Friday, January 19, 2018

আমার চোখে রাজস্থান পর্ব ৬ ( চিতোরগড়)

আমি যখন কলকাতায় একদিন থেকে জামাকাপড় প্যাক করছিলাম, আলমারি ঘাটতে গিয়ে অনেক এমন জামা পাই যেগুলি একদা অত্যন্ত প্রিয় হলেও চেন্নাইতে থাকার সুবাদে পড়া হয়ে ওঠেনি। তেমনি একটি প্রিয় সালওয়ার কামিজ, বেগুনীর ওপর সোনালি সুতোর কাজ করা, ওটা মনে হল রাজস্থান ট্যুরের জন্য নিয়েই নিই। বেশী রংচঙে মনে হলে চিন্তা নেই, কারডিগানের নীচে ঢাকা পড়ে যাবে। সেই মত নিলাম, আর তখন ঠিক করলাম যে চিতোর বেড়াতে যাব যেদিন, সেইদিন পড়তে পারব। তেমন সুযোগ পেলে একটু ঘুমর ঘুমর বলে নেচেও নেব।
মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। আমার ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হলনা। এই কদিন ঘুরে বেরিয়ে বুঝে গিয়েছিলাম যে আর যাই হোক, দিনেরবেলা ওইসব রংচঙে ঝলমলে সিন্থেটিক পড়া যাবেনা। অগত্যা, আজমের থেকে চিতোর যাওয়ার সময় আমায় এমনি সাধারণ পোশাকই পড়তে হল। "আমার আর পদ্মিনী সাজা হল না!"
সকাল সকালই বেরিয়ে পড়েছিলাম।। বাসে ব্রেকফাস্ট সেরে চিতোর পৌঁছোতে পৌঁছোতে প্রায় সাড়ে দশটা এগারোটা বেজে গিয়েছিল। পারকিং লটে গাড়ি দাঁড় করানো হল বটে। কিন্তু নামতে গিয়ে বিপত্তি। একটা বিরাট পোষা হাতি রাস্তা আটকে ছিল। হেলতে দুলতে সে বেশ খানিক পরে রাস্তা ছাড়ল। ছাড়পত্র পেতে তাকে বাসের জানলা দিয়ে কমলা লেবু, বান রুটি এইসব ঘুষ দিতে হয়েছিল। অটো চেপে আমাদের চিতোর দর্শন হবে ঠিক হল। হাতির পিঠে চেপেও করা যায়। তবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়ও পেরিয়ে গিয়েছিল। বোধহয় সকাল এগারোটা অবধিই চলে এই হস্তিবিহার। ২৯জনের দলকে মোটামুটি ছটা অটোতে চাপিয়ে রওনা দেওয়া হল। একটি অটোর ড্রাইভার আমাদের গাইডের কাজ করবেন। লক্ষ্য করলাম প্রতিটি অটোর সামনে কাঁচের ওপর সত্যিকার সাটানো। "আমরা পদ্মাবতী সিনেমার ঘোরতর বিরোধ করি।" হিন্দিতে লেখা। বুঝলাম, হাওয়া বেশ গরম। আলটপকা মন্তব্যও করলেই মুশকিল।
চিতোরগড় ভারতের অন্যতম বড় গড়ের মধ্যে অন্যতম। শুধুমাত্র বিশাল আকৃতির জন্যই না, বরং চিতোর আমাদের সকলের মনে দাগ কাটে তার বীরত্বের জন্য, প্রেমের জন্য। সাম্প্রতিক কালে নানান বিতর্কের জন্য সারা দেশ পদ্মিনীর কথা জানলেও আমরা কিন্তু বহু আগে থেকেই পদ্মিনি-রতন সিনহ-আলাউদ্দিন খিলজির গল্প শুনেছি। চিতোরগড় দেখবো বলে তাই আলাদা উৎসাহ ছিল। অটোতে এসে আমাদের প্রথম স্টপ হয় কুম্ভ শ্যাম মন্দিরে। রাণা কুম্ভ এই মন্দিরটি বানান। স্থাপত্যে পুরীর অগন্নাথ মন্দিরের সাথে ভালোই মিল রয়েছে এই মন্দিরটির। কথিত আছে, ভোজরাজের স্ত্রী মীরাবাঈ এই মন্দিরেই শ্রী কৃষ্ণের উপাসনা করতেন। রাজপ্রাসাদের বাহুল্য তার কাছে অপ্রয়োজনীয় ছিল। তিনি স্বামীর অনুমতি নিয়ে এই মন্দিরেই সময় কাটাতেন। সূর্যবংশী হওয়া সত্ত্বেও ভোজরাজ তার স্ত্রীর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কৃষ্ণের উপাসনা চলতে দিলেও ওনার মৃত্যুর পর পরিবারের বাকিরা মীরাকে এখান থেকে সরানোর জন্য উঠে পড়ে লাগেন। সেই চিরাচরিত পারিবারিক সাতকাহন। মীরাকে নানান পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবারই ভক্তির জোরে রক্ষাও পান। অবশেষে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মীরা চিতোর ছেড়ে চলে যান। কুম্ভ শ্যাম মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি ছোট মীরা মন্দির।
মন্দির দেখে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পদ্মিনীর প্যালেস। চিতোরগড় এতটাই বড় যে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা অসম্ভব। কেল্লায় ঢুকতেই আমাদের বেশ অনেকগুলো ফটক পার হতে হয়েছিল। আমাদের গাইডের কোথায়, "Garh ho toh Chittor ka, baki sab garhaiya", অর্থাৎ কেল্লা হতে হয় চিতোরের মত হবে। বাকিরা ধারেকাছেও লাগেনা। এমন নাকি কথিত আছে।
পদ্মিনীর প্যালেসের কাছে এসে গাইড বললেন ইতিহাসের কথা। রতন সিং ও পদ্মিনীর কথা। পদ্মিনী নাকি এতটাই সুন্দরী ছিলেন, এমন তার গায়ের রঙ ছিল যে উনি নাকি যখন জল খেতেন, বাইরে থেকে দেখা যেত জল নামছে গলা দিয়ে। আলাউদ্দিন খিলজি জনশ্রুতিতে জেনেছিলেন এই সৌন্দর্যের কথা। তার বহু পীড়াপীড়িতে রাজপুতরা অবশেষে রাজি হন পদ্মিনীর সৌন্দর্যের সাথে আলাউদ্দিনের পরিচয় ঘটাতে। তবে অবশ্যই ছলের মাধ্যমে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে (রিফ্লেকশন রিফ্র্যাকশনের নানান কম্বিনেশনে) আলাউদ্দিন দেখলেন তার স্বপ্নসুন্দরীকে। আর যথারীতি মাথা ঘুরে গেল তার। পদ্মিনীকে জয় করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করলেন চিতোর। বীরপুরুষ রাজপুতরা প্রাণ দিয়ে বাপ্পা রাওালের প্রতিষ্ঠিত মেওয়ার রাজ্যের রাজধানী চিতোরকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। সেই জুদ্ধে পরাজিত হন পরম শৌর্যের নিদর্শন দেখিয়েও। আর তারপরে পদ্মিনী তার ১৩০০ সঙ্গিনীকে নিয়ে "জোউহর" করেন, অর্থাৎ শত্রুর হাতে নিজেদের তুলে দেওয়ার চেয়ে প্রাণ দিয়ে দেন বিরাট চন্দন কাঠের আগুনে। রাজপুতমেয়েরাও যে সমান বীরাঙ্গনা, তার নিদর্শন পদে পদে রাজস্থানের বিভিন্ন গড়ে পাওয়া গেছে। চিতোরগড়েই তিনবার জোউহর হয়েছে বিভিন্ন শতাব্দীতে।
পদ্মিনীর প্যালেসের ধারের পদ্ম পুকুরটির আজ শোচনীয় অবস্থা। ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয়না। যে আয়না ঘরে বসে আলাউদ্দিন রিফ্লেকশন দেখেছিলেন, সেইটিও সাম্প্রতিক বিতর্কের জেরে ""vandalised" হওয়ায় এখন তালাবন্দী হয়ে আছে। সে আয়না ভাংচুর করে ফেলেছে কিছু উত্তেজিত জনতা। এক টুকরো ইতিহাস চিরতরে হারিয়ে গেল। জানিনা কি করে এডমিনিস্ট্রেশন এগুলো হতে দিল। শাস্তিও কেউ পেয়েছে বলে তো শুনিনি। প্যালেসের বাগানে ফুলে ভর্তি। সুন্দর দৃশ্য। কিন্তু গড়ের ক্ষতির উদাহরণ দেখে ততক্ষণে আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আমরা গেলাম চিতোরগড়ের অন্যতম বিখ্যাত বিজয় স্তম্ভে। মালওয়া আর গুজরাটে জয় লাভ করে রাণা কুম্ভ এই বিরাট স্তম্ভটি বানান। মোট নয় তলা। প্রতিটি তলায় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন ঘটনা খোদাই করা। অসম্ভব সুন্দর স্থাপত্য। সময়ের অভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওপর থেকে চিতোরগড় শহরের দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি। কাছেই জউহরের জায়গাটিও দেখলাম। সেখানে পাশে সতী মায়ের মন্দির রয়েছে। জউহরের কুয়োতে অনেক গরু ছাগল ও অনেক সময় শিশুরাও পড়ে যেত বলে সেটি এখন মাটি চেপে দিয়েছে।
এছাড়া চিতোরগড় অঞ্চলে দেখার মত রয়েছে কিছু জৈন মন্দির, কীর্তি স্তম্ভ। আর রয়েছে গোমুখ। একটি জলাশয় যেখানে জল আসে প্রাকৃতিক কারণে। গরুর মুখের মতো দেখতে সেই জলের সোর্সটি। এই জলকে স্থানীয়রা উপাসনা করেন।
ফেরার পথে কালীমাতার মন্দির চোখে পড়ল। সেখানে তখন প্যান্ডেল করে বড় কোন পুজো যজ্ঞ চলছিল। ঘণ্টা আড়াই কাটিয়ে আমরা ফিরলাম পারকিং লটে। দুপুরের খাওয়া সেরে এবারের গন্তব্য উদয়পুর।

No comments:

Post a Comment