Sunday, January 21, 2018

সরস্বতী পুজো

বছর আঠাশের শুভ্রা। বিয়ে হয়ে মান্ডি এসছে সবে ছয় মাস হল। কলকাতায় থাকতে এপারট্মেন্টের সবার একেবারে মধ্যমণি ছিল। সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকত ও। সুষ্ঠু ভাবে তা সম্পন্ন হতো বলে সকলের আদরের ছিল শুভ্রা। সরস্বতী পুজো থেকে শুরু করে দোল, নববর্ষের অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে রবি-নজ্রুল সন্ধ্যা, রথযাত্রা থেকে  বিজয়া সম্মিলনী, ক্রিসমাস থেকে  ন্যু ইয়ার। কোনটাই বাদ পড়ত না। ওর বর অরুণাভ আই আই টি মান্ডিতে  কম্প্যুটার সায়েন্স বিভাগে সদ্য জয়েন করেছে এসিস্টেন্ট প্রোফেসর হিসেবে। সেই সুবাদে শুভ্রাও কলকাতার চাকরি ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পিছু পিছু এসেছে মান্ডি।
পাহাড়ের কোলে, নদীর ধারে ওদের ক্যাম্পাসটি ভীষণ সুন্দর, পিকচার পোস্টকার্ডের মতোই নয়নাভিরাম। প্রথম কয়েক মাস কোয়ার্টার গুছিয়ে, ঘুরে বেরিয়ে আনন্দ করে কাটালেও আজকাল শুভ্রার জীবনে অখন্ড অবসর। সব সময় কাজের মধ্যে থাকতে যে মেয়ে ভালোবাসে, তাকে এখন সারাদিন খালি বাড়িতে বসে সময় কাটাতে হয়। কত আর বই পড়ে গান শুনে সময় কাটবে। রান্নাবান্না করতে মোটেই ভালোবাসেনা। আশেপাশের কোয়ার্টারেও তেমন কারুর সাথে খুব একটা হৃদ্যতা জমাতে পারেনি এখনো অবধি। মোট কথা, নিতান্তই একাকীত্বে কাটছে শুভ্রার দিনগুলি। 
এর মধ্যে হই হই করে এসে গেলো সরস্বতী পুজো। পুজোর মাস খানেক আগে থেকে ওদের কলকাতার এপারট্মেন্টের মেসেজ গ্রুপে চলতে লাগল হাজার একটা প্ল্যানিং। ও প্রথম প্রথম খুব উৎসাহ নিয়ে সেই সব আলোচনায় ভিড় করত বটে। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই একদিন কী মনে হতে সব ছেড়েছুড়ে দিল শুভ্রা। সেখানে না থাকতে পারায় বড্ড কষ্ট হচ্ছিল কি না। বউয়ের এই মন খারাপটা  অরুণাভর হঠাৎএকদিন চোখে পড়ল। ভাগ্যিস! নইলে অমন স্কলার ছেলে, মোটামুটি আর বাকি সময়ে জগত সংসার সম্বন্ধে এক্কেবারে ভ্রুক্ষেপহীন। "কী হয়েছে, কেন এমন মন খারাপ, মুখ গোমড়া করে আছে কেন", এসব প্রশ্ন করতে লাগল। শুভ্রাও খুব একটা চাপা মেয়ে না। সে গড়্গড় করে বলল তার বর কে।
"ও এই ব্যাপার? দাঁড়াও, কিছু একটা করতে হবে। আমায় দুদিন সময় দাও।" এই বলে অরুণাভ সেদিন ক্লাস নিতে চলে গেলো। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরল সঙ্গে ওর কিছু কলিগদের নিয়ে। মান্ডি ক্যাম্পাসে জনা সাতেক বাঙালি ফ্যাকাল্টি পরিবার। সেই সব বাঙালি ফ্যাকাল্টিদের সাথে শুভ্রার অল্প বিস্তর আলাপ ছিল। তাদেরকে নিজের কোয়ার্টারে দেখে একটু অবাক হল বটে। হঠাৎ কী দরকারে, কেন সবাই হাজির ভাবতে ভাবতে অরুণাভই ওর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল, " এই নাও। এবার সবাই মিলে প্ল্যান করে একটা সরস্বতী পুজো নামাও তো" এই বলে। 
" আরে এটা তো দারুণ বলেছো অরুণাভ।" শুভ্রার মন আনন্দে নেচে উঠল। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও, কোন একটা ব্যাপারে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারবে, এই আনন্দে প্রায় সব দায়িত্বই ও নিতে রাজী হয়ে গেল। 
কিন্তু পুজো যে হবে, কোথায় হবে? ঠাকুর কোথায় পাবে? কে করবে? এইসব নানান প্রশ্নের উত্তর পেতে শুভ্রা পরেরদিনই একটা ছোট মিটিং ডাকল নিজের বাড়িতে। ক্যাম্পাসের সব বাঙ্গালিরা এলো। চা সামোসা সহযোগে চলল আলোচনা। ঠিক হল, অম্লান দা, অর্থাৎ কেমিস্ট্রির অম্লান ব্যানারজীদা পুজো করবেন। কলেজে থাকাকালীন করার অভিজ্ঞতা আছে। এইবারে আর মূর্তি আনানোর বা বানানোর সময় নেই, তাই ছবি প্রিন্ট করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘটে পুজো হবে। শুভ্রাদের বাড়িতেই হবে। কী কী জিনিস লাগবে, কোথা থেকে তা জোগাড় করা যাবে, এইসবের ফর্দ করতে হবে। শুভ্রার বেশ মজা লাগছে। এতদিনে মনে হচ্ছে যেন আবার নিজের এপারট্মেন্টের দিনগুলিতে ফিরে গিয়েছে। মায়ের থেকে ওর পুরনো ফাইল ঘেঁটে পুজোর ফর্দর ছবি ওয়াটসআপে নিয়েছে। এক এক করে কোথায় পাওয়া যেতে আপ্রে, তার হদিস চলছে। 
ওর খুব ইচ্ছে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হোক সন্ধ্যেবেলা। লোকবল তেমন নেই। তাই চাইলেও নাটক বা গীতিনাট্য করা যাবেনা। কোন চিন্তা নেই। রমেনদার স্ত্রী, মালবিকা বৌদি খুব ভালো নাচ করেন। ঠিক হল, উনিই বাকি আর তিনজনকে ঘষে মেজে নাচ তুলিয়ে দেবেন। সাথে গান গাইবে শুভ্রা। শুভ্রাকে গানে সঙ্গত করবে তবলায় অরুণাভ। পি এইচ ডি করার সময়ে শেষ তবলা বাজিয়েছিল ও, আজ কিছু বছর পর আবার সেই সুযোগ আসছে দেখে ও সমান ভাবে উত্তেজিত।  আজকাল শুভ্রার মধ্যে একটা বেশ খুশি খুশি ভাব দেখে অরুণাভ। দেখেও ভালো লাগে। সত্যি তো, চাকুরিরতা মেয়েকে এমন ঘরবন্দী করে রাখলে কাহাতক আর ওর ভালো লাগে? এই ইনিশিয়েটিভটাকে জিইয়ে রাখতে পারলে ভালো হয়। 
দেখতে দেখতে বসন্ত পঞ্চমী এসে গেল। ভোর থেকে, আলো ফোটার আগে থেকেই অরুণাভ টের পেল শুভ্রা উঠে পড়েছে। স্নান সেরে ঠাকুর রাখার জায়গাটা ধুয়ে মুছে তৈরি করছে। ছটা বাজতে না বাজতে একে একে কলিং বেল বাজতে লাগল। হৈমন্তী দি, মালবিকা বৌদি, রিনি, মহুয়াদি, সব এসে পড়তে লাগল। এরপর একে একে দল বেঁধে শুরু হল পুজোর তোড়জোড়। কেউ আল্পনা দিচ্ছে, কেউ ফল কাটছে। তো অন্যদিকে আবার কেউ ঠাকুর সাজাচ্ছে। পুরুষেরাও মেতে উঠেছে পুজোর কাজে। প্ররবাসে হলেও উৎসাহ বা চেষ্টার কোনরকম ত্রুটি রাখেনি ওরা। রমেনদা আবার পটাপট লেন্সবন্দী করে চলেছেন  এই মুহূর্তগুলি।  
এই খানিক্ষনের মধ্যেই ঘর ভরে যাবে ধূপকাঠির সৌরভে, কর্পূরের গন্ধে তৈরি হবে একটা পুজো পুজো আবহাওয়া। আর সাথে থাকবে দৃপ্ত কণ্ঠস্বরে
"জয় জয় দেবী চরাচর সারে
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।"  যা পৌঁছে দেবে এক লহমায় অনেকগুলো বছর আগের এমনই কোন  বসন্ত পঞ্চমীর দিনে। ফিরে আসবে কত মিষ্টি মধুর স্মৃতি। 


No comments:

Post a Comment