হোটেলে ঢুকে তো আরেকপ্রস্থ ঝুটঝামেলা। গিয়ে জানা গেলো, আমাদের সকলের জন্য বরাদ্দ ১৩টা ঘরের মধ্যে নাকি সব ঘর এখনো খালি নেই চেক ইন টাইম দুপুর বারোটা। তাই ঘর রেডি নেই। ম্যানেজার কাকু, হোটেলের ম্যানেজার, দলের লোকজন মিলে বাকবিতন্ডা (মিথ্যে বলব না, আমিও কম কথা শোনাইনি, আর শোনাব নাই বা কেন? ওমা, ভোর চারটেতে রাইট টাইমে পৌঁছলে কী হত? তখনও বারোটা অবধি লবিতে রাখত নাকি?) করে শেষমেশ বারোটার আগেই ঘর পাওয়া গেল। বেশ সুন্দর পরিষ্কার ছিমছাম ঘর, ব্যাল্কনি দেওয়া। সবাইকে ফ্রেশ হয়ে একটার মধ্যে লাঞ্চ করতে বলা হল। এই শুরু হল, প্রতিদিন খাওয়ার সময় এমন এনাউন্সমেন্ট। সারাদিনের টাইমটেবিল জানানো। ওইদিনের প্রোগ্রাম আগ্রা ফোরট আর তাজ মহল। গরম জলে ভালো করে স্নান করে শরীরের গ্লানি কাটিয়ে খেতে বসেই মন ভালো হয়ে গেলো। চেন্নাইয়ে দিনের পর দিন মাছ না পাওয়া আমি, পাতে দেখি মাছের মাথা দিয়ে ডাল, পাবদা মাছের ঝাল আর ইয়া বড় সাইজের গলদা (নাকি বাগদা? আমার এখনো গুলিয়ে যায় কোনটা কী) চিংড়ির কারি। মন ভরে পেট ভরে খেয়ে এবার সবাই মিলে বাসে ওঠা হল। প্রথম দিন, অল্পক্ষণের জার্নি, তাই বাসের সীট এলট্মেন্ট কিছু হয়নি। মৃত্যুঞ্জয় কাকু বলেই দিলেন। পরের দিন থেকে সীট নাম্বার লিস্ট সব দিয়ে দেওয়া হবে। আমরা তো তখনও বুঝিনি যে এই সীট নিয়েও কেমন দক্ষযজ্ঞ লেগে যেতে পারে। যাই হোক, আমাদের হোটেল থেকে আগ্রা ফোরট এবং তাজ মহল, দুটোই খুব কাছে। ট্যুর প্রোগ্রাম অনুযায়ী ঠিক হল যে আগে ফোরট যাওয়া হবে। তারপরে তাজ মহল। আমি অবশ্য একটু গাঁইগুই করছিলাম বটে যে ফোরটের লাইট এন্ড সাউন্ড দেখা যায় সন্ধ্যে ছটার পর থেকে। তার আগে বরং তাজ মহল দেখে নিই। কিন্তু যেহেতু সেট শিডিউল, তাই কিছু করার নেই। এই প্রথম বললাম মা বাবাকে, "ওই জন্যই নিজেরা নিজেরা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেরানো উচিৎ। নিজেরদের মতো প্রোগ্রাম করে। কী যে দরকার এই ট্যুর পার্টিগুলোর, ইত্যাদি ইত্যাদি।"
ফোরট পৌঁছলাম মিনিট কুড়ি পঁচিশেই। রাস্তায় সামান্য জ্যাম ছিল। বাস কোথায় পার্ক হবে, কোথায় আমাদের নামতে হবে, এইসব চর্চা যখন চলছে, ইতিমধ্যে আমি জানলার পর্দা সরিয়ে পটাপট ছবি তোলা শুরু করে দিয়েছি। দুপুরের রোদে খয়েরি রঙের ফোরটের একটা সোনালি ব্রাউন রঙ, অপূর্ব লাগছিল।
ঘুরতে আসার আগে আগেই আমি ইন্দু সুন্দরেসনের একটি বই পড়ি, "দি টুএনটিএথ ওয়াইফ" নামের। এই বইটিতে মূলত মেহর-উন-নিসা অর্থাৎ নূর জাহানের কথাই লেখা। নূর জাহানের চোখ দিয়ে তৎকালীন মোগল সাম্রাজ্য, রাজ পরিবারের নানান কাহিনী। আর সেই বইতে প্রায় সিংহভাগ জুড়েই আগ্রা। আগ্রা ফোরট আর তাজ মহল। ফোরটে টিকিট কেটে (এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, রাজস্থান বেড়াতে এলে এমনি থাকা খাওয়া যাতায়াতের জন্য তো খরচ আছেই, আমাদের যেমন ট্রেন/প্লেন ভাড়া ছাড়া টুইন শেয়ারিং বেসিসে প্রতি জনের কুড়ি হাজার টাকা লেগেছিল, তার সাথে সাথে অন্তত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা লাগে বিভিন্ন জায়গায় এন্ট্রি ফি আর গাইড ফি দিতে গিয়ে।) অমর সিং গেট দিয়ে ঢুকেই মনে হল, ঠিক যেন গল্পের পাতায় পৌঁছে গেলাম। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি, ছোট্ট মেহর-উন-নিসা মা বাবার হাত ধরে জেনানা মহলে ঢুকছে, বেগামের সাথে দেখা করতে। সেই বাগান যেখানে একদিন মেহরের সাথে চোখাচুখি হয় সেলিমের (যিনি তখনও জাহাঙ্গীর উপাধি নেন নি।)। আগ্রা ফোরট কিন্তু বাবরের আমল থেকেই মোগল সম্রাটদের দখলে, মাঝে কয়েকবার বিভিন্ন যুদ্ধে কেল্লার মালিকানা হারালেও পরবর্তী কালে মোগলদের হাতেই থেকে যায়। ইতিহাস বলে যে শুরুতে ইটের তৈরি কেল্লা হলেও সম্রাট আকবর স্থানীয় লাল স্যান্ডস্টোন দিয়ে এই কেল্লার বর্তমান রূপটি আনেন।
ফোরটের ভিতরে তিনটি স্বতন্ত্র স্থান দেখতে পাওয়া যায়। একটি আকবরের আমলের, অন্যটি জাহাঙ্গীর এবং তৃতীয়টি শাহ জাহানের। মূল কেল্লার স্থাপত্য দেখার মতো। সুক্ষ্ম কারুকার্য , সাদা মার্বেলের ওপর অতুলনীয়। দিওয়ান -ই-আম, দিওান-ই-খাসের নাম যেমন ইতিহাসের বইতে পড়েছি, তেমনি পরেছিলাম ওই গল্পের বইটিতে। চাক্ষুস দেখতে দেখতে সত্যি বলছি, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। যে জানলা দিয়ে শাহ জাহান শেষ বয়সে তাজ মহল দেখতেন, সেইখানে দাঁড়িয়ে যখন তাজ মহল দেখছিলাম, নিজেকে ইতিহাসের একটা অংশ মনে হচ্ছিল। শব্দ দিয়ে বলে বোঝাতে পারব না এই অনুভুতির কথা। গল্পের বইয়ে পড়েছিলাম মীনা বাজারের কথা, যেখানে মহিলা মহলের জন্য আলাদা করে বাজার বস্ত, দোকানীরা পসরা সাজাতো, সেলিম আর মেহর-উন-নিসার কথোপকথন হত যেখানে, সেই মীনা বাজারের কথা যখন গাইড বলছিলেন, চোখের সামনে সিনেমার মতো দেখতে পাচ্ছিলাম প্রতিটি দৃশ্য। কেল্লাটি বিশাল, পুরোটা ভালো করে ঘুরে, ছবি তুলে বেরোতে বেরোতে আর উনত্রিশ জন একসঙ্গে বাসে আসতে আসতে প্রায় সাড়ে চারটে বেজে গেল। তাজ মহলে এন্ট্রি পাঁচটা নাগাদ বন্ধ হয়ে যায়। তাজের দিকের রাস্তায় ভীষণ ভিড়। রবিবার বিকেল। ছুটির মরসুম চলছে। আমাদের বুক ধুকপুক করছে, তাজ মহল কী দেখতে পাবো? প্ল্যান অনুযায়ী আগামীকাল সকাল সকাল জয়পুর বেরিয়ে যাওয়ার কথা। তীরে এসে তরী ডুবলে ভারী মন খারাপ হবে। ঠিক পাঁচটা বাজতে পাঁচে তাজ মহলের পারকিং লটে বাস থেকে নেমে টিকিট কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছি সকলে, আশে পাশের দোকানীরা বললেন যে এখন আর গিয়ে কোন লাভ নেই। টিকিট পাওয়া যাবেনা। বিষণ্ণ হয়ে হোটেলে ফিরলাম। সন্ধ্যের চা আর ফিশ ফ্রাইও মনে আনন্দ আনতে পারল না এতটুকুও। দ্বিতীয়বার মা কে বললাম, "এই জন্যই ট্রাভেল এজেন্সির সাথে আসতে নেই। আগে ফোরটে না গেলেই হতো! মিছিমিছি তাজ মহল মিস করলাম।"
No comments:
Post a Comment