৩রা জানুয়ারি সকাল সকাল জয়সালমের থেকে রওনা দিলাম যোধপুরের উদ্দেশ্যে। ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা। তার মধ্যে আবার মাঝে চা আর দুপুরের খাবারের ব্রেক। রাস্তাঘাট খুব সুন্দর। কিন্তু গনগনে রোদ। আর এতদিনের ঘোরাঘুরির ধকল। সকলেরই অবস্থা কাহিল। বাসে আসতে আসতে পরেরদিনের ট্রেনের টিকিট ক্যান্সেল করলাম। বাবার শরীরটা হাল্কা খারাপ হবো হবো করছে। বুঝলাম সবই ক্লান্তি থেকে। এই কটাদিন প্রায় রোজ রাত্রে শুতে যাওয়া হয়েছে বারোটার দিকে, উঠতে হয়েছে সক্কাল সক্কাল। সাড়ে পাঁচটা ছটায়। লঙ জার্নি। শরীরের তো সহ্যের সীমানা থাকে, না কি?
যোধপুর পৌঁছলাম বিকেল তিনটের দিকে। আসার পথে রাস্তায় বড্ড বালি। কিন্তু শহরটা যতটুকু দেখলাম, ভারি ছিমছাম। খুব সুন্দর। গোছানো। শহরের মধ্যে দিয়ে আমাদের বাস চলতে চলতে প্রথমেই নিয়ে এলো মেহেরানগড় কেল্লায়। অনেকেই বলেন, রাজস্থান ভ্রমণের সময় তেমন বেশী না থাকলে, অন্তত যে একটি কেল্লা দেখা উচিত, সেটি মেহেরানগড়। আমি জানি না কতটা একমত হতে পারব বলে, তবে অবশ্য করেই অন্যতম সেরা ও প্রিয় এইটি। পাহাড়ের ওপর এক বিরাটাকায় কেল্লা। পনেরোশো শতাব্দীতে রাও যোধার বানানো। ভীষণ সুন্দর কারুকার্য, স্থাপত্য এবং সর্বোপরি বিরাট আঙিনা। এই এত কেল্লা ঘুরে ঘুরে উচি উঁচু সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন হাঁটুর অবস্থা যায় যায় আর কি, তখন মেহেরানগড়ের লিফট ফেসিলিটি আছে জানতে পাড়া একটা বিশাল আশীর্বাদ। টিকিট কাউন্টার থেকে কেল্লার প্রবেশপত্র কিনতে গিয়ে লিফটের জন্য আলাদা টিকিট কিনে নেওয়া যায়। তারপর লম্বা লাইনে অপেক্ষা। অন্তত মিনিট কুড়ি পরে সুযোগ এলো। লিফটে করে এক্কেবারে সাঁটত ওলায় পৌঁছলাম। বেরিয়ে দেখি আবারও এক বিশাল উঠোন মত ছাদ। ছাদের থেকে যোধপুড় শহরের অপরূপ দৃশ্য। সারি সারি নীল রঙের দেওয়ালের বাড়ি। শুনেছি নাকি কেবলমাত্র ব্রাহ্মণরা তাদের বাড়ির দেওয়াল নীল রঙ করতে পারতেন। সে যাই হোক, ছাদ থেকে ভালো লাগছিল, বোঝা গেল কেন শহরটিকে "Blue city" বলা হয়। রোদের তেজে সাংঘাতিক, আর সেই কারণেই যোধপুরের আরেক নাম "Sun city"। একটা কামান দেখলাম। ছাদ থেকে তাক করা। শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলেই যাতে দাগা যায়। আজকাল অবশ্য সে শত্রুও নেই। তা বলে মশা মারতেও ব্যবহার করে কিনা, জানা নেই।
কেল্লার ভিতরে সেই ম্যুজিয়াম। রাজা মহারাজাদের ব্যবহৃত জামা কাপড় থেকে শুরু করে অস্ত্র শস্ত্র। দেখলাম। ঘুরলাম। ভালো লাগল। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগল রাঙিদের মহলগুলি। কী সুন্দর পেইন্টিং দিয়ে সাজানো। রঙের খেলা। আহা, খাসা। হাতিদের হাওদাগুলো খাসা। তেমনি ভালো লেগেছিল প্রচুর পালকি। খুব নিখুঁত কারুকার্য করা। ফুল মহল প্যালেসটি এক কোথায় অসামান্য সুন্দর। কাঁচের ওপর নানান রঙের আঁকিবুঁকি করা। ফুলের মতোই সুন্দর এটি, তাই নাম ফুলমহল। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে অসামান্য স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হতে হতে সাত তলা পার করলাম। কেল্লার ভিতরে কিছু মন্দির রয়েছে। আর রয়েছে ক্রাফট বাজার। অবশ্য করেই বাইরের চেয়ে অনেক বেশী দাম, কিন্তু দেখতে ভারি সুন্দর। হ্যান্ডিক্রাফটস, জামাকাপড় সব মিলিয়ে রঙিন পসরা। কেল্লায় প্রবেশের জন্য বেশ কয়েকটি ফটক আছে। লোহাপোলের ধারেই অনেক হাতের ছাপ। সেগুলি নাকি সতী পালন করতে যাওয়ার আগে রাণীদের হাতের ছাপ। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে এগুলো ভাবলে সত্যি খুব খারাপ লাগে বটে। কিন্তু তখন যেমন যা নিয়ম, সমাজনীতি ছিল।
প্রায় ঘণ্টা দুই পর ভালো করে কেল্লা ঘুরে আমরা এলাম মূল শহরে। আমাদের হোটেলটি একদম ব্যস্ত মেন রোডের ওপর। ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরেরদিন জয়পুর কিভাবে যাওয়া যায়, তার খোঁজ নিতে। ট্রেনে গিয়ে তেমন লাভ নেই। আবার গাড়িতেও অনেকটাই বেশী খরচা। হাঁটতে হাঁটতে কাছাকাছির মধ্যেই একটি ট্রাভেল এজেন্সির কাউন্টার থেকে বাসের টিকিট কাটলাম। আড়াইশো টাকার মত পড়ল জনপ্রতি। পরেরদিন দুপুর আড়াইতে নাগাদ বাস। দুটোর মধ্যে কাউন্টারে পৌঁছে যেতে বলল। কাছেই একটা সাইবার ক্যাফে থেকে প্লেনের টিকিট আর বোর্ডিং পাসের প্রিন্ট নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। ইতিমধ্যে দলের সকলেরই পরেরদিন ট্রেন কত লেট করবে, কী হবে, সেই চিন্তায় নাজেহাল অবস্থা। এখনো যে একটা স্পট ঘোরা বাকি, সেই নিয়ে তেমনভাবে কারুরুই হেলদোল নেই। রাত্রের খাওয়ার পর শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে খোঁজ নিয়ে জানলাম সাইটসিয়িং দুপুরে হবে। লাঞ্চের পর। যেহেতু আমাদের হাতে সময় নেই, তাই আমরা ঠিক করলাম নিজেরাই ঘুরে নেব। বাবার রাত্রে জ্বর আসায় ঘুম ভালো হয়নি, রেস্ট নেবে বলল। মা আমি আর কাকা বেরলাম। ওলা বুক করলাম, এলো না। অটো তে অনেক অনেক দরাদরি করে শেষমেশ একটাকে ঠিক করলাম। গন্তব্য উমেদ ভবন।প্রথমে যদিও ভেবেছিলাম রেস্ট নিয়ে সকালটা কাটিয়ে দেবো, আর কতই বা ওই প্যালেস দেখবো।ভাগ্যিস তা করিনি! ভাগ্যিস ইন্টারনেট ঘেঁটে সত্যি ভালো ভালো রিভিউ পেয়েছিলাম। নইলে যে কী জিনিস মিস হতে চলেছিল, ভাবা যায়না!
উমেদ ভবন প্যালেসটি মহারাজা উমেদ সিংহের তৈরি। এটিতে তিনটি ভাগ। ১। যেখানে রাজপরিবার থাকে। ২। তাজ গ্রুপের লাক্সারি হোটেল। ৩। মিউজিয়াম। প্রথম দুটিতে আমাদের এক্সেস নেই। তাই অমন অপূর্ব স্থাপত্য (ইয়ুরোপীয় ও ভারতীয় স্থাপত্যের সংমিশ্রণ) দেখার জন্য একমাত্র ভরসা মিউজিয়াম। প্রবল খরায় যোধপুরবাসীর অবস্থা যখন নাজেহাল হয়ে যায়, তাদের কর্মসংস্থান করার জন্যই নাকি এই বিলাসবহুল প্রাসাদটি বানানো হয়। উমেদ ভবন শহর থেকে একটু দূরে একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত। পাশেই মিলিটারই এরিয়া, খুব সুন্দর ফুলের গাছে সাজানো রাস্তা জুড়ে। সোনালি আর খয়েরি রঙের মিশ্রণে যে রঙ হয়, সেই রঙের স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরি এই প্রাসাদ। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। প্রথমেই সারি সারি ছবি। বর্তমান রাজপরিবারের সদস্য সদস্যাদের। কিছু পুরনো ছবি, যোধপুরের, রাজপরিবারের। গ্যালারিটির সিলিঙেও দেখার মত কারুকার্য। আধুনিকতা ও প্রাচীনত্বের এক অসামান্য সমাবেশ। বিভিন্ন পোশাক অস্ত্র শস্ত্র তো অনেক দেখেছি। কিন্তু উমেদ ভবনে যেটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল, তা হল রাজা মহারাজাদের ব্যবহৃত দৈনন্দিন প্রয়োজনের নিত্য সামগ্রী। কলম, চিঠির খাম, দোয়াত থেকে শুরু করে চায়ের পিরিচ, সুরাপানের গ্লাস, কাতলারি, আয়না, ঘড়ি, আসবাবপত্র। এক সে বড়কর এক। কত কত বিভিন্ন ডিজাইনের ঘড়ি, আমি তো দেখে পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আর ওই রাজকীয় বাসনপত্র দেখে না মনে হচ্ছিল যে ইশ, সামনের জন্মে যেন এমন রাজপরিবারে জন্মাতে পারি। আহা কি বিলাসিতা। অবশ্য ততদিনে রাজপরিবারগুলির এই বৈভব থাকবে কি না, জানা নেই। স্টাফ করা চিতাবাঘ দেখে চক্ষু চড়ক গাছ! দরবার হলের পেইন্টিংগুলি আমার মত অনভিজ্ঞর কাছেও অসম্ভব মুগ্ধতার উদ্রেক করে। পোল খেলা যোধপুরের মহারাজাদের একচেটিয়া ছিল এক কালে, সেইসব আমলের ট্রফিগুলিও বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। মূল প্যালেসের সামনে কাঁচের ঘরে কত কত ভিন্টেজ গাড়ির প্রদর্শনী। মানে যাকে বলে, total aristocracy। উমেদ ভবনে ঘণ্টা দেড়েকের ওপর কাটিয়ে আবার অটো করে ফিরলাম হোটেলে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে বেরলাম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। বাইপাস রাস্তার ওপর দিয়ে বাস যায়, মূল শহরে তাকে আসতে দেয়না। বাস এলো প্রায় তিনটে নাগাদ। স্লিপার বাস। কী চওড়া সীট। একদম প্লেনের বিজনেস ক্লাসের মতো! দারুণ লেগস্পেস। ঘণ্টা ছয়েকের রাস্তা, আজমের হয়ে জয়পুর। একটুও কষ্ট হয়নি। জয়পুরে আমাদের হোটেলটা ভীষণ ভালো ছিল। অ্যাপ দিয়ে বুক করা। একদম সিন্ধ্রি গেট টারমিনাসের কাছেই। পরদিন সকালে আবার মা কাকা আর আমি পায়ে হেঁটে ঘুরতে বেরলাম। বাবা ব্রেকফাস্ট করে ঘরে রইলো। আমরা তিনজন কাছেই মেট্রো স্টেশন দেখে ঢুকে গেলাম। শেষ ষ্টেশন অবধি গেলাম এলাম। কী ফাঁকা কোচ। আর কী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ঝকঝকে তকতকে। বেশ লাগল। বিকেলের দিকে ক্যাব ডেকে চললাম এয়ারপোর্টের দিকে। আমার এই নিয়ে তেরো নম্বর ফ্লাইট হলেও বাবা মা এবং কাকার জন্য প্রথম প্লেনে চড়া। তাদের জন্য এক্কেবারে অনন্য এক্সপিরিয়েন্স। আমার জন্যও। যাঁদের হাত ধরে হাঁটা শিখলাম, তাদেরকে হাত ধরে প্লেনে চাপা শেখাতে পারা, বিরাট প্রাপ্তি। দু ঘণ্টার প্লেন জার্নি আর তারপর এক ঘণ্টা ক্যাবে চেপে অবশেষে দুই সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরলাম পাঁচ তারিখ।
অসম্ভব ভালো ঘুরেছি বললেও কম বলা হয়। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখতে লিখতে খেয়াল করেছি যে অনেক অনেক কিছু দেখা বাকি রয়ে গেল। অনেক কিছু আরো বেশী সময় ব্যয় করে দেখতে হত। তবে কোন আক্ষেপ নেই। বারবার ফিরে যাবো আমি রাজস্থানে, এইটুকু আমি জানি। আর তাই কোন না কোন দিন ঠিক পুরো ঘুরব। কুম্ভলগড়, রান্থামবোর, নাহারগড়, বিকানের, ভানগড়...কত কিছু বাকি। ধীরেসুস্থে নিশ্চয়ই যাবো। এমন রঙিন রাজ্য, এত আন্তরিকতা, এত আপন...
"রঙ যেন মোর মর্মে লাগে
আমার সকল কর্মে লাগে।" এই আশাতেই শেষ করলাম এবারের মতো আমার চোখে রাজস্থান ভ্রমণের লেখা। সাধারণ ভ্রমণকাহিনী অনেক পড়েছেন। সেখানে এর চেয়ে অনেক বেশী ভালো করে জায়গাগুলির ইতিহাস সম্বন্ধে, ঘুরে বেরানো সম্বন্ধে অনেক তথ্য থাকবে। আমার এই গোটা সিরিজটি লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন সাধারণ ট্যুরিস্ট হিসেবেকী দেখলাম, কী বুঝলাম আর সর্বোপরি কী উপভোগ করলাম, সেইটুকুই নিজের মত করে জানানো। গোটা যাত্রাপথে সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment