Sunday, January 27, 2019

গানের ঝর্ণাতলায়

গানের ঝর্ণাতলায়

দুটো ক্লাস নিয়ে স্টাফরুমে এসে একটু বসেছি। এপ্রিলের মাঝামাঝিতেই বড্ড গরম পড়ে গিয়েছে কলকাতায়। আমাদের কলেজটা তাও ভাগ্যিস বেশ "নিউ-এজ", সেন্ট্রালাইজড এয়ার কন্ডিশন্ড। তাই একটু রক্ষে। জলের বোতলটা খুলে একটু গলা ভিজাতে যাব, এমন সময়ে এক দল সেকেন্ড ইয়ারের ছেলে মেয়ে এসে ভিড় করল আমার টেবিলের সামনে। "ম্যাম, ম্যাম, গান শিখব।" আমি অবাক। গান শিখবে মানে? আমি তো রস কষ বিহীন সাবজেক্ট কেমিস্ট্রি পড়াই, সারাদিন থারমোডাইনামিক্স, কাইনেটিক্স এইসবের বাঘা বাঘা ফর্মুলা, থিয়োরি আর অঙ্ক করিয়ে আমার দিন কাটে, সেখানে হঠাৎ এমন গানের কথা আসে কী করে। জিজ্ঞেস করলাম, "গান? কীসের? কেন? আমি গান জানি নাকি?"

ওরা সমবেতস্বরে বলে উঠল, "ম্যাম, চলুন রুমের বাইরে। বলছি। এখানে এতজন মিলে কথা বললে অন্য স্যর ম্যামেরা আপনাকে আর আমাদের বকা দেবেন।" সত্যি, এরা পারেও বটে। ছেলেমানুষ। সারল্য দেখলে কেমন মায়া পড়ে যায়। ওদের পিছু পিছু বাইরে এলাম। বললাম, "বলো। কী ব্যাপার?"

মীনাক্ষী বলে একটি মেয়ে ওদের মধ্যে বেশ একটু লিডার গোছের, ওই এগিয়ে এসে বলল, "ম্যাম, আমরা ঠিক করেছি এইবারে রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন করব। সেমিস্টার শেষ হয়ে যাবে তখন। অসুবিধে নেই। কয়েকটা গান একটু তুলিয়ে দিতে হবে।" মনে পড়ে গেল ওদের উৎসাহ দেখে আমাদের নিজেদের কথা। এই যে বয়সটা, একদম ডানা মেলে উড়বার সময়। এদিক ওদিক নানান জিনিস পরখ করার সময়। বললাম, "কিন্তু আমি গান জানি, কী করে জানলে?" শোভন বলল, "ম্যাম আমরা আপনাকে গাইতে দেখেছি। ইউটিউবে। বোধহয় আপনার কলেজ জীবনের ভিডিও।" এই রে। ওই অত পুরনো ভিডিও পর্যন্ত ওরা দেখে ফেলেছে? যাক গে, কী করা যাবে আর। শেখাব। রাজি হলাম ওদের গান শিখিয়ে দিতে কয়েকটা।



উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রথম গান হবে "প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে", ওরাই ঠিক করেছে। আটজনের গ্রুপ। কয়েকজন বেশ ভালোই গাইছে। পরিচিত গান। কিন্তু জয়িতা আর প্রণতির মাঝে মাঝেই তাল আর সুর কাটছে। "শোন, ৩-৩ মাত্রার গান। হাতে গুনে গুনে করো।" আমি জায়গায় জায়গায় ওদের সাথে আলাদা করে এক লাইন দুই লাইন গেয়ে বোঝাচ্ছি। স্বরলিপি সমেত। গাইতে ও শেখাতে গিয়ে পৌঁছে গেলাম অন্তত বারো বছর আগে। কলেজের তখন সেকেন্ড ইয়ার চলছে। ফ্রেশারস ওয়েল্কামের জন্য গান গাইতে হবে। মোটামুটি গুনগুন করতে পারি বলে আমায় ধরে বেঁধে গানের দলে নাম লিখিয়েছে। ফিমেল ভয়েসের বড়ই অভাব ছিল। ঋজুর দায়িত্ব ছিল আমায় গানটা তোলানোর। ঋজু দক্ষিণীর ছাত্র। অসম্ভব দখল গানে। আর আমি ওই টিভি দেখে আর রেডিও শুনে একটু আধটু যা করি। কোন ফর্মাল ট্রেনিং নেই বলা চলে।



"আরো আলো, আরো আলো, এই নয়নে প্রভু ঢালো... ঢা- আ-লো। পা-ধা পা-ণি ধা।"

"ধুর ঋজু, আমি পারছি না। আমি তো এই সরগমই করছি।"

"না তুতুল, তুই শুদ্ধ নি বলছিস। কোমল নি হবে। আমি করছি। তুই শোন।"

ঋজুর উদাত্ত কন্ঠে তখন অডিটোরিয়াম মুখরিত হয়।

"সুরে সুরে বাঁশি পুরে, তুমি আরো আরো দাও তান..."

তখন আমার বয়স কত হবে? উনিশ? মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি ওই সুললিত সুর। প্রতিটি নোট যেন এসে বিঁধছে এসে এই বুকের মধ্যে। আহা। কী শব্দ। কী সুর। কী গায়কী। গান শিখব কী, শিক্ষকের প্রেমে ইতিমিধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। আর এদিকে ঋজুও শিক্ষক হিসেবে বেশ সিরিয়াস। কিছুতেই পারফেকশন না এনে রেহাই দেবে না। অবশ্য হ্যাঁ, কাজে দিয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে গোটা মঞ্চ এততাই হাততালিতে ফেটে পড়ছিল, সেই শব্দ যেন আমি এখনও চোখ বন্ধ করে শুনতে পাই। বাকি কলেজ লাইফে আরো অনেক অনুষ্ঠানে আমরা একসাথে গান করেওছিলাম। আমদের ওই গানে গানে প্রেম চলেওছিল তারপর অনেকদিন।



আজ এত বছর পর একই গান গাইতে গিয়ে এই ছাত্র ছাত্রীগুলোর মধ্যে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখছিলাম মনে হল। নবীন এক ঝাঁক প্রতিভা। এখনই তো স্বপ্ন দেখার বয়স।



আবার লাস্ট পিরিয়ডের পর রিহার্সালে বসব ওদের নিয়ে, এই বলে আমি পরের ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিতে চললাম স্টাফরুমে। এখন কটাদিন একটু দেরি হবে বাড়ি ফিরতে। যতদিন না অনুষ্ঠান পর্ব মিটছে। সংসারের দিকে একটু মনোযোগ কম দেওয়া হবে এই ক'দিন। হোক। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে একবার ঋজুকে মেসেজ করে দিলাম।

"ছেলেমেয়েগুলো ধরেছে ওদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য গান তুলিয়ে দিতে। কটাদিন একটু ফিরতে দেরি হবে। তুই প্লিজ হোম ফ্রন্টটা ম্যানেজ করে দিস? আর পারলে এক দুদিন আমাদের রিহার্সালে আসিস। তোর একদা ছাত্রী এখন নিজেই টিচার। কেমন শেখাচ্ছে, দেখতে হবে তো তোকে?" ওর একটা ছোট্ট রিপ্লাই এল, "অবশ্যই। তুই এগিয়ে যা। আমি তো আছিই।"

আমি জানি, ও ঠিক সামলে দেবে। কারণ একদিন তো আমরা এই অঙ্গীকার নিয়েছিলাম,



"গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে

ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে..."












Saturday, January 26, 2019

হৃদয়াসনে



মেরুন রঙের ইনোভাটা ঠিক সাতটার সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে দেবনদী হেরিটেজ হোটেলের সামনে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর ড্রাইভারসাব প্রথমে ফোন করে ও তারপর পাঁচ দশ মিনিটের ব্যবধানে ম্যানেজার, বেয়ারা সবার মারফত দুই তিনবার আরো রিমাইন্ডার পাঠিয়েছে রুম নম্বর ৩০৬এ। সেই রুমের বাসিন্দারা গতকাল দুপুরে কলকাতা থেকে হরিদ্বার পৌঁছেছে ট্রেনে। আজ গাড়ি নিয়ে ওই দম্পতি যাবে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে রুদ্রপ্রয়াগে। ঘন্টা পাঁচেকের রাস্তা। সকাল সকাল বেরিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে যাওয়ার প্ল্যান। সেই মতোই গাড়িকে এরকম সময় বলে দেওয়া। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরোলো বছর আঠাশ উনত্রিশের যুবতী। পরনে নীল জিন্স, হলুদ জ্যাকেট। গলায় বেনারসি কাজ করা কালচে স্টোলটা বেশ কায়দা করে পেঁচানো। মাফলারের মতো। ছোট খোলা চুল। ডান হাতে একটা লাল টুকটুকে স্ট্রলি ব্যাগ, বাঁ হাতে মোবাইল। "হাঁ ভাইসাব, হম বস পাঁচ মিনিট মে হি নিকল যায়েঙ্গে। আপ ডিকি খোলো। সামান ডাল দো," এই বলে ও নিজের ট্রলিটা এগিয়ে আবার হোটেলের ভিতর ঢুকে গেলো। লবিতে ততক্ষণে ওর সঙ্গী যুবকটি চলে এসেছে। সোফায় বসে তাড়াহুড়ো করে জুতোর ফিতে লাগানোর চেষ্টা চলছে। "কী রে, আর কতক্ষণ লাগবে তোর? গাড়ি কখন থেকে দাঁড়িয়ে।" যুবতী একটু কড়া স্বরেই বলল। "এই তো, হয়ে এলো। তুই এই সুটকেসটা নিয়ে যা। আমি ব্যাকপ্যাক আর ক্যামেরাটা নিয়ে আসছি।" মেয়েটি একটু বিরক্ত মুখ করে নীল সুটকেসটা ঠেলতে ঠেলতে এগলো। ছেলেটি পাঁচ মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে পিঠে কালো হলুদ ব্যাকপ্যাক, কাঁধে ক্যামেরার ঢাউস ব্যাগ হাতে এসে দাঁড়ালো গাড়ির সামনে। মেয়েটি ইতিমধ্যেই চোখে স্টাইলিশ নীল সানগ্লাস পরে মাঝের সাড়িতে জানলার ধরে বসে গিয়েছে। ছেলেটি সামনের সিটে ব্যাকপ্যাক রেখে একবার লুকিং গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে উস্কো খুস্কো চুলগুলোকে ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করলো। ঘুম ভেঙেছে আজ এত দেরিতে, স্নানের সময় পায়নি। কোনক্রমে জিন্স আর গ্রে পুল ওভারটা গায়ে দিয়েই বেড়িয়েছে। গাড়ির ভিতর উঠতেই মেয়েটি নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে ওকে সানগ্লাসটা ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, "পরে নে। রোদ লাগলে তো আবার মাইগ্রেনের ব্যথায় কাতরাবি।" ছেলেটি কৃতজ্ঞ চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, "থ্যাঙ্ক ইউ। তুই না থাকলে যে কী হত আমার?" মেয়েটি বলল, "থাক, হয়েছে। এবার যাওয়া যাক। অনেক লেট হয়ে গিয়েছে অলরেডি।" ছেলেটি উত্তর দিল, "চলো পানসি রুদ্রপ্রয়াগ। চলিয়ে ড্রাইভারসাব, নিকলতে হ্যায় ইয়াহা সে।" হাসি খুশি অল্পবয়সী ড্রাইভারটি "হাঁ ঠিক হ্যায় সাব" বলে গাড়ির ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। গাড়ির ম্যুজিক সিস্টেমে শুরু হল কিশোর লতার "কাঞ্চি রে কাঞ্চি রে"। লং ড্রাইভে, বিশেষ করে পাহাড়ি রাস্তায়, এইসব গান বড় ভাল লাগে ওদের। আধ খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা মারছে মেয়েটির মুখে। ছেলেটির বোঝাই যাচ্ছে ঘুম পুরো হয়নি। ইতিমধ্যেই ঝিমোতে শুরু করে দিয়েছে। গাড়ি চলছে হরিদ্বার শহর ছাড়িয়ে, এখনও সমতল। সকালের নরম রোদ আর চারপাশের গাছপালা সাথে নিয়ে ওরাও চলেছে।
জানলার বাইরে দেখতে দেখতে বারবার মেয়েটির মনে পড়ে যাচ্ছিল বছর পনেরো-ষোলোর আগের কথা। বাবা মায়ের সাথে সেইবারে কেদার বদ্রী ঘুরতে এসেছিল। এইসব রাস্তা দিয়েই তো গিয়েছে। মায়ের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে উঠলেই বমি পেত। অ্যাভোমিন ছাড়া গতি নেই। তাও, মাঝে মাঝেই ব্রেক নিতো। বাবা যত্ন করে মায়ের চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিত। তারপর আবার সফর চলত। এতগুলো বছর পর আবার এই একই রাস্তা দিয়ে যেতে ভালোই লাগছে। এবারে অবশ্য গন্তব্য আলাদা। রুদ্রপ্রয়াগ। ওখানেই দিন চারেক থেকে আবার হরিদ্বার হয়ে ফেরা। এর বেশি ছুটি পাওয়া যায়নি। দুজনেই নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে সাঙ্ঘাতিক ব্যস্ত। ছেলেটির দাদুর বাড়ি রুদ্রপ্রয়াগে। দাদু অনেকদিন ধরেই নাতি আর নাতবৌকে দেখবেন বলে আবদার করেছিলেন, তাই ছুটি নিয়ে এখানে আসা। কলকাতা থেকে হরিদ্বার আর হরিদ্বার থেকে কলকাতা ট্রেনে যাওয়া আসার আইডিয়াও মেয়েটির। মেয়েটি আদ্যোপান্ত নস্ট্যালজিক এবং রোম্যান্টিক প্রকৃতির। আর তাই ছোটবেলার শখ মেটাতে উপাসনা এক্সপ্রেসে এসেছে। ফার্স্ট এসি না থাকায় অবশ্য পুরো শখ মেটেনি। সাড়ে নটার দিকে বিয়াসি পৌঁছে রাস্তার ধারে একটা ধাবার সামনে গাড়ি থামালো ড্রাইভারজী। "ভাবী, চায় নাস্তা কর লিজিয়ে। আগে ঔর নেহি রুকেঙ্গে।" মেয়েটি ছেলেটিকে হাল্কা টোকা মেরে ঘুম থেকে তুলল। "কীরে কুম্ভকর্ণ"। ছেলেটি আধো ঘুম আধো জাগা হয়ে বিড়বিড় করল, "কী হল? এসে গেলাম?" মেয়েটি এবার "ওরে অগ্নি, ওঠ। ব্রেকফাস্ট করবি তো?" বলে অল্প খোঁচা দিল পিঠে। মেয়েটির কাঁধ থেকে মাথা তুলে চোখ কচলে একটা হাই তুলে অগ্নি এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কোথায় পৌঁছলাম? কী খাবার পাবো এখানে রুমুন?"  রুমুন হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে নেমে বলল, "বিয়াসি। চল, দেখি। অ্যাট লিস্ট চা কফি তো পাবোই। আর কী খাওয়া যায় দেখি। তুই আলুর পরোটা খাবি নিশ্চয়ই পেলে?" আধ ঘন্টা পর চা-কফি-পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা রওনা দিল আবার। দাদুর বাড়ির উদ্দেশ্যে, রুদ্রপ্রয়াগ। এইবারে অগ্নির কাঁধে রুমুনের মাথা রেখে নিশ্চিন্ত ঘুমের পালা। মান অভিমান পর্বে সাময়িক বিরতি। রাস্তা ক্রমে চড়াই উতরাই হতে থাকে। দুই পাশে বড় বড় গাছ। রোদের তেজ বেড়েছে। তবুও হাল্কা শিরশিরানি ঠান্ডা আছে। নীল আকাশ। ঝকঝকে। মনোরম পরিবেশের মধ্যে দিয়ে ওদের গাড়ি চলতে থাকে। রেয়ার ভিউ মিরর দিয়ে মাঝে মাঝে ড্রাইভারজীর সাথে অগ্নির চোখাচুখি হলে দুজনের মধ্যে হাসি বিনিময় হয়। সাউন্ড সিস্টেমে এখনও পুরনো গান চলতে থাকে নিজের মতো। "হম দোনো, দো প্রেমী, দুনিয়া ছোড় চলে..."



২।

রুমুনের বরাবরের অভ্যেস সক্কাল সক্কাল উঠে পড়ার। বেড়াতে এসে তো আরোই তাই। সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। বাইরে এখনও ভালোই অন্ধকার। মাথার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, অনেকগুলো মেসেজ আর ইমেলের নোটিফিকেশন। মিনিট দশেক সেগুলোর ওপর চোখ বোলাল। বেশিরভাগই স্প্যাম বা অদরকারি। কয়েকটা কলেজের। কাজেরগুলো প্রথমেই "আনরেড" মার্ক করে রাখল। এইবারের বেড়ানোয় এইটাই ওর ইচ্ছে। অগ্নিকেও তাই বলেছে ও। এমারজেন্সি ছাড়া কাজের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না কটাদিন। কাজের চাপে এমনিতেই  দুজনেই এখন খুব ব্যস্ত, চিঁড়েচ্যাপটা। হাঁপিয়ে উঠেছে দুজনেই। আগে ওদের ন'মাসে ছ'মাসে ঝগড়া হত, এখন হচ্ছে প্রায় রোজ। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারে। সেইসব সমস্যার সমাধানের জন্যই মূলত এই চার পাঁচ দিনের ছুটিতে আসা। এটা নিয়েও তো কম অসুবিধে হয়নি। ডিসেম্বরে সেমেস্টারের শেষে যখন ওর কাজের চাপ একটু কম, তখন অগ্নির অফিসে কাজের পাহাড়। ওর ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনা এই ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে। তখন আবার রুমুনের সেমিস্টার তুঙ্গে। তবুও অনেক বলে কয়ে আগে এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে কলিগদের ম্যানেজ করে ছুটি নিয়েছে ও। এই আশায় যে রোজের অভ্যেস থেকে দূরে এলে হয়তো সম্পর্কটা পুরনো চার্ম ফিরে পাবে। চার বছরের কোর্টশিপের পর দেড় বছরের দাম্পত্যেই ইতিমধ্যে এসেছে অদ্ভুত স্থিতাবস্থা। সব কিছু কেমন একঘেয়ে, সামান্য পান থেকে চুন খসলেই কথা কাটাকাটি। রুমুন খুব চেষ্টা করছে নিজেকে ঠিক রাখার, মাথা গরম না করার। এক কালে অগ্নির যে অভ্যেসগুলো ভীষণ ভালো লাগত, সেইগুলিই এখন দুই চোখের বিষ লাগে। তবুও নিজেকে সংযত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো পারছে, কখনো না। এই তো, সেদিন হাওড়া থেকে যে ট্রেনে উঠল, ঠিক শেষ মুহূর্তে অফিস ছুটতে হয়েছিল অগ্নিকে। রুমুনকে, "তুই লাগেজ নিয়ে স্টেশন চলে যা, আমি সময় মত পৌঁছে যাব" বলে ও সেই সক্কাল সক্কাল বেরোল। একটায় ট্রেন। দৌড়তে দৌড়তে অগ্নি পৌঁছল ঠিক একটা বাজতে দশ মিনিটে। রুমুনের ততক্ষণে প্যানিক অ্যাটাক আসার জোগাড়। বারবার ফোনে, "হ্যাঁ এই আসছি" শুনছে ও, এদিকে ঘড়ির কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে। অগ্নির দেখা নেই। তাহলে কি শেষ মুহূর্তে ট্রেন মিস করবে অগ্নি? ও এসে না পৌঁছলে রুমুন কী করবে? একা একা চলে যাবে? এত সোজা? এ কি জীবন নাকি সেলুলয়েড? যখন অগ্নি এসে পৌঁছল, রুমুন ওকে দেখে নিশ্চিন্ত হল বটে, কিন্তু এবারে রাগ শুরু হল। যতই অগ্নি "সরি, খুব জ্যাম ছিল ব্রেবোরন রোডে", "আমি কিন্তু ঠিক সময়েই বেরিয়েছিলাম, ওলার বুকিং দেখ" ইত্যাদি বলে ওর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করুক, রুমুন সারাদিন আর কথাই বলেনি ওর সাথে। মায়ের প্যাক করে দেওয়া সুস্বাদু লাঞ্চ অগ্নিই বেশ তরিবৎ করে সারভ করে দিল রুমুনকে। রুমুনের ফেভারিট সব আইটেম। এমন কী, কেচাপ দিয়ে স্মাইলিও এঁকে দিল ও। তবুও রুমুনের মুখে কথা নেই। মাঝে মাঝে কেন যে এমন করে? অগ্নি বুঝে উঠেতে পারে না। এত মুড সুইং?
এবারে ট্রেনে ওরা দুজনে পেয়েছে ওপর নিচের সাইড লোয়ার আপার সিট। আপাতত দুজনেই লোয়ার বার্থে মুখোমুখি বসে। দুজনের হাতে দুটো বই। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে বদলে যাওয়া প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা। স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম, পুকুর, মাঠ, গ্রাম, চাষ জমি। সন্ধ্যের পর অবশেষে রুমুনের অভিমান পর্ব মিটল। নিজের থেকে? নাকি বারবার অগ্নির দিক থেকে চেষ্টা দেখে এই গলে যাওয়া? যাই কারণ হোক, শেষমেশ এতে দুজনেই খুশি। এতক্ষণ মোটেই কারুর ভালোই লাগছিল না। আগামী কটাদিনের ছুটি খুব ভালো করে কাটাতে হবে। সেই সবের কথাবার্তা আলোচনা করতে করতে রাত হল।
হরিদ্বারে ওরা ছিল আধ বেলা মতো। তারই মধ্যে দুজনে গঙ্গার ঘাটে  বসে অনেকটা সময় কাটালো। এ কথা সে কথা, স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। হর-কি-পউরিতে গঙ্গারতি, পাতার নৌকোয় দেবাঞ্জলি ভাসানো, দিব্যি কাটল। দুজনেই খুশি। রুমুন ভাবল, বুঝি বেড়ানো কাজে দিচ্ছে। পরিবেশ বদলে ব্যবহার বদল, ভালোর দিকে। ও মা, সব আশায় জল ঢেলে আবার তো কাল সকালে দেরি হওয়া নিয়ে আরেক প্রস্থ ঝগড়া হল দুজনের। আসলে অগ্নি রাত জেগে বই পড়ছিল। রুমুন বারবার মনে করিয়েছে, পরেরদিন সক্কাল সক্কাল উঠতে হবে। তাও শোনেনি। অবধারিত পরেরদিন লেট। বিয়াসী পৌঁছনো অবধি তো কথাই বলেনি রুমুন অগ্নির সাথে। তারপর কখন যে অবশ্য অগ্নিরই কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুম ভেঙ্গেছে একেবারে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছে। ওই অপূর্ব পরিবেশে মনের সব ক্লান্তি ও গ্লানি উধাও। রুমুন জানে, ওদের এই ওঠাপড়াগুলো খুবই সাময়িক। এবং অনেকটাই সাইন কার্ভের মতোই পিরিয়ডিক। দুজনকেই যত্ন করে সম্পর্কটাকে বাঁচাতে হবে। শুরুর দিকের ঝড়ঝাপটাগুলোর স্মৃতি যে এখনও টাটকা।
ভাবনাচিন্তাগুলো মনটাকে বড্ড এলোমেলো করে দেয়। জানলার বাইরে তাকিয়ে রুমুন দেখল, আলো ফুটতে শুরু করেছে। চটপট লেপের ভিতর থেকে বেরিয়ে হাত মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলো ও। একটু হাঁটতে বেরোবে। কাল দাদুর থেকে রাস্তাঘাটের ডিরেকশন জেনে নিয়েছে। দুই নদীর সঙ্গমের দিকেই যাওয়ার ইচ্ছে। ভেবেছিল অগ্নিকে নিয়ে বেরোবে, কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হল। ঘুমোতে এত ভালোবাসে। একদম বাচ্চাদের মতো কুঁকড়ে শুয়ে আছে। লেপটা ওর গায়ে আরো একবার ভালো করে টেনে দিয়ে কপালে আলতো চুমু খেয়ে রুমুন বেরোল। ওর স্পর্শে যেন অগ্নি আরো আয়েশ করে শুল। দাদুর ঘরের সামনে থেকে যখন যাচ্ছিল, আবছা গানের সুর ভেসে আসছিল সেখান থেকে। বোধহয় রেডিও। শুনতে পেল, "ভোর ভয়ে পনঘট পে / মোহে নটখট শ্যাম সতায়ে / মোরি চুনরিয়া লিপটি যায় / ম্যায় ক্যা করু হায়ে রাম হায়..."

৩।

দাদুর বাড়িটা জোশিমঠ রোডের ওপর। একদম বিড়লা গেস্ট হাউজের গায়েই বলা চলে। বাগান থেকে অদূরে নদীর সঙ্গম দেখা যায়। একদিকে অলকানন্দা, অন্যদিকে মন্দাকিনী। অপূর্ব এই সমাগম দৃশ্য। দুই নদীর দুই বিশিষ্ট রঙ মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে। সেই আদি অনন্তকাল থেকে। এদিকে বাড়ির বাগানের ফুলগুলি ফুটে এক রঙিন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গোলাপ, ডালিয়া, কসমস, জিনিয়া, গাঁদা - রং বাহারি সৌন্দর্য। সকালের টাটকা বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে রুমুন চলতে লাগল সঙ্গমের দিকে। দশ মিনিটে পৌঁছেও গেল। সূর্য উঠে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। মন্দাকিনীর পার বরাবর পাঁচ বছর আগে যে ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বন্যায়, তার চিহ্ন এদিক ওদিকে বর্তমান। বেশ এখনও বোঝা যায়। রুমুনের মনে পড়ে সেই যে ছোটবেলায় যখন এসেছিল, তখনের রুদ্রপ্রয়াগ আর আজকের রুদ্রপ্রয়াগে কত পার্থক্য। কত পরিবর্তন। সত্যিই, পরিবর্তনই তো ধর্ম। এই এতগুলো বছরে কি ওর নিজের মধ্যে পরিবর্তন আসেনি? মানুষ হিসেবে অনেকটা পরিণত হয়নি? প্রকৃতির তো বদল ঘটবেই। নদীর ওপর দিয়ে যে ছোট্ট পায়ে চলার সাঁকোটা ছিল, সেটাও  আর নেই। নারদ শিলাটিও বন্যার পর হারিয়ে গিয়েছে। জীবন থেকে বহু মানুষের মতোই। এইসব নানান এলোমেলো চিন্তাভাবনার মধ্যেই ছিল ও। এমন সময়ে কানে ভেসে এলো বাংলায় কথাবার্তার টুকরো। এদিক ওদিক তাকিয়ে রুমুন দেখল, পাঁচজনের একটা ছোট দল। বাবা, মা, দাদু, ঠাকুমা বা দিদিমা আর বছর নয় দশের এক ছেলে। ছেলেটি কিছুতেই মাঙ্কি ক্যাপ পরবে না। আর মাও ছাড়বে না। এই বয়সের এক্কেবারে চিরপরিচিত সংগ্রাম। ওদের সাথে চোখাচুখি হতে রুমুন হাসল। "বাঙালি"? জিজ্ঞেস করলেন বাচ্চাটির বাবা। "হ্যাঁ", হেসে উত্তর দিল রুমুন। "কেদার না বদ্রী?" জিজ্ঞেস করলেন উনি। "আপাতত এবারে শুধুই রুদ্রপ্রয়াগ।" রুমুন বলল। ও জানে কথা আরও চলবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর একদম ইচ্ছে করছিল না। আগেভাগেই তাই "আচ্ছা আমি একটু ওদিকটা যাই" বলে সরে গেল।
এইদিকটা একটু ভিড় কম। অলকানন্দার দিকে। দূরে হলেও সঙ্গম স্থল দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে ওখানে। অনেকেই ঘাটে বসে পুজো করছে। আস্তে আস্তে ছোট ছোট দোকানগুলি খুলছে। খানিকক্ষণ বসে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রুমুনের একটু চা তেষ্টা পেল। এই ঠান্ডায় গরম এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। পিঠে একটা হাল্কা টোকা পেয়ে রুমুন মুখ তুলে তাকালো। "কখন এলে দিদিভাই?" সদা হাসি খুশি দাদু। কখন এলো দাদু এখানে? "এই তো এই ঘন্টাখানেক হবে প্রায়", রুমুন কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে বলল। "তুমি?"
দাদু হেসে বলল, "আমি এই এখন এলাম। আরো আগে আসতাম। তবে বড্ড ঠাণ্ডা তো, তাই ভোরের দিকে এক্কেবারে বেরোইনি।"
"হ্যাঁ, আমি যখন এলাম, সূর্য ওঠেনি। বেশ ঠাণ্ডা ছিল।"
" চা খাবে নাকি দিদিভাই?"
"হ্যাঁ, চলো। আমিও ভাবছিলামই তাই।"
"চলো তাহলে। আমি যেখানে রোজ যাই, সেইদিকে এসো।"
রুমুন আর দাদু হাঁটতে থাকে পাশাপাশি। দাদুর বয়স আশি ছাড়িয়েছে। অথচ এখনও কী ঋজু চেহারা। শরীরে এতটুকুও বার্ধক্যের ছাপ নেই। ঠিক যেন সিনেমার এভারগ্রিন হিরো। একটা গাঢ় নীল ট্র্যাকপ্যান্ট, মোটা খয়েরি পুল ওভার, লাল মাফলার, কালো টুপি, চোখে রিমলেস কেতাদুরস্ত চশমা। এই বয়সেও কী স্টাইলিশ দাদু। রুমুন মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে দাদুকে, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে। ওরা মিনিট দশেক হাঁটার পর এসে পৌঁছেছে মঙ্গল সিং এর চায়ের দোকানে। ছোট্ট একটা ঝুপড়ি। কাঠের দুটো বেঞ্চি পাতা। কালো হয়ে আসা কেটলিতে গরম হচ্ছে চা। কাঠের আঁচে। ওরা ছাড়া আর এক দুজন মাঝে মাঝে এসে চা নিয়ে যাচ্ছে ফ্লাস্কে। তারা বেশিরভাগই আশেপাশের দোকানদার। গরম চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে আয়েশ করে এক চুমুক দিয়ে রুমুন বলল, " দাদু, তুমি এই বয়সেও কী হ্যান্ডসাম গো!"
"এই বয়স আবার কী? আমার বয়স কত জানো?"
"এইট্টি প্লাস। মামণিই তো অলমোস্ট সিক্সটি।"
"এইট্টি থ্রি টু বি প্রিসাইস। আই আম আ ইয়ং ম্যান অফ এইট্টি থ্রি।" রুমুন লক্ষ্য করল, হাসলে দাদুর চোখের কোণ কুঁচকে যায়। তাতে যেন আরো সুন্দর দেখায় দাদুকে।
"হুম, সে তো আমি জানি। দিম্মা নিশ্চয়ই তোমার এই হ্যান্ডসাম লুক দেখেই বোল্ড আউট হয়েছিল?" দাদু উত্তরে কিছু বলল না। বরং একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে রইল।
"কী গো? বলো?" রুমুনের গলার স্বরে বোঝা যায়, বেশ একটা গল্পের আমেজ এসেছে।

দাদু এইবারে পকেট থেকে কালো মানিব্যাগটা বের করলো। খুলে সেখান থেকে একটা ছোট ছবি হাতে নিলো। সাদা কালো। বহু বছরের পুরনো। হলুদ হয়ে আসা। সযত্নে সেটি দাদু রুমুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, " এই দেখো দিদিভাই। আমাদের ফার্স্ট অ্যানিভারসারির দিন স্টুডিয়োতে গিয়ে তোলা।" রুমুন "দেখি দেখি" বলে হাতে নিলো ছবিটা। অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে একদৃষ্টে। তারপর একবার দাদুর দিকে, একবার আবার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমায় তো চেনাই যাচ্ছেনা দাদু। কী হ্যান্ডসাম। ঠিক যেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর দিম্মা ওয়াজ সো প্রিটি, ঠিক যেন সুচিত্রা সেন। ওয়াও।" দাদুর চোখ চিকচিক করে উঠল। বলল, "এখনও মনে আছে জানো দিদিভাই এই দিনটার কথা। তখন আমি কলকাতায় থাকি। নতুন চাকরি। সারাদিন অনেক খাটুনি। তোমার দিম্মাকে একা ঘর সংসার সামলাতে হয়। এই সময়টা প্রচণ্ড স্ট্রাগল করেছি। দেশের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হত। কলকাতার ভাড়া বাড়ির খরচাও নেহাত কম ছিল না। যত সম্ভব ওভার টাইম করেছি। তোমার দিম্মা কোনদিনও কমপ্লেন করেনি। আমার খুব খারাপ লাগত। খুব খারাপ লাগত। চেষ্টা করতাম উইক্লি অফের দিন বেরোতে। পায়ে হেঁটে বাসে ট্রামে কত হেঁটেছি, ঘুরেছি। ভিক্টোরিয়া,ময়দান, সাহেব পাড়া। বোর্ন অ্যান্ড শেপারডের সামনে দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছি। ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট ছবি দেখেছি হাঁ করে। দুজনেই। চোখে এক রাশ মুগ্ধতা। সেরকমই একদিন আমি ঠিক করেছিলাম, রেণুকে নিয়ে আমাদের প্রথম অ্যানিভারসারিতে স্টুডিয়ো গিয়ে আমাদের ছবি তোলাব।"
"ও, দ্যাট ইস সো রোম্যান্টিক দাদু।" রুমুন বলল।
"শুধু তাই নয় দিদিভাই। গোটা ব্যাপারটাই ওয়াজ আ সারপ্রাইজ।"
"দিম্মা নিশ্চয়ই দারুণ খুশি হয়েছিল?"
"তা তো হবেই। আনন্দে আবেগে আত্মহারা।"
"আর এই জন্যই ছবিটা এত সুন্দর। তাই না?"
"জানো দিদিভাই, আমি প্রতি বছর বিবাহবার্ষিকীতে স্টুডিয়ো গিয়ে ছবি তুলিয়েছি দুজনের। বেড়াতে গিয়েও সব সময় ছবি তুলিয়েছি। তোমার শাশুড়ি, মামা শ্বশুর তাদের জন্মের পরেও এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয়নি। ইভেন যে বছর তোমার দিম্মা চলে গেল, সেইবারেও। ও তখন ভালো মতোই অসুস্থ। তবুও বাড়িতে ক্যামেরাম্যান ডেকে ফটো তুলিয়েছি। বাড়ি চলো, তোমায় অ্যালবাম দেখাবও। আমি মাঝে মাঝেই ওগুলো খুলে বসি। যেদিন যেদিন রেণুর জন্য ভীষণ বেশি মন খারাপ লাগে, মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওকে স্বপ্নে দেখে... বা কোন কোন অলস দুপুরে হঠাৎ কোন বই পড়তে গিয়ে ওর পেজমার্ক দিয়ে রাখা কোন পাতায় পৌঁছে, বা কোন গান শুনতে শুনতে। তোমার দিম্মার গানের গলা অসামান্য ছিল, জানো তো? বিয়ের পরে নিয়মিত আমায় শোনাত।একটা হারমোনিয়াম নিয়ে এসেছিল বাপের বাড়ি থেকে। ওর খুব প্রিয় ছিল। রোজ ওটাকে বের করত বাক্স থেকে। গুনগুন করত। রেওয়াজ করত। ছেলে মেয়ে দুটোকেও ছোটবেলায় ওই তো গান শিখিয়েছিল। শাশুড়ি মায়ের গান শুনেছ?"
রুমুন মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। মামণির গানের ফ্যান ও।
"ও তো মায়ের কাছেই গান শিখেছে। রেণু বলত। সোহিনীর গানের গলা ভালো। মা মেয়ে দুজনে মাঝে মাঝেই গানের আসর বসাত। তখন আমার চাকরি বদলেছে। জীবনে এসেছে স্বচ্ছলতা, সাথে অনেকটা আরাম। দেশের বাড়ির দায়িত্ব চলে গিয়েছে। ওই সময়টা আমরা খুব বেড়াতাম। আর যে কোন জায়গায় গেলেই গান হত। মনে আছে সে বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা চারজন রুদ্রপ্রয়াগেই এসেছি। তখন রাস্তাঘাট মোটেই এত ভালো ছিল না। দুর্গম। কেদার বদ্রী যাব। পূর্ণিমার রাত। নদীর সঙ্গমে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে। রেণু আর সোহিনী গান ধরল। একটার পর একটা। 'এই লভিনু সঙ্গ তব', 'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে', আরো কত। এইসব গান শুনলে এখনো রেণুর জন্য খুব মন কেমন করে। তখন বসে বসে পুরোনো ছবিগুলো দেখি। আমায় কীরকম ফাঁকি দিয়ে চলে গেল দেখো?"
রুমুন চোখ বোজে। চোখের সামনে যেন দেখতে পায় সাদা কালো ছবির থেকে উঠে আসা এভারগ্রিন দাদু দিম্মাকে। একটা প্রাণোচ্ছ্বল জীবন। সাংসারিক সুবিধা অসুবিধা দায় দায়িত্ব। সব আছে। কিন্তু কোথাও যেন তার মধ্যে রয়েছে অনেকটা হাসি, আনন্দ। ও নিজের আর অগ্নির এমন ছবি ভাবার চেষ্টা করে। সেই কোর্টশিপের সময় মনে পড়ে। আর তারপর হানিমুনে লাদাখ। তারপর? তারপর আর ছবি কই? মুহূর্ত কই? এত ব্যস্ততা? এত কাজ? দুজনের সময় কই? না হয় হিল্লি দিল্লি হলো না। কিন্তু নিজেদের যা আছে যেটুকু, সেটুকুও কি ওরা লালন পালন করছে?
"দিম্মাকে খুব মিস করো, না?" রুমুন জিজ্ঞেস করে।
"খুউব। ফিফটি ফাইভ ইয়ার্স অফ টুগেদারনেস। আর তারপর ওই যে আমায় ঠিক ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। ভেবেছিল আমিও বোধহয় সাথে যাবো। রেণু  বুঝলই না। আমার এখনও অনেক বাঁচা বাকি। কত জায়গা ঘুরতে হবে বলো তো দিদিভাই?"
"তাই না তাই? তুমি তো আমার ইয়ং ম্যান। এসো দেখি একটা সেলফি তুলে ইন্সটাতে দেবো। স্টার্টিং এ ব্র্যান্ড নিউ ডে উইথ মাই এভারগ্রিন হিরো।" রুমুন মোবাইলের সেলফি মোড অন করতে করতে বলে। ছবি তোলা হয়ে গেলে দাদু এবার কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা থেকে একটা ফ্রেমবন্দী ছবি বের করে দেখায়  রুমুনকে। রঙিন ছবি। দিম্মার একার। এক মাথা ধবধবে সাদা চুল। খোঁপা করা। সাদা শাড়ি লাল পাড়। একই লাল সাদা ব্লাউজ। কপালে এত্ত বড় সিঁদুরের টিপ। মুখে হাসিটি অমলিন। "এটা রেণুর শেষ ছবি। তখন চরম অসুস্থ। তবুও ছবি তোলার নামে দেখো, কী সুন্দর হেসেছে। ভারী ফটোজেনিক ছিল কিন্তু। কে বলবে দেখে যে তখন অতো কড়া কড়া ওষুধ চলছে? এই ছবিটা নিয়ে ঘুরি সব সময়। এদিক ওদিক যেখানেই যাই না কেন। সাথে থাকে। ভিউ পয়েন্টে গিয়ে ওর ছবি বের করে দুজনে বসে প্রকৃতি দেখি। ওর বেড়ানোর খুব শখ ছিল জানো। চাকরি সূত্রে যখন এই কাছের শ্রীনগরে পোস্টিং পাই, তখন থেকেই বলে রেখেছিল। রিটায়ার করার পর আমরা রুদ্রপ্রয়াগে থাকব। আসলে ও পাহাড় খুব ভালবাসত। রুদ্রপ্রয়াগকে ও খুব ভালোবাসতো। বন্যার পর ওর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শহরটার এই তছনছ অবস্থা দেখতে পারতো না। তবে পুরোপুরি জায়গাটার গুছিয়ে ওঠার আগেই তো ও চলে গেল। এখনও কোন নতুন জায়গায় গেলে ওকে খুব মিস করি। ওর উইশলিস্টের প্রায় সব  জায়গায় গিয়েছি। শুধু বাদ গিয়েছে সুইজারল্যান্ড। যখন বয়স ছিল, সামর্থ্য ছিল না। পরে সামর্থ্য হল। কিন্তু নানান কারণে যাওয়া হয়ে উঠল না আর। এটাই আক্ষেপ জানো?"
রুমুন চুপ করে শুনছে। কী অসম্ভব ভালোবাসা। এত বছরের সাহচর্য, সঙ্গদান, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক। আর এই ওরা দুজন। শুধুই নিজস্ব গোলস আর অ্যাম্বিশনসের পিছনে ছুটছে। কী লাভ হচ্ছে? দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে কি? পরবর্তী প্রজন্মকে কী গল্প বলবে?
"একী দিদিভাই, কাঁদছ নাকি?" দাদুর কথায় সম্বিত ফেরে রুমুনের। কখন যে দাদু-দিম্মার গল্প শুনতে শুনতে একাত্ম হয়ে ওর দুই চোখ ছাপিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে, ও খেয়ালই করেনি।
"না, কিছু না দাদু। চলো এবারে ফেরা যাক। ব্রেকফাস্ট করে তোমার অ্যাল্বামগুলো দেখবো। বলো কী খেতে চাও আজ?"
" সে চলো। কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টিয়ো না দিদিভাই। দাদুভাইয়ের এগেন্সটে এনি কমপ্লেন্ট?"
"না না তা না দাদু।"
"উহু। আমার অভিজ্ঞ চোখ দিদিভাই। তোমাদের দুজনের এই অধ্যায়ে যে কেমিস্ট্রি থাকার কথা, তা আমি মোটেই দেখছি না। এমন তো হতে দেওয়া যায় না। আমার নাতি হয়ে দাদুভাই এরকম করবে, অমার্জনীয়। যা বুঝছি, ছেলেকে একটু শেখাতে টেখাতে হবে। ছোটি সি বাত সিনেমাটা দেখেছো?"
"হ্যাঁ। গানগুলো বড্ড সুন্দর।"
"হুম। ওখানে অশোক কুমারের রোলটা মনে হচ্ছে আমায় প্লে করতে হবে তোমার অমল পালেকরের জন্য। চিন্তা করো না দিদিভাই। আমি সব ঠিক করে দেবো। তা তুমি ব্রেকফাস্ট বানাবে বলছিলে না? একটু চিড়ের পোলাও বানিয়ে দেবে? ভানু সিং একদম পারে না ওটা। এদিকে তোমার দিম্মার এক্সপারটিজ ছিল ওতে। দেখি তুমি পারো কি না।"


৪।


ব্রেকফাস্টের পর অনেকটা সময় জুড়ে দাদুর কাছে বাগানে বসে অগ্নি আর রুমুন পুরনো অ্যাল্বামগুলো দেখল। আরো কত স্মৃতিচারণা। কথা বলতে বলতে দাদু যেন বারবার সেই চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে পৌঁছে যাচ্ছিল। ওদের মনে হচ্ছিল, ঠিক যেন বড় পর্দায় বসে কোন সিনেমা দেখছে। ভালোবাসার গল্প।
বারোটার দিকে আকাশ কালো করে এলো। "দাদুভাই, বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। চলো ভিতরে যাওয়া যাক" বলে দাদু অ্যালবামগুলো তুলে বাগান থেকে ঘরের দিকে উঠে গেল। অগ্নি দেখল, রুমুন কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
"কীরে চল? বসে থাকবি? ভিতরে চল। এক্ষুণি তো ঠাণ্ডা লাগাবি আর হাঁচি কাশি শুরু হবে।" রুমুনের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে অগ্নি জিজ্ঞেস করে। রুমুন যেন ঠিক এই স্পর্শের জন্যই আকুল হয়ে বসেছিল। ডান হাতটা দিয়ে অগ্নির হাতটা আঁকড়ে ধরে মাথা কাত করে ওর দিকে তাকালো। তাকিয়েই রইল। কোন কথা নেই।
"কী রে? কী বলবি?" অগ্নি আবারও জিজ্ঞেস করে।
"অগ্নি, আমি জানি, আমার মধ্যে অনেক ইম্পারফেকশন। আই অ্যাম অ্যা ব্যাগেজ অফ ইমোশনস। তাও, কথা দে কোনদিনও আমায় ছেড়ে চলে যাবি না।" আস্তে আস্তে রুমুন কথাগুলো বলে।
"অ্যাঁ? কী হয়েছে টা কী? এ আবার কেমন কথা? কীসব জিজ্ঞেস করছিস রুমুন?" অগ্নি অবাক হয়ে বলে।
"না তুই প্লিজ আমায় কথা দে।" রুমুনের গলায় আর্তি যেন ভীষণভাবে প্রকট।
অগ্নি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, " এ তো কবেই প্রমিস করেছি। আজ আবার নতুন করে কেন?"
"তুই দাদুর কাছে বসে কখনও দিম্মার কথা শুনেছিস?" রুমুন জিগেগস করে।
"সেরকমভাবে না। ওই টুকটাক। কেন?" অগ্নি বলে।
"আমি শুনেছি। আজ সকাল থেকে শুনেছি। অ্যান্ড দ্যাট গট মি থিঙ্কিং।" রুমুন বলতে থাকে। "দে হ্যাড দেয়ার শেয়ারস অফ রেস্পন্সিবিলিটিজ। তাও দেখ, দে হ্যাড আ লাইফ। আ হ্যাপি ওয়ান। আমরা তাহলে কেন পারছি না বল তো?"
"আমরা হ্যাপি নই?" অগ্নি একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করে।
"আর উই?" রুমুনের পাল্টা প্রশ্ন।
"অফ কোর্স উই আর। দিনের মধ্যে চৌদ্দবার ইন্সট্যা আর ফেসবুকে দশটা পোস্ট দিইনা, পি ডি এ করিনা, কিন্তু তা বলে কি আমাদের ভালোবাসায় কমতি আছে নাকি? অগ্নি রুমুনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি হাল্কা করতে ও রুমুনের খুব পছন্দের একটা গান ধরে, "ধূপ লগে যাহা তুঝে ছায়া বনু, আজা সজনা..."
কাঁপা স্বরে রুমুন বলে, "এক সাথে বুড়ো-বুড়ি হবো তো আমরা? আমায় ছেড়ে চলে যাবি না তো?"
"ধুর পাগলী। তোর হলোটা কী? ছেড়ে যাবো কোন দুঃখে? ইউ আর দ্য বেস্ট দ্যাট হ্যাপেন্ড টু মি। সাত জন্মের জন্য তো এগ্রিমেন্ট হয়েই আছে। ভাবছি এক্সটেন্ড করিয়ে নেবো সেটার।" হাওয়ায় ওর রুমুনের ফুরফুরে চুলগুলোকে ঘেঁটে দিয়ে বলে অগ্নি।
"প্রমিস?" রুমুন ঠোঁট ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করে।
"গড প্রমিস। দাঁড়া তোকে একটা জিনিস তাহলে দেখাই। ভেবেছিলাম ওটা আমার সিক্রেট। তবে আজ মনে হচ্ছে দেখাতেই হবে।" এই বলে অগ্নি ওর ট্যাবে কিছু খুটখাট শুরু করল। রুমুন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে, "কী?"
"দাঁড়া, দেখাচ্ছি। আমার গাইডলাইন্স।" এরপর ট্যাবে একটা এক্সেল শিট বের করে রুমুনের দিকে দিয়ে বলে, "এই নে। পড়।"
রুমুন ট্যাবটা হাতে নেয়। দেখে লেখা, "আওয়ার গোলস"। এবং সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বছর ভিত্তিক কবে কোথায় যাবে, বেড়াবে, বাড়ি কিনবে, গাড়ি কিনবে, ইনশিয়োরেন্স, সবের ফর্দ, তালিকা।অগ্নি খুব গুছিয়ে কাজ করে, রুমুন জানে। কিন্তু তা বলে এতটা ভাবতে পারেনি। ও বেশ অবাক হয়েই তাই জিজ্ঞেস করে, "এটা একজ্যাক্টলি কী?"

"এটা আমাদের আগামী দিনগুলোর জন্য একটা রাফ রোড ম্যাপ।যদিও ফাইনাল না, তবুও এটাকেই গাইডলাইন মেনে চলছি, চলব।" অগ্নি বলে।
"এবার একটু কপট রাগতস্বরে রুমুন বলে, "আওয়ার, এদিকে আমায় একবারও কন্সাল্ট করিসনি তো?"
অগ্নির ঝটপট উত্তর আসে, যেন তৈরিই ছিল এই প্রশ্নের জন্য। "ওই যে, নীচে দেখ। লেখা আছে, টারমস অ্যান্ড কন্ডিশনস অ্যাপ্লাইড। ওটাই এটাকে হ্যান্ডল করবে। তোর পরামর্শ ছাড়া কিছু হয় নাকি রে? এটা ওই যে বললাম, রাফ ড্রাফট।" অগ্নি হাসে। রুমুনও এইবারে বলে, "তাহলে এক লাইনে সামারাইজ কর।"
"উফ, প্রফেসর ম্যাডাম, এটা তোর ক্লাসরুম নাকি? সামারাইজ কর! কী দাবী!" মজার ছলে অগ্নি বলে।
"শোন, বিয়ের পর বরদের স্ট্যাটাস হতে হয় বউয়ের ওবিডিয়েন্ট স্টুডেন্ট। নইলে... " চোখ পাকায় রুমুন।
অগ্নিও দুই কানে হাত দিয়ে বলে, "আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। বলছি। টু সামারাইজ, লেট মি গেট ডাউন অন মাই নীজ অ্যান্ড আস্ক, মিসেস সেন, উইল ইউ লেট দিস অধম গ্রো ওল্ড উইথ ইউ?"
রুমুন খানিক তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। কিছু বলতে পারে না। তারপর জড়িয়ে ধরে অগ্নির বুকে মুখ গুঁজে দেয়। আর তখনই আকাশ ভেঙ্গে নামে বৃষ্টি। প্রেমধারা।


৫।

মাস তিনেক পরের ঘটনা। দুটো স্ট্রলি আর কাঁধে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে এয়ারপোর্টের এন্ট্র্যান্সের বাইরে দাঁড়িয়ে রুমুন। পরনে লাল সাদা ঢাকাই শাড়ি। শ্যাম্পু করা চুল যত্ন করে খোঁপায় বাঁধা, তাতে আবার জুঁই ফুলের মালা লাগানো, দুই চোখে মোটা করে কাজল পরা, কপালে এই এত্ত বড় সিঁদুরের টিপ। দুই হাতে শাঁখা পলা আর সরু সোনার চুরি চারগাছা পরে এক্কেবারে বাঙালি বউ লাগছে। বার বার বাঁ হাত ঘুড়িয়ে ঘড়ি দেখছে। ভুরু কিঞ্চিত কুঁচকে গিয়েছে। এইবারে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করল অগ্নির নম্বরে।
"ওরে, কতদূর পৌঁছলি? আজকেও লেট করবি নাকি? প্লিজ, এটা ইন্টারন্যাশ্নাল ফ্লাইট। উপাসনা এক্সপ্রেস না। ফ্লাইট মিস করলে কিন্তু আমি জানি না।" উত্তেজিত রুমুন এক নাগাড়ে বলতে থাকে। অপরদিকে অগ্নি হেসে বলল, "আরে রিল্যাক্স বাবা, রিল্যাক্স। আমি আসছি। অলমোস্ট দেয়ার। ডিপারচারের রাস্তায় উঠে পড়েছি।"
"বড্ড জ্বালাস জানিস তো তুই? জানিস আমি প্যানিক করি। তাও এরকম করেই যাবি।" রুমুন একটু দুখী গলায় বললেই অগ্নি গলে যায়। "এই সরি সরি। দাঁড়া, ব্যাগে চকলেট এনেছি। গিয়েই দিচ্ছি। এবার তো ক্ষমা কর।"
রুমুন হাসতে হাসতে বলে, "শোন, মা সহ্য করেছে। বউ কিন্তু সহ্য করবে না। এই বলে দিলাম।" ফোনের উল্টোদিক থেকে অগ্নিরও হাসির রোল শোনা যায়। প্রাণখোলা এই হাসি।

আজ ওরা দুজনে এক সপ্তাহের জন্য সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ফিরেই এই সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। অনেক হয়েছে ছোটাছুটি। এবার একটু থিতু হতেই হবে। দাদুর থেকে দিম্মার শেষ ছবিটার একটা কপি নিয়ে এসেছিল ওরা। সেই ছবি এখন সযত্নে রুমুনের হ্যান্ডব্যাগে রয়েছে। রেণুও চলেছেন আজ নাতি নাতবউয়ের সাথে সুইজারল্যান্ড। দাদুকে কথা দিয়েছে ওরা, ভিডিও কল করবে ওরা রোজ। দুই প্রজন্ম কপোত-কপোতীর আজ উড়বার পালা।


Friday, January 25, 2019

সেদিন দুপুরে

মিতিল বছর তিনের এক মিষ্টি মেয়ে। ফর্সা গোলগাল চেহারা, এক মাথা কোঁকড়া চুল। ঠিক যেন একটা ডল পুতুল। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। মিতিল আর ওর বাবা মা মাস ছয় হয়েছে আমাদের এই হাউজিং কমপ্লেক্সে এসেছে। আমাদের কমপ্লেক্সটা আর পাঁচটা মার্কিনি শহরের ঝাঁ চকচকে রেসিডেন্সিয়াল বাড়ির মতোই। প্রত্যেকে নিজেদের মতো থাকে। আশেপাশের বাড়ির লোকের সাথে তেমন কথা নেই। হয়তো মুখোমুখি হলে একবার হাই বলে হাসলাম। ব্যস। অবশ্য মিতিলদের সাথে ব্যাপারটা একটু আলাদা। একই বিলিডিংয়ে দুটো ভারতীয় তায় আবার বাঙালি পরিবার। আলাপ ও এ বাড়ি ও বাড়ি যাওয়া আসা লেগেই আছে।
মিতিলের বাবা মা, অমিত আর সুলগ্না দুজনেই আই টি ফার্মে চাকুরীরত। বাচ্চাকে দেখার জন্য এক মেক্সিকান ন্যানি রয়েছে। আমি বাড়ি বসে কাজ করি, তাই মাঝে মাঝে এক দুবার একটু দেখে আসি। ও ঠিক আছে কি না। মিতিলের ন্যানিটির নাম লোরি। মাঝ বয়সী। ধর্মভীরু। হাসি খুশি। দক্ষ। আমি যতবারই গিয়েছি, দেখেছি মিতিলের সাথে খুব ভাব। বেশ দুজনে খেলছে। লোরি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ওকে গল্প শোনাচ্ছে। আমি খানিকটা সময় ওদের সাথে কাটিয়ে আবার নিজের বাড়ি ফিরে আসি। সুলগ্নাকে একটা মেসেজে জানিয়ে দিই সব ঠিক আছে।
এরকমই এক দুপুরে একটু বাইরের কাজকর্ম সেরে ফিরে সবে খেয়ে উঠেছি। বাসন নামাচ্ছি, এমন সময়ে আমাদের দরজাটা বার বার ধাক্কাতে লাগলো। কী ব্যাপার, কে। কী হলো। এত ঘন ঘন কে কী চায়। আমি পিপ হোল দিয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম একটা বছর দশেকের ছেলে দাঁড়িয়ে। চেহারা দেখে তো ভারতীয় বা নিদেনপক্ষে দক্ষিণ এশীয় লাগল। আমি দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার।
ছেলেটির পরনে ছিল একটি বেল বটম জিন্স প্যান্ট। আর এই গরমেও একটা মোটা সোয়েট শার্ট। চোখে লাগলো আমার। ও আমায় পরিষ্কার বাংলায় বললো, "আন্টি, তুমি শিগগিরই মিতিলদের বাড়ি যাও। ওর বিপদ।"
কী বিপদ, ও কে কিছু জানতে চাওয়ার আগে ও দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে চলে গেল। আমি কোনো রকমে ফোন আর গাড়ির চাবি আর পার্স হাতে নিয়ে মিতিলদের দরজায় নক করলাম। ভিতর থেকে মিতিলের কান্নার শব্দ পাচ্ছি মনে হল। নাকি টিভি চলছে? দু মিনিট অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য আমার ছিল না। আমার কাছে ওদের একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আমি থমকে গেলাম। দেখি লোরি ওর বিশাল চেহারা নিয়ে শুয়ে আছে মেঝের ওপর। মাথা ফেটে রক্তে কার্পেট ভিজে যাচ্ছে। পাশে বসে মিতিল কেঁদেই চলেছে। খিদেয়। ভয়ে। আর মিতিলের পাশেই খুব বিপজ্জনকভাবে পড়ে রয়েছে কাটলারি সেট। মিতিলের হাতে ছুরি। হয়তো খিদেয় টেবিল থেকে খাবার খুঁজতে গিয়ে হাত থেকে ফেলেছে।
আমি এক দৌড়ে ওর হাত থেকে ছুরিটা সরালাম। সঙ্গে সঙ্গে ৯১১ ফোন করলাম। সুলগ্না আর অমিত যতক্ষণে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষনে লোরিকে নিয়ে এম্বুলেন্স চলে গিয়েছে। আমি মিতিলকে আমার ঘরে বসিয়ে খাইয়ে দাইয়ে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়েছি।
সুলগ্না তো মিতিলকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলল।  বার বার আমায় দিদি তুমি না থাকলে কী যে হত, চির কৃতজ্ঞ এইসব বলতে লাগলো। আমি বললাম, আমায় ধন্যবাদ দিয়ো না। বরং ওই ছেলেটি কে, তাকে থ্যাংকস জানাও। সুলগ্না আর অমিত দুজনেই অবাক। কে ছেলে? কী ব্যাপার? আমি তখন সবটা বললাম।
সুলগ্না জিজ্ঞেস করল, একটা জিন্স প্যান্ট আর সোয়েট শার্ট পরা কি? বললাম হ্যাঁ। খানিক চুপ করে থেকে বলল, তার মানে রুপু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রুপু কে? অমিত বলল, আমরাও ঠিক জানিনা। বিগত এক মাস ধরে মিতিল আমাদের ওর রুপু দাদার কথা বলে। আমরা তেমন গা করিনি। ও যদিও এরকম বর্ণনা দিত, রুপু দাদার সাথে ও খেলে, দাদা ওকে গল্প শোনায়। লোরিকে জিজ্ঞেস করায় ও বলে এমন কেউ তো আসেনি কখনো। শিশুমনের কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি আমরা। তবে আজ মনে হচ্ছে, সত্যিই রুপু দাদা বলে কেউ আছে। আর তার জন্যই মিতিলের কোনো বড় ক্ষতি হয়নি। লোরিও ঠিক হয়ে যাবে শুনলাম। এই রুপু দাদাকে দেখছিই খুঁজতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজে কিছু পাওয়া যায় কি খোঁজ নেব ম্যানেজারের থেকে।" এই অবধি বলে অমিত থামল।
"কোনো লাভ নেই অমিত। কিছু পাবে না। আমি জানি রুপু দাদা কোথায় আছে।" সুলগ্না শান্ত হয়ে জানালো।
"কে ও?" অমিত ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
সুলগ্না ওর ফোন ঘেঁটে একটা পুরোনো স্ক্যান্ড ছবি বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "দেখো তো দিদি, এই ছেলেটিই না কি?"
আমি ছবির দিকে তাকিয়ে অবাক। অবিকল দুপুরের বাচ্চাটা। সেই এক পোশাক। একই রকম ঝাঁকড়া উস্ক খুস্কো চুল। "কে এ?" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
"এটি আমার দাদার ছবি। আমি কখনো দেখিনি দাদাকে। নয় বছর বয়সে আমার জন্মের আগেই মারা যায়। কনজেনিটাল হার্ট ডিসিস ছিল। মায়ের কাছ থেকে দাদার এই ছবিটা দেখেছিলাম। আমার গ্যালারিতে সব সময় থাকে। দাদার নাম ছিল রূপায়ণ। আদর করে সবার রুপু।"

Thursday, January 24, 2019

033 - 1

#জিরো_থ্রি_থ্রি
এক বন্ধুর সূত্রে খবর পেয়ে একটা app ডাউনলোড করে আজকাল রেডিও শুনি খুব। কলকাতার মোটে একটাই স্টেশন ধরে। আকাশবাণীর কোনো একটা। গীতাঞ্জলি। কলকাতায় থাকতে শুনিনি। তখন মূলত প্রাইভেট এফ এম শুনতাম। আর আকাশবাণী হলে রেনবো আর গোল্ড। বিশেষ করে রাত ১০টা থেকে অবশ্যই রেনবোতে "আজ রাতে" অনুষ্ঠান। দিব্যি শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম..মা বেচারিকে রোজ মাঝ রাতে উঠে রেডিও অফ করে দিতে হতো। আর প্রতিদিন সকালে আমার কপালে জুটত বকুনি। আজকাল এখানে এসে খুব মিস করি।
এখন হোস্টেলে আনলিমিটেড ওয়াইফাই। তা ছাড়া জিও ফোন। একা থাকি। প্রায় সারা রাত app এ রেডিও চলে। বা ইউটিউবে হয় হিন্দি বা বাংলা গল্প। কিছু একটা শুনতেই হয়। নইলে ঘুম আসেনা। মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভাঙলে বন্ধ করে দিই। নইলে সকালে দেখি চলতে চলতে কখন অটো প্লে অফ হয়ে থেমে গিয়েছে। এখন এখানে বকবার কেউ নেই। অথচ দেখো, টেকনোলজি হাজির, সমস্যার সমাধান করতে।
তা যাই হোক, যে ধান ভাঙতে শিবের গাজন গাইলাম..হয়েছে কী, এখনও ওই মোবাইলে খুটুর খুটুর করতে করতে রেডিওতে বাংলা অনুষ্ঠান শুনছিলাম। দিব্যি লাগছিলো। আমাদের এদিকটা একটু নিরিবিলি, নির্জন। খোলা জানলা দিয়ে হঠাৎ শুনতে পেলাম ঢং ঢং করে দশটা বাজার শব্দ। এক ছুট্টে যেন পৌঁছে গেলাম সেই ছোটবেলার দাদাই বাড়ি, যেখানে ছোট ঘরটাতে ছিল একটা এই বড় দেয়াল ঘড়ি। প্রতি ঘন্টায় এমন ঢং ঢং করতো। কত ছুটির দিনে মা আর আমি বড় ঘরে শুয়ে আছি। ঘুম আসছেনা। গভীর রাত অবধি দুজনে শুয়ে শুয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘড়ির শব্দ গুনেছি।
এখন খালি মনে হচ্ছিল যেন সেই সেইদিনের দাদাই বাড়িতেই বসে আছি আমি। দশটা বাজলো। এক্ষুণি মা শুতে যেতে ডাকবে। আমায় খেলনাপাতি তুলে রাখতে হবে।
দালানের শেষ প্রান্তে একটা আলনা ছিল। তার নীচের তাকে আমার খেলনার পুটলি রাখবো। টিমটিমে হলুদ বাল্ব জ্বলছে। আরশোলা টিকটিকির ভয়ে আমি সিঁটিয়ে। মা কে ডাকছি।
এখন আর ওগুলোয় ভয় লাগে না। বড় হওয়ার সাথে সাথে ভয়গুলো কেমন পাল্টে যায়।
একটা শব্দের জেরে চেন্নাই কলকাতা সব এক হয়ে গেল কেমন... কে জানে আজকের "আজ রাতে" অনুষ্ঠানের বিষয় কী।।

Monday, January 21, 2019

বিরস দিন

একেকটা দিন মাথার মধ্যে ভুলভাল ইচ্ছের পোকাগুলো নড়ে ওঠে। উঠে পড়ি কোন এক বিদঘুটে সংখ্যার রুটের বাসে।
অফিস টাইমে। কখনও বা দুপুরে।
কপাল করে আবার ফাঁকা সিটও একটা ঠিক জুটে যায়ই যায়। মরা শহরে আর কজনই বা থাকে?
একলা বসে জানলার বাইরে মুখ বাড়াই।
শপিং মল, সিনেমা হল, স্কুল কলেজ, অফিস। ঠ্যালা গাড়ি, অটো, টোটো।
কত লোক, কত ভিড়। ক্যাঁচর ম্যাচর।

কিন্তু আমি...

চুপ করে বসে থাকি, ওই ভীষণ ভিড়ের মধ্যেই।
এদিক ওদিক দেখি কত অনুভূতি। হল্লা। হট্টগোল।
চেষ্টা করি তার মধ্যে মিলে মিশে যেতে।
আমার আলাদা অস্তিত্বটা তবুও ডুবতে ডুবতে শেষ একটা চেষ্টা করে বাঁচবার।

স্বপ্নগুলি হাতছানি দিয়ে যায় তারই মধ্যে দিয়ে।
ইচ্ছেগুলো বড়ই ডাকাডাকি করে। বেয়ারা আবদারে। 
তবুও হুঠ করে কেন যে পালিয়ে বেড়াই প্রায় রোজ
মন খারাপের দলে নাম লিখিয়ে...

Saturday, January 19, 2019

parody of kicchu chaini ami

কিচ্ছু চাইনি আমি শুধু একটু রিসার্চ করা ছাড়া
আমিও তাদেরই দলে, মাত্র একটা পেপার চায় যারা।।
না না কিচ্ছু চাইনি আমি শুধু একটা পি এইচ ডি ছাড়া।
আমিও তাদের দলে পেপার চায় একটাই যারা।।

সময়ের জাঁতাকলে উদ্যম যায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে
আমি একা বসে থাকি পেপার আসবে কবে বলে।
ডিগ্রি শেষে চাকরি আর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
ডিগ্রি শেষে চাকরি আর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ
কিচ্ছু চাইনি আমি শুধু একটা পি এইচ ডি ছাড়া।

করতে করতে কাজ আমারই ল্যাবে গেছি পচে
করতে করতে কাজ আমারই ল্যাবে গেছি পচে
তবুও ফিরে ফিরে আসি প্রতিদিন এই একই ল্যাবে
যদি একটু সাফল্য আসে ভুলে।।

না না কিচ্ছু চাইনি আমি শুধু একটু রিসার্চ করা ছাড়া।
আমিও তাদেরই দলে, মাত্র একটা পেপার চায় যারা।।

Thursday, January 17, 2019

033

#জিরো_থ্রি_থ্রি
দুপুর তখন একটা। মোটামুটি অফিস পাড়া বলা চলে। রাস্তার দুদিকেই বড় বড় বাড়ি। কিছু অফিস। অল্প কয়েকটা রেসিডেন্সিয়াল। আমি ক্যাবের অপেক্ষায়। ভুরভুর করে বিরিয়ানি, পরোটা আর মাংসের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি অফিসের বাবুরা হুমড়ি খেয়ে রাস্তার ধারের দোকানগুলিতে ভিড় করে খাচ্ছে। কোথায় গিয়ে যেন এক হয়ে গেল চেটপেট আর আমাদের ডালহৌসি বা ক্যামাক স্ট্রিট।
ফেরার পথে সেনোটাফ রোডের ছোট্ট ব্রিজের ওপর দিয়ে যখন গাড়িটা যায়, মনে হয় আনওয়ার শা রোড কানেক্টর দিয়ে যাচ্ছি। এই বুঝি ব্রিজ থেকে নামলেই যাদবপুর থানা। ডানদিকে একটু ঝুঁকে তাকালেই চিরপরিচিত স্কুল।
তবে ০৩৩ থেকে ০৪৪ এর দূরত্বটা কিছুতেই যেন কমে না।

Sunday, January 13, 2019

বহতা

অভিমানের বোঝা জমতে জমতে একদিন পাহাড় হয়ে যায়।
চোখের জলে পুষ্টি পেয়ে তারপর সেখানে শ্যাওলাও জমে।।
সময়ের নিয়মেই এরপর সেখানে পড়ে রোদের অকৃপণ ছটা।
ফুল ফোটে, পাখি গান গায়। তৈরি হয় মনোরম বীথি।।
কেউ কেউ প্রায় ভুলতেও বসে সেদিনের সেই দুঃখের টুকরোগুলো।।
হঠাৎ তারপর একদিন ঝড় ওঠে।
লন্ডভন্ড করে দেয় সব কিছু।
ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতোই অশ্রুলাভা বেরিয়ে ধ্বংস করে দেয় সমস্তটা।
আবার সব কিছু ঠাণ্ডা হয়।
থেমে যায় অনাসৃষ্টি।।
আবার জন্ম নেয় ধ্বংসস্তূপে নতুন প্রাণ।
কালের চাকা ঘুরতে থাকে।
অপরিবর্তিত। অনির্দিষ্ট।

Saturday, January 12, 2019

Elixir



Do you realise
It's been a while
Since the raindrops drenched us...

Empty hearts
Empty souls
Parched to death like never before.

We tasted a drop
Of the magic potion
Trying to believe..
In what they called love.


The winter's harsh
Snow fall all around
As we slowly get buried.

Broken twigs
Fallen snowmen
Waiting for their end like there is no tomorrow.


We tasted a li'l more
Of the magic potion
Trying to believe...
In what they called love.

A tiny shoot
Sprung out of the snow
And then  there was one more
And a garden followed.

The kids are out
And the laughter's back
Flowers bloomed
And then there were showers.

We tasted a lot
Of the magic potion
And now believe
In what they called love

The elixir of life...

Friday, January 11, 2019

চিতপটাং

আমার একটি পোষা বিড়াল আছে। ওর নাম চিতপটাং। সারাদিন যেখানেই থাকুক না কেন, রাত্তির হলেই সে আমার ঘরে চলে আসবেই। বড়ই আদুরে। কালো হলুদ সাদা লোমশ। আমার খাটের নীচে ওকে শুতে হবেই। ওর ম্যাও ম্যাও ডাক না শুনলে আমার ঠিক ঘুম হয় না। এটাই অভ্যেস।
গত তিনদিন ধরে চিতপটাং নিখোঁজ। অনেক এদিক ওদিক খুঁজলাম। কিন্তু ওকে দেখতেই পেলাম না। কত ডাকলাম। কোন পাত্তা নেই। মন খারাপ আমার।
গতকাল রাত্তিরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছি। হঠাৎ মাঝ রাত্তিরে চিতপটাং এর পরিচিত স্বরে ম্যাও ম্যাও ডাকে আমার ঘুম ভাঙল। বেড স্যুইচ অন করে দেখলাম আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর ডাকছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও নিজের জায়গায় গিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল।
সকাল হতে দেখি ও নেই। বেরিয়ে গিয়েছে। কাজ কর্ম সেরে বেরোতে যাব বাড়ির বাইরে, দরজাটা লক করছি, এমন সময় মনে পড়ল, গতকাল সকালেই না চিতপটাংকে সিমেট্রিতে রেখে এসেছি?

Thursday, January 10, 2019

to new beginnings (6)

অবশেষে ডাক্তারের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে সুকন্যা কোনোদিনও মা হতে পারবে না। শুদ্ধশীল ও তার বাড়ির লোকজন রীতিমত বিরক্ত। ঠাকুমা তো বংশের বাতি কে জ্বালাবে সেই দুঃখে শোকাতুরা। পিসি বিধান দিলো, এক্ষুণি এই মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটা বিয়ে দেওয়া হোক শুদ্ধর। চেনাশোনা উকিল আছে। মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স পেতে অসুবিধে হবে না। দুজনে সই করে দিলেই হয়ে যাবে। মুক্তি। নতুন জীবন।
এমনটা হতেই পারতো। কিন্তু, হলো না। শুদ্ধশীল আর সুকন্যা একসাথে সই করলো বটে একটা কাগজে। কিন্তু সেটি ডিভোর্স পেপার নয়। adoption এর কাগজ। ছোট্ট তানিকে নিয়ে আজ ওরা নতুন করে শুরু করতে চলেছে নিজেদের জীবন।
To new beginnings...
নববর্ষ উপলক্ষে এই চিন্তায় বেশ কয়েকটি মাইক্রো টেলস লিখলাম। আজকেই ছিল শেষ পর্ব। আগামীর পথ হোক মসৃণ।

Wednesday, January 9, 2019

To new beginnings 5

আজ তিষ্য দাশগুপ্তর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। তিষ্য মেডিকালে রাজ্যে পঞ্চম স্থান অর্জন করেছে। আর তার ফলে ওদের বাড়িতে আজ একটা হইহই রমরমা আবহাওয়া। দাশগুপ্ত পরিবারের বাড়িশুদ্ধু সক্কলে ডাক্তার। ঠাকুরদা, ঠাকুমা, জ্যাঠা, জেঠি, বাবা, মা, দুই পিসি, জেঠতুতো দুই দাদা দিদি প্রত্যেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। আর তিষ্যও পড়াশোনায় বরাবরই ভালো। কোনদিন প্রথম তিনের বাইরে থাকেনি স্কুলে। মাধ্যমিকে তো স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পর্যন্ত পেয়েছিল ও।  তাই এই রেজাল্ট ওদের কারুর কাছেই তেমন অপ্রত্যাশিত নয়।

ল্যান্ডলাইন টেলিফোন, মা বাবার মোবাইল, ওর নিজের মোবাইল সারাক্ষণ বেজেই যাচ্ছে। শুভেচ্ছা বার্তার ছড়াছড়ি। মিডিয়ার লোক এই এলো বলে।

এমন সময়ে তিষ্য ওর মা আর বাবাকে ডেকে নিজের ঘরে গিয়ে বসল। বলল, "মা, বাবা। তোমাদের কিছু জানাতে চাই।"
দুজনে একটু অবাক। কী ব্যাপার এমন যে ছেলে ওঁদের এমনভাবে ঘরে ডেকে আনল।
"হ্যাঁ, বল কী বলবি?" মা তিষ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন।
"যদিও আমি মেডিকালে এত ভালো র‍্যাঙ্ক করেছি, কিন্তু আমি ডাক্তারি পড়তে চাই না মা।" একটু কাঁপা কাঁপা গলায় তিষ্য কথাগুলো বলল।
"ডাক্তারি পড়বি না মানে? তাহলে কী পড়বি? এই এত ভালো র‍্যাঙ্ক করে কেউ ডাক্তারি ছেড়ে দেয়? পাগল হলি নাকি? " তিষ্যর বাবা গড়গড় করে বলে যান।
"হ্যাঁ বাবু। কী পাগলামি কথা এগুলো? ডাক্তারি পড়ার তোর কত শখ ছিল তো। এত পড়াশোনা করে এমন দুর্দান্ত রেজাল্ট করে এসব কী বলছিস?" তিষ্যর মাও উত্তেজিত হয়েই ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন।

"মা, বাবা। আমি জানি তোমাদের সকলের অবস্থা। আমার এই ডিসিশানটা সত্যিই অন্যরকম। আমিও তোমাদের জায়গায় থাকলে এমনভাবেই রিঅ্যাক্ট করতাম। কিন্তু দেখো, তোমাদের সকলকে দেখে আমার মনে হয়েছে যে এই পেশা আমার জন্য নয়। আমি তাই ঠিক করেছি জেনারাল লাইনে লেখাপড়া করব। ফিজিক্সে। আমার ফিজিক্স পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। মাস্টার্স তো করবোই। তারপর পি এইচ ডি ও। নামের আগে ডক্টর বসে যাবে ঠিকই।  জার্নিটা সহজ হবেনা ঠিক। কিন্তু তোমরা প্লিজ আমার সাথে থেকো?"
দাশগুপ্ত দম্পতি অবাক। ওঁদের ছেলে কবে এত বড় হয়ে গেল? এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পেয়ে গেল... এত আত্মবিশ্বাসই বা কোত্থেকে এলো?

"দেখ বাবু, শেষমেশ তোকে নিজের কেরিয়ারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনদিনও আমরা তোর ওপর কিছু চাপাইনি। আজও চাপাবো না। তবে তুই যা ভালো বুঝিস, তাই কর। শুধু এইটা জেনে রাখ, আমরা রইলাম তোর পাশে। সব সময়। " মায়ের কথায় তিষ্য যেন অনেকটা ভরসা পেল।


আর এইভাবেই পরেরদিনের সংবাদপত্রের শিরোনাম তৈরি হয়ে গেল। "রাজ্য জয়েন্টের কৃতী ছাত্র ডাক্তারি না পড়ে যেতে চায় পদার্থবিদ্যার গবেষণায়। শিক্ষায় কি এলো নতুন দিশা?"   

Tuesday, January 8, 2019

To new beginnings 4

খুব ভয়ে ভয়ে রুমুন বাড়ির কলিং বেল বাজালো। আজকে বড়সড় কেস খেতে খেতে বেঁচেছে মায়ের কাছে। আজ শনিবার। বাড়িতে সবাই ওরা স্ট্রিক্টলি নিরামিষ খায়। একদম মাথায় ছিল না। অগ্নির সাথে ডেটে গিয়ে জমিয়ে চিকেন কাবাব খেয়েছে সিনেমার পর। তারপরেই মা ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করল, "কী খেলি?"
একদম ফ্লোতে এসে বলে ফেলেছিল রুমুন, "চিকেন কাবাব"। আর বলেই এই এত্ত বড় করে জিভ বের করে "কেস খেয়েছি" মুখ করলো। ভাগ্যিস মায়ের ফোনটা ডিস্টার্ব করছিল। তাই মা বললো বটে, "কী বলছিস এহ? শনিবারে চিকেন?" রুমুনও সুযোগ বুঝে বলল, "চিকেন কেন হবে মা? আমি কি জানি না নাকি আজ শনিবার? চিকপি কাবাব খেলাম মা। দারুণ খেতে। একদিন খাওয়াবো তোমায়।" যদিও মা "ও তাই বল" বলল, তবুও, বুকটা ধুকপুক করছেই।
মা এসে দরজা খুলল। আহ। কী সুন্দর বিরিয়ানির গন্ধ। নিশ্চয়ই পাশের ফ্ল্যাটে খাচ্ছে।
"রুমুন, তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে আয়। আমি ডিনার সার্ভ করছি।"
বেশ বেশ। মায়ের মুড মনে তো হচ্ছেনা খুব খারাপ বলে। তাহলে হয়তো এ যাত্রায় বেঁচেই গেল রুমুন।
খাবার টেবিলে ওর সামনে এসে মা যখন বিরিয়ানির প্লেটটা রাখল, ঠ্যাংটা অত্যন্ত লোভনীয় ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে। ঠিক যেন ওকে উস্কাচ্ছে। কী অবাক কান্ড। "শনিবারে চিকেন? কী ব্যাপার মা?" রুমুন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালো।
"ইচ্ছে করছিল খুব। ফ্রিজে চিকেন ছিল। তাই বানিয়ে ফেললাম। আজ থেকে আর নো মোর সাচ মঙ্গল শনি।"
"চিয়ার্স মা। To new beginnings..." রুমুন মায়ের গলা জড়িয়ে গালে চুমু খেলো।

Saturday, January 5, 2019

to new beginnings 3

"মহামান্য আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী শ্রী দেবদীপ মিত্র এই মামলায় বেকসুর খালাস হলেন।" জজসাহেবের নির্দেশটা মাথা উঁচু করেই শুনল দেবদীপ। মিউজিয়ামের চুরির দায়ে মিথ্যে ফেঁসে যাওয়ার থেকে অবশেষে মুক্তি। মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার সেই অভিশপ্ত রাত্তিরের কথা। সবে ডিনার সেরে উঠছে। এমন সময় সদর দরজায় পুলিশের টোকা। তারপরে প্রতিবেশীদের কৌতূহলী নজরের সামনে দিয়ে থানা যাওয়া। লকাপ। পুলিশের জেরা। অফিস থেকে সাসপেনশন। তদন্ত চলাকালীন সকলের ওকেই দোষী ধরে নেওয়া। অসম্ভব অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কেটেছে দিনগুলি।

তবুও, প্রতি মুহূর্তে স্ত্রী সুচিত্রা আর কন্যা গুড্ডির আশ্বাসে নিজেকে সামলে রেখেছিল দেবদীপ। বারবার এই অপ্রয়োজনীয় হয়রানির মুহূর্তগুলো দুর্বল করে দিত ওকে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করেছে কতবার। মা বাবা আর স্ত্রী সন্তানের মুখ চেয়ে পারেনি। ভাগ্যিস।

আদালতের রায় শোনার পর সেদিনের সেই তথাকথিত বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা আজ ভিড় করেছে ওকে আবার আপন করে নিতে। কিন্তু দেবদীপর ওসবের জন্য এখন সময় নেই। শিগগিরই অফিস জয়েন করতে হবে। আর তারপর সপরিবারে নিছক একটা ছুটিযাপনের পরিকল্পনা করতেই হবে।

শুরু হতে চলেছে ওর জীবনে একটা নতুন অধ্যায়। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার লড়াইটা যে জিতে গিয়েছে ও।

To new beginnings...


Thursday, January 3, 2019

To new beginnings (1)

কুয়াশা ঘেরা রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটছে ওরা দুজন। অচেনা। অজানা। সামনে অনেকটা পথ চলা বাকি। সারাদিনের বৃষ্টিতে বাতাস স্যাঁতস্যাঁতে। কনকনে ঠাণ্ডা।
ছেলেটি নিজের গা থেকে কোটটা খুলে জড়িয়ে দিল মেয়েটির গায়ে।
মুহূর্তের উষ্ণতায় তৈরি হল এক নতুন বন্ধুত্ব।
To new beginnings... To a very happy new year 2019...

To new beginnings (2)

"শেষ মেশ তাহলে ইস্তফাটা দিয়েই দিলি?" অনিন্দ্যর টেবিলে এসে জিজ্ঞেস করলেন বোসদা।

"হ্যাঁ। বস রাজি হয়ে গেল। প্রথমে একটু দোনামনা করছিল। আমি বললাম পেন্ডিং কাজ সব শেষ করে দেবো। তখন গিয়ে রাজি হল।" অনিন্দ্য হাসি মুখে উত্তর দিল সহকর্মী বোসদাকে।

"ভেবেচিন্তে করেছিস তো বটেই। যাক তাহলে ফাইনালি মনের মতো কাজ করতে পারবি।" অনিন্দ্যর পিঠ চাপড়ে বললেন বোসদা।

"হুম। খেতে পাই না পাই, অন্তত দিনের পর দিন নিঃশ্বাস না নিতে পেরে হাঁপিয়ে উঠব না।" অমলিন হেসে উত্তর দিল অনিন্দ্য।


নিজের সাথে নিজের বহু কথা কাটাকাটির পর অনেক সাহস সঞ্চয় করে অবশেষে অনিন্দ্য এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। অনেকদিন ধরে অ্যাড এজেন্সিতে ওই ডেডলাইন আর ক্লায়েন্টের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে করতে কোথায় যেন নিজের শিল্পী সত্ত্বাটাকে হারিয়ে ফেলছিল। আর না। এবার থেকে শুধুমাত্র ফ্রিলানসিং। নিজের ইচ্ছেয়, নিজের মনের মতো কাজ।


To new beginnings...