Thursday, January 25, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৯ জয়সালমের

সোনার কেল্লার সাথে বোধহয় আমাদের সব বাঙ্গালীর আলাদা একটা সেন্টিমেন্ট কাজ করে, তাই না? নইলে বলুন, জয়সালমের যাচ্ছি ভাব্লেই কেন একটা আলাদা রকমের ভালো লাগা আসবে মনে? সবাই কেন বলবে, "ইশ, কী মজা রে!"? ফেলুদস গুলে বড় হয়েছি, সোনার কেল্লা সিনেমাটা কতবার যে দেখেছি, তার আর ইয়ত্তা নেই। এবারে চাক্ষুষ দেখব, ভাবতেই উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল। মাউন্ট আবু থেকে জয়সালমেরের ওই দীর্ঘ পথ, নিমেষেই সব ক্লান্তি দূর করে দিতে শুরু করলাম কিন্ডল রিডারে আবার করে সোনার কেল্লা পড়া। বই পড়া শেষ হলে চলল ইয়ুট্যুবে সিনেমাটি দেখা। জয় বাবা জিয়োর জয়, ওই ধু ধু প্রান্তরেই অমন ভালো টাওয়ার, আহা! রাস্তায় ব্রেক নিয়ে নিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে জয়সালমের পৌঁছলাম সন্ধ্যেবেলা। শহরে ঢুকতে ঢুকতেই চোখে পড়ল সুবিশাল কেল্লা। রাতের আলোয় সাজানো "সোনার কেল্লা"। অদ্ভুত ভালো লাগা, বিচিত্র অনুভূতি। চোখের সামনে ছোটবেলা।

আমাদের হোটেলে বাস পৌঁছে দিল। সেখানে রিসেপশনে দেখলাম ক্যামেল সাফারি, সোনার কেল্লার ছবি। এত বাঙালি ট্যুরিস্ট আসে ওখানে বলে, দেওয়ালে বাংলাতে নোটিস লিখে রাখা। ওই হোটেলে তখন আমাদের দল ছাড়াও আরো দুটি দল আসায় ঘরের কমতি হয়েছিল। তাই আমাদের কিছুজনকে পাশের আরেকটা হোটেলে ঘর দিল। সাপে বর হল বটে কারণ এই নতুন হোটেলটি ভারী সুন্দর। সোনালী রঙের প্রাসাদের মতোই দেখতে। ঘরগুলি বড়। বিছানা পরিপাটি। বিছানার ওপর দেওয়ালে সোনার কেল্লার একটা প্যানোরামা ছবি বাঁধিয়ে রাখা। প্রথম হোটেলটির ছাদে রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ছাদ থেকে কাছেই সোনার কেল্লা দেখা যায়। দিব্যি সেই দেখতে দেখতে মাংস ভাত দিয়ে ডিনার সারলাম।

সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেরনো হল লোকাল সাইটসিয়িং করতে। সাথে গাইড ছিলেন। প্রথমেই গেলাম পাট্টা কি হাভেলিতে। ওই একই জায়গায় দুটো হাভেলি আছে। আমরা একটিই দেখা স্থির করলাম। পঞ্চাশ টাকা টিকিট কাটতে হল। হাভেলির বাইরে থেকে দেখলাম সোনালী পাথরে তৈরি একটি বিশাল বড় বাড়ি। অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকার্য করা দেওয়ালে, পাথরের ওপর। বারান্দাগুলি দেখার মতো। তেমনি দেখার মতো হল জাফরি কাজগুলি। ব্যবসায়ী পরিবারের অঢেল টাকা, তাই এমন ব্য্যবহুল বাড়ি বানানো। বিলাসবহুলও বটে। হাভেলির ভিতরে বিশাল উঁচু উঁচু সিঁড়ি। এবং সরু। আমার আবার একটু ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে, তাই হাল্কা অস্বস্তি হচ্ছিল সিঁড়ি ভাঙতে। কিন্তু এই কষ্টটা সত্যিই করা উচিৎ। কারণ ভিতরটাও দেখার মতোই সুন্দর। সিলিঙে নানান রঙের পেইন্টিং থেকে শুরু করে কাঁচের কাজ, স্কাল্পচার, অসামান্য। একেক তলায় একেক খনির সম্ভার যেন। সবচেয়ে ওপরতলা আর ছাদ, দুই জায়গা থেকেই বিশাল সোনার কেল্লা দেখা যায়। আমাদের গাইড তো বেশ উৎসাহ পেয়ে আমায় দাঁড় করিয়ে পোজ দিইয়ে অনেক ছবি তুলে দিলেন সোনার কেল্লার ব্যাকড্রপে। হাভেলির বাইরে আবার অনেক ছোটখাটো দোকান। সস্তায় বেশ রংবেরঙের জামা ব্যাগ শোপিস ইত্যাদি ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিল। আমি কি কিনলাম কিছু? হ্যাঁ অবশ্যই! যোধপুর ছাড়া সব জায়গা থেকেই আমি কিছু না কিছু কিনেছি, এইটা পরে খেয়াল হল!

হাভেলি ঘোরা এবং তারপরে কেনাকাটির পর গাইড আমাদের ভিতরের গলির রাস্তা দিয়ে দিয়ে নিয়ে চললেন সোনার কেল্লার দিকে। একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করলাম। রাস্তা জুড়ে দেওয়ালগুলিতে বিয়ের বিজ্ঞপ্তি। অমুকের সাথে তমুকের বিয়ে। অমুক দিন। তমুক জায়গায়। বাড়িগুলোর দেওয়ালে লেখা। রঙিন। মা অবাক হয়ে জানতে চাইল এখানে কার্ডের প্রচলন নেই নাকি? গাইড বললেন যে হ্যাঁ, টা আছে। তবুও এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়াটা চলে আসছে বছরের পর বছর। ভারী মজার কিন্তু!

সোনার কেল্লাতে ঢুকলাম একটা বাজার অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে। সোনার কেল্লা নাকি অন্যতম "living fort", অর্থাৎ, এখনো জয়সালমের শহরের বহু বাসিন্দা কেল্লার মধ্যেই বসবাস করেন। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই কেল্লা। কিছুটা এলাকা শুধুমাত্র টুরিস্টদের জন্য। কিছুটা ব্রাহ্মণদের থাকার জায়গা আর কিছুটা রাজপুতদের। গাইড বললেন, কেল্লার ভিতরে অনেকটা হাঁটাহাঁটি আর কিছু সিঁড়ি ভাঙ্গা রয়েছে। সেই শুনে দলের তিন চারজন এলেন না। তারা নীচেই বসে চারিদিক দেখতে লাগলেন। দোকানপাট, লোকজন। আমরা গাইডের পিছন পিছন চললাম। প্রথমেই আমাদের নিয়ে এলেন লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে। দেব দেবী নিয়ে কিছু বলার নেই, তবে মন্দিরের বাইরের কারুকার্য খুব সুন্দর। সেই জাফরি কাজের। এরপরের স্থান হল "মুকুল বাড়ি"। সোনার কেল্লা সিনেমায় যে বাড়িটা দেখে মুকুল নিজের বাড়ি বলে পরিচয় দেয়, সেই ভগ্নাবশেষটি এখন আরেকটা "স্পট"। অন্যান্য প্রদেশের টুরিস্টদের সেটি দেখানো হয় কিনা সেই বিষয়ে আমার খুব কৌতূহল। চারিদিকেই মুকুল আর মুকুল। একটি দোকান দেখলাম পাথর বাটির, সেটির নামেও মুকুল। শুনেছি ওখানে নাকি প্রত্যেক দোকানেই (অন্তত পুরনো গুলো) সত্যজিত রায়ের ছবিতে পুজো করে। নেহাত কোন দোকানে ঢুকিনি, তাই যাচাই করতে পারিনি। এমনি রাস্তার ধারে কেল্লার মধ্যে ঢেলে বিক্রি হচ্ছে সোনার পাথরবাটি। দর দাম করতে হবে অবশ্যই। কিনলাম কয়েকটা।

এরপর মূল মহলে যাওয়া কেল্লার। টিকিট কাটতে হল। ক্যামেরার আলাদা টিকিট। প্রাসাদে রাজাদের বংশতালিকা, তাদের ছবি তো দেখলামই, সাথে তাদের ব্যবহৃত পোশাক, অস্ত্র সবই চোখে পড়ল। এগুলি দেখে দেখে এখন চোখ পচে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু যা বার বার দেখছিলাম আর মুগ্ধ হচ্ছিলাম, তা হল স্থাপত্য। কী অসম্ভব সুন্দর করে পাথরের ওপর খোদাই করে কাজ করা। ততক্ষণে সূর্যের তেজ বেড়েছে। সূর্যের আলোয় হলুদ স্যান্ডস্টোনের কেল্লাকে দেখে সত্যি মনে হচ্ছিল যেন সোনা দিয়ে তৈরি। সোনালি আভা ঠিকরে পড়ছিল যেন। প্রাসাদের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম অনতিদূরে জৈন মন্দিরের চুড়ো। পাশে লোকজনের বাড়ি। প্রাচীন কেল্লায় এখন টাটা স্কাইয়ের এন্টেনাও দেখলাম, পুরনো ও নতুনের কী অদ্ভুত সুন্দর মিলন। ছাদ থেকে পাট্টা হাভেলিটিও দেখলাম। জায়গায় জায়গায় এখন হোটেল, দোকান। ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছে কেল্লার ভিতর। যার ফলে নাকি এখন কেল্লার সামগ্রিক অবস্থা বিশেষ সুবিধের না, সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা গিয়েছে। ড্রেনেজ সিস্টেমের অবস্থা নিতান্তই শোচনীয়।  মাঝে মাঝে থেমে থেমে আমরা ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম কেল্লা থেকে। পারকিং লট অবধি পৌছতে পৌছতে কেল্লার বিশাল প্রাচীর আমাদের সাথে সাথেই ছিল। সোনার কেল্লা সোনার কেল্লা বলে এত উত্তেজনা, তাও দেখা শেষ!
ইতিমধ্যে ওই ভীষণ রোদে ঘুরে ঘুরে আমার সাইনাসের ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠল। তাই এরপরে কাছেই একটি মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে আর আমি নামিনি। বিকেলে উট চাপতে হবে যে। এনারজি বাঁচানো আর কী!

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট মিটিয়ে চারটে নাগাদ বেরনো হল আবার বাসে করে, ক্যামেল সাফারির উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যে তো যাবতীয় সব রকম পড়াশোনা করে রেখেছি, কী ভাবে উটে উঠবো। খুব লাফাচ্ছি, আহা, উট, শিপ অফ দি ডেজারট, ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। তারপরে যখন আসল সময় এলো, ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়। আমি বেঁটে মানুষ, পা দুটো ছোট। বাইকে একদিকে দুই পা রেখে বসি, সে হেন মানুষকে উটের পিঠে বসাতে গিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। দলের আরেকটি মেয়ে ছিল, কোনমতে উটে চেপে তার কোমর জড়িয়ে বসেছি। উট সামনে ঝুঁকবে না আমি পিছনে ঝুঁকব, এই ভাবতে ভাবতে  ঠিক করতে করতে দেখি হ্যাঁচকা দিয়ে উট চার পায়ে খাঁড়া। উটের পিঠে চেপে তারপরে শুরু হল আমাদের সাফারি। উট ব্যাটা সোজা রাস্তা দিয়ে যাবেনা, তাকে যত উঁচু নীচু জায়গা দিয়েই যেতে হবে। খালি মনে হচ্ছে, এই রে, এই বুঝি উল্টে পড়ব। উটের সাথে যে ছেলেটি যাচ্ছিল, সে যত আমায় বলে যে কিচ্ছু হবেনা, পড়ব না। রিলাক্স করি যেন। আমার তো ভয়ে অবস্থা খারাপ। পারলে ওখানেই নেমে যাই, এমন অবস্থা। এই হাল্কা দুলুনি, এই বুঝি গেলাম, এই রে, এই শেষ, সাইকেল থেকে পড়ে হাত ভাঙতে ভাঙতে বেঁচেছি, ফাঁড়াটা কাটেনি, এই এবার উট থেকে পড়ব, এইসব ভাবতে ভাবতে যতক্ষণে দেখি এডজাস্ট হবো হবো, ততক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। মিনিট পনেরো, মোটামুটি মরুভূমির ওপর দিয়ে গেলাম। তবে সেখানে গিয়ে উট চালক বলে কি এটা কী আর আসল রেগিস্তান, আরো ছয়শো টাকা দিলে আধ ঘন্টা ধরে মূল মরুভূমিতে ঘুরিয়ে আনবে। কোথায় রুদালি, কোথায় বর্ডার ইত্যাদি সিনেমার শুটিং হয়েছে, সব দেখাবে। ততক্ষণে আমার অবস্থা এমন যে ফ্রিতে নিয়ে গেলেও যাবো না। বাবা রে বাবা, সখ মিটে গিয়েছে। হেঁটে চলে বেরাব, তাও ভালো। কিন্তু উটের পিঠে আর না। দাঁড়িয়ে ঘুরে বেরিয়ে তারপরে সূর্যাস্ত দেখলাম মরুভুমিতে। বিরাট লাল সূর্য আস্তে আস্তে ঢলে পড়ল পশ্চিম আকাশে। দিগন্ত বিস্তৃত লালচে আভার আকাশ। ক্রমে অন্ধকার নামল। আমাদের এরপরের গন্তব্য ফোক ডান্স শো। ক্যাম্পে যেতে গিয়ে দেখলাম পূর্ণিমার এত্ত বড় চাঁদ উঠছে। সূর্যাস্ত সূর্যোদয় অনেক দেখছি, চন্দ্রোদয় এই প্রথম দেখলাম। অসম্ভব সুন্দর লাগল। খোলা আকাশের নীচে এরপর গ্যালারিতে বসলাম। খুব কনকনে ঠান্ডা ছিল। ভালো করে সোয়েটার পড়ে চাদর মুরি দিয়ে বসলাম। শুরু হল কেসরিয়া বালাম গান দিয়ে। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায়। পরপর চলতে লাগল রাজস্থানি লোকসঙ্গীত, সাথে নাচ। সে নাচ কখনো ঘুমর নাচ, কখনো বাঞ্জারা নাচ। আগুন নিয়ে নাচ, কাঁচের ওপর দাঁড়িয়ে নাচ, মাথায় মটকা ব্যালেন্স করে নাচ। আহা। না দেখলে বোঝান যাবেনা বলে। অসম্ভব ভালো লেগেছিল। ঘন্টা দুই পারফরমেন্স দেখে এবার হোটেল ফেরার পালা।
আর মোটে যোধপুর ঘোরা বাকি। পরের দিন যোধপুর। তারপরের দিন সেখান থেকে যোধপুর এক্সপ্রেসে হাওড়া ফেরার টিকিট। এদিকে ট্রেন ট্র্যাক করে দেখা যাচ্ছে, কুয়াশার জন্য প্রত্যেক দিন ট্রেনটি প্রায় ১৫-১৬ ঘন্টা লেটে চলছে। যে ট্রেনটা হাওড়া থেকে আসবে আর আমরা তাতে উঠব, সেটা যোধপুর থেকে ছেড়েছে প্রায় ১৬ ঘন্টা লেটে। বাড়তি চিন্তা শুরু হল ফেরা নিয়ে। ট্রেন ক্যান্সেল করলেই শেষ। ডিনার টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ট্রেনে ফিরলে খুব দেরি হয়ে যাবে। ততদিনে সকলেই আমরা টায়ারড ভীষণ ভাবে। লম্বা ট্রিপ করে কাহিল চারজনেই। যোধপুর থেকে ফ্লাইট আছে কলকাতার, তবে ভায়া দিল্লি বা বম্বে। তাতে তখন টিকিটের দাম ষোল সতেরো হাজার টাকা একেক জনের। মারাত্মক। জয়পুর থেকে দেখলাম ছয় হাজারের একটু বেশী। খানিক ভেবেচিন্তে জয়পুরের টিকিট কেটে নেওয়া হল। আগে তো যোধপুর পৌঁছই, তারপর দেখা যাবে। যোধপুর আই আই টি তে আমার এক পরিচিত পড়ায়, ওকে জিজ্ঞেস করলাম জয়পুর যাবো কি ভাবে। বাস গাড়ি ট্রেন সবের হদিস পেলাম। নিশ্চিন্ত হলাম। মা বাবা আর কাকার প্রথম ফ্লাইট হবে, সেই নিয়ে অল্প উত্তেজনাও হল। জয়পুরে গিয়ে কোথায় থাকব, সেটাও অ্যাপ দিয়ে খুঁজে বুক করে ফেললাম চুটকিতেই। কত সুবিধে আজকাল!
আগামীকাল লম্বা জার্নি আবার। যোধপুর যাওয়া।


No comments:

Post a Comment