Friday, January 19, 2018

তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন

তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন

১।

টিফিন ব্রেকের সময় ভয়ে ভয়ে ক্লাসরুমে ঢুকেছে আজ শ্রেয়ান। এত বছর বয়েজ স্কুলে পড়ার পর এই প্রথম কোএডে। তার ওপর আবার কলেজের প্রথম দিন। মেধাবী ছেলে শ্রেয়ান উচ্চ মাধ্যমিকে চমকপ্রদ রেজাল্ট করে বর্ধমান জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতার অন্যতম নামী কলেজে ফিজিক্স নিয়ে পড়তে এসেছে। হোস্টেলে থাকতে হবে। আজ সকালেই বাবা কলেজ গেটে পৌঁছে বাড়ি চলে গিয়েছেন। এত বড় কলকাতা শহরে ও সম্পূর্ণ একা। কাউকে চেনেনা। শুনেছে কলেজে, হোস্টেলে ভালো মতই র‍্যাগিং হয়। বুক ঢিপ ঢিপ করছে ওর।
শতাব্দীপ্রাচীন কলেজের বড় ক্লাসরুমটাতে বাইরের আলো তেমন নেই, দিনেরবেলাও টিউবলাইট জ্বলছে। ঢুকে দেখল ওদের ক্লাসের বাকি ছেলেমেয়েরা দুটো বেঞ্চ জুড়ে জটলা পাকিয়ে বসে আছে। ওর আর জায়গা হবেনা ওখানে বলে পিছনের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল শ্রেয়ান। টিচার্স প্ল্যাটফর্মের ওখানে জনা দশেক সিনিয়র দাদা দিদিরা দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকজন টেবিলে চেয়ারে বসে।
" এই শোন, কলেজের প্রথম দিন এসছিস, সিনিয়রদের সম্মান জানাতে হয়, জানিস না? এলি আর বসে পড়লি? গুড আফটারনুন উইশ কে করবে?"
শ্রেয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল সিনিয়র "দিদি", পরনে সাদার ওপর হলুদ ফুল ছাপ কুর্তি আর নীল জিন্স, গোড়ালি অবধি গিয়ে শেষ হয়েছে। মাথায় এক ঢাল কালো চুল, কয়েকটা আবার বার বার কপালের উপর পড়ছিল বলে মাঝে মাঝেই হাত চলে যাচ্ছিল চুল ঠিক করতে। কানে একজোড়া বড় ঝুমকো দুল। ঠোঁটের ওপর ছোট্ট তিল মুখশ্রীতে আলাদা মাধুর্য এনেছে, শ্রেয়ানের শিল্পী মনে ভাবনা এলো।
" গুড আফটারনুন দিদি।" উঠে দাঁড়িয়ে বলল ও।
" দিদি আবার কী? বলবি মধুরা। নাম কী তোর? "
" শ্রেয়ান। ঠিক আছে দিদি। এই সরি, মধুরা।"
" আতাক্যালানে। যা বোস।"


২।

মাস দুই হয়ে গিয়েছে কলেজের। এখনো শ্রেয়ানের ক্লাসে তেমন বেশী বন্ধু হয়নি। মুখচোরা ছেলে ও। রুমমেটের সাথে ছাড়া আর দু তিনজন ছেলের সাথে যা একটু কথাবার্তা হয় ওর। ক্লাস আর লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সময় পেলে চলতে থাকে আঁকাঝোঁকা। আজ লাঞ্চের পরে ক্লাসটা ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ায় লাইব্রেরির দিকে হাঁটা লাগিয়েছিল ও। কেমিস্ট্রি বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যাচ্ছে যখন, দেখল, উল্টোদিক থেকে আসছে মধুরা। আজ ওর পরনে লাল নীল জংলাছাপ গোড়ালি ঝুলের ড্রেস। ওকে দেখেই, " কী রে কেমন আছিস?" বলে হাল্কা হাসল মধুরা।
" ভালো আছি দি।"
"আবার দি? কোথায় যাচ্ছিস এখন? ক্লাস নেই?"
" না দি। আজ এম বি স্যার ক্লাস নেবেন না বলেছেন। তাই ভাবলাম একটু লাইব্রেরিতে বসি গিয়ে।"
" ওরে হাঁদারাম, এটা স্কুল না যে সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকতে হবে। ক্লাস নেই তো মজা করে ঘুরে বেরা!"
" আসলে আমি তেমন কিছুই চিনিনা। কোথায় যাবো? "
" ওরে নিজেকে চিনে নিতে হয়। "
" হুম। ঠিক আছে দি।"
" শোন কাল আমাদের এনভাইরনমেন্টালের ক্লাসটা আমি বাঙ্ক করছি। বারোটায়। তোদের তো ওই সময় বাংলা থাকে। কাউকে বলিস প্রক্সি দিতে। আমার সাথে দেখা করবি মেন গেটে। তোকে নিয়ে যাবো এক জায়গায়। "
" কোথায় দি?"
" কাল দেখতে পাবি। "
ভ্যাবলা হয়ে মধুরার চলে যাওয়া হাঁ করে দেখতে লাগল শ্রেয়ান।

৩।

বারোটা বেজে পনেরো। মধুরার দেখা নেই। শ্রেয়ান কিন্তু কিছুটা কৌতূহলবশত আর কিছুটা ভয়ে ভয়ে (এখনো সিনিয়রদের প্রতি ভীতিটা কাটেনি ওর) অপেক্ষা করে আছে গেটে। চলে গেলে পাছে পরে দেখা হয়ে বকা খায়, এই ভেবে যেতেও পারছেনা। কাউকে প্রক্সি দিতে বলতেই পারেনি ও। মিছিমিছি একটা এটেন্ডেন্স নষ্ট হল। এইসব ভাবতে ভাবতে ফোনে খুঁটখুঁট করছিল শ্রেয়ান।
" সরি, একটু দেরি হয়ে গেল। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস কি?"
মুখ তুলে মধুরাকে দেখতে পেল।
" ওই আর কী। আগের ক্লাসটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। তখন থেকেই আছি।"
" আসলে আমার আগের ক্লাসটা এস এমের ছিল। বুড়িটা এক্সট্রা টাইম নিলো। তাই দেরি হল। এদিকে তোর নম্বরটাও জানিনা যে এস এম এস করে দেবো। ঝটপট তোর নম্বরটা দে তো।"
" ৯৪৩৩......"
" মিসড কল দিয়ে দিচ্ছি।"
বলতে বলতেই শ্রেয়ানের ফোনে রিং হল, অচেনা নম্বর থেকে। দুটো রিং হতেই কেটে দিল মধুরা।
" নে সেভ করে রাখ।"
" হ্যাঁ, করছি।" "মধুরা দি" লিখে সেভ করল নম্বরটা শ্রেয়ান।
" আজ ওয়েদার ভালো নেই। যে কোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। তাই যেখানে প্ল্যান করেছিলাম, যাওয়া যাবেনা। তার চেয়ে বরং চল কোথাও খেতে যাই।"
" কোথায় যাবে?"
" পার্ক স্ট্রিট চল।"

" কী হল? অমন ভ্যাবলাকান্তর মতো মুখ করে আছিস কেন রে? পার্ক স্ট্রিট গেছিস কখনো?"
" না, মানে শুনেছি দামী জায়গা খুব..."
" ধুর ধুর। আজকে আমার ট্রিট। তোদের ইন্ট্রো নেওয়ার দিন হেবি চেটেছিলাম তোকে। তারপরে ফ্রেশারসে আসিনি আমি। ট্রিটটা পেন্ডিং আছে। বন্ধুত্ত্ব অটুট করতে হবেনা?"
মধুরার মিষ্টি হাসি দেখে আর কথা বাড়ালো না শ্রেয়ান।


৪।

"শুভ মহালয়া দিদি।" শ্রেয়ানের এস এম এস ঢুকল মধুরার ফোনে। খেয়াল পড়ল, তাই তো। আজ থেকে টানা দেড় মাস কলেজ ছুটি। দেড় মাস শ্রেয়ানকে দেখতে পাবেনা। ও ফিরে যাচ্ছে জল্পাইগুড়ি  নিজের বাড়ি পুজোয়, শ্রেয়ানও বর্ধমান। একটু যেন তেতো লাগল কফিটা। উফ, এই পিজির রান্নার মাসিটা না। এক্কেবারে যাচ্ছেতাই।
প্রায় প্রতিদিন কলেজের পরে শ্রেয়ান আর ও হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত অনেকটা দূর। একেকদিন একেক দিকে। সারাদিনের লেখাপড়ার কথা, বাড়ির কথা, শ্রেয়ানের রবীন্দ্রনাথ চর্চা আর ওর গ্রিন ডের চর্চা। মাঝে কোথাও দাঁড়িয়ে ভাঁড়ের চা। অসমবয়সী হলেও কোথাও যেন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত শ্রেয়ানের জন্য মধুরা। সহজ সরল ছেলেটার সাথে কথা বললে আরাম লাগে, মন ভালো থাকে।  আবার একটা রুটিন ব্রেক হবে। একদম ভালো লাগেনা মধুরার।
" হুম, ভালো করে পুজো এঞ্জয় করে ফের।" ছোট্ট জবাব দিয়ে বিছানা ছাড়ল মধুরা। বিস্বাদ কফিটা ছুড়ে ফেলল বেসিনে। ওকে তো আবার ব্যাগ গোছাতে হবে। রাত্রের ট্রেন।

৫।

হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছে শ্রেয়ান। তিন মাস পর বাড়ি যাচ্ছে। মাঝে অবশ্য কয়েকবার বাবা এসে দেখা করে গিয়েছেন। তবে মা আর ঠাকুমার সাথে দেখা হয়নি এতদিন। ভিডিয়ো কলে দেখেছে বটে, কিন্তু স্পর্শ অনুভব করতে পারেনি। যেদিন প্রথম কলকাতা আসে, সেদিন থেকে দিন গুনতে থেকেছে শ্রেয়ান, কবে বাড়ি যাবে পুজোর ছুটিতে। ভেবেছিল বুঝি খুব আনন্দ হবে। কিন্তু আজ কেমন একটা মন খারাপ গ্রাস করে আসছে ওকে। একেই বাইরে মেঘলা, অন্ধকার হয়ে আছে। বৃষ্টি একদম ভালোবাসেনা শ্রেয়ান। তার ওপর কলেজ, হোস্টেল, মধুরাদিকে ছেড়ে দেড় মাস থাকার কষ্ট, কিচ্ছু ভালো লাগছেনা ওর। এই কয়েক মাসে যেন ভালোবেসে ফেলেছে ও কলকাতা শহরটাকে, আর তার সিংহভাগ কৃতিত্ব মধুরার। ওকে সাথে নিয়ে গোটা শহরটা ঘুরে বেরিয়েছে। ষ্টেশনে ট্রেন ঢুকতেই কামরায় উঠে জানলার ধারে সীট নিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে বসল শ্রেয়ান।
"I walk the empty streets
On the boulevard of broken dreams" গ্রীন ডে চলতে লাগল একের পর এক।

৬।

দেড় মাস বাদে জগদ্ধাত্রী পুজোর পরে আজ কলেজ খুলেছে ওদের। দুটোয় ল্যাব আর ক্লাস শেষ করে দুজনের আজ গঙ্গার ঘাট যাওয়ার কথা। কথামতো কলেজ গেটে দেখা করল ওরা। ফেলে যাওয়া শরতের মিঠে  রোদে আজ বড় মন জুড়ানো আরামদায়ক। কদিনের প্যাচপ্যাচে বৃষ্টির পর আকাশ আজ রৌদ্রজ্জ্বল। মধুরার পরনে একটা হাল্কা বেগুনি রঙের চিকন কাজ করা শাড়ি। লম্বা চুলটাকে অযত্নে হাতখোঁপায় আটকে রেখেছে, কানে ছোট্ট দুল। দুই চোখে কাজলের ঔজ্জ্বল্য। শ্রেয়ানকেও বড় ঝকঝকে লাগছে আজ লাল পাঞ্জাবিতে।
" চল, গঙ্গার ঘাটে যাই। নৌকোতে চড়ে ঘুরব।"
" চলো!"
গঙ্গার বুকে নৌকোবিহার চলল ওদের অনেকক্ষণ। আজ শ্রেয়ান ওর ক্যামেরাটা নিয়ে এসছিল। পুজোয় বাড়ি গিয়ে বাবার থেকে পাওয়া গিফট। সবে শেখা শুরু করেছে। গোটা সময়টা জুড়েই লেন্স তাক করে রেখেছিল মধুরার দিকেই।
" এই, কী তখন থেকে শুধু ছবিই তুলে যাচ্ছিস?"
" তোমায় আজ খুব সুন্দর লাগছে মধুরাদি।"
" বলছিস?"
" হুম।"
" আমি ওই ন্যাকা মেয়েদের মতো বলব না যে কই কিছুই তো সাজিনি। না, আজ সত্যিই আমি সেজেছি। ভালো লাগছে বললি সেটাও এঞ্জয় করলাম। থ্যাঙ্ক ইয়ু!"
" একটা কথা বলব?"
" কী বল?"
" অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম বলব..."
"ভালোবাসিস আমায়?"

"কী হল, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলি?"
" না মানে..."
" ও, ভালোবাসিস না?"
" না না। তা না। অবশ্যই বাসি।"
" তাহলে?"
" না মানে তুমিও?"
" কী মনে হয়?"
" কে জানে। জানলে তো এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেতাম না।"
" পাগল কোথাকার!" হেসে শ্রেয়ানের মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে ঘেঁটে দিল মধুরা।

"চল, ফেরা যাক। তোর তো পড়ার টাইম নষ্ট হচ্ছে।"
" হ্যাঁ, তা বটে। কাল ল্যাব নোটবুক জমা দিতে হবে। আজ স্পেক্ট্রোর এক্সপেরিমেন্টটা শেষ করেছি।"
" উফ। চল।"
" পৌঁছে একটা ফোন করো।"
" হুম।"



ঘন্টাখানেক পরে শ্রেয়ান ওর হোস্টেলের ঘরে বসে পড়ছে। বা বলা চলে, পড়ার চেষ্টা করছে। সারাদিনের ঘটনার আকস্মিকতার ঘোর এখনো কাটেনি। এমন সময়ে ফোনে বেজে উঠল, " তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা। তুমি আমার সাধের সাধনা।" স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল সদ্য এডিট করা নাম।
"Madhura calling"।



No comments:

Post a Comment