খাম্মা ঘানি! কাল অনেক রাত্রে জয়পুরে পৌঁছলাম তো, তখন আর মাথা কাজ করছিল না। তাই এই রাজস্থানি সম্ভাষণটা করা হয়ে ওঠেনি। এখন করলাম। আজ অর্থাৎ ২৬শে ডিসেম্বর আমাদের সারাদিন জয়পুর সিটি সাইটসিইং করার কথা। হিসেব মত পঁচিশ তারিখটা আমাদের সন্ধ্যেবেলা ফ্রি থাকার কথা ছিল। মোটামুটি যত রিসোর্স আছে, সব কাজে লাগিয়ে ভালো শপিঙের জায়গার হদিস নিয়ে এসছিলাম। প্ল্যান ছিল ওইদিন ফাঁকা সময়টা শপিঙে কাজে লাগানো যাবে। তবে বাসের অনুপস্থিতি সব ভেস্তে দিল। কিন্তু নো চিন্তা! মৃত্যুঞ্জয় কাকুর থেকে গোটা দিনের একটা রাফ শিডিউল জেনে নিয়ে ঠিক করলাম, লাস্ট স্পট থেকে একটা ওলা বা উবার নিয়ে বাপু বাজার চলে যাব (এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, জয়পুর ছাড়াও বাপু বাজার আছে উদয়পুরে। দুটোই খুব বিখ্যাত।)। পারলে বিকেল বিকেল। কারণ সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে দোকান বাজার বন্ধ হয়ে যায়।
ব্রেকফাস্ট করার আগে চলল আমাদের হোটেলে একপ্রস্থ ফটোশুট। হোটেলটি রাজপুত ডাক্তার পরিবারের পৈত্রিক বাড়ি। কিছু অংশে পরিবারের লোকজন এখনো থাকেন, আর বাকিটা হেরিটেজ হোটেল হিসেবে চলে। রাজকীয় ব্যবস্থাপনা। প্রতিটিঘরের অন্দরসজ্জা যেমন খুবই রুচিসম্পন্ন, তেমনি প্রতিটি ফ্লোরের লিভিং স্পেস, রিডিং রুম, সমানভাবে সাজানো। একতলায় ড্রয়িং রুমে গতকাল রাত্রেই চোখে পড়েছিল সেনটার টেবিলটি, ওটির পায়া আসলে একটি বাঘিনী। আরেকটি ছিল, সেটি আবার উটের ওপর ভর করা। বিভিন্ন কাঠের মূর্তি, অমূল্য পেইন্টিং, সিলিঙে অনন্য কারুকার্য, হাল্কা লাইটিং, সব মিলিয়ে ছবি তোলার জন্য যাকে বলে পারফেক্ট। বেরোনোর মুখে আরেক প্রস্থ বাস সমস্যা শুরু হল। যে নতুন বাসটি আসার কথা ছিল, সেটি তখনো রেডি না বলে আবার নানান মনোমালিন্য ইত্যাদি ইত্যাদির পর রওনা দেওয়া হল। আমরা চারজন বাসের পিছনের সিট নিয়েছিলাম। বেশ খেলে ছড়িয়ে বসা যায়। ক্যামেরা হাতে আমার জায়গা ছিল জানলার ধারে। পুরনো জয়পুরের রাস্তা দিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য যন্তর মন্তর। অবশ্য পথে যেতে যেতে প্রথমেই আমাদের ডানদিকে দেখিয়ে দেওয়া হল রাজমন্দির সিনেমা হল। এই সিনেমা হলটির বৈশিষ্ট্য বলতে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা নাকি ভিতরে। বাইরে থেকেও বেশ একধরণের ফরাসী মিষ্টির মত দেখতে। সময়ের অভাবে আর ভিতরে যাওয়া হয়নি। অনেক ট্যুরিস্ট এখানে সিনেমা দেখেন। আমার বাবা ১৯৯৭ সালে যখন জয়পুর এসেছিল, তখন সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত জুড়ওয়া সিনেমাটি দেখেছিল এখানে।
এরপরই আমাদের পথে পড়ল জয়পুরের বিখ্যাত হাওয়া মহল। আমাদের বাঁ দিকে। পরে ভিতরে এক্সপ্লোর করা হবে। তখন শুধুমাত্র বাইরে থেকে দেখে নেওয়া হল। জয়পুর বললে ছোট থেকে যা বুঝি, তা কিন্তু হাওয়া মহল। বিরাট একটা গোলাপী স্থাপত্য, অনেকটা মৌমাছিদের বাসার মত। বাসটা ওই জায়গায় ট্রাফিকের জন্য এমনিই আস্তে চলছিল, তাই ওই বিরাট ফ্যাকেডের ছবি তুলতে অসুবিধে হয়নি। "পিঙ্ক সিটি"র রাস্তায় এরপর দেখলাম লাইন দিয়ে গোলাপী রঙের বাড়ি, বিভিন্ন দোকান। অনেকটা আমাদের ধর্মতলা নিউ মার্কেট চত্বরের মত। সারি দিয়ে শুধুই দোকান। ওই সকালে তখনো দোকানগুলি খোলেনি। গোলাপী রঙটা ঠিক আমাদের পরিচিত গোলাপী বলা যায় না। খানিকটা যেন কমলা মিশিয়ে দেওয়া। তবে প্রতিটি দেওয়ালে ওই গোলাপীর ওপর খুব নিখুঁত ভাবে সাদা দিয়ে বর্ডার এঁকে আলপনা দেওয়া। দেখতে বেশ ভালো লাগছিল।
যন্তর মন্তরে পৌঁছলাম। পারকিং থেকে স্পটে যাওয়ার পথে দেখলাম অনেক দানা বিক্রি হচ্ছে। লোকে কিনে কিনে পায়রাদের খাওয়াচ্ছে। রাজস্থানিরা মনে করেন যে এতে পুণ্য হয়। গোটা রাজস্থান জুড়েই খুব দেখেছি এই ব্যাপারটা। আরেকটা জিনিস যেটা লক্ষ্য করলাম, সমস্ত ট্যুরিস্ট স্পটের ধারেকাছেই ভর্তি হকার, রঙ বেরঙের পসরা সাজিয়ে। মাথার পাগড়ি থেকে শুরু করে চাবির রিং, জামা, ঘর সাজানোর জন্য ছোট ছোট মূর্তি, ওয়াল হ্যানগিং, ইত্যাদি। ওই রঙ দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। অনেকে বলেন যে রাজস্থান রুক্ষ, মরুভূমির দেশ। তাই মানুষজন পোশাকে রঙের খুব ব্যবহার করেন মন মেজাজ ভালো রাখতে। এই প্রসঙ্গে বলি, রাজস্থান মূলত দুই ভাগে বিভক্তঃ মেওয়ার ও মাড়োওয়ার। মেওয়ার দিব্যি সবুজ, চাষ হয়, অনেক গাছপালা আছে। জয়পুর উদয়পুর চিতোর সব মেওয়ারে। মাড়োওয়ার বালির জায়গা। যোধপুর জয়সালমের। যাই হোক, যা বলতে গিয়ে এতগুলো কথা বলে ফেললাম। সেই দোকানিদের থেকে দরদাম করে বেশ একটা হলুদ লাল সবুজ মেশানো পাগড়ি কিনে ফেললাম।
যন্তর মন্তরে ঢুকে দেখলাম দেখলাম এবং আশ্চর্য হলাম (যারা দিল্লীতে যন্তর মন্তর ঘুরেছেন, শুনেছি সেটা নাকি আরো মনোগ্রাহী)। নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সের স্টুডেন্ট বলেই যেন ওই প্রাচীন যুগে ভারতীয়দের টেকনলজিকাল এডভান্সমেন্টের এই দারুণ নিদর্শন দেখে বেশ একটা গর্ববোধ করছিলাম। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে হয়তো ওই যন্ত্রগুলির কোনটারই তেমনভাবে কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, কিন্তু সেই আমলে এস্ট্রোনমি চর্চার জন্য যে এমন সব যন্ত্র বানানো হয়েছিল সাওাই জয় সিং দ্বিতীয়র আমলে, তা সত্যিই কুর্নিশ যোগ্য। যন্তর মন্তরটি ইয়ুনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত, পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ সানডায়ালটি এখানেই রয়েছে। যন্তর মন্তরের মূল কমপ্লেক্স থেকে সিটি প্যালেস আর দূরে নাহারগড় কেল্লা দেখা যায়। এরপরের গন্তব্য সিটি প্যালেস। তবে নাহারগড় আমাদের শিডিউলে ছিলনা। নাহারগড়ের নাম সম্ভবত সব বাঙালিরা আমরা প্রথম শুনি সোনার কেল্লা পড়তে গিয়ে (আমার তো মনে হয় বাঙালির রাজস্থান প্রীতির একটা অন্যতম কারণ সত্যজিৎ রায়, ফেলুদা।)। এইখান থেকেই ডঃ হাজরাকে ঠেলে ফেলে দেয় মন্দার বোস এন্ড কোং।
সিটি প্যালেসটিো তৈরি হয় মহারাজা জয় সিং দ্বিতীয়র আমলে। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে আমের থেকে রাজধানী সরিয়ে যখন জয়পুরে আনা হয়, এক বাঙালি স্থপতি ছিলেন অন্যতম। জালেব চৌকের কাছে উদয়পোল দিয়ে সিটি প্যালেসে আমরা এলাম টিকিট কেটে। প্রথমেই এলাম মুবারক মহলে। এই মহলটিতে রয়েছে মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের ভিতরে রাজা মহারাজাদের ব্যবহার করা পোশাক অস্ত্রের বিচিত্র সম্ভার। নজর কেড়েছিল সাওয়াই মাধো সিংজীর বিরাট পোশাক। মুবারাক মহলের পরে সিটি প্যালেস কমপ্লেক্সেই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল চন্দ্র মহল। ভিতরে মিউজিয়াম ছিল, তবে যাইনি। সেই জায়গায় বাইরেটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। গোলাপী রঙের ওপর খুব সূক্ষ্ম কারুকার্য অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল। সিটি প্যালেসেই চোখে পড়ল দুইটি বিরাট কলসীর, স্টারলিং রুপোর তৈরি। গাইড বললেন যে ওইটি নাকি গিনেস রেকর্ড হোল্ডার। চার হাজার লিটার জল ধরবে ওতে। ভাবতেই চোখ গোল হয়ে গেল! সিটি প্যালেসে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দলের এক বয়স্ক মানুষ হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেলেন। এদিকে তার সাথে ফোন নেই, খোঁজ খোঁজ করতে করতে অনেক পরে ওনাকে পাওয়া গেল। উনি নাকি ভিতরে অত হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন না বলে বাইরেই ছিলেন। বোঝো কাণ্ড!
সিটি প্যালেসের পর আমাদের পরের গন্তব্য আমের ফোরট। পথে জলমহল পড়ল। দেখলাম মান সাগর হ্রদের জলের মধ্যে একটা প্রাসাদ। কথা রইলো ফেরার পথে নেমে ফটো তোলা যাবে। একটা পারকিং লটে বাস থামিয়ে ওখানেই প্যাকড লাঞ্চ খেয়ে নেওয়া হল। সামনেই ছিল সরকারী হ্যান্ডলুম হ্যান্ডিক্রাফটসের আউটলেট। আমি যত মাকে বলি যে না, আমি বাপু বাজার থেকেই কেনাকাটি করবো, মায়ের তত এক কথা। "না না, দর দাম হবেনা আমার দ্বারা, তোর দ্বারাও হয় না। বরং গভমেন্টের জিনিস, ফিক্সড প্রাইস, এখান থেকেই কিনব।" ঘুরে ফিরে কিছু কিনব না কিনব না করেও কেনাকাটি হল। দাম বেশী কি কম, বলতে পারব না। এইটুকু সান্ত্বনা যে আমি ঠকলে আর পাঁচটা লোক যারা কিনল, তারাও ঠকেছে, আমি একা না!
আমের ফোরট পৌঁছোতে প্রায় চারটে বেজে গেল। রোদ পড়ে আসছে। মাওতা লেকের ধারে বিশাল ফোরটটির গায়ে পড়ন্ত সূর্যের সোনালী আলো। ফোরটের ভিতরে যেতে গেলে বেশ খানিকটা চড়াই চড়তে হবে। ব্যাটারই চালিত গাড়ি পাওয়া যায়, বেশ মিষ্টি দেখতে। বিভিন্ন রঙের। একটা গাড়িতে পাঁচ ছয় জন অনায়াসে এঁটে যায়। তবে আমরা যতক্ষণে গেলাম স্ট্যান্ডে, স্ট্যান্ড খালি। লাইনে দাঁড়ালে ঘন্টাখানেকের আগে চান্স পাওয়া যাবেনা। কোই বাত নেহি, এগারো নম্বর গাড়ি আছে না? তার ভরসায় মিনিট পনেরো কুড়ি উঁচুতে চড়ে অবশেষে পৌঁছলাম আমের ফোরটে।রাজস্থানের বেশীরভাগ ফোরতেই মোটামুটি একই ধরণের স্ট্রাকচার। একটা বিশাল কপমাউন্ড। চারিদিকে উঁচু বাড়ি। এখানেও তাই। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে আসতে আসতে গোটা কেল্লাটা ঘুরলাম। রাজার মহল, রানির মহল (সুহাগ মন্দির, যেখান থেকে রাজ পরিবারের নারীরা পর্দার আড়ালে থেকে ণিচে দিওয়ান ই আমের কর্মযজ্ঞ দেখতে পেতেন), দিওয়ান ই আম, দিওয়ান ই খাস, সব। শীষমহলে কাঁচের ওপর কারুকার্য সত্যি দেখার মতো। ট্যুরিস্ট এসে এসে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মূল ঘরটিতে এখন আর ঢুকতে দেওয়া হয়না। বাইরে থেকেই দেখতে হয়। আগে নাকি গাইডরা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেখাতেন ওই মহলের সৌন্দর্য, কাঁচের ওপর আলোর রিফ্লেকশনের ছটা।
যতক্ষণে আমরা আমের ফোরট ঘুরে নীচে এলাম, ততক্ষণে সূর্যাস্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমের আকাশ এক অদ্ভুত মায়াবী লাল রঙে রঙিন। তার ব্যাকড্রপে আমের ফোরটকে কি সুন্দর যে লাগছিল, কী বলি? আমাদের বাস যতক্ষণে এসে পৌঁছল, ততক্ষণে ফোরটে আলো জ্বলে গিয়েছে। অসাধারণ দৃশ্য। এবার ফেরার পালা।
বাসে উঠতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। আবার একজন সদস্য মিসিং। তাকে খুঁজতে খুঁজতে আরো ঘন্টাখানেক প্রায় কেটে গেলো। যা বুঝলাম, জলমহল আর দেখা যাবেনা। পরের গন্তব্য বিড়লা মন্দির। ততক্ষণে আমার শরীরের সমস্ত এনার্জি শেষ। বাপু বাজারে গিয়ে যে শপিং করব, তারও আর ইচ্ছা নেই। মা ইতিমধ্যে আমের ফোরটের গেটের উল্টোদিকের একটা দোকানে গিয়ে বেশ কিছু টুকটাক কেনাকাটি করেছিলও। আমাদের দলের অনেকেই দেখলাম মার্কেটিং করেছে। মা বলল, "থাক। আবার অন্য জায়গায় কিনব।" আমিও কিছু বললাম না। একটু মন খারাপ হল বটে। সঙ্গে সঙ্গে গুগুল খুলে দেখতে লাগলাম পরের শহরগুলিতে কোথায় ভালো কেনাকাটি করা যায়। আসলে রাজস্থান বেড়ানোর কারণগুলির অন্যতম আমার কাছে ছবি তোলা আর কেনাকাটি করা। কাজেই একটু এফোরট দিতেই হবে। বিড়লা মন্দিরে আর নামিনি। বাসে বসেই তখন নেটে উদয়পুর যোধপুরের বাজারের হাল হকিকত দেখছিলাম।
রাত্রে হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে নরম বিছানায় শুয়ে টানা ঘুম দিলাম। আহ, কী আরাম। আবার পরেরদিন সক্কাল সক্কাল বেরোনো। পুষ্কর হয়ে আজমের। সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে লাগেজ দিয়ে দিতে হতো। সাতটায় বাস ছাড়ত। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি।
No comments:
Post a Comment