Friday, January 25, 2019

সেদিন দুপুরে

মিতিল বছর তিনের এক মিষ্টি মেয়ে। ফর্সা গোলগাল চেহারা, এক মাথা কোঁকড়া চুল। ঠিক যেন একটা ডল পুতুল। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। মিতিল আর ওর বাবা মা মাস ছয় হয়েছে আমাদের এই হাউজিং কমপ্লেক্সে এসেছে। আমাদের কমপ্লেক্সটা আর পাঁচটা মার্কিনি শহরের ঝাঁ চকচকে রেসিডেন্সিয়াল বাড়ির মতোই। প্রত্যেকে নিজেদের মতো থাকে। আশেপাশের বাড়ির লোকের সাথে তেমন কথা নেই। হয়তো মুখোমুখি হলে একবার হাই বলে হাসলাম। ব্যস। অবশ্য মিতিলদের সাথে ব্যাপারটা একটু আলাদা। একই বিলিডিংয়ে দুটো ভারতীয় তায় আবার বাঙালি পরিবার। আলাপ ও এ বাড়ি ও বাড়ি যাওয়া আসা লেগেই আছে।
মিতিলের বাবা মা, অমিত আর সুলগ্না দুজনেই আই টি ফার্মে চাকুরীরত। বাচ্চাকে দেখার জন্য এক মেক্সিকান ন্যানি রয়েছে। আমি বাড়ি বসে কাজ করি, তাই মাঝে মাঝে এক দুবার একটু দেখে আসি। ও ঠিক আছে কি না। মিতিলের ন্যানিটির নাম লোরি। মাঝ বয়সী। ধর্মভীরু। হাসি খুশি। দক্ষ। আমি যতবারই গিয়েছি, দেখেছি মিতিলের সাথে খুব ভাব। বেশ দুজনে খেলছে। লোরি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ওকে গল্প শোনাচ্ছে। আমি খানিকটা সময় ওদের সাথে কাটিয়ে আবার নিজের বাড়ি ফিরে আসি। সুলগ্নাকে একটা মেসেজে জানিয়ে দিই সব ঠিক আছে।
এরকমই এক দুপুরে একটু বাইরের কাজকর্ম সেরে ফিরে সবে খেয়ে উঠেছি। বাসন নামাচ্ছি, এমন সময়ে আমাদের দরজাটা বার বার ধাক্কাতে লাগলো। কী ব্যাপার, কে। কী হলো। এত ঘন ঘন কে কী চায়। আমি পিপ হোল দিয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম একটা বছর দশেকের ছেলে দাঁড়িয়ে। চেহারা দেখে তো ভারতীয় বা নিদেনপক্ষে দক্ষিণ এশীয় লাগল। আমি দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার।
ছেলেটির পরনে ছিল একটি বেল বটম জিন্স প্যান্ট। আর এই গরমেও একটা মোটা সোয়েট শার্ট। চোখে লাগলো আমার। ও আমায় পরিষ্কার বাংলায় বললো, "আন্টি, তুমি শিগগিরই মিতিলদের বাড়ি যাও। ওর বিপদ।"
কী বিপদ, ও কে কিছু জানতে চাওয়ার আগে ও দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে চলে গেল। আমি কোনো রকমে ফোন আর গাড়ির চাবি আর পার্স হাতে নিয়ে মিতিলদের দরজায় নক করলাম। ভিতর থেকে মিতিলের কান্নার শব্দ পাচ্ছি মনে হল। নাকি টিভি চলছে? দু মিনিট অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য আমার ছিল না। আমার কাছে ওদের একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আমি থমকে গেলাম। দেখি লোরি ওর বিশাল চেহারা নিয়ে শুয়ে আছে মেঝের ওপর। মাথা ফেটে রক্তে কার্পেট ভিজে যাচ্ছে। পাশে বসে মিতিল কেঁদেই চলেছে। খিদেয়। ভয়ে। আর মিতিলের পাশেই খুব বিপজ্জনকভাবে পড়ে রয়েছে কাটলারি সেট। মিতিলের হাতে ছুরি। হয়তো খিদেয় টেবিল থেকে খাবার খুঁজতে গিয়ে হাত থেকে ফেলেছে।
আমি এক দৌড়ে ওর হাত থেকে ছুরিটা সরালাম। সঙ্গে সঙ্গে ৯১১ ফোন করলাম। সুলগ্না আর অমিত যতক্ষণে এসে পৌঁছেছে, ততক্ষনে লোরিকে নিয়ে এম্বুলেন্স চলে গিয়েছে। আমি মিতিলকে আমার ঘরে বসিয়ে খাইয়ে দাইয়ে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়েছি।
সুলগ্না তো মিতিলকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলল।  বার বার আমায় দিদি তুমি না থাকলে কী যে হত, চির কৃতজ্ঞ এইসব বলতে লাগলো। আমি বললাম, আমায় ধন্যবাদ দিয়ো না। বরং ওই ছেলেটি কে, তাকে থ্যাংকস জানাও। সুলগ্না আর অমিত দুজনেই অবাক। কে ছেলে? কী ব্যাপার? আমি তখন সবটা বললাম।
সুলগ্না জিজ্ঞেস করল, একটা জিন্স প্যান্ট আর সোয়েট শার্ট পরা কি? বললাম হ্যাঁ। খানিক চুপ করে থেকে বলল, তার মানে রুপু। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রুপু কে? অমিত বলল, আমরাও ঠিক জানিনা। বিগত এক মাস ধরে মিতিল আমাদের ওর রুপু দাদার কথা বলে। আমরা তেমন গা করিনি। ও যদিও এরকম বর্ণনা দিত, রুপু দাদার সাথে ও খেলে, দাদা ওকে গল্প শোনায়। লোরিকে জিজ্ঞেস করায় ও বলে এমন কেউ তো আসেনি কখনো। শিশুমনের কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছি আমরা। তবে আজ মনে হচ্ছে, সত্যিই রুপু দাদা বলে কেউ আছে। আর তার জন্যই মিতিলের কোনো বড় ক্ষতি হয়নি। লোরিও ঠিক হয়ে যাবে শুনলাম। এই রুপু দাদাকে দেখছিই খুঁজতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজে কিছু পাওয়া যায় কি খোঁজ নেব ম্যানেজারের থেকে।" এই অবধি বলে অমিত থামল।
"কোনো লাভ নেই অমিত। কিছু পাবে না। আমি জানি রুপু দাদা কোথায় আছে।" সুলগ্না শান্ত হয়ে জানালো।
"কে ও?" অমিত ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
সুলগ্না ওর ফোন ঘেঁটে একটা পুরোনো স্ক্যান্ড ছবি বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "দেখো তো দিদি, এই ছেলেটিই না কি?"
আমি ছবির দিকে তাকিয়ে অবাক। অবিকল দুপুরের বাচ্চাটা। সেই এক পোশাক। একই রকম ঝাঁকড়া উস্ক খুস্কো চুল। "কে এ?" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
"এটি আমার দাদার ছবি। আমি কখনো দেখিনি দাদাকে। নয় বছর বয়সে আমার জন্মের আগেই মারা যায়। কনজেনিটাল হার্ট ডিসিস ছিল। মায়ের কাছ থেকে দাদার এই ছবিটা দেখেছিলাম। আমার গ্যালারিতে সব সময় থাকে। দাদার নাম ছিল রূপায়ণ। আদর করে সবার রুপু।"

No comments:

Post a Comment