Sunday, January 27, 2019

গানের ঝর্ণাতলায়

গানের ঝর্ণাতলায়

দুটো ক্লাস নিয়ে স্টাফরুমে এসে একটু বসেছি। এপ্রিলের মাঝামাঝিতেই বড্ড গরম পড়ে গিয়েছে কলকাতায়। আমাদের কলেজটা তাও ভাগ্যিস বেশ "নিউ-এজ", সেন্ট্রালাইজড এয়ার কন্ডিশন্ড। তাই একটু রক্ষে। জলের বোতলটা খুলে একটু গলা ভিজাতে যাব, এমন সময়ে এক দল সেকেন্ড ইয়ারের ছেলে মেয়ে এসে ভিড় করল আমার টেবিলের সামনে। "ম্যাম, ম্যাম, গান শিখব।" আমি অবাক। গান শিখবে মানে? আমি তো রস কষ বিহীন সাবজেক্ট কেমিস্ট্রি পড়াই, সারাদিন থারমোডাইনামিক্স, কাইনেটিক্স এইসবের বাঘা বাঘা ফর্মুলা, থিয়োরি আর অঙ্ক করিয়ে আমার দিন কাটে, সেখানে হঠাৎ এমন গানের কথা আসে কী করে। জিজ্ঞেস করলাম, "গান? কীসের? কেন? আমি গান জানি নাকি?"

ওরা সমবেতস্বরে বলে উঠল, "ম্যাম, চলুন রুমের বাইরে। বলছি। এখানে এতজন মিলে কথা বললে অন্য স্যর ম্যামেরা আপনাকে আর আমাদের বকা দেবেন।" সত্যি, এরা পারেও বটে। ছেলেমানুষ। সারল্য দেখলে কেমন মায়া পড়ে যায়। ওদের পিছু পিছু বাইরে এলাম। বললাম, "বলো। কী ব্যাপার?"

মীনাক্ষী বলে একটি মেয়ে ওদের মধ্যে বেশ একটু লিডার গোছের, ওই এগিয়ে এসে বলল, "ম্যাম, আমরা ঠিক করেছি এইবারে রবীন্দ্র জয়ন্তী উদযাপন করব। সেমিস্টার শেষ হয়ে যাবে তখন। অসুবিধে নেই। কয়েকটা গান একটু তুলিয়ে দিতে হবে।" মনে পড়ে গেল ওদের উৎসাহ দেখে আমাদের নিজেদের কথা। এই যে বয়সটা, একদম ডানা মেলে উড়বার সময়। এদিক ওদিক নানান জিনিস পরখ করার সময়। বললাম, "কিন্তু আমি গান জানি, কী করে জানলে?" শোভন বলল, "ম্যাম আমরা আপনাকে গাইতে দেখেছি। ইউটিউবে। বোধহয় আপনার কলেজ জীবনের ভিডিও।" এই রে। ওই অত পুরনো ভিডিও পর্যন্ত ওরা দেখে ফেলেছে? যাক গে, কী করা যাবে আর। শেখাব। রাজি হলাম ওদের গান শিখিয়ে দিতে কয়েকটা।



উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রথম গান হবে "প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে", ওরাই ঠিক করেছে। আটজনের গ্রুপ। কয়েকজন বেশ ভালোই গাইছে। পরিচিত গান। কিন্তু জয়িতা আর প্রণতির মাঝে মাঝেই তাল আর সুর কাটছে। "শোন, ৩-৩ মাত্রার গান। হাতে গুনে গুনে করো।" আমি জায়গায় জায়গায় ওদের সাথে আলাদা করে এক লাইন দুই লাইন গেয়ে বোঝাচ্ছি। স্বরলিপি সমেত। গাইতে ও শেখাতে গিয়ে পৌঁছে গেলাম অন্তত বারো বছর আগে। কলেজের তখন সেকেন্ড ইয়ার চলছে। ফ্রেশারস ওয়েল্কামের জন্য গান গাইতে হবে। মোটামুটি গুনগুন করতে পারি বলে আমায় ধরে বেঁধে গানের দলে নাম লিখিয়েছে। ফিমেল ভয়েসের বড়ই অভাব ছিল। ঋজুর দায়িত্ব ছিল আমায় গানটা তোলানোর। ঋজু দক্ষিণীর ছাত্র। অসম্ভব দখল গানে। আর আমি ওই টিভি দেখে আর রেডিও শুনে একটু আধটু যা করি। কোন ফর্মাল ট্রেনিং নেই বলা চলে।



"আরো আলো, আরো আলো, এই নয়নে প্রভু ঢালো... ঢা- আ-লো। পা-ধা পা-ণি ধা।"

"ধুর ঋজু, আমি পারছি না। আমি তো এই সরগমই করছি।"

"না তুতুল, তুই শুদ্ধ নি বলছিস। কোমল নি হবে। আমি করছি। তুই শোন।"

ঋজুর উদাত্ত কন্ঠে তখন অডিটোরিয়াম মুখরিত হয়।

"সুরে সুরে বাঁশি পুরে, তুমি আরো আরো দাও তান..."

তখন আমার বয়স কত হবে? উনিশ? মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি ওই সুললিত সুর। প্রতিটি নোট যেন এসে বিঁধছে এসে এই বুকের মধ্যে। আহা। কী শব্দ। কী সুর। কী গায়কী। গান শিখব কী, শিক্ষকের প্রেমে ইতিমিধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। আর এদিকে ঋজুও শিক্ষক হিসেবে বেশ সিরিয়াস। কিছুতেই পারফেকশন না এনে রেহাই দেবে না। অবশ্য হ্যাঁ, কাজে দিয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে গোটা মঞ্চ এততাই হাততালিতে ফেটে পড়ছিল, সেই শব্দ যেন আমি এখনও চোখ বন্ধ করে শুনতে পাই। বাকি কলেজ লাইফে আরো অনেক অনুষ্ঠানে আমরা একসাথে গান করেওছিলাম। আমদের ওই গানে গানে প্রেম চলেওছিল তারপর অনেকদিন।



আজ এত বছর পর একই গান গাইতে গিয়ে এই ছাত্র ছাত্রীগুলোর মধ্যে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখছিলাম মনে হল। নবীন এক ঝাঁক প্রতিভা। এখনই তো স্বপ্ন দেখার বয়স।



আবার লাস্ট পিরিয়ডের পর রিহার্সালে বসব ওদের নিয়ে, এই বলে আমি পরের ক্লাসের জন্য প্রস্তুতি নিতে চললাম স্টাফরুমে। এখন কটাদিন একটু দেরি হবে বাড়ি ফিরতে। যতদিন না অনুষ্ঠান পর্ব মিটছে। সংসারের দিকে একটু মনোযোগ কম দেওয়া হবে এই ক'দিন। হোক। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে একবার ঋজুকে মেসেজ করে দিলাম।

"ছেলেমেয়েগুলো ধরেছে ওদের রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য গান তুলিয়ে দিতে। কটাদিন একটু ফিরতে দেরি হবে। তুই প্লিজ হোম ফ্রন্টটা ম্যানেজ করে দিস? আর পারলে এক দুদিন আমাদের রিহার্সালে আসিস। তোর একদা ছাত্রী এখন নিজেই টিচার। কেমন শেখাচ্ছে, দেখতে হবে তো তোকে?" ওর একটা ছোট্ট রিপ্লাই এল, "অবশ্যই। তুই এগিয়ে যা। আমি তো আছিই।"

আমি জানি, ও ঠিক সামলে দেবে। কারণ একদিন তো আমরা এই অঙ্গীকার নিয়েছিলাম,



"গানের সুরের আসনখানি পাতি পথের ধারে

ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে..."












No comments:

Post a Comment