Tuesday, January 23, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৭ (উদয়পুর)

উদয়পুর পৌঁছোতে পৌঁছোতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল। রাজস্থান ট্রিপ যখনই কোন ট্রাভেল এজেন্সির সাথে হয়,যেহেতু একেকটা জায়গা একে ওপরের থেকে এতটাই দূরে, তাই কোন স্পটে দুই রাত্তির রাখা মানে আসলে তার মধ্যে একটা দিন ধরে সেখানে পৌঁছনোর জন্য। আরেকটা দিন হয় সেইখানের সাইটসিয়িং করার জন্য। এই কদিনে এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করেই নিয়েছিলাম। আর তাই যত দেরিতেই কোন জায়গায় পৌঁছই না কেন, আর প্যানিক করতাম না। উদয়পুরে আমাদের যে হোটেলে রেখেছিল, সেটা একটা চৌরাস্তার মুখে, আমাদের অত বড় বাস ওখানে পার্ক করা যাবেনা। তাই মালপত্র ট্রাভেলের ছেলেদের জিম্মায় রেখে আমরা মিনিট পাঁচ সাত হেঁটে হোটেলে পৌঁছলাম। মোতি মহল। একদম মুক্তোর মতোই ধবধবে সাদা। এই প্রসঙ্গে বলি, উদয়পুরের বিভিন্ন নামের মধ্যে, "white city" প্রসিদ্ধ (ঠিক যেমন জয়পুর পিঙ্ক সিটি আর জয়সালমের golden city, ইত্যাদি)। হোটেলটি বেশ সুন্দর সাজানো, ঘর দোর স্ট্যান্ডার্ড। সেদিন রাত্রে আমাদের আর কিছু করার ছিল না। মাংস ভাত খেয়ে টিভি দেখে ঘুম। পরের দিন সকাল সকাল সাইট সিয়িং করতে বেরোনোর কথা।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বেরলাম শহর ঘুরতে। বাসে যেতে যেতে প্রথমেই আমাদের বেদান্তর হেড কোয়ার্টার দেখাল। আরো জানলাম, জিঙ্কের জন্য প্রসিদ্ধ উদয়পুর। এরপর আমরা পৌঁছলাম ফতেহ সাগর লেকে। City of lakes বলে বিখ্যাত উদয়পুরকে অনেকেই Venice of the east আখ্যাও দেন। মূলত পাঁচটি বড় লেকের মধ্যে অন্যতম ফতেহ সাগর। বিশাল জায়গা জুড়ে এই লেক। এখানে এমনি মোটর বোট ছাড়াও স্পীড বোটিং ও করা যায়। আমরা মোটর বোটে উঠে গোটা লেকের এক চক্কর কাটলাম। পাহাড় ঘেরা এই লেকটির আঁকার দূর থেকে দেখলে অনেকটা ভারতে ম্যাপের মত লাগে। এই লেকের মধ্যে কয়েকটি দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপগুলিতে রয়েছে নেহরু পার্ক, সোলার অবজারভেটরি। প্রতিটিই আলাদা করে টুরিস্ট ডেসটিনেশন। আমরা একটাতেও নামিনি, কিন্তু লেক ঘুরে দেখার সময় দেখলাম আর ছবি তুললাম। মিনিট কুড়ি ধরে চলল জলবিহার।
এরপরে আমরা গেলাম লেকের প্রায় উল্টোদিকেই অবস্থিত রাণা প্রতাপ স্মারকে। পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সময়সাপেক্ষ। আমাদের হাতে তেমন সময় ছিল না। তাই আমরা আমাদের বাসেই গেলাম। মোতি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই স্মারকটি। মহারাণা প্রতাপ ও তার সাধের চেতকের একটি lifesize ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে। মূর্তির ফলকে হলদিঘাটির যুদ্ধ আর চেতকের শেষ নিঃশ্বাসের দৃশ্য দুইদিকে খোদাই করা। এই স্মারকস্থলটি থেকে উদয়পুর শহরের কিছুটা দেখা যায়। আশেপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। পাশে ফতেহ সাগর লেক। রোদ ঝলমলে। শীতের সকাল। সব মিলিয়ে জমজমাট। সামনেই একটি ছোট্ট স্যুভেনির শপও রয়েছে। আমি চেতক চাবির রিং কিনলাম সেখান থেকে।
পরবর্তী গন্তব্য ভারতীয় লোককলা কেন্দ্র। এটি রাজস্থানি আর্ট এন্ড ক্রাফট সম্বন্ধে জানার জন্য একেবারে যোগ্য স্থান। বিভিন্ন রাজস্থানি শিল্পকলা, তাদের ইতিহাসের রঙিন সমাবেশ এই কেন্দ্রে। সত্যি কথা বলতে, তখন মনে দিয়ে পড়ে এলেও এখন হয়তো জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলতে পারব না। কিন্তু ওই সময়ে যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করেছিলও মনে, সেটা অনস্বীকার্য। আগেও বলেছি, রঙ আমার খুব প্রিয়। আর তাই এই জায়গাটা আমার বেশিরকমের পছন্দ হয়েছিল। ছবিতে কয়েকটা উদাহরণ দেখালেও সামনা সামনি দেখার আলাদা "চার্ম"। ওই একই জায়গায় এরপর আমরা দেখতে পেলাম ট্র্যাডিশনাল রাজস্থানি পুতুল নাচ। রাজসভায় রাজা ও মন্ত্রীদের সামনে বসে রাজ নর্তক ও নর্তকীর নাচ, ফোক ম্যুজিকের তালে তালে। কতটা দক্ষতা লাগে এই ধরণের উপস্থাপনা করতে, না দেখলে বোঝা কঠিন। ভীষণভাবে উপভোগ্য।
লোক কলা কেন্দ্রের পর আম্রা গেলাম "সহেলীয়ও কি বাড়ি"। রাজপরিবারের মেয়েদের তাদের সহেলীদের সাথে খেলে বেরানোর জায়গা এটি। কিছুই না তেমন, শুধু একটু ফোয়ারা দিয়ে ঘেরা সাজানো গোছানো সুন্দর ফুলে ভর্তি বাগান। ছবি তোলার জন্য মনের মত জায়গা। মিনিট কুড়ির মধ্যে ঘুরে নেওয়াই যায়। বাইরে রাজস্থানি পোশাক পরে ছবি তোলানোরও ব্যবস্থা আছে।
সকালের মত ঘুরে এবার হোটেল ফিরে লাঞ্চ সারা হল। দ্বিতীয়ার্ধে ঘোরার কথা ছিল সিটি প্যালেস। ততক্ষণে কেন জানিনা ওই প্যালেস আর ম্যুজিয়াম দেখতে দেখতে একটু হলেও একঘেয়ে লাগছিল। তার ওপর জনপ্রতি সারে তিনশো টাকা শুনে একটু হলেও বিরত হলাম। আমরা চারজনে সেই জায়গায় অটো ভাড়া করে চলে গেলাম লেক পিচোলা। উদয়পুর বলতেই লোকের মনে যেই নাম আসে, সেটি এই লেক পিচোলা। ভিড় জমজমাট লেকের ধার। পাশেই উদয়পুরের সিটি প্যালেস। লেকের মধ্যে দ্বীপগুলিতে রয়েছে লেক প্যালেস (বর্তমানে বিলাসবহুল হোটেল। সিনেমার শুটিং, প্রচুর টাকাওয়ালা লোকেদের বিয়েবাড়ি এইসব পারপাসেই ব্যবহার হয়) , জগমন্দির ( এর রূপ দেখেই নাকি সম্রাট শাহ জাহান তাজ মহল বানানোর অনুপ্রেরণা পান)। আমরা যেটা করলাম, লেকের কাছেই একটু উঁচুতে অবস্থিত রোপওয়ে রয়েছে, সেটার টিকিট কাটলাম। জনপ্রতি একশোর একটু বেশী খরচ। অপেক্ষা করতে হল খানিকক্ষণ। তারপর মিনিট পাঁচেকে পৌঁছে দিল উল্টোদিকের পাহাড়ে। একসাথে তিনটে গাড়ি চলে, লাল হলুদ ও সবুজ রঙের। ভারি সুন্দর লাগে দূর থেকে দেখতে। ভিতরটা কাছের বড় জানলা দিয়ে তৈরি। পাহাড় পেরোনোর সময় ধারে সিটি প্যালেস, লেক পিচোলা, যোগ মন্দির সব চোখে পড়ে। উলটোদিকে নেমে জানা গেল কর্নি মাতার মন্দির আছে। মা আর কাকা মন্দির থেকে ঘুরে এলো। আমি আর বাবা ওখানে এমনি ঘোরাঘুরি করলাম। ওপর থেকে উদয়পুর শহরটাকে খুব সুন্দর লাগছিল। একটু ঘিঞ্জি, কিন্তু ধবধবে সাদা বাড়ির দেওয়াল। লেকের ওপর সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্যও চোখে পড়ল। ছবি তোলার জন্য আইডিয়াল সানসেট স্পট।
এবার ফেরার পালা। মনে আছে তো সেই যে পেন্ডিং শপিঙের কথা বার বার বলছিলাম? অটো ধরে আমরা এলাম বাপু বাজার। অনেক অনেক দোকান। একদম আমাদের বড় বাজার চত্বরের মতোই। কিছু খুচখাচ জামাকাপড় কেনা হল বটে। কিন্তু সেই রাজস্থানি ঝুমকোর আর দেখা পাই না। হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক করে চষে ফেললাম গোটা অঞ্চল, কিন্তু কোথায় কি? শেষে বাসন গ্যাস এসবের দোকানের পাড়ায় পৌঁছে এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি দেখিয়ে দিলেন একটি রাস্তা। ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমে গিয়েছে। রাস্তা প্রায় শুনশান। ওইসব দিকে সন্ধ্যে সারে সাতটার মধ্যেই সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দেখানো রাস্তা দিয়ে গিয়েও কিছুই খুঁজে পাই না। ফিরে আসব আসব করছি, এমন সময় রাস্তার একজনকে জিজ্ঞেস করায় উনি একটি বাড়ি থেকে কাউকে ডেকে দিলেন। মা আর আমি একটু বাঁধো বাঁধো হয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম বটে। বাবা আর কাকা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল পাহারা দিয়ে।
জানলাম এটি যার বাড়ি, তিনি গয়নার হোলসেলার। রীতিমতো আদর আপ্যায়ন করে "বেটি তুঝে যো পসন্দ আয়ে, নিকালকে লে লে" বলে ছাড়পত্র দিলেন। ঘরের টাক ভর্তি গয়নার বাক্স। নামিয়ে নামিয়ে ডিজাইন পছন্দ করে অনেক অনেক কিনলাম। প্রায় আশ মিটিয়ে যাকে বলে। কী সস্তা সব। এখন মনে হয় আরো কিনলে হতো। অনেক গল্প হল ওনার সাথে। পরের বার উদয়পুর এলে ওনার বাড়ি ডাল বাটি চুরমা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন ওনার ছেলের বৌ। সাথে করে ওনার কার্ড নিয়ে এসেছি। কারুর যদি উদয়পুর যাওয়ার প্ল্যান থাকে, বলবেন। ঠিকানা দিয়ে দেবো।
আবার আরেকটা জায়গা ঘোরা হয়ে গেল। কতটা ঘুরলাম কি, জানিনা। তবে এইটুকু বলতে পারি, জেনে গেলাম আরো কত কিছু দেখার আছে। হাতে সময় নিয়ে এসে আরো কত কিছু দেখতে হবে, অনুভব করতে হবে। বেরানো শেষের দিকে। মাউন্ট আবু, জয়সালমের আর যোধপুর বাকি। আগামীকাল সকাল সকাল হলদিঘাটি হয়ে যাওয়ার কথা মাউন্ট আবু। সেখান থেকে শুরু হবে মাড়ওয়ার। রুক্ষ্ম প্রকৃতি। বালিয়াড়ি।

No comments:

Post a Comment