১
মেরুন রঙের ইনোভাটা ঠিক সাতটার সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে দেবনদী হেরিটেজ হোটেলের সামনে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর ড্রাইভারসাব প্রথমে ফোন করে ও তারপর পাঁচ দশ মিনিটের ব্যবধানে ম্যানেজার, বেয়ারা সবার মারফত দুই তিনবার আরো রিমাইন্ডার পাঠিয়েছে রুম নম্বর ৩০৬এ। সেই রুমের বাসিন্দারা গতকাল দুপুরে কলকাতা থেকে হরিদ্বার পৌঁছেছে ট্রেনে। আজ গাড়ি নিয়ে ওই দম্পতি যাবে প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে রুদ্রপ্রয়াগে। ঘন্টা পাঁচেকের রাস্তা। সকাল সকাল বেরিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে যাওয়ার প্ল্যান। সেই মতোই গাড়িকে এরকম সময় বলে দেওয়া। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরোলো বছর আঠাশ উনত্রিশের যুবতী। পরনে নীল জিন্স, হলুদ জ্যাকেট। গলায় বেনারসি কাজ করা কালচে স্টোলটা বেশ কায়দা করে পেঁচানো। মাফলারের মতো। ছোট খোলা চুল। ডান হাতে একটা লাল টুকটুকে স্ট্রলি ব্যাগ, বাঁ হাতে মোবাইল। "হাঁ ভাইসাব, হম বস পাঁচ মিনিট মে হি নিকল যায়েঙ্গে। আপ ডিকি খোলো। সামান ডাল দো," এই বলে ও নিজের ট্রলিটা এগিয়ে আবার হোটেলের ভিতর ঢুকে গেলো। লবিতে ততক্ষণে ওর সঙ্গী যুবকটি চলে এসেছে। সোফায় বসে তাড়াহুড়ো করে জুতোর ফিতে লাগানোর চেষ্টা চলছে। "কী রে, আর কতক্ষণ লাগবে তোর? গাড়ি কখন থেকে দাঁড়িয়ে।" যুবতী একটু কড়া স্বরেই বলল। "এই তো, হয়ে এলো। তুই এই সুটকেসটা নিয়ে যা। আমি ব্যাকপ্যাক আর ক্যামেরাটা নিয়ে আসছি।" মেয়েটি একটু বিরক্ত মুখ করে নীল সুটকেসটা ঠেলতে ঠেলতে এগলো। ছেলেটি পাঁচ মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে পিঠে কালো হলুদ ব্যাকপ্যাক, কাঁধে ক্যামেরার ঢাউস ব্যাগ হাতে এসে দাঁড়ালো গাড়ির সামনে। মেয়েটি ইতিমধ্যেই চোখে স্টাইলিশ নীল সানগ্লাস পরে মাঝের সাড়িতে জানলার ধরে বসে গিয়েছে। ছেলেটি সামনের সিটে ব্যাকপ্যাক রেখে একবার লুকিং গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে উস্কো খুস্কো চুলগুলোকে ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করলো। ঘুম ভেঙেছে আজ এত দেরিতে, স্নানের সময় পায়নি। কোনক্রমে জিন্স আর গ্রে পুল ওভারটা গায়ে দিয়েই বেড়িয়েছে। গাড়ির ভিতর উঠতেই মেয়েটি নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে ওকে সানগ্লাসটা ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, "পরে নে। রোদ লাগলে তো আবার মাইগ্রেনের ব্যথায় কাতরাবি।" ছেলেটি কৃতজ্ঞ চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, "থ্যাঙ্ক ইউ। তুই না থাকলে যে কী হত আমার?" মেয়েটি বলল, "থাক, হয়েছে। এবার যাওয়া যাক। অনেক লেট হয়ে গিয়েছে অলরেডি।" ছেলেটি উত্তর দিল, "চলো পানসি রুদ্রপ্রয়াগ। চলিয়ে ড্রাইভারসাব, নিকলতে হ্যায় ইয়াহা সে।" হাসি খুশি অল্পবয়সী ড্রাইভারটি "হাঁ ঠিক হ্যায় সাব" বলে গাড়ির ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। গাড়ির ম্যুজিক সিস্টেমে শুরু হল কিশোর লতার "কাঞ্চি রে কাঞ্চি রে"। লং ড্রাইভে, বিশেষ করে পাহাড়ি রাস্তায়, এইসব গান বড় ভাল লাগে ওদের। আধ খোলা জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে ধাক্কা মারছে মেয়েটির মুখে। ছেলেটির বোঝাই যাচ্ছে ঘুম পুরো হয়নি। ইতিমধ্যেই ঝিমোতে শুরু করে দিয়েছে। গাড়ি চলছে হরিদ্বার শহর ছাড়িয়ে, এখনও সমতল। সকালের নরম রোদ আর চারপাশের গাছপালা সাথে নিয়ে ওরাও চলেছে।
জানলার বাইরে দেখতে দেখতে বারবার মেয়েটির মনে পড়ে যাচ্ছিল বছর পনেরো-ষোলোর আগের কথা। বাবা মায়ের সাথে সেইবারে কেদার বদ্রী ঘুরতে এসেছিল। এইসব রাস্তা দিয়েই তো গিয়েছে। মায়ের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে উঠলেই বমি পেত। অ্যাভোমিন ছাড়া গতি নেই। তাও, মাঝে মাঝেই ব্রেক নিতো। বাবা যত্ন করে মায়ের চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিত। তারপর আবার সফর চলত। এতগুলো বছর পর আবার এই একই রাস্তা দিয়ে যেতে ভালোই লাগছে। এবারে অবশ্য গন্তব্য আলাদা। রুদ্রপ্রয়াগ। ওখানেই দিন চারেক থেকে আবার হরিদ্বার হয়ে ফেরা। এর বেশি ছুটি পাওয়া যায়নি। দুজনেই নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে সাঙ্ঘাতিক ব্যস্ত। ছেলেটির দাদুর বাড়ি রুদ্রপ্রয়াগে। দাদু অনেকদিন ধরেই নাতি আর নাতবৌকে দেখবেন বলে আবদার করেছিলেন, তাই ছুটি নিয়ে এখানে আসা। কলকাতা থেকে হরিদ্বার আর হরিদ্বার থেকে কলকাতা ট্রেনে যাওয়া আসার আইডিয়াও মেয়েটির। মেয়েটি আদ্যোপান্ত নস্ট্যালজিক এবং রোম্যান্টিক প্রকৃতির। আর তাই ছোটবেলার শখ মেটাতে উপাসনা এক্সপ্রেসে এসেছে। ফার্স্ট এসি না থাকায় অবশ্য পুরো শখ মেটেনি। সাড়ে নটার দিকে বিয়াসি পৌঁছে রাস্তার ধারে একটা ধাবার সামনে গাড়ি থামালো ড্রাইভারজী। "ভাবী, চায় নাস্তা কর লিজিয়ে। আগে ঔর নেহি রুকেঙ্গে।" মেয়েটি ছেলেটিকে হাল্কা টোকা মেরে ঘুম থেকে তুলল। "কীরে কুম্ভকর্ণ"। ছেলেটি আধো ঘুম আধো জাগা হয়ে বিড়বিড় করল, "কী হল? এসে গেলাম?" মেয়েটি এবার "ওরে অগ্নি, ওঠ। ব্রেকফাস্ট করবি তো?" বলে অল্প খোঁচা দিল পিঠে। মেয়েটির কাঁধ থেকে মাথা তুলে চোখ কচলে একটা হাই তুলে অগ্নি এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, "কোথায় পৌঁছলাম? কী খাবার পাবো এখানে রুমুন?" রুমুন হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে নেমে বলল, "বিয়াসি। চল, দেখি। অ্যাট লিস্ট চা কফি তো পাবোই। আর কী খাওয়া যায় দেখি। তুই আলুর পরোটা খাবি নিশ্চয়ই পেলে?" আধ ঘন্টা পর চা-কফি-পরোটা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা রওনা দিল আবার। দাদুর বাড়ির উদ্দেশ্যে, রুদ্রপ্রয়াগ। এইবারে অগ্নির কাঁধে রুমুনের মাথা রেখে নিশ্চিন্ত ঘুমের পালা। মান অভিমান পর্বে সাময়িক বিরতি। রাস্তা ক্রমে চড়াই উতরাই হতে থাকে। দুই পাশে বড় বড় গাছ। রোদের তেজ বেড়েছে। তবুও হাল্কা শিরশিরানি ঠান্ডা আছে। নীল আকাশ। ঝকঝকে। মনোরম পরিবেশের মধ্যে দিয়ে ওদের গাড়ি চলতে থাকে। রেয়ার ভিউ মিরর দিয়ে মাঝে মাঝে ড্রাইভারজীর সাথে অগ্নির চোখাচুখি হলে দুজনের মধ্যে হাসি বিনিময় হয়। সাউন্ড সিস্টেমে এখনও পুরনো গান চলতে থাকে নিজের মতো। "হম দোনো, দো প্রেমী, দুনিয়া ছোড় চলে..."
২।
রুমুনের বরাবরের অভ্যেস সক্কাল সক্কাল উঠে পড়ার। বেড়াতে এসে তো আরোই তাই। সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। বাইরে এখনও ভালোই অন্ধকার। মাথার কাছ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, অনেকগুলো মেসেজ আর ইমেলের নোটিফিকেশন। মিনিট দশেক সেগুলোর ওপর চোখ বোলাল। বেশিরভাগই স্প্যাম বা অদরকারি। কয়েকটা কলেজের। কাজেরগুলো প্রথমেই "আনরেড" মার্ক করে রাখল। এইবারের বেড়ানোয় এইটাই ওর ইচ্ছে। অগ্নিকেও তাই বলেছে ও। এমারজেন্সি ছাড়া কাজের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না কটাদিন। কাজের চাপে এমনিতেই দুজনেই এখন খুব ব্যস্ত, চিঁড়েচ্যাপটা। হাঁপিয়ে উঠেছে দুজনেই। আগে ওদের ন'মাসে ছ'মাসে ঝগড়া হত, এখন হচ্ছে প্রায় রোজ। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপারে। সেইসব সমস্যার সমাধানের জন্যই মূলত এই চার পাঁচ দিনের ছুটিতে আসা। এটা নিয়েও তো কম অসুবিধে হয়নি। ডিসেম্বরে সেমেস্টারের শেষে যখন ওর কাজের চাপ একটু কম, তখন অগ্নির অফিসে কাজের পাহাড়। ওর ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনা এই ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে। তখন আবার রুমুনের সেমিস্টার তুঙ্গে। তবুও অনেক বলে কয়ে আগে এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে কলিগদের ম্যানেজ করে ছুটি নিয়েছে ও। এই আশায় যে রোজের অভ্যেস থেকে দূরে এলে হয়তো সম্পর্কটা পুরনো চার্ম ফিরে পাবে। চার বছরের কোর্টশিপের পর দেড় বছরের দাম্পত্যেই ইতিমধ্যে এসেছে অদ্ভুত স্থিতাবস্থা। সব কিছু কেমন একঘেয়ে, সামান্য পান থেকে চুন খসলেই কথা কাটাকাটি। রুমুন খুব চেষ্টা করছে নিজেকে ঠিক রাখার, মাথা গরম না করার। এক কালে অগ্নির যে অভ্যেসগুলো ভীষণ ভালো লাগত, সেইগুলিই এখন দুই চোখের বিষ লাগে। তবুও নিজেকে সংযত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো পারছে, কখনো না। এই তো, সেদিন হাওড়া থেকে যে ট্রেনে উঠল, ঠিক শেষ মুহূর্তে অফিস ছুটতে হয়েছিল অগ্নিকে। রুমুনকে, "তুই লাগেজ নিয়ে স্টেশন চলে যা, আমি সময় মত পৌঁছে যাব" বলে ও সেই সক্কাল সক্কাল বেরোল। একটায় ট্রেন। দৌড়তে দৌড়তে অগ্নি পৌঁছল ঠিক একটা বাজতে দশ মিনিটে। রুমুনের ততক্ষণে প্যানিক অ্যাটাক আসার জোগাড়। বারবার ফোনে, "হ্যাঁ এই আসছি" শুনছে ও, এদিকে ঘড়ির কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে। অগ্নির দেখা নেই। তাহলে কি শেষ মুহূর্তে ট্রেন মিস করবে অগ্নি? ও এসে না পৌঁছলে রুমুন কী করবে? একা একা চলে যাবে? এত সোজা? এ কি জীবন নাকি সেলুলয়েড? যখন অগ্নি এসে পৌঁছল, রুমুন ওকে দেখে নিশ্চিন্ত হল বটে, কিন্তু এবারে রাগ শুরু হল। যতই অগ্নি "সরি, খুব জ্যাম ছিল ব্রেবোরন রোডে", "আমি কিন্তু ঠিক সময়েই বেরিয়েছিলাম, ওলার বুকিং দেখ" ইত্যাদি বলে ওর রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করুক, রুমুন সারাদিন আর কথাই বলেনি ওর সাথে। মায়ের প্যাক করে দেওয়া সুস্বাদু লাঞ্চ অগ্নিই বেশ তরিবৎ করে সারভ করে দিল রুমুনকে। রুমুনের ফেভারিট সব আইটেম। এমন কী, কেচাপ দিয়ে স্মাইলিও এঁকে দিল ও। তবুও রুমুনের মুখে কথা নেই। মাঝে মাঝে কেন যে এমন করে? অগ্নি বুঝে উঠেতে পারে না। এত মুড সুইং?
এবারে ট্রেনে ওরা দুজনে পেয়েছে ওপর নিচের সাইড লোয়ার আপার সিট। আপাতত দুজনেই লোয়ার বার্থে মুখোমুখি বসে। দুজনের হাতে দুটো বই। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে বদলে যাওয়া প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা। স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম, পুকুর, মাঠ, গ্রাম, চাষ জমি। সন্ধ্যের পর অবশেষে রুমুনের অভিমান পর্ব মিটল। নিজের থেকে? নাকি বারবার অগ্নির দিক থেকে চেষ্টা দেখে এই গলে যাওয়া? যাই কারণ হোক, শেষমেশ এতে দুজনেই খুশি। এতক্ষণ মোটেই কারুর ভালোই লাগছিল না। আগামী কটাদিনের ছুটি খুব ভালো করে কাটাতে হবে। সেই সবের কথাবার্তা আলোচনা করতে করতে রাত হল।
হরিদ্বারে ওরা ছিল আধ বেলা মতো। তারই মধ্যে দুজনে গঙ্গার ঘাটে বসে অনেকটা সময় কাটালো। এ কথা সে কথা, স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। হর-কি-পউরিতে গঙ্গারতি, পাতার নৌকোয় দেবাঞ্জলি ভাসানো, দিব্যি কাটল। দুজনেই খুশি। রুমুন ভাবল, বুঝি বেড়ানো কাজে দিচ্ছে। পরিবেশ বদলে ব্যবহার বদল, ভালোর দিকে। ও মা, সব আশায় জল ঢেলে আবার তো কাল সকালে দেরি হওয়া নিয়ে আরেক প্রস্থ ঝগড়া হল দুজনের। আসলে অগ্নি রাত জেগে বই পড়ছিল। রুমুন বারবার মনে করিয়েছে, পরেরদিন সক্কাল সক্কাল উঠতে হবে। তাও শোনেনি। অবধারিত পরেরদিন লেট। বিয়াসী পৌঁছনো অবধি তো কথাই বলেনি রুমুন অগ্নির সাথে। তারপর কখন যে অবশ্য অগ্নিরই কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘুম ভেঙ্গেছে একেবারে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছে। ওই অপূর্ব পরিবেশে মনের সব ক্লান্তি ও গ্লানি উধাও। রুমুন জানে, ওদের এই ওঠাপড়াগুলো খুবই সাময়িক। এবং অনেকটাই সাইন কার্ভের মতোই পিরিয়ডিক। দুজনকেই যত্ন করে সম্পর্কটাকে বাঁচাতে হবে। শুরুর দিকের ঝড়ঝাপটাগুলোর স্মৃতি যে এখনও টাটকা।
ভাবনাচিন্তাগুলো মনটাকে বড্ড এলোমেলো করে দেয়। জানলার বাইরে তাকিয়ে রুমুন দেখল, আলো ফুটতে শুরু করেছে। চটপট লেপের ভিতর থেকে বেরিয়ে হাত মুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলো ও। একটু হাঁটতে বেরোবে। কাল দাদুর থেকে রাস্তাঘাটের ডিরেকশন জেনে নিয়েছে। দুই নদীর সঙ্গমের দিকেই যাওয়ার ইচ্ছে। ভেবেছিল অগ্নিকে নিয়ে বেরোবে, কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হল। ঘুমোতে এত ভালোবাসে। একদম বাচ্চাদের মতো কুঁকড়ে শুয়ে আছে। লেপটা ওর গায়ে আরো একবার ভালো করে টেনে দিয়ে কপালে আলতো চুমু খেয়ে রুমুন বেরোল। ওর স্পর্শে যেন অগ্নি আরো আয়েশ করে শুল। দাদুর ঘরের সামনে থেকে যখন যাচ্ছিল, আবছা গানের সুর ভেসে আসছিল সেখান থেকে। বোধহয় রেডিও। শুনতে পেল, "ভোর ভয়ে পনঘট পে / মোহে নটখট শ্যাম সতায়ে / মোরি চুনরিয়া লিপটি যায় / ম্যায় ক্যা করু হায়ে রাম হায়..."
৩।
দাদুর বাড়িটা জোশিমঠ রোডের ওপর। একদম বিড়লা গেস্ট হাউজের গায়েই বলা চলে। বাগান থেকে অদূরে নদীর সঙ্গম দেখা যায়। একদিকে অলকানন্দা, অন্যদিকে মন্দাকিনী। অপূর্ব এই সমাগম দৃশ্য। দুই নদীর দুই বিশিষ্ট রঙ মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে। সেই আদি অনন্তকাল থেকে। এদিকে বাড়ির বাগানের ফুলগুলি ফুটে এক রঙিন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গোলাপ, ডালিয়া, কসমস, জিনিয়া, গাঁদা - রং বাহারি সৌন্দর্য। সকালের টাটকা বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে রুমুন চলতে লাগল সঙ্গমের দিকে। দশ মিনিটে পৌঁছেও গেল। সূর্য উঠে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। মন্দাকিনীর পার বরাবর পাঁচ বছর আগে যে ভয়ঙ্কর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বন্যায়, তার চিহ্ন এদিক ওদিকে বর্তমান। বেশ এখনও বোঝা যায়। রুমুনের মনে পড়ে সেই যে ছোটবেলায় যখন এসেছিল, তখনের রুদ্রপ্রয়াগ আর আজকের রুদ্রপ্রয়াগে কত পার্থক্য। কত পরিবর্তন। সত্যিই, পরিবর্তনই তো ধর্ম। এই এতগুলো বছরে কি ওর নিজের মধ্যে পরিবর্তন আসেনি? মানুষ হিসেবে অনেকটা পরিণত হয়নি? প্রকৃতির তো বদল ঘটবেই। নদীর ওপর দিয়ে যে ছোট্ট পায়ে চলার সাঁকোটা ছিল, সেটাও আর নেই। নারদ শিলাটিও বন্যার পর হারিয়ে গিয়েছে। জীবন থেকে বহু মানুষের মতোই। এইসব নানান এলোমেলো চিন্তাভাবনার মধ্যেই ছিল ও। এমন সময়ে কানে ভেসে এলো বাংলায় কথাবার্তার টুকরো। এদিক ওদিক তাকিয়ে রুমুন দেখল, পাঁচজনের একটা ছোট দল। বাবা, মা, দাদু, ঠাকুমা বা দিদিমা আর বছর নয় দশের এক ছেলে। ছেলেটি কিছুতেই মাঙ্কি ক্যাপ পরবে না। আর মাও ছাড়বে না। এই বয়সের এক্কেবারে চিরপরিচিত সংগ্রাম। ওদের সাথে চোখাচুখি হতে রুমুন হাসল। "বাঙালি"? জিজ্ঞেস করলেন বাচ্চাটির বাবা। "হ্যাঁ", হেসে উত্তর দিল রুমুন। "কেদার না বদ্রী?" জিজ্ঞেস করলেন উনি। "আপাতত এবারে শুধুই রুদ্রপ্রয়াগ।" রুমুন বলল। ও জানে কথা আরও চলবে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর একদম ইচ্ছে করছিল না। আগেভাগেই তাই "আচ্ছা আমি একটু ওদিকটা যাই" বলে সরে গেল।
এইদিকটা একটু ভিড় কম। অলকানন্দার দিকে। দূরে হলেও সঙ্গম স্থল দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে ওখানে। অনেকেই ঘাটে বসে পুজো করছে। আস্তে আস্তে ছোট ছোট দোকানগুলি খুলছে। খানিকক্ষণ বসে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রুমুনের একটু চা তেষ্টা পেল। এই ঠান্ডায় গরম এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। পিঠে একটা হাল্কা টোকা পেয়ে রুমুন মুখ তুলে তাকালো। "কখন এলে দিদিভাই?" সদা হাসি খুশি দাদু। কখন এলো দাদু এখানে? "এই তো এই ঘন্টাখানেক হবে প্রায়", রুমুন কবজি ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখে বলল। "তুমি?"
দাদু হেসে বলল, "আমি এই এখন এলাম। আরো আগে আসতাম। তবে বড্ড ঠাণ্ডা তো, তাই ভোরের দিকে এক্কেবারে বেরোইনি।"
"হ্যাঁ, আমি যখন এলাম, সূর্য ওঠেনি। বেশ ঠাণ্ডা ছিল।"
" চা খাবে নাকি দিদিভাই?"
"হ্যাঁ, চলো। আমিও ভাবছিলামই তাই।"
"চলো তাহলে। আমি যেখানে রোজ যাই, সেইদিকে এসো।"
রুমুন আর দাদু হাঁটতে থাকে পাশাপাশি। দাদুর বয়স আশি ছাড়িয়েছে। অথচ এখনও কী ঋজু চেহারা। শরীরে এতটুকুও বার্ধক্যের ছাপ নেই। ঠিক যেন সিনেমার এভারগ্রিন হিরো। একটা গাঢ় নীল ট্র্যাকপ্যান্ট, মোটা খয়েরি পুল ওভার, লাল মাফলার, কালো টুপি, চোখে রিমলেস কেতাদুরস্ত চশমা। এই বয়সেও কী স্টাইলিশ দাদু। রুমুন মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে দাদুকে, হাতে চায়ের কাপ নিয়ে। ওরা মিনিট দশেক হাঁটার পর এসে পৌঁছেছে মঙ্গল সিং এর চায়ের দোকানে। ছোট্ট একটা ঝুপড়ি। কাঠের দুটো বেঞ্চি পাতা। কালো হয়ে আসা কেটলিতে গরম হচ্ছে চা। কাঠের আঁচে। ওরা ছাড়া আর এক দুজন মাঝে মাঝে এসে চা নিয়ে যাচ্ছে ফ্লাস্কে। তারা বেশিরভাগই আশেপাশের দোকানদার। গরম চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে আয়েশ করে এক চুমুক দিয়ে রুমুন বলল, " দাদু, তুমি এই বয়সেও কী হ্যান্ডসাম গো!"
"এই বয়স আবার কী? আমার বয়স কত জানো?"
"এইট্টি প্লাস। মামণিই তো অলমোস্ট সিক্সটি।"
"এইট্টি থ্রি টু বি প্রিসাইস। আই আম আ ইয়ং ম্যান অফ এইট্টি থ্রি।" রুমুন লক্ষ্য করল, হাসলে দাদুর চোখের কোণ কুঁচকে যায়। তাতে যেন আরো সুন্দর দেখায় দাদুকে।
"হুম, সে তো আমি জানি। দিম্মা নিশ্চয়ই তোমার এই হ্যান্ডসাম লুক দেখেই বোল্ড আউট হয়েছিল?" দাদু উত্তরে কিছু বলল না। বরং একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে রইল।
"কী গো? বলো?" রুমুনের গলার স্বরে বোঝা যায়, বেশ একটা গল্পের আমেজ এসেছে।
দাদু এইবারে পকেট থেকে কালো মানিব্যাগটা বের করলো। খুলে সেখান থেকে একটা ছোট ছবি হাতে নিলো। সাদা কালো। বহু বছরের পুরনো। হলুদ হয়ে আসা। সযত্নে সেটি দাদু রুমুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, " এই দেখো দিদিভাই। আমাদের ফার্স্ট অ্যানিভারসারির দিন স্টুডিয়োতে গিয়ে তোলা।" রুমুন "দেখি দেখি" বলে হাতে নিলো ছবিটা। অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে একদৃষ্টে। তারপর একবার দাদুর দিকে, একবার আবার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, "তোমায় তো চেনাই যাচ্ছেনা দাদু। কী হ্যান্ডসাম। ঠিক যেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর দিম্মা ওয়াজ সো প্রিটি, ঠিক যেন সুচিত্রা সেন। ওয়াও।" দাদুর চোখ চিকচিক করে উঠল। বলল, "এখনও মনে আছে জানো দিদিভাই এই দিনটার কথা। তখন আমি কলকাতায় থাকি। নতুন চাকরি। সারাদিন অনেক খাটুনি। তোমার দিম্মাকে একা ঘর সংসার সামলাতে হয়। এই সময়টা প্রচণ্ড স্ট্রাগল করেছি। দেশের বাড়িতে টাকা পাঠাতে হত। কলকাতার ভাড়া বাড়ির খরচাও নেহাত কম ছিল না। যত সম্ভব ওভার টাইম করেছি। তোমার দিম্মা কোনদিনও কমপ্লেন করেনি। আমার খুব খারাপ লাগত। খুব খারাপ লাগত। চেষ্টা করতাম উইক্লি অফের দিন বেরোতে। পায়ে হেঁটে বাসে ট্রামে কত হেঁটেছি, ঘুরেছি। ভিক্টোরিয়া,ময়দান, সাহেব পাড়া। বোর্ন অ্যান্ড শেপারডের সামনে দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়েছি। ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট ছবি দেখেছি হাঁ করে। দুজনেই। চোখে এক রাশ মুগ্ধতা। সেরকমই একদিন আমি ঠিক করেছিলাম, রেণুকে নিয়ে আমাদের প্রথম অ্যানিভারসারিতে স্টুডিয়ো গিয়ে আমাদের ছবি তোলাব।"
"ও, দ্যাট ইস সো রোম্যান্টিক দাদু।" রুমুন বলল।
"শুধু তাই নয় দিদিভাই। গোটা ব্যাপারটাই ওয়াজ আ সারপ্রাইজ।"
"দিম্মা নিশ্চয়ই দারুণ খুশি হয়েছিল?"
"তা তো হবেই। আনন্দে আবেগে আত্মহারা।"
"আর এই জন্যই ছবিটা এত সুন্দর। তাই না?"
"জানো দিদিভাই, আমি প্রতি বছর বিবাহবার্ষিকীতে স্টুডিয়ো গিয়ে ছবি তুলিয়েছি দুজনের। বেড়াতে গিয়েও সব সময় ছবি তুলিয়েছি। তোমার শাশুড়ি, মামা শ্বশুর তাদের জন্মের পরেও এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয়নি। ইভেন যে বছর তোমার দিম্মা চলে গেল, সেইবারেও। ও তখন ভালো মতোই অসুস্থ। তবুও বাড়িতে ক্যামেরাম্যান ডেকে ফটো তুলিয়েছি। বাড়ি চলো, তোমায় অ্যালবাম দেখাবও। আমি মাঝে মাঝেই ওগুলো খুলে বসি। যেদিন যেদিন রেণুর জন্য ভীষণ বেশি মন খারাপ লাগে, মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওকে স্বপ্নে দেখে... বা কোন কোন অলস দুপুরে হঠাৎ কোন বই পড়তে গিয়ে ওর পেজমার্ক দিয়ে রাখা কোন পাতায় পৌঁছে, বা কোন গান শুনতে শুনতে। তোমার দিম্মার গানের গলা অসামান্য ছিল, জানো তো? বিয়ের পরে নিয়মিত আমায় শোনাত।একটা হারমোনিয়াম নিয়ে এসেছিল বাপের বাড়ি থেকে। ওর খুব প্রিয় ছিল। রোজ ওটাকে বের করত বাক্স থেকে। গুনগুন করত। রেওয়াজ করত। ছেলে মেয়ে দুটোকেও ছোটবেলায় ওই তো গান শিখিয়েছিল। শাশুড়ি মায়ের গান শুনেছ?"
রুমুন মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। মামণির গানের ফ্যান ও।
"ও তো মায়ের কাছেই গান শিখেছে। রেণু বলত। সোহিনীর গানের গলা ভালো। মা মেয়ে দুজনে মাঝে মাঝেই গানের আসর বসাত। তখন আমার চাকরি বদলেছে। জীবনে এসেছে স্বচ্ছলতা, সাথে অনেকটা আরাম। দেশের বাড়ির দায়িত্ব চলে গিয়েছে। ওই সময়টা আমরা খুব বেড়াতাম। আর যে কোন জায়গায় গেলেই গান হত। মনে আছে সে বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা চারজন রুদ্রপ্রয়াগেই এসেছি। তখন রাস্তাঘাট মোটেই এত ভালো ছিল না। দুর্গম। কেদার বদ্রী যাব। পূর্ণিমার রাত। নদীর সঙ্গমে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে। রেণু আর সোহিনী গান ধরল। একটার পর একটা। 'এই লভিনু সঙ্গ তব', 'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে', আরো কত। এইসব গান শুনলে এখনো রেণুর জন্য খুব মন কেমন করে। তখন বসে বসে পুরোনো ছবিগুলো দেখি। আমায় কীরকম ফাঁকি দিয়ে চলে গেল দেখো?"
রুমুন চোখ বোজে। চোখের সামনে যেন দেখতে পায় সাদা কালো ছবির থেকে উঠে আসা এভারগ্রিন দাদু দিম্মাকে। একটা প্রাণোচ্ছ্বল জীবন। সাংসারিক সুবিধা অসুবিধা দায় দায়িত্ব। সব আছে। কিন্তু কোথাও যেন তার মধ্যে রয়েছে অনেকটা হাসি, আনন্দ। ও নিজের আর অগ্নির এমন ছবি ভাবার চেষ্টা করে। সেই কোর্টশিপের সময় মনে পড়ে। আর তারপর হানিমুনে লাদাখ। তারপর? তারপর আর ছবি কই? মুহূর্ত কই? এত ব্যস্ততা? এত কাজ? দুজনের সময় কই? না হয় হিল্লি দিল্লি হলো না। কিন্তু নিজেদের যা আছে যেটুকু, সেটুকুও কি ওরা লালন পালন করছে?
"দিম্মাকে খুব মিস করো, না?" রুমুন জিজ্ঞেস করে।
"খুউব। ফিফটি ফাইভ ইয়ার্স অফ টুগেদারনেস। আর তারপর ওই যে আমায় ঠিক ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। ভেবেছিল আমিও বোধহয় সাথে যাবো। রেণু বুঝলই না। আমার এখনও অনেক বাঁচা বাকি। কত জায়গা ঘুরতে হবে বলো তো দিদিভাই?"
"তাই না তাই? তুমি তো আমার ইয়ং ম্যান। এসো দেখি একটা সেলফি তুলে ইন্সটাতে দেবো। স্টার্টিং এ ব্র্যান্ড নিউ ডে উইথ মাই এভারগ্রিন হিরো।" রুমুন মোবাইলের সেলফি মোড অন করতে করতে বলে। ছবি তোলা হয়ে গেলে দাদু এবার কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা থেকে একটা ফ্রেমবন্দী ছবি বের করে দেখায় রুমুনকে। রঙিন ছবি। দিম্মার একার। এক মাথা ধবধবে সাদা চুল। খোঁপা করা। সাদা শাড়ি লাল পাড়। একই লাল সাদা ব্লাউজ। কপালে এত্ত বড় সিঁদুরের টিপ। মুখে হাসিটি অমলিন। "এটা রেণুর শেষ ছবি। তখন চরম অসুস্থ। তবুও ছবি তোলার নামে দেখো, কী সুন্দর হেসেছে। ভারী ফটোজেনিক ছিল কিন্তু। কে বলবে দেখে যে তখন অতো কড়া কড়া ওষুধ চলছে? এই ছবিটা নিয়ে ঘুরি সব সময়। এদিক ওদিক যেখানেই যাই না কেন। সাথে থাকে। ভিউ পয়েন্টে গিয়ে ওর ছবি বের করে দুজনে বসে প্রকৃতি দেখি। ওর বেড়ানোর খুব শখ ছিল জানো। চাকরি সূত্রে যখন এই কাছের শ্রীনগরে পোস্টিং পাই, তখন থেকেই বলে রেখেছিল। রিটায়ার করার পর আমরা রুদ্রপ্রয়াগে থাকব। আসলে ও পাহাড় খুব ভালবাসত। রুদ্রপ্রয়াগকে ও খুব ভালোবাসতো। বন্যার পর ওর ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। শহরটার এই তছনছ অবস্থা দেখতে পারতো না। তবে পুরোপুরি জায়গাটার গুছিয়ে ওঠার আগেই তো ও চলে গেল। এখনও কোন নতুন জায়গায় গেলে ওকে খুব মিস করি। ওর উইশলিস্টের প্রায় সব জায়গায় গিয়েছি। শুধু বাদ গিয়েছে সুইজারল্যান্ড। যখন বয়স ছিল, সামর্থ্য ছিল না। পরে সামর্থ্য হল। কিন্তু নানান কারণে যাওয়া হয়ে উঠল না আর। এটাই আক্ষেপ জানো?"
রুমুন চুপ করে শুনছে। কী অসম্ভব ভালোবাসা। এত বছরের সাহচর্য, সঙ্গদান, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক। আর এই ওরা দুজন। শুধুই নিজস্ব গোলস আর অ্যাম্বিশনসের পিছনে ছুটছে। কী লাভ হচ্ছে? দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। কিন্তু মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে কি? পরবর্তী প্রজন্মকে কী গল্প বলবে?
"একী দিদিভাই, কাঁদছ নাকি?" দাদুর কথায় সম্বিত ফেরে রুমুনের। কখন যে দাদু-দিম্মার গল্প শুনতে শুনতে একাত্ম হয়ে ওর দুই চোখ ছাপিয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে, ও খেয়ালই করেনি।
"না, কিছু না দাদু। চলো এবারে ফেরা যাক। ব্রেকফাস্ট করে তোমার অ্যাল্বামগুলো দেখবো। বলো কী খেতে চাও আজ?"
" সে চলো। কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টিয়ো না দিদিভাই। দাদুভাইয়ের এগেন্সটে এনি কমপ্লেন্ট?"
"না না তা না দাদু।"
"উহু। আমার অভিজ্ঞ চোখ দিদিভাই। তোমাদের দুজনের এই অধ্যায়ে যে কেমিস্ট্রি থাকার কথা, তা আমি মোটেই দেখছি না। এমন তো হতে দেওয়া যায় না। আমার নাতি হয়ে দাদুভাই এরকম করবে, অমার্জনীয়। যা বুঝছি, ছেলেকে একটু শেখাতে টেখাতে হবে। ছোটি সি বাত সিনেমাটা দেখেছো?"
"হ্যাঁ। গানগুলো বড্ড সুন্দর।"
"হুম। ওখানে অশোক কুমারের রোলটা মনে হচ্ছে আমায় প্লে করতে হবে তোমার অমল পালেকরের জন্য। চিন্তা করো না দিদিভাই। আমি সব ঠিক করে দেবো। তা তুমি ব্রেকফাস্ট বানাবে বলছিলে না? একটু চিড়ের পোলাও বানিয়ে দেবে? ভানু সিং একদম পারে না ওটা। এদিকে তোমার দিম্মার এক্সপারটিজ ছিল ওতে। দেখি তুমি পারো কি না।"
৪।
ব্রেকফাস্টের পর অনেকটা সময় জুড়ে দাদুর কাছে বাগানে বসে অগ্নি আর রুমুন পুরনো অ্যাল্বামগুলো দেখল। আরো কত স্মৃতিচারণা। কথা বলতে বলতে দাদু যেন বারবার সেই চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে পৌঁছে যাচ্ছিল। ওদের মনে হচ্ছিল, ঠিক যেন বড় পর্দায় বসে কোন সিনেমা দেখছে। ভালোবাসার গল্প।
বারোটার দিকে আকাশ কালো করে এলো। "দাদুভাই, বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। চলো ভিতরে যাওয়া যাক" বলে দাদু অ্যালবামগুলো তুলে বাগান থেকে ঘরের দিকে উঠে গেল। অগ্নি দেখল, রুমুন কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
"কীরে চল? বসে থাকবি? ভিতরে চল। এক্ষুণি তো ঠাণ্ডা লাগাবি আর হাঁচি কাশি শুরু হবে।" রুমুনের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে অগ্নি জিজ্ঞেস করে। রুমুন যেন ঠিক এই স্পর্শের জন্যই আকুল হয়ে বসেছিল। ডান হাতটা দিয়ে অগ্নির হাতটা আঁকড়ে ধরে মাথা কাত করে ওর দিকে তাকালো। তাকিয়েই রইল। কোন কথা নেই।
"কী রে? কী বলবি?" অগ্নি আবারও জিজ্ঞেস করে।
"অগ্নি, আমি জানি, আমার মধ্যে অনেক ইম্পারফেকশন। আই অ্যাম অ্যা ব্যাগেজ অফ ইমোশনস। তাও, কথা দে কোনদিনও আমায় ছেড়ে চলে যাবি না।" আস্তে আস্তে রুমুন কথাগুলো বলে।
"অ্যাঁ? কী হয়েছে টা কী? এ আবার কেমন কথা? কীসব জিজ্ঞেস করছিস রুমুন?" অগ্নি অবাক হয়ে বলে।
"না তুই প্লিজ আমায় কথা দে।" রুমুনের গলায় আর্তি যেন ভীষণভাবে প্রকট।
অগ্নি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, " এ তো কবেই প্রমিস করেছি। আজ আবার নতুন করে কেন?"
"তুই দাদুর কাছে বসে কখনও দিম্মার কথা শুনেছিস?" রুমুন জিগেগস করে।
"সেরকমভাবে না। ওই টুকটাক। কেন?" অগ্নি বলে।
"আমি শুনেছি। আজ সকাল থেকে শুনেছি। অ্যান্ড দ্যাট গট মি থিঙ্কিং।" রুমুন বলতে থাকে। "দে হ্যাড দেয়ার শেয়ারস অফ রেস্পন্সিবিলিটিজ। তাও দেখ, দে হ্যাড আ লাইফ। আ হ্যাপি ওয়ান। আমরা তাহলে কেন পারছি না বল তো?"
"আমরা হ্যাপি নই?" অগ্নি একটু অবাক হয়েই প্রশ্ন করে।
"আর উই?" রুমুনের পাল্টা প্রশ্ন।
"অফ কোর্স উই আর। দিনের মধ্যে চৌদ্দবার ইন্সট্যা আর ফেসবুকে দশটা পোস্ট দিইনা, পি ডি এ করিনা, কিন্তু তা বলে কি আমাদের ভালোবাসায় কমতি আছে নাকি? অগ্নি রুমুনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে। পরিস্থিতি হাল্কা করতে ও রুমুনের খুব পছন্দের একটা গান ধরে, "ধূপ লগে যাহা তুঝে ছায়া বনু, আজা সজনা..."
কাঁপা স্বরে রুমুন বলে, "এক সাথে বুড়ো-বুড়ি হবো তো আমরা? আমায় ছেড়ে চলে যাবি না তো?"
"ধুর পাগলী। তোর হলোটা কী? ছেড়ে যাবো কোন দুঃখে? ইউ আর দ্য বেস্ট দ্যাট হ্যাপেন্ড টু মি। সাত জন্মের জন্য তো এগ্রিমেন্ট হয়েই আছে। ভাবছি এক্সটেন্ড করিয়ে নেবো সেটার।" হাওয়ায় ওর রুমুনের ফুরফুরে চুলগুলোকে ঘেঁটে দিয়ে বলে অগ্নি।
"প্রমিস?" রুমুন ঠোঁট ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করে।
"গড প্রমিস। দাঁড়া তোকে একটা জিনিস তাহলে দেখাই। ভেবেছিলাম ওটা আমার সিক্রেট। তবে আজ মনে হচ্ছে দেখাতেই হবে।" এই বলে অগ্নি ওর ট্যাবে কিছু খুটখাট শুরু করল। রুমুন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করে, "কী?"
"দাঁড়া, দেখাচ্ছি। আমার গাইডলাইন্স।" এরপর ট্যাবে একটা এক্সেল শিট বের করে রুমুনের দিকে দিয়ে বলে, "এই নে। পড়।"
রুমুন ট্যাবটা হাতে নেয়। দেখে লেখা, "আওয়ার গোলস"। এবং সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বছর ভিত্তিক কবে কোথায় যাবে, বেড়াবে, বাড়ি কিনবে, গাড়ি কিনবে, ইনশিয়োরেন্স, সবের ফর্দ, তালিকা।অগ্নি খুব গুছিয়ে কাজ করে, রুমুন জানে। কিন্তু তা বলে এতটা ভাবতে পারেনি। ও বেশ অবাক হয়েই তাই জিজ্ঞেস করে, "এটা একজ্যাক্টলি কী?"
"এটা আমাদের আগামী দিনগুলোর জন্য একটা রাফ রোড ম্যাপ।যদিও ফাইনাল না, তবুও এটাকেই গাইডলাইন মেনে চলছি, চলব।" অগ্নি বলে।
"এবার একটু কপট রাগতস্বরে রুমুন বলে, "আওয়ার, এদিকে আমায় একবারও কন্সাল্ট করিসনি তো?"
অগ্নির ঝটপট উত্তর আসে, যেন তৈরিই ছিল এই প্রশ্নের জন্য। "ওই যে, নীচে দেখ। লেখা আছে, টারমস অ্যান্ড কন্ডিশনস অ্যাপ্লাইড। ওটাই এটাকে হ্যান্ডল করবে। তোর পরামর্শ ছাড়া কিছু হয় নাকি রে? এটা ওই যে বললাম, রাফ ড্রাফট।" অগ্নি হাসে। রুমুনও এইবারে বলে, "তাহলে এক লাইনে সামারাইজ কর।"
"উফ, প্রফেসর ম্যাডাম, এটা তোর ক্লাসরুম নাকি? সামারাইজ কর! কী দাবী!" মজার ছলে অগ্নি বলে।
"শোন, বিয়ের পর বরদের স্ট্যাটাস হতে হয় বউয়ের ওবিডিয়েন্ট স্টুডেন্ট। নইলে... " চোখ পাকায় রুমুন।
অগ্নিও দুই কানে হাত দিয়ে বলে, "আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। বলছি। টু সামারাইজ, লেট মি গেট ডাউন অন মাই নীজ অ্যান্ড আস্ক, মিসেস সেন, উইল ইউ লেট দিস অধম গ্রো ওল্ড উইথ ইউ?"
রুমুন খানিক তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। কিছু বলতে পারে না। তারপর জড়িয়ে ধরে অগ্নির বুকে মুখ গুঁজে দেয়। আর তখনই আকাশ ভেঙ্গে নামে বৃষ্টি। প্রেমধারা।
৫।
মাস তিনেক পরের ঘটনা। দুটো স্ট্রলি আর কাঁধে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে এয়ারপোর্টের এন্ট্র্যান্সের বাইরে দাঁড়িয়ে রুমুন। পরনে লাল সাদা ঢাকাই শাড়ি। শ্যাম্পু করা চুল যত্ন করে খোঁপায় বাঁধা, তাতে আবার জুঁই ফুলের মালা লাগানো, দুই চোখে মোটা করে কাজল পরা, কপালে এই এত্ত বড় সিঁদুরের টিপ। দুই হাতে শাঁখা পলা আর সরু সোনার চুরি চারগাছা পরে এক্কেবারে বাঙালি বউ লাগছে। বার বার বাঁ হাত ঘুড়িয়ে ঘড়ি দেখছে। ভুরু কিঞ্চিত কুঁচকে গিয়েছে। এইবারে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করল অগ্নির নম্বরে।
"ওরে, কতদূর পৌঁছলি? আজকেও লেট করবি নাকি? প্লিজ, এটা ইন্টারন্যাশ্নাল ফ্লাইট। উপাসনা এক্সপ্রেস না। ফ্লাইট মিস করলে কিন্তু আমি জানি না।" উত্তেজিত রুমুন এক নাগাড়ে বলতে থাকে। অপরদিকে অগ্নি হেসে বলল, "আরে রিল্যাক্স বাবা, রিল্যাক্স। আমি আসছি। অলমোস্ট দেয়ার। ডিপারচারের রাস্তায় উঠে পড়েছি।"
"বড্ড জ্বালাস জানিস তো তুই? জানিস আমি প্যানিক করি। তাও এরকম করেই যাবি।" রুমুন একটু দুখী গলায় বললেই অগ্নি গলে যায়। "এই সরি সরি। দাঁড়া, ব্যাগে চকলেট এনেছি। গিয়েই দিচ্ছি। এবার তো ক্ষমা কর।"
রুমুন হাসতে হাসতে বলে, "শোন, মা সহ্য করেছে। বউ কিন্তু সহ্য করবে না। এই বলে দিলাম।" ফোনের উল্টোদিক থেকে অগ্নিরও হাসির রোল শোনা যায়। প্রাণখোলা এই হাসি।
আজ ওরা দুজনে এক সপ্তাহের জন্য সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ফিরেই এই সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। অনেক হয়েছে ছোটাছুটি। এবার একটু থিতু হতেই হবে। দাদুর থেকে দিম্মার শেষ ছবিটার একটা কপি নিয়ে এসেছিল ওরা। সেই ছবি এখন সযত্নে রুমুনের হ্যান্ডব্যাগে রয়েছে। রেণুও চলেছেন আজ নাতি নাতবউয়ের সাথে সুইজারল্যান্ড। দাদুকে কথা দিয়েছে ওরা, ভিডিও কল করবে ওরা রোজ। দুই প্রজন্ম কপোত-কপোতীর আজ উড়বার পালা।
No comments:
Post a Comment