Saturday, January 13, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ১

প্রস্তুতি ও ট্রেন পর্ব

বেড়াতে যেতে আমি খুব ভালোবাসি। আগে বছরে দুবার ঘুরতে যেতাম, একটা ছোট ট্রিপ হত (মানে ওই দিন সাতেকের), মার্চ এপ্রিলে স্কুলের নতুন সেশান শুরু হওয়ার আগে। আরেকটা হত একটু বড়। দিন পনেরোর। মূলত ডিসেম্বরে শীতের ছুটিতে। আর কলেজে পড়াকালীন দেড় মাস পুজোর ছুটি পেতাম বলে লক্ষ্মী পুজোর পর বেরোতাম। যবে থেকে মাদ্রাজে এসেছি লেখাপড়ার জন্য, বছরে যে কটাদিন ছুটি পাই, মন আনচান করে কখন বাড়ি যাবো, সেই ভেবে। তাই বাবা মায়ের সাথে তেমন করে ঘুরে বেড়ানো হয়না। আশেপাশে এখানে উইকেন্ড বা ডে ট্রিপ খুচখাচ লেগেই থাকে। ওদিকে বাবা মা ও নিজেরা অল্প বিস্তর এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। দুই পক্ষই নিজের মতো ঘুরে বেড়ালেও একসাথে ঘোরার আনন্দ বড্ড মিস করছিলাম, আর তাই সুযোগ খোঁজা হচ্ছিল একসাথে কোথাও যাওয়ার। যেতেই হবে এমন জায়গার লিস্টে ছিল রাজস্থান, লাদাখ, আন্দামান। শীত ছাড়া ছুটি পাওয়া যাবেনা বলে লাদাখ বাদ পড়ে গেলো। আন্দামান আর রাজস্থানের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর অবশেষে পরম বিক্রমের সাথে রাণাদের দেশ, রাজপুতানাই জিতে গেলো। বেশ কিছু বছর আগে শাহরুখ খানকে পহেলী সিনেমায় দেখে রাজস্থান জায়গাটির প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে যাই। এই আকর্ষণ কখনো কমতে পারেনি, তার আরেকটা কারণ হল, রাজস্থান সাঙ্ঘাতিক রকমের ফোটোজেনিক। আর যেই জায়গার  আর যেখানে ছবি তুলে আনন্দ পাওয়া যায়, আমি এক পায়ে খাড়া সেখানে যেতে। কাছাকাছি পাড়ার এক ট্রাভেল এজেন্সির (এদের সাথে বাবা মা দুটো ট্রিপ করে বেশ সন্তুষ্ট। কারণগুলি ক্রমশ প্রকাশ্য) লিস্ট দেখে ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ ঠিক হল দুই সপ্তাহব্যাপী রাজস্থান ভ্রমণের। বাঙালি ফাউ পেলে আর কিছু চায় না, আমরাও রাজস্থানের সাথে ফাউ পেলাম আগ্রা। আহ! সেই কবে থেকে ইতিহাসের পাতায় " টিয়ারড্রপ ইন দি চিক অফ টাইম"এর কথা পড়েছি, ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বাড়িতে ছোট রেপ্লিকা দেখেছি। এইবারে চাক্ষুস দেখব। নতুন কেনা ডি এস এল আর টার সদ্ব্যবহার হবে, এই আশায় আমি সমানে লাফাচ্ছি চেন্নাইতে বসে।
একুশ তারিখ বাড়ি এলাম। সন্ধ্যে থেকে নিজের লাগেজ প্যাক করতে বসলাম। ইতিমধ্যে মা নিজের আর বাবারটা গুছিয়ে রেখেছিল। আমি চেন্নাই থেকে এমনি সাধারণ পোশাক নিয়ে আসলেও গরমজামা কলকাতা থেকেই নিতে হল (কী করব, ২০১৩'র পর গরম জামা পড়েছি কেবলমাত্র গত জানুয়ারিতে পুণা গিয়ে)। অসম্ভব টায়ারড হয়েই (প্যাকিং আর বাইশে একটু দুই একজন আত্মীয়ের সাথে দেখা সাক্ষাত করেই কাহিল) ট্রেনে উঠলাম তেইশ তারিখ। সকাল আটটার পূর্বাতে টিকিট ছিল। বাড়ি থেকে ভোর ভোর (মানে আমার কাছে অন্তত ভোর। তার ওপর আবার ডিসেম্বরের শেষের ঠান্ডা, কম্বলের আরাম ছাড়া বড্ড কড়া শাস্তি যে!) বেরিয়ে ট্রেনে তো উঠলাম। এসি থ্রি টিয়ারে আমাদের রিজার্ভেশন ছিল। আমি পেয়েছিলাম পছন্দসই লোয়ার বার্থ (তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল সাইড লোয়ার। বেশ পর্দা টেনে নিজস্ব একটা জগত তৈরি করা যেত। কিন্তু আজকাল তো ভারতীয় রেল অনেক বেশী প্রগতিশীল হয়েছে, পর্দা সিস্টেম কবেই উঠে গিয়েছে! ভালো ভালো। দেশের উন্নতি।) মা বাবা আর আমি এক জায়গায়, আমার কাকা আসানসোল থেকে উঠবে, শেষ মুহূর্তে জয়েন করেছে প্ল্যানে, তাই এসিতে টিকিট হয়নি, তৎকালেও। বেচারা স্লিপারেই পুরোটা এলো। আমাদের সহযাত্রীরা ছিল এক গুজরাটি পরিবার। প্রায় ৩০-৪০জনের দল ওদের, পুরো পরিবার মিলে মথুরা যাবে। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওরা সবাই মিলে চলেছে। ওদেরও গন্তব্য টুন্ডলা ষ্টেশন, আমাদেরই মতো। ট্রেন রাইট টাইমে পৌঁছলে ভোর তিনটে নাগাদ টুন্ডলা নামার কথা, তবে শীতকাল। জানা কথাই যে লেট হবে। আমরা শুধু এইটুকুই প্রার্থনা করছি, যেন অন্তত চারটে পাঁচটার আগে ষ্টেশন না আসে (প্রার্থনার যে ভালোই জোর আছে, এবং কিছুটা হলেও দরকারের চেয়ে বেশী, তা আমরা খুব শিগগিরি বুঝে গিয়েছিলাম!)। ওই বিশাল দলটা সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে বকবক করেই চলছিল, শুরুর দিকে মন্দ না লাগলেও আসতে আসতে বেশ একটা বিরক্তি ধরছিল বটে। আমি সচরাচর ট্রেনে বা প্লেনে উঠলে বই পড়ি বা গান শুনি। শুয়ে শুয়ে কিন্ডল রিডারে বই পড়তে খুব অসুবিধে হচ্ছিল এই ক্ষেত্রে। জানলার ধারে এমনি বসে থাকলে আমার খুব ঘুম পায়। তাই কিছুটা ঘুমোতে ঘুমোতে আর খানিক বই পড়তে পড়তে চলল আমাদের ট্রেন জার্নি। ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার বাবু, মৃত্যুঞ্জয় কাকু মাঝে এসে দেখা করে গেলেন। চুক্তি অনুযায়ী ট্রেনে সেদিন ব্রেকফাস্ট থেকেই ওদের খাবার দেওয়া শুরু।
মা বাবা এই এজেন্সির সাথে প্রথম যায় মধ্য প্রদেশ। জার্নি, থাকা ইত্যাদি নিয়ে আমরা তিনজনেই খুব ফ্লেক্সিবল, শুধু যেটা সমস্যা দাঁড়ায়, খাওয়া নিয়ে। না, মানে বাঙালি খাবার ছাড়া মুখে কিছু রোচে না এমনটা না, যদিও কেদারনাথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যখন দেখলাম ভারত সেবাশ্রমে রান্না হচ্ছে খিচুরি আর আলুভাজা, আমরা যেমন আনন্দিত হই, ঠিক তেমনি অমৃতসরের পথে ধাবায় বসে সরসো কা সাগ আর মকাই কি রুটি তেমনি উপভোগ করি। তবে আজকাল বয়সের সাথে সাথে আমার মায়ের বেশী করে (গলব্লাডারের স্টোন অপারেশনের পর এটা বেড়েছে) আর কিছুটা হলেও আমার বাবার টানা বেশিদিন তেল মসলা দেওয়া খাবার খেলে শরীর খারাপ করে। তাই ওরা আজকাল প্রেফার করেন এরকম এজেন্সির সাথে ঘোরা যাতে ঘরোয়া খাবারটা পাওয়া যায় (যদিও চিরকাল আমরা নিজেরাই ঘুরে বেরিয়েছি। রাজস্থান ট্রিপ্টাই আমার জন্য প্রথম এজেন্সির সাথে বেরানো)। ব্রেকফাস্টে বান রুটি, ডিম সিদ্ধ, আপেল, মিষ্টি ছিল। সাথে চা। দুপুরে প্যাকড লাঞ্চ। ফ্রায়েড রাইস কাতলা মাছের কালিয়া আর আবার মিষ্টি (এই ট্রিপে প্রত্যেকদিন ব্রেকফাস্টে একটা করে মিষ্টি খেয়েছি। কাজেই কত কিলো যে ওজন বাড়িয়েছি, সেই প্রসঙ্গে না গেলেও চলে)। দিনেরবেলা ট্রেন বিহার দিয়ে যায়, কাজেই একদম প্রত্যাশিতভাবেই প্রচুর এক্সট্রা লোকজন উঠলেন রিজারভড কামরাতে। অবশ্য করেই অসুবিধে হয়, ওদের ওপর রাগ হয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই কষ্ট লাগে ওদের জন্য, এই বিরাট ভারতবর্ষে যেমন আমরা থাকি মেট্রো সিটিতে, যেখানে রয়েছে সব রকম সুবিধে, ঠিক তেমনি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকেন এরা। যাদের কাছে এই দূরপাল্লার ট্রেন ছাড়া কোন গতি নেই। আর তাই নিরুপায় হয়ে রিজারভড কম্পারট্মেন্টেও উঠতে হয়, লোকের কটুক্তি শুনতে হয়। প্রতিনিয়ত।
কখন টুন্ডলা আসবে, নামতে হবে, এই ভাবতে ভাবতে প্রতি ঘন্টায় একবার করে জেগে বাইরেটা জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে করতে অবশেষে পরেরদিন ছয় ঘন্টা লেট করে আমাদের ট্রেন সকাল নটায় ঢুকল টুন্ডলা। দুই মিনিটের হল্ট, অনেক লোক নাম্বে একই কামরা থেকে, তাই একটু টেনশন ছিল। মোটামুটি ধাক্কাধাক্কি করতে করতে মাল নিয়ে নেমে পড়লাম টুন্ডলা। ট্রাভেল এজেন্সির সাথে ঘোরার পরবর্তী উপকারিতা এইবারে টের পেলাম। সমস্ত লাগেজের দায়িত্ব ওদের। এক্টুও মাল টানাটানি করতে হয়নি। সাথে প্রৌঢ় বা বয়স্ক মানুষ থাকলেও লাগেজ নিয়ে ঘুরতে একটুও অসুবিধে হয়না। ষ্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আমাদের একটি বাসে তুলে দেওয়া হল। ওই তখনই পরিচয় হল মোটামুটি গ্রুপের বাকিদের সাথে। আমরা চারজন (মা বাবা কাকা আর আমি) ছাড়া আরো পঁচিশজন। এছাড়া এজেন্সির পাঁচ কর্মচারী আর ম্যানেজার মশাই। মোট দলে পয়ত্রিশজন। বাসে ঘন্টাখানেকের জার্নি করে আমরা শেষমেশ এসে পৌঁছলাম আগ্রাতে, আমাদের হোটেল ডিলাক্স প্লাজাতে। 

No comments:

Post a Comment