আলো ফোটেনি, এমন অবস্থাতেই আমরা জয়পুর থেকে রওনা দিলাম পুষ্করের উদ্দেশ্যে। ঘুম ঘুম চোখে জানলার ধারে চাদর দিয়ে মাথা ঢেকেঢুকে, যা ঠাণ্ডা। কানে চলছে গান, চোখে রাত্রের কোটার বাকি ঘুম। বাস চলছে মেওয়ারের রাস্তা বেয়ে। এগারোটার দিকে জানলার বাইরে দিয়ে উট চোখে পড়তে লাগল। কিছু এমনিই বুনো উট, কিছু পোশ্য, সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। বুঝলাম, পুষ্কর পৌঁছলাম। আসলে পুষ্কর মানেই জানি ক্যামেল ফেয়ার। কার্ত্তিক মাসের পূর্ণিমা অবধি চলে, প্রতি বছর। তখন সাড়া দেশ থেকে, এমন কি বিদেশ থেকেও লোকজন ভিড় করে এই পুষ্করে। ছবি তোলার জন্য এক্কেবারে পারফেক্ট। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছবি দেখেই পুষ্করের সাথে আমার পরিচয়। তবে এছাড়াও পুষ্করে যে দেখার মধ্যে হ্রদ আর মন্দির আছে, সেই বিষয়ে আমার তেমন ধারণা ছিলনা। ট্রাভেল এজেন্সির আইটিনারি দেখে তবে জেনেছি।
প্রত্যেকবার কোথাও বেড়াতে গেলে আগে সেই জায়গার ওপর বেশ অনেক পড়াশোনা করে যাওয়ার চেষ্টা করি। দুর্ভাগ্যবশত এই ট্রিপে তা করতে পারিনি। এক তো সময়ের অভাব ছিল। দুই, ভেবেছিলাম আশা করে থাকব, এই দেখবো, সেই দেখবো, অথচ তারপরে ট্রাভেল এজেন্সি বলে আদ্ধেক জিনিসই বাদের তালিকায় চলে যাবে, তখন মন খারাপ হবে। তাই প্রতিদিন রাত্রে পরেরদিনের জায়গাটি সম্বন্ধে নেটে অল্প করে পড়ে রাখতাম। সেইরকমই জেনেছিলাম, পুষ্করের হ্রদ নাকি বিখ্যাত পুণ্যস্থান। ওই হ্রদের জলের বুঝি ঔষধি গুণ আছে। সেই জল স্পর্শ করলে মানুষের চর্মরোগ সেরে যায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তও থেকে তাই লোকেরা এই হ্রদে আসে, পুণ্যস্নান করতে। কাছেই ব্রহ্মার মন্দির। সারা পৃথিবীতে নাকি আর কোথাও ব্রহ্মার মন্দির নেই।
পারকিং লটে বাস থেকে নেমে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হল। শুরুতে বালি বালি রাস্তাঘাট। উটেরা সারি দিয়ে বসে আছে। কোন কোন গুলোর দিকে তাকিয়ে মায়া হল। কিছু উটমালিক আমাদের ধরাধরি করতে লাগলেন, ক্যামেল সাফারির জন্য। প্রত্যেককেই মানা করে দিলাম। জয়সালমেরে এমনিই আমাদের প্রোগ্রামে ঠিক করা আছে ক্যামেল সাফারি। হেঁটে যখন মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি, তখন শুনলাম যে আর জুতো পরে যাওয়া যাবেনা। মন্দিরে জুতো চল্বেনা, সেটা যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি অদ্ভুত লাগল যে তা বলে এত আগে থেকে কেন জুতো ছাড়তে হবে। জুতো রাখার জন্য দোকানগুলো জোরাজুরি করছিল। জুতো রাখতে দেওয়া যাবে যদি পুজোর ডালা ওদের থেকে কেনা হয়। আমি খুব বেশী মন্দির দর্শনে উৎসাহী থাকিনা সচরাচর। তা ছাড়া সেখানে যদি শুনি এরকম খুব ভিড়, তাহলে তো কথাই নেই। বাইরে থেকে, দূর থেকে নমস্কার করে চলে আসব। আমার বাবা আর কাকাও ওরকম। আমরা তিনজন মন্দির গেলাম না। মা গেলো বাকিদের সাথে। ইতিমধ্যে আমরা তিনজন হাঁটা লাগালাম হ্রদের দিকে। রাস্তা জুড়ে দুইদিকে দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। কত রঙ, কত হস্তশিল্প। দাঁড়িয়ে দেখে মুগ্ধ হতে হয়। কোথাও উটের প্রতিকৃতি তো কোথাও হাতি। কাঁচের কাজ করা ব্যাগ। মাটির ওপর নানান রঙের কাজের ওয়াল হ্যানগিং। কাপড়ের পুতুল। শাড়ি। জামা। সব মিলিয়ে জমজমাট। একটু দরদাম করলাম পছন্দের জিনিসের। কিন্তু মা সাথে না থাকায় সাহস করে কিনলাম না। হ্রদে পৌঁছে দেখি মোটামুটি ভিড়। লোকজন ঘাটে বসে পুজো করছেন, স্নান করছেন। কিন্তু জলের যা অবস্থা দেখলাম, মনে হল যে এই জলে স্নান করলে চর্মরোগ তো সারবেই না, উল্টে নতুন করে হয়ে যাবে। পুষ্করিণীর জলের সংস্করণ চলছে শুনলাম, কী জানি, কিছু তো বুঝলাম না। এমনি বেশ সুন্দর, অনেকটা বড়, হ্রদ। চারপাশে পাহাড় ঘেরা। দেখতে ভালো। কিন্তু ঘাট বড্ড পিছল। খানিকক্ষণ ঘাটে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে মায়েরা এলো। পুজোর প্রসাদ মুখে দিয়ে তারপরে ফেরত চললাম বাসের দিকে। পথে দোকানগুলোতে ঢুঁ মেরে চলল অল্পবিস্তর কেনাকাটি। সাবিত্রী মাতার মন্দির অনেক উঁচুতে থাকায় কেউই যায়নি।
পুষ্কর হয়ে তারপরে বাস চলল আজমেরের পথে। আজমের শহরটি তো আজমের শরিফ দরগার জন্য বিশ্ববিখ্যাত। পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে মানুষ আসেন, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা মাথা ঠেকায়, চাদর চড়ায় এখানে। পথে চোখে পড়ল বিশাল আনা সাগর লেকের। হোটেলে পৌঁছে স্নান সেরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোনোর কথা দরগায়। দুপুরের খাবার রেডি হতে দেরি হছহিল বলে পাশেই থাকা একটু মিষ্টির দোকান থেকে গরম গরম গোলাপ জাম মিষ্টি খেলাম। আহ, কী অপূর্ব সে স্বাদ। ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি। রাজস্থান জুড়ে নানান জায়গায় বেশ সুন্দর সুন্দর সুস্বাদু অনেক মিষ্টি খেয়েছি। কিন্তু ক্যালোরি কনশাস হলেই শেষ!
দরগা অঞ্চলে খুব ভিড় হয়, আর তার সাথে সাথে নাকি পকেটমারির খুব প্রকোপ। তাই ম্যানেজার কাকু বললেন ক্যামেরা বা ফোন সাথে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। (যদিও ওইদিন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফোন আসার কথা ছিল আমার, তাই আমি ফোন নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আর তাই অল্প হলেও কয়েকটা ছবি তুলেছি।) আর টাকাও খুব কম রাখতে। এই একটা আফসোস আমার রয়ে গেল। দরগার সামনের রাস্তা জুড়ে যে বাজার বসে, সেখানে এত অভাবনীয় কম দামে এত বিচিত্র পসরা, ভাবা যায় না। কি সস্তা কি সস্তা! সাথে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না বলে বড় মিস করলাম এই শপিঙের চান্স।
দরগায় আমরা চাদর চড়াইনি। শুধু ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলাম। দরগাটি বেশ একটা বড় কম্পাউন্ডের মধ্যে। অনেকগুলি সাদা মার্বেলের বিল্ডিং। একটি মসজিদ রয়েছে। গেটে উর্দুতে ঈশ্বরচেতনার (ঈশ্বর কি বলা চলবে? জানিনা) বাণী লিপিবদ্ধ। খাদিম যিনি ছিলেন ভিতরে, এত দরদ দিয়ে আন্তরিকভাবে দুয়া পড়লেন আমাদের জন্য, মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি এসে গেল। সেই সম্রাট আকবরের আমল থেকে শুরু করে আজও লোকের ঢল নামে এখানে। এতটাই জাগ্রত এই দরগা। এখানে মাথা ঠেকাতে পেরে ভালো লেগেছিল খুব।
দরগার পর আমরা যাই আনা সাগর লেকে। পৃথ্বীরাজ চৌহানের ঠাকুরদার তৈরি করা এই লেক। তেরো কিলোমিটার লম্বা এই লেক। শহরের জলের কষ্ট নিবারণ করতেই বানানো এটি। বিশাল জায়গা জুড়ে, পাশে সুন্দর পার্ক বানিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। মোঘল সম্রাট শাহ জাহান ও জাহাঙ্গীরের তৈরি এই ধারের বারাদারি আর ঘট। যতক্ষণে আমরা আনা সাগরে পৌঁছই, সূর্যাস্তের সময় এসে গিয়েছে। দিগন্তবিস্তৃত আকাশ তখন লালের ছটায় রঙিন। তার ব্যাকড্রপে দেখছি দিনের শেষে সমস্ত পাখিরা ঘরে ফিরছে। সে এক মায়াবী দৃশ্য।
আমাদেরও এদিনের মত এবার ঘরে ফেরার পালা। আগামীকাল উদয়পুর যাবো। চিতোরগড় হয়ে। রাণী পদ্মিনীর গল্প শুনে বড় হওয়া। পদ্মাবতী সিনেমার ট্রেলার গান শুনে সেই উৎসাহ আরো বেড়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে, মন উসখুস। কতক্ষণে পৌছব চিতোর।
No comments:
Post a Comment