উদয়পুর ঘুরবার পর আমাদের পরেরদিন সক্কাল সক্কাল বেরোনো হল। উদ্দেশ্য মাউন্ট আবু। পথে একবার যাওয়ার কথা হলদিঘাটি। ঘন্টাখানেকের পথ ছিল। হার কাঁপানো ঠাণ্ডায় বাস যখন হলদিঘাটিতে পৌঁছল, তখন যেন বাস থেকে নামতেই ইছহে করছেনা, এমন অবস্থা। চেতকের স্মৃতি ফলক ছিল আমাদের প্রথম স্টপ। সেই জায়গাটিতেই চেতক তার শেষ নিঃশ্বাস নেয়। অসীম সাহস, দক্ষতা ও প্রভুভক্তির চরম নিদর্শন রাণা প্রতাপের ঘোড়া চেতক। তাই তার স্মৃতি বিজড়িত স্থানটি দেখতেই হত। মোটা সোয়েটার, চাদর, টুপি পরেও যেন বাধ মানছিল নাওই কনকন ঠাণ্ডা বাতাস। হাতে হাতে ঘষতে ঘষতে তাও নামলাম। দেখলাম। অনুভব করলাম। মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথেই রয়েছে একটু সামনেই, মহারাণা প্রতাপ মিউজিয়াম। একটা নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে এই মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখা যায়। ঢুকেই প্রথমেই নজরে পড়ে কপার রঙের ধাতুর তৈরি বিরাট কিছু মূর্তি। যুদ্ধরত রাণা প্রতাপ ও মান সিংহ, কিছু আরও সহকারী সেনা। মিউজিয়ামের ভিতর ঢুকে সেই রাজপুত রাণাদের অস্ত্রশস্ত্রর প্রদর্শনী দেখলাম। ইতিমধ্যে বেশ কিছু মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে এখন আর ওগুলোর প্রতি আলাদা আকর্ষণ বোধ করছিলাম না। যেটা ভালো লাগল এরপর, সেটা হল পাঁচ মিনিটের একটি ভিডিয়ো, রাণা প্রতাপের জীবনী নিয়ে।
হলদিঘাটির যুদ্ধের ঘটনা প্রায় প্রত্যেকেই আমরা পড়েছি ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু মূলত আমাদের ইতিহাস শিক্ষা সীমিত থেকেছে মোঘল সাম্রাজ্যের কাহিনী অবধি। রাজপুতদের কাহিনী খুব কম পড়েছি। এই ভিডিয়োটির মাধ্যমে রাজপুতদের বীর বিক্রমের কথা দেখতে পাই, জানতে পারি তাদের শৌর্যর কথা। হলদিঘাটির যুদ্ধের একটা ব্যাপার যেটা লক্ষ্য করলাম তা হল, রাণা প্রতাপের সেনাপতি ছিলেন এক মুসলমান ব্যক্তি। আর আকবরের সেনাপতি ছিলেন মান সিংহ। অর্থাৎ এটিকে কিন্তু সেই অর্থে হিন্দু মুসলমানের communal warfareও বলা চলে না। যেদিন প্রবল যুদ্ধ চলছিল, প্রায় রাণা প্রতাপের হার নিশ্চিত, এমন সময়ে তার এক সৈন্য, যাকে অবিকল প্রতাপের মতোই দেখতে, সে প্রতাপের বেশ ধারণ করে লড়াই করেন ও প্রাণ বলিদান দেন। সেই সুযোগে প্রতাপ চেতকের সাহায্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে সক্ষম হন। এই সময়ে চেতকের বীর বিক্রমের কাহিনী তো আমরা সকলেই জানি। রাজস্থান বিভিন্ন স্থানেও এর চিত্র বা মূর্তি দেখেছি। ভিডিয়োটির পর লাইট এন্ড সাউন্ডের ব্যবস্থা ছিল। পুতুল ও আরো বিভিন্ন প্রপ্সের সাহায্যে, লাইট ফেলে সাথে সুন্দর ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যুজিক দিয়ে মহারাণা প্রতাপ ও হলদিঘাটির লড়াইয়ের পুরো ইতিহাস বলে যাচ্ছিল। পান্নাদাইয়ের ইন্সটলেশনের সামনে এসে খানিক স্তব্ধ হলাম। যদিও পান্নার চরম বলিদানের কথা বইতে পড়া, তবুও চোখের সামনে ওই নিজের সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে রেখে রাণাকে সুরক্ষিত স্থানে সরানোর দৃশ্য দেখে যেন ব্যাপারটা ধাক্কা মারল। একজন মা যে কীভাবে এমন বলিদান দিতে পারেন, দেশমাতৃকার জন্য, সত্যিই ভাবনার বাইরে। মিউজিয়ামের বাইরে গুলকন্দ বিক্রি হচ্ছিল। আমরা কিনিনি। বরং আশেপাশে একটু ঘুরলাম। কিছু উট, গরু ইত্যাদির বড় মূর্তি আছে। ছবি তোলার জন্য ভালো। গরুর টানে আখের রস তৈরি হচ্ছিল, সেটাও দেখলাম। দশ টাকা করে গ্লাস প্রতি বিক্রিও হচ্ছিল। স্যুভেনির শপ আছে। বাইরে থেকেই দেখতে ভালো। ঢুকলে মোটামুটি গলা কাটা দাম যে হবেই, আন্দাজ করে নিয়েছিলাম। মূল কম্পাউন্ডের বাইরে কিছু উট সাজানো ছিল, কেউ যদি সাফারই করতে চান, সেই উদ্দেশ্যে। আমরা রাস্তায় চায়ের দোকান থেকে গরম গরম চা খেলাম, ঠাণ্ডায় আরাম হল। ব্রেকফাস্টে সেদিন ওই বান রুটি ইত্যাদি আর ভালো লাগছিল না বলে খাইনি। রাস্তার দোকান থেকেই পোহা খেলাম। মেসে এমনিতে পোহা দেখলে নাক কুঁচকোই, কিন্তু এদিন দিব্যি ভালো লাগল। আশেপাশে হলদিঘাটির হলুদ মাটিও দেখলাম।
এরপর রওনা দিলাম আরাবল্লী পাহাড় ভেদ করে মাউন্ট আবুর দিকে। ঠাণ্ডা ভালোই লাগছিল। পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। হোটেলটি ছিল একটু রাস্তার ভিতরে। দেখলাম পাশাপাশি অনেকগুলো হোটেল ওরকম। বাড়িগুলোর সব কমন দেওয়াল। ওই সরু রাস্তায় আমাদের বড় বাস আসতে পারবেনা। তাই আমাদের এবং আমাদের লাগেজের জন্য জিপগাড়ির ব্যবস্থা হল। জীপ চড়লেই বেশ একটা পাহাড় পাহাড় অনুভূতি হয়, ভালো লাগে। মিনিট পাঁচেকে পৌঁছলাম হোটেল। ছিমছাম। সুন্দর। দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা গেলাম নাক্কি লেক দেখতে। হোটেল থেকে পায়ে হাঁটা পথ। এ যাবত অনেক লেক দেখেছি পাহাড়ি শহরে। এই লেকটিও তার মধ্যে কোন আলাদা কিছু নজরে এলনা। সাধারণ সাজানো গোছানো লেক। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। আলো দিয়ে ধারটা ঝলমল করছে। বোটিং চলছে। যেটা টেনেছিল সেটা অবশ্য করেই সারি সারি দোকান। লেকে যাওয়ার রাস্তা জুড়ে শুধুই দোকান আর দোকান। হ্যান্ডিক্রাফট, ব্যাগ, জামা, জুতো সব। আর খালি খাবারের দোকান। আইসক্রিম, ডাল বাটি চুরমা, মোমো, পুরী সব্জি কী নেই? মনের সুখে কেনাকাটা হল। ভুট্টা সিদ্ধ খাওয়া হল। ওই সময়ে তিনদিন ব্যাপী "winter festival" চলছিল মাউন্ট আবুতে। নাচ গান, খেলা, ফটোগ্রাফি নানান বিষয়ে বিভিন্ন এক্টিভিটিজ ছিল। আমরা সন্ধ্যের বাকি সময়টা কাটালাম সামিয়ানার নীচে বসে রাজস্থানি লোক নৃত্য দেখতে দেখতে। ভারী রঙিন সে দৃশ্য। গানগুলিও বড্ড "catchy"।
পরের দিন গরম গরম আলুর পরোটা ছোলার তরকারি আর মিষ্টি খেয়ে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা আবার জিপগাড়িতে চেপেই বেরলাম লোকাল সাইটসিইং করতে। মাউন্ট আবুতে দর্শনীয় স্থান বলতে বিশ্ব বিখ্যাত দিলও্যারা মন্দির। জৈনদের মন্দির। অসামান্য স্থাপত্য কারুকার্য। কিন্তু সেটি এগারোটা না বারোটার আগে খোলেনা। তাই সময় কাটাতে আমাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হল ব্রহ্মকুমারীদের হেড সেন্টারে। বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও ইয়ুট্যুবের কল্যাণে ব্রহ্মকুমারীদের সাথে আমাদের পরিচয় আছেই, তাদের হেড অফিস (অফিস বলা চলে কি?) দেখলাম। ধব ধবে সাদা বাড়ি। সামনে ভীষণ সুন্দর করে বাগান করা। বাড়িটির ভিতরে রয়েছে প্রেয়ার হল। ঝকঝকে তকতকে। ওখান থেকে তারপরে গেলাম একটি শিব মন্দিরে। কোন বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু ভারতীয়দের একটু মন্দির দেখালে তারা খুশী হয়ে যায়, আর সেই জন্যই বুঝি এই মন্দিরগুলিও "স্পট" হয়ে গিয়েছে। এটি ছিল হাঁটা পথে। এরপরে আবার জিপে চড়ে যাওয়া হল আরো এক মন্দিরে। নাম আর মনে নেই। তবে বিষ্ণু আর মহাদেব দুজনেই উপাসিত, সেইটুকু মনে আছে। মন্দিরটি বড়। পাথরের কাজ করা।
পরের গন্তব্য গুরু শিখর। মাউন্ট আবুর সবচেয়ে উঁচু স্থান। অনেকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে আবারও সেখানে মন্দির। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেই মন্দিরে যাইনি। এমনিই হেঁটেচলে আশেপাশেটা দেখলাম। কাঁচা গাজর, মুলো, ভুট্টা বিক্রি হচ্ছিল। রোদ পড়ে বেশ একটা শীতের আমেজ পাচ্ছিলাম। ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে নিজেরা ছবি তুললাম। অবশেষে বারোটা বাজতে গেলাম বহু প্রতীক্ষিত দিলোয়ারা মন্দিরে। মন্দিরে ঢুকতে গেলে সাংঘাতিক কড়া সিকিউরিটি। ফোন বা ক্যামেরা এলাউড না। তাই দুর্ভাগ্যবশত অমন অপূর্ব শিল্পকলার একটি ছবিও নেই। জুতো খুলে ব্যাগ ম্যানেজার কাকুর জিম্মায় রেখে লম্বা লাইন দিয়ে (ছেলেদের ও মেয়েদের লাইন আলাদা) ঢুকলাম। দেখলাম ড্রেস কোড রয়েছে। হাফ প্যান্ট লুঙ্গি ইত্যাদি চলবেনা। মন্দির কমপ্লেক্সের ভিতর তিন চারটে মন্দির দেখার মতো। বাইরে থেকে দেখে বোঝাই যায়না যে ভিতরটা অমন সুন্দর। আসলে এটি নাকি ইচ্ছাকৃত। যাতে কি না শত্রুরা নষ্ট না করে। মন্দিরের মধ্যে মার্বেলের ওপর exquisite স্থাপত্য। জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি, মন্দির, বিভিন্ন নারী পুরুষের আকৃতি। দেখার মত। অনেকের মতে তাজ মহলের চেয়েও নাকি অপূর্ব। আমার যদিও তেমন মনে হয়নি, কিন্তু দেখতে ভীষণ ভালো লেগেছে, এইটুকু বলতে পারি। মন্দির ঘুরতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগল। মন্দির তৈরির ইতিহাস জানলাম। জানলাম একটি মন্দির কারিগরেরা নিজেদের ফ্রি টাইমে বিশ্রাম না নিয়ে ঝটতি পটতি মার্বেলের অংশ বিশেষ দিয়ে তৈরি করেন। তার ডিজাইন অবশ্যই তত সূক্ষ্ম না হলেও তাদের এফোরটটাকে সাধুবাদ জানাই।
হোটেলে ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে অল্প ঘুম দেওয়া হল। বিকেলে পায়ে হেঁটে সানসেট পয়েন্ট যাওয়ার কথা। এমন ঠাণ্ডা জাঁকিয়ে পড়েছিল, আর লেপের তলা থেকে বেরোতে পারিনি! মনে হল, সানসেট তো অনেক দেখেছি। একটু আরাম করি। বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখে মন খারাপ না করে লেপের ওম নিই। ন্যু ইয়ার ইভ স্পেশাল সেদিন জম্পেশ ডিনার হল। মাছ, পাঁঠার মাংস, ডিমের ডেভিল, ফ্রায়েড রাইস, কাস্টারড ইত্যাদি ইত্যাদি। পরেরদিন সকাল সকাল বেরোতে হবে। পরবর্তী গন্তব্য জয়সালমের। লম্বা রাস্তা, প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার। ব্রেক দিয়ে যেতে যেতে বারো ঘণ্টা লাগবেই। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেও, রাত বারোটা বাজতেই ফেস্টিভাল (আমাদের হোটেল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে ছিল) প্রাঙ্গণ থেকে খুব বাজি ফাটার আওয়াজ আসছিল, ঘুম ভেঙ্গে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করে আবার ঘুম দিলাম।
No comments:
Post a Comment