যাকটিস করবো না? Shouldn't I look my very best?
- সে তো তুই গামছা প্রিন্টের স্কারট পরলেও দারুণ লাগিস!
- গামছা??
- কেন ওই যে লাস্ট উইক তুই মন্দিরাদিদের গৃহপ্রবেশে পরলি?
- ও মাই গড, ওটা গামছা প্রিন্ট???  That was a freaking designer saree.. a one of a kind exclusive product..
- Whatever...তাহলেই বোঝ দীপু। সেদিনও এত সময় লাগালি, আমি মোচার চপটা মিস করলাম। এত সেজে কী হল? আমিই বুঝলাম না তোর সাজ।
- হুহ! তুই বুঝবি বলে যেন সাজি?
- তা না?
- অবশ্যই না! শোনো মিস্টার, মেয়েরা সাজে অন্য মেয়েদের দেখাতে। বুঝলে হে?
- হে ভগবান। যাক গে শোন, এই বকবক করতে করতে অনেকক্ষণ গেল। আধ ঘণ্টা ধরে তুই আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আছিস, এখনো ড্রেস ঠিক করতে পারলি না?
- যেটাই ভাবছি পরি আজ, মনে পড়ছে অন্য কোন পার্টিতে পরেছি। সো চেনাজানা লোকেরা দেখে নিয়েছে, রিপিট হবে।
- তুই না। উফ। ওই হলুদ সিল্কটা পর।
- কোনটা?
- ওই যে। ওই ওপরের তাকে যেটা দেখা যাচ্ছে। ওই যে রে, নীলের নীচে।
- উফ তাতান, ওটা দুপাট্টা।
- আমি কি করে বুঝব? ওই অত লম্বা জিনিস।
- তাহলে যা বুঝিস না তা নিয়ে কেন তখন থেকে হেজিয়ে যাচ্ছিস? আমায় একটু শান্তিতে ডিসাইড করতে দে না রে বাবা। ধুর।
- কারণ আমি চাই তুই তাড়াতাড়ি কর। যাতে আমরা ঝটপট বেরোতে পারি। আমি গিয়ে অন্তত তিন রাউন্ড স্টারটার আর দু বাটি স্যুপ খাবোই খাবো।
- সুস্থ মানুষে ওই স্যুপ খায় নাকি রে? তুই এত স্যুপ স্যুপ করিস না তো।
- আবার শুরুতে ফিরে গেলি তো?
- তুইই তো ড্র্যাগ করছিস।
- ঘাঁট হয়েছে আমার। উফ। তুই যতক্ষণ ধরে ইচ্ছে রেডি হও। আমি মন্টুর দোকান থেকে চিকেন চপ খেয়ে আসি। নটার আগে পৌঁছব না বুঝে গিয়েছি। আর বৃথা আশা রেখে লাভ নেই।
- সেই ভালো। আর হ্যাঁ শোন। আমার জন্য এগ রোল আনবি যখন, আগেরবারের মতো ঝাল দিতে বারণ করবি। জাস্ট লেবুর রস। নো সস। ওকে?
- যো আজ্ঞা মেরে আকা!

Thursday, January 25, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব দশ যোধপুর ও ঘরে ফেরা।

৩রা জানুয়ারি সকাল সকাল জয়সালমের থেকে রওনা দিলাম যোধপুরের উদ্দেশ্যে। ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা। তার মধ্যে আবার মাঝে চা আর দুপুরের খাবারের ব্রেক। রাস্তাঘাট খুব সুন্দর। কিন্তু গনগনে রোদ। আর এতদিনের ঘোরাঘুরির ধকল। সকলেরই অবস্থা কাহিল। বাসে আসতে আসতে পরেরদিনের ট্রেনের টিকিট ক্যান্সেল করলাম। বাবার শরীরটা হাল্কা খারাপ হবো হবো করছে। বুঝলাম সবই ক্লান্তি থেকে। এই কটাদিন প্রায় রোজ রাত্রে শুতে যাওয়া হয়েছে বারোটার দিকে, উঠতে হয়েছে সক্কাল সক্কাল। সাড়ে পাঁচটা ছটায়। লঙ জার্নি। শরীরের তো সহ্যের সীমানা থাকে, না কি?
যোধপুর পৌঁছলাম বিকেল তিনটের দিকে। আসার পথে রাস্তায় বড্ড বালি। কিন্তু শহরটা যতটুকু দেখলাম, ভারি ছিমছাম। খুব সুন্দর। গোছানো। শহরের মধ্যে দিয়ে আমাদের বাস চলতে চলতে প্রথমেই নিয়ে এলো মেহেরানগড় কেল্লায়। অনেকেই বলেন, রাজস্থান ভ্রমণের সময় তেমন বেশী না থাকলে, অন্তত যে একটি কেল্লা দেখা উচিত, সেটি মেহেরানগড়। আমি জানি না কতটা একমত হতে পারব বলে, তবে অবশ্য করেই অন্যতম সেরা ও প্রিয় এইটি। পাহাড়ের ওপর এক বিরাটাকায় কেল্লা। পনেরোশো শতাব্দীতে রাও যোধার বানানো। ভীষণ সুন্দর কারুকার্য, স্থাপত্য এবং সর্বোপরি বিরাট আঙিনা। এই এত কেল্লা ঘুরে ঘুরে উচি উঁচু সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন হাঁটুর অবস্থা যায় যায় আর কি, তখন মেহেরানগড়ের লিফট ফেসিলিটি আছে জানতে পাড়া একটা বিশাল আশীর্বাদ। টিকিট কাউন্টার থেকে কেল্লার প্রবেশপত্র কিনতে গিয়ে লিফটের জন্য আলাদা টিকিট কিনে নেওয়া যায়। তারপর লম্বা লাইনে অপেক্ষা। অন্তত মিনিট কুড়ি পরে সুযোগ এলো। লিফটে করে এক্কেবারে সাঁটত ওলায় পৌঁছলাম। বেরিয়ে দেখি আবারও এক বিশাল উঠোন মত ছাদ। ছাদের থেকে যোধপুড় শহরের অপরূপ দৃশ্য। সারি সারি নীল রঙের দেওয়ালের বাড়ি। শুনেছি নাকি কেবলমাত্র ব্রাহ্মণরা তাদের বাড়ির দেওয়াল নীল রঙ করতে পারতেন। সে যাই হোক, ছাদ থেকে ভালো লাগছিল, বোঝা গেল কেন শহরটিকে "Blue city" বলা হয়। রোদের তেজে সাংঘাতিক, আর সেই কারণেই যোধপুরের আরেক নাম "Sun city"। একটা কামান দেখলাম। ছাদ থেকে তাক করা। শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলেই যাতে দাগা যায়। আজকাল অবশ্য সে শত্রুও নেই। তা বলে মশা মারতেও ব্যবহার করে কিনা, জানা নেই।
কেল্লার ভিতরে সেই ম্যুজিয়াম। রাজা মহারাজাদের ব্যবহৃত জামা কাপড় থেকে শুরু করে অস্ত্র শস্ত্র। দেখলাম। ঘুরলাম। ভালো লাগল। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগল রাঙিদের মহলগুলি। কী সুন্দর পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। রঙের খেলা। আহা, খাসা। হাতিদের হাওদাগুলো খাসা। তেমনি ভালো লেগেছিল প্রচুর পালকি। খুব নিখুঁত কারুকার্য করা। ফুল মহল প্যালেসটি এক কোথায় অসামান্য সুন্দর। কাঁচের ওপর নানান রঙের আঁকিবুঁকি করা। ফুলের মতোই সুন্দর এটি, তাই নাম ফুলমহল। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে অসামান্য স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হতে হতে সাত তলা পার করলাম। কেল্লার ভিতরে কিছু মন্দির রয়েছে। আর রয়েছে ক্রাফট বাজার। অবশ্য করেই বাইরের চেয়ে অনেক বেশী দাম, কিন্তু দেখতে ভারি সুন্দর। হ্যান্ডিক্রাফটস, জামাকাপড় সব মিলিয়ে রঙিন পসরা। কেল্লায় প্রবেশের জন্য বেশ কয়েকটি ফটক আছে। লোহাপোলের ধারেই অনেক  হাতের ছাপ। সেগুলি নাকি সতী পালন করতে যাওয়ার আগে রাণীদের হাতের ছাপ। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এগুলো ভাবলে সত্যি খুব খারাপ লাগে বটে। কিন্তু তখন যেমন যা নিয়ম, সমাজনীতি ছিল।
প্রায় ঘণ্টা দুই পর ভালো করে কেল্লা ঘুরে আমরা এলাম মূল শহরে। আমাদের হোটেলটি একদম ব্যস্ত মেন রোডের ওপর। ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরেরদিন জয়পুর কিভাবে যাওয়া যায়, তার খোঁজ নিতে। ট্রেনে গিয়ে তেমন লাভ নেই। আবার গাড়িতেও অনেকটাই বেশী খরচা। হাঁটতে হাঁটতে কাছাকাছির মধ্যেই একটি ট্রাভেল এজেন্সির কাউন্টার থেকে বাসের টিকিট কাটলাম। আড়াইশো টাকার মত পড়ল জনপ্রতি। পরেরদিন দুপুর আড়াইতে নাগাদ বাস। দুটোর মধ্যে কাউন্টারে পৌঁছে যেতে বলল। কাছেই একটা সাইবার ক্যাফে থেকে প্লেনের টিকিট আর বোর্ডিং পাসের প্রিন্ট নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। ইতিমধ্যে দলের সকলেরই পরেরদিন ট্রেন কত লেট করবে, কী হবে, সেই চিন্তায় নাজেহাল অবস্থা। এখনো যে একটা স্পট ঘোরা বাকি, সেই নিয়ে তেমনভাবে কারুরুই হেলদোল নেই। রাত্রের খাওয়ার পর শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে খোঁজ নিয়ে জানলাম সাইটসিয়িং দুপুরে হবে। লাঞ্চের পর। যেহেতু আমাদের হাতে সময় নেই, তাই আমরা ঠিক করলাম নিজেরাই ঘুরে নেব। বাবার রাত্রে জ্বর আসায় ঘুম ভালো হয়নি, রেস্ট নেবে বলল। মা আমি আর কাকা বেরলাম। ওলা বুক করলাম, এলো না। অটো তে অনেক অনেক দরাদরি করে শেষমেশ একটাকে ঠিক করলাম। গন্তব্য উমেদ ভবন।প্রথমে যদিও ভেবেছিলাম রেস্ট নিয়ে সকালটা কাটিয়ে দেবো, আর কতই বা ওই প্যালেস দেখবো।ভাগ্যিস তা করিনি! ভাগ্যিস ইন্টারনেট ঘেঁটে সত্যি ভালো ভালো রিভিউ পেয়েছিলাম। নইলে যে কী জিনিস মিস হতে চলেছিল, ভাবা যায়না!
উমেদ ভবন প্যালেসটি মহারাজা উমেদ সিংহের তৈরি। এটিতে তিনটি ভাগ। ১। যেখানে রাজপরিবার থাকে। ২। তাজ গ্রুপের লাক্সারি হোটেল। ৩। মিউজিয়াম। প্রথম দুটিতে আমাদের এক্সেস নেই। তাই অমন অপূর্ব স্থাপত্য (ইয়ুরোপীয় ও ভারতীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণ) দেখার জন্য একমাত্র ভরসা মিউজিয়াম। প্রবল খরায় যোধপুরবাসীর অবস্থা যখন নাজেহাল হয়ে যায়, তাদের কর্মসংস্থান করার জন্যই নাকি এই বিলাসবহুল প্রাসাদটি বানানো হয়। উমেদ ভবন শহর থেকে একটু দূরে একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। পাশেই মিলিটারই এরিয়া, খুব সুন্দর ফুলের গাছে সাজানো রাস্তা জুড়ে। সোনালি আর খয়েরি রঙের মিশ্রণে যে রঙ হয়, সেই রঙের স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি এই প্রাসাদ। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। প্রথমেই সারি সারি ছবি। বর্তমান রাজপরিবারের সদস্য সদস্যাদের। কিছু পুরনো ছবি, যোধপুরের, রাজপরিবারের। গ্যালারিটির সিলিঙেও দেখার মত কারুকার্য। আধুনিকতা ও প্রাচীনত্বের এক অসামান্য সমাবেশ। বিভিন্ন পোশাক অস্ত্র শস্ত্র তো অনেক দেখেছি। কিন্তু উমেদ ভবনে যেটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল, তা হল রাজা মহারাজাদের ব্যবহৃত দৈনন্দিন প্রয়োজনের নিত্য সামগ্রী। কলম, চিঠির খাম, দোয়াত থেকে শুরু করে চায়ের পিরিচ, সুরাপানের গ্লাস, কাতলারি, আয়না, ঘড়ি, আসবাবপত্র। এক সে বড়কর এক। কত কত বিভিন্ন ডিজাইনের ঘড়ি, আমি তো দেখে পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আর ওই রাজকীয় বাসনপত্র দেখে না মনে হচ্ছিল যে ইশ, সামনের জন্মে যেন এমন রাজপরিবারে জন্মাতে পারি। আহা কি বিলাসিতা। অবশ্য ততদিনে রাজপরিবারগুলির এই বৈভব থাকবে কি না, জানা নেই। স্টাফ করা চিতাবাঘ দেখে চক্ষু চড়ক গাছ! দরবার হলের পেইন্টিংগুলি আমার মত অনভিজ্ঞর কাছেও অসম্ভব মুগ্ধতার উদ্রেক করে।  পোল খেলা যোধপুরের মহারাজাদের একচেটিয়া ছিল এক কালে, সেইসব আমলের ট্রফিগুলিও বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। মূল প্যালেসের সামনে কাঁচের ঘরে কত কত ভিন্টেজ গাড়ির প্রদর্শনী। মানে যাকে বলে, total aristocracy। উমেদ ভবনে ঘণ্টা দেড়েকের ওপর কাটিয়ে আবার অটো করে ফিরলাম হোটেলে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে বেরলাম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। বাইপাস রাস্তার ওপর দিয়ে বাস যায়, মূল শহরে তাকে আসতে দেয়না। বাস এলো প্রায় তিনটে নাগাদ। স্লিপার বাস। কী চওড়া সীট। একদম প্লেনের বিজনেস ক্লাসের মতো! দারুণ লেগস্পেস। ঘণ্টা ছয়েকের রাস্তা, আজমের হয়ে জয়পুর। একটুও কষ্ট হয়নি। জয়পুরে আমাদের হোটেলটা ভীষণ ভালো ছিল। অ্যাপ দিয়ে বুক করা। একদম সিন্ধ্রি গেট টারমিনাসের কাছেই। পরদিন সকালে আবার মা কাকা আর আমি পায়ে হেঁটে ঘুরতে বেরলাম। বাবা ব্রেকফাস্ট করে ঘরে রইলো। আমরা তিনজন কাছেই মেট্রো স্টেশন দেখে ঢুকে গেলাম।  শেষ ষ্টেশন অবধি গেলাম এলাম। কী ফাঁকা কোচ। আর কী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঝকঝকে তকতকে। বেশ লাগল। বিকেলের দিকে ক্যাব ডেকে চললাম এয়ারপোর্টের দিকে। আমার এই নিয়ে তেরো নম্বর ফ্লাইট হলেও বাবা মা এবং কাকার জন্য প্রথম প্লেনে চড়া। তাদের জন্য এক্কেবারে অনন্য এক্সপিরিয়েন্স। আমার জন্যও। যাঁদের হাত ধরে হাঁটা শিখলাম, তাদেরকে হাত ধরে প্লেনে চাপা শেখাতে পারা, বিরাট প্রাপ্তি। দু ঘণ্টার প্লেন জার্নি আর তারপর এক ঘণ্টা ক্যাবে চেপে অবশেষে দুই সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরলাম পাঁচ তারিখ।
অসম্ভব ভালো ঘুরেছি বললেও কম বলা হয়। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখতে লিখতে খেয়াল করেছি যে অনেক অনেক কিছু দেখা বাকি রয়ে গেল। অনেক কিছু আরো বেশী সময় ব্যয় করে দেখতে হত। তবে কোন আক্ষেপ নেই। বারবার ফিরে যাবো আমি রাজস্থানে, এইটুকু আমি জানি। আর তাই কোন না কোন দিন ঠিক পুরো ঘুরব। কুম্ভলগড়, রান্থামবোর, নাহারগড়, বিকানের, ভানগড়...কত কিছু বাকি। ধীরেসুস্থে নিশ্চয়ই যাবো। এমন রঙিন রাজ্য, এত আন্তরিকতা, এত আপন...

"রঙ যেন মোর মর্মে লাগে
আমার সকল কর্মে লাগে।" এই আশাতেই শেষ করলাম এবারের মতো আমার চোখে রাজস্থান ভ্রমণের লেখা। সাধারণ ভ্রমণকাহিনী অনেক পড়েছেন। সেখানে এর চেয়ে অনেক বেশী ভালো করে জায়গাগুলির ইতিহাস সম্বন্ধে, ঘুরে বেরানো সম্বন্ধে অনেক তথ্য থাকবে। আমার এই গোটা সিরিজটি লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন সাধারণ ট্যুরিস্ট হিসেবেকী দেখলাম, কী বুঝলাম আর সর্বোপরি কী উপভোগ করলাম, সেইটুকুই নিজের মত করে জানানো। গোটা যাত্রাপথে সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৯ জয়সালমের

সোনার কেল্লার সাথে বোধহয় আমাদের সব বাঙ্গালীর আলাদা একটা সেন্টিমেন্ট কাজ করে, তাই না? নইলে বলুন, জয়সালমের যাচ্ছি ভাব্লেই কেন একটা আলাদা রকমের ভালো লাগা আসবে মনে? সবাই কেন বলবে, "ইশ, কী মজা রে!"? ফেলুদস গুলে বড় হয়েছি, সোনার কেল্লা সিনেমাটা কতবার যে দেখেছি, তার আর ইয়ত্তা নেই। এবারে চাক্ষুষ দেখব, ভাবতেই উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল। মাউন্ট আবু থেকে জয়সালমেরের ওই দীর্ঘ পথ, নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর করে দিতে শুরু করলাম কিন্ডল রিডারে আবার করে সোনার কেল্লা পড়া। বই পড়া শেষ হলে চলল ইয়ুট্যুবে সিনেমাটি দেখা। জয় বাবা জিয়োর জয়, ওই ধু ধু প্রান্তরেই অমন ভালো টাওয়ার, আহা! রাস্তায় ব্রেক নিয়ে নিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে জয়সালমের পৌঁছলাম সন্ধ্যেবেলা। শহরে ঢুকতে ঢুকতেই চোখে পড়ল সুবিশাল কেল্লা। রাতের আলোয় সাজানো "সোনার কেল্লা"। অদ্ভুত ভালো লাগা, বিচিত্র অনুভূতি। চোখের সামনে ছোটবেলা।

আমাদের হোটেলে বাস পৌঁছে দিল। সেখানে রিসেপশনে দেখলাম ক্যামেল সাফারি, সোনার কেল্লার ছবি। এত বাঙালি ট্যুরিস্ট আসে ওখানে বলে, দেওয়ালে বাংলাতে নোটিস লিখে রাখা। ওই হোটেলে তখন আমাদের দল ছাড়াও আরো দুটি দল আসায় ঘরের কমতি হয়েছিল। তাই আমাদের কিছুজনকে পাশের আরেকটা হোটেলে ঘর দিল। সাপে বর হল বটে কারণ এই নতুন হোটেলটি ভারী সুন্দর। সোনালী রঙের প্রাসাদের মতোই দেখতে। ঘরগুলি বড়। বিছানা পরিপাটি। বিছানার ওপর দেওয়ালে সোনার কেল্লার একটা প্যানোরামা ছবি বাঁধিয়ে রাখা। প্রথম হোটেলটির ছাদে রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ছাদ থেকে কাছেই সোনার কেল্লা দেখা যায়। দিব্যি সেই দেখতে দেখতে মাংস ভাত দিয়ে ডিনার সারলাম।

সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেরনো হল লোকাল সাইটসিয়িং করতে। সাথে গাইড ছিলেন। প্রথমেই গেলাম পাট্টা কি হাভেলিতে। ওই একই জায়গায় দুটো হাভেলি আছে। আমরা একটিই দেখা স্থির করলাম। পঞ্চাশ টাকা টিকিট কাটতে হল। হাভেলির বাইরে থেকে দেখলাম সোনালী পাথরে তৈরি একটি বিশাল বড় বাড়ি। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকার্য করা দেওয়ালে, পাথরের ওপর। বারান্দাগুলি দেখার মতো। তেমনি দেখার মতো হল জাফরি কাজগুলি। ব্যবসায়ী পরিবারের অঢেল টাকা, তাই এমন ব্য্যবহুল বাড়ি বানানো। বিলাসবহুলও বটে। হাভেলির ভিতরে বিশাল উঁচু উঁচু সিঁড়ি। এবং সরু। আমার আবার একটু ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে, তাই হাল্কা অস্বস্তি হচ্ছিল সিঁড়ি ভাঙতে। কিন্তু এই কষ্টটা সত্যিই করা উচিৎ। কারণ ভিতরটাও দেখার মতোই সুন্দর। সিলিঙে নানান রঙের পেইন্টিং থেকে শুরু করে কাঁচের কাজ, স্কাল্পচার, অসামান্য। একেক তলায় একেক খনির সম্ভার যেন। সবচেয়ে ওপরতলা আর ছাদ, দুই জায়গা থেকেই বিশাল সোনার কেল্লা দেখা যায়। আমাদের গাইড তো বেশ উৎসাহ পেয়ে আমায় দাঁড় করিয়ে পোজ দিইয়ে অনেক ছবি তুলে দিলেন সোনার কেল্লার ব্যাকড্রপে। হাভেলির বাইরে আবার অনেক ছোটখাটো দোকান। সস্তায় বেশ রংবেরঙের জামা ব্যাগ শোপিস ইত্যাদি ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিল। আমি কি কিনলাম কিছু? হ্যাঁ অবশ্যই! যোধপুর ছাড়া সব জায়গা থেকেই আমি কিছু না কিছু কিনেছি, এইটা পরে খেয়াল হল!

হাভেলি ঘোরা এবং তারপরে কেনাকাটির পর গাইড আমাদের ভিতরের গলির রাস্তা দিয়ে দিয়ে নিয়ে চললেন সোনার কেল্লার দিকে। একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলাম। রাস্তা জুড়ে দেওয়ালগুলিতে বিয়ের বিজ্ঞপ্তি। অমুকের সাথে তমুকের বিয়ে। অমুক দিন। তমুক জায়গায়। বাড়িগুলোর দেওয়ালে লেখা। রঙিন। মা অবাক হয়ে জানতে চাইল এখানে কার্ডের প্রচলন নেই নাকি? গাইড বললেন যে হ্যাঁ, টা আছে। তবুও এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়াটা চলে আসছে বছরের পর বছর। ভারী মজার কিন্তু!

সোনার কেল্লাতে ঢুকলাম একটা বাজার অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে। সোনার কেল্লা নাকি অন্যতম "living fort", অর্থাৎ, এখনো জয়সালমের শহরের বহু বাসিন্দা কেল্লার মধ্যেই বসবাস করেন। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই কেল্লা। কিছুটা এলাকা শুধুমাত্র টুরিস্টদের জন্য। কিছুটা ব্রাহ্মণদের থাকার জায়গা আর কিছুটা রাজপুতদের। গাইড বললেন, কেল্লার ভিতরে অনেকটা হাঁটাহাঁটি আর কিছু সিঁড়ি ভাঙ্গা রয়েছে। সেই শুনে দলের তিন চারজন এলেন না। তারা নীচেই বসে চারিদিক দেখতে লাগলেন। দোকানপাট, লোকজন। আমরা গাইডের পিছন পিছন চললাম। প্রথমেই আমাদের নিয়ে এলেন লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে। দেব দেবী নিয়ে কিছু বলার নেই, তবে মন্দিরের বাইরের কারুকার্য খুব সুন্দর। সেই জাফরি কাজের। এরপরের স্থান হল "মুকুল বাড়ি"। সোনার কেল্লা সিনেমায় যে বাড়িটা দেখে মুকুল নিজের বাড়ি বলে পরিচয় দেয়, সেই ভগ্নাবশেষটি এখন আরেকটা "স্পট"। অন্যান্য প্রদেশের টুরিস্টদের সেটি দেখানো হয় কিনা সেই বিষয়ে আমার খুব কৌতূহল। চারিদিকেই মুকুল আর মুকুল। একটি দোকান দেখলাম পাথর বাটির, সেটির নামেও মুকুল। শুনেছি ওখানে নাকি প্রত্যেক দোকানেই (অন্তত পুরনো গুলো) সত্যজিত রায়ের ছবিতে পুজো করে। নেহাত কোন দোকানে ঢুকিনি, তাই যাচাই করতে পারিনি। এমনি রাস্তার ধারে কেল্লার মধ্যে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে সোনার পাথরবাটি। দর দাম করতে হবে অবশ্যই। কিনলাম কয়েকটা।

এরপর মূল মহলে যাওয়া কেল্লার। টিকিট কাটতে হল। ক্যামেরার আলাদা টিকিট। প্রাসাদে রাজাদের বংশতালিকা, তাদের ছবি তো দেখলামই, সাথে তাদের ব্যবহৃত পোশাক, অস্ত্র সবই চোখে পড়ল। এগুলি দেখে দেখে এখন চোখ পচে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু যা বার বার দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম, তা হল স্থাপত্য। কী অসম্ভব সুন্দর করে পাথরের ওপর খোদাই করে কাজ করা। ততক্ষণে সূর্যের তেজ বেড়েছে। সূর্যের আলোয় হলুদ স্যান্ডস্টোনের কেল্লাকে দেখে সত্যি মনে হচ্ছিল যেন সোনা দিয়ে তৈরি। সোনালি আভা ঠিকরে পড়ছিল যেন। প্রাসাদের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম অনতিদূরে জৈন মন্দিরের চুড়ো। পাশে লোকজনের বাড়ি। প্রাচীন কেল্লায় এখন টাটা স্কাইয়ের এন্টেনাও দেখলাম, পুরনো ও নতুনের কী অদ্ভুত সুন্দর মিলন। ছাদ থেকে পাট্টা হাভেলিটিও দেখলাম। জায়গায় জায়গায় এখন হোটেল, দোকান। ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছে কেল্লার ভিতর। যার ফলে নাকি এখন কেল্লার সামগ্রিক অবস্থা বিশেষ সুবিধের না, সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা গিয়েছে। ড্রেনেজ সিস্টেমের অবস্থা নিতান্তই শোচনীয়।  মাঝে মাঝে থেমে থেমে আমরা ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম কেল্লা থেকে। পারকিং লট অবধি পৌছতে পৌছতে কেল্লার বিশাল প্রাচীর আমাদের সাথে সাথেই ছিল। সোনার কেল্লা সোনার কেল্লা বলে এত উত্তেজনা, তাও দেখা শেষ!
ইতিমধ্যে ওই ভীষণ রোদে ঘুরে ঘুরে আমার সাইনাসের ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠল। তাই এরপরে কাছেই একটি মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে আর আমি নামিনি। বিকেলে উট চাপতে হবে যে। এনারজি বাঁচানো আর কী!

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট মিটিয়ে চারটে নাগাদ বেরনো হল আবার বাসে করে, ক্যামেল সাফারির উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে তো যাবতীয় সব রকম পড়াশোনা করে রেখেছি, কী ভাবে উটে উঠবো। খুব লাফাচ্ছি, আহা, উট, শিপ অফ দি ডেজারট, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। তারপরে যখন আসল সময় এলো, ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়। আমি বেঁটে মানুষ, পা দুটো ছোট। বাইকে একদিকে দুই পা রেখে বসি, সে হেন মানুষকে উটের পিঠে বসাতে গিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। দলের আরেকটি মেয়ে ছিল, কোনমতে উটে চেপে তার কোমর জড়িয়ে বসেছি। উট সামনে ঝুঁকবে না আমি পিছনে ঝুঁকব, এই ভাবতে ভাবতে  ঠিক করতে করতে দেখি হ্যাঁচকা দিয়ে উট চার পায়ে খাঁড়া। উটের পিঠে চেপে তারপরে শুরু হল আমাদের সাফারি। উট ব্যাটা সোজা রাস্তা দিয়ে যাবেনা, তাকে যত উঁচু নীচু জায়গা দিয়েই যেতে হবে। খালি মনে হচ্ছে, এই রে, এই বুঝি উল্টে পড়ব। উটের সাথে যে ছেলেটি যাচ্ছিল, সে যত আমায় বলে যে কিচ্ছু হবেনা, পড়ব না। রিলাক্স করি যেন। আমার তো ভয়ে অবস্থা খারাপ। পারলে ওখানেই নেমে যাই, এমন অবস্থা। এই হাল্কা দুলুনি, এই বুঝি গেলাম, এই রে, এই শেষ, সাইকেল থেকে পড়ে হাত ভাঙতে ভাঙতে বেঁচেছি, ফাঁড়াটা কাটেনি, এই এবার উট থেকে পড়ব, এইসব ভাবতে ভাবতে যতক্ষণে দেখি এডজাস্ট হবো হবো, ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। মিনিট পনেরো, মোটামুটি মরুভূমির ওপর দিয়ে গেলাম। তবে সেখানে গিয়ে উট চালক বলে কি এটা কী আর আসল রেগিস্তান, আরো ছয়শো টাকা দিলে আধ ঘন্টা ধরে মূল মরুভূমিতে ঘুরিয়ে আনবে। কোথায় রুদালি, কোথায় বর্ডার ইত্যাদি সিনেমার শুটিং হয়েছে, সব দেখাবে। ততক্ষণে আমার অবস্থা এমন যে ফ্রিতে নিয়ে গেলেও যাবো না। বাবা রে বাবা, সখ মিটে গিয়েছে। হেঁটে চলে বেরাব, তাও ভালো। কিন্তু উটের পিঠে আর না। দাঁড়িয়ে ঘুরে বেরিয়ে তারপরে সূর্যাস্ত দেখলাম মরুভুমিতে। বিরাট লাল সূর্য আস্তে আস্তে ঢলে পড়ল পশ্চিম আকাশে। দিগন্ত বিস্তৃত লালচে আভার আকাশ। ক্রমে অন্ধকার নামল। আমাদের এরপরের গন্তব্য ফোক ডান্স শো। ক্যাম্পে যেতে গিয়ে দেখলাম পূর্ণিমার এত্ত বড় চাঁদ উঠছে। সূর্যাস্ত সূর্যোদয় অনেক দেখছি, চন্দ্রোদয় এই প্রথম দেখলাম। অসম্ভব সুন্দর লাগল। খোলা আকাশের নীচে এরপর গ্যালারিতে বসলাম। খুব কনকনে ঠান্ডা ছিল। ভালো করে সোয়েটার পড়ে চাদর মুরি দিয়ে বসলাম। শুরু হল কেসরিয়া বালাম গান দিয়ে। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায়। পরপর চলতে লাগল রাজস্থানি লোকসঙ্গীত, সাথে নাচ। সে নাচ কখনো ঘুমর নাচ, কখনো বাঞ্জারা নাচ। আগুন নিয়ে নাচ, কাঁচের ওপর দাঁড়িয়ে নাচ, মাথায় মটকা ব্যালেন্স করে নাচ। আহা। না দেখলে বোঝান যাবেনা বলে। অসম্ভব ভালো লেগেছিল। ঘন্টা দুই পারফরমেন্স দেখে এবার হোটেল ফেরার পালা।
আর মোটে যোধপুর ঘোরা বাকি। পরের দিন যোধপুর। তারপরের দিন সেখান থেকে যোধপুর এক্সপ্রেসে হাওড়া ফেরার টিকিট। এদিকে ট্রেন ট্র্যাক করে দেখা যাচ্ছে, কুয়াশার জন্য প্রত্যেক দিন ট্রেনটি প্রায় ১৫-১৬ ঘন্টা লেটে চলছে। যে ট্রেনটা হাওড়া থেকে আসবে আর আমরা তাতে উঠব, সেটা যোধপুর থেকে ছেড়েছে প্রায় ১৬ ঘন্টা লেটে। বাড়তি চিন্তা শুরু হল ফেরা নিয়ে। ট্রেন ক্যান্সেল করলেই শেষ। ডিনার টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ট্রেনে ফিরলে খুব দেরি হয়ে যাবে। ততদিনে সকলেই আমরা টায়ারড ভীষণ ভাবে। লম্বা ট্রিপ করে কাহিল চারজনেই। যোধপুর থেকে ফ্লাইট আছে কলকাতার, তবে ভায়া দিল্লি বা বম্বে। তাতে তখন টিকিটের দাম ষোল সতেরো হাজার টাকা একেক জনের। মারাত্মক। জয়পুর থেকে দেখলাম ছয় হাজারের একটু বেশী। খানিক ভেবেচিন্তে জয়পুরের টিকিট কেটে নেওয়া হল। আগে তো যোধপুর পৌঁছই, তারপর দেখা যাবে। যোধপুর আই আই টি তে আমার এক পরিচিত পড়ায়, ওকে জিজ্ঞেস করলাম জয়পুর যাবো কি ভাবে। বাস গাড়ি ট্রেন সবের হদিস পেলাম। নিশ্চিন্ত হলাম। মা বাবা আর কাকার প্রথম ফ্লাইট হবে, সেই নিয়ে অল্প উত্তেজনাও হল। জয়পুরে গিয়ে কোথায় থাকব, সেটাও অ্যাপ দিয়ে খুঁজে বুক করে ফেললাম চুটকিতেই। কত সুবিধে আজকাল!
আগামীকাল লম্বা জার্নি আবার। যোধপুর যাওয়া।


আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৮ (হলদিঘাটি ও মাউন্ট আবু)

উদয়পুর ঘুরবার পর আমাদের পরেরদিন সক্কাল সক্কাল বেরোনো হল। উদ্দেশ্য মাউন্ট আবু। পথে একবার যাওয়ার কথা হলদিঘাটি। ঘন্টাখানেকের পথ ছিল। হার কাঁপানো ঠাণ্ডায় বাস যখন হলদিঘাটিতে পৌঁছল, তখন যেন বাস থেকে নামতেই ইছহে করছেনা, এমন অবস্থা। চেতকের স্মৃতি ফলক ছিল আমাদের প্রথম স্টপ। সেই জায়গাটিতেই চেতক তার শেষ নিঃশ্বাস নেয়। অসীম সাহস, দক্ষতা ও প্রভুভক্তির চরম নিদর্শন রাণা প্রতাপের ঘোড়া চেতক। তাই তার স্মৃতি বিজড়িত স্থানটি দেখতেই হত। মোটা সোয়েটার, চাদর, টুপি পরেও যেন বাধ মানছিল নাওই কনকন ঠাণ্ডা বাতাস। হাতে হাতে ঘষতে ঘষতে তাও নামলাম। দেখলাম। অনুভব করলাম। মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথেই রয়েছে একটু সামনেই, মহারাণা প্রতাপ মিউজিয়াম। একটা নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে এই মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখা যায়। ঢুকেই প্রথমেই নজরে পড়ে কপার রঙের ধাতুর তৈরি বিরাট কিছু মূর্তি। যুদ্ধরত রাণা প্রতাপ ও মান সিংহ, কিছু আরও সহকারী সেনা। মিউজিয়ামের ভিতর ঢুকে সেই রাজপুত রাণাদের অস্ত্রশস্ত্রর প্রদর্শনী দেখলাম। ইতিমধ্যে বেশ কিছু মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে এখন আর ওগুলোর প্রতি আলাদা আকর্ষণ বোধ করছিলাম না। যেটা ভালো লাগল এরপর, সেটা হল পাঁচ মিনিটের একটি ভিডিয়ো, রাণা প্রতাপের জীবনী নিয়ে।
হলদিঘাটির যুদ্ধের ঘটনা প্রায় প্রত্যেকেই আমরা পড়েছি ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু মূলত আমাদের ইতিহাস শিক্ষা সীমিত থেকেছে মোঘল সাম্রাজ্যের কাহিনী অবধি। রাজপুতদের কাহিনী খুব কম পড়েছি। এই ভিডিয়োটির মাধ্যমে রাজপুতদের বীর বিক্রমের কথা দেখতে পাই, জানতে পারি তাদের শৌর্যর কথা। হলদিঘাটির যুদ্ধের একটা ব্যাপার যেটা লক্ষ্য করলাম তা হল, রাণা প্রতাপের সেনাপতি ছিলেন এক মুসলমান ব্যক্তি। আর আকবরের সেনাপতি ছিলেন মান সিংহ। অর্থাৎ এটিকে কিন্তু সেই অর্থে হিন্দু মুসলমানের communal warfareও বলা চলে না। যেদিন প্রবল যুদ্ধ চলছিল, প্রায় রাণা প্রতাপের হার নিশ্চিত, এমন সময়ে তার এক সৈন্য, যাকে অবিকল প্রতাপের মতোই দেখতে, সে প্রতাপের বেশ ধারণ করে লড়াই করেন ও প্রাণ বলিদান দেন। সেই সুযোগে প্রতাপ চেতকের সাহায্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে সক্ষম হন। এই সময়ে চেতকের বীর বিক্রমের কাহিনী তো আমরা সকলেই জানি। রাজস্থান বিভিন্ন স্থানেও এর চিত্র বা মূর্তি দেখেছি। ভিডিয়োটির পর লাইট এন্ড সাউন্ডের ব্যবস্থা ছিল। পুতুল ও আরো বিভিন্ন প্রপ্সের সাহায্যে, লাইট ফেলে সাথে সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যুজিক দিয়ে মহারাণা প্রতাপ ও হলদিঘাটির লড়াইয়ের পুরো ইতিহাস বলে যাচ্ছিল। পান্নাদাইয়ের ইন্সটলেশনের সামনে এসে খানিক স্তব্ধ হলাম। যদিও পান্নার চরম বলিদানের কথা বইতে পড়া, তবুও চোখের সামনে ওই নিজের সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে রেখে রাণাকে সুরক্ষিত স্থানে সরানোর দৃশ্য দেখে যেন ব্যাপারটা ধাক্কা মারল। একজন মা যে কীভাবে এমন বলিদান দিতে পারেন, দেশমাতৃকার জন্য, সত্যিই ভাবনার বাইরে। মিউজিয়ামের বাইরে গুলকন্দ বিক্রি হচ্ছিল। আমরা কিনিনি। বরং আশেপাশে একটু ঘুরলাম। কিছু উট, গরু ইত্যাদির বড় মূর্তি আছে। ছবি তোলার জন্য ভালো। গরুর টানে আখের রস তৈরি হচ্ছিল, সেটাও দেখলাম। দশ টাকা করে গ্লাস প্রতি বিক্রিও হচ্ছিল। স্যুভেনির শপ আছে। বাইরে থেকেই দেখতে ভালো। ঢুকলে মোটামুটি গলা কাটা দাম যে হবেই, আন্দাজ করে নিয়েছিলাম। মূল কম্পাউন্ডের বাইরে কিছু উট সাজানো ছিল, কেউ যদি সাফারই করতে চান, সেই উদ্দেশ্যে। আমরা রাস্তায় চায়ের দোকান থেকে গরম গরম চা খেলাম, ঠাণ্ডায় আরাম হল। ব্রেকফাস্টে সেদিন ওই বান রুটি ইত্যাদি আর ভালো লাগছিল না বলে খাইনি। রাস্তার দোকান থেকেই পোহা খেলাম। মেসে এমনিতে পোহা দেখলে নাক কুঁচকোই, কিন্তু এদিন দিব্যি ভালো লাগল। আশেপাশে হলদিঘাটির হলুদ মাটিও দেখলাম।
এরপর রওনা দিলাম আরাবল্লী পাহাড় ভেদ করে মাউন্ট আবুর দিকে। ঠাণ্ডা ভালোই লাগছিল। পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। হোটেলটি ছিল একটু রাস্তার ভিতরে। দেখলাম পাশাপাশি অনেকগুলো হোটেল ওরকম। বাড়িগুলোর সব কমন দেওয়াল। ওই সরু রাস্তায় আমাদের বড় বাস আসতে পারবেনা। তাই আমাদের এবং আমাদের লাগেজের জন্য জিপগাড়ির ব্যবস্থা হল। জীপ চড়লেই বেশ একটা পাহাড় পাহাড় অনুভূতি হয়, ভালো লাগে। মিনিট পাঁচেকে পৌঁছলাম হোটেল। ছিমছাম। সুন্দর। দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা গেলাম নাক্কি লেক দেখতে। হোটেল থেকে পায়ে হাঁটা পথ। এ যাবত অনেক লেক দেখেছি পাহাড়ি শহরে। এই লেকটিও তার মধ্যে কোন আলাদা কিছু নজরে এলনা। সাধারণ সাজানো গোছানো লেক। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। আলো দিয়ে ধারটা ঝলমল করছে। বোটিং চলছে। যেটা টেনেছিল সেটা অবশ্য করেই সারি সারি দোকান। লেকে যাওয়ার রাস্তা জুড়ে শুধুই দোকান আর দোকান। হ্যান্ডিক্রাফট, ব্যাগ, জামা, জুতো সব। আর খালি খাবারের দোকান। আইসক্রিম, ডাল বাটি চুরমা, মোমো, পুরী সব্জি কী নেই? মনের সুখে কেনাকাটা হল। ভুট্টা সিদ্ধ খাওয়া হল। ওই সময়ে তিনদিন ব্যাপী "winter festival" চলছিল মাউন্ট আবুতে। নাচ গান, খেলা, ফটোগ্রাফি নানান বিষয়ে বিভিন্ন এক্টিভিটিজ ছিল। আমরা সন্ধ্যের বাকি সময়টা কাটালাম সামিয়ানার নীচে বসে রাজস্থানি লোক নৃত্য দেখতে দেখতে। ভারী রঙিন সে দৃশ্য। গানগুলিও বড্ড "catchy"।
পরের দিন গরম গরম আলুর পরোটা ছোলার তরকারি আর মিষ্টি খেয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা আবার জিপগাড়িতে চেপেই বেরলাম লোকাল সাইটসিইং করতে। মাউন্ট আবুতে দর্শনীয় স্থান বলতে বিশ্ব বিখ্যাত দিলও্যারা মন্দির। জৈনদের মন্দির। অসামান্য স্থাপত্য কারুকার্য। কিন্তু সেটি এগারোটা না বারোটার আগে খোলেনা। তাই সময় কাটাতে আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ব্রহ্মকুমারীদের হেড সেন্টারে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও ইয়ুট্যুবের কল্যাণে ব্রহ্মকুমারীদের সাথে আমাদের পরিচয় আছেই, তাদের হেড অফিস (অফিস বলা চলে কি?) দেখলাম। ধব ধবে সাদা বাড়ি। সামনে ভীষণ সুন্দর করে বাগান করা। বাড়িটির ভিতরে রয়েছে প্রেয়ার হল। ঝকঝকে তকতকে। ওখান থেকে তারপরে গেলাম একটি শিব মন্দিরে। কোন বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু ভারতীয়দের একটু মন্দির দেখালে তারা খুশী হয়ে যায়, আর সেই জন্যই বুঝি এই মন্দিরগুলিও "স্পট" হয়ে গিয়েছে। এটি ছিল হাঁটা পথে। এরপরে আবার জিপে চড়ে যাওয়া হল আরো এক মন্দিরে। নাম আর মনে নেই। তবে বিষ্ণু আর মহাদেব দুজনেই উপাসিত, সেইটুকু মনে আছে। মন্দিরটি বড়। পাথরের কাজ করা।
পরের গন্তব্য গুরু শিখর। মাউন্ট আবুর সবচেয়ে উঁচু স্থান। অনেকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে আবারও সেখানে মন্দির। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই মন্দিরে যাইনি। এমনিই হেঁটেচলে আশেপাশেটা দেখলাম। কাঁচা গাজর, মুলো, ভুট্টা বিক্রি হচ্ছিল। রোদ পড়ে বেশ একটা শীতের আমেজ পাচ্ছিলাম। ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নিজেরা ছবি তুললাম। অবশেষে বারোটা বাজতে গেলাম বহু প্রতীক্ষিত দিলোয়ারা মন্দিরে। মন্দিরে ঢুকতে গেলে সাংঘাতিক কড়া সিকিউরিটি। ফোন বা ক্যামেরা এলাউড না। তাই দুর্ভাগ্যবশত অমন অপূর্ব শিল্পকলার একটি ছবিও নেই। জুতো খুলে ব্যাগ ম্যানেজার কাকুর জিম্মায় রেখে লম্বা লাইন দিয়ে (ছেলেদের ও মেয়েদের লাইন আলাদা) ঢুকলাম। দেখলাম ড্রেস কোড রয়েছে। হাফ প্যান্ট লুঙ্গি ইত্যাদি চলবেনা। মন্দির কমপ্লেক্সের ভিতর তিন চারটে মন্দির দেখার মতো। বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায়না যে ভিতরটা অমন সুন্দর। আসলে এটি নাকি ইচ্ছাকৃত। যাতে কি না শত্রুরা নষ্ট না করে। মন্দিরের মধ্যে মার্বেলের ওপর exquisite স্থাপত্য। জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি, মন্দির, বিভিন্ন নারী পুরুষের আকৃতি। দেখার মত। অনেকের মতে তাজ মহলের চেয়েও নাকি অপূর্ব। আমার যদিও তেমন মনে হয়নি, কিন্তু দেখতে ভীষণ ভালো লেগেছে, এইটুকু বলতে পারি। মন্দির ঘুরতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগল। মন্দির তৈরির ইতিহাস জানলাম। জানলাম একটি মন্দির কারিগরেরা নিজেদের ফ্রি টাইমে বিশ্রাম না নিয়ে ঝটতি পটতি মার্বেলের অংশ বিশেষ দিয়ে তৈরি করেন। তার ডিজাইন অবশ্যই তত সূক্ষ্ম না হলেও তাদের এফোরটটাকে সাধুবাদ জানাই।
হোটেলে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে অল্প ঘুম দেওয়া হল। বিকেলে পায়ে হেঁটে সানসেট পয়েন্ট যাওয়ার কথা। এমন ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে পড়েছিল, আর লেপের তলা থেকে বেরোতে পারিনি! মনে হল, সানসেট তো অনেক দেখেছি। একটু আরাম করি। বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখে মন খারাপ না করে লেপের ওম নিই। ন্যু ইয়ার ইভ স্পেশাল সেদিন জম্পেশ ডিনার হল। মাছ, পাঁঠার মাংস, ডিমের ডেভিল, ফ্রায়েড রাইস, কাস্টারড ইত্যাদি ইত্যাদি। পরেরদিন সকাল সকাল বেরোতে হবে। পরবর্তী গন্তব্য জয়সালমের। লম্বা রাস্তা, প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার। ব্রেক দিয়ে যেতে যেতে বারো ঘণ্টা লাগবেই। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেও, রাত বারোটা বাজতেই ফেস্টিভাল (আমাদের হোটেল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে ছিল) প্রাঙ্গণ থেকে খুব বাজি ফাটার আওয়াজ আসছিল, ঘুম ভেঙ্গে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করে আবার ঘুম দিলাম। 

Tuesday, January 23, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৭ (উদয়পুর)

উদয়পুর পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল। রাজস্থান ট্রিপ যখনই কোন ট্রাভেল এজেন্সির সাথে হয়,যেহেতু একেকটা জায়গা একে ওপরের থেকে এতটাই দূরে, তাই কোন স্পটে দুই রাত্তির রাখা মানে আসলে তার মধ্যে একটা দিন ধরে সেখানে পৌঁছনোর জন্য। আরেকটা দিন হয় সেইখানের সাইটসিয়িং করার জন্য। এই কদিনে এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করেই নিয়েছিলাম। আর তাই যত দেরিতেই কোন জায়গায় পৌঁছই না কেন, আর প্যানিক করতাম না। উদয়পুরে আমাদের যে হোটেলে রেখেছিল, সেটা একটা চৌরাস্তার মুখে, আমাদের অত বড় বাস ওখানে পার্ক করা যাবেনা। তাই মালপত্র ট্রাভেলের ছেলেদের জিম্মায় রেখে আমরা মিনিট পাঁচ সাত হেঁটে হোটেলে পৌঁছলাম। মোতি মহল। একদম মুক্তোর মতোই ধবধবে সাদা। এই প্রসঙ্গে বলি, উদয়পুরের বিভিন্ন নামের মধ্যে, "white city" প্রসিদ্ধ (ঠিক যেমন জয়পুর পিঙ্ক সিটি আর জয়সালমের golden city, ইত্যাদি)। হোটেলটি বেশ সুন্দর সাজানো, ঘর দোর স্ট্যান্ডার্ড। সেদিন রাত্রে আমাদের আর কিছু করার ছিল না। মাংস ভাত খেয়ে টিভি দেখে ঘুম। পরের দিন সকাল সকাল সাইট সিয়িং করতে বেরোনোর কথা।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরলাম শহর ঘুরতে। বাসে যেতে যেতে প্রথমেই আমাদের বেদান্তর হেড কোয়ার্টার দেখাল। আরো জানলাম, জিঙ্কের জন্য প্রসিদ্ধ উদয়পুর। এরপর আমরা পৌঁছলাম ফতেহ সাগর লেকে। City of lakes বলে বিখ্যাত উদয়পুরকে অনেকেই Venice of the east আখ্যাও দেন। মূলত পাঁচটি বড় লেকের মধ্যে অন্যতম ফতেহ সাগর। বিশাল জায়গা জুড়ে এই লেক। এখানে এমনি মোটর বোট ছাড়াও স্পীড বোটিং ও করা যায়। আমরা মোটর বোটে উঠে গোটা লেকের এক চক্কর কাটলাম। পাহাড় ঘেরা এই লেকটির আঁকার দূর থেকে দেখলে অনেকটা ভারতে ম্যাপের মত লাগে। এই লেকের মধ্যে কয়েকটি দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপগুলিতে রয়েছে নেহরু পার্ক, সোলার অবজারভেটরি। প্রতিটিই আলাদা করে টুরিস্ট ডেসটিনেশন। আমরা একটাতেও নামিনি, কিন্তু লেক ঘুরে দেখার সময় দেখলাম আর ছবি তুললাম। মিনিট কুড়ি ধরে চলল জলবিহার।
এরপরে আমরা গেলাম লেকের প্রায় উল্টোদিকেই অবস্থিত রাণা প্রতাপ স্মারকে। পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সময়সাপেক্ষ। আমাদের হাতে তেমন সময় ছিল না। তাই আমরা আমাদের বাসেই গেলাম। মোতি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই স্মারকটি। মহারাণা প্রতাপ ও তার সাধের চেতকের একটি lifesize ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে। মূর্তির ফলকে হলদিঘাটির যুদ্ধ আর চেতকের শেষ নিঃশ্বাসের দৃশ্য দুইদিকে খোদাই করা। এই স্মারকস্থলটি থেকে উদয়পুর শহরের কিছুটা দেখা যায়। আশেপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। পাশে ফতেহ সাগর লেক। রোদ ঝলমলে। শীতের সকাল। সব মিলিয়ে জমজমাট। সামনেই একটি ছোট্ট স্যুভেনির শপও রয়েছে। আমি চেতক চাবির রিং কিনলাম সেখান থেকে।
পরবর্তী গন্তব্য ভারতীয় লোককলা কেন্দ্র। এটি রাজস্থানি আর্ট এন্ড ক্রাফট সম্বন্ধে জানার জন্য একেবারে যোগ্য স্থান। বিভিন্ন রাজস্থানি শিল্পকলা, তাদের ইতিহাসের রঙিন সমাবেশ এই কেন্দ্রে। সত্যি কথা বলতে, তখন মনে দিয়ে পড়ে এলেও এখন হয়তো জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে পারব না। কিন্তু ওই সময়ে যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করেছিলও মনে, সেটা অনস্বীকার্য। আগেও বলেছি, রঙ আমার খুব প্রিয়। আর তাই এই জায়গাটা আমার বেশিরকমের পছন্দ হয়েছিল। ছবিতে কয়েকটা উদাহরণ দেখালেও সামনা সামনি দেখার আলাদা "চার্ম"। ওই একই জায়গায় এরপর আমরা দেখতে পেলাম ট্র্যাডিশনাল রাজস্থানি পুতুল নাচ। রাজসভায় রাজা ও মন্ত্রীদের সামনে বসে রাজ নর্তক ও নর্তকীর নাচ, ফোক ম্যুজিকের তালে তালে। কতটা দক্ষতা লাগে এই ধরণের উপস্থাপনা করতে, না দেখলে বোঝা কঠিন। ভীষণভাবে উপভোগ্য।
লোক কলা কেন্দ্রের পর আম্রা গেলাম "সহেলীয়ও কি বাড়ি"। রাজপরিবারের মেয়েদের তাদের সহেলীদের সাথে খেলে বেরানোর জায়গা এটি। কিছুই না তেমন, শুধু একটু ফোয়ারা দিয়ে ঘেরা সাজানো গোছানো সুন্দর ফুলে ভর্তি বাগান। ছবি তোলার জন্য মনের মত জায়গা। মিনিট কুড়ির মধ্যে ঘুরে নেওয়াই যায়। বাইরে রাজস্থানি পোশাক পরে ছবি তোলানোরও ব্যবস্থা আছে।
সকালের মত ঘুরে এবার হোটেল ফিরে লাঞ্চ সারা হল। দ্বিতীয়ার্ধে ঘোরার কথা ছিল সিটি প্যালেস। ততক্ষণে কেন জানিনা ওই প্যালেস আর ম্যুজিয়াম দেখতে দেখতে একটু হলেও একঘেয়ে লাগছিল। তার ওপর জনপ্রতি সারে তিনশো টাকা শুনে একটু হলেও বিরত হলাম। আমরা চারজনে সেই জায়গায় অটো ভাড়া করে চলে গেলাম লেক পিচোলা। উদয়পুর বলতেই লোকের মনে যেই নাম আসে, সেটি এই লেক পিচোলা। ভিড় জমজমাট লেকের ধার। পাশেই উদয়পুরের সিটি প্যালেস। লেকের মধ্যে দ্বীপগুলিতে রয়েছে লেক প্যালেস (বর্তমানে বিলাসবহুল হোটেল। সিনেমার শুটিং, প্রচুর টাকাওয়ালা লোকেদের বিয়েবাড়ি এইসব পারপাসেই ব্যবহার হয়) , জগমন্দির ( এর রূপ দেখেই নাকি সম্রাট শাহ জাহান তাজ মহল বানানোর অনুপ্রেরণা পান)। আমরা যেটা করলাম, লেকের কাছেই একটু উঁচুতে অবস্থিত রোপওয়ে রয়েছে, সেটার টিকিট কাটলাম। জনপ্রতি একশোর একটু বেশী খরচ। অপেক্ষা করতে হল খানিকক্ষণ। তারপর মিনিট পাঁচেকে পৌঁছে দিল উল্টোদিকের পাহাড়ে। একসাথে তিনটে গাড়ি চলে, লাল হলুদ ও সবুজ রঙের। ভারি সুন্দর লাগে দূর থেকে দেখতে। ভিতরটা কাছের বড় জানলা দিয়ে তৈরি। পাহাড় পেরোনোর সময় ধারে সিটি প্যালেস, লেক পিচোলা, যোগ মন্দির সব চোখে পড়ে। উলটোদিকে নেমে জানা গেল কর্নি মাতার মন্দির আছে। মা আর কাকা মন্দির থেকে ঘুরে এলো। আমি আর বাবা ওখানে এমনি ঘোরাঘুরি করলাম। ওপর থেকে উদয়পুর শহরটাকে খুব সুন্দর লাগছিল। একটু ঘিঞ্জি, কিন্তু ধবধবে সাদা বাড়ির দেওয়াল। লেকের ওপর সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্যও চোখে পড়ল। ছবি তোলার জন্য আইডিয়াল সানসেট স্পট।
এবার ফেরার পালা। মনে আছে তো সেই যে পেন্ডিং শপিঙের কথা বার বার বলছিলাম? অটো ধরে আমরা এলাম বাপু বাজার। অনেক অনেক দোকান। একদম আমাদের বড় বাজার চত্বরের মতোই। কিছু খুচখাচ জামাকাপড় কেনা হল বটে। কিন্তু সেই রাজস্থানি ঝুমকোর আর দেখা পাই না। হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক করে চষে ফেললাম গোটা অঞ্চল, কিন্তু কোথায় কি? শেষে বাসন গ্যাস এসবের দোকানের পাড়ায় পৌঁছে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি দেখিয়ে দিলেন একটি রাস্তা। ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমে গিয়েছে। রাস্তা প্রায় শুনশান। ওইসব দিকে সন্ধ্যে সারে সাতটার মধ্যেই সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দেখানো রাস্তা দিয়ে গিয়েও কিছুই খুঁজে পাই না। ফিরে আসব আসব করছি, এমন সময় রাস্তার একজনকে জিজ্ঞেস করায় উনি একটি বাড়ি থেকে কাউকে ডেকে দিলেন। মা আর আমি একটু বাঁধো বাঁধো হয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম বটে। বাবা আর কাকা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল পাহারা দিয়ে।
জানলাম এটি যার বাড়ি, তিনি গয়নার হোলসেলার। রীতিমতো আদর আপ্যায়ন করে "বেটি তুঝে যো পসন্দ আয়ে, নিকালকে লে লে" বলে ছাড়পত্র দিলেন। ঘরের টাক ভর্তি গয়নার বাক্স। নামিয়ে নামিয়ে ডিজাইন পছন্দ করে অনেক অনেক কিনলাম। প্রায় আশ মিটিয়ে যাকে বলে। কী সস্তা সব। এখন মনে হয় আরো কিনলে হতো। অনেক গল্প হল ওনার সাথে। পরের বার উদয়পুর এলে ওনার বাড়ি ডাল বাটি চুরমা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন ওনার ছেলের বৌ। সাথে করে ওনার কার্ড নিয়ে এসেছি। কারুর যদি উদয়পুর যাওয়ার প্ল্যান থাকে, বলবেন। ঠিকানা দিয়ে দেবো।
আবার আরেকটা জায়গা ঘোরা হয়ে গেল। কতটা ঘুরলাম কি, জানিনা। তবে এইটুকু বলতে পারি, জেনে গেলাম আরো কত কিছু দেখার আছে। হাতে সময় নিয়ে এসে আরো কত কিছু দেখতে হবে, অনুভব করতে হবে। বেরানো শেষের দিকে। মাউন্ট আবু, জয়সালমের আর যোধপুর বাকি। আগামীকাল সকাল সকাল হলদিঘাটি হয়ে যাওয়ার কথা মাউন্ট আবু। সেখান থেকে শুরু হবে মাড়ওয়ার। রুক্ষ্ম প্রকৃতি। বালিয়াড়ি।

Sunday, January 21, 2018

সরস্বতী পুজো

বছর আঠাশের শুভ্রা। বিয়ে হয়ে মান্ডি এসছে সবে ছয় মাস হল। কলকাতায় থাকতে এপারট্মেন্টের সবার একেবারে মধ্যমণি ছিল। সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকত ও। সুষ্ঠু ভাবে তা সম্পন্ন হতো বলে সকলের আদরের ছিল শুভ্রা। সরস্বতী পুজো থেকে শুরু করে দোল, নববর্ষের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে রবি-নজ্রুল সন্ধ্যা, রথযাত্রা থেকে  বিজয়া সম্মিলনী, ক্রিসমাস থেকে  ন্যু ইয়ার। কোনটাই বাদ পড়ত না। ওর বর অরুণাভ আই আই টি মান্ডিতে  কম্প্যুটার সায়েন্স বিভাগে সদ্য জয়েন করেছে এসিস্টেন্ট প্রোফেসর হিসেবে। সেই সুবাদে শুভ্রাও কলকাতার চাকরি ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পিছু পিছু এসেছে মান্ডি।
পাহাড়ের কোলে, নদীর ধারে ওদের ক্যাম্পাসটি ভীষণ সুন্দর, পিকচার পোস্টকার্ডের মতোই নয়নাভিরাম। প্রথম কয়েক মাস কোয়ার্টার গুছিয়ে, ঘুরে বেরিয়ে আনন্দ করে কাটালেও আজকাল শুভ্রার জীবনে অখন্ড অবসর। সব সময় কাজের মধ্যে থাকতে যে মেয়ে ভালোবাসে, তাকে এখন সারাদিন খালি বাড়িতে বসে সময় কাটাতে হয়। কত আর বই পড়ে গান শুনে সময় কাটবে। রান্নাবান্না করতে মোটেই ভালোবাসেনা। আশেপাশের কোয়ার্টারেও তেমন কারুর সাথে খুব একটা হৃদ্যতা জমাতে পারেনি এখনো অবধি। মোট কথা, নিতান্তই একাকীত্বে কাটছে শুভ্রার দিনগুলি। 
এর মধ্যে হই হই করে এসে গেলো সরস্বতী পুজো। পুজোর মাস খানেক আগে থেকে ওদের কলকাতার এপারট্মেন্টের মেসেজ গ্রুপে চলতে লাগল হাজার একটা প্ল্যানিং। ও প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ নিয়ে সেই সব আলোচনায় ভিড় করত বটে। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই একদিন কী মনে হতে সব ছেড়েছুড়ে দিল শুভ্রা। সেখানে না থাকতে পারায় বড্ড কষ্ট হচ্ছিল কি না। বউয়ের এই মন খারাপটা  অরুণাভর হঠাৎএকদিন চোখে পড়ল। ভাগ্যিস! নইলে অমন স্কলার ছেলে, মোটামুটি আর বাকি সময়ে জগত সংসার সম্বন্ধে এক্কেবারে ভ্রুক্ষেপহীন। "কী হয়েছে, কেন এমন মন খারাপ, মুখ গোমড়া করে আছে কেন", এসব প্রশ্ন করতে লাগল। শুভ্রাও খুব একটা চাপা মেয়ে না। সে গড়্গড় করে বলল তার বর কে।
"ও এই ব্যাপার? দাঁড়াও, কিছু একটা করতে হবে। আমায় দুদিন সময় দাও।" এই বলে অরুণাভ সেদিন ক্লাস নিতে চলে গেলো। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরল সঙ্গে ওর কিছু কলিগদের নিয়ে। মান্ডি ক্যাম্পাসে জনা সাতেক বাঙালি ফ্যাকাল্টি পরিবার। সেই সব বাঙালি ফ্যাকাল্টিদের সাথে শুভ্রার অল্প বিস্তর আলাপ ছিল। তাদেরকে নিজের কোয়ার্টারে দেখে একটু অবাক হল বটে। হঠাৎ কী দরকারে, কেন সবাই হাজির ভাবতে ভাবতে অরুণাভই ওর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল, " এই নাও। এবার সবাই মিলে প্ল্যান করে একটা সরস্বতী পুজো নামাও তো" এই বলে। 
" আরে এটা তো দারুণ বলেছো অরুণাভ।" শুভ্রার মন আনন্দে নেচে উঠল। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও, কোন একটা ব্যাপারে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারবে, এই আনন্দে প্রায় সব দায়িত্বই ও নিতে রাজী হয়ে গেল। 
কিন্তু পুজো যে হবে, কোথায় হবে? ঠাকুর কোথায় পাবে? কে করবে? এইসব নানান প্রশ্নের উত্তর পেতে শুভ্রা পরেরদিনই একটা ছোট মিটিং ডাকল নিজের বাড়িতে। ক্যাম্পাসের সব বাঙ্গালিরা এলো। চা সামোসা সহযোগে চলল আলোচনা। ঠিক হল, অম্লান দা, অর্থাৎ কেমিস্ট্রির অম্লান ব্যানারজীদা পুজো করবেন। কলেজে থাকাকালীন করার অভিজ্ঞতা আছে। এইবারে আর মূর্তি আনানোর বা বানানোর সময় নেই, তাই ছবি প্রিন্ট করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘটে পুজো হবে। শুভ্রাদের বাড়িতেই হবে। কী কী জিনিস লাগবে, কোথা থেকে তা জোগাড় করা যাবে, এইসবের ফর্দ করতে হবে। শুভ্রার বেশ মজা লাগছে। এতদিনে মনে হচ্ছে যেন আবার নিজের এপারট্মেন্টের দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছে। মায়ের থেকে ওর পুরনো ফাইল ঘেঁটে পুজোর ফর্দর ছবি ওয়াটসআপে নিয়েছে। এক এক করে কোথায় পাওয়া যেতে আপ্রে, তার হদিস চলছে। 
ওর খুব ইচ্ছে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোক সন্ধ্যেবেলা। লোকবল তেমন নেই। তাই চাইলেও নাটক বা গীতিনাট্য করা যাবেনা। কোন চিন্তা নেই। রমেনদার স্ত্রী, মালবিকা বৌদি খুব ভালো নাচ করেন। ঠিক হল, উনিই বাকি আর তিনজনকে ঘষে মেজে নাচ তুলিয়ে দেবেন। সাথে গান গাইবে শুভ্রা। শুভ্রাকে গানে সঙ্গত করবে তবলায় অরুণাভ। পি এইচ ডি করার সময়ে শেষ তবলা বাজিয়েছিল ও, আজ কিছু বছর পর আবার সেই সুযোগ আসছে দেখে ও সমান ভাবে উত্তেজিত।  আজকাল শুভ্রার মধ্যে একটা বেশ খুশি খুশি ভাব দেখে অরুণাভ। দেখেও ভালো লাগে। সত্যি তো, চাকুরিরতা মেয়েকে এমন ঘরবন্দী করে রাখলে কাহাতক আর ওর ভালো লাগে? এই ইনিশিয়েটিভটাকে জিইয়ে রাখতে পারলে ভালো হয়। 
দেখতে দেখতে বসন্ত পঞ্চমী এসে গেল। ভোর থেকে, আলো ফোটার আগে থেকেই অরুণাভ টের পেল শুভ্রা উঠে পড়েছে। স্নান সেরে ঠাকুর রাখার জায়গাটা ধুয়ে মুছে তৈরি করছে। ছটা বাজতে না বাজতে একে একে কলিং বেল বাজতে লাগল। হৈমন্তী দি, মালবিকা বৌদি, রিনি, মহুয়াদি, সব এসে পড়তে লাগল। এরপর একে একে দল বেঁধে শুরু হল পুজোর তোড়জোড়। কেউ আল্পনা দিচ্ছে, কেউ ফল কাটছে। তো অন্যদিকে আবার কেউ ঠাকুর সাজাচ্ছে। পুরুষেরাও মেতে উঠেছে পুজোর কাজে। প্ররবাসে হলেও উৎসাহ বা চেষ্টার কোনরকম ত্রুটি রাখেনি ওরা। রমেনদা আবার পটাপট লেন্সবন্দী করে চলেছেন  এই মুহূর্তগুলি।  
এই খানিক্ষনের মধ্যেই ঘর ভরে যাবে ধূপকাঠির সৌরভে, কর্পূরের গন্ধে তৈরি হবে একটা পুজো পুজো আবহাওয়া। আর সাথে থাকবে দৃপ্ত কণ্ঠস্বরে
"জয় জয় দেবী চরাচর সারে
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।"  যা পৌঁছে দেবে এক লহমায় অনেকগুলো বছর আগের এমনই কোন  বসন্ত পঞ্চমীর দিনে। ফিরে আসবে কত মিষ্টি মধুর স্মৃতি। 


Friday, January 19, 2018

তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন

তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন

১।

টিফিন ব্রেকের সময় ভয়ে ভয়ে ক্লাসরুমে ঢুকেছে আজ শ্রেয়ান। এত বছর বয়েজ স্কুলে পড়ার পর এই প্রথম কোএডে। তার ওপর আবার কলেজের প্রথম দিন। মেধাবী ছেলে শ্রেয়ান উচ্চ মাধ্যমিকে চমকপ্রদ রেজাল্ট করে বর্ধমান জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতার অন্যতম নামী কলেজে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে এসেছে। হোস্টেলে থাকতে হবে। আজ সকালেই বাবা কলেজ গেটে পৌঁছে বাড়ি চলে গিয়েছেন। এত বড় কলকাতা শহরে ও সম্পূর্ণ একা। কাউকে চেনেনা। শুনেছে কলেজে, হোস্টেলে ভালো মতই র‍্যাগিং হয়। বুক ঢিপ ঢিপ করছে ওর।
শতাব্দীপ্রাচীন কলেজের বড় ক্লাসরুমটাতে বাইরের আলো তেমন নেই, দিনেরবেলাও টিউবলাইট জ্বলছে। ঢুকে দেখল ওদের ক্লাসের বাকি ছেলেমেয়েরা দুটো বেঞ্চ জুড়ে জটলা পাকিয়ে বসে আছে। ওর আর জায়গা হবেনা ওখানে বলে পিছনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল শ্রেয়ান। টিচার্স প্ল্যাটফর্মের ওখানে জনা দশেক সিনিয়র দাদা দিদিরা দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকজন টেবিলে চেয়ারে বসে।
" এই শোন, কলেজের প্রথম দিন এসছিস, সিনিয়রদের সম্মান জানাতে হয়, জানিস না? এলি আর বসে পড়লি? গুড আফটারনুন উইশ কে করবে?"
শ্রেয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল সিনিয়র "দিদি", পরনে সাদার ওপর হলুদ ফুল ছাপ কুর্তি আর নীল জিন্স, গোড়ালি অবধি গিয়ে শেষ হয়েছে। মাথায় এক ঢাল কালো চুল, কয়েকটা আবার বার বার কপালের উপর পড়ছিল বলে মাঝে মাঝেই হাত চলে যাচ্ছিল চুল ঠিক করতে। কানে একজোড়া বড় ঝুমকো দুল। ঠোঁটের ওপর ছোট্ট তিল মুখশ্রীতে আলাদা মাধুর্য এনেছে, শ্রেয়ানের শিল্পী মনে ভাবনা এলো।
" গুড আফটারনুন দিদি।" উঠে দাঁড়িয়ে বলল ও।
" দিদি আবার কী? বলবি মধুরা। নাম কী তোর? "
" শ্রেয়ান। ঠিক আছে দিদি। এই সরি, মধুরা।"
" আতাক্যালানে। যা বোস।"


২।

মাস দুই হয়ে গিয়েছে কলেজের। এখনো শ্রেয়ানের ক্লাসে তেমন বেশী বন্ধু হয়নি। মুখচোরা ছেলে ও। রুমমেটের সাথে ছাড়া আর দু তিনজন ছেলের সাথে যা একটু কথাবার্তা হয় ওর। ক্লাস আর লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সময় পেলে চলতে থাকে আঁকাঝোঁকা। আজ লাঞ্চের পরে ক্লাসটা ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ায় লাইব্রেরির দিকে হাঁটা লাগিয়েছিল ও। কেমিস্ট্রি বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যাচ্ছে যখন, দেখল, উল্টোদিক থেকে আসছে মধুরা। আজ ওর পরনে লাল নীল জংলাছাপ গোড়ালি ঝুলের ড্রেস। ওকে দেখেই, " কী রে কেমন আছিস?" বলে হাল্কা হাসল মধুরা।
" ভালো আছি দি।"
"আবার দি? কোথায় যাচ্ছিস এখন? ক্লাস নেই?"
" না দি। আজ এম বি স্যার ক্লাস নেবেন না বলেছেন। তাই ভাবলাম একটু লাইব্রেরিতে বসি গিয়ে।"
" ওরে হাঁদারাম, এটা স্কুল না যে সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকতে হবে। ক্লাস নেই তো মজা করে ঘুরে বেরা!"
" আসলে আমি তেমন কিছুই চিনিনা। কোথায় যাবো? "
" ওরে নিজেকে চিনে নিতে হয়। "
" হুম। ঠিক আছে দি।"
" শোন কাল আমাদের এনভাইরনমেন্টালের ক্লাসটা আমি বাঙ্ক করছি। বারোটায়। তোদের তো ওই সময় বাংলা থাকে। কাউকে বলিস প্রক্সি দিতে। আমার সাথে দেখা করবি মেন গেটে। তোকে নিয়ে যাবো এক জায়গায়। "
" কোথায় দি?"
" কাল দেখতে পাবি। "
ভ্যাবলা হয়ে মধুরার চলে যাওয়া হাঁ করে দেখতে লাগল শ্রেয়ান।

৩।

বারোটা বেজে পনেরো। মধুরার দেখা নেই। শ্রেয়ান কিন্তু কিছুটা কৌতূহলবশত আর কিছুটা ভয়ে ভয়ে (এখনো সিনিয়রদের প্রতি ভীতিটা কাটেনি ওর) অপেক্ষা করে আছে গেটে। চলে গেলে পাছে পরে দেখা হয়ে বকা খায়, এই ভেবে যেতেও পারছেনা। কাউকে প্রক্সি দিতে বলতেই পারেনি ও। মিছিমিছি একটা এটেন্ডেন্স নষ্ট হল। এইসব ভাবতে ভাবতে ফোনে খুঁটখুঁট করছিল শ্রেয়ান।
" সরি, একটু দেরি হয়ে গেল। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস কি?"
মুখ তুলে মধুরাকে দেখতে পেল।
" ওই আর কী। আগের ক্লাসটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। তখন থেকেই আছি।"
" আসলে আমার আগের ক্লাসটা এস এমের ছিল। বুড়িটা এক্সট্রা টাইম নিলো। তাই দেরি হল। এদিকে তোর নম্বরটাও জানিনা যে এস এম এস করে দেবো। ঝটপট তোর নম্বরটা দে তো।"
" ৯৪৩৩......"
" মিসড কল দিয়ে দিচ্ছি।"
বলতে বলতেই শ্রেয়ানের ফোনে রিং হল, অচেনা নম্বর থেকে। দুটো রিং হতেই কেটে দিল মধুরা।
" নে সেভ করে রাখ।"
" হ্যাঁ, করছি।" "মধুরা দি" লিখে সেভ করল নম্বরটা শ্রেয়ান।
" আজ ওয়েদার ভালো নেই। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। তাই যেখানে প্ল্যান করেছিলাম, যাওয়া যাবেনা। তার চেয়ে বরং চল কোথাও খেতে যাই।"
" কোথায় যাবে?"
" পার্ক স্ট্রিট চল।"

" কী হল? অমন ভ্যাবলাকান্তর মতো মুখ করে আছিস কেন রে? পার্ক স্ট্রিট গেছিস কখনো?"
" না, মানে শুনেছি দামী জায়গা খুব..."
" ধুর ধুর। আজকে আমার ট্রিট। তোদের ইন্ট্রো নেওয়ার দিন হেবি চেটেছিলাম তোকে। তারপরে ফ্রেশারসে আসিনি আমি। ট্রিটটা পেন্ডিং আছে। বন্ধুত্ত্ব অটুট করতে হবেনা?"
মধুরার মিষ্টি হাসি দেখে আর কথা বাড়ালো না শ্রেয়ান।


৪।

"শুভ মহালয়া দিদি।" শ্রেয়ানের এস এম এস ঢুকল মধুরার ফোনে। খেয়াল পড়ল, তাই তো। আজ থেকে টানা দেড় মাস কলেজ ছুটি। দেড় মাস শ্রেয়ানকে দেখতে পাবেনা। ও ফিরে যাচ্ছে জল্পাইগুড়ি  নিজের বাড়ি পুজোয়, শ্রেয়ানও বর্ধমান। একটু যেন তেতো লাগল কফিটা। উফ, এই পিজির রান্নার মাসিটা না। এক্কেবারে যাচ্ছেতাই।
প্রায় প্রতিদিন কলেজের পরে শ্রেয়ান আর ও হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত অনেকটা দূর। একেকদিন একেক দিকে। সারাদিনের লেখাপড়ার কথা, বাড়ির কথা, শ্রেয়ানের রবীন্দ্রনাথ চর্চা আর ওর গ্রিন ডের চর্চা। মাঝে কোথাও দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের চা। অসমবয়সী হলেও কোথাও যেন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত শ্রেয়ানের জন্য মধুরা। সহজ সরল ছেলেটার সাথে কথা বললে আরাম লাগে, মন ভালো থাকে।  আবার একটা রুটিন ব্রেক হবে। একদম ভালো লাগেনা মধুরার।
" হুম, ভালো করে পুজো এঞ্জয় করে ফের।" ছোট্ট জবাব দিয়ে বিছানা ছাড়ল মধুরা। বিস্বাদ কফিটা ছুড়ে ফেলল বেসিনে। ওকে তো আবার ব্যাগ গোছাতে হবে। রাত্রের ট্রেন।

৫।

হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছে শ্রেয়ান। তিন মাস পর বাড়ি যাচ্ছে। মাঝে অবশ্য কয়েকবার বাবা এসে দেখা করে গিয়েছেন। তবে মা আর ঠাকুমার সাথে দেখা হয়নি এতদিন। ভিডিয়ো কলে দেখেছে বটে, কিন্তু স্পর্শ অনুভব করতে পারেনি। যেদিন প্রথম কলকাতা আসে, সেদিন থেকে দিন গুনতে থেকেছে শ্রেয়ান, কবে বাড়ি যাবে পুজোর ছুটিতে। ভেবেছিল বুঝি খুব আনন্দ হবে। কিন্তু আজ কেমন একটা মন খারাপ গ্রাস করে আসছে ওকে। একেই বাইরে মেঘলা, অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টি একদম ভালোবাসেনা শ্রেয়ান। তার ওপর কলেজ, হোস্টেল, মধুরাদিকে ছেড়ে দেড় মাস থাকার কষ্ট, কিচ্ছু ভালো লাগছেনা ওর। এই কয়েক মাসে যেন ভালোবেসে ফেলেছে ও কলকাতা শহরটাকে, আর তার সিংহভাগ কৃতিত্ব মধুরার। ওকে সাথে নিয়ে গোটা শহরটা ঘুরে বেরিয়েছে। ষ্টেশনে ট্রেন ঢুকতেই কামরায় উঠে জানলার ধারে সীট নিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে বসল শ্রেয়ান।
"I walk the empty streets
On the boulevard of broken dreams" গ্রীন ডে চলতে লাগল একের পর এক।

৬।

দেড় মাস বাদে জগদ্ধাত্রী পুজোর পরে আজ কলেজ খুলেছে ওদের। দুটোয় ল্যাব আর ক্লাস শেষ করে দুজনের আজ গঙ্গার ঘাট যাওয়ার কথা। কথামতো কলেজ গেটে দেখা করল ওরা। ফেলে যাওয়া শরতের মিঠে  রোদে আজ বড় মন জুড়ানো আরামদায়ক। কদিনের প্যাচপ্যাচে বৃষ্টির পর আকাশ আজ রৌদ্রজ্জ্বল। মধুরার পরনে একটা হাল্কা বেগুনি রঙের চিকন কাজ করা শাড়ি। লম্বা চুলটাকে অযত্নে হাতখোঁপায় আটকে রেখেছে, কানে ছোট্ট দুল। দুই চোখে কাজলের ঔজ্জ্বল্য। শ্রেয়ানকেও বড় ঝকঝকে লাগছে আজ লাল পাঞ্জাবিতে।
" চল, গঙ্গার ঘাটে যাই। নৌকোতে চড়ে ঘুরব।"
" চলো!"
গঙ্গার বুকে নৌকোবিহার চলল ওদের অনেকক্ষণ। আজ শ্রেয়ান ওর ক্যামেরাটা নিয়ে এসছিল। পুজোয় বাড়ি গিয়ে বাবার থেকে পাওয়া গিফট। সবে শেখা শুরু করেছে। গোটা সময়টা জুড়েই লেন্স তাক করে রেখেছিল মধুরার দিকেই।
" এই, কী তখন থেকে শুধু ছবিই তুলে যাচ্ছিস?"
" তোমায় আজ খুব সুন্দর লাগছে মধুরাদি।"
" বলছিস?"
" হুম।"
" আমি ওই ন্যাকা মেয়েদের মতো বলব না যে কই কিছুই তো সাজিনি। না, আজ সত্যিই আমি সেজেছি। ভালো লাগছে বললি সেটাও এঞ্জয় করলাম। থ্যাঙ্ক ইয়ু!"
" একটা কথা বলব?"
" কী বল?"
" অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম বলব..."
"ভালোবাসিস আমায়?"

"কী হল, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলি?"
" না মানে..."
" ও, ভালোবাসিস না?"
" না না। তা না। অবশ্যই বাসি।"
" তাহলে?"
" না মানে তুমিও?"
" কী মনে হয়?"
" কে জানে। জানলে তো এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেতাম না।"
" পাগল কোথাকার!" হেসে শ্রেয়ানের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঘেঁটে দিল মধুরা।

"চল, ফেরা যাক। তোর তো পড়ার টাইম নষ্ট হচ্ছে।"
" হ্যাঁ, তা বটে। কাল ল্যাব নোটবুক জমা দিতে হবে। আজ স্পেক্ট্রোর এক্সপেরিমেন্টটা শেষ করেছি।"
" উফ। চল।"
" পৌঁছে একটা ফোন করো।"
" হুম।"



ঘন্টাখানেক পরে শ্রেয়ান ওর হোস্টেলের ঘরে বসে পড়ছে। বা বলা চলে, পড়ার চেষ্টা করছে। সারাদিনের ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর এখনো কাটেনি। এমন সময়ে ফোনে বেজে উঠল, " তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা। তুমি আমার সাধের সাধনা।" স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল সদ্য এডিট করা নাম।
"Madhura calling"।



আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৬ ( চিতোরগড়)

আমি যখন কলকাতায় একদিন থেকে জামাকাপড় প্যাক করছিলাম, আলমারি ঘাটতে গিয়ে অনেক এমন জামা পাই যেগুলি একদা অত্যন্ত প্রিয় হলেও চেন্নাইতে থাকার সুবাদে পড়া হয়ে ওঠেনি। তেমনি একটি প্রিয় সালওয়ার কামিজ, বেগুনীর ওপর সোনালি সুতোর কাজ করা, ওটা মনে হল রাজস্থান ট্যুরের জন্য নিয়েই নিই। বেশী রংচঙে মনে হলে চিন্তা নেই, কারডিগানের নীচে ঢাকা পড়ে যাবে। সেই মত নিলাম, আর তখন ঠিক করলাম যে চিতোর বেড়াতে যাব যেদিন, সেইদিন পড়তে পারব। তেমন সুযোগ পেলে একটু ঘুমর ঘুমর বলে নেচেও নেব।
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। আমার ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হলনা। এই কদিন ঘুরে বেরিয়ে বুঝে গিয়েছিলাম যে আর যাই হোক, দিনেরবেলা ওইসব রংচঙে ঝলমলে সিন্থেটিক পড়া যাবেনা। অগত্যা, আজমের থেকে চিতোর যাওয়ার সময় আমায় এমনি সাধারণ পোশাকই পড়তে হল। "আমার আর পদ্মিনী সাজা হল না!"
সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছিলাম।। বাসে ব্রেকফাস্ট সেরে চিতোর পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় সাড়ে দশটা এগারোটা বেজে গিয়েছিল। পারকিং লটে গাড়ি দাঁড় করানো হল বটে। কিন্তু নামতে গিয়ে বিপত্তি। একটা বিরাট পোষা হাতি রাস্তা আটকে ছিল। হেলতে দুলতে সে বেশ খানিক পরে রাস্তা ছাড়ল। ছাড়পত্র পেতে তাকে বাসের জানলা দিয়ে কমলা লেবু, বান রুটি এইসব ঘুষ দিতে হয়েছিল। অটো চেপে আমাদের চিতোর দর্শন হবে ঠিক হল। হাতির পিঠে চেপেও করা যায়। তবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়ও পেরিয়ে গিয়েছিল। বোধহয় সকাল এগারোটা অবধিই চলে এই হস্তিবিহার। ২৯জনের দলকে মোটামুটি ছটা অটোতে চাপিয়ে রওনা দেওয়া হল। একটি অটোর ড্রাইভার আমাদের গাইডের কাজ করবেন। লক্ষ্য করলাম প্রতিটি অটোর সামনে কাঁচের ওপর সত্যিকার সাটানো। "আমরা পদ্মাবতী সিনেমার ঘোরতর বিরোধ করি।" হিন্দিতে লেখা। বুঝলাম, হাওয়া বেশ গরম। আলটপকা মন্তব্যও করলেই মুশকিল।
চিতোরগড় ভারতের অন্যতম বড় গড়ের মধ্যে অন্যতম। শুধুমাত্র বিশাল আকৃতির জন্যই না, বরং চিতোর আমাদের সকলের মনে দাগ কাটে তার বীরত্বের জন্য, প্রেমের জন্য। সাম্প্রতিক কালে নানান বিতর্কের জন্য সারা দেশ পদ্মিনীর কথা জানলেও আমরা কিন্তু বহু আগে থেকেই পদ্মিনি-রতন সিনহ-আলাউদ্দিন খিলজির গল্প শুনেছি। চিতোরগড় দেখবো বলে তাই আলাদা উৎসাহ ছিল। অটোতে এসে আমাদের প্রথম স্টপ হয় কুম্ভ শ্যাম মন্দিরে। রাণা কুম্ভ এই মন্দিরটি বানান। স্থাপত্যে পুরীর অগন্নাথ মন্দিরের সাথে ভালোই মিল রয়েছে এই মন্দিরটির। কথিত আছে, ভোজরাজের স্ত্রী মীরাবাঈ এই মন্দিরেই শ্রী কৃষ্ণের উপাসনা করতেন। রাজপ্রাসাদের বাহুল্য তার কাছে অপ্রয়োজনীয় ছিল। তিনি স্বামীর অনুমতি নিয়ে এই মন্দিরেই সময় কাটাতেন। সূর্যবংশী হওয়া সত্ত্বেও ভোজরাজ তার স্ত্রীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কৃষ্ণের উপাসনা চলতে দিলেও ওনার মৃত্যুর পর পরিবারের বাকিরা মীরাকে এখান থেকে সরানোর জন্য উঠে পড়ে লাগেন। সেই চিরাচরিত পারিবারিক সাতকাহন। মীরাকে নানান পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবারই ভক্তির জোরে রক্ষাও পান। অবশেষে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মীরা চিতোর ছেড়ে চলে যান। কুম্ভ শ্যাম মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি ছোট মীরা মন্দির।
মন্দির দেখে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পদ্মিনীর প্যালেস। চিতোরগড় এতটাই বড় যে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা অসম্ভব। কেল্লায় ঢুকতেই আমাদের বেশ অনেকগুলো ফটক পার হতে হয়েছিল। আমাদের গাইডের কোথায়, "Garh ho toh Chittor ka, baki sab garhaiya", অর্থাৎ কেল্লা হতে হয় চিতোরের মত হবে। বাকিরা ধারেকাছেও লাগেনা। এমন নাকি কথিত আছে।
পদ্মিনীর প্যালেসের কাছে এসে গাইড বললেন ইতিহাসের কথা। রতন সিং ও পদ্মিনীর কথা। পদ্মিনী নাকি এতটাই সুন্দরী ছিলেন, এমন তার গায়ের রঙ ছিল যে উনি নাকি যখন জল খেতেন, বাইরে থেকে দেখা যেত জল নামছে গলা দিয়ে। আলাউদ্দিন খিলজি জনশ্রুতিতে জেনেছিলেন এই সৌন্দর্যের কথা। তার বহু পীড়াপীড়িতে রাজপুতরা অবশেষে রাজি হন পদ্মিনীর সৌন্দর্যের সাথে আলাউদ্দিনের পরিচয় ঘটাতে। তবে অবশ্যই ছলের মাধ্যমে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে (রিফ্লেকশন রিফ্র্যাকশনের নানান কম্বিনেশনে) আলাউদ্দিন দেখলেন তার স্বপ্নসুন্দরীকে। আর যথারীতি মাথা ঘুরে গেল তার। পদ্মিনীকে জয় করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলেন চিতোর। বীরপুরুষ রাজপুতরা প্রাণ দিয়ে বাপ্পা রাওালের প্রতিষ্ঠিত মেওয়ার রাজ্যের রাজধানী চিতোরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। সেই জুদ্ধে পরাজিত হন পরম শৌর্যের নিদর্শন দেখিয়েও। আর তারপরে পদ্মিনী তার ১৩০০ সঙ্গিনীকে নিয়ে "জোউহর" করেন, অর্থাৎ শত্রুর হাতে নিজেদের তুলে দেওয়ার চেয়ে প্রাণ দিয়ে দেন বিরাট চন্দন কাঠের আগুনে। রাজপুতমেয়েরাও যে সমান বীরাঙ্গনা, তার নিদর্শন পদে পদে রাজস্থানের বিভিন্ন গড়ে পাওয়া গেছে। চিতোরগড়েই তিনবার জোউহর হয়েছে বিভিন্ন শতাব্দীতে।
পদ্মিনীর প্যালেসের ধারের পদ্ম পুকুরটির আজ শোচনীয় অবস্থা। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয়না। যে আয়না ঘরে বসে আলাউদ্দিন রিফ্লেকশন দেখেছিলেন, সেইটিও সাম্প্রতিক বিতর্কের জেরে ""vandalised" হওয়ায় এখন তালাবন্দী হয়ে আছে। সে আয়না ভাংচুর করে ফেলেছে কিছু উত্তেজিত জনতা। এক টুকরো ইতিহাস চিরতরে হারিয়ে গেল। জানিনা কি করে এডমিনিস্ট্রেশন এগুলো হতে দিল। শাস্তিও কেউ পেয়েছে বলে তো শুনিনি। প্যালেসের বাগানে ফুলে ভর্তি। সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু গড়ের ক্ষতির উদাহরণ দেখে ততক্ষণে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আমরা গেলাম চিতোরগড়ের অন্যতম বিখ্যাত বিজয় স্তম্ভে। মালওয়া আর গুজরাটে জয় লাভ করে রাণা কুম্ভ এই বিরাট স্তম্ভটি বানান। মোট নয় তলা। প্রতিটি তলায় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন ঘটনা খোদাই করা। অসম্ভব সুন্দর স্থাপত্য। সময়ের অভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওপর থেকে চিতোরগড় শহরের দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি। কাছেই জউহরের জায়গাটিও দেখলাম। সেখানে পাশে সতী মায়ের মন্দির রয়েছে। জউহরের কুয়োতে অনেক গরু ছাগল ও অনেক সময় শিশুরাও পড়ে যেত বলে সেটি এখন মাটি চেপে দিয়েছে।
এছাড়া চিতোরগড় অঞ্চলে দেখার মত রয়েছে কিছু জৈন মন্দির, কীর্তি স্তম্ভ। আর রয়েছে গোমুখ। একটি জলাশয় যেখানে জল আসে প্রাকৃতিক কারণে। গরুর মুখের মতো দেখতে সেই জলের সোর্সটি। এই জলকে স্থানীয়রা উপাসনা করেন।
ফেরার পথে কালীমাতার মন্দির চোখে পড়ল। সেখানে তখন প্যান্ডেল করে বড় কোন পুজো যজ্ঞ চলছিল। ঘণ্টা আড়াই কাটিয়ে আমরা ফিরলাম পারকিং লটে। দুপুরের খাওয়া সেরে এবারের গন্তব্য উদয়পুর।

Thursday, January 18, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৫ (পুষ্কর ও আজমের)

আলো ফোটেনি, এমন অবস্থাতেই আমরা জয়পুর থেকে রওনা দিলাম পুষ্করের উদ্দেশ্যে। ঘুম ঘুম চোখে জানলার ধারে চাদর দিয়ে মাথা ঢেকেঢুকে, যা ঠাণ্ডা। কানে চলছে গান, চোখে রাত্রের কোটার বাকি ঘুম। বাস চলছে মেওয়ারের রাস্তা বেয়ে। এগারোটার দিকে জানলার বাইরে দিয়ে উট চোখে পড়তে লাগল। কিছু এমনিই বুনো উট, কিছু পোশ্য, সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। বুঝলাম, পুষ্কর পৌঁছলাম। আসলে পুষ্কর মানেই জানি ক্যামেল ফেয়ার। কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমা অবধি চলে, প্রতি বছর। তখন সাড়া দেশ থেকে, এমন কি বিদেশ থেকেও লোকজন ভিড় করে এই পুষ্করে। ছবি তোলার জন্য এক্কেবারে পারফেক্ট। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছবি দেখেই পুষ্করের সাথে আমার পরিচয়। তবে এছাড়াও পুষ্করে যে দেখার মধ্যে হ্রদ আর মন্দির আছে, সেই বিষয়ে আমার তেমন ধারণা ছিলনা। ট্রাভেল এজেন্সির আইটিনারি দেখে তবে জেনেছি।
প্রত্যেকবার কোথাও বেড়াতে গেলে আগে সেই জায়গার ওপর বেশ অনেক পড়াশোনা করে যাওয়ার চেষ্টা করি। দুর্ভাগ্যবশত এই ট্রিপে তা করতে পারিনি। এক তো সময়ের অভাব ছিল। দুই, ভেবেছিলাম আশা করে থাকব, এই দেখবো, সেই দেখবো, অথচ তারপরে ট্রাভেল এজেন্সি বলে আদ্ধেক জিনিসই বাদের তালিকায় চলে যাবে, তখন মন খারাপ হবে। তাই প্রতিদিন রাত্রে পরেরদিনের জায়গাটি সম্বন্ধে নেটে অল্প করে পড়ে রাখতাম। সেইরকমই জেনেছিলাম, পুষ্করের হ্রদ নাকি বিখ্যাত পুণ্যস্থান। ওই হ্রদের জলের বুঝি ঔষধি গুণ আছে। সেই জল স্পর্শ করলে মানুষের চর্মরোগ সেরে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তও থেকে তাই লোকেরা এই হ্রদে আসে, পুণ্যস্নান করতে। কাছেই ব্রহ্মার মন্দির। সারা পৃথিবীতে নাকি আর কোথাও ব্রহ্মার মন্দির নেই।
পারকিং লটে বাস থেকে নেমে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হল। শুরুতে বালি বালি রাস্তাঘাট। উটেরা সারি দিয়ে বসে আছে। কোন কোন গুলোর দিকে তাকিয়ে মায়া হল। কিছু উটমালিক আমাদের ধরাধরি করতে লাগলেন, ক্যামেল সাফারির জন্য। প্রত্যেককেই মানা করে দিলাম। জয়সালমেরে এমনিই আমাদের প্রোগ্রামে ঠিক করা আছে ক্যামেল সাফারি। হেঁটে যখন মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি, তখন শুনলাম যে আর জুতো পরে যাওয়া যাবেনা। মন্দিরে জুতো চল্বেনা, সেটা যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি অদ্ভুত লাগল যে তা বলে এত আগে থেকে কেন জুতো ছাড়তে হবে। জুতো রাখার জন্য দোকানগুলো জোরাজুরি করছিল। জুতো রাখতে দেওয়া যাবে যদি পুজোর ডালা ওদের থেকে কেনা হয়। আমি খুব বেশী মন্দির দর্শনে উৎসাহী থাকিনা সচরাচর। তা ছাড়া সেখানে যদি শুনি এরকম খুব ভিড়, তাহলে তো কথাই নেই। বাইরে থেকে, দূর থেকে নমস্কার করে চলে আসব। আমার বাবা আর কাকাও ওরকম। আমরা তিনজন মন্দির গেলাম না। মা গেলো বাকিদের সাথে। ইতিমধ্যে আমরা তিনজন হাঁটা লাগালাম হ্রদের দিকে। রাস্তা জুড়ে দুইদিকে দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। কত রঙ, কত হস্তশিল্প। দাঁড়িয়ে দেখে মুগ্ধ হতে হয়। কোথাও উটের প্রতিকৃতি তো কোথাও হাতি। কাঁচের কাজ করা ব্যাগ। মাটির ওপর নানান রঙের কাজের ওয়াল হ্যানগিং। কাপড়ের পুতুল। শাড়ি। জামা। সব মিলিয়ে জমজমাট।  একটু দরদাম করলাম পছন্দের জিনিসের। কিন্তু মা সাথে না থাকায় সাহস করে কিনলাম না। হ্রদে পৌঁছে দেখি মোটামুটি ভিড়। লোকজন ঘাটে বসে পুজো করছেন, স্নান করছেন। কিন্তু জলের যা অবস্থা দেখলাম, মনে হল যে এই জলে স্নান করলে চর্মরোগ তো সারবেই না, উল্টে নতুন করে হয়ে যাবে। পুষ্করিণীর জলের সংস্করণ চলছে শুনলাম, কী জানি, কিছু তো বুঝলাম না। এমনি বেশ সুন্দর, অনেকটা বড়, হ্রদ। চারপাশে পাহাড় ঘেরা। দেখতে ভালো। কিন্তু ঘাট বড্ড পিছল। খানিকক্ষণ ঘাটে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে মায়েরা এলো। পুজোর প্রসাদ মুখে দিয়ে তারপরে ফেরত চললাম বাসের দিকে। পথে দোকানগুলোতে ঢুঁ মেরে চলল অল্পবিস্তর কেনাকাটি। সাবিত্রী মাতার মন্দির অনেক উঁচুতে থাকায় কেউই যায়নি।
পুষ্কর হয়ে তারপরে বাস চলল আজমেরের পথে। আজমের শহরটি তো আজমের শরিফ দরগার জন্য বিশ্ববিখ্যাত। পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে মানুষ আসেন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মাথা ঠেকায়, চাদর চড়ায় এখানে। পথে চোখে পড়ল বিশাল আনা সাগর লেকের। হোটেলে পৌঁছে স্নান সেরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোনোর কথা দরগায়। দুপুরের খাবার রেডি হতে দেরি হছহিল বলে পাশেই থাকা একটু মিষ্টির দোকান থেকে গরম গরম গোলাপ জাম মিষ্টি খেলাম। আহ, কী অপূর্ব সে স্বাদ। ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি। রাজস্থান জুড়ে নানান জায়গায় বেশ সুন্দর সুন্দর সুস্বাদু অনেক মিষ্টি খেয়েছি। কিন্তু ক্যালোরি কনশাস হলেই শেষ!
দরগা অঞ্চলে খুব ভিড় হয়, আর তার সাথে সাথে নাকি পকেটমারির খুব প্রকোপ। তাই ম্যানেজার কাকু বললেন ক্যামেরা বা ফোন সাথে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। (যদিও ওইদিন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসার কথা ছিল আমার, তাই আমি ফোন নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আর তাই অল্প হলেও কয়েকটা ছবি তুলেছি।)  আর টাকাও খুব কম রাখতে। এই একটা আফসোস আমার রয়ে গেল। দরগার সামনের রাস্তা জুড়ে যে বাজার বসে, সেখানে এত অভাবনীয় কম দামে এত বিচিত্র পসরা, ভাবা যায় না। কি সস্তা কি সস্তা! সাথে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না বলে বড় মিস করলাম এই শপিঙের চান্স।
দরগায় আমরা চাদর চড়াইনি। শুধু ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলাম। দরগাটি বেশ একটা বড় কম্পাউন্ডের মধ্যে। অনেকগুলি সাদা মার্বেলের বিল্ডিং। একটি মসজিদ রয়েছে। গেটে উর্দুতে ঈশ্বরচেতনার (ঈশ্বর কি বলা চলবে? জানিনা) বাণী লিপিবদ্ধ। খাদিম যিনি ছিলেন ভিতরে, এত দরদ দিয়ে আন্তরিকভাবে দুয়া পড়লেন আমাদের জন্য, মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি এসে গেল। সেই সম্রাট আকবরের আমল থেকে শুরু করে আজও লোকের ঢল নামে এখানে। এতটাই জাগ্রত এই দরগা। এখানে মাথা ঠেকাতে পেরে ভালো লেগেছিল খুব।
দরগার পর আমরা যাই আনা সাগর লেকে। পৃথ্বীরাজ চৌহানের ঠাকুরদার তৈরি করা এই লেক। তেরো কিলোমিটার লম্বা এই লেক। শহরের জলের কষ্ট নিবারণ করতেই বানানো এটি। বিশাল জায়গা জুড়ে, পাশে সুন্দর পার্ক বানিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। মোঘল সম্রাট শাহ জাহান ও জাহাঙ্গীরের তৈরি এই ধারের বারাদারি আর ঘট। যতক্ষণে আমরা আনা সাগরে পৌঁছই, সূর্যাস্তের সময় এসে গিয়েছে। দিগন্তবিস্তৃত আকাশ তখন লালের ছটায় রঙিন। তার ব্যাকড্রপে দেখছি দিনের শেষে সমস্ত পাখিরা ঘরে ফিরছে। সে এক মায়াবী দৃশ্য।
আমাদেরও এদিনের মত এবার ঘরে ফেরার পালা। আগামীকাল উদয়পুর যাবো। চিতোরগড় হয়ে। রাণী পদ্মিনীর গল্প শুনে বড় হওয়া। পদ্মাবতী সিনেমার ট্রেলার গান শুনে সেই উৎসাহ আরো বেড়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে, মন উসখুস। কতক্ষণে পৌছব চিতোর।

Tuesday, January 16, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৪ (জয়পুর)

খাম্মা ঘানি! কাল অনেক রাত্রে জয়পুরে পৌঁছলাম তো, তখন আর মাথা কাজ করছিল না। তাই এই রাজস্থানি সম্ভাষণটা করা হয়ে ওঠেনি। এখন করলাম। আজ অর্থাৎ ২৬শে ডিসেম্বর আমাদের সারাদিন জয়পুর সিটি সাইটসিইং করার কথা। হিসেব মত পঁচিশ তারিখটা আমাদের সন্ধ্যেবেলা ফ্রি থাকার কথা ছিল। মোটামুটি যত রিসোর্স আছে, সব কাজে লাগিয়ে ভালো শপিঙের জায়গার হদিস নিয়ে এসছিলাম। প্ল্যান ছিল ওইদিন ফাঁকা সময়টা শপিঙে কাজে লাগানো যাবে। তবে বাসের অনুপস্থিতি সব ভেস্তে দিল। কিন্তু নো চিন্তা! মৃত্যুঞ্জয় কাকুর থেকে গোটা দিনের একটা রাফ শিডিউল জেনে নিয়ে ঠিক করলাম, লাস্ট স্পট থেকে একটা ওলা বা উবার নিয়ে বাপু বাজার চলে যাব (এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, জয়পুর ছাড়াও বাপু বাজার আছে উদয়পুরে। দুটোই খুব বিখ্যাত।)। পারলে বিকেল বিকেল। কারণ সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে দোকান বাজার বন্ধ হয়ে যায়।
ব্রেকফাস্ট করার আগে চলল আমাদের হোটেলে একপ্রস্থ ফটোশুট। হোটেলটি রাজপুত ডাক্তার পরিবারের পৈত্রিক বাড়ি। কিছু অংশে পরিবারের লোকজন এখনো থাকেন, আর বাকিটা হেরিটেজ হোটেল হিসেবে চলে। রাজকীয় ব্যবস্থাপনা। প্রতিটিঘরের অন্দরসজ্জা যেমন খুবই রুচিসম্পন্ন, তেমনি প্রতিটি ফ্লোরের লিভিং স্পেস, রিডিং রুম, সমানভাবে সাজানো। একতলায় ড্রয়িং রুমে গতকাল রাত্রেই চোখে পড়েছিল সেনটার টেবিলটি, ওটির পায়া আসলে একটি বাঘিনী। আরেকটি ছিল, সেটি আবার উটের ওপর ভর করা। বিভিন্ন কাঠের মূর্তি, অমূল্য পেইন্টিং, সিলিঙে অনন্য কারুকার্য, হাল্কা লাইটিং, সব মিলিয়ে ছবি তোলার জন্য যাকে বলে পারফেক্ট। বেরোনোর মুখে আরেক প্রস্থ বাস সমস্যা শুরু হল। যে নতুন বাসটি আসার কথা ছিল, সেটি তখনো রেডি না বলে আবার নানান মনোমালিন্য ইত্যাদি ইত্যাদির পর রওনা দেওয়া হল। আমরা চারজন বাসের পিছনের সিট নিয়েছিলাম। বেশ খেলে ছড়িয়ে বসা যায়। ক্যামেরা হাতে আমার জায়গা ছিল জানলার ধারে। পুরনো জয়পুরের রাস্তা দিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য যন্তর মন্তর। অবশ্য পথে যেতে যেতে প্রথমেই আমাদের ডানদিকে দেখিয়ে দেওয়া হল রাজমন্দির সিনেমা হল। এই সিনেমা হলটির বৈশিষ্ট্য বলতে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা নাকি ভিতরে। বাইরে থেকেও বেশ একধরণের ফরাসী মিষ্টির মত দেখতে। সময়ের অভাবে আর ভিতরে যাওয়া হয়নি। অনেক ট্যুরিস্ট এখানে সিনেমা দেখেন। আমার বাবা ১৯৯৭ সালে যখন জয়পুর এসেছিল, তখন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত জুড়ওয়া সিনেমাটি দেখেছিল এখানে।
এরপরই আমাদের পথে পড়ল জয়পুরের বিখ্যাত হাওয়া মহল। আমাদের বাঁ দিকে। পরে ভিতরে এক্সপ্লোর করা হবে। তখন শুধুমাত্র বাইরে থেকে দেখে নেওয়া হল। জয়পুর বললে ছোট থেকে যা বুঝি, তা কিন্তু হাওয়া মহল। বিরাট একটা গোলাপী স্থাপত্য, অনেকটা মৌমাছিদের বাসার মত। বাসটা ওই জায়গায় ট্রাফিকের জন্য এমনিই আস্তে চলছিল, তাই ওই বিরাট ফ্যাকেডের ছবি তুলতে অসুবিধে হয়নি। "পিঙ্ক সিটি"র রাস্তায় এরপর দেখলাম লাইন দিয়ে গোলাপী রঙের বাড়ি, বিভিন্ন দোকান। অনেকটা আমাদের ধর্মতলা নিউ মার্কেট চত্বরের মত। সারি দিয়ে শুধুই দোকান। ওই সকালে তখনো দোকানগুলি খোলেনি। গোলাপী রঙটা ঠিক আমাদের পরিচিত গোলাপী বলা যায় না। খানিকটা যেন কমলা মিশিয়ে দেওয়া। তবে প্রতিটি দেওয়ালে ওই গোলাপীর ওপর খুব নিখুঁত ভাবে সাদা দিয়ে বর্ডার এঁকে আলপনা দেওয়া। দেখতে বেশ ভালো লাগছিল।
যন্তর মন্তরে পৌঁছলাম। পারকিং থেকে স্পটে যাওয়ার পথে দেখলাম অনেক দানা বিক্রি হচ্ছে। লোকে কিনে কিনে পায়রাদের খাওয়াচ্ছে। রাজস্থানিরা মনে করেন যে এতে পুণ্য হয়। গোটা রাজস্থান জুড়েই খুব দেখেছি এই ব্যাপারটা। আরেকটা জিনিস যেটা লক্ষ্য করলাম, সমস্ত ট্যুরিস্ট স্পটের ধারেকাছেই ভর্তি হকার, রঙ বেরঙের পসরা সাজিয়ে। মাথার পাগড়ি থেকে শুরু করে চাবির রিং, জামা, ঘর সাজানোর জন্য ছোট ছোট মূর্তি, ওয়াল হ্যানগিং, ইত্যাদি। ওই রঙ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। অনেকে বলেন যে রাজস্থান রুক্ষ, মরুভূমির দেশ। তাই মানুষজন পোশাকে রঙের খুব ব্যবহার করেন মন মেজাজ ভালো রাখতে। এই প্রসঙ্গে বলি, রাজস্থান মূলত দুই ভাগে বিভক্তঃ মেওয়ার ও মাড়োওয়ার। মেওয়ার দিব্যি সবুজ, চাষ হয়, অনেক গাছপালা আছে। জয়পুর উদয়পুর চিতোর সব মেওয়ারে। মাড়োওয়ার বালির জায়গা। যোধপুর জয়সালমের। যাই হোক, যা বলতে গিয়ে এতগুলো কথা বলে ফেললাম। সেই দোকানিদের থেকে দরদাম করে বেশ একটা হলুদ লাল সবুজ মেশানো পাগড়ি কিনে ফেললাম।
যন্তর মন্তরে ঢুকে দেখলাম দেখলাম এবং আশ্চর্য হলাম (যারা দিল্লীতে যন্তর মন্তর ঘুরেছেন, শুনেছি সেটা নাকি আরো মনোগ্রাহী)। নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সের স্টুডেন্ট বলেই যেন ওই প্রাচীন যুগে ভারতীয়দের টেকনলজিকাল এডভান্সমেন্টের এই দারুণ নিদর্শন দেখে বেশ একটা গর্ববোধ করছিলাম। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে হয়তো ওই যন্ত্রগুলির কোনটারই তেমনভাবে কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, কিন্তু সেই আমলে এস্ট্রোনমি চর্চার জন্য যে এমন সব যন্ত্র বানানো হয়েছিল সাওাই জয় সিং দ্বিতীয়র আমলে, তা সত্যিই কুর্নিশ যোগ্য। যন্তর মন্তরটি ইয়ুনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত, পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ সানডায়ালটি এখানেই রয়েছে। যন্তর মন্তরের মূল কমপ্লেক্স থেকে সিটি প্যালেস আর দূরে নাহারগড় কেল্লা দেখা যায়। এরপরের গন্তব্য সিটি প্যালেস। তবে নাহারগড় আমাদের শিডিউলে ছিলনা। নাহারগড়ের নাম সম্ভবত সব বাঙালিরা আমরা প্রথম শুনি সোনার কেল্লা পড়তে গিয়ে (আমার তো মনে হয় বাঙালির রাজস্থান প্রীতির একটা অন্যতম কারণ সত্যজিৎ রায়, ফেলুদা।)। এইখান থেকেই ডঃ হাজরাকে ঠেলে ফেলে দেয় মন্দার বোস এন্ড কোং।
সিটি প্যালেসটিো তৈরি হয় মহারাজা জয় সিং দ্বিতীয়র আমলে। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে আমের থেকে রাজধানী সরিয়ে যখন জয়পুরে আনা হয়, এক বাঙালি স্থপতি ছিলেন অন্যতম। জালেব চৌকের কাছে উদয়পোল দিয়ে সিটি প্যালেসে আমরা এলাম টিকিট কেটে। প্রথমেই এলাম মুবারক মহলে। এই মহলটিতে রয়েছে মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের ভিতরে রাজা মহারাজাদের ব্যবহার করা পোশাক অস্ত্রের বিচিত্র সম্ভার। নজর কেড়েছিল সাওয়াই মাধো সিংজীর বিরাট পোশাক। মুবারাক মহলের পরে সিটি প্যালেস কমপ্লেক্সেই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল চন্দ্র মহল। ভিতরে মিউজিয়াম ছিল, তবে যাইনি। সেই জায়গায় বাইরেটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। গোলাপী রঙের ওপর খুব সূক্ষ্ম কারুকার্য অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। সিটি প্যালেসেই চোখে পড়ল দুইটি বিরাট কলসীর, স্টারলিং রুপোর তৈরি। গাইড বললেন যে ওইটি নাকি গিনেস রেকর্ড হোল্ডার। চার হাজার লিটার জল ধরবে ওতে। ভাবতেই চোখ গোল হয়ে গেল! সিটি প্যালেসে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দলের এক বয়স্ক মানুষ হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেলেন। এদিকে তার সাথে ফোন নেই, খোঁজ খোঁজ করতে করতে অনেক পরে ওনাকে পাওয়া গেল। উনি নাকি ভিতরে অত হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন না বলে বাইরেই ছিলেন। বোঝো কাণ্ড!

সিটি প্যালেসের পর আমাদের পরের গন্তব্য আমের ফোরট। পথে জলমহল পড়ল। দেখলাম মান সাগর হ্রদের জলের মধ্যে একটা প্রাসাদ। কথা রইলো ফেরার পথে নেমে ফটো তোলা যাবে। একটা পারকিং লটে বাস থামিয়ে ওখানেই প্যাকড লাঞ্চ খেয়ে নেওয়া হল। সামনেই ছিল সরকারী হ্যান্ডলুম হ্যান্ডিক্রাফটসের আউটলেট। আমি যত মাকে বলি যে না, আমি বাপু বাজার থেকেই কেনাকাটি করবো, মায়ের তত এক কথা। "না না, দর দাম হবেনা আমার দ্বারা, তোর দ্বারাও হয় না। বরং গভমেন্টের জিনিস, ফিক্সড প্রাইস, এখান থেকেই কিনব।" ঘুরে ফিরে কিছু কিনব না কিনব না করেও কেনাকাটি হল। দাম বেশী কি কম, বলতে পারব না। এইটুকু সান্ত্বনা যে আমি ঠকলে আর পাঁচটা লোক যারা কিনল, তারাও ঠকেছে, আমি একা না!
আমের ফোরট পৌঁছোতে প্রায় চারটে বেজে গেল। রোদ পড়ে আসছে। মাওতা লেকের ধারে বিশাল ফোরটটির গায়ে পড়ন্ত সূর্যের সোনালী আলো। ফোরটের ভিতরে যেতে গেলে বেশ খানিকটা চড়াই চড়তে হবে। ব্যাটারই চালিত গাড়ি পাওয়া যায়, বেশ মিষ্টি দেখতে। বিভিন্ন রঙের। একটা গাড়িতে পাঁচ ছয় জন অনায়াসে এঁটে যায়। তবে আমরা যতক্ষণে গেলাম স্ট্যান্ডে, স্ট্যান্ড খালি। লাইনে দাঁড়ালে ঘন্টাখানেকের আগে চান্স পাওয়া যাবেনা। কোই বাত নেহি, এগারো নম্বর গাড়ি আছে না? তার ভরসায় মিনিট পনেরো কুড়ি উঁচুতে চড়ে অবশেষে পৌঁছলাম আমের ফোরটে।রাজস্থানের বেশীরভাগ ফোরতেই মোটামুটি একই ধরণের স্ট্রাকচার। একটা বিশাল কপমাউন্ড। চারিদিকে উঁচু বাড়ি। এখানেও তাই। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে আসতে আসতে গোটা কেল্লাটা ঘুরলাম। রাজার মহল, রানির মহল (সুহাগ মন্দির, যেখান থেকে রাজ পরিবারের নারীরা পর্দার আড়ালে থেকে ণিচে দিওয়ান ই আমের কর্মযজ্ঞ দেখতে পেতেন), দিওয়ান ই আম, দিওয়ান ই খাস, সব। শীষমহলে কাঁচের ওপর কারুকার্য সত্যি দেখার মতো। ট্যুরিস্ট এসে এসে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মূল ঘরটিতে এখন আর ঢুকতে দেওয়া হয়না। বাইরে থেকেই দেখতে হয়। আগে নাকি গাইডরা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখাতেন ওই মহলের সৌন্দর্য, কাঁচের ওপর আলোর রিফ্লেকশনের ছটা।
যতক্ষণে আমরা আমের ফোরট ঘুরে নীচে এলাম, ততক্ষণে সূর্যাস্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমের আকাশ এক অদ্ভুত মায়াবী লাল রঙে রঙিন। তার ব্যাকড্রপে আমের ফোরটকে কি সুন্দর যে লাগছিল, কী বলি? আমাদের বাস যতক্ষণে এসে পৌঁছল, ততক্ষণে ফোরটে আলো জ্বলে গিয়েছে। অসাধারণ দৃশ্য। এবার ফেরার পালা।
বাসে উঠতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। আবার একজন সদস্য মিসিং। তাকে খুঁজতে খুঁজতে আরো ঘন্টাখানেক প্রায় কেটে গেলো। যা বুঝলাম, জলমহল আর দেখা যাবেনা। পরের গন্তব্য বিড়লা মন্দির। ততক্ষণে আমার শরীরের সমস্ত এনার্জি শেষ। বাপু বাজারে গিয়ে যে শপিং করব, তারও আর ইচ্ছা নেই। মা ইতিমধ্যে আমের ফোরটের গেটের উল্টোদিকের একটা দোকানে গিয়ে বেশ কিছু টুকটাক কেনাকাটি করেছিলও। আমাদের দলের অনেকেই দেখলাম মার্কেটিং করেছে। মা বলল, "থাক। আবার অন্য জায়গায় কিনব।" আমিও কিছু বললাম না। একটু মন খারাপ হল বটে। সঙ্গে সঙ্গে গুগুল খুলে দেখতে লাগলাম পরের শহরগুলিতে কোথায় ভালো কেনাকাটি করা যায়। আসলে রাজস্থান বেড়ানোর কারণগুলির অন্যতম আমার কাছে ছবি তোলা আর কেনাকাটি করা। কাজেই একটু এফোরট দিতেই হবে। বিড়লা মন্দিরে আর নামিনি। বাসে বসেই তখন নেটে উদয়পুর যোধপুরের বাজারের হাল হকিকত দেখছিলাম।
রাত্রে হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে নরম বিছানায় শুয়ে টানা ঘুম দিলাম। আহ, কী আরাম। আবার পরেরদিন সক্কাল সক্কাল বেরোনো। পুষ্কর হয়ে আজমের। সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে লাগেজ দিয়ে দিতে হতো। সাতটায় বাস ছাড়ত। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। 
 

Monday, January 15, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৩ (তাজ মহল)

রাত্রে ডিনার টেবিলে বসে সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করা হল যে পরেরদিন সকাল সকাল তাজ মহল দেখতে যাওয়া হবে। তাজ দর্শন করে তবেই জয়পুরের উদ্দেশ্যে বেরোনো হবে। প্রথমে ঠিক ছিল ফতেহপুর সিক্রিও যাওয়া হবে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই পরিকল্পনা মুলতুবি রাখতে হল।
পঁচিশে ডিসেম্বর, সাংঘাতিক ভিড় হবে। এমনি দিনেই গড়ে এক দেড় ঘণ্টার লাইন পড়ে তাজ মহলে ঢুকতে, তাই সক্কাল সক্কাল ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা চারজন একটা অটো ধরে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে। তখন সবে টিকিট কাউন্টারে লাইন পড়ব পড়ব করছে। পাঁচ মিনিটে টিকিট হাতে নিয়ে মূল গেটে চলে এলাম। এসে দেখি ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা লাইন। এবং সেই লাইন বিশাল লম্বা। তাজ মহল খুলে যায় ভোর ছটা নাগাদ। আমরা প্রায় সাড়ে আটটা নটা নাগাদ লাইনে ঢুকলাম। মেয়েদের লাইনে ঘণ্টা দেড়েক লেগেছিল মায়ের আর আমার। সিকিউরিটি চেকিং বেশ কড়া (মানে অনেকটা ওই এয়ারপোর্টের মতোই)। কিছু নিষিদ্ধ জিনিস আছে যেমন ছুরি কাঁচি ইত্যাদি। জল নিয়ে যাওয়া যায়। তবে কোনরকম কস্মেটিক, খাবার কিছু এলাউড না।  তাজের খয়েরি রঙের মূল এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকে একটা বিরাট কম্পাউন্ডে এসে পড়লাম। শুরু হয়ে গেল আমার ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। বাবাকে ফোন করে জানা গেল ওদের লাইনটা অনেক লম্বা হওয়ায় ওদের ভিতরে আসতে অন্তত আরো ঘন্টাখানেক লাগবেই। মা কে বললাম, "সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চলো আমরা ঘুরতে থাকি। ছবি তোলার সময় পেয়ে যাবো। চলো।"
এই বলে তাজ মহলের দিকে এগোলাম। একটা গেটের সামনে দেখি খুব ভিড়। কারণটা খুব শিগগিরি বুঝে গেলাম। ওখান থেকেই যে প্রথম দর্শন পাওয়া যাচ্ছে দুনিয়ার সাত আশ্চর্যের আশ্চর্যটির। কেদারনাথ যাওয়ার পথে একটা জায়গা আছে, দেওদিখানি। সেখান থেকে প্রথম মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। তেমনি এই জায়গাটা যেন তাজদিখানি। তাজের সাথে শুভদৃষ্টিটা মানুষ এখান থেকেই সারছেন। আর তাই আরো বেশী ভিড়। ফটক টপকে যখন বইয়ের পাতায় দেখা আমাদের চিরপরিচিত তাজ মহল প্রথম দেখলাম, একেবারে পূর্ণ অবয়বে, ওই শ্বেত মার্বেলের বিশালাকৃতি দেখে অল্পক্ষণের জন্য হলেও থমকে গিয়েছিলাম। আর তার পরেই যেন ঘটনা ও পরিস্থিতির বাস্তবতা আমায় ধাক্কা দিয়ে ঘোরের মধ্যে থেকে বের করল। আরে, ছবি তুলতে হবে তো। খচ খচ করে একটার পর একটা ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। জুম লেন্সের ব্যাগটা বাবার হাতে, তাই কেরামতি মেরে দূর থেকে ভিড় টপকে একটাও ছবি এলোনা। আদ্ধেকের বেশী ছবিতেই পিলপিল করছে লোক। জন অরণ্য যাকে বলে। মোটামুটি জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে পোজ দিতে দিতে ও দেওয়াতে দেওয়াতে ছবি তুলে ও তুলিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম মূল মউসোলিয়ামে। দু চোখ ভরে অবাক চোখে দেখে যেতে লাগলাম মার্বেলের ওপর নয়নাভিরাম কারুকার্য। এত শত বছর আগের তৈরি, কী সাঙ্ঘাতিক প্রতিভাবান শিল্পীরা বানিয়েছিলেন এটিকে, আজ এতগুলো বছর পরেও সমানভাবে আমাদের আকর্ষণ করছে তাজ মহল। বাহ তাজ বলি আমরা সব সময়, আমার তো মনে হয়, প্রতিটি শিল্পীর নাম নিয়ে নিয়ে বাহ বললে হয়ত তাদের কাজের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে। ঐতিহাসিক কারণের চেয়েও বেশী, তাজ মহল আমার ভালো লেগেছে শৈল্পিক কারণে।
পরিবেশ দূষণের কারণে, তাজ মহলের আগের জৌলুস নাকি আর নেই। কী জানি বাবা, আমি তো এই প্রথম দেখলাম, ওই দুধ সাদা মনুমেন্টটি দেখে আমি হাঁ! আর এই দূষণের থেকে তাজ মহলকে বাঁচাতে এখন ভিতরে জুতো পরে যেতে দেয়না। জুতো পড়লেও তার ওপর পলিথিনের এক ধরণের আস্তরন লাগিয়ে ঢুকতে হয়। দশটাকা দিয়ে আমরা প্রত্যেকের জন্য এক এক জোড়া কিনে রেখেছিলাম আগেরদিনই। তাজ মহলের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য দেখলাম আরেকপ্রস্থ বিশাল লাইন। আমাদের হাতে সময় কম। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে বেরোতে হবে জয়পুরের উদ্দেশ্যে। জীবনে একবারে সব কিছু পাওয়া হয় না, এরকম একটা দার্শনিক মনোভাব নিয়েই মা আর আমি ঠিক করলাম যে থাক, আর ভিতরে ঢুকে কাজ নেই। এমনিও শাহ জাহান মুমতাজের আসল সমাধি মোটেই দেখাবেনা, আর কারুকার্য, সে তো বাইরে থেকেই ভালোই দেখতে পাচ্ছি। মোটেই বিরাট আর্ট ক্রিটিক নই আমরা যে একদম ডিটেলে না দেখলে জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং তাজের চার পাশটা প্রায় প্রদক্ষিণ করার মতো করেই হাঁটলাম। পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে যমুনা নদী, জল কম। কুয়াশাচ্ছন্ন। একটু ফাঁকা দেখে তাজের দেওয়ালে হাত দিলাম, স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করলাম এই বিশাল কীর্তিটিকে, বিশ্বজুড়ে যা এত বিখ্যাত করেছে আমার দেশকে। সাধারণ ভাবে ভাবলে হয়তো অন্য কোন শ্বেত পাথরের স্তম্ভ ছুঁয়ে দেখলেও একই অনুভূতি হত, কিন্তু ব্যাপারটা যেখানে তাজ মহল, যা চাক্ষুস দেখব বলে এই কদিন ধরে তিল তিল করে উত্তেজনার পাহাড় জমিয়েছি মনে, তাই সেই হিমশীতল স্পর্শও দিব্যি লাগল।
ইতিমধ্যে বাবা আর কাকাও চলে এসেছে। বাবার আগে জয়পুর আগ্রা ঘোরা, দিল্লি থেকে এসে। বাবা তো এই এত ভিড় দেখে অবাক। বলল যে লাস্ট যখন এসেছিল, তখন নাকি কোন লাইনই পায়নি। এমনি এমনি টুকটাক এসো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘুরে বেড়াও। সঙ্গে সঙ্গে উইশ লিস্টে যোগ করে নিলাম। তাজ মহল, ফাঁকাতে এসে ডিটেলে ঘুরতে হবে। আরো এক প্রস্থ ছবি তুলে দলের বাকি লোকজন (সবাই না, এই দলে এমন অনেকেই ছিল যারা সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তা মানত না। সেইসব কীর্তি বিভিন্ন পর্বে আরো আসবে।) মিলে আমরা হোটেলে ফিরলাম। এসে শুনি আরেক বিপত্তি। যে বাসে করে আমাদের জয়পুর যাওয়ার কথা, তথা, গোটা ট্রিপটা হওয়ার কথা, সেটা উদয়পুর থেকে আসছিল। পথে তার উইন্ডস্ক্রিন ভেঙ্গে চুরচুর। সে বাস গিয়েছে গ্যারেজে সারাতে। সকাল থেকে তো এমন কথা শুঞ্ছিলাম। এসে দেখি তখনও সে বাস আসেনি। কাঁচও কেনা হয়নি। এবার কতক্ষনে বাস রেডি হয়ে আসবে, কতক্ষণে আমরা বেরবো...জয়পুর পৌঁছব কতক্ষনে। দুপুরের খাবার খেয়ে হোটেলের ঘর চেক আউট করে সবাই লবিতে এসে বসেছি। বারবার ম্যানেজার কাকুকে সবাই জিজ্ঞেস করছি, কোন আপডেট আছে কি না। হোটেলের পাশে একটা স্যুভেনির শপ ছিল, সবাই প্রায় পালা করে করে ওখানে ঢুঁ মেরে এসেছি। আমার মা আর বাবা এর মধ্যে একবার বেরিয়ে আগ্রার বিখ্যাত পেঠা কিনেও এনেছে। এদিকে তো আসের কোন পাত্তা নেই। তখন খালি ভাবছি, ওলা ডেকে ফতেপুর সিক্রিটা দিব্যি ঘুরে আসা যেত এমন জানলে। কপালে না থাকলে যা হয়, আর কী। যাই হোক, সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমাদের বাস এলো প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ। হইহই করে লোকজন ছুটল সীট দখল করতে। মায়ের কাছে শোনা, এই কোম্পানির নিয়ম হল ট্যুরের মোট সময়টাকে দুই ভাগে ভাগ করে সীট এলট করা, যাতে কি না সকলেই মোটামুটি সামনে পিছনে মিলিয়ে বসতে পারে। বেশ ভালো নিয়ম। তা এই বাসে উঠেও দেখলাম সেরকম লিস্ট করে দেওয়া আছে। এদিকে সিটের গায়ে কোন নম্বর লেখা নেই। সেই নিয়ে শুরু হল গোলমাল। ডান্দিক থেকে এক নম্বর না বাঁ দিক থেকে এক নম্বর ধরা হবে... আরে বাবা, সিটিং প্ল্যান তো ছবির মতো আঁকা আছে, সিনেমার টিকিট কাটতে গেলে যেমন দেখি। তেমন করে বসলেই হল। তা না। যাদের পিছনের দিকে সীট পড়েছে, তারা শুরু করল আপত্তি। পাঁচ সাড়ে পাঁচ ঘন্টার জার্নি কি করে টানা কেউ পিছনে বসবে, এই একদিনেই ওলট পালট করতে হবে, সামনে বসতে দিতে হবে, হাঁটু ট্রান্সপ্লান্ট করা, তাই সামনে বসব (অথচ গোটা ট্রিপে একবারও অন্য সময় কিন্তু দেখলাম না আর কিছুতে কোন অসুবিধে),  কোমরে ব্যথা তাই ঝাঁকুনি সহ্য হবেনা, সিনিয়ার সিটিজেন তাই সামনে বসব। লেগ স্পেস কম, বসব না। বাস পাল্টাও। এখুনি মালিককে কল করো, ট্রিপ ক্যান্সেল করে দিচ্ছি। ইত্যাদি ইত্যাদি। কান ঝালাপালা করে শেষমেশ জয়পুর থেকে বাস বদল হবে এই আশ্বাসে আমাদের বাসটা ছাড়ল প্রায় চারটের পর, সকাল নটায় যেটা রওনা হওয়ার কথা ছিল। ফতেহপুর, ভরতপুর সব জায়গার ওপর দিয়ে যেতে যেতে মাঝে চায়ের হল্ট দিয়ে শেষমেশ বাস জয়পুরে ঢুকল রাত প্রায় দশটা নাগাদ। চারিদিক তখন প্রায় শুনশান। বাসের ড্রাইভার হোটেলের রাস্তা চেনেনা। কেন যে এরা গুগুল ম্যাপ ব্যবহার করেনা, কে জানে। অটোওয়ালা জোগাড় হল, একশো না দেড়শো টাকার বিনিময়ে রফা হল, সে আগে আগে গিয়ে আমাদের হোটেল অবধি বাসটাকে পৌঁছে দেবে। জয়পুরের হোটেলটা ছিল একটি হেরিটেজ হোটেল। রাডোলি হাউজ। ইন্টারনেটে দেখে এসছিলাম, দারুণ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল, উৎসুক হয়েছিলাম তাই ওখানে পৌঁছতে। শেষমেশ রাত এগারোটার পর হোটেলের গেটে এসে পৌঁছলাম। ঘুমে দুই চোখ বুজে আসছে। এক ঝলক দেখে যা বুঝলাম, অতি রাজকীয় থাকার ব্যবস্থা। সকালে উঠে ভালো করে দেখেশুনে ছবি তুলতে হবে।
এজেন্সির লোকজন তাড়াহুড়ো করে ওই রাতে রান্না চাপাতে গেল। পরেরদিন আমার কাকার জন্মদিন ছিল। কেকের ব্যবস্থা নেই। তাই রাত বারোটা বাজতে না বাজতে, কাকাকে দিয়ে "পেঠা কাটিয়ে" জন্মদিন পালন হল। আমি নিজে বছর দুই আগে মুন্নারে পিতজা কেটে জন্মদিন পালন করেছি। তবে পেঠাটা সত্যিই বিচিত্র! ওই অত রাত্তিরেও ভাত ডাল ভাজা মাছ (নাকি মাংস? ঠিক খেয়াল নেই) পেয়ে ক্লান্ত শরীর একটু আরাম পেল। মশমশে গরম জলে স্নান করে খেয়ে নরম বিছানায় গা এলালাম যখন, রাস্তায় বাইরে তখন শুধু কুকুরের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। রাত প্রায় দেড়টা। এদিকে নির্দেশ এসে গিয়েছে, পরেরদিন সকাল আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট দিয়ে দেওয়া হবে। নটায় বেরনো। সিটি সাইট সিইং।

Sunday, January 14, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ২ (আগ্রা ফোরট)

হোটেলে ঢুকে তো আরেকপ্রস্থ ঝুটঝামেলা। গিয়ে জানা গেলো, আমাদের সকলের জন্য বরাদ্দ ১৩টা ঘরের মধ্যে নাকি সব ঘর এখনো খালি নেই চেক ইন টাইম দুপুর বারোটা। তাই ঘর রেডি নেই। ম্যানেজার কাকু, হোটেলের ম্যানেজার, দলের লোকজন মিলে বাকবিতন্ডা (মিথ্যে বলব না, আমিও কম কথা শোনাইনি, আর শোনাব নাই বা কেন? ওমা, ভোর চারটেতে রাইট টাইমে পৌঁছলে কী হত? তখনও বারোটা অবধি লবিতে রাখত নাকি?) করে শেষমেশ বারোটার আগেই ঘর পাওয়া গেল। বেশ সুন্দর পরিষ্কার ছিমছাম ঘর, ব্যাল্কনি দেওয়া। সবাইকে ফ্রেশ হয়ে একটার মধ্যে লাঞ্চ করতে বলা হল। এই শুরু হল, প্রতিদিন খাওয়ার সময় এমন এনাউন্সমেন্ট। সারাদিনের টাইমটেবিল জানানো। ওইদিনের প্রোগ্রাম আগ্রা ফোরট আর তাজ মহল। গরম জলে ভালো করে স্নান করে শরীরের গ্লানি কাটিয়ে খেতে বসেই মন ভালো হয়ে গেলো। চেন্নাইয়ে দিনের পর দিন মাছ না পাওয়া আমি, পাতে দেখি মাছের মাথা দিয়ে ডাল, পাবদা মাছের ঝাল আর ইয়া বড় সাইজের গলদা (নাকি বাগদা? আমার এখনো গুলিয়ে যায় কোনটা কী) চিংড়ির কারি। মন ভরে পেট ভরে খেয়ে এবার সবাই মিলে বাসে ওঠা হল। প্রথম দিন, অল্পক্ষণের জার্নি, তাই বাসের সীট এলট্মেন্ট কিছু হয়নি। মৃত্যুঞ্জয় কাকু বলেই দিলেন। পরের দিন থেকে সীট নাম্বার লিস্ট সব দিয়ে দেওয়া হবে। আমরা তো তখনও বুঝিনি যে এই সীট নিয়েও কেমন দক্ষযজ্ঞ লেগে যেতে পারে। যাই হোক, আমাদের হোটেল থেকে আগ্রা ফোরট এবং তাজ মহল, দুটোই খুব কাছে। ট্যুর প্রোগ্রাম অনুযায়ী ঠিক হল যে আগে ফোরট যাওয়া হবে। তারপরে তাজ মহল। আমি অবশ্য একটু গাঁইগুই করছিলাম বটে যে ফোরটের লাইট এন্ড সাউন্ড দেখা যায় সন্ধ্যে ছটার পর থেকে। তার আগে বরং তাজ মহল দেখে নিই। কিন্তু যেহেতু সেট শিডিউল, তাই কিছু করার নেই। এই প্রথম বললাম মা বাবাকে, "ওই জন্যই নিজেরা নিজেরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেরানো উচিৎ। নিজেরদের মতো প্রোগ্রাম করে। কী যে দরকার এই ট্যুর পার্টিগুলোর, ইত্যাদি ইত্যাদি।"
ফোরট পৌঁছলাম মিনিট কুড়ি পঁচিশেই। রাস্তায় সামান্য জ্যাম ছিল। বাস কোথায় পার্ক হবে, কোথায় আমাদের নামতে হবে, এইসব চর্চা যখন চলছে, ইতিমধ্যে আমি জানলার পর্দা সরিয়ে পটাপট ছবি তোলা শুরু করে দিয়েছি। দুপুরের রোদে খয়েরি রঙের ফোরটের একটা সোনালি ব্রাউন রঙ, অপূর্ব লাগছিল।
ঘুরতে আসার আগে আগেই আমি ইন্দু সুন্দরেসনের একটি বই পড়ি, "দি টুএনটিএথ ওয়াইফ" নামের। এই বইটিতে মূলত মেহর-উন-নিসা অর্থাৎ নূর জাহানের কথাই লেখা। নূর জাহানের চোখ দিয়ে তৎকালীন মোগল সাম্রাজ্য, রাজ পরিবারের নানান কাহিনী। আর সেই বইতে প্রায় সিংহভাগ জুড়েই আগ্রা। আগ্রা ফোরট আর তাজ মহল। ফোরটে টিকিট কেটে (এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, রাজস্থান বেড়াতে এলে এমনি থাকা খাওয়া যাতায়াতের জন্য তো খরচ আছেই, আমাদের যেমন ট্রেন/প্লেন ভাড়া ছাড়া টুইন শেয়ারিং বেসিসে প্রতি জনের কুড়ি হাজার টাকা লেগেছিল, তার সাথে সাথে অন্তত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লাগে বিভিন্ন জায়গায় এন্ট্রি ফি আর গাইড ফি দিতে গিয়ে।) অমর সিং গেট দিয়ে ঢুকেই মনে হল, ঠিক যেন গল্পের পাতায় পৌঁছে গেলাম। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি, ছোট্ট মেহর-উন-নিসা মা বাবার হাত ধরে জেনানা মহলে ঢুকছে, বেগামের সাথে দেখা করতে। সেই বাগান যেখানে একদিন মেহরের সাথে চোখাচুখি হয় সেলিমের (যিনি তখনও জাহাঙ্গীর উপাধি নেন নি।)। আগ্রা ফোরট কিন্তু বাবরের আমল থেকেই মোগল সম্রাটদের দখলে, মাঝে কয়েকবার বিভিন্ন যুদ্ধে কেল্লার মালিকানা হারালেও পরবর্তী কালে মোগলদের হাতেই থেকে যায়। ইতিহাস বলে যে শুরুতে ইটের তৈরি কেল্লা হলেও সম্রাট আকবর স্থানীয় লাল স্যান্ডস্টোন দিয়ে এই কেল্লার বর্তমান রূপটি আনেন।
ফোরটের ভিতরে তিনটি স্বতন্ত্র স্থান দেখতে পাওয়া যায়। একটি আকবরের আমলের, অন্যটি জাহাঙ্গীর এবং তৃতীয়টি শাহ জাহানের। মূল কেল্লার স্থাপত্য দেখার মতো। সুক্ষ্ম কারুকার্য , সাদা মার্বেলের ওপর অতুলনীয়। দিওয়ান -ই-আম, দিওান-ই-খাসের নাম যেমন ইতিহাসের বইতে পড়েছি, তেমনি পরেছিলাম ওই গল্পের বইটিতে। চাক্ষুস দেখতে দেখতে সত্যি বলছি, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। যে জানলা দিয়ে শাহ জাহান শেষ বয়সে তাজ মহল দেখতেন, সেইখানে দাঁড়িয়ে যখন তাজ মহল দেখছিলাম, নিজেকে ইতিহাসের একটা অংশ মনে হচ্ছিল। শব্দ দিয়ে বলে বোঝাতে পারব না এই অনুভুতির কথা। গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম মীনা বাজারের কথা, যেখানে মহিলা মহলের জন্য আলাদা করে বাজার বস্ত, দোকানীরা পসরা সাজাতো, সেলিম আর মেহর-উন-নিসার কথোপকথন হত যেখানে, সেই মীনা বাজারের কথা যখন গাইড বলছিলেন, চোখের সামনে সিনেমার মতো দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিটি দৃশ্য। কেল্লাটি বিশাল, পুরোটা ভালো করে ঘুরে, ছবি তুলে বেরোতে বেরোতে আর উনত্রিশ জন একসঙ্গে বাসে আসতে আসতে প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেল। তাজ মহলে এন্ট্রি পাঁচটা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায়। তাজের দিকের রাস্তায় ভীষণ ভিড়। রবিবার বিকেল। ছুটির মরসুম চলছে। আমাদের বুক ধুকপুক করছে, তাজ মহল কী দেখতে পাবো? প্ল্যান অনুযায়ী আগামীকাল সকাল সকাল জয়পুর বেরিয়ে যাওয়ার কথা। তীরে এসে তরী ডুবলে ভারী মন খারাপ হবে। ঠিক পাঁচটা বাজতে পাঁচে তাজ মহলের পারকিং লটে বাস থেকে নেমে টিকিট কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছি সকলে, আশে পাশের দোকানীরা বললেন যে এখন আর গিয়ে কোন লাভ নেই। টিকিট পাওয়া যাবেনা। বিষণ্ণ হয়ে হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যের চা আর ফিশ ফ্রাইও মনে আনন্দ আনতে পারল না এতটুকুও। দ্বিতীয়বার মা কে বললাম, "এই জন্যই ট্রাভেল এজেন্সির সাথে আসতে নেই। আগে ফোরটে না গেলেই হতো! মিছিমিছি তাজ মহল মিস করলাম।"

Saturday, January 13, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ১

প্রস্তুতি ও ট্রেন পর্ব

বেড়াতে যেতে আমি খুব ভালোবাসি। আগে বছরে দুবার ঘুরতে যেতাম, একটা ছোট ট্রিপ হত (মানে ওই দিন সাতেকের), মার্চ এপ্রিলে স্কুলের নতুন সেশান শুরু হওয়ার আগে। আরেকটা হত একটু বড়। দিন পনেরোর। মূলত ডিসেম্বরে শীতের ছুটিতে। আর কলেজে পড়াকালীন দেড় মাস পুজোর ছুটি পেতাম বলে লক্ষ্মী পুজোর পর বেরোতাম। যবে থেকে মাদ্রাজে এসেছি লেখাপড়ার জন্য, বছরে যে কটাদিন ছুটি পাই, মন আনচান করে কখন বাড়ি যাবো, সেই ভেবে। তাই বাবা মায়ের সাথে তেমন করে ঘুরে বেড়ানো হয়না। আশেপাশে এখানে উইকেন্ড বা ডে ট্রিপ খুচখাচ লেগেই থাকে। ওদিকে বাবা মা ও নিজেরা অল্প বিস্তর এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। দুই পক্ষই নিজের মতো ঘুরে বেড়ালেও একসাথে ঘোরার আনন্দ বড্ড মিস করছিলাম, আর তাই সুযোগ খোঁজা হচ্ছিল একসাথে কোথাও যাওয়ার। যেতেই হবে এমন জায়গার লিস্টে ছিল রাজস্থান, লাদাখ, আন্দামান। শীত ছাড়া ছুটি পাওয়া যাবেনা বলে লাদাখ বাদ পড়ে গেলো। আন্দামান আর রাজস্থানের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর অবশেষে পরম বিক্রমের সাথে রাণাদের দেশ, রাজপুতানাই জিতে গেলো। বেশ কিছু বছর আগে শাহরুখ খানকে পহেলী সিনেমায় দেখে রাজস্থান জায়গাটির প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে যাই। এই আকর্ষণ কখনো কমতে পারেনি, তার আরেকটা কারণ হল, রাজস্থান সাঙ্ঘাতিক রকমের ফোটোজেনিক। আর যেই জায়গার  আর যেখানে ছবি তুলে আনন্দ পাওয়া যায়, আমি এক পায়ে খাড়া সেখানে যেতে। কাছাকাছি পাড়ার এক ট্রাভেল এজেন্সির (এদের সাথে বাবা মা দুটো ট্রিপ করে বেশ সন্তুষ্ট। কারণগুলি ক্রমশ প্রকাশ্য) লিস্ট দেখে ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ ঠিক হল দুই সপ্তাহব্যাপী রাজস্থান ভ্রমণের। বাঙালি ফাউ পেলে আর কিছু চায় না, আমরাও রাজস্থানের সাথে ফাউ পেলাম আগ্রা। আহ! সেই কবে থেকে ইতিহাসের পাতায় " টিয়ারড্রপ ইন দি চিক অফ টাইম"এর কথা পড়েছি, ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বাড়িতে ছোট রেপ্লিকা দেখেছি। এইবারে চাক্ষুস দেখব। নতুন কেনা ডি এস এল আর টার সদ্ব্যবহার হবে, এই আশায় আমি সমানে লাফাচ্ছি চেন্নাইতে বসে।
একুশ তারিখ বাড়ি এলাম। সন্ধ্যে থেকে নিজের লাগেজ প্যাক করতে বসলাম। ইতিমধ্যে মা নিজের আর বাবারটা গুছিয়ে রেখেছিল। আমি চেন্নাই থেকে এমনি সাধারণ পোশাক নিয়ে আসলেও গরমজামা কলকাতা থেকেই নিতে হল (কী করব, ২০১৩'র পর গরম জামা পড়েছি কেবলমাত্র গত জানুয়ারিতে পুণা গিয়ে)। অসম্ভব টায়ারড হয়েই (প্যাকিং আর বাইশে একটু দুই একজন আত্মীয়ের সাথে দেখা সাক্ষাত করেই কাহিল) ট্রেনে উঠলাম তেইশ তারিখ। সকাল আটটার পূর্বাতে টিকিট ছিল। বাড়ি থেকে ভোর ভোর (মানে আমার কাছে অন্তত ভোর। তার ওপর আবার ডিসেম্বরের শেষের ঠান্ডা, কম্বলের আরাম ছাড়া বড্ড কড়া শাস্তি যে!) বেরিয়ে ট্রেনে তো উঠলাম। এসি থ্রি টিয়ারে আমাদের রিজার্ভেশন ছিল। আমি পেয়েছিলাম পছন্দসই লোয়ার বার্থ (তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল সাইড লোয়ার। বেশ পর্দা টেনে নিজস্ব একটা জগত তৈরি করা যেত। কিন্তু আজকাল তো ভারতীয় রেল অনেক বেশী প্রগতিশীল হয়েছে, পর্দা সিস্টেম কবেই উঠে গিয়েছে! ভালো ভালো। দেশের উন্নতি।) মা বাবা আর আমি এক জায়গায়, আমার কাকা আসানসোল থেকে উঠবে, শেষ মুহূর্তে জয়েন করেছে প্ল্যানে, তাই এসিতে টিকিট হয়নি, তৎকালেও। বেচারা স্লিপারেই পুরোটা এলো। আমাদের সহযাত্রীরা ছিল এক গুজরাটি পরিবার। প্রায় ৩০-৪০জনের দল ওদের, পুরো পরিবার মিলে মথুরা যাবে। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওরা সবাই মিলে চলেছে। ওদেরও গন্তব্য টুন্ডলা ষ্টেশন, আমাদেরই মতো। ট্রেন রাইট টাইমে পৌঁছলে ভোর তিনটে নাগাদ টুন্ডলা নামার কথা, তবে শীতকাল। জানা কথাই যে লেট হবে। আমরা শুধু এইটুকুই প্রার্থনা করছি, যেন অন্তত চারটে পাঁচটার আগে ষ্টেশন না আসে (প্রার্থনার যে ভালোই জোর আছে, এবং কিছুটা হলেও দরকারের চেয়ে বেশী, তা আমরা খুব শিগগিরি বুঝে গিয়েছিলাম!)। ওই বিশাল দলটা সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে বকবক করেই চলছিল, শুরুর দিকে মন্দ না লাগলেও আসতে আসতে বেশ একটা বিরক্তি ধরছিল বটে। আমি সচরাচর ট্রেনে বা প্লেনে উঠলে বই পড়ি বা গান শুনি। শুয়ে শুয়ে কিন্ডল রিডারে বই পড়তে খুব অসুবিধে হচ্ছিল এই ক্ষেত্রে। জানলার ধারে এমনি বসে থাকলে আমার খুব ঘুম পায়। তাই কিছুটা ঘুমোতে ঘুমোতে আর খানিক বই পড়তে পড়তে চলল আমাদের ট্রেন জার্নি। ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার বাবু, মৃত্যুঞ্জয় কাকু মাঝে এসে দেখা করে গেলেন। চুক্তি অনুযায়ী ট্রেনে সেদিন ব্রেকফাস্ট থেকেই ওদের খাবার দেওয়া শুরু।
মা বাবা এই এজেন্সির সাথে প্রথম যায় মধ্য প্রদেশ। জার্নি, থাকা ইত্যাদি নিয়ে আমরা তিনজনেই খুব ফ্লেক্সিবল, শুধু যেটা সমস্যা দাঁড়ায়, খাওয়া নিয়ে। না, মানে বাঙালি খাবার ছাড়া মুখে কিছু রোচে না এমনটা না, যদিও কেদারনাথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যখন দেখলাম ভারত সেবাশ্রমে রান্না হচ্ছে খিচুরি আর আলুভাজা, আমরা যেমন আনন্দিত হই, ঠিক তেমনি অমৃতসরের পথে ধাবায় বসে সরসো কা সাগ আর মকাই কি রুটি তেমনি উপভোগ করি। তবে আজকাল বয়সের সাথে সাথে আমার মায়ের বেশী করে (গলব্লাডারের স্টোন অপারেশনের পর এটা বেড়েছে) আর কিছুটা হলেও আমার বাবার টানা বেশিদিন তেল মসলা দেওয়া খাবার খেলে শরীর খারাপ করে। তাই ওরা আজকাল প্রেফার করেন এরকম এজেন্সির সাথে ঘোরা যাতে ঘরোয়া খাবারটা পাওয়া যায় (যদিও চিরকাল আমরা নিজেরাই ঘুরে বেরিয়েছি। রাজস্থান ট্রিপ্টাই আমার জন্য প্রথম এজেন্সির সাথে বেরানো)। ব্রেকফাস্টে বান রুটি, ডিম সিদ্ধ, আপেল, মিষ্টি ছিল। সাথে চা। দুপুরে প্যাকড লাঞ্চ। ফ্রায়েড রাইস কাতলা মাছের কালিয়া আর আবার মিষ্টি (এই ট্রিপে প্রত্যেকদিন ব্রেকফাস্টে একটা করে মিষ্টি খেয়েছি। কাজেই কত কিলো যে ওজন বাড়িয়েছি, সেই প্রসঙ্গে না গেলেও চলে)। দিনেরবেলা ট্রেন বিহার দিয়ে যায়, কাজেই একদম প্রত্যাশিতভাবেই প্রচুর এক্সট্রা লোকজন উঠলেন রিজারভড কামরাতে। অবশ্য করেই অসুবিধে হয়, ওদের ওপর রাগ হয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই কষ্ট লাগে ওদের জন্য, এই বিরাট ভারতবর্ষে যেমন আমরা থাকি মেট্রো সিটিতে, যেখানে রয়েছে সব রকম সুবিধে, ঠিক তেমনি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন এরা। যাদের কাছে এই দূরপাল্লার ট্রেন ছাড়া কোন গতি নেই। আর তাই নিরুপায় হয়ে রিজারভড কম্পারট্মেন্টেও উঠতে হয়, লোকের কটুক্তি শুনতে হয়। প্রতিনিয়ত।
কখন টুন্ডলা আসবে, নামতে হবে, এই ভাবতে ভাবতে প্রতি ঘন্টায় একবার করে জেগে বাইরেটা জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে করতে অবশেষে পরেরদিন ছয় ঘন্টা লেট করে আমাদের ট্রেন সকাল নটায় ঢুকল টুন্ডলা। দুই মিনিটের হল্ট, অনেক লোক নাম্বে একই কামরা থেকে, তাই একটু টেনশন ছিল। মোটামুটি ধাক্কাধাক্কি করতে করতে মাল নিয়ে নেমে পড়লাম টুন্ডলা। ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ঘোরার পরবর্তী উপকারিতা এইবারে টের পেলাম। সমস্ত লাগেজের দায়িত্ব ওদের। এক্টুও মাল টানাটানি করতে হয়নি। সাথে প্রৌঢ় বা বয়স্ক মানুষ থাকলেও লাগেজ নিয়ে ঘুরতে একটুও অসুবিধে হয়না। ষ্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আমাদের একটি বাসে তুলে দেওয়া হল। ওই তখনই পরিচয় হল মোটামুটি গ্রুপের বাকিদের সাথে। আমরা চারজন (মা বাবা কাকা আর আমি) ছাড়া আরো পঁচিশজন। এছাড়া এজেন্সির পাঁচ কর্মচারী আর ম্যানেজার মশাই। মোট দলে পয়ত্রিশজন। বাসে ঘন্টাখানেকের জার্নি করে আমরা শেষমেশ এসে পৌঁছলাম আগ্রাতে, আমাদের হোটেল ডিলাক্স প্লাজাতে। 

আমার চোখে রাজস্থান: পর্ব ০



- কী ব্যাপার তোমার, অমন প্যাঁচার মত মুখ করে বসে আছো কেন?
- সা, মন মেজাজ ভালো নেই।
- কেন গো? কী হল?
- ধুর ধুর। এই নটা বাজতে গেল। এইবারে ভিড় শুরু হবে। আবার ওই হাসি মুখ করে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আর ভালো লাগছেনা।
- তা এ তো তোমার আজকের নতুন রুটিন না। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। হঠাৎ আজ কী হল?
- হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আমার আজকাল আর ভালো লাগছেনা। এই যে এত্তগুলো বাইরের অজানা অচেনা লোকজন আসছে, আমাদের সব জিনিসপত্রের ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশে হাভেলির অমন দুর্লভ পেইন্টিংগুলোর রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির এত সুন্দর সুন্দর ডিজাইন লোকে বেমালুম কপি করে যাচ্ছে। এক্সলুসিভ বলে আর কিছু থাকছেনা যে।
- বুঝি সবই বুঝি। কিন্তু কিছু তো করার নেই সা। বংশধরেরা যে এখনো অবধি হাভেলিটাকে পাঁচতারা হোটেল বানাতে দিয়ে দেয়নি, এই ঢের। নইলে তোমার আমার স্থান যে কোথায় হত আমি ভাবতেও পারছিনা। ওদের রোজগারপাতির ঠিকঠিকানা নেই, এদিকে লাইফস্টাইল দেখো এখনো খানদানি। ওদের কথা ভেবে নাহয় আমাদের আরো দিনের পর দিন এমনভাবে নিজেদের ডিসপ্লে আইটেম করতে হবে!
- কপাল, কপাল!
- হু। ছাড়ো। নাস্তা দাও। কী বানিয়েছ?
- কী আবার? ডাল বাটি চুরমা। একটু ভারি খাবার না খেলে বিকেল অবধি ঠায় দাঁড়ানোর স্ট্রেন্থ পাবেনা সা।
- তাও বটে। তাও বটে।।