রাত্রে ডিনার টেবিলে বসে সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করা হল যে পরেরদিন সকাল সকাল তাজ মহল দেখতে যাওয়া হবে। তাজ দর্শন করে তবেই জয়পুরের উদ্দেশ্যে বেরোনো হবে। প্রথমে ঠিক ছিল ফতেহপুর সিক্রিও যাওয়া হবে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই পরিকল্পনা মুলতুবি রাখতে হল।
পঁচিশে ডিসেম্বর, সাংঘাতিক ভিড় হবে। এমনি দিনেই গড়ে এক দেড় ঘণ্টার লাইন পড়ে তাজ মহলে ঢুকতে, তাই সক্কাল সক্কাল ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা চারজন একটা অটো ধরে পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে। তখন সবে টিকিট কাউন্টারে লাইন পড়ব পড়ব করছে। পাঁচ মিনিটে টিকিট হাতে নিয়ে মূল গেটে চলে এলাম। এসে দেখি ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা লাইন। এবং সেই লাইন বিশাল লম্বা। তাজ মহল খুলে যায় ভোর ছটা নাগাদ। আমরা প্রায় সাড়ে আটটা নটা নাগাদ লাইনে ঢুকলাম। মেয়েদের লাইনে ঘণ্টা দেড়েক লেগেছিল মায়ের আর আমার। সিকিউরিটি চেকিং বেশ কড়া (মানে অনেকটা ওই এয়ারপোর্টের মতোই)। কিছু নিষিদ্ধ জিনিস আছে যেমন ছুরি কাঁচি ইত্যাদি। জল নিয়ে যাওয়া যায়। তবে কোনরকম কস্মেটিক, খাবার কিছু এলাউড না। তাজের খয়েরি রঙের মূল এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকে একটা বিরাট কম্পাউন্ডে এসে পড়লাম। শুরু হয়ে গেল আমার ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। বাবাকে ফোন করে জানা গেল ওদের লাইনটা অনেক লম্বা হওয়ায় ওদের ভিতরে আসতে অন্তত আরো ঘন্টাখানেক লাগবেই। মা কে বললাম, "সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চলো আমরা ঘুরতে থাকি। ছবি তোলার সময় পেয়ে যাবো। চলো।"
এই বলে তাজ মহলের দিকে এগোলাম। একটা গেটের সামনে দেখি খুব ভিড়। কারণটা খুব শিগগিরি বুঝে গেলাম। ওখান থেকেই যে প্রথম দর্শন পাওয়া যাচ্ছে দুনিয়ার সাত আশ্চর্যের আশ্চর্যটির। কেদারনাথ যাওয়ার পথে একটা জায়গা আছে, দেওদিখানি। সেখান থেকে প্রথম মন্দিরের চূড়া দেখা যায়। তেমনি এই জায়গাটা যেন তাজদিখানি। তাজের সাথে শুভদৃষ্টিটা মানুষ এখান থেকেই সারছেন। আর তাই আরো বেশী ভিড়। ফটক টপকে যখন বইয়ের পাতায় দেখা আমাদের চিরপরিচিত তাজ মহল প্রথম দেখলাম, একেবারে পূর্ণ অবয়বে, ওই শ্বেত মার্বেলের বিশালাকৃতি দেখে অল্পক্ষণের জন্য হলেও থমকে গিয়েছিলাম। আর তার পরেই যেন ঘটনা ও পরিস্থিতির বাস্তবতা আমায় ধাক্কা দিয়ে ঘোরের মধ্যে থেকে বের করল। আরে, ছবি তুলতে হবে তো। খচ খচ করে একটার পর একটা ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। জুম লেন্সের ব্যাগটা বাবার হাতে, তাই কেরামতি মেরে দূর থেকে ভিড় টপকে একটাও ছবি এলোনা। আদ্ধেকের বেশী ছবিতেই পিলপিল করছে লোক। জন অরণ্য যাকে বলে। মোটামুটি জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে পোজ দিতে দিতে ও দেওয়াতে দেওয়াতে ছবি তুলে ও তুলিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম মূল মউসোলিয়ামে। দু চোখ ভরে অবাক চোখে দেখে যেতে লাগলাম মার্বেলের ওপর নয়নাভিরাম কারুকার্য। এত শত বছর আগের তৈরি, কী সাঙ্ঘাতিক প্রতিভাবান শিল্পীরা বানিয়েছিলেন এটিকে, আজ এতগুলো বছর পরেও সমানভাবে আমাদের আকর্ষণ করছে তাজ মহল। বাহ তাজ বলি আমরা সব সময়, আমার তো মনে হয়, প্রতিটি শিল্পীর নাম নিয়ে নিয়ে বাহ বললে হয়ত তাদের কাজের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হবে। ঐতিহাসিক কারণের চেয়েও বেশী, তাজ মহল আমার ভালো লেগেছে শৈল্পিক কারণে।
পরিবেশ দূষণের কারণে, তাজ মহলের আগের জৌলুস নাকি আর নেই। কী জানি বাবা, আমি তো এই প্রথম দেখলাম, ওই দুধ সাদা মনুমেন্টটি দেখে আমি হাঁ! আর এই দূষণের থেকে তাজ মহলকে বাঁচাতে এখন ভিতরে জুতো পরে যেতে দেয়না। জুতো পড়লেও তার ওপর পলিথিনের এক ধরণের আস্তরন লাগিয়ে ঢুকতে হয়। দশটাকা দিয়ে আমরা প্রত্যেকের জন্য এক এক জোড়া কিনে রেখেছিলাম আগেরদিনই। তাজ মহলের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য দেখলাম আরেকপ্রস্থ বিশাল লাইন। আমাদের হাতে সময় কম। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে বেরোতে হবে জয়পুরের উদ্দেশ্যে। জীবনে একবারে সব কিছু পাওয়া হয় না, এরকম একটা দার্শনিক মনোভাব নিয়েই মা আর আমি ঠিক করলাম যে থাক, আর ভিতরে ঢুকে কাজ নেই। এমনিও শাহ জাহান মুমতাজের আসল সমাধি মোটেই দেখাবেনা, আর কারুকার্য, সে তো বাইরে থেকেই ভালোই দেখতে পাচ্ছি। মোটেই বিরাট আর্ট ক্রিটিক নই আমরা যে একদম ডিটেলে না দেখলে জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং তাজের চার পাশটা প্রায় প্রদক্ষিণ করার মতো করেই হাঁটলাম। পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে যমুনা নদী, জল কম। কুয়াশাচ্ছন্ন। একটু ফাঁকা দেখে তাজের দেওয়ালে হাত দিলাম, স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করলাম এই বিশাল কীর্তিটিকে, বিশ্বজুড়ে যা এত বিখ্যাত করেছে আমার দেশকে। সাধারণ ভাবে ভাবলে হয়তো অন্য কোন শ্বেত পাথরের স্তম্ভ ছুঁয়ে দেখলেও একই অনুভূতি হত, কিন্তু ব্যাপারটা যেখানে তাজ মহল, যা চাক্ষুস দেখব বলে এই কদিন ধরে তিল তিল করে উত্তেজনার পাহাড় জমিয়েছি মনে, তাই সেই হিমশীতল স্পর্শও দিব্যি লাগল।
ইতিমধ্যে বাবা আর কাকাও চলে এসেছে। বাবার আগে জয়পুর আগ্রা ঘোরা, দিল্লি থেকে এসে। বাবা তো এই এত ভিড় দেখে অবাক। বলল যে লাস্ট যখন এসেছিল, তখন নাকি কোন লাইনই পায়নি। এমনি এমনি টুকটাক এসো, সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘুরে বেড়াও। সঙ্গে সঙ্গে উইশ লিস্টে যোগ করে নিলাম। তাজ মহল, ফাঁকাতে এসে ডিটেলে ঘুরতে হবে। আরো এক প্রস্থ ছবি তুলে দলের বাকি লোকজন (সবাই না, এই দলে এমন অনেকেই ছিল যারা সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তা মানত না। সেইসব কীর্তি বিভিন্ন পর্বে আরো আসবে।) মিলে আমরা হোটেলে ফিরলাম। এসে শুনি আরেক বিপত্তি। যে বাসে করে আমাদের জয়পুর যাওয়ার কথা, তথা, গোটা ট্রিপটা হওয়ার কথা, সেটা উদয়পুর থেকে আসছিল। পথে তার উইন্ডস্ক্রিন ভেঙ্গে চুরচুর। সে বাস গিয়েছে গ্যারেজে সারাতে। সকাল থেকে তো এমন কথা শুঞ্ছিলাম। এসে দেখি তখনও সে বাস আসেনি। কাঁচও কেনা হয়নি। এবার কতক্ষনে বাস রেডি হয়ে আসবে, কতক্ষণে আমরা বেরবো...জয়পুর পৌঁছব কতক্ষনে। দুপুরের খাবার খেয়ে হোটেলের ঘর চেক আউট করে সবাই লবিতে এসে বসেছি। বারবার ম্যানেজার কাকুকে সবাই জিজ্ঞেস করছি, কোন আপডেট আছে কি না। হোটেলের পাশে একটা স্যুভেনির শপ ছিল, সবাই প্রায় পালা করে করে ওখানে ঢুঁ মেরে এসেছি। আমার মা আর বাবা এর মধ্যে একবার বেরিয়ে আগ্রার বিখ্যাত পেঠা কিনেও এনেছে। এদিকে তো আসের কোন পাত্তা নেই। তখন খালি ভাবছি, ওলা ডেকে ফতেপুর সিক্রিটা দিব্যি ঘুরে আসা যেত এমন জানলে। কপালে না থাকলে যা হয়, আর কী। যাই হোক, সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমাদের বাস এলো প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ। হইহই করে লোকজন ছুটল সীট দখল করতে। মায়ের কাছে শোনা, এই কোম্পানির নিয়ম হল ট্যুরের মোট সময়টাকে দুই ভাগে ভাগ করে সীট এলট করা, যাতে কি না সকলেই মোটামুটি সামনে পিছনে মিলিয়ে বসতে পারে। বেশ ভালো নিয়ম। তা এই বাসে উঠেও দেখলাম সেরকম লিস্ট করে দেওয়া আছে। এদিকে সিটের গায়ে কোন নম্বর লেখা নেই। সেই নিয়ে শুরু হল গোলমাল। ডান্দিক থেকে এক নম্বর না বাঁ দিক থেকে এক নম্বর ধরা হবে... আরে বাবা, সিটিং প্ল্যান তো ছবির মতো আঁকা আছে, সিনেমার টিকিট কাটতে গেলে যেমন দেখি। তেমন করে বসলেই হল। তা না। যাদের পিছনের দিকে সীট পড়েছে, তারা শুরু করল আপত্তি। পাঁচ সাড়ে পাঁচ ঘন্টার জার্নি কি করে টানা কেউ পিছনে বসবে, এই একদিনেই ওলট পালট করতে হবে, সামনে বসতে দিতে হবে, হাঁটু ট্রান্সপ্লান্ট করা, তাই সামনে বসব (অথচ গোটা ট্রিপে একবারও অন্য সময় কিন্তু দেখলাম না আর কিছুতে কোন অসুবিধে), কোমরে ব্যথা তাই ঝাঁকুনি সহ্য হবেনা, সিনিয়ার সিটিজেন তাই সামনে বসব। লেগ স্পেস কম, বসব না। বাস পাল্টাও। এখুনি মালিককে কল করো, ট্রিপ ক্যান্সেল করে দিচ্ছি। ইত্যাদি ইত্যাদি। কান ঝালাপালা করে শেষমেশ জয়পুর থেকে বাস বদল হবে এই আশ্বাসে আমাদের বাসটা ছাড়ল প্রায় চারটের পর, সকাল নটায় যেটা রওনা হওয়ার কথা ছিল। ফতেহপুর, ভরতপুর সব জায়গার ওপর দিয়ে যেতে যেতে মাঝে চায়ের হল্ট দিয়ে শেষমেশ বাস জয়পুরে ঢুকল রাত প্রায় দশটা নাগাদ। চারিদিক তখন প্রায় শুনশান। বাসের ড্রাইভার হোটেলের রাস্তা চেনেনা। কেন যে এরা গুগুল ম্যাপ ব্যবহার করেনা, কে জানে। অটোওয়ালা জোগাড় হল, একশো না দেড়শো টাকার বিনিময়ে রফা হল, সে আগে আগে গিয়ে আমাদের হোটেল অবধি বাসটাকে পৌঁছে দেবে। জয়পুরের হোটেলটা ছিল একটি হেরিটেজ হোটেল। রাডোলি হাউজ। ইন্টারনেটে দেখে এসছিলাম, দারুণ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল, উৎসুক হয়েছিলাম তাই ওখানে পৌঁছতে। শেষমেশ রাত এগারোটার পর হোটেলের গেটে এসে পৌঁছলাম। ঘুমে দুই চোখ বুজে আসছে। এক ঝলক দেখে যা বুঝলাম, অতি রাজকীয় থাকার ব্যবস্থা। সকালে উঠে ভালো করে দেখেশুনে ছবি তুলতে হবে।
এজেন্সির লোকজন তাড়াহুড়ো করে ওই রাতে রান্না চাপাতে গেল। পরেরদিন আমার কাকার জন্মদিন ছিল। কেকের ব্যবস্থা নেই। তাই রাত বারোটা বাজতে না বাজতে, কাকাকে দিয়ে "পেঠা কাটিয়ে" জন্মদিন পালন হল। আমি নিজে বছর দুই আগে মুন্নারে পিতজা কেটে জন্মদিন পালন করেছি। তবে পেঠাটা সত্যিই বিচিত্র! ওই অত রাত্তিরেও ভাত ডাল ভাজা মাছ (নাকি মাংস? ঠিক খেয়াল নেই) পেয়ে ক্লান্ত শরীর একটু আরাম পেল। মশমশে গরম জলে স্নান করে খেয়ে নরম বিছানায় গা এলালাম যখন, রাস্তায় বাইরে তখন শুধু কুকুরের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। রাত প্রায় দেড়টা। এদিকে নির্দেশ এসে গিয়েছে, পরেরদিন সকাল আটটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট দিয়ে দেওয়া হবে। নটায় বেরনো। সিটি সাইট সিইং।
No comments:
Post a Comment