" আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানিয়েছে, আজও সারাদিন শহরে প্রবল দাবদাহ চলবে। তাপমাত্রা দুপুরের দিকে কোন সময়ে চল্লিশ ছুঁতে পারে। কালবৈশাখীর কোন সম্ভাবনা নেই। "
সক্কাল সক্কাল দূরদর্শন সংবাদে পাঠিকার থেকে এই ঘোষণা শোনার পর থেকেই রুমুনের মেজাজ বিগড়ে আছে। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কী। কোথায় এখন মা বাবার সাথে সিলেরিগাঁওয়ের হোমস্টের বাগানে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে গরম গরম দার্জিলিং টিতে চুমুক দেবে আর মাঝে মাঝেই সাপ্লাই আসবে নরম তুলতুলে বাঁধাকপির পাতা ঠাসা মোমো, তা না। একেই এই বিচ্ছিরি গরম শহরে, তার মধ্যে আবার পা ভেঙ্গে প্লাস্টার করে শয্যাশায়ী। মা পইপই করে বলেছিল সেদিন পাকামো করে স্টিলের ল্যাদাড়ে না ছাপতে। কিন্তু না। ওকে যে তক্ষুণি কোন মান্ধাতার আমলে কী না কী ডায়েরিতে হাবিজাবি লিখে রেখেছিল, সেটা চাইই চাই। ইন্সট্যাগ্র্যামে দেবে। মায়ের কথা না শোনার ফল। ধপাস। মটমট। দুধ না খেয়ে খেয়ে ক্যালসিয়ামের অভাব। ফলে ডান পা ভেঙে ছয় সপ্তাহ প্লাস্টার, গৃহবন্দী। মা বাবা তাঁদের যাওয়াটা ক্যান্সেল করবে বলায় রুমুন নিজে থেকেই "না না তোমরা ঘুরেই এসো, ইউ ওয়ের লুকিং ফরওয়ার্ড টু ইট। আমি ম্যানেজ করে নেবো। পরে তিনজনে যাবো নাহয়" বলায় তাঁরা যে সত্যি সত্যিই সেটা মেনে নেবেন, রুমুন ভাবতে পারেনি। রমলাদির হাতে ওর সব দায়িত্ব সঁপে তাঁরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভাগ্যিস ইন্টারনেটের সিগন্যাল কমজোরি, তাই পরপর অন্তত হোয়াটসঅ্যাপে ছবির পর ছবি আসছে না। এমনিতে যা উৎসাহ। আপাতত ভয়েস কলেই যা মন খারাপ হয়ে আছে রুমুনের। ধুর।
অগ্নিটাকেও সকাল থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করে করেও পাচ্ছে না। সমানে আউট অফ রেঞ্জ বলে চলেছে। নির্ঘাত বন্ধুদের সাথে উইকেন্ডে হুঠ করে কোন প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়েছে। ভাল্লাগেনা। সবাই নিজের নিজের মতো আনন্দ করছে। ওর কথা কেউ ভাবছেই না। ওকে কেউ ভালোইবাসে না। ও বেচারি বসে বসে একটার পর একটা চিপসের প্যাকেটের শ্রাদ্ধ করেই চএলছে। বই পড়তে, সিনেমা দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না। টিভিতেও কিছু নেই। নইলে সকাল সকাল কেউ দূরদর্শন খুলে বসে?
আনমনা হয়ে এইসব উল্টোপাল্টা এলোমেলো চিন্তা করতে করতে কখন কে জানে ঘুম এসে গিয়েছিল রুমুনের। এই হয়। চুপচাপ শুয়ে থাকলে খালি ঘুম আসে। রান্নাঘর থেকে হঠাৎ হইহই শব্দ শুনে ঘুমটা ভাঙল। পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলও, দশটা কুড়ি। তাহলে বোধহয় রান্নার দিদি এসেছে। রমলাদির সাথে গল্প করছে। দুজনেই যা বকবক করে, পারেও এরা। কিন্তু... উহু... পুরুষ কণ্ঠ শুনলো মনে হলো। কে এলো? কারুর তো এখন আসার কথা না। চিমনি পরিষ্কার করতে? তার সাথে হ্যাঁ হ্যাঁ করবে না তো রমলাদি।
"রমলাদি, একবার এ ঘরে এসো" বলে হাঁক পাড়ল রুমুন।
"দিদিমণি, ব্যস্ত আছি একটু। দোষ মিনিট পর আসছি", উত্তর এলো রান্নাঘর থেকে।
ব্যাপারটা ভালো লাগছে না রুমুনের। অচেনা অজানা কেউ এলো নাকি? কী করবে? কাকে ফোন করবে? নিজেও তো উঠে গিয়ে দেখতে পারবে না। ধুস। অস্থির লাগছে। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গিয়েছে। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসা একটু কমেছে। শুধু ওই বাসনের টুকটাক শব্দ। ব্যস। রমলাদিকে আরেকবার ডাকবে কি না ভাবছে ও, এমন সময় সবুজ চেক পর্দাটা ঠেলে হাতে সাদা প্লাস্টিকের ট্রে নিয়ে যে ঢুকল, তাকে দেখে রুমুন অবাক। এ কী, অগ্নি? ওর তো এখন এখানে থাকার কথা না। সত্যিই ও? হ্যাঁ, তাইই তো। গত জন্মদিনে দেওয়া হলুদ টিশার্ট পরে। চুলগুলো সেই বিচ্ছিরি স্টাইলে সেট করা।
"তুই?" রুমুন চোখগুলো বড় বড় করে প্রশ্ন করলো।
"কেমন? সারপ্রাইজটা কেমন লাগল বল?" ট্রে হাতে নিয়ে অগ্নি এগিয়ে এলো। এতক্ষণে রুমুন ভালো করে তাকিয়ে দেখল। গরম গরম সাদা ধবধবে মোমো। ধোঁওয়া উঠছে এখনও। আহা!
"খেয়ে বল কেমন", অগ্নি হাসি মুখে বলে।
"বানালি?" জিজ্ঞেস করে রুমুন। ঝপ করে একটা মোমো মুখে পুরতেই যেন স্বর্গসুখ অনুভূতি হয়।
"ওয়াও, দিস ইজ অ্যামেজিং", উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রুমুন বলে।
"দার্জিলিং যেতে পারলি না তো কী হয়েছে? আমি দার্জিলিং নিয়ে আসবো তোর কাছে। দুদিনের জন্য এসেছি। এসিটা চড়া ঠাণ্ডায় সেট করে একটা বেশ দার্জিলিং দার্জিলিং পরিবেশ বানিয়ে ফেলবো। খালি মোমো খাবো। আর চা। ও, মাঝে মাঝে স্টিমিং হট রাইস আর চিলি পর্ক কারি। সাথে দার্জিলিং জমজমাট আর ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দুটোই পড়ে শোনাবো। কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমাটাও স্ট্রিম করবো। অঞ্জন দত্তর গান চলবে। বল আর কী চাই?"
রুমুন খানিক তাকিয়ে থাকে অগ্নির দিকে। তারপর এক ঝাঁপে ওর দিকে এগিয়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে কানে কানে বলে, "এই তো তুইই আমার দার্জিলিং। আমার আর কিচ্ছু চাই না!"
রুমুনের চুলের ভিতর দিয়ে আঙুলগুলো দিয়ে খেলতে খেলতে অগ্নি হাসে। বলে, "পাগলী!"
Saturday, April 27, 2019
Friday, April 26, 2019
- শোন না। আমি একটা হিসেব করেছি।
- কী?
- এই যে তুই তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আসবি, ওই ২২ দিন সারাক্ষণ আমার সাথে থাকবি।
- আর আমার মা বাবা ফ্যামিলি বাকি বন্ধু বান্ধব?
- আমি জানি না। আমার হিসেব করা আছে।
- শুনি?
- আমাদের আলাপের এগারো মাস হচ্ছে।
- বেশ। তো?
- এই এগারো মাস আমরা একই শহরে থাকলে সপ্তাহে অন্তত চারদিন দেখা করতাম। on an average, প্রতি মিটে তিন ঘন্টা কাটাতাম। মানে ১১*৪*৪*৩, মানে দাঁড়াচ্ছে ওই ৫০০ প্লাস ঘন্টা। দিনে ২৪ ঘন্টা। অর্থাৎ, ওই approx ২২ দিন। ইন ফ্যাক্ট, বাইশ দিন কম হচ্ছে। আরো পেন্ডিং রয়ে গেল। তুই এই পুরো বাইশ দিন আমার সাথে থাকবি।
- কাকু কাকিমা? আমার মা বাবা?
- মাকে বলছি। তোকে adopt করবে। কাকু কাকিমার থেকে পারমিশন নিয়ে।
- তুই অফিস করবি না তো এই কদিন?
- না। ছুটি নেব।
- তারপর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে আমরা ঝগড়া করবো। তখন?
- তুই গোঁসা করে নিজের বাড়ি ফিরবি। আমি তোর রাগ ভাঙাতে যাবো। আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।
- আই উইশ...
- কী আই উইশ? তুই রাজি থাকলে বল, এক্ষুণি মাকে বলছি। সিরিয়াসলি।
- ছুটিটা ক্যান্সেলড হয়ে গেল রে।
- মানে?
- মানে আর কী। যাওয়াটা হচ্ছে না...
- কী?
- এই যে তুই তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে আসবি, ওই ২২ দিন সারাক্ষণ আমার সাথে থাকবি।
- আর আমার মা বাবা ফ্যামিলি বাকি বন্ধু বান্ধব?
- আমি জানি না। আমার হিসেব করা আছে।
- শুনি?
- আমাদের আলাপের এগারো মাস হচ্ছে।
- বেশ। তো?
- এই এগারো মাস আমরা একই শহরে থাকলে সপ্তাহে অন্তত চারদিন দেখা করতাম। on an average, প্রতি মিটে তিন ঘন্টা কাটাতাম। মানে ১১*৪*৪*৩, মানে দাঁড়াচ্ছে ওই ৫০০ প্লাস ঘন্টা। দিনে ২৪ ঘন্টা। অর্থাৎ, ওই approx ২২ দিন। ইন ফ্যাক্ট, বাইশ দিন কম হচ্ছে। আরো পেন্ডিং রয়ে গেল। তুই এই পুরো বাইশ দিন আমার সাথে থাকবি।
- কাকু কাকিমা? আমার মা বাবা?
- মাকে বলছি। তোকে adopt করবে। কাকু কাকিমার থেকে পারমিশন নিয়ে।
- তুই অফিস করবি না তো এই কদিন?
- না। ছুটি নেব।
- তারপর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে আমরা ঝগড়া করবো। তখন?
- তুই গোঁসা করে নিজের বাড়ি ফিরবি। আমি তোর রাগ ভাঙাতে যাবো। আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।
- আই উইশ...
- কী আই উইশ? তুই রাজি থাকলে বল, এক্ষুণি মাকে বলছি। সিরিয়াসলি।
- ছুটিটা ক্যান্সেলড হয়ে গেল রে।
- মানে?
- মানে আর কী। যাওয়াটা হচ্ছে না...
বাহন
বাহন
বাবার সাথে কথা শেষ করে ফোনটা ছাড়তে ছাড়তেই একটা অচেনা নম্বর থেকে কল ঢুকলো লাবণ্যর ফোনে। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে শুনতে পেলো "নমস্কার। আপনি লাবণ্যলতা দত্ত কথা বলছেন?" কণ্ঠস্বরটি বেশ শ্রুতিমধুর লাগলো লাবণ্যর। ও উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। বলুন?"
উল্টোদিকে থেকে ভেসে এলো, "আমার নাম অমিত রায়। আপনার গাড়িটি আপনি বিক্রি করেছিলেন রাজু সাহাকে। আমি ওঁর থেকে কিনি এটা।" খানিক আগেই বাবার থেকে আভাস পেয়েছে এই বিষয়ে। তাই কিঞ্চিৎ আন্দাজ করতে পারছেও। তবুও লাবণ্য বললো, " আচ্ছা। বলুন।" উল্টোদিকের ভদ্রলোকটি বললেন, " আসলে মোটর ভেহিকলস থেকে বলছে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন আপনার নাম থেকে আমার নামে করতে গেলে আপনার সই সাবুদ লাগবে।" ভদ্রলোকের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে লাবণ্য বললো, "কিন্তু আমি তো সমস্ত ফর্মে সই করেই দিয়েছি।" অমিত রায় বললেন, " হ্যাঁ তা দিয়েছেন। মোটর ভেহিকেল থেকে তাও কাস্টোমারী চেকিং এর জন্য হয়তো আপনার কাছে ফোন করতে পারে। তাই আমি আপনাকে জানাতে কল করলাম। আমার নাম অমিত রায়। ডিসেম্বর ২০১৮ তে আমি গাড়িটা কিনি।" লাবণ্য বললো, "হ্যাঁ। ঠিক আছে। বলে দেবো।" অমিত বললেন, "আমি কি আপনাকে একটা মেসেজ করে দেবো এই কথাগুলো?" লাবণ্য খানিক বিরক্ত বোধ করলো। একটু কি বেশিই কথা বলেন? হয়তো সেলস টেলসে আছেন। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন। বলিয়ে কইয়ে লোক। তবে এক্ষেত্রেএইটুকু তো একটা কথা। তাও আবার মেসেজের কী দরকার। তবে লাবণ্য রাগ বা বিরক্তি কোনোটাই প্রকাশ করলো না। শুধু একটু মাপা স্বরে বললো, "বেশ। টেক্সট করে দিন।" অমিত বিগলিত কণ্ঠে "অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম" বলে ফোন ছাড়লেন। মুহূর্তেই এস এম এস এলো একটা ওই নম্বর থেকে। নাম ও গাড়িটি কবে কিনেছেন, সেই তারিখ দিয়ে। পরে ফোন নম্বরটা কোনো কাজে লাগতে পারে ভেবে লাবণ্য নম্বরটা সেভ করলো। অমিত রায়। টাইপ করতে গিয়েই এক চোট হাসি পেলো ভারী। লাবণ্য আর অমিত। এবং কী আশ্চর্য, পদবী পর্যন্ত এক। কোইনসিডেন্স বটে!
সারাদিন আজ কাজের প্রেশার সাংঘাতিক ছিলো। মাস খানেক হলো ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে কলকাতায় এই ইনস্টিটিউটে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে জয়েন করেছে লাবণ্য। প্রশাসনিক কাজ, পড়াশোনার কাজ সব মিলিয়ে ভালোই ব্যস্ততা। ইনস্টিটিউট থেকে বাড়ি ফেরার ডাইরেক্ট বাস নেই। রোজ রোজ ওলা উবার চাপলে মাইনে পুরো তাতেই শেষ হয়ে যাবে, যা সার্জ প্রাইসিং। অগত্যা দুবার অটো আর তারপর বাস, এই ভরসা। প্রথম অটোর লাইনে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে লাবণ্য। লাইন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অথচ অটোর দেখা নেই। বাধ্য হয়ে ওলা উবার দেখলো, তাতেও তথৈবচ। মাকে একটা ফোন করে অবস্থা জানিয়ে রাখলো। চিন্তা করবে নইলে। ইয়ারফোনেও রেডিও চলছে, কতক্ষণ ধরে সেখানে শুধুই বিজ্ঞাপন। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে লাবণ্যর। গাড়িটা থাকলে এই অসুবিধে হতোই না। বারবার বাবাকে বলেছিল, গাড়িটা বিক্রি না করতে। কিন্তু ও ব্যাঙ্গালোরে থাকায় কলকাতায় গাড়িটা ব্যবহার না হয়ে শুধু শুধু পড়ে পড়ে মেন্টেনেনসের জন্য মাসে মাসে এত টাকা খরচ হচ্ছিলো। নাহ, এইবারে একটা গাড়ি কিনতেই হবে। ই এম আই দিয়েই নাহয়।
মোড়ের মাথায় বিচ্ছিরি জ্যাম হয়ে আছে। গাড়িগুলো সমানে হর্ন বাজিয়ে চলেছে। বিরক্ত হয়ে লাবণ্য একটু পিছিয়ে গেল। ট্র্যাফিক সিগনাল অনেকক্ষণ ধরে লাল। কখন সবুজ হবে, ঠিক নেই। তাই পিছিয়ে গিয়ে ক্যাবের চেষ্টা করবে। যদি কপাল খোলে। এবং কী আশ্চর্য। কপাল খুললো কি না কে জানে, তবে ওই গাড়ির ভিড়ে চোখে পড়লো ওর প্রিয় সিলভার স্যানট্রো গাড়িটা। হ্যাঁ, ঠিক। নম্বরও তো একই। ওই তো, ১৭৯৬। এই নিয়ে সারাদিনে দ্বিতীয়বার কোইনসিডেন্স কথাটা মাথায় এলো লাবণ্যর। আচ্ছা, গাড়িটা আছে তো কী হয়েছে, লিফট চাওয়া যায় নাকি। তা ছাড়া চেনে না জানে না। হাজার হোক, গাড়িটা এখন আর ওর না। জনৈক মিস্টার অমিত রায়ের। তা বলে তাকে হুট করে গিয়ে বলবে, "শুনুন, আমি লাবণ্য। আপনার সাথে সকালে আমার কথা হয়েছে। আপনি যে গাড়িটা চালাচ্ছেন, সেটা এক কালে আমি চালাতাম। আমায় তাই আপনি লিফট দিন।" ধ্যাৎ, কেমন একটা নিজের কানেই কথাটা লাগলো লাবণ্যর। কী করবে। যাবে? না যাবে না? বড়ই দ্বিধা। প্রিয় স্যানট্রো এদিকে যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে বারবার। মনে পড়ে যাচ্ছে ওতে চড়ার সমস্ত স্মৃতি। প্রথম গাড়ি চালানো। প্রথমবার মায়ের ওপর রাগ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। বাবার সে কী বকুনি ফিরে এসে। দিদির বাড়ি দল বেঁধে যাওয়া, ওই প্রথম ওর ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরোনো। হাতটা নিশপিশ করছে একটু স্টিয়ারিং উইলে ছোঁয়াতে।
সমস্ত দ্বিধা দ্দ্বন্দ্ব কাটিয়ে, লজ্জার মাথা খেয়ে লাবণ্য ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করলো। এখনও ট্র্যাফিক লাইট লাল হয়ে আছে। ২০০সেকেন্ড দেখাচ্ছে। কল লিস্ট থেকে অমিত রায়ের নম্বরটা বের করে সবুজ সিম্বলটা সোয়াইপ করেই ফেললো। অপরপ্রান্তে রিং হচ্ছে। "আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী"। বাবাঃ। বেশ চিজী ব্যাপার। ইশ, ভুল করলো না তো ফোনটা করে, ভাবছিল লাবণ্য। মনে হচ্ছিল কেটে দেয়। কিন্তু না। তাহলে উনি কল ব্যাক করবেন। আবার তখন কেনো ফোন করেছের সাথে সাথে কেনো কেটে দিলো, তার কারণ বলতে হবে। ধুর। কী যে করে ও। নিজের ওপর নিজেরই মাঝে মাঝে রাগ হয় লাবণ্যর। এত হঠকারী।
"বলুন ম্যাডাম।" সকালের সেই সুবক্তার ঝকঝকে কণ্ঠস্বরে লাবণ্য মুহূর্তে হকচকিয়ে গেলো। কী বলবে, ভাবছে। ইতিমধ্যেই ওই দিক থেকে "হ্যালো ম্যাডাম, বলুন" এসে গেলো। এবার তো উত্তর দিতেই হয়। একটু থতকে ও বললো, "আচ্ছা, বাই এনি চান্স আপনি কি এখন কলেজ মোড়ে রয়েছেন?" "হ্যাঁ। কী করে জানলেন? ও, বুঝেছি। আপনিও বুঝি ওখানেই? গাড়িটা দেখতে পেয়েছেন নিশ্চয়ই।" লাবণ্য মনে মনে হাসলো। যাক, বুদ্ধি আছে ভালোই। শুধুই বুকনি না। চোখ পড়ল সিগনালে। আর ৯০সেকেন্ড। বললো, "হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন। আসলে জ্যামের মধ্যে দেখতে পেলাম। ভাবছিলাম কোনদিকে যাচ্ছেন, যদি লিফ্ট..."
"আরে নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আপনার এড্রেস তো দেখেছিলাম গলফ গ্রীন। আমি যাদবপুরে থাকি। রাস্তা এক। কোনো অসুবিধে নেই। আসুন। দাঁড়ান, আপনার লোকেশনটা বলুন। আমি পৌঁছে যাচ্ছি।"
লাবণ্য হেসে বললো, "চায়ের ঝুপড়িটার ঠিক সামনে আছি। সাদা কুর্তি, নীল জিন্স। পিঠে ল্যাপটপ ব্যাগ। ডান হাতে ফোন। কানে লাল ইয়ারফোন।"
"ব্যস ব্যস, বুঝে গিয়েছি। দেখতেও পেয়ে গেলাম। আসছি। সিগ্নালটা খুলুক। চলে আসছি।"
লাবণ্য নিজেই নিজের এরকম প্রগল্ভ আচরণে অবাক। বুকটা কিঞ্চিৎ ধুকপুক করছে। কী বলবে, কীভাবে কথা শুরু করবে। সিগনাল সবুজ হতেই গাড়ির যেন ঢেউ আছড়ে পড়লো রাস্তায়। একের পর এক। সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। এরই মধ্যে ওর সিলভার স্যানট্রো এসে থামলো, ওরই সামনে। কাঁচ নামিয়ে দরজাটা খুলে নীল স্ট্রাইপ ফর্মাল শার্ট, চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা পরা এক বছর তিরিশের সুদর্শন যুবক বললো, "উঠে পড়ুন দেখি, ঝটপট। আবার না সিগনালে আটকাই। অনেক কষ্টে লাল থেকে সবুজ হলাম।"
লাবণ্য সিটবেল্ট বেঁধে বসতে বসতে গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে। মিউজিক প্লেয়ারে এফ এমে গান চলছে। প্রিয় স্টেশন। ঠিক যেমন ওর চলতো। আহ। কতদিন পরে যেন নিজের অনেক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলো, এমনটাই মনে হচ্ছিল লাবণ্যর। গাড়ির ইন্টিরিয়র এখনো পাল্টায়নি। এমনকি একই ফ্র্যাগরেন্সের এয়ার পিউরিফায়ার। আহা। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল লাবণ্য। দুজনেই চুপ। বাইপাস দিয়ে চলেছে গাড়ি। আনমনা হয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে লাবণ্য। ব্যস্ত শহর। সবাই ঘরে ফিরছে। রুবির মোড়ে পৌঁছে সম্বিৎ ফিরলো অমিতের কথায়, "আপনি কি এই রুটে এই সময়েই যাতায়াত করেন?"
"মোটামুটি। ওই পনেরো মিনিট, আধ ঘন্টা প্লাস মাইনাস। কেনো?" জিজ্ঞেস করে লাবণ্য।
"আসলে ভাবছিলাম যে, আমার অফিস ওই কলেজ মোড়ের সামনেই। আমিও এই রুটেই ফিরি। এই সময়। রোজ। তাই, আর কী। আমি রোজই লিফ্ট দিতেই পারি আপনাকে।" ঝকঝকে স্মার্ট অমিত বললেন। লাবণ্য চুপ। অমিত বলতে থাকলেন, " অবশ্য রোজ হয়তো দেখা হবে না। টাইম কি আর রোজ মেলে?"
লাবণ্য মনে মনে হাসছে। বেশ বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। নেহাত মন্দও লাগছে না। তবুও কিছু বলে না। হাসে।
গাড়িটা যাদবপুর থানা কানেক্টরে সিগনালে আটকে আছে আবার। লাবণ্য বলে, "আমায় থানার ওখানে নামালেই হবে। বাস পেয়ে যাবো।"
অমিত বলেন, "আরে না না। তা কী করে হয়। আমি বাড়ি অবধিই পৌঁছে দেবো। ঠিকানাটা মনে নেই অবশ্য। আপনি ডিরেকশন দিন।"
লাবণ্য হেসে বলে "এরকম আরাম পেলে তো দেখছি রোজ টাইম মিলিয়ে নিতে হবে!"
অমিত হাসে। এই প্রথম যেন কী বলবে, বুঝে ওঠে না।
ট্রাফিকের লাল সিগনাল সবুজ হয়। সিলভার স্যানট্রো তার প্রাক্তন ও বর্তমান মালিককে নিয়ে ছুটতে থাকে বাইপাস কানেক্টর দিয়ে।
বাবার সাথে কথা শেষ করে ফোনটা ছাড়তে ছাড়তেই একটা অচেনা নম্বর থেকে কল ঢুকলো লাবণ্যর ফোনে। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে শুনতে পেলো "নমস্কার। আপনি লাবণ্যলতা দত্ত কথা বলছেন?" কণ্ঠস্বরটি বেশ শ্রুতিমধুর লাগলো লাবণ্যর। ও উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। বলুন?"
উল্টোদিকে থেকে ভেসে এলো, "আমার নাম অমিত রায়। আপনার গাড়িটি আপনি বিক্রি করেছিলেন রাজু সাহাকে। আমি ওঁর থেকে কিনি এটা।" খানিক আগেই বাবার থেকে আভাস পেয়েছে এই বিষয়ে। তাই কিঞ্চিৎ আন্দাজ করতে পারছেও। তবুও লাবণ্য বললো, " আচ্ছা। বলুন।" উল্টোদিকের ভদ্রলোকটি বললেন, " আসলে মোটর ভেহিকলস থেকে বলছে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন আপনার নাম থেকে আমার নামে করতে গেলে আপনার সই সাবুদ লাগবে।" ভদ্রলোকের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে লাবণ্য বললো, "কিন্তু আমি তো সমস্ত ফর্মে সই করেই দিয়েছি।" অমিত রায় বললেন, " হ্যাঁ তা দিয়েছেন। মোটর ভেহিকেল থেকে তাও কাস্টোমারী চেকিং এর জন্য হয়তো আপনার কাছে ফোন করতে পারে। তাই আমি আপনাকে জানাতে কল করলাম। আমার নাম অমিত রায়। ডিসেম্বর ২০১৮ তে আমি গাড়িটা কিনি।" লাবণ্য বললো, "হ্যাঁ। ঠিক আছে। বলে দেবো।" অমিত বললেন, "আমি কি আপনাকে একটা মেসেজ করে দেবো এই কথাগুলো?" লাবণ্য খানিক বিরক্ত বোধ করলো। একটু কি বেশিই কথা বলেন? হয়তো সেলস টেলসে আছেন। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন। বলিয়ে কইয়ে লোক। তবে এক্ষেত্রেএইটুকু তো একটা কথা। তাও আবার মেসেজের কী দরকার। তবে লাবণ্য রাগ বা বিরক্তি কোনোটাই প্রকাশ করলো না। শুধু একটু মাপা স্বরে বললো, "বেশ। টেক্সট করে দিন।" অমিত বিগলিত কণ্ঠে "অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম" বলে ফোন ছাড়লেন। মুহূর্তেই এস এম এস এলো একটা ওই নম্বর থেকে। নাম ও গাড়িটি কবে কিনেছেন, সেই তারিখ দিয়ে। পরে ফোন নম্বরটা কোনো কাজে লাগতে পারে ভেবে লাবণ্য নম্বরটা সেভ করলো। অমিত রায়। টাইপ করতে গিয়েই এক চোট হাসি পেলো ভারী। লাবণ্য আর অমিত। এবং কী আশ্চর্য, পদবী পর্যন্ত এক। কোইনসিডেন্স বটে!
সারাদিন আজ কাজের প্রেশার সাংঘাতিক ছিলো। মাস খানেক হলো ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে কলকাতায় এই ইনস্টিটিউটে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে জয়েন করেছে লাবণ্য। প্রশাসনিক কাজ, পড়াশোনার কাজ সব মিলিয়ে ভালোই ব্যস্ততা। ইনস্টিটিউট থেকে বাড়ি ফেরার ডাইরেক্ট বাস নেই। রোজ রোজ ওলা উবার চাপলে মাইনে পুরো তাতেই শেষ হয়ে যাবে, যা সার্জ প্রাইসিং। অগত্যা দুবার অটো আর তারপর বাস, এই ভরসা। প্রথম অটোর লাইনে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে লাবণ্য। লাইন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অথচ অটোর দেখা নেই। বাধ্য হয়ে ওলা উবার দেখলো, তাতেও তথৈবচ। মাকে একটা ফোন করে অবস্থা জানিয়ে রাখলো। চিন্তা করবে নইলে। ইয়ারফোনেও রেডিও চলছে, কতক্ষণ ধরে সেখানে শুধুই বিজ্ঞাপন। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে লাবণ্যর। গাড়িটা থাকলে এই অসুবিধে হতোই না। বারবার বাবাকে বলেছিল, গাড়িটা বিক্রি না করতে। কিন্তু ও ব্যাঙ্গালোরে থাকায় কলকাতায় গাড়িটা ব্যবহার না হয়ে শুধু শুধু পড়ে পড়ে মেন্টেনেনসের জন্য মাসে মাসে এত টাকা খরচ হচ্ছিলো। নাহ, এইবারে একটা গাড়ি কিনতেই হবে। ই এম আই দিয়েই নাহয়।
মোড়ের মাথায় বিচ্ছিরি জ্যাম হয়ে আছে। গাড়িগুলো সমানে হর্ন বাজিয়ে চলেছে। বিরক্ত হয়ে লাবণ্য একটু পিছিয়ে গেল। ট্র্যাফিক সিগনাল অনেকক্ষণ ধরে লাল। কখন সবুজ হবে, ঠিক নেই। তাই পিছিয়ে গিয়ে ক্যাবের চেষ্টা করবে। যদি কপাল খোলে। এবং কী আশ্চর্য। কপাল খুললো কি না কে জানে, তবে ওই গাড়ির ভিড়ে চোখে পড়লো ওর প্রিয় সিলভার স্যানট্রো গাড়িটা। হ্যাঁ, ঠিক। নম্বরও তো একই। ওই তো, ১৭৯৬। এই নিয়ে সারাদিনে দ্বিতীয়বার কোইনসিডেন্স কথাটা মাথায় এলো লাবণ্যর। আচ্ছা, গাড়িটা আছে তো কী হয়েছে, লিফট চাওয়া যায় নাকি। তা ছাড়া চেনে না জানে না। হাজার হোক, গাড়িটা এখন আর ওর না। জনৈক মিস্টার অমিত রায়ের। তা বলে তাকে হুট করে গিয়ে বলবে, "শুনুন, আমি লাবণ্য। আপনার সাথে সকালে আমার কথা হয়েছে। আপনি যে গাড়িটা চালাচ্ছেন, সেটা এক কালে আমি চালাতাম। আমায় তাই আপনি লিফট দিন।" ধ্যাৎ, কেমন একটা নিজের কানেই কথাটা লাগলো লাবণ্যর। কী করবে। যাবে? না যাবে না? বড়ই দ্বিধা। প্রিয় স্যানট্রো এদিকে যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে বারবার। মনে পড়ে যাচ্ছে ওতে চড়ার সমস্ত স্মৃতি। প্রথম গাড়ি চালানো। প্রথমবার মায়ের ওপর রাগ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। বাবার সে কী বকুনি ফিরে এসে। দিদির বাড়ি দল বেঁধে যাওয়া, ওই প্রথম ওর ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরোনো। হাতটা নিশপিশ করছে একটু স্টিয়ারিং উইলে ছোঁয়াতে।
সমস্ত দ্বিধা দ্দ্বন্দ্ব কাটিয়ে, লজ্জার মাথা খেয়ে লাবণ্য ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করলো। এখনও ট্র্যাফিক লাইট লাল হয়ে আছে। ২০০সেকেন্ড দেখাচ্ছে। কল লিস্ট থেকে অমিত রায়ের নম্বরটা বের করে সবুজ সিম্বলটা সোয়াইপ করেই ফেললো। অপরপ্রান্তে রিং হচ্ছে। "আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী"। বাবাঃ। বেশ চিজী ব্যাপার। ইশ, ভুল করলো না তো ফোনটা করে, ভাবছিল লাবণ্য। মনে হচ্ছিল কেটে দেয়। কিন্তু না। তাহলে উনি কল ব্যাক করবেন। আবার তখন কেনো ফোন করেছের সাথে সাথে কেনো কেটে দিলো, তার কারণ বলতে হবে। ধুর। কী যে করে ও। নিজের ওপর নিজেরই মাঝে মাঝে রাগ হয় লাবণ্যর। এত হঠকারী।
"বলুন ম্যাডাম।" সকালের সেই সুবক্তার ঝকঝকে কণ্ঠস্বরে লাবণ্য মুহূর্তে হকচকিয়ে গেলো। কী বলবে, ভাবছে। ইতিমধ্যেই ওই দিক থেকে "হ্যালো ম্যাডাম, বলুন" এসে গেলো। এবার তো উত্তর দিতেই হয়। একটু থতকে ও বললো, "আচ্ছা, বাই এনি চান্স আপনি কি এখন কলেজ মোড়ে রয়েছেন?" "হ্যাঁ। কী করে জানলেন? ও, বুঝেছি। আপনিও বুঝি ওখানেই? গাড়িটা দেখতে পেয়েছেন নিশ্চয়ই।" লাবণ্য মনে মনে হাসলো। যাক, বুদ্ধি আছে ভালোই। শুধুই বুকনি না। চোখ পড়ল সিগনালে। আর ৯০সেকেন্ড। বললো, "হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন। আসলে জ্যামের মধ্যে দেখতে পেলাম। ভাবছিলাম কোনদিকে যাচ্ছেন, যদি লিফ্ট..."
"আরে নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আপনার এড্রেস তো দেখেছিলাম গলফ গ্রীন। আমি যাদবপুরে থাকি। রাস্তা এক। কোনো অসুবিধে নেই। আসুন। দাঁড়ান, আপনার লোকেশনটা বলুন। আমি পৌঁছে যাচ্ছি।"
লাবণ্য হেসে বললো, "চায়ের ঝুপড়িটার ঠিক সামনে আছি। সাদা কুর্তি, নীল জিন্স। পিঠে ল্যাপটপ ব্যাগ। ডান হাতে ফোন। কানে লাল ইয়ারফোন।"
"ব্যস ব্যস, বুঝে গিয়েছি। দেখতেও পেয়ে গেলাম। আসছি। সিগ্নালটা খুলুক। চলে আসছি।"
লাবণ্য নিজেই নিজের এরকম প্রগল্ভ আচরণে অবাক। বুকটা কিঞ্চিৎ ধুকপুক করছে। কী বলবে, কীভাবে কথা শুরু করবে। সিগনাল সবুজ হতেই গাড়ির যেন ঢেউ আছড়ে পড়লো রাস্তায়। একের পর এক। সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। এরই মধ্যে ওর সিলভার স্যানট্রো এসে থামলো, ওরই সামনে। কাঁচ নামিয়ে দরজাটা খুলে নীল স্ট্রাইপ ফর্মাল শার্ট, চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা পরা এক বছর তিরিশের সুদর্শন যুবক বললো, "উঠে পড়ুন দেখি, ঝটপট। আবার না সিগনালে আটকাই। অনেক কষ্টে লাল থেকে সবুজ হলাম।"
লাবণ্য সিটবেল্ট বেঁধে বসতে বসতে গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে। মিউজিক প্লেয়ারে এফ এমে গান চলছে। প্রিয় স্টেশন। ঠিক যেমন ওর চলতো। আহ। কতদিন পরে যেন নিজের অনেক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলো, এমনটাই মনে হচ্ছিল লাবণ্যর। গাড়ির ইন্টিরিয়র এখনো পাল্টায়নি। এমনকি একই ফ্র্যাগরেন্সের এয়ার পিউরিফায়ার। আহা। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল লাবণ্য। দুজনেই চুপ। বাইপাস দিয়ে চলেছে গাড়ি। আনমনা হয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে লাবণ্য। ব্যস্ত শহর। সবাই ঘরে ফিরছে। রুবির মোড়ে পৌঁছে সম্বিৎ ফিরলো অমিতের কথায়, "আপনি কি এই রুটে এই সময়েই যাতায়াত করেন?"
"মোটামুটি। ওই পনেরো মিনিট, আধ ঘন্টা প্লাস মাইনাস। কেনো?" জিজ্ঞেস করে লাবণ্য।
"আসলে ভাবছিলাম যে, আমার অফিস ওই কলেজ মোড়ের সামনেই। আমিও এই রুটেই ফিরি। এই সময়। রোজ। তাই, আর কী। আমি রোজই লিফ্ট দিতেই পারি আপনাকে।" ঝকঝকে স্মার্ট অমিত বললেন। লাবণ্য চুপ। অমিত বলতে থাকলেন, " অবশ্য রোজ হয়তো দেখা হবে না। টাইম কি আর রোজ মেলে?"
লাবণ্য মনে মনে হাসছে। বেশ বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। নেহাত মন্দও লাগছে না। তবুও কিছু বলে না। হাসে।
গাড়িটা যাদবপুর থানা কানেক্টরে সিগনালে আটকে আছে আবার। লাবণ্য বলে, "আমায় থানার ওখানে নামালেই হবে। বাস পেয়ে যাবো।"
অমিত বলেন, "আরে না না। তা কী করে হয়। আমি বাড়ি অবধিই পৌঁছে দেবো। ঠিকানাটা মনে নেই অবশ্য। আপনি ডিরেকশন দিন।"
লাবণ্য হেসে বলে "এরকম আরাম পেলে তো দেখছি রোজ টাইম মিলিয়ে নিতে হবে!"
অমিত হাসে। এই প্রথম যেন কী বলবে, বুঝে ওঠে না।
ট্রাফিকের লাল সিগনাল সবুজ হয়। সিলভার স্যানট্রো তার প্রাক্তন ও বর্তমান মালিককে নিয়ে ছুটতে থাকে বাইপাস কানেক্টর দিয়ে।
Wednesday, April 24, 2019
বই দিবস উপলক্ষে
ছোট থেকেই তেমন বেশি বন্ধুবান্ধব কখনোই ছিল না। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে
তাই গল্পের বইই হতো আমার একমাত্র সাথী। কোন ছোটবেলা থেকে মা বাবার হাত ধরে
জাগরণী পাঠাগার থেকে বই নেওয়া শুরু। মবি ডিক, রবিনসন ক্রুসো, এরাউন্ড দ্য
ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ, কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো... কত এমন ইংরেজি
ক্লাসিক্স পড়েছি। তারপর হাই স্কুলে প্রথম স্কুল লাইব্রেরি থেকে নিজের নামে
বই ইস্যু করা। প্রতি ক্লাসে মেন লাইব্রেরি পিরিয়ড তো থাকতোই, তার সাথে
ক্লাস লাইব্রেরি থেকেও বই নিয়ে গোগ্রাসে গিলতাম। গরমের ছুটি পুজোর ছুটিগুলোয়
দুপুরবেলা চুপচাপ মা বাবার আনা বইগুলো পড়তাম। সেগুলো তো আবার তখন "বড়দের
বই", তাই লুকিয়ে পড়া ছাড়া নিরুপায়। দিদিমার বাড়ি গিয়ে শরৎ রচনাবলী শেষ করা।
বাড়িতে গল্পগুচ্ছ। শরদিন্দু। সত্যজিৎ। পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা। আনন্দবাজার
পত্রিকা। দেশ। সব। গোলপার্কের পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো (আমার বন্ধু আবার
তার গালভরা নাম দিয়েছিল। লেন্ডিং লাইব্রেরি) থেকে গুচ্ছের গুচ্ছের ন্যান্সি
ড্রিউ, হার্ডি বয়েজ, ফেমাস ফাইভ, সিক্রেট সেভেন, ফাইভ ফাইন্ড আউটার্স,
ম্যালরি টাওয়ার্স, সুইট ভ্যালি... বলে শেষ করতে পারবো না।
বই পড়ার অভ্যেসটা মাঝে লেখাপড়ার চাপে অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তবুও নিয়ম করে পূজাবার্ষিকীগুলো পড়তাম।
চেন্নাইতে আসার পর একদিন কী মনে হলো কে জানে। ভাবলাম অনেক হলো এই সারাক্ষণ ওয়েব সিরিজ আর সিনেমা দেখা। আবার বইয়ে ফিরতে হবে। এখানে বসে বাংলা বই পড়ার সুযোগ প্রায় নেই বলে চলে। একটা লাইব্রেরির মেম্বার হলাম। অনলাইন বই বাছতাম। ওরা এসে দিয়ে যেতো। হোস্টেলের লাইব্রেরি থেকেও অনেক বই পড়েছি। ফেসবুকের সূত্রে অনেক ভালো ভালো বইয়ের সন্ধান পেয়েছি।
এখন দিনকাল পাল্টেছে। অনলাইনে কেনাকাটার দৌলতে চেন্নাইতে বসেও বাংলা বই পাই। প্রচুর ক্লাসিক বইয়ের পিডিএফও পাওয়া যায় সহজে। এতদিন কিন্ডল রিডারে পড়তাম। এখন সেটি খারাপ হওয়ায়, কিন্ডল app দিয়েই কাজ চালাই। দিব্যি লাগে।
শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়। এখনো কত কত বই পড়া বাকি। এ জীবনে কি পারবো শেষ করতে সব?
ভালো ভালো বই পড়ুন। পড়ান।
বিশ্ব পুস্তক দিবসের শুভেচ্ছা জানাই সকলকে।
চেন্নাইতে আসার পর একদিন কী মনে হলো কে জানে। ভাবলাম অনেক হলো এই সারাক্ষণ ওয়েব সিরিজ আর সিনেমা দেখা। আবার বইয়ে ফিরতে হবে। এখানে বসে বাংলা বই পড়ার সুযোগ প্রায় নেই বলে চলে। একটা লাইব্রেরির মেম্বার হলাম। অনলাইন বই বাছতাম। ওরা এসে দিয়ে যেতো। হোস্টেলের লাইব্রেরি থেকেও অনেক বই পড়েছি। ফেসবুকের সূত্রে অনেক ভালো ভালো বইয়ের সন্ধান পেয়েছি।
এখন দিনকাল পাল্টেছে। অনলাইনে কেনাকাটার দৌলতে চেন্নাইতে বসেও বাংলা বই পাই। প্রচুর ক্লাসিক বইয়ের পিডিএফও পাওয়া যায় সহজে। এতদিন কিন্ডল রিডারে পড়তাম। এখন সেটি খারাপ হওয়ায়, কিন্ডল app দিয়েই কাজ চালাই। দিব্যি লাগে।
শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়। এখনো কত কত বই পড়া বাকি। এ জীবনে কি পারবো শেষ করতে সব?
ভালো ভালো বই পড়ুন। পড়ান।
বিশ্ব পুস্তক দিবসের শুভেচ্ছা জানাই সকলকে।
- ফোনে স্পেস নেই, ড্রাইভে স্পেস নেই বলে বলে আর আমার মাথা খাবি না। এই বলে দিলাম।
- হঠাৎ?
- তোর পোস্টে সব আমার লাভ রিয়াক্ট করা নোটিফিকেশনের স্ক্রিন শট নিয়ে বসে আছিস। তুই কি পাগল?
- তুই কী করে জানলি? (খানিক চুপ। অপর প্রান্তে মৃদু হাসি।) তুই কী অসভ্য রে। যেই আমার পাসওয়ার্ডটা দিয়েছি, অমনি গুগল ফোটোস খুলছিস?
- আজ্ঞে না ম্যাডাম। আমি অত জবলেস নই। অটো সিঙ্কড ছিল। একবার সাইন ইন করায় আমার ফোনের সাথে সিঙ্কড হয়ে গিয়েছে। আমি নিজের গ্যালারি দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম।
- whatever। তুই তাও দেখবি কেন?
- আগে তুই বল, তুই এসব স্ক্রিন শট নিয়ে সেভ করতিস কেন?
- (আদুরে গলায়) ভালো লাগতো। তাই। তখনও 'কমিটেড' ছিলাম না। এগুলোই ছোট ছোট ভালোলাগা ছিল।
- আর এখন?
- এখন কী?
- এখন স্ক্রিন শট নিস না?
- নাহ!
- সব ভালোবাসা উধাও?
- উহু। এখন সব ভালোবাসা অনুভব করি। এইসব খেলো তুচ্ছ ব্যাপারে যায় আসে না।
- বুঝলাম!
- হুম। খাওয়া হয়েছে?
- না। এই খাবো।
- মিষ্টি খাস না। সেভ দ্য ক্যালোরি। রাত্রে আইসক্রিম খেতে যাবো।
- ওকে!
- তাড়াতাড়ি ফিরিস।
- চেষ্টা করবো। বাই।
- লাভ ইউ টু!
- লাভ ইউ!
- হঠাৎ?
- তোর পোস্টে সব আমার লাভ রিয়াক্ট করা নোটিফিকেশনের স্ক্রিন শট নিয়ে বসে আছিস। তুই কি পাগল?
- তুই কী করে জানলি? (খানিক চুপ। অপর প্রান্তে মৃদু হাসি।) তুই কী অসভ্য রে। যেই আমার পাসওয়ার্ডটা দিয়েছি, অমনি গুগল ফোটোস খুলছিস?
- আজ্ঞে না ম্যাডাম। আমি অত জবলেস নই। অটো সিঙ্কড ছিল। একবার সাইন ইন করায় আমার ফোনের সাথে সিঙ্কড হয়ে গিয়েছে। আমি নিজের গ্যালারি দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম।
- whatever। তুই তাও দেখবি কেন?
- আগে তুই বল, তুই এসব স্ক্রিন শট নিয়ে সেভ করতিস কেন?
- (আদুরে গলায়) ভালো লাগতো। তাই। তখনও 'কমিটেড' ছিলাম না। এগুলোই ছোট ছোট ভালোলাগা ছিল।
- আর এখন?
- এখন কী?
- এখন স্ক্রিন শট নিস না?
- নাহ!
- সব ভালোবাসা উধাও?
- উহু। এখন সব ভালোবাসা অনুভব করি। এইসব খেলো তুচ্ছ ব্যাপারে যায় আসে না।
- বুঝলাম!
- হুম। খাওয়া হয়েছে?
- না। এই খাবো।
- মিষ্টি খাস না। সেভ দ্য ক্যালোরি। রাত্রে আইসক্রিম খেতে যাবো।
- ওকে!
- তাড়াতাড়ি ফিরিস।
- চেষ্টা করবো। বাই।
- লাভ ইউ টু!
- লাভ ইউ!
Monday, April 22, 2019
" যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিলো "
অ্যাপ ক্যাবের গাড়িটা ছুটছে ইস্ট কোস্ট রোড বরাবর। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। সূর্যাস্ত দেখতে গিয়েছিল ওরা দুজন, শনিবারের বিকেলে। শহর থেকে অনতিদূরে, মহাবলিপুরমে। ওরা অর্থাৎ তোরণা সেনগুপ্ত আর পুলস্ত্য চক্রবর্তী। একটি মাল্টিন্যাশ্নাল কোম্পানিতে একসাথে চাকরি করে। কলিগের চেয়েও ঢের বেশী গভীর ওদের বন্ধুত্ব। সারা সপ্তাহের ব্যস্ততার পরে মাঝে মধ্যেই ওরা দুজনে এরকম বেরিয়ে পড়ে, শহরে, শহরের বাইরে ঘুরে বেড়াতে।
আজকেও বেশ ঘুরলো ফিরলো। তোরণার ফোটগ্রাফির শখ। জমিয়ে সূর্যাস্তের ছবি তুলেছে। তারপর দুজনের অতি প্রিয় রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রন, ক্র্যাব সহ জমাটি খাওয়া দাওয়া সেরেছে। সাথে আবার কিঞ্চিৎ পানপর্বও চলেছে। মন মেজাজ তাই দুজনেরই বেশ ফুরফুরে। এরই মধ্যে আবার বৃষ্টি। তার সাথে প্রাইম ক্যাবে খুব প্রিয় কিছু গান পরপর বেজে চলেছে প্লে-লিস্ট ধরে। এল্টন জন, জর্জ মাইকেল, এরোস্মিথ, লোবো।
"আজ দারুণ সময় কাটলো, বল?" জানলার বাইরে তাকিয়ে তোরণা বলল।
পুলস্ত্য মৃদু হাসলো। তারপর বললো, "ওয়েদারটা জাস্ট পাগল পাগল করে দিচ্ছে রে। ইচ্ছে করছে এই বৃষ্টিতে নেমে একটু ভিজি। আহ!"
বৃষ্টি তোরণার বড় প্রিয়। পুলস্ত্যই বরং একটু রাখঢাক করে চলে। ওর মুখে এমন ইচ্ছে শুনে তাই তোরণা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। চোখ মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। পুলস্ত্যর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, "চল। ভিজি। প্লীজ?"
পুলস্ত্য জানে। তোরণা একটু বেশিই প্রাণোচ্ছ্বল। একবার যখন মাথায় প্ল্যানটা এসেছে, তখন ওকে আটকানো মুশকিল। তবুও একটা শেষ চেষ্টা করতে ও বললো, "পাগল? ভিজে টিজে তারপর জ্বর হলে কে কাকে দেখবে? নেক্সট উইকে ইম্পরটেন্ট ক্লায়েন্ট মিট আছে, সে খেয়াল নেই বুঝি?"
"ধ্যাত্তেরি, বড্ড বেরসিক তুই। ওই জন্যই জীবনে কিছু হলো না তোর। একবার যখন ঠিক করেছি, তো আজকে ভিজবোই। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি যদি থেমে যায়, ড্রাইভারকে বলছি একটু সাইড করে পার্ক করতে। নেমে পড়।"
তোরণার আদেশে ড্রাইভার গাড়িটাকে একটু এগিয়ে রাস্তার ধারে পার্ক করলো। ওরা দুজনে নামলো বৃষ্টির মধ্যে। ড্রাইভার এসবে অভ্যস্ত। ওদের দিকে পাত্তা না দিয়ে তাই নিজের মনে ফোন নিয়ে খুটখুট করতে লাগলো।
বৃষ্টির তেজ যেন বেড়েছে। তার সাথে শনশন করে প্রবল হাওয়া দিচ্ছে। ওরা ভিজছে। একে অপরের হাত ধরে। তোরণা ষোড়শীর মতো উচ্ছ্বল। পুলস্ত্য একটু সংযত।
হঠাৎ প্রবল গর্জনে মেঘ ডেকে উঠলো। ত্রস্ত তোরণা এক ছুট্টে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলস্ত্যর বুকে। কেঁপে উঠলো পুলস্ত্যর বুক। দু'হাত দিয়ে সযত্নে তোরণার মুখ তুলে ধরল ও। তোরণার কপালের ওপর এসে পড়া এলোমেলো চুলগুলো পুলস্ত্য সযত্নে সরালো। তারপর আরো যত্নে নিজের তৃষ্ণার্ত ঠোঁটকে ডুবিয়ে দিলো তোরণার নরম কমলালেবুর মতো ঠোঁটে। শুষে নিতে সমস্ত প্রাণরস।
এটা যদি বায়োস্কোপ হতো, এখন নিশ্চয়ই পাশের কোন চায়ের দোকানের পুরনো এফ এম রেডিওতে বাজতো "উই রে, উই রে, ভান্দ ইয়েনর কলন্দভিড়ে..." *।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে যেটা হলো, তোরণার জিনসের পকেটে বেজে উঠলো ওর মোবাইল ফোনটা। আচমকা নিজেকে পুলস্ত্যর বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে ফোনটা বের করলো ও। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে অরিঞ্জয়ের নাম।
অরিঞ্জয় বর্তমানে ক্যানাডায় চাকুরীরত। গত অঘ্রাণে বেশ ধুমধাম করেই ওর আর তোরণার বিয়েটা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
**************************************************
* Uyirae Uyirae Vanthu Ennodu Kalanthuvidu
Uyirae Uyirae Ennai Unnoadu Kalanthuvidu
Ninaivae Ninaivae Enthan Nenjoadu Kalanthuvidu
Nilavae Nilavae Intha Vinnoadu Kalanthuvidu
Kaathal Irunthaal Enthan Kannoadu Kalanthuvidu
Kaalam Thaduthaal Ennai Mannoadu Kalanthuvidu
(এই গানটি আপনারা চেনেন। বম্বে সিনেমার "তু হি রে"। সেটারই তামিল ভার্সন।)
আজকেও বেশ ঘুরলো ফিরলো। তোরণার ফোটগ্রাফির শখ। জমিয়ে সূর্যাস্তের ছবি তুলেছে। তারপর দুজনের অতি প্রিয় রেস্তোরাঁয় গিয়ে প্রন, ক্র্যাব সহ জমাটি খাওয়া দাওয়া সেরেছে। সাথে আবার কিঞ্চিৎ পানপর্বও চলেছে। মন মেজাজ তাই দুজনেরই বেশ ফুরফুরে। এরই মধ্যে আবার বৃষ্টি। তার সাথে প্রাইম ক্যাবে খুব প্রিয় কিছু গান পরপর বেজে চলেছে প্লে-লিস্ট ধরে। এল্টন জন, জর্জ মাইকেল, এরোস্মিথ, লোবো।
"আজ দারুণ সময় কাটলো, বল?" জানলার বাইরে তাকিয়ে তোরণা বলল।
পুলস্ত্য মৃদু হাসলো। তারপর বললো, "ওয়েদারটা জাস্ট পাগল পাগল করে দিচ্ছে রে। ইচ্ছে করছে এই বৃষ্টিতে নেমে একটু ভিজি। আহ!"
বৃষ্টি তোরণার বড় প্রিয়। পুলস্ত্যই বরং একটু রাখঢাক করে চলে। ওর মুখে এমন ইচ্ছে শুনে তাই তোরণা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। চোখ মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলো। পুলস্ত্যর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, "চল। ভিজি। প্লীজ?"
পুলস্ত্য জানে। তোরণা একটু বেশিই প্রাণোচ্ছ্বল। একবার যখন মাথায় প্ল্যানটা এসেছে, তখন ওকে আটকানো মুশকিল। তবুও একটা শেষ চেষ্টা করতে ও বললো, "পাগল? ভিজে টিজে তারপর জ্বর হলে কে কাকে দেখবে? নেক্সট উইকে ইম্পরটেন্ট ক্লায়েন্ট মিট আছে, সে খেয়াল নেই বুঝি?"
"ধ্যাত্তেরি, বড্ড বেরসিক তুই। ওই জন্যই জীবনে কিছু হলো না তোর। একবার যখন ঠিক করেছি, তো আজকে ভিজবোই। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি যদি থেমে যায়, ড্রাইভারকে বলছি একটু সাইড করে পার্ক করতে। নেমে পড়।"
তোরণার আদেশে ড্রাইভার গাড়িটাকে একটু এগিয়ে রাস্তার ধারে পার্ক করলো। ওরা দুজনে নামলো বৃষ্টির মধ্যে। ড্রাইভার এসবে অভ্যস্ত। ওদের দিকে পাত্তা না দিয়ে তাই নিজের মনে ফোন নিয়ে খুটখুট করতে লাগলো।
বৃষ্টির তেজ যেন বেড়েছে। তার সাথে শনশন করে প্রবল হাওয়া দিচ্ছে। ওরা ভিজছে। একে অপরের হাত ধরে। তোরণা ষোড়শীর মতো উচ্ছ্বল। পুলস্ত্য একটু সংযত।
হঠাৎ প্রবল গর্জনে মেঘ ডেকে উঠলো। ত্রস্ত তোরণা এক ছুট্টে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো পুলস্ত্যর বুকে। কেঁপে উঠলো পুলস্ত্যর বুক। দু'হাত দিয়ে সযত্নে তোরণার মুখ তুলে ধরল ও। তোরণার কপালের ওপর এসে পড়া এলোমেলো চুলগুলো পুলস্ত্য সযত্নে সরালো। তারপর আরো যত্নে নিজের তৃষ্ণার্ত ঠোঁটকে ডুবিয়ে দিলো তোরণার নরম কমলালেবুর মতো ঠোঁটে। শুষে নিতে সমস্ত প্রাণরস।
এটা যদি বায়োস্কোপ হতো, এখন নিশ্চয়ই পাশের কোন চায়ের দোকানের পুরনো এফ এম রেডিওতে বাজতো "উই রে, উই রে, ভান্দ ইয়েনর কলন্দভিড়ে..." *।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে যেটা হলো, তোরণার জিনসের পকেটে বেজে উঠলো ওর মোবাইল ফোনটা। আচমকা নিজেকে পুলস্ত্যর বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে ফোনটা বের করলো ও। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে অরিঞ্জয়ের নাম।
অরিঞ্জয় বর্তমানে ক্যানাডায় চাকুরীরত। গত অঘ্রাণে বেশ ধুমধাম করেই ওর আর তোরণার বিয়েটা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
**************************************************
* Uyirae Uyirae Vanthu Ennodu Kalanthuvidu
Uyirae Uyirae Ennai Unnoadu Kalanthuvidu
Ninaivae Ninaivae Enthan Nenjoadu Kalanthuvidu
Nilavae Nilavae Intha Vinnoadu Kalanthuvidu
Kaathal Irunthaal Enthan Kannoadu Kalanthuvidu
Kaalam Thaduthaal Ennai Mannoadu Kalanthuvidu
(এই গানটি আপনারা চেনেন। বম্বে সিনেমার "তু হি রে"। সেটারই তামিল ভার্সন।)
Friday, April 19, 2019
জিরো থ্রি থ্রি (৩)
৪৩/১ গোপাল ব্যানার্জী লেন। ছোট্ট কাঠের খিল দেওয়া দরজা ঠেলে ঢুকলেই উঠোন। উঠোনে চৌবাচ্চায় ঠাণ্ডা কালো জল। দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠেই সেই টানা লম্বা দালান। দালানের একদিকে হাবিজাবি বাতিল জিনিসে ঠাসা একটা পুরনো শুকনো চৌবাচ্চা। পাশেই রান্নাঘর। মইমার রান্নাঘর। উঁকি মারলেই সব-পেয়েছির-দেশ। গরম গরম ঘুগনি, টমেটোর আঁচার, মৌরলা মাছ ভাজা, কুঁচো নিমকি, মিল্কমেইডের টিন... সবুজ মিটসেফের ভিতর রত্ন খনি। মায়ের শাসন, চোখ রাঙানি মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ! এল-শেপের দালানের আরেক প্রান্তে দেওয়ালে পেরেক দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা মা আর মামণির কোন ছোট্টবেলাকার টানা রথ। পাশেই কাঠের তাকে সারি সারি ঠাকুর দেবতার মূর্তি, ছবি। অবশ্য আমার নজর তাঁদের সামনে রাখা পুঁচকি স্টিলের প্লেটে রাখা নকুলদানা আর মিছরিতে। দালানে পাতা কাঠের বেঞ্চিতে খানিক বসতে না বসতেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা গ্লুকন ডি হাজির। ততক্ষণে অবশ্য আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গলির উল্টোদিকের রান্নাঘর থেকে মইমার পাড়াতুতো ননদেরা "ও বৌদি, নাতনি এলো বুঝি?" শুরু করে দিয়েছে। আমিও এক ছুট্টে দাদাই ঘরে ঢুকে সবুজ লোহার জানলার পাল্লা খুলে গরাদ ধরে ঝুলে পড়েছি। "কেমন আছো দিদা? কী রান্না করছো আজ?"
একটু দুপুর হতেই পোস্ত ডাল তরকারি মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে অ্যাজবেস্টসের ছাদের ঘরে ঢুকে পড়া। প্রচণ্ড গরম। লম্বা ডাণ্ডার ডিসি ফ্যান মাঝে মাঝেই বিরাম নিয়ে ফেলছে। বাঁচতে তখন একটাই উপায়। খাটের তলায় ঢুকে যাও। সিমেন্টের মেঝে। অনেকটাই ঠাণ্ডা। এদিকে ঘুম তো আসে না চোখে। মায়ের পিটুনি খেয়ে তাও চোখ বুজে শুয়ে থাকা। যদি ভুল করে একটু ঘুমিয়ে পড়ি। পাশের বাড়ির অ্যাজবেস্টসের ছাদের নীচে ফাঁকে তখন এক দল পায়রার সুখ-নীড়। মধ্যে মধ্যেই তাই বক-বকম। ঘুমহীন চোখ। হাঁ পিত্যেশ করে তাকিয়ে আছি দেওয়াল ঘড়ির দিকে। কখন ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘরে পৌঁছবে। এই মিছিমিছি ঘুমের প্রহসন থেকে পাবো মুক্তি। গড়াতে গড়াতে কাঁচের আলমারির এক্কেবারে সামনে চলে আসি। নীচের তাকে তখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায় দাদাভাইয়ের সেই মেরুন-সবুজ রঙের কাঠের রেল-ইঞ্জিন, মামণির দেওয়া খেলনাবাটি। আর একটু ওপরের তাক থেকে জুলজুল করে দেখছে আর আমায় বারবার হাতছানি দিচ্ছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার আর শরৎ রচনাবলী।
একটা সময় দালানের এক্কেবারে শেষ প্রান্তে, জামাকাপড় বোঝাই আলনার উল্টোদিকে ছোট ঘরটায় দেওয়ালের পেন্ডুলাম ঘড়িটি ঢং ঢং করে ছুটি ঘোষণা করে। হইহই করে এক ছুটে ঘরে উঠে রাস্তার দিকের দরজাটা খুলে বসে পড়ি খেলনাবাটি নিয়ে। শুরু হয় মনগড়া জগতে অবাধ বিচরণ।
শেষ হয়ে যায় আরেকটা গ্রীষ্মের দুপুর।
এখনও লু বয়। এখনও পায়রাগুলো ডেকে যায়। সেই কাঠের রেল-ইঞ্জিন ধুঁকতে থাকে। তবু ঘরে ফেরা হয় না।
একটু দুপুর হতেই পোস্ত ডাল তরকারি মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে অ্যাজবেস্টসের ছাদের ঘরে ঢুকে পড়া। প্রচণ্ড গরম। লম্বা ডাণ্ডার ডিসি ফ্যান মাঝে মাঝেই বিরাম নিয়ে ফেলছে। বাঁচতে তখন একটাই উপায়। খাটের তলায় ঢুকে যাও। সিমেন্টের মেঝে। অনেকটাই ঠাণ্ডা। এদিকে ঘুম তো আসে না চোখে। মায়ের পিটুনি খেয়ে তাও চোখ বুজে শুয়ে থাকা। যদি ভুল করে একটু ঘুমিয়ে পড়ি। পাশের বাড়ির অ্যাজবেস্টসের ছাদের নীচে ফাঁকে তখন এক দল পায়রার সুখ-নীড়। মধ্যে মধ্যেই তাই বক-বকম। ঘুমহীন চোখ। হাঁ পিত্যেশ করে তাকিয়ে আছি দেওয়াল ঘড়ির দিকে। কখন ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘরে পৌঁছবে। এই মিছিমিছি ঘুমের প্রহসন থেকে পাবো মুক্তি। গড়াতে গড়াতে কাঁচের আলমারির এক্কেবারে সামনে চলে আসি। নীচের তাকে তখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায় দাদাভাইয়ের সেই মেরুন-সবুজ রঙের কাঠের রেল-ইঞ্জিন, মামণির দেওয়া খেলনাবাটি। আর একটু ওপরের তাক থেকে জুলজুল করে দেখছে আর আমায় বারবার হাতছানি দিচ্ছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার আর শরৎ রচনাবলী।
একটা সময় দালানের এক্কেবারে শেষ প্রান্তে, জামাকাপড় বোঝাই আলনার উল্টোদিকে ছোট ঘরটায় দেওয়ালের পেন্ডুলাম ঘড়িটি ঢং ঢং করে ছুটি ঘোষণা করে। হইহই করে এক ছুটে ঘরে উঠে রাস্তার দিকের দরজাটা খুলে বসে পড়ি খেলনাবাটি নিয়ে। শুরু হয় মনগড়া জগতে অবাধ বিচরণ।
শেষ হয়ে যায় আরেকটা গ্রীষ্মের দুপুর।
এখনও লু বয়। এখনও পায়রাগুলো ডেকে যায়। সেই কাঠের রেল-ইঞ্জিন ধুঁকতে থাকে। তবু ঘরে ফেরা হয় না।
Monday, April 15, 2019
একটি
ভূতের গল্প
সুচেতনা
গুপ্ত
আসুন
আজ আপনাদের একটি পোষা ভূতের
গল্প বলি। কী বললেন?
পোষা
ভূত শুনে চমকে গেলেন?
ও
মা, লোকের
পোষা কুকুর বিড়াল খরগোশ মাছ
এমনকি হাতি থাকতে পারলে,
পোষা
ভূত থাকতে পারে না বুঝি?
অনেক
বড়লোক পয়সাওয়ালা লোকজন তো
আবার শখ করে কত সময় মানুষও
পুষে ফেলে। সেই বেলা?
যাক
গে, তো
যা বলছিলাম। ঘটনাটি শোনা আমার
ছোট মামার কাছে। সেবার গরমের
ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়েছি।
মামা তখন ভাগলপুর থেকে ছুটি
নিয়ে জলপাইগুড়িতে নিজের বাড়ি
এসেছে। মায়ের সাথে আমি আর বড়
মাসীর সাথে আমার দুই যমজ বোন
ফুল আর রেণুও ওখানে। বড়মামার
দুই ছেলেমেয়ে। তুবড়ি দাদা আর
চরকি দিদিও রয়েছে। ভাইবোনেরা
মিলে সারাদিন হইহুল্লোড় করে
বাড়ি মাথায় করছি। তখন সন্ধ্যেবেলা
খুব কারেন্ট যেত। আর তার মধ্যে
ঝড়বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।
হয়তো সারারাত এলোই না। আমার
মামাবাড়ির ওদিকে তখনও ইনভার্টারের
রমরমা হয়নি। কাজেই কারেন্ট
যাওয়া মানে তখন পাঁচ ভাই বোন
মিলে বড়দের পাকড়াও করা। গল্প
শোনানোর জন্য। ছোট মামার বদলির
চাকরি। অনেক অভিজ্ঞতা। তাই
প্রায়দিনই গল্পকার হতো ছোটমামা।
মা মাসি বড় মামা,
মামীও
যোগ দিতো ওই গল্প শোনার আসরে।
বিরাট বড় হলঘরে দুটো লন্ঠন
রাখা। তার টিমটিমে আলো ঘিরে
আমরা সবাই বসে। বাইরে বৃষ্টি
হলেই ভূতের গল্প। গা ছমছমে
পরিবেশে পুরো জমে যেত।
এরকম
একদিন যখন তুবড়ি দাদা আর ফুল
রেণু মামাকে ধরেছে আবার ভূতের
গল্প শোনাতে,
ছোটমামা
বলল, "দাঁড়া,
তোদের
আজ অন্যরকমের ভূতের গল্প বলি।”
আমরা
তো অবাক। বলে কী?
অন্যরকম
ভূতের গল্প। সে আবার কেমন
ব্যাপার?
আমাদের
অবাক চোখ মুখ দেখে ছোটমামা
বলল, "এই
ভূত হলো পোষা ভূত। এই ধর চরকি
তোর মাসীর বাড়ি যেমন পোষা টমি
আছে, তেমনই
পোষা।” টমি হল বড় মামীর দিদির
বাড়ির খয়েরি রঙের পোষা
স্প্যানিয়েল। আমরা খুব ভালোবাসি।
মাঝেমাঝে ওদের বাড়ি গিয়ে আদর
করে আসি। আমি বললাম,
"সে
কীরকম? বলো
বলো। বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে।”
এইবারে
ছোটমামা একটু গলা খাঁকড়ি দিয়ে
শুরু করলো আসল গল্প।
'আমার
এক কলিগ,
মাধবরাও
পাণ্ডে একদিন আমায় ওঁর বাড়ি
নেমন্তন্ন করেছেন। আমি একা
মানুষ। নিজে হাত পুড়িয়ে রান্না
করে খাই। আর উনি রোজ কোর্মা
কালিয়া পোলাওয়ের গল্প করেন।
কী দয়া হলো কে জানে,
আমায়
বললেন,
"সেনগুপ্তা
সাহাব, কাল
শাম আপনি আমার সাথে আমার ঘর
চলুন। আমার ঘরপে থোড়া বহত খানা
খেয়ে যাবেন।” আমি বাপু খানেওয়ালা
লোক। এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম।
শুধু একবার ভদ্রতার খাতিরে
জিজ্ঞেস করলাম,
"আপনার
কোন অসুবিধে হবে না তো মাধবজী?
ভাবীও
নেই এখানে এখন। রান্নাবান্নার
চক্করে নাই বা গেলেন...”
উনি
হেসে আমায় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে
বললেন, "কুছ
চিন্তা নেই সেনগুপ্তা সাহাব,
আমার
ঝুমরি আছে তো। ও আমায় সাহায্য
করবে।” আমি কিছু বললাম না,
ঠিক
আছে। কাজের লোক টোক আছে বুঝি।
সেই সাহায্য করবে যখন,
আর
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।'
"আচ্ছা
মামা, এই
ঝুমরিই কি ভূত?”
ফুল
প্রশ্ন করলো।
ছোটমামা
বলল, “দেখো
ভাগ্নি,
তুমি
খুব স্মার্ট আর বুদ্ধিমতী সে
আমি জানি। কিন্তু শোনো,
ভূতের
গল্প শুনতে বসে প্রথম নিয়ম।
মাঝপথে থামাবে না। এতে গল্পের
ফ্লোতে ব্যাঘাত ঘটে। বিঘ্ন
ঘটলে আর মজা পাবে না। বুঝলে?”
ফুল
একটু চুপসে গেলো। আমি আর চরকি
দিদি ওর দিকে খানিক কটমট করে
তাকালাম। তারপর মামা আবার
শুরু করলো।
'তো
যা বলছিলাম। পরদিন সন্ধ্যেবেলা,
এই
ধর তখন ক'টা
হবে... এই
সাড়ে ছটা নাগাদ আমি আর মাধবজী
ওঁর মোটরসাইকেলে রওনা দিলাম
ওঁর বাসার উদ্দেশ্যে। পথে
সুখদেবের দোকানে একবার বাইক
থামিয়ে আমরা ওই একটু পেপসি
টেপসি আর চিপস কিনে সাতটার
একটু পরে পৌঁছলাম বাড়ি। বাড়ি
এক্কেবারে সেই মান্ধাতার
আমলের। এই বড় বড় থাম। লম্বা
দালান। টানা গাড়ি বারান্দা।
মাধবজী বাইকটাকে উঠোনের একটা
কোণে রেখে আমায় নিয়ে বারান্দায়
উঠলেন। এরপর পকেট থেকে একটা
চাবি বের করে দরজা খুলে বললেন,
"আসুন
সাহাব। গরীবের বাসায় আসুন।”
বাঁ দিকের দেওয়ালেই সুইচবোর্ড।
উনি আলো জ্বাললেন। দেখলাম কী
উঁচু সিলিঙ। লম্বা লম্বা
ডাণ্ডাওয়ালা পাখা। লাইটগুলোও
পুরনো ধাঁচের। নক্সা করা
ল্যাম্পশেড। দেওয়ালের রঙ
ফিকে। একটা নরম গদির সোফা,
পরিপাটি
করে সাজানো। আমায় বসতে বললেন
ওখানে। আমি বললাম,
"বাহ,
আপনি
তো বেশ গুছিয়ে থাকেন মশাই।
ভাবী নেই। তাও এমন টিপটপ,
ফিটফাট।”
মাধবজী হেসে হাত কচলে বললেন,
"সবই
ঝুমরির কৃপা। আপনি বসুন। আরাম
করে বসুন। আমি পেপসিটা গ্লাসে
ঢেলে আনছি।” এই বলে উনি ভিতরে
চলে গেলেন। সম্ভবত রান্নাঘর।
বা ডাইনিং রুম। আমি একটু এদিক
ওদিক চোখ বোলালাম। সত্যি,
বাইরে
থেকে মান্ধাতার আমলের বাড়ি
লাগলেও,
অন্দরসজ্জা
খুবই শৌখিন ও রুচিসম্পন্ন।
ঝুমরিই যদি সব করে থাকে,
খুবই
বাহবা দিতে হয় বই কি।
এইসব
ভাবছি,
ইতিমধ্যে
মাধবজী একটা ট্রেতে দুই গ্লাস
পেপসি আর প্লেটে চানাচুর আর
চিপস আনলেন। টেবিলে রেখে আবার
গেলেন ভিতরে। এবার নিয়ে ফিরলেন
আরেকটা প্লেট। এতে দেখলাম
ভাজাভুজি। নানারকমের। আমার
দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
"নিন
নিন। খেতে শুরু করুন। একদম
গরমা গরম।” ওই যে বললাম,
আমি
খাবার ব্যাপারে কোন রাখঢাক
করি না। বলা মাত্রই একটা চপ
তুলে মুখে দিলাম। আহা। খুব
গরম। কিন্তু অতুলনীয় স্বাদ।
নরম তুলতুলে পনীরের চপ। আমি
আরো খান সাত আটেক খেয়ে দেয়ে
ওঁকে বললাম,
"দারুণ
টেস্ট। আপনি বানালেন বুঝি?”
মাধবজী
এবার জোরে জোরে হাসতে হাসতে
বললেন, "আরে
না না সেনগুপ্তা সাহাব। আমি
কী করে বানাবো?
আপ
হি কে সাথ তো আমি এলাম। এসেই
এমন গরম চপ হাম কী করে রেঁধে
দেবে আপনাকে?
এ
সব ঝুমরির করা।”
এই
নিয়ে দ্বিতীয়বার ঝুমরির
প্রশংসা শুনলাম এই বাড়িতে।
ভাবলাম,
বেশ
ভালোই কাজের লোক পেয়েছেন উনি।
ওদিকে আমার কমলার মা তো মাসের
মধ্যে আদ্ধেক দিনই কামাই করে।
কপাল। সবই কপাল। আমাদের গল্প
চলতে লাগল। অফিস। ক্লাব।
সিনেমা। ক্রিকেট। নানান বিষয়ে।
মাঝে একবার উনি আমায় জিজ্ঞেস
করলেন কটা নাগাদ রাতের খাবার
খাই। আমি বললাম,
"ওই
নটার দিকে। একা থাকি। তাড়াতাড়ি
খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ি। রাত জেগেই
বা কী করবো?”
উনি
বললেন,
"দাঁড়ান
তাহলে। ভিতরে খবর দিয়ে আসি।”
খানিক
পরে এসে বললেন,
“ঝুমরিকে
বলে এলাম। রান্নাবান্না
মোটামুটি আমার সকালেই করে
রাখা আছে। ও গরম করে দেবে। আর
কটা রুটি করবে। আপনি রুটি খান
তো? নাকি
ভাত? মেনুতে
চিকেন কারি,
আলু
মসলা আর ব্যাঙ্গন ভর্তা রয়েছে।”
আমি প্রসন্ন হয়ে বললাম,
"হ্যাঁ
এই মেনুতে রুটিই সেরা সঙ্গত
হবে। আপনি বসুন তো। বড্ড ঘরবার
করছেন। এই জন্যই বলছিলাম। এত
আয়োজন না করতে।”
"আরে
না না। ঝুমরিই সব করছে।” উনি
আবারও বলে আশ্বস্ত করলেন আমায়।
গল্প
করতে করতে সন্ধ্যেটা বেশ কাটল
আমাদের। নটার একটু আগে উনি
রান্নাঘরে গিয়ে ঝুমরিকে
নির্দেশ দিয়ে এলেন রুটি আর
ভর্তা বানানোর। আমিও মাঝে
মাঝে রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছোক
শব্দ পেতে লাগলাম। নটা নাগাদ
যখন মাধবজীর সাথে খাবার ঘরে
গেলাম,
দেখলাম
টেবিলে খুব সুন্দর করে সমস্ত
খাবার সাজানো। ক্যাসারোলে
রুটি, বাটিতে
ডাল, তরকারি।
বড় বাটিতে মাংস। কাঁচের প্লেটে
স্যালাড। এলাহী আয়োজন। গল্প
করতে করতেই খেলাম। সে খাবারের
স্বাদ বিশ্বাস করবি না,
স্বর্গীয়।
কী সুসিদ্ধ মাংস। সমস্ত মসলা
যেন এক্কেরে সঠিক পরিমাণে
দেওয়া। খাওয়াদাওয়া শেষ করে
পান মসলা চিবোতে চিবোতে আমি
একবার ভদ্রতার খাতিরে মাধবজীকে
বললাম,
"মাধবজী,
একবার
আপনার ঝুমরিকে ডেকে দিন না।
ও এত ভালো রেঁধেছে। ওকে বলি।
একটু বকশিস দিতেও ইচ্ছে করছে।”
আমার
কথা শুনে মাধবজী যেন আকাশ থেকে
পড়লেন, এমন
মুখ করে বললেন,
"আরে
সেনগুপ্তা সাহাব,
বলেন
কী? ঝুমরিকে
বকশিস?”
আমি
একটু অপ্রস্তুত বোধ করলাম।
এই রে, ভুল
কিছু বললাম নাকি?
আমি
তো ধরেই নিয়েছি ঝুমরি ওঁর
কাজের মেয়ের নাম। আসলে আত্মীয়
টাত্মীয় নয় তো?
তাহলে
তো খুবই লজ্জার ব্যাপার হবে।
একটু নিচু গলায় প্রশ্ন করলাম,
"না
মানে, কেন?
আসলে
আমি ওর কাজে খুবই খুশি হয়েছি।
আমাদের ওখানে তো এটাই রীতি...”
মাধবজী
হেসে বললেন,
"আরে,
সে
বকশিসের রীতি তো আমাদেরও আছে।
তবে ঝুমরির ব্যাপারটা অন্য।”
আমি
ক্রমশ উদগ্রীব হচ্ছি ব্যাপারটা
বোঝার জন্য। এরপর উনি যা বললেন,
তা
শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত
ছিলাম না। মানে যে কেউই চমকে
যেতো। উনি বললেন,
"ঝুমরি
আমার পোষা ভূত।”
"অ্যাঁ?
বলেন
কী পোষা ভূত?”
আমার
গলাটা একটু কেঁপে গেলো।
"হেঁহেঁ,
বিশ্বাস
হচ্ছেনা তো?
আসুন
তবে।” এই বলে উনি আমায় রান্নাঘরে
নিয়ে গেলেন। দেখলাম,
কেউ
কোথাও নেই।
"কই?
কেউ
নেই তো?”
আমি
বললাম।
"আছে
আছে। না থাকলে এই এত রান্নাবান্না
কে করল বলুন?
আমি
তো আপনার সাথেই ছিলাম। রান্নার
শব্দ পাচ্ছিলেন তো।” উনি
বললেন।
আমি
বললাম, "সে
হয়তো রাঁধুনি এসেছিল। চলে
গেছে এখন।'
"উহু",
উনি
মাথা নাড়লেন। "দাঁড়ান,
আপনার
যাতে বিশ্বাস হয়,
ডেমো
দেখাই।” এই বলে তিনি গলা উঁচু
করে ভিতরদিকে তাকিয়ে অদৃশ্য
কারুর উদ্দেশ্যে বললেন,
"ঝুমরি,
বেটি
এক গ্লাস জল আনো তো মা। বাবুকে
দাও।”
এবং
তোরা বিশ্বাস করবি কি জানিনা,
মুহূর্তের
মধ্যে দেখলাম তাক থেকে একটা
স্টিলের গ্লাস উঠে এলো। ঠিক
যেন কেউ ওটা ধরে নিয়েছে। আমি
শুধু তার হাত দেখতে পাচ্ছিনা।
তারপর দেখলাম টেবিল থেকে জলের
কলসীটা কাত হলো। এবারও কোন
অদৃশ্য হাতেই। কলকল করে জল
ভরতে থাকলো গ্লাসে। ঢালতে
গিয়ে খানিকটা জল মেঝেতে পড়ল।
আমি হাঁ হয়ে দেখছি গোটা ব্যাপারটা।
জল ভর্তি গ্লাসটা আমার সামনে
এসে গেলো।
"দেখুন
দেখুন। দেখুন সেনগুপ্তা সাহাব,
মেঝেতে
দেখুন।” কোনমতে গ্লাসটা ধরে
মেঝেতে দেখলাম। দেখি এক জোড়া
ছোট পায়ের ছাপ। ভিতরে চলে
যাচ্ছে। একদম আমরা যেমন মা
লক্ষ্মীর পায়ের আলপনা দিই,
ওইরকম।
তবে একটু আলাদা। এই পায়ের ছাপ
ঠিক উল্টো। যেন গোড়ালি সামনে,
পায়ের
আঙুল পিছনে।
আমি
ঘামতে শুরু করে দিয়েছি। এসব
কী হচ্ছে?
আমার
অবস্থা দেখে মাধবজীর বুঝি
দয়া হল। আমার কাঁধে হাত রেখে
বললেন,
"ঘাবড়াবেন
না সাহাব। ঝুমরি বহুত আচ্ছি
বাচ্চি হ্যায়। ও কোন ক্ষতি
করবে না কারুর।”
বলে
কী? ভূত?
আদৌ
হয় বলে এতদিন বিশ্বাস করতাম
না। একেই চোখের সামনে দেখতে
পেলাম। তারপর বলে কি কোন ক্ষতি
করবে না?
মানেটা
কী?
"আমি
কিচ্ছু বুঝছি না,”
ভয়ে
ভয়ে বললাম।
“আরে
তাহলে আপনাকে ঝুমরির গল্প
বলি।” এই বলে উনি আমায় নিয়ে
সোফায় এসে বসলেন। তারপর বললেন,
“পাঁচ
মহিনা পেহলে একদিন দোপেহেরে
আপনার ভাবীজি খাওয়ার পর বাসন
মাজতে বসেছে,
কাজের
বউটি আসেনি বলে। তখনই প্রথম
ঝুমরির উপস্থিতি টের পেলেন।
চৌবাচ্চার জলের মধ্যে হঠাৎ
হঠাৎ যেন কেউ ঢিল ছুঁড়ছে। আমার
বউ তো প্রথমে অবাক। আশেপাশের
বাড়ি থেকে কোন বিচ্ছু ছেলেপুলে
নাকি? এদিক
ওদিক ভালো করে দেখতে থাকল।
কোথাও কেউ নেই। তাহলে হয়তো
হাওয়ায় হলো?
কে
জানে। আর কিছু ভাবেনি।
এরপর
আবার দিন তিনেক পর একই ঘটনা
ঘটল আবার। এইবারে আমার বউ একটু
ঘাবড়ে গেলো। কে কে বলে চেঁচাল।
তখন একটা বাচ্চার খিলখিল হাসির
শব্দ শুনতে পেলো। ও তো অবাক।
এদিক ওদিক দেখছে। কেউ কোথাও
নেই। ভয় লাগছে। হাসির শব্দ
বরাবর তাকালো। দেখল একটু দূরে
শুকনো উঠোনের একদিকে পায়ের
ছাপ। এবং ঠিক এরকম উল্টো। আমার
বউ ভির্মি খেয়ে গেলো। ওঁর
জ্ঞান ফিরল খানিক পর,
জলের
ঝাপটায়। অথচ চোখ খুলে দেখে
সেই কোথাও কেউ নেই। তখনই একটা
রিনরিনে গলায় শুনলো,
"ও
মউসি, ডরো
মত। আমি ঝুমরি।”
আমার
বউয়ের আবার জ্ঞান হারানোর
অবস্থা। বলে কী?
তারপর
আবার মেয়েটির কথা শুরু হলো,
"মউসি,
আমি
ঝুমরি। আগে এই বাড়িতে থাকতাম।
তারপর একদিন মোটর দুর্ঘটনায়
একদিন বাবা মা আর আমি মরে যাই।
বাবা মায়ের পরের জন্ম হয়ে
গিয়েছে। আমি এখনও লাইনে আছি।
কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই
আমার পুরনো ঘরে এসে থাকি। একলা
একলা থাকি। ভাল্লাগেনা। তাই
ভাবলাম একটু তোমার সাথে আলাপ
করি। তুমিও দিনভর অকেলা থাকো।
মউসি, আমি
কথা দিচ্ছি। তোমায় বা মউসাকে
একটুও ভয় দেখাবো না। আমি বরং
তোমাদের কাজেকর্মেও সাহায্য
করব। শুধু আমার সাথে দুটো গল্প
করো মউসি। একা একা নইলে খুব
খারাপ লাগে।” আমার বউ তখনও
হতবাক। আমায় শিগগিরই ফোন করে
বাড়ি ডাকল। আমি ফিরে এসে সব
শুনে থ। এর মধ্যে আবার ঝুমরি
আমায়ও ওর উপস্থিতির ডেমো তো
দিলোই, সাথে
আবার লজ্জা টজ্জা পেয়েও গল্প
করলো। সেই থেকে ঝুমরি আমাদের
বাড়িতেই থাকে সেনগুপ্তা সাহাব।
বেটির মতোই। ওকে আমরাই পালছি।”
সেদিন
মাধবজী ওঁর বাইকে চাপিয়ে আমায়
বাড়ি অবধি পৌঁছে দেন। ফেরার
সময় বলেন,
"কিন্তু
সাহাব,
ঝুমরির
আসলিয়াত অফিসে শুধু আপনি
জানেন। আর কাউকে বলবেন না
প্লীজ। লোকে আমায় পাগল ভাববে।
নউকরি নিয়ে টানাটানি হয়ে যাবে।
বুঝতেই তো পারছেন। আপনি বঙ্গালী।
অনেক লিব্রাল আছেন। তাই আপনাকে
সাহস করে বললাম।”
আমি
অবশ্য অফিসে কাউকে এই কথা
বলিনি। কে জানে,
লোকে
হয়তো আমাকেই পাগল ভাববে।
ভাবতেই পারে। তাঁদের কারুর
তো আর এমন অভিজ্ঞতা হওয়ার
সুযোগ নেই। মাধবজী ওঁদের
কাউকেই ডাকবেন না বাড়িতে কখনও
ভাবীজি না থাকলে।'
এই
পর্যন্ত বলে ছোটমামা থামল।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
"কী?
কেমন
লাগল?” আমরা
পাঁচ ভাইবোন চুপ। মুখে একটাও
কথা নেই। পাশ থেকে শুধু মাসি
বলল, “ইশ,
আমাদের
যদি এরকম একটা হেল্পিং হ্যান্ড
থাকতো রে...
ওই
বীণার মা মঞ্জু এরা ডুব দিলেও
পাত্তা দিতাম না।”
ছোটমামা
সব শুনেটুনে একটাই কথা বলল,
"বোঝো
কাণ্ড!”
*****************************************
Friday, April 12, 2019
- জানিস সকাল সকাল মনটা কেমন একটা করছে!
- কী আবার হলো?
- মালপোয়া আর ছানার জিলিপি জিলিপি করছে মনটা।
- মানে?
- কী মানে? মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
- ঘুম থেকে উঠেই ক্রেভিং?
- আহা, স্বপ্ন দেখলাম যে।
- স্বপ্নে মিষ্টি?
- হ্যাঁ!
- কীরকম?
- দেখলাম তুই আমাদের বাড়িতে এসে আছিস। এমন সময় তোর জ্যাঠা জেঠি এসেছেন। তুই এখানে বলে ওঁরা এখানেই এসেছেন। সাথে এই এত্ত এত্ত মিষ্টি। মালপোয়া, ছানার জিলিপি, সরভাজা। ও পাটিসাপটাও।
- খেলি?
- না হলে বলছি? কী টেস্ট রে!!! এক কামড় দিচ্ছি আর রস চুইয়ে পড়ছে। আহা। অমৃত বুঝি একেই বলে।
- কটা খেলি?
- মালপোয়া ৩টে। ও, মা জানে ২টো। ছানার জিলিপি ৩টে। ওটাও মা জানে ২টো। আর তোর ভাগ থেকেও এম কামড় করে দুটো মিষ্টি থেকেই।
- আর পাটিসাপটা?
- না। ওটা পরে।
- মানে ৬টা মিষ্টি খেয়েও আবার মিষ্টির ক্রেভিং? সুগার টেস্ট করা।
- ধুর। স্বপ্নে তো। থোড়াই সত্যি খেয়েছি।
- উহু। কোন এক মহামনীষী বলে গেছেন, ঘুমের মধ্যে এত মিষ্টি খেলে, হয় জেগে উঠে এক্সারসাইজ করতে হয়, নইলে সন্ধ্যের মধ্যে কোমর দুই ইঞ্চি বেড়ে যায়।
- যত ঢপবাজি, না?
- যা কাজ কর। উইকেন্ড এলো বলে। কাল মিষ্টি হাব যাবোখন।
- ইয়ে!!!
- ও, আর সরভাজা কটা?
- ওটাতে মা হাত দিতে দেয়নি।
- আহা রে। কাল তাহলে আগে ওটা!
- এই না হলে তুই!! মানুষ চিনতে একটুও ভুল করিনি!
- কী আবার হলো?
- মালপোয়া আর ছানার জিলিপি জিলিপি করছে মনটা।
- মানে?
- কী মানে? মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
- ঘুম থেকে উঠেই ক্রেভিং?
- আহা, স্বপ্ন দেখলাম যে।
- স্বপ্নে মিষ্টি?
- হ্যাঁ!
- কীরকম?
- দেখলাম তুই আমাদের বাড়িতে এসে আছিস। এমন সময় তোর জ্যাঠা জেঠি এসেছেন। তুই এখানে বলে ওঁরা এখানেই এসেছেন। সাথে এই এত্ত এত্ত মিষ্টি। মালপোয়া, ছানার জিলিপি, সরভাজা। ও পাটিসাপটাও।
- খেলি?
- না হলে বলছি? কী টেস্ট রে!!! এক কামড় দিচ্ছি আর রস চুইয়ে পড়ছে। আহা। অমৃত বুঝি একেই বলে।
- কটা খেলি?
- মালপোয়া ৩টে। ও, মা জানে ২টো। ছানার জিলিপি ৩টে। ওটাও মা জানে ২টো। আর তোর ভাগ থেকেও এম কামড় করে দুটো মিষ্টি থেকেই।
- আর পাটিসাপটা?
- না। ওটা পরে।
- মানে ৬টা মিষ্টি খেয়েও আবার মিষ্টির ক্রেভিং? সুগার টেস্ট করা।
- ধুর। স্বপ্নে তো। থোড়াই সত্যি খেয়েছি।
- উহু। কোন এক মহামনীষী বলে গেছেন, ঘুমের মধ্যে এত মিষ্টি খেলে, হয় জেগে উঠে এক্সারসাইজ করতে হয়, নইলে সন্ধ্যের মধ্যে কোমর দুই ইঞ্চি বেড়ে যায়।
- যত ঢপবাজি, না?
- যা কাজ কর। উইকেন্ড এলো বলে। কাল মিষ্টি হাব যাবোখন।
- ইয়ে!!!
- ও, আর সরভাজা কটা?
- ওটাতে মা হাত দিতে দেয়নি।
- আহা রে। কাল তাহলে আগে ওটা!
- এই না হলে তুই!! মানুষ চিনতে একটুও ভুল করিনি!
Wednesday, April 10, 2019
- আবার মিষ্টি খাচ্ছিস?
- হ্যাঁ তো?
- আর কত মোটা হবি?
- নিজে মিষ্টি পাচ্ছিস না বলে যত হিংসুটেপনা, না? বুঝি বুঝি। সব বুঝি।
- কে বলেছে আমি পাই না? ফ্রিজ ভর্তি এই এত চকলেট, কেক, পেস্ট্রি সব আছে।
- কিন্তু মালাই চমচম তো নেই?
- সে যাই হোক। তবে, সিরিয়াসলি। আর মিষ্টি খাস না। মোটা হয়ে যাবি।
- ল অফ কনজার্ভেশন অফ মাস রে। তুই যে ওয়েটটা লুজ করছিস, সেটা যাচ্ছে কোথায়? এই আমিই ডিপোজিট রাখছি।
- যত ঢপবাজি, না?
- তুইই তো শুরু করলি। কেউ মিষ্টি খাওয়ার সময় এরকম ইরিটেট করে?
- তা বলে...
- নো তা বলে টাবলে। বরং তুই একটু গায়ে লাগা কিছু। দিনদিন যা হচ্ছিস, একটা টাইট ব্যের হাগ দিতে গেলেই না পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়, এই চিন্তায় টেন্সড থাকি, জানিস!
- মানে, যা তা।
- ওই হলো।
- হ্যাঁ তো?
- আর কত মোটা হবি?
- নিজে মিষ্টি পাচ্ছিস না বলে যত হিংসুটেপনা, না? বুঝি বুঝি। সব বুঝি।
- কে বলেছে আমি পাই না? ফ্রিজ ভর্তি এই এত চকলেট, কেক, পেস্ট্রি সব আছে।
- কিন্তু মালাই চমচম তো নেই?
- সে যাই হোক। তবে, সিরিয়াসলি। আর মিষ্টি খাস না। মোটা হয়ে যাবি।
- ল অফ কনজার্ভেশন অফ মাস রে। তুই যে ওয়েটটা লুজ করছিস, সেটা যাচ্ছে কোথায়? এই আমিই ডিপোজিট রাখছি।
- যত ঢপবাজি, না?
- তুইই তো শুরু করলি। কেউ মিষ্টি খাওয়ার সময় এরকম ইরিটেট করে?
- তা বলে...
- নো তা বলে টাবলে। বরং তুই একটু গায়ে লাগা কিছু। দিনদিন যা হচ্ছিস, একটা টাইট ব্যের হাগ দিতে গেলেই না পাঁজরের হাড় ভেঙে যায়, এই চিন্তায় টেন্সড থাকি, জানিস!
- মানে, যা তা।
- ওই হলো।
Tuesday, April 9, 2019
পুনর্মিলন
স্কুলের পুনর্মিলন উৎসবগুলি ভারি অদ্ভুত অনুভূতির জায়গা। সেদিনের সেই কালি-ঝুলি মাখা ছাই-সাদা ইউনিফর্ম ছেড়ে আজ প্রত্যেকেই ঝাঁ চকচকে, ফিটফাট। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। কেউ বা শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক। এক কথায়, সকলেরই সামাজিক সাফল্য ও প্রতিপত্তি অভাবনীয়।
অভাবনীয়ই বটে। অন্তত সেই পুরনো নোনা ধরা দেওয়াল আর ভাঙ্গা কাঠের বেঞ্চিগুলোর কাছে। একদা বড়ই আপন রঙ-তুলি, গানের খাতা, স্কুল ম্যাগাজিনগুলো যে আজ কোন গহন গোপন কুঠুরিতে হারিয়ে গিয়েছে, ওরা ভেবেই পায় না।
শুধু বছর বছর ওই একদিন সেই মলিন ব্ল্যাকবোর্ডের গায়ে লাগে রঙিন নক্সা। আর থাকে মেরে ফেলা ইচ্ছেগুলোর স্মৃতিযাপন।
হয়তো এতেই হয় ওদের তর্পণ। এটাই ওদের ভবিতব্য।
অভাবনীয়ই বটে। অন্তত সেই পুরনো নোনা ধরা দেওয়াল আর ভাঙ্গা কাঠের বেঞ্চিগুলোর কাছে। একদা বড়ই আপন রঙ-তুলি, গানের খাতা, স্কুল ম্যাগাজিনগুলো যে আজ কোন গহন গোপন কুঠুরিতে হারিয়ে গিয়েছে, ওরা ভেবেই পায় না।
শুধু বছর বছর ওই একদিন সেই মলিন ব্ল্যাকবোর্ডের গায়ে লাগে রঙিন নক্সা। আর থাকে মেরে ফেলা ইচ্ছেগুলোর স্মৃতিযাপন।
হয়তো এতেই হয় ওদের তর্পণ। এটাই ওদের ভবিতব্য।
Monday, April 8, 2019
আজি ঝড়ের রাতে (২)
শুভাদিত্য সান্যাল। বয়স পঁয়ত্রিশ। নামী দামী কলেজের ডিগ্রীর দৌলতে ইতিমধ্যেই একটি বহুজাতিক সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বম্বেতে কর্মরত। সোম থেকে শুক্র অফিসে বারো ঘণ্টা কাটালেও, শনি এবং রবি, পারতপক্ষে কাজেকর্মে থাকতে নারাজ। এই দু'দিন ওর যাকে বলে "মি-টাইম"। সারা সপ্তাহের রসদ জোগায় এই দুদিন।
সক্কাল সক্কাল কমপ্লেক্সের অনতিদূরে অবস্থিত পার্কে খানিক জগিং, তারপর কমপ্লেক্সেরই জিমে খানিক ঘাম ঝরানো। উদ্দেশ্য, এন্ডরফিন সৃষ্টি। এরপর বাড়ি ফিরে খবরের কাগজ। ইতিমধ্যে স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সেও কর্মরত, সারা সপ্তাহে একসাথে বেশিরভাগ দিনই সময় হয় না খাওয়ার। উইকেন্ডে তাই বাড়ির নিয়ম, একই শহরে থাকলে অন্তত দুটো খাওয়া একসাথে বসে খেতেই হবে। শনিবার ব্রেকফাস্ট স্ত্রী মনস্বী বানালে রবিবার বানায় শুভাদিত্য। আজ অবশ্য মনস্বী শহরে নেই। কলেজ রি-ইউনিয়নে ব্যাঙ্গালোরে। তাই নিজের হাতেই ব্রেড টোস্ট আর স্ক্র্যাম্বল্ড এগস, সাথে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে খেতে হল।
এরপর সারাদিন টুকটাক নিজের স্টাডি রুমটা গুছিয়ে রাখা, বইয়ের আলমারিতে বইগুলো নিয়ে এদিক ওদিক করা। কখনও কখনও আবার এক আধটা বই বের করে উল্টে পাল্টে দেখা। এই আলমারির সংগ্রহ ওদের দুজনের মিলিত প্রয়াস। দুজনেই বই-পোকা। ম্যাট্রিমোনি ওয়েবসাইটে যখন দুজনের প্রথম আলাপ হয়, গান ও সিনেমা ছাড়া আরো যে একটা কমন পছন্দ দুজনের রয়েছে, এটা জেনে শুভাদিত্য যারপরনাই খুশি হয়েছিল। অবশ্য কাজের চাপে ইদানীং পড়া কম হয়ে গিয়েছে আগের তুলনায়, তবুও মাঝে মধ্যেই বইগুলো নেড়েঘেঁটে রাখা হয়।
আজ একা একা লাঞ্চ করতে হবে বলে শুভাদিত্য ক্লাব থেকেই খেয়ে এলো। ওখানে কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব ছিল। খেতে বসে বেশ একটু আড্ডাও হয়ে গেলো। বাড়ি ফেরার পালা।
এই এত বড় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা যেন আজ বড্ড খালি খালি লাগছে। কেউ শুনলে হয়তো বলবে শুভাদিত্য মনস্বীকে চোখে হারায়, কিন্তু ঠিক তা না। তবে মনস্বীর উপস্থিতিটাই এমন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে যে ও না থাকলেই কেমন জানি কী নেই কী নেই মনে হয়।
আজ দুপুরে বারান্দায় ইজিচেয়ারটা নিয়ে বইয়ের আলমারি থেকে কে জানে কী মনে হতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস সমগ্র নিয়ে বসেছিল। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে মনস্বীকে দেওয়া ওর উপহার। পড়তে পড়তে কখন কে জানে দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছে। ঘুম ভাঙল ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝোঁকে। ধুলো উড়ছে। এই রে, হাওয়ার ধাক্কায় ড্রয়িং রুমে মনস্বীর যত্ন করে গুছিয়ে রাখা পোর্সিলিনের শো-পিসগুলি উল্টে গিয়েছে। ভাগ্যিস ভাঙেনি, কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো নইলে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে সেগুলিকে এক এক করে ঠিক করে সযত্নে আগের মতো করেই রাখল শুভাদিত্য। আগের মতো? মনে মনে হাসল শুভাদিত্য। সব কি আগের মতো আদৌ হয়?
ঝড় বৃষ্টি যেন আজকাল শুভাদিত্যর বড্ড ভালো লাগে। কেন জানি না মনে হয়, প্রকৃতি বুঝি ভীষণভাবে ওর জীবনের সাথে মিলে মিশে একাকার। মুহূর্তের একটা থমথমে ভাব। তারপরএই তোলপাড়, আলোড়ন। তারপর সব কিছু ঠাণ্ডা করে দিয়ে নামে বৃষ্টি। মুষলধারায়। মাস দেড়েক আগে যেমন হয়েছিল। অদ্ভুতভাবেই অপ্রত্যাশিত সেই ঘটনা। অত্যন্ত অনভিপ্রেতও বটে। মনস্বীর অনুপস্থিতিতে শুভাদিত্য জানতে পারে ওর জীবনে কৃষ্ণনের কথা। প্রথমে হতবাক হয়। খানিক যেন বিশ্বাসই করতে পারেনা ও। মনস্বী? এমন করলো?
শুভাদিত্য ঠাণ্ডা মাথায় ভাবে। কোথাও হয়তো কোন ভুল হচ্ছে কিছু। সন্দেহের জালে না ফেঁসে সোজাসুজি মনস্বীর সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন যখন ও মনস্বীকে নিয়ে ডিনারের পর গাড়ি পার্ক করে মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটতে বেরোয়, মনস্বী কিন্তু অবাক হয়নি। হয়তো এইসব বিষয়ে আগাম আঁচ সকলেই পেয়ে যায়। তাই শুভাদিত্য যখন কৃষ্ণনের কথা ওকে জিজ্ঞেস করে, মনস্বী একটুও না চমকে দৃপ্ত কণ্ঠে জানায় যে হ্যাঁ, ও কৃষ্ণনকে ভালোবাসে। যেমন বাসত সেই কলেজের দিনগুলি থেকে। তবে কৃষ্ণন ভালোবাসে ওর স্ত্রী সিন্ধুজাকে। তাই মনস্বীরটা এক তরফাই থেকে যায়।
"তাহলে তুমি আমায় ঠকিয়েছিলে বিয়ে করে?" শুভাদিত্য প্রশ্ন করেছিল।
"দেখো, যখন তোমায় বিয়ে করি, আমি তখন অনেকটাই সরে এসেছিলাম ব্যাপারটা থেকে। ভেবেছিলাম তোমায় বিয়ে করে হয়তো পুরোপুরি ভুলে যাবো ওকে। হয়েছিলও তাই। আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম। তুমিই বলো, কোনদিনও তোমার নিজেকে আন-লাভড মনে হয়েছে?" মনস্বী জিজ্ঞেস করেছিল।
শুভাদিত্য চুপ। সত্যিই, এর তো কোন উত্তর নেই ওর কাছে। আজ যদি ও জানতে না পারতো, তাহলে কি কোনভাবে মনস্বীর কোন আচরণে ও বুঝতে পেরেছিল? মনস্বী কি স্ত্রী হওয়ার সমস্ত ধর্ম পালন করেনি? অদ্ভুত এক দোলাচলে ভোগে শুভাদিত্য।
"শোনো, আমি নিজেও খুবই কনফিউজড। আমার মনে হয় আবার কৃষ্ণনের সাথে যোগাযোগটা হওয়ায় আমার মন এমন ঘেঁটে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি। এবং সেটা নিখাদ। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, হয়তো কৃষ্ণনকেও আমি সমানভাবে ভালোবাসি। বা হয়তো বাসি না। যা বোধ করছি এই মুহূর্তে, তা হয়তো গোটাটাই সাময়িক মোহ? মায়া? দেখো, সিন্ধুজার ক্যান্সারের খবর পেয়ে কৃষ্ণনের সাথে আমার যোগাযোগটা আবার শুরু হয়। সিম্প্যাথি থেকেই বন্ধুত্বটা গভীর হয়। আগে যেটা হয়তো ইনফ্যাচুয়েশন ছিল, বা ধরে নিলাম ভালোবাসা, আমি ঠিক শিয়োর নই, হয়তো এখনও সেই একই অনুভূতি। শুধুমাত্র বয়স এবং পরিস্থিতি বদলের জন্য অন্যরকম লাগছে।"
মনস্বীর কথা শুনে শুভাদিত্য হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে ও? এরপর আর কীই বা বলার আছে?
"তাহলে আমাদের কী হবে মনস্বী? তুমি আমি আর আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী?" শুধুমাত্র এইটুকু জিজ্ঞেস করতে পেরেছিল ও।
"যেমন ছিল, তেমন থাক না শুভ?" মনস্বী বলেছিল।
ঝড় থেমে তখন গোটা গোটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ ওরা গাড়িতে ফিরে বসে রইলো। তারপর মনস্বী বলল, "আমায় একটু সময় দেবে শুভ? আমি একটু নিজেকে যাচাই করি? নিজের অনুভূতিগুলি? আগামী মাসে একটা উইকেন্ডে আমাদের কলেজ রি-ইউনিয়ন আছে। আমি ওখানে যাই। কৃষ্ণনও আসবে ওখানে। শুনেছি। আমার মনে হয় ওখানে গেলেই আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি শুভ, ঠকাবো না।" এরপর আর শুভাদিত্য কিচ্ছুটি বলতে পারেনি। তবে ভিতরের তোলপাড় শান্ত হয়েছে।
ঝড় বৃষ্টি চলল অনেক রাত অবধি। শুভাদিত্য চুপচাপ জানালর ধারে বসে বাইরেটা দেখতে লাগল। ব্যস্ত শহর। অগুন্তি লোক। কোলাহল। তাণ্ডব। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে মুহূর্ত।
দশটার দিকে ফোন এলো মনস্বীর।
"শুভ, কাল কিন্তু প্লীজ এয়ারপোর্টে এসো। বলেছিলাম না এখানে এলে আমার মাথাটা পরিষ্কার হবে? হয়েওছে ঠিক তাই। এখন আমি একদম শিয়োর। আমি কী চাই। কাকে চাই। লক্ষ্মীটি, কাল আমায় পিক-আপ করতে এসো। যতক্ষণ না মুখোমুখি কথা হচ্ছে, আমি তর সইতে পারছি না।" কলকল করে বলে গেলো ও।
"বেশ, আসবো। ফ্লাইট ডিটেলস মেসেজ করে দিয়ো।" শুভ মৃদু হেসে বলল।
রাত প্রায় বারোটা। বৃষ্টিটা ধরেছে খানিকক্ষণ হল। চারিদিক ঠাণ্ডা। শান্ত। স্নিগ্ধ। বারান্দার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলগুলো বৃষ্টির জলে স্নান করে ঝকঝক করছে স্ট্রিটলাইটের আলোয়।
আবারও শুভাদিত্য নিজের জীবনের সাথে প্রকৃতিকে বড্ড একাত্ম বোধ করলো।
সক্কাল সক্কাল কমপ্লেক্সের অনতিদূরে অবস্থিত পার্কে খানিক জগিং, তারপর কমপ্লেক্সেরই জিমে খানিক ঘাম ঝরানো। উদ্দেশ্য, এন্ডরফিন সৃষ্টি। এরপর বাড়ি ফিরে খবরের কাগজ। ইতিমধ্যে স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সেও কর্মরত, সারা সপ্তাহে একসাথে বেশিরভাগ দিনই সময় হয় না খাওয়ার। উইকেন্ডে তাই বাড়ির নিয়ম, একই শহরে থাকলে অন্তত দুটো খাওয়া একসাথে বসে খেতেই হবে। শনিবার ব্রেকফাস্ট স্ত্রী মনস্বী বানালে রবিবার বানায় শুভাদিত্য। আজ অবশ্য মনস্বী শহরে নেই। কলেজ রি-ইউনিয়নে ব্যাঙ্গালোরে। তাই নিজের হাতেই ব্রেড টোস্ট আর স্ক্র্যাম্বল্ড এগস, সাথে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে খেতে হল।
এরপর সারাদিন টুকটাক নিজের স্টাডি রুমটা গুছিয়ে রাখা, বইয়ের আলমারিতে বইগুলো নিয়ে এদিক ওদিক করা। কখনও কখনও আবার এক আধটা বই বের করে উল্টে পাল্টে দেখা। এই আলমারির সংগ্রহ ওদের দুজনের মিলিত প্রয়াস। দুজনেই বই-পোকা। ম্যাট্রিমোনি ওয়েবসাইটে যখন দুজনের প্রথম আলাপ হয়, গান ও সিনেমা ছাড়া আরো যে একটা কমন পছন্দ দুজনের রয়েছে, এটা জেনে শুভাদিত্য যারপরনাই খুশি হয়েছিল। অবশ্য কাজের চাপে ইদানীং পড়া কম হয়ে গিয়েছে আগের তুলনায়, তবুও মাঝে মধ্যেই বইগুলো নেড়েঘেঁটে রাখা হয়।
আজ একা একা লাঞ্চ করতে হবে বলে শুভাদিত্য ক্লাব থেকেই খেয়ে এলো। ওখানে কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব ছিল। খেতে বসে বেশ একটু আড্ডাও হয়ে গেলো। বাড়ি ফেরার পালা।
এই এত বড় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা যেন আজ বড্ড খালি খালি লাগছে। কেউ শুনলে হয়তো বলবে শুভাদিত্য মনস্বীকে চোখে হারায়, কিন্তু ঠিক তা না। তবে মনস্বীর উপস্থিতিটাই এমন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে যে ও না থাকলেই কেমন জানি কী নেই কী নেই মনে হয়।
আজ দুপুরে বারান্দায় ইজিচেয়ারটা নিয়ে বইয়ের আলমারি থেকে কে জানে কী মনে হতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস সমগ্র নিয়ে বসেছিল। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে মনস্বীকে দেওয়া ওর উপহার। পড়তে পড়তে কখন কে জানে দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছে। ঘুম ভাঙল ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝোঁকে। ধুলো উড়ছে। এই রে, হাওয়ার ধাক্কায় ড্রয়িং রুমে মনস্বীর যত্ন করে গুছিয়ে রাখা পোর্সিলিনের শো-পিসগুলি উল্টে গিয়েছে। ভাগ্যিস ভাঙেনি, কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো নইলে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে সেগুলিকে এক এক করে ঠিক করে সযত্নে আগের মতো করেই রাখল শুভাদিত্য। আগের মতো? মনে মনে হাসল শুভাদিত্য। সব কি আগের মতো আদৌ হয়?
ঝড় বৃষ্টি যেন আজকাল শুভাদিত্যর বড্ড ভালো লাগে। কেন জানি না মনে হয়, প্রকৃতি বুঝি ভীষণভাবে ওর জীবনের সাথে মিলে মিশে একাকার। মুহূর্তের একটা থমথমে ভাব। তারপরএই তোলপাড়, আলোড়ন। তারপর সব কিছু ঠাণ্ডা করে দিয়ে নামে বৃষ্টি। মুষলধারায়। মাস দেড়েক আগে যেমন হয়েছিল। অদ্ভুতভাবেই অপ্রত্যাশিত সেই ঘটনা। অত্যন্ত অনভিপ্রেতও বটে। মনস্বীর অনুপস্থিতিতে শুভাদিত্য জানতে পারে ওর জীবনে কৃষ্ণনের কথা। প্রথমে হতবাক হয়। খানিক যেন বিশ্বাসই করতে পারেনা ও। মনস্বী? এমন করলো?
শুভাদিত্য ঠাণ্ডা মাথায় ভাবে। কোথাও হয়তো কোন ভুল হচ্ছে কিছু। সন্দেহের জালে না ফেঁসে সোজাসুজি মনস্বীর সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন যখন ও মনস্বীকে নিয়ে ডিনারের পর গাড়ি পার্ক করে মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটতে বেরোয়, মনস্বী কিন্তু অবাক হয়নি। হয়তো এইসব বিষয়ে আগাম আঁচ সকলেই পেয়ে যায়। তাই শুভাদিত্য যখন কৃষ্ণনের কথা ওকে জিজ্ঞেস করে, মনস্বী একটুও না চমকে দৃপ্ত কণ্ঠে জানায় যে হ্যাঁ, ও কৃষ্ণনকে ভালোবাসে। যেমন বাসত সেই কলেজের দিনগুলি থেকে। তবে কৃষ্ণন ভালোবাসে ওর স্ত্রী সিন্ধুজাকে। তাই মনস্বীরটা এক তরফাই থেকে যায়।
"তাহলে তুমি আমায় ঠকিয়েছিলে বিয়ে করে?" শুভাদিত্য প্রশ্ন করেছিল।
"দেখো, যখন তোমায় বিয়ে করি, আমি তখন অনেকটাই সরে এসেছিলাম ব্যাপারটা থেকে। ভেবেছিলাম তোমায় বিয়ে করে হয়তো পুরোপুরি ভুলে যাবো ওকে। হয়েছিলও তাই। আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম। তুমিই বলো, কোনদিনও তোমার নিজেকে আন-লাভড মনে হয়েছে?" মনস্বী জিজ্ঞেস করেছিল।
শুভাদিত্য চুপ। সত্যিই, এর তো কোন উত্তর নেই ওর কাছে। আজ যদি ও জানতে না পারতো, তাহলে কি কোনভাবে মনস্বীর কোন আচরণে ও বুঝতে পেরেছিল? মনস্বী কি স্ত্রী হওয়ার সমস্ত ধর্ম পালন করেনি? অদ্ভুত এক দোলাচলে ভোগে শুভাদিত্য।
"শোনো, আমি নিজেও খুবই কনফিউজড। আমার মনে হয় আবার কৃষ্ণনের সাথে যোগাযোগটা হওয়ায় আমার মন এমন ঘেঁটে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি। এবং সেটা নিখাদ। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, হয়তো কৃষ্ণনকেও আমি সমানভাবে ভালোবাসি। বা হয়তো বাসি না। যা বোধ করছি এই মুহূর্তে, তা হয়তো গোটাটাই সাময়িক মোহ? মায়া? দেখো, সিন্ধুজার ক্যান্সারের খবর পেয়ে কৃষ্ণনের সাথে আমার যোগাযোগটা আবার শুরু হয়। সিম্প্যাথি থেকেই বন্ধুত্বটা গভীর হয়। আগে যেটা হয়তো ইনফ্যাচুয়েশন ছিল, বা ধরে নিলাম ভালোবাসা, আমি ঠিক শিয়োর নই, হয়তো এখনও সেই একই অনুভূতি। শুধুমাত্র বয়স এবং পরিস্থিতি বদলের জন্য অন্যরকম লাগছে।"
মনস্বীর কথা শুনে শুভাদিত্য হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে ও? এরপর আর কীই বা বলার আছে?
"তাহলে আমাদের কী হবে মনস্বী? তুমি আমি আর আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী?" শুধুমাত্র এইটুকু জিজ্ঞেস করতে পেরেছিল ও।
"যেমন ছিল, তেমন থাক না শুভ?" মনস্বী বলেছিল।
ঝড় থেমে তখন গোটা গোটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ ওরা গাড়িতে ফিরে বসে রইলো। তারপর মনস্বী বলল, "আমায় একটু সময় দেবে শুভ? আমি একটু নিজেকে যাচাই করি? নিজের অনুভূতিগুলি? আগামী মাসে একটা উইকেন্ডে আমাদের কলেজ রি-ইউনিয়ন আছে। আমি ওখানে যাই। কৃষ্ণনও আসবে ওখানে। শুনেছি। আমার মনে হয় ওখানে গেলেই আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি শুভ, ঠকাবো না।" এরপর আর শুভাদিত্য কিচ্ছুটি বলতে পারেনি। তবে ভিতরের তোলপাড় শান্ত হয়েছে।
ঝড় বৃষ্টি চলল অনেক রাত অবধি। শুভাদিত্য চুপচাপ জানালর ধারে বসে বাইরেটা দেখতে লাগল। ব্যস্ত শহর। অগুন্তি লোক। কোলাহল। তাণ্ডব। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে মুহূর্ত।
দশটার দিকে ফোন এলো মনস্বীর।
"শুভ, কাল কিন্তু প্লীজ এয়ারপোর্টে এসো। বলেছিলাম না এখানে এলে আমার মাথাটা পরিষ্কার হবে? হয়েওছে ঠিক তাই। এখন আমি একদম শিয়োর। আমি কী চাই। কাকে চাই। লক্ষ্মীটি, কাল আমায় পিক-আপ করতে এসো। যতক্ষণ না মুখোমুখি কথা হচ্ছে, আমি তর সইতে পারছি না।" কলকল করে বলে গেলো ও।
"বেশ, আসবো। ফ্লাইট ডিটেলস মেসেজ করে দিয়ো।" শুভ মৃদু হেসে বলল।
রাত প্রায় বারোটা। বৃষ্টিটা ধরেছে খানিকক্ষণ হল। চারিদিক ঠাণ্ডা। শান্ত। স্নিগ্ধ। বারান্দার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলগুলো বৃষ্টির জলে স্নান করে ঝকঝক করছে স্ট্রিটলাইটের আলোয়।
আবারও শুভাদিত্য নিজের জীবনের সাথে প্রকৃতিকে বড্ড একাত্ম বোধ করলো।
Sunday, April 7, 2019
আজি ঝড়ের রাতে
শহরের নামকরা একটি ফাইভ স্টার হোটেলের ব্যাংকুয়েট হলে আজ একটা জমাটি গেট টুগেদার চলছে। উপলক্ষ্য সেন্ট জেমস কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যাচ অফ ২০০৯ এর টেন্থ রি-ইউনিয়ন। এই রি-ইউনিয়নের জন্য দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রায় ষাটজন প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা এসেছে ব্যাঙ্গালোর শহরে। ওদের কলেজে। শুক্রবার রাত্রের মধ্যে সবাই এসে পড়েছে। শনিবার সারাদিন হইহই করে আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া। আর রাত্রে এই বিলাসবহুল ডিনার পার্টি। কাল আবার সবাই যে যার ডেরায় ফিরে যাওয়া।
এত বছর পর ব্যাচের সবার সাথে সবার দেখা হয়ে প্রত্যেকেই খুব খুশি। এক কালে যে দুই বন্ধুকে সর্বক্ষণ একসাথে দেখা যেত, রুমমেট ছিল হোস্টেলে, তারাই এখন দুজনে দুই মহাদেশে। কলেজ ছাড়ার পর হয়তো দশ বছরে তিন থেকে চারবার দেখা হয়েছে মেরেকেটে। সেদিনের সেই মানিক জোড়ের আজ এতটা সময় একসাথে কাটিয়ে, আবার আগের মতো করে আনন্দ করে যেন রিভাইটাল টনিকের চেয়েও বেশি কাজ দিয়েছে। একেই আনন্দ, উল্লাস। তারপর কয়েক পেগ উইস্কি। ক্যারাওকেতে যখন পরপর ওদের প্রিয় সমস্ত গান চলতে শুরু হলো, দুজনকে আর দেখতে হয় না। মাইক হাতে হেড়ে গলায় প্রাণ খুলে ওরা একটার পর একটা গান গেয়েই যেতে লাগলো। ঠিক যেমন হতো হোস্টেল নাইটে। ফেস্টে।
মনস্বী কলেজ জীবনেও চুপচাপ থাকত। এখনও একটুও বদলায়নি। ওয়াইন গ্লাস হাতে সুইমিং পুলের ধারে একটা কোণায় বসে অনেকক্ষণ ধরে এদের সকলের নাচ গান আড্ডা শুনছিলো, দেখছিল। ওর এতেই আনন্দ। মাঝে মাঝে এ সে এসে দুটো কথা বলে যাচ্ছিল। ছোট্ট করে হেসে দুটো কথা বলে, ফোন নম্বর ইমেল এড্রেস এক্সচেঞ্জ করে আবার নিজের ছোট্ট জগতে ফেরত। রাধিকা কয়েকবার রিকুয়েস্ট করলো ওকে, ক্যারাওকেতে এসে গাইতে। হেসে বারণ করলো। রাধিকা চলে গেল। মনস্বীর মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। হোস্টেল নাইটে সেবার বন্ধুদের জোরাজুরিতে গানের কম্পিটিশনে নাম দিয়েছিল। তারপর স্টেজে উঠে একেই তো ওই চোখ ধাঁধানো আলো। তারপর প্রথম সারিতে বসা বাঘা বাঘা বিচারক। পিছনে এত ভিড়। এবং সেই ভিড়ের মধ্যে সেই এক জোড়া চোখ। কৃষ্ণনের। যে চোখের দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকিয়ে থাকত ক্লাসে বেশিরভাগ সময়। সেই চোখদুটিও ওর দিকে তাকিয়ে। অধীর আগ্রহে। সব কেমন ঘেঁটে গেল ওর। নার্ভাস হয়ে গলা দিয়ে সুরই বেরোলো না। বেতালা, বেসুরো গান। পুরোটা শেষ করবার সুযোগও পায়নি ও। তার আগেই দর্শকাসন থেকে চিৎকার, হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কোনোমতে কার্টেন ড্রপ। আর ওর পালিয়ে নেমে আসা। কী বিভীষিকা। আর কোনোদিনও এরপর মনস্বী স্টেজে গান করেনি। কারুর সামনেও গায় না।
' হাই! এখানে একা একা বসে? ভিড় ভালো লাগছে না বুঝি?' মনস্বী তাকিয়ে দেখল। ওর পাশে এসে বসেছে কৃষ্ণন। গাঢ় নীল স্যুট। কব্জিতে দামি ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। চোখে সরু চশমা। কিন্তু সেই দশ বারো বছর আগের স্পার্কটা এখনো একইভাবে বর্তমান। বিলাসবহুল ফ্রেঞ্চ পারফিউমের সুগন্ধ। সব মিলিয়ে কৃষ্ণন এখনো একইভাবে আকর্ষণীয়। স্বল্প হেসে মনস্বী বললো, 'হ্যাঁ। এখানে বসে দিব্যি লাগছে। লোকজন কী সুন্দর গাইছে। আমিও দূরে বসে গুনগুন করছি। এই ভালো।'
কৃষ্ণন মাথা নাড়লো।
'তুই এদিকে এলি যে?' মনস্বী ওকে প্রশ্ন করলো।
'একচ্যুয়ালি আমিও খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছি এই ভিড়ে। ওভারডোজ হয়ে গিয়েছে আমার।' কৃষ্ণন হাসলো।
'বাবা, এ যে একেবারে উলটপুরাণ। দ্য হ্যাপেনিং কৃষ্ণন। দ্য কৃষ্ণন হু ইজ দ্য লাইফলাইন অফ অল পার্টিজ, সে টায়ার্ড?' এইবারে একটু জোরেই হেসে কথাগুলি বললো মনস্বী।
'আরে তুইও এরকম বলিস না! তুইও পিছনে লাগলে কী করে হবে?' কৃষ্ণনের এই কাতর কণ্ঠে মনস্বীর হাসি আরো বেড়ে গেলো। ও বললো, 'তাহলে কী করতে ইচ্ছে করছে এখন? চুপচাপ এখানে বসে ওয়াইন খাওয়া?'
কৃষ্ণন ছোট্ট করে হাসলো। তারপর বলল, 'ইচ্ছে তো করছে এখন এখানে আমার বউয়ের পাশে বসে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকাই। আর তারা গুনি। বউ পাশ থেকে গুনগুন করে গান গাক। বউয়ের ফেভারিট। আজি যত তারা তবে আকাশে। কিন্তু...'
'কিন্তু কী কৃষ্ণন?' মনস্বী জিজ্ঞেস করে।
'আকাশে ঘন মেঘ। একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয় ঝড়টা এলো বলে। বউকে যে এবারে অন্য গান গাইতে হবে?'
মনস্বী তাকায় ওর দিকে।
তারপর খোলা গলায় গান ধরে।
'আজি ঝড়ের রাতে, তোমার অভিসার।
পরাণসখা, বন্ধু হে আমার।'
যতক্ষণে ও পৌঁছয় 'সুদূর কোন নদীর পারে, গহন কোন বনের ধারে
গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার'এ, আইফোনের ওয়েদার app কে সঠিক প্রমাণ করে তখন ব্যাঙ্গালোরে উঠেছে প্রবল ঝড়। কংক্রিটের বনে, সুইমিং পুলের ধার কীভাবে যেন হয়ে গিয়েছে শিলাইদহ।
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা শুরু হলো। চারিদিকে হলের ভিতরে ঘরে ঢোকার জন্য ছোটাছুটি।
ওরা দুজনে ভিজছে। আজ অনেকদিন পর।
' হাই! এখানে একা একা বসে? ভিড় ভালো লাগছে না বুঝি?' মনস্বী তাকিয়ে দেখল। ওর পাশে এসে বসেছে কৃষ্ণন। গাঢ় নীল স্যুট। কব্জিতে দামি ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। চোখে সরু চশমা। কিন্তু সেই দশ বারো বছর আগের স্পার্কটা এখনো একইভাবে বর্তমান। বিলাসবহুল ফ্রেঞ্চ পারফিউমের সুগন্ধ। সব মিলিয়ে কৃষ্ণন এখনো একইভাবে আকর্ষণীয়। স্বল্প হেসে মনস্বী বললো, 'হ্যাঁ। এখানে বসে দিব্যি লাগছে। লোকজন কী সুন্দর গাইছে। আমিও দূরে বসে গুনগুন করছি। এই ভালো।'
কৃষ্ণন মাথা নাড়লো।
'তুই এদিকে এলি যে?' মনস্বী ওকে প্রশ্ন করলো।
'একচ্যুয়ালি আমিও খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছি এই ভিড়ে। ওভারডোজ হয়ে গিয়েছে আমার।' কৃষ্ণন হাসলো।
'বাবা, এ যে একেবারে উলটপুরাণ। দ্য হ্যাপেনিং কৃষ্ণন। দ্য কৃষ্ণন হু ইজ দ্য লাইফলাইন অফ অল পার্টিজ, সে টায়ার্ড?' এইবারে একটু জোরেই হেসে কথাগুলি বললো মনস্বী।
'আরে তুইও এরকম বলিস না! তুইও পিছনে লাগলে কী করে হবে?' কৃষ্ণনের এই কাতর কণ্ঠে মনস্বীর হাসি আরো বেড়ে গেলো। ও বললো, 'তাহলে কী করতে ইচ্ছে করছে এখন? চুপচাপ এখানে বসে ওয়াইন খাওয়া?'
কৃষ্ণন ছোট্ট করে হাসলো। তারপর বলল, 'ইচ্ছে তো করছে এখন এখানে আমার বউয়ের পাশে বসে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকাই। আর তারা গুনি। বউ পাশ থেকে গুনগুন করে গান গাক। বউয়ের ফেভারিট। আজি যত তারা তবে আকাশে। কিন্তু...'
'কিন্তু কী কৃষ্ণন?' মনস্বী জিজ্ঞেস করে।
'আকাশে ঘন মেঘ। একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয় ঝড়টা এলো বলে। বউকে যে এবারে অন্য গান গাইতে হবে?'
মনস্বী তাকায় ওর দিকে।
তারপর খোলা গলায় গান ধরে।
'আজি ঝড়ের রাতে, তোমার অভিসার।
পরাণসখা, বন্ধু হে আমার।'
যতক্ষণে ও পৌঁছয় 'সুদূর কোন নদীর পারে, গহন কোন বনের ধারে
গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার'এ, আইফোনের ওয়েদার app কে সঠিক প্রমাণ করে তখন ব্যাঙ্গালোরে উঠেছে প্রবল ঝড়। কংক্রিটের বনে, সুইমিং পুলের ধার কীভাবে যেন হয়ে গিয়েছে শিলাইদহ।
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা শুরু হলো। চারিদিকে হলের ভিতরে ঘরে ঢোকার জন্য ছোটাছুটি।
ওরা দুজনে ভিজছে। আজ অনেকদিন পর।
Thursday, April 4, 2019
- কখন ফিরলি অফিস থেকে?
-
- এই? কীরে?
- অ্যাঁ? কিছু বলছিস?
- বলছি যে, কখন ফিরলি?
- খেয়াল নেই। তবে ঘন্টাখানেকের ওপর। বৃষ্টিটা শুরু হয়নি তখনও।
- চা খেয়েছিস?
- উহু।
- কেন?
- ইচ্ছে করছিল না। এমন রোম্যান্টিক ওয়েদার। বসে বসে কী সুন্দর বৃষ্টি দেখছিলাম।
- নিকুচি করেছে ওয়েদার। বাড়ি ফিরতে জল কাদায় পাগল হয়ে গেলাম। একটা ট্যাক্সি নেই। কিছু না। বাসগুলো ভিড়। বিরক্তিকর।
- আমি ভাবছিলাম...
- কী? এবারে একটা গাড়ি কিনলে হয়, বল?
- ওসব না। আমি ভাবছিলাম...
- বল।
- ধর বছর দশেক পর, এমনই এক বৃষ্টির সন্ধ্যেয় তোর আর আমার হঠাৎ দেখা হল কোথাও...
- কোথায়?
- ধর কোথাও।
- ধরলাম। তো?
- তাহলে তুই আমায় তখন কী বলবি?
- কী বলবো?
- সে তুই বল। তোকে জিজ্ঞেস করছি তো।
- উমম...ফ্রিজে চারটেই ডিম আছে। রাত্রের জন্য খিচুরি ডিম ভাজা করে ফেলছি। কিন্তু কাল সকালে তাতান আর তিতিরের টিফিন কী দেবো? দেখ যদি বৃষ্টিটা কমে, একবার গিয়ে নিয়ে আয় বা আনিয়ে নে তো।
- এই? এই বলবি তুই?
- বিয়িং প্র্যাক্টিকাল!
- হাউ আনরোম্যান্টিক!!
- সামওয়ান হ্যাস টু বি প্র্যাক্টিকাল টু!
- হা ঈশ্বর।
- বাই দ্য ওয়ে, তাতান অ্যান্ড তিতির?
- হ্যাঁ!
- মানে একে শান্তি নেই।
- যমজ, যমজ...
Tuesday, April 2, 2019
তাতান ও ম্যাজিক সানগ্লাস
১।
ছ'টার জায়গায় পৌনে সাতটায় যখন দার্জিলিং মেলটা শিয়ালদা ঢুকল, তাতান যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল। যদিও এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে গিয়ে বেশ ভালোই লেগেছে ওর, তবুও এই আজকে ঠিক সময়ে বাড়িতে না পৌঁছলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত তাতানের। তাতান, অর্থাৎ সেন্ট ডমিনিক পাবলিক স্কুলের ক্লাস সিক্সের সৌরদীপ সেনগুপ্ত। আগামীকাল ওর একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচ রয়েছে। সেন্ট ডমিনিক ভার্সেস সানশাইন অ্যাকাডেমি। যদিও স্কুলেরই কাবস দল, অর্থাৎ জুনিয়র দলের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা, তবুও সিনিয়রদের রেষারেষির ছায়া এদের মধ্যেও পড়েছে। কাবসের ইনটার স্কুলে গত বছর সানশাইনকে ফাইনালে পাঁচ উইকেটে হারিয়ে সেন্ট ডমিনিক জিতলেও এইবারে অবস্থা হাড্ডাহাড্ডি। গ্রুপ ম্যাচে এবারে সেন্ট ডমিনিকের পারফর্মেন্স খুব একটা ভালো যায়নি। ওদের স্টার প্লেয়ার, ফাস্ট বোলার চাঁদু, অর্থাৎ চন্দ্রদীপ দ্বিতীয় ম্যাচের দিনেই পা ভেঙ্গে কাহিল। বদলি বোলার হারুণ নতুন। নার্ভাস। তাই নেটে ভালো খেললেও আসল ম্যাচে বলে বলে ওকে অপনেন্টের ব্যাটসম্যানরা পিটিয়ে ছাতু করে দিচ্ছে, রোজ। নেহাত তাতান, অর্ক আর মানিক - তিনজনেই দুর্দান্ত ফর্মে আছে, তাই কোনরকমে ব্যাটিং দিয়ে ম্যানেজ হয়েছে এ যাবৎ। কিন্তু সানশাইন তো আর যে সে টিম নয়। ওদের বিরুদ্ধে জিততে গেলে একেবারে জান প্রাণ লড়িয়ে দিতে হবে।
প্রচণ্ড গরম এবং বেশ কিছু প্লেয়ারদের চোট আঘাতের জন্য গ্রুপ ম্যাচের পর দশদিনের ছুটি ছিল। আগামীকাল থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু। এবং প্রথম ম্যাচেই সেন্ট ডমিনিক খেলবে সানশাইনের বিরুদ্ধে। তাতান সেন্ট ডমিনিকের ক্যাপ্টেন। ওর ওপর তাই বাড়তি দায়িত্ব, বাড়তি চাপ। আজ দুপুরের প্র্যাকটিস সেশনটা তাই ওদের জন্য খুব জরুরি। তাতান মুখিয়ে আছে। হারুণকে চাঙ্গা করতে দার্জিলিং থেকে দুর্ধর্ষ টোটকা নিয়ে এসেছে। এবার তারই পরীক্ষা।
২।
বাড়ি ফিরে ঠামুর কাছে আদর আহ্লাদ পেয়ে, স্নান সেরে, ডাল-ভাত-পোস্ত-মাছের ঝোল খেয়ে তাতান বসল নিজের কিট ব্যাগটা নিয়ে। দেড়টা বেজে গিয়েছে। আড়াইটের মধ্যে স্কুল গ্রাউন্ডে ওদের সবার পৌঁছে যাওয়ার কথা। তার আগে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে হবে। দার্জিলিং ট্রিপে ওর যাবতীয় জামা-প্যান্ট সব ছিল বাবার স্যুটকেসে। বাবা তো এখন ঘুমোচ্ছে। ডেকে তোলাও যাবে না। বকা খাবে। কাজেই বন্ধুদের জন্য কেনা উপহারগুলো আজ আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। যাক গে। কীই বা করা যাবে। কিন্তু আসল জিনিসটা তাতান বুদ্ধি করে গতকাল বিকেলেই মায়ের হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিয়েছিল। ভাগ্যিস। মা একটু সবে ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়েছে, হাতে মোবাইল নিয়ে, তাতান বলল, "মা, আমার সানগ্লাসটা তোমার হ্যানন্ডব্যাগে দিয়েছিলাম না কাল? ওটা নিয়ে বেরবো এখন। ব্যাগটা কোথায় আছে বলো, আমি বের করে নেবো।" মা চোখ না তুলেই বলল, "দেখ ড্রেসিং টেবিলের পাশে চেয়ারে রাখা আছে। নিয়ে নে সাবধানে।" তাতান গেলো ড্রেসিং টেবিলের কাছে। মায়ের হাল্কা গোলাপী ব্যাগটার চেন খুলে খানিক হাতড়ে খুঁজে পেল সানগ্লাসের কালো পাউচটা। একবার দড়ি খুলে দেখে নিলো, সব ঠিকঠাক আছে তো? এরপর নিজের ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে প্র্যাকটিস জার্সি-ট্রাউজারস পরে চোখে সানগ্লাসটা এঁটে কিটব্যাগ নিয়ে সাইকেল চেপে বেরোল স্কুল গ্রাউন্ডের দিকে।
যতক্ষণে তাতান স্কুলে পৌঁছল, ঘড়িতে তখন বাজে সোয়া দুটো। দেখল, ইতিমধ্যেই সেন্ট ডমিনিকের রত্নরা, অর্থাৎ, অর্ক, মানিক, পল্লব, রজত, আনন্দ, কল্যাণ সবাই এসে গিয়েছে। এখনও আসা বাকি ফারুখ, বিদ্যুৎ, প্রদীপ্ত আর ঋভুর। তাতান মাঠে যেতেই সবাই ওকে ঘিরে ধরল। "কীরে কেমন ঘুরলি?" "মোমো খেলি?" "ঠাণ্ডা পেলি?" সব প্রশ্নের উত্তর একে একে দিয়ে তাতান বলল, "শোন, যে কারণে তোদের আগেভাগে ডাকা। কালকের ম্যাচের জন্য ছোট্ট করে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করবো। আর একটা ছোটো করে নেট প্র্যাকটিস। এ ক'দিন সবাই খেলেছিস তো নিয়মিত?"
বিদ্যুৎ বলল, "সে তো খেলেছি। স্ট্র্যাটেজি করবি, ভেরি গুড। কিন্তু এখনও হারুণ আসেনি কেন?"
"ও আসবে। ওকে আমিই তিনটে নাগাদ আসতে বলেছি। ও আসার আগে আমাদের কিছু আলোচনা আছে।" গম্ভীরস্বরে তাতান কথাগুলো বলে দলের সকলকে নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খানিক জটলা পাকিয়ে খেলার স্ট্র্যাটেজি তৈরির আলোচনা শুরু করলো। খানিক ফিসফাস, আস্তে, জোরে সবরকমই গুঞ্জন শোনা গেলো। এরপর তাতান বিদ্যুৎকে বলল, "ভাই, হারুণ যখন তোকে বল করবে, ফুল টস দিলেই ছয় হাঁকিয়ে দিবি। ইয়রকার দিলে ছেড়ে দিয়ে বোল্ড আউট হবি। আর একটু শর্ট লেন্থ দিলেই খোঁচা লাগাবি" তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, "কেউ একটাও ক্যাচ ফেলবি না যেন। আজকের ম্যাচ প্র্যাকটিসটা বুঝতেই পারছিস কতটা ভাইটাল। স্পেশালি আমাদের হারুণের জন্য। চল চল, ও এসে গিয়েছে দেখ। লেটস ওয়ার্ম আপ।"
হারুণ সেন্ট ডমিনিকের ক্লাস ফাইভের ছাত্র। রোগা পাতলা এই ছেলেটি সাধারণত চুপচাপ থাকে, একটু ভীতু প্রকৃতিরই। নেহাৎ গেমসের নিখিলেশ স্যার ওকে গেমস পিরিয়ডে দুর্দান্ত কয়েকটা ইয়রকার দিতে দেখেছিলেন, তাই। এই বছর যখন সেন্ট ডমিনিকের কাবসের দল তৈরি হচ্ছিল, উনি নিজে তাতানের কাছে ওর নাম সুপারিশ করে বলেন, "সৌরদীপ, যদিও হারুণ একটু ছোট, তবুও বলবো। ওকে তোমাদের দলে রেখে দাও। কোন কোন ম্যাচে খেলিয়ো। ওর মধ্যে একটা পোটেনশিয়াল আছে, আমি দেখেছি। দেখো, ভালোই খেলবে।" স্যারের কথা অনুযায়ী তাতান হারুণকে দলে নিলো। চাঁদুর চোটের পর খেলালোও সব ম্যাচ। কিন্তু নেটে যে উইকেটের বাইরে একটাও বল করে না, সে কিনা পরপর তিন ম্যাচে একটাও উইকেট না পেয়ে শুধুই চার আর ছয় খেয়ে গেলো। আগামীকাল সানশাইনের খেলা নিয়ে ও ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। তাতানকে তো দার্জিলিঙে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার ফোন করে "দাদা আমি কী করে খেলবো? আমায় বের করে দাও দল থেকে। আমায় সবাই খালি ছয় চার মারে" বলে কাকুতি মিনতি করেছে। তাতান ছোটো হলেও ওর মধ্যে ক্যাপ্টেনসুলভ বিচক্ষণতা আছে। বারবার যথাসাধ্য ও হারুণকে সাহস জুগিয়ে চলেছে। কিন্তু কোথায় কী? আসল ম্যাচে ছেলেটা নার্ভাস হয়ে এত বিচ্ছিরি ভাবে খেলেছে। নেহাৎই নিরুপায়। তাই তাতান ওকে টিমে রাখতে বাধ্য হয়েছে। দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে দাদানের সাথে অনেক গল্প চলাকালীন তাতান হারুণের ব্যাপারে কথা বলতেই দাদানই এই চমৎকার আইডিয়াটি দেয়। এইবার এই চমৎকার আইডিয়া কতদূর খাটে এই ক্ষেত্রে, তা পরখের প্রতীক্ষা।
"হারুণ, চলে আয়। রেডি তো?" তাতান হাসিমুখে প্রশ্ন করে।
"হ্যাঁ দাদা। রেডি। তবে..." কাচুমুচু মুখে হারুণ আদ্ধেক কথা বলে থেমে যায়।
"কী হলো রে? কী তবে?" তাতান জিজ্ঞেস করে।
"তবে ভয় করছে।" হারুণ একটু নীচু স্বরে বলে।
"তাহলে এক কাজ করি। এদিকে আয় আমার সাথে। তোকে একটা সিক্রেট বলি।" এই বলে তাতান হারুণের কাঁধে হাত রেখে ওকে নিয়ে এগলো গ্যালারির দিকে। বাকিরা কথা মতো ফিল্ডিং প্র্যাকটিস চালু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে।
"এই যে, এই সানগ্লাসটা পরে আছি আমি দেখছিস?" তাতান নিজের নীল সানগ্লাসটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
"হ্যাঁ, বেশ দেখতে কিন্তু! একদম রিকি পন্টিং এর মতো লাগছে দেখতে তোমাকে।" হারুণ বলল, মুগ্ধ হয়ে।
"শুধু দেখতেই না রে। এই সানগ্লাসটা পরলে আমার মধ্যে রিকি পন্টিং খোদ ভর করে রে।" তাতান বলতে থাকে।
হারুণ অবাক হয়ে বলে, "মানে?"
"মানে এই যে এই চশমাটা চোখে থাকলে আমার ক্রিকেটীয় বুদ্ধি দারুণ বেড়ে যায়। এমন কী আমি ম্যাজিকের মতো ঠিক আগে থেকে দেখে বুঝে যাই। দেখতে পাই, বলতে পারিস। কোন বোলার কীরকম বল করবে। কোন ব্যাটসম্যান কীভাবে খেলবে। সব। এমনকি, ফিল্ডার ক্যাচ মিস করবে কি রান আউট করতে পারবে, সব আমি আগাম বলে দিতে পারি। সবকিছু দেখতে পেয়ে যাই এই চশমাটা পরলেই।" তাতানের কথাগুলো শুনে হারুণ খানিক অবাক হয়ে তাকায়। তারপর বলে, "ধ্যাত, কী যে বলো দাদা? এমন আবার হয় নাকি?" তাতান যেন এমন প্রশ্নের জন্য তৈরিই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, "চল তাহলে তোকে ডেমো দেখাই একটা। তবে যদি তুই বিশ্বাস করিস। নেটে চল।"
"চলো" বলে হারুণ আর তাতান এগোয় নেটের দিকে।
নেটে তখন কল্যাণ বল করছিল ঋভুকে। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ। কল্যাণের থেকে বলটা নিয়ে হারুণের হাতে দিল তাতান। আর বিদ্যুতের দিকে তাকিয়ে বলল, "দেখি তো বিদ্যুৎ, কেমন খেলিস হারুণকে।" হারুণের দিকে একবার হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে তাতান বলল, " নে দেখি। উইকেট টিপ করে বল কর। দেখি কেমন ছয় মারে। কল্যাণ ব্যাটাকে তো ছয়ের পর ছয় হাঁকছিল দেখলাম। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তুই টিপ রেখে বল করছিস। পরপর বেল উড়ছে। নে দেখি, খেল।"
সত্যিই তাই। এরপর পরপর ছয় বল হারুণ এক্কেবারে উইকেট লক্ষ্য করেই করলো। এবং প্রত্যেকটাতেই বিদ্যুতের বিখ্যাত ডিফেন্সকে নড়বড়ে প্রমাণ করে বেল উড়ে গেলো। ছয়ে ছয়।
"সাবাশ হারুণ।" তাতান, মানিক, অর্ক ওর পিঠ চাপড়ে গেলো একে একে। বিদ্যুতের মতো প্লেয়ারের ডিফেন্স পরপর ছ'বার অ্যাটাক করে বেল উড়িয়ে দেওয়া, চারটিখানি কথা না।
আরো ঘণ্টা দেড়েক চলল ওদের প্র্যাকটিস। এই এতক্ষণে তাতানের মনে হল, ওর দল দুর্ধর্ষ ফর্মে রয়েছে। প্রত্যেকে। আত্মবিশ্বাস টগবগ করছে সকলের। কালকে সানশাইনকে দেখিয়ে দেবে ওরা।
৩।
অবশেষে আজ সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের দিন। সকাল ন'টা থেকে সেন্ট ডমিনিকের গ্রাউন্ডেই খেলা। হোম গ্রাউন্ড অ্যাডভান্টেজ নিতে ওরা প্রস্তুত। স্কুলের কমলা খয়েরি জার্সি গায়ে দিয়ে ওরা এগারোজন প্লেয়ার মাঠে নামছে। সবার সামনে রয়েছে ওদের ক্যাপ্টেন, সৌরদীপ। মাথায় সাদা রঙের ক্যাপ। এ যাবৎ টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রানের প্রতীক। চোখে নীল সানগ্লাস। টসে জিতে সানশাইন ব্যাটিং নিয়েছে। ব্যাটিং এর উপযুক্ত একদম এই পিচ। এমনটা ইচ্ছে করেই করা। কারণ সেন্ট ডমিনিকের ব্যাটসম্যানেরাই সম্বল।
তাতানের ভিতরে উত্তেজনা তুঙ্গে। এই ম্যাচটা বের করতেই হবে। টসে হেরে একটু দমে গেলেও বাকিদের সামনে দেখানোই যাবেনা। বিশেষ করে হারুণ। কল্যাণকে দিয়ে ওপেন করালো ওভার। এবং প্রথম বলেই চার মারল সানশাইনের কপিল। দ্বিতীয় বল, একটু স্লো করলো। ব্যাটে বলে লাগল না। তৃতীয় বল। আবারও ব্যাটে বলে হল না। ডট বল। চতুর্থ বল। ফুল টস। তবুও দুই রানই হল। পঞ্চম বল। গুড লেন্থ। ঠুকে খেলে এক রান নিলো কপিল। এবারে শেষ বল খেলবে রাজীব। ডট বল। প্রথম ওভারের শেষে সানশাইনের রান ৭/০।
দ্বিতীয় ওভার বল করবে হারুণ। তাতান ওর হাতে বল দিয়ে পিঠ চাপড়ে বলল, "হারুণ, আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই কালকের মতো উইকেট টিপ করে বল কর। বোল্ড হবেই।" ফিল্ড সাজানো হল। লম্বা রান-আপ নিয়ে বল করলো হারুণ। এবং এক্কেবারে ফুল-টস। কপিল সুযোগ ছাড়ল না। তুলে ছয়। তাতান দৌড়ে এসে হারুণের কাঁধে হাত রেখে বলল, "ভয় পাস না। বলছি না? তুই উইকেট লক্ষ্য করে বল কর। বোল্ড হবেই। কপিল এই ওভারেই বোল্ড হবে।" দ্বিতীয় বল। ইয়রকার। এবং কপিল বোল্ড। দলের সব ছেলেরা লাফিয়ে এসে হারুণকে জড়িয়ে ধরল। এরপর নামল সূরজ। সানশাইনের এই মুহূর্তের সবচেয়ে ইন-ফরম ব্যাটসম্যান। তাতান জানে, হারুণের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ওকে সামলাতে হবে। সূরজ লেগের বলগুলো দারুণ খেলে। ওইদিকে তাই ওকে কিছুতেই বল দেওয়া যাবে না। কোনমতে সামলে রাখতে হবে। হারুণকে বলল, "আস্তে করে শর্ট দে একটা। খোঁচা লাগাক। স্লিপে ছেলে রাখছি। আউট হবেই।" হারুণ ওর তাতান দাদার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। এবং অবধারিতভাবে ফলও পেল। স্লিপে পল্লবের হাতে ক্যাচ আউট। পরের তিন বলই ডট। দ্বিতীয় ওভারের শেষে সানশাইন ১৩/২।
এরপর স্পিনার এলো। সানশাইন তুলে তুলে মারল। মারবেই। ব্যাটিং পিচ। দশ ওভারের শেষে ওরা ৮০/২। আর পাঁচ ওভার বাকি। এই স্লগ ওভারগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হারুণের এখনও দু'ওভার বল বাকি। তাতান এবার তাই ওকেই ডেকে বল দিল। ব্যাট করবে প্রদীপ্ত। কুড়ি বলে পঁয়ত্রিশ করে খেলছে। তাতান হারুণকে তাতানোর জন্য এগিয়ে এলো, "আবার সোজা উইকেট দেখে বল কর। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই ওকে বোল্ড করবি। এই ওভারেই। দেখে বল কর ভাই।"
হারুণ বল হাতে ছোটা শুরু করল। সেন্ট ডমিনিকের গ্যালারি থেকে "গো হারুণ, গো হারুণ" চিৎকার। এবং সোজা উইকেটে বল। প্রদীপ্তর ডিফেন্স কোন কাজেই এলো না। বেল উড়ে গিয়ে মিডল স্টাম্প ছিটকে গেলো। সারা মাঠ হইহই করে উঠল। ৮০/৩। এবারে ক্রিজে এলো সায়ন। বিগ হিটার। সানশাইনের ক্রিস গেল। তাতানের সেই এক বুলি। হারুণ বল করলো। এবারে লেগ স্টাম্প উড়ল। ৮০/৪। এই নিয়ে ম্যাচে দ্বিতীয়বার, "হারুণ অন আ হ্যাট্রিক।" তাতান এসে হারুণকে বলল, "দেখ, হ্যাট্রিক করার সুবর্ণ সুযোগ। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই এই বলেই উইকেট পাবি। শান্ত হয়ে খেল। মাথা ঠাণ্ডা। স্লো বল দে। খোঁচা লাগাক। স্লিপে ঋভু থাকবে।" সানশাইনের ঝড় এখন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছে। নতুন ব্যাটসম্যান দীপু। চূড়ান্ত চাপে আছে। চোখ মুখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মারাত্মক টেনশনে। এদিকে হারুণ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। স্লো বল করলো একটা। এবং ঠিক তাতানের ভবিষ্যৎবাণী মেনেই বলটা না ছেড়ে দিপু খেলতে গেলো, এবং আবার সেই খোঁচা লাগল। স্লিপে ক্যাচ। ঋভুর হাতে এসে বল সহজেই পড়ল। আউট। হারুণের হ্যাট্রিকে গোটা মাঠ উল্লাসে ফেটে পড়েছে। গ্যালারি থেকে ভেঁপু, বাঁশির আওয়াজ। হইহই। চিৎকার। হারুণ নিজে ছুটে গিয়ে তাতানকে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল। "দাদা, আমি পারলাম। তোমার প্রেডিকশন পারফেক্ট।"
সানশাইনের ইনিংস শেষ হল নব্বই রানে। সেন্ট ডমিনিকের ব্যাটসম্যানেরা হেসে হেসে বারো ওভারের আগেই তিন উইকেট হারিয়ে সেই রান তুলেও ফেলল। সানশাইনকে হারিয়ে সেমি ফাইনালে পৌঁছল সেন্ট ডমিনিক। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ স্বাভাবিকভাবেই হারুণ।
প্রাইজ সেরিমনির পর নিজেদের মধ্যে বসে ওরা বারোজন এখনও লাফালাফি করছে। এ ওর কাঁধে চাপছে। হারুণকে তো কেউ ছাড়তেই চাইছে না। ওই তো আজকের হিরো। এরই ফাঁকে তাতান মায়ের পৌঁছে দেওয়া ব্যাগটা নিয়ে এসেছে। এতক্ষণে সময় হয়েছে বন্ধুদের জন্য আনা গিফটগুলো দেওয়ার। প্রথমেই ও ডাকল হারুণকে। একটা কালো পাউচ ওর হাতে দিয়ে বলল, "এই নে। তোর জন্য আমারই মতো একটা ম্যাজিক সানগ্লাস। পরে দেখ দেখি। কী দেখতে পাস।"
হারুণ সোল্লাসে নিলো ওটা। চোখে দিল। খানিক এদিক ওইদিক দেখল। কিন্তু এ কী? আর পাঁচটা সাধারণ সানগ্লাসের চেয়ে তো আলাদা কিছু বুঝছে না।
"কী? দেখতে পেলি কিছু স্পেশাল?" তাতান প্রশ্ন করলো।
"কই না তো তাতান দাদা। আমি তো বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না। এমনিই তোমাদের সবাইকে, এদিক ওদিক সব দেখলাম। শুধু নীল কাঁচ বলে একটু অন্য রঙে।" অবাক হয়েই হারুণ বলল কথাগুলি।
"ওহো হো, তাহলে বোধহয় তোকে অর্করটা দিয়েছি। সরি।" অর্ককে ওই সানগ্লাসটা ধরিয়ে তাতান ব্যাগ থেকে আরো একটা ওইরকম পাউচ বের করলো। হারুণ চোখে দিল চশমা। এবং এবারেও সেই এক। এইটা পেল বিদ্যুৎ। দেখতে দেখতে হারুণের হাত ঘুরে সকলেই পেল একই চশমা। হারুণের স্পেশালটা তাহলে কোথায়?
"আচ্ছা, তুই বরং আমারটা পরে দেখ তো একবার।" তাতান নিজের সানগ্লাসটা খুলে দিল হারুণকে। অবাক কাণ্ড। হারুণ এতেও আর পাঁচটার চেয়ে আলাদা কিচ্ছুটি বুঝল না। অবাক হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, "কই তাতান দাদা, এটাও তো একই দেখছি।" সানগ্লাসটা তাতানকে ফেরত দিয়ে জানালো ও। এইবারে তাতান মুচকি হেসে বলল, "আসলে হারুণ তোর কোন দোষ নেই। সব সানগ্লাসই এক। আমি সবকটাই তোদের জন্য হং কং মার্কেট থেকে কিনেছি। কোনটার আলাদা করে কিচ্ছু ম্যাজিকাল পাওয়ার নেই। এই ম্যাজিকের গোটা গল্পটাই ছিল প্রি-প্ল্যান্ড। যাতে কিনা তোর ভয় কাটে। কনফিডেন্স বাড়ে। আসলে তুই এমনিই সেরা প্লেয়ার। খুব ট্যালেন্টেডও। কিন্তু তোর যেটা প্রব্লেম, নিজের ওপর কোন বিশ্বাস নেই। তোর মধ্যে ম্যাচের আগে এই ভরসাটা ফেরত আনা খুব দরকার ছিল। তাই আমরা দশজন মিলে তোর সাথে এই গল্পটা প্রেজেন্ট করি। তুই সেটায় বিশ্বাসও করলি। আর দেখ, তাই ভয় ভুলে কেমন নিজের সেরাটা দিলি। দিলি তো? ফলও দেখতে পেলি?"
হারুণ অবাক। নির্বাক। কী বলবে? এমনও হয়? ও সত্যিই তাহলে ভালো বল করে?
"যাক গে, আজ সবাই রেস্ট নে। আবার কাল থেকে প্র্যাকটিস। শুক্রবার সেমি আছে।" তাতান সকলকে বিদায় জানিয়ে স্কুল গ্রাউন্ড থেকে বেরোয়। মা বাইরে অপেক্ষা করছে। মায়ের থেকে মোবাইলটা নিয়ে ফোন করে দাদানকে। গোটা প্ল্যানের মাস্টারমাইন্ডকে রেজাল্টটা জানাতে হবে তো? রিং হচ্ছে। অপর প্রান্তে এইবারে দাদানের গলা শুনেই ও বলে উঠল, "হিপ হিপ হুররে দাদান!"
ছ'টার জায়গায় পৌনে সাতটায় যখন দার্জিলিং মেলটা শিয়ালদা ঢুকল, তাতান যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল। যদিও এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে গিয়ে বেশ ভালোই লেগেছে ওর, তবুও এই আজকে ঠিক সময়ে বাড়িতে না পৌঁছলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত তাতানের। তাতান, অর্থাৎ সেন্ট ডমিনিক পাবলিক স্কুলের ক্লাস সিক্সের সৌরদীপ সেনগুপ্ত। আগামীকাল ওর একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচ রয়েছে। সেন্ট ডমিনিক ভার্সেস সানশাইন অ্যাকাডেমি। যদিও স্কুলেরই কাবস দল, অর্থাৎ জুনিয়র দলের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা, তবুও সিনিয়রদের রেষারেষির ছায়া এদের মধ্যেও পড়েছে। কাবসের ইনটার স্কুলে গত বছর সানশাইনকে ফাইনালে পাঁচ উইকেটে হারিয়ে সেন্ট ডমিনিক জিতলেও এইবারে অবস্থা হাড্ডাহাড্ডি। গ্রুপ ম্যাচে এবারে সেন্ট ডমিনিকের পারফর্মেন্স খুব একটা ভালো যায়নি। ওদের স্টার প্লেয়ার, ফাস্ট বোলার চাঁদু, অর্থাৎ চন্দ্রদীপ দ্বিতীয় ম্যাচের দিনেই পা ভেঙ্গে কাহিল। বদলি বোলার হারুণ নতুন। নার্ভাস। তাই নেটে ভালো খেললেও আসল ম্যাচে বলে বলে ওকে অপনেন্টের ব্যাটসম্যানরা পিটিয়ে ছাতু করে দিচ্ছে, রোজ। নেহাত তাতান, অর্ক আর মানিক - তিনজনেই দুর্দান্ত ফর্মে আছে, তাই কোনরকমে ব্যাটিং দিয়ে ম্যানেজ হয়েছে এ যাবৎ। কিন্তু সানশাইন তো আর যে সে টিম নয়। ওদের বিরুদ্ধে জিততে গেলে একেবারে জান প্রাণ লড়িয়ে দিতে হবে।
প্রচণ্ড গরম এবং বেশ কিছু প্লেয়ারদের চোট আঘাতের জন্য গ্রুপ ম্যাচের পর দশদিনের ছুটি ছিল। আগামীকাল থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু। এবং প্রথম ম্যাচেই সেন্ট ডমিনিক খেলবে সানশাইনের বিরুদ্ধে। তাতান সেন্ট ডমিনিকের ক্যাপ্টেন। ওর ওপর তাই বাড়তি দায়িত্ব, বাড়তি চাপ। আজ দুপুরের প্র্যাকটিস সেশনটা তাই ওদের জন্য খুব জরুরি। তাতান মুখিয়ে আছে। হারুণকে চাঙ্গা করতে দার্জিলিং থেকে দুর্ধর্ষ টোটকা নিয়ে এসেছে। এবার তারই পরীক্ষা।
২।
বাড়ি ফিরে ঠামুর কাছে আদর আহ্লাদ পেয়ে, স্নান সেরে, ডাল-ভাত-পোস্ত-মাছের ঝোল খেয়ে তাতান বসল নিজের কিট ব্যাগটা নিয়ে। দেড়টা বেজে গিয়েছে। আড়াইটের মধ্যে স্কুল গ্রাউন্ডে ওদের সবার পৌঁছে যাওয়ার কথা। তার আগে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে হবে। দার্জিলিং ট্রিপে ওর যাবতীয় জামা-প্যান্ট সব ছিল বাবার স্যুটকেসে। বাবা তো এখন ঘুমোচ্ছে। ডেকে তোলাও যাবে না। বকা খাবে। কাজেই বন্ধুদের জন্য কেনা উপহারগুলো আজ আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। যাক গে। কীই বা করা যাবে। কিন্তু আসল জিনিসটা তাতান বুদ্ধি করে গতকাল বিকেলেই মায়ের হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিয়েছিল। ভাগ্যিস। মা একটু সবে ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়েছে, হাতে মোবাইল নিয়ে, তাতান বলল, "মা, আমার সানগ্লাসটা তোমার হ্যানন্ডব্যাগে দিয়েছিলাম না কাল? ওটা নিয়ে বেরবো এখন। ব্যাগটা কোথায় আছে বলো, আমি বের করে নেবো।" মা চোখ না তুলেই বলল, "দেখ ড্রেসিং টেবিলের পাশে চেয়ারে রাখা আছে। নিয়ে নে সাবধানে।" তাতান গেলো ড্রেসিং টেবিলের কাছে। মায়ের হাল্কা গোলাপী ব্যাগটার চেন খুলে খানিক হাতড়ে খুঁজে পেল সানগ্লাসের কালো পাউচটা। একবার দড়ি খুলে দেখে নিলো, সব ঠিকঠাক আছে তো? এরপর নিজের ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে প্র্যাকটিস জার্সি-ট্রাউজারস পরে চোখে সানগ্লাসটা এঁটে কিটব্যাগ নিয়ে সাইকেল চেপে বেরোল স্কুল গ্রাউন্ডের দিকে।
যতক্ষণে তাতান স্কুলে পৌঁছল, ঘড়িতে তখন বাজে সোয়া দুটো। দেখল, ইতিমধ্যেই সেন্ট ডমিনিকের রত্নরা, অর্থাৎ, অর্ক, মানিক, পল্লব, রজত, আনন্দ, কল্যাণ সবাই এসে গিয়েছে। এখনও আসা বাকি ফারুখ, বিদ্যুৎ, প্রদীপ্ত আর ঋভুর। তাতান মাঠে যেতেই সবাই ওকে ঘিরে ধরল। "কীরে কেমন ঘুরলি?" "মোমো খেলি?" "ঠাণ্ডা পেলি?" সব প্রশ্নের উত্তর একে একে দিয়ে তাতান বলল, "শোন, যে কারণে তোদের আগেভাগে ডাকা। কালকের ম্যাচের জন্য ছোট্ট করে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করবো। আর একটা ছোটো করে নেট প্র্যাকটিস। এ ক'দিন সবাই খেলেছিস তো নিয়মিত?"
বিদ্যুৎ বলল, "সে তো খেলেছি। স্ট্র্যাটেজি করবি, ভেরি গুড। কিন্তু এখনও হারুণ আসেনি কেন?"
"ও আসবে। ওকে আমিই তিনটে নাগাদ আসতে বলেছি। ও আসার আগে আমাদের কিছু আলোচনা আছে।" গম্ভীরস্বরে তাতান কথাগুলো বলে দলের সকলকে নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খানিক জটলা পাকিয়ে খেলার স্ট্র্যাটেজি তৈরির আলোচনা শুরু করলো। খানিক ফিসফাস, আস্তে, জোরে সবরকমই গুঞ্জন শোনা গেলো। এরপর তাতান বিদ্যুৎকে বলল, "ভাই, হারুণ যখন তোকে বল করবে, ফুল টস দিলেই ছয় হাঁকিয়ে দিবি। ইয়রকার দিলে ছেড়ে দিয়ে বোল্ড আউট হবি। আর একটু শর্ট লেন্থ দিলেই খোঁচা লাগাবি" তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, "কেউ একটাও ক্যাচ ফেলবি না যেন। আজকের ম্যাচ প্র্যাকটিসটা বুঝতেই পারছিস কতটা ভাইটাল। স্পেশালি আমাদের হারুণের জন্য। চল চল, ও এসে গিয়েছে দেখ। লেটস ওয়ার্ম আপ।"
হারুণ সেন্ট ডমিনিকের ক্লাস ফাইভের ছাত্র। রোগা পাতলা এই ছেলেটি সাধারণত চুপচাপ থাকে, একটু ভীতু প্রকৃতিরই। নেহাৎ গেমসের নিখিলেশ স্যার ওকে গেমস পিরিয়ডে দুর্দান্ত কয়েকটা ইয়রকার দিতে দেখেছিলেন, তাই। এই বছর যখন সেন্ট ডমিনিকের কাবসের দল তৈরি হচ্ছিল, উনি নিজে তাতানের কাছে ওর নাম সুপারিশ করে বলেন, "সৌরদীপ, যদিও হারুণ একটু ছোট, তবুও বলবো। ওকে তোমাদের দলে রেখে দাও। কোন কোন ম্যাচে খেলিয়ো। ওর মধ্যে একটা পোটেনশিয়াল আছে, আমি দেখেছি। দেখো, ভালোই খেলবে।" স্যারের কথা অনুযায়ী তাতান হারুণকে দলে নিলো। চাঁদুর চোটের পর খেলালোও সব ম্যাচ। কিন্তু নেটে যে উইকেটের বাইরে একটাও বল করে না, সে কিনা পরপর তিন ম্যাচে একটাও উইকেট না পেয়ে শুধুই চার আর ছয় খেয়ে গেলো। আগামীকাল সানশাইনের খেলা নিয়ে ও ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। তাতানকে তো দার্জিলিঙে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার ফোন করে "দাদা আমি কী করে খেলবো? আমায় বের করে দাও দল থেকে। আমায় সবাই খালি ছয় চার মারে" বলে কাকুতি মিনতি করেছে। তাতান ছোটো হলেও ওর মধ্যে ক্যাপ্টেনসুলভ বিচক্ষণতা আছে। বারবার যথাসাধ্য ও হারুণকে সাহস জুগিয়ে চলেছে। কিন্তু কোথায় কী? আসল ম্যাচে ছেলেটা নার্ভাস হয়ে এত বিচ্ছিরি ভাবে খেলেছে। নেহাৎই নিরুপায়। তাই তাতান ওকে টিমে রাখতে বাধ্য হয়েছে। দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে দাদানের সাথে অনেক গল্প চলাকালীন তাতান হারুণের ব্যাপারে কথা বলতেই দাদানই এই চমৎকার আইডিয়াটি দেয়। এইবার এই চমৎকার আইডিয়া কতদূর খাটে এই ক্ষেত্রে, তা পরখের প্রতীক্ষা।
"হারুণ, চলে আয়। রেডি তো?" তাতান হাসিমুখে প্রশ্ন করে।
"হ্যাঁ দাদা। রেডি। তবে..." কাচুমুচু মুখে হারুণ আদ্ধেক কথা বলে থেমে যায়।
"কী হলো রে? কী তবে?" তাতান জিজ্ঞেস করে।
"তবে ভয় করছে।" হারুণ একটু নীচু স্বরে বলে।
"তাহলে এক কাজ করি। এদিকে আয় আমার সাথে। তোকে একটা সিক্রেট বলি।" এই বলে তাতান হারুণের কাঁধে হাত রেখে ওকে নিয়ে এগলো গ্যালারির দিকে। বাকিরা কথা মতো ফিল্ডিং প্র্যাকটিস চালু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে।
"এই যে, এই সানগ্লাসটা পরে আছি আমি দেখছিস?" তাতান নিজের নীল সানগ্লাসটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
"হ্যাঁ, বেশ দেখতে কিন্তু! একদম রিকি পন্টিং এর মতো লাগছে দেখতে তোমাকে।" হারুণ বলল, মুগ্ধ হয়ে।
"শুধু দেখতেই না রে। এই সানগ্লাসটা পরলে আমার মধ্যে রিকি পন্টিং খোদ ভর করে রে।" তাতান বলতে থাকে।
হারুণ অবাক হয়ে বলে, "মানে?"
"মানে এই যে এই চশমাটা চোখে থাকলে আমার ক্রিকেটীয় বুদ্ধি দারুণ বেড়ে যায়। এমন কী আমি ম্যাজিকের মতো ঠিক আগে থেকে দেখে বুঝে যাই। দেখতে পাই, বলতে পারিস। কোন বোলার কীরকম বল করবে। কোন ব্যাটসম্যান কীভাবে খেলবে। সব। এমনকি, ফিল্ডার ক্যাচ মিস করবে কি রান আউট করতে পারবে, সব আমি আগাম বলে দিতে পারি। সবকিছু দেখতে পেয়ে যাই এই চশমাটা পরলেই।" তাতানের কথাগুলো শুনে হারুণ খানিক অবাক হয়ে তাকায়। তারপর বলে, "ধ্যাত, কী যে বলো দাদা? এমন আবার হয় নাকি?" তাতান যেন এমন প্রশ্নের জন্য তৈরিই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, "চল তাহলে তোকে ডেমো দেখাই একটা। তবে যদি তুই বিশ্বাস করিস। নেটে চল।"
"চলো" বলে হারুণ আর তাতান এগোয় নেটের দিকে।
নেটে তখন কল্যাণ বল করছিল ঋভুকে। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ। কল্যাণের থেকে বলটা নিয়ে হারুণের হাতে দিল তাতান। আর বিদ্যুতের দিকে তাকিয়ে বলল, "দেখি তো বিদ্যুৎ, কেমন খেলিস হারুণকে।" হারুণের দিকে একবার হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে তাতান বলল, " নে দেখি। উইকেট টিপ করে বল কর। দেখি কেমন ছয় মারে। কল্যাণ ব্যাটাকে তো ছয়ের পর ছয় হাঁকছিল দেখলাম। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তুই টিপ রেখে বল করছিস। পরপর বেল উড়ছে। নে দেখি, খেল।"
সত্যিই তাই। এরপর পরপর ছয় বল হারুণ এক্কেবারে উইকেট লক্ষ্য করেই করলো। এবং প্রত্যেকটাতেই বিদ্যুতের বিখ্যাত ডিফেন্সকে নড়বড়ে প্রমাণ করে বেল উড়ে গেলো। ছয়ে ছয়।
"সাবাশ হারুণ।" তাতান, মানিক, অর্ক ওর পিঠ চাপড়ে গেলো একে একে। বিদ্যুতের মতো প্লেয়ারের ডিফেন্স পরপর ছ'বার অ্যাটাক করে বেল উড়িয়ে দেওয়া, চারটিখানি কথা না।
আরো ঘণ্টা দেড়েক চলল ওদের প্র্যাকটিস। এই এতক্ষণে তাতানের মনে হল, ওর দল দুর্ধর্ষ ফর্মে রয়েছে। প্রত্যেকে। আত্মবিশ্বাস টগবগ করছে সকলের। কালকে সানশাইনকে দেখিয়ে দেবে ওরা।
৩।
অবশেষে আজ সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের দিন। সকাল ন'টা থেকে সেন্ট ডমিনিকের গ্রাউন্ডেই খেলা। হোম গ্রাউন্ড অ্যাডভান্টেজ নিতে ওরা প্রস্তুত। স্কুলের কমলা খয়েরি জার্সি গায়ে দিয়ে ওরা এগারোজন প্লেয়ার মাঠে নামছে। সবার সামনে রয়েছে ওদের ক্যাপ্টেন, সৌরদীপ। মাথায় সাদা রঙের ক্যাপ। এ যাবৎ টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রানের প্রতীক। চোখে নীল সানগ্লাস। টসে জিতে সানশাইন ব্যাটিং নিয়েছে। ব্যাটিং এর উপযুক্ত একদম এই পিচ। এমনটা ইচ্ছে করেই করা। কারণ সেন্ট ডমিনিকের ব্যাটসম্যানেরাই সম্বল।
তাতানের ভিতরে উত্তেজনা তুঙ্গে। এই ম্যাচটা বের করতেই হবে। টসে হেরে একটু দমে গেলেও বাকিদের সামনে দেখানোই যাবেনা। বিশেষ করে হারুণ। কল্যাণকে দিয়ে ওপেন করালো ওভার। এবং প্রথম বলেই চার মারল সানশাইনের কপিল। দ্বিতীয় বল, একটু স্লো করলো। ব্যাটে বলে লাগল না। তৃতীয় বল। আবারও ব্যাটে বলে হল না। ডট বল। চতুর্থ বল। ফুল টস। তবুও দুই রানই হল। পঞ্চম বল। গুড লেন্থ। ঠুকে খেলে এক রান নিলো কপিল। এবারে শেষ বল খেলবে রাজীব। ডট বল। প্রথম ওভারের শেষে সানশাইনের রান ৭/০।
দ্বিতীয় ওভার বল করবে হারুণ। তাতান ওর হাতে বল দিয়ে পিঠ চাপড়ে বলল, "হারুণ, আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই কালকের মতো উইকেট টিপ করে বল কর। বোল্ড হবেই।" ফিল্ড সাজানো হল। লম্বা রান-আপ নিয়ে বল করলো হারুণ। এবং এক্কেবারে ফুল-টস। কপিল সুযোগ ছাড়ল না। তুলে ছয়। তাতান দৌড়ে এসে হারুণের কাঁধে হাত রেখে বলল, "ভয় পাস না। বলছি না? তুই উইকেট লক্ষ্য করে বল কর। বোল্ড হবেই। কপিল এই ওভারেই বোল্ড হবে।" দ্বিতীয় বল। ইয়রকার। এবং কপিল বোল্ড। দলের সব ছেলেরা লাফিয়ে এসে হারুণকে জড়িয়ে ধরল। এরপর নামল সূরজ। সানশাইনের এই মুহূর্তের সবচেয়ে ইন-ফরম ব্যাটসম্যান। তাতান জানে, হারুণের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ওকে সামলাতে হবে। সূরজ লেগের বলগুলো দারুণ খেলে। ওইদিকে তাই ওকে কিছুতেই বল দেওয়া যাবে না। কোনমতে সামলে রাখতে হবে। হারুণকে বলল, "আস্তে করে শর্ট দে একটা। খোঁচা লাগাক। স্লিপে ছেলে রাখছি। আউট হবেই।" হারুণ ওর তাতান দাদার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। এবং অবধারিতভাবে ফলও পেল। স্লিপে পল্লবের হাতে ক্যাচ আউট। পরের তিন বলই ডট। দ্বিতীয় ওভারের শেষে সানশাইন ১৩/২।
এরপর স্পিনার এলো। সানশাইন তুলে তুলে মারল। মারবেই। ব্যাটিং পিচ। দশ ওভারের শেষে ওরা ৮০/২। আর পাঁচ ওভার বাকি। এই স্লগ ওভারগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হারুণের এখনও দু'ওভার বল বাকি। তাতান এবার তাই ওকেই ডেকে বল দিল। ব্যাট করবে প্রদীপ্ত। কুড়ি বলে পঁয়ত্রিশ করে খেলছে। তাতান হারুণকে তাতানোর জন্য এগিয়ে এলো, "আবার সোজা উইকেট দেখে বল কর। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই ওকে বোল্ড করবি। এই ওভারেই। দেখে বল কর ভাই।"
হারুণ বল হাতে ছোটা শুরু করল। সেন্ট ডমিনিকের গ্যালারি থেকে "গো হারুণ, গো হারুণ" চিৎকার। এবং সোজা উইকেটে বল। প্রদীপ্তর ডিফেন্স কোন কাজেই এলো না। বেল উড়ে গিয়ে মিডল স্টাম্প ছিটকে গেলো। সারা মাঠ হইহই করে উঠল। ৮০/৩। এবারে ক্রিজে এলো সায়ন। বিগ হিটার। সানশাইনের ক্রিস গেল। তাতানের সেই এক বুলি। হারুণ বল করলো। এবারে লেগ স্টাম্প উড়ল। ৮০/৪। এই নিয়ে ম্যাচে দ্বিতীয়বার, "হারুণ অন আ হ্যাট্রিক।" তাতান এসে হারুণকে বলল, "দেখ, হ্যাট্রিক করার সুবর্ণ সুযোগ। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই এই বলেই উইকেট পাবি। শান্ত হয়ে খেল। মাথা ঠাণ্ডা। স্লো বল দে। খোঁচা লাগাক। স্লিপে ঋভু থাকবে।" সানশাইনের ঝড় এখন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছে। নতুন ব্যাটসম্যান দীপু। চূড়ান্ত চাপে আছে। চোখ মুখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মারাত্মক টেনশনে। এদিকে হারুণ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। স্লো বল করলো একটা। এবং ঠিক তাতানের ভবিষ্যৎবাণী মেনেই বলটা না ছেড়ে দিপু খেলতে গেলো, এবং আবার সেই খোঁচা লাগল। স্লিপে ক্যাচ। ঋভুর হাতে এসে বল সহজেই পড়ল। আউট। হারুণের হ্যাট্রিকে গোটা মাঠ উল্লাসে ফেটে পড়েছে। গ্যালারি থেকে ভেঁপু, বাঁশির আওয়াজ। হইহই। চিৎকার। হারুণ নিজে ছুটে গিয়ে তাতানকে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল। "দাদা, আমি পারলাম। তোমার প্রেডিকশন পারফেক্ট।"
সানশাইনের ইনিংস শেষ হল নব্বই রানে। সেন্ট ডমিনিকের ব্যাটসম্যানেরা হেসে হেসে বারো ওভারের আগেই তিন উইকেট হারিয়ে সেই রান তুলেও ফেলল। সানশাইনকে হারিয়ে সেমি ফাইনালে পৌঁছল সেন্ট ডমিনিক। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ স্বাভাবিকভাবেই হারুণ।
প্রাইজ সেরিমনির পর নিজেদের মধ্যে বসে ওরা বারোজন এখনও লাফালাফি করছে। এ ওর কাঁধে চাপছে। হারুণকে তো কেউ ছাড়তেই চাইছে না। ওই তো আজকের হিরো। এরই ফাঁকে তাতান মায়ের পৌঁছে দেওয়া ব্যাগটা নিয়ে এসেছে। এতক্ষণে সময় হয়েছে বন্ধুদের জন্য আনা গিফটগুলো দেওয়ার। প্রথমেই ও ডাকল হারুণকে। একটা কালো পাউচ ওর হাতে দিয়ে বলল, "এই নে। তোর জন্য আমারই মতো একটা ম্যাজিক সানগ্লাস। পরে দেখ দেখি। কী দেখতে পাস।"
হারুণ সোল্লাসে নিলো ওটা। চোখে দিল। খানিক এদিক ওইদিক দেখল। কিন্তু এ কী? আর পাঁচটা সাধারণ সানগ্লাসের চেয়ে তো আলাদা কিছু বুঝছে না।
"কী? দেখতে পেলি কিছু স্পেশাল?" তাতান প্রশ্ন করলো।
"কই না তো তাতান দাদা। আমি তো বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না। এমনিই তোমাদের সবাইকে, এদিক ওদিক সব দেখলাম। শুধু নীল কাঁচ বলে একটু অন্য রঙে।" অবাক হয়েই হারুণ বলল কথাগুলি।
"ওহো হো, তাহলে বোধহয় তোকে অর্করটা দিয়েছি। সরি।" অর্ককে ওই সানগ্লাসটা ধরিয়ে তাতান ব্যাগ থেকে আরো একটা ওইরকম পাউচ বের করলো। হারুণ চোখে দিল চশমা। এবং এবারেও সেই এক। এইটা পেল বিদ্যুৎ। দেখতে দেখতে হারুণের হাত ঘুরে সকলেই পেল একই চশমা। হারুণের স্পেশালটা তাহলে কোথায়?
"আচ্ছা, তুই বরং আমারটা পরে দেখ তো একবার।" তাতান নিজের সানগ্লাসটা খুলে দিল হারুণকে। অবাক কাণ্ড। হারুণ এতেও আর পাঁচটার চেয়ে আলাদা কিচ্ছুটি বুঝল না। অবাক হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, "কই তাতান দাদা, এটাও তো একই দেখছি।" সানগ্লাসটা তাতানকে ফেরত দিয়ে জানালো ও। এইবারে তাতান মুচকি হেসে বলল, "আসলে হারুণ তোর কোন দোষ নেই। সব সানগ্লাসই এক। আমি সবকটাই তোদের জন্য হং কং মার্কেট থেকে কিনেছি। কোনটার আলাদা করে কিচ্ছু ম্যাজিকাল পাওয়ার নেই। এই ম্যাজিকের গোটা গল্পটাই ছিল প্রি-প্ল্যান্ড। যাতে কিনা তোর ভয় কাটে। কনফিডেন্স বাড়ে। আসলে তুই এমনিই সেরা প্লেয়ার। খুব ট্যালেন্টেডও। কিন্তু তোর যেটা প্রব্লেম, নিজের ওপর কোন বিশ্বাস নেই। তোর মধ্যে ম্যাচের আগে এই ভরসাটা ফেরত আনা খুব দরকার ছিল। তাই আমরা দশজন মিলে তোর সাথে এই গল্পটা প্রেজেন্ট করি। তুই সেটায় বিশ্বাসও করলি। আর দেখ, তাই ভয় ভুলে কেমন নিজের সেরাটা দিলি। দিলি তো? ফলও দেখতে পেলি?"
হারুণ অবাক। নির্বাক। কী বলবে? এমনও হয়? ও সত্যিই তাহলে ভালো বল করে?
"যাক গে, আজ সবাই রেস্ট নে। আবার কাল থেকে প্র্যাকটিস। শুক্রবার সেমি আছে।" তাতান সকলকে বিদায় জানিয়ে স্কুল গ্রাউন্ড থেকে বেরোয়। মা বাইরে অপেক্ষা করছে। মায়ের থেকে মোবাইলটা নিয়ে ফোন করে দাদানকে। গোটা প্ল্যানের মাস্টারমাইন্ডকে রেজাল্টটা জানাতে হবে তো? রিং হচ্ছে। অপর প্রান্তে এইবারে দাদানের গলা শুনেই ও বলে উঠল, "হিপ হিপ হুররে দাদান!"
চৈত্র বিকেলে বৃষ্টি পড়লে যেই ছেলেটা এখনও ছাদে দৌড়াদৌড়ি করে,
অফিস ডেস্কে কাজের ভিড়ে সন্দেশ শুকতারা যার এখনও উঁকি মারে,
সেই ছেলেটার যত্ন নিয়ো,
ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিয়ো।
দায়িত্ব পেয়ে সে আজ মস্ত লোক,
আদরে আবদারে ওর খুউব ভালো হোক।।
অফিস ডেস্কে কাজের ভিড়ে সন্দেশ শুকতারা যার এখনও উঁকি মারে,
সেই ছেলেটার যত্ন নিয়ো,
ভালোবাসায় মুড়িয়ে দিয়ো।
দায়িত্ব পেয়ে সে আজ মস্ত লোক,
আদরে আবদারে ওর খুউব ভালো হোক।।
Monday, April 1, 2019
আরশোলা
ব্যাপারটা বেশ কিছুদিন পরে আবার ঘটল। এর আগে সপ্তাহখানেক আগে হয়েছিল বটে। তবে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ধরে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেই এড়িয়ে গিয়েছি। আসলে ব্যাপারটা এমন কিছু প্রসন্নদায়ক তো নয়। তাই মাথা না ঘামানোই শ্রেয় মনে করেছিলাম। কিন্তু গতকাল আর আজ সকালে আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির পর আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত। খুলে বলি।
গতকাল ভোরবেলা আমার যখন ঘুম ভাঙল, খাট থেকে নেমে মাটির দিকে চোখ পড়তে, দেখতে পেলাম একটা মরা আরশোলা। হাত পা তুলে উল্টে শুয়ে আছে। কোত্থেকে এলো, কে জানে, এইসব ভাবতে ভাবতে আমি ওটিকে ঝাঁটা দিয়ে চৌকাঠ পার করে দিলাম।
আজ সকালে উঠে দেখি, সেই একই জায়গায় একই ভাবে আরেকটি আরশোলা মরে পড়ে আছে। আজ ঝাঁটা দিয়ে ওটাকে বের করতে গিয়ে দরজার কোণে আটকে গেলো। অন্য শক্তপোক্ত ঝাঁটা এনে ওটা বের করতে গিয়ে দেখি ওটি নেই। আরশোলা নেই। কী কাণ্ড! এই এক্ষুণি একটা মরা আরশোলা এখানে ফেলে রেখে গেলাম। আর এই এক্ষুণি দেখছি নেই? কী করে হলো? মরা পোকা গেলো কোথায়? তাও এত অল্প সময়ে?
তাহলে কি... তাহলে কি ওটা আদৌ মরা ছিল না? অশরীরী? নইলে পরপর দুদিন ও আগের সপ্তাহে একদিন ঠিক একই জায়গায়, একই ভাবে কী করে পড়ে থাকলো আরশোলাটা?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, মরল কী করে? আমি তো স্প্রে করিনি গত কয়েকদিনে?
হঠাৎ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "টিকটিকির ডিম" গল্পটার কথা মনে পড়ে গেলো। কোন একদিন আরশোলা মেরেছিলাম বলে কি এইভাবে বদলা নিতে আসছে? এরপরে কি চারিদিকে মরা আরশোলা দেখবো?
গতকাল ভোরবেলা আমার যখন ঘুম ভাঙল, খাট থেকে নেমে মাটির দিকে চোখ পড়তে, দেখতে পেলাম একটা মরা আরশোলা। হাত পা তুলে উল্টে শুয়ে আছে। কোত্থেকে এলো, কে জানে, এইসব ভাবতে ভাবতে আমি ওটিকে ঝাঁটা দিয়ে চৌকাঠ পার করে দিলাম।
আজ সকালে উঠে দেখি, সেই একই জায়গায় একই ভাবে আরেকটি আরশোলা মরে পড়ে আছে। আজ ঝাঁটা দিয়ে ওটাকে বের করতে গিয়ে দরজার কোণে আটকে গেলো। অন্য শক্তপোক্ত ঝাঁটা এনে ওটা বের করতে গিয়ে দেখি ওটি নেই। আরশোলা নেই। কী কাণ্ড! এই এক্ষুণি একটা মরা আরশোলা এখানে ফেলে রেখে গেলাম। আর এই এক্ষুণি দেখছি নেই? কী করে হলো? মরা পোকা গেলো কোথায়? তাও এত অল্প সময়ে?
তাহলে কি... তাহলে কি ওটা আদৌ মরা ছিল না? অশরীরী? নইলে পরপর দুদিন ও আগের সপ্তাহে একদিন ঠিক একই জায়গায়, একই ভাবে কী করে পড়ে থাকলো আরশোলাটা?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, মরল কী করে? আমি তো স্প্রে করিনি গত কয়েকদিনে?
হঠাৎ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "টিকটিকির ডিম" গল্পটার কথা মনে পড়ে গেলো। কোন একদিন আরশোলা মেরেছিলাম বলে কি এইভাবে বদলা নিতে আসছে? এরপরে কি চারিদিকে মরা আরশোলা দেখবো?
প্যাঁচা প্যাঁচানি সংলাপ
- সকাল সকাল এলবাম খুলে বসে কী করছিস?
- আমাদের ছবি খুঁজছি।
- কেন? দিব্যি তো ওয়ালপেপার ঠিক আছে।
- আরে এটা অন্য কারণে।
- কী?
- ধ্যাত। এত কৌতূহল কেন?
- সকাল থেকে দেখে যাচ্ছি এই এত এলবাম খুলে বসে আছিস। ফেসবুক ইন্সটা হার্ড ডিস্ক। সব ঘেঁটে চলেছিস। প্রশ্ন করতে পারব না?
- উহু। কোনো প্রশ্ন নয়। পরে সঠিক সময় সব জানতে পারবি।
- আমাদের ছবি খুঁজছি।
- কেন? দিব্যি তো ওয়ালপেপার ঠিক আছে।
- আরে এটা অন্য কারণে।
- কী?
- ধ্যাত। এত কৌতূহল কেন?
- সকাল থেকে দেখে যাচ্ছি এই এত এলবাম খুলে বসে আছিস। ফেসবুক ইন্সটা হার্ড ডিস্ক। সব ঘেঁটে চলেছিস। প্রশ্ন করতে পারব না?
- উহু। কোনো প্রশ্ন নয়। পরে সঠিক সময় সব জানতে পারবি।
- ওরকম বিটকেল মুখ না করে একটা কাপল ফোটো সিলেক্ট করে দে না।
- কারণ না জানলে কী ভাবে চ্যুজ করবো?
- মানে?
- না মানে ধর তুই কোনো ফাইট টাইটের বিজ্ঞাপন বানাতে চাইলে এক ধরণের ছবি দেব। লাভি ডাভি কিছু চাইলে আরেক ধরণ।
- লাভি ডাভি চাই। এই দেখ, এইটা দিই? আমায় কী ভালো লাগছে দেখতে।
- না। এটা না। আই লুক টেরিবল হিয়ার। ওই দেখ, ওইটা। জ্যু এর সামনেরটা।
- ইশ। না। আমায় কেমন প্যাঁচার মতো লাগছে।
- তা মন্দ কী? জ্যুয়ের সামনে ঠিকই আছে। বাই দি ওয়ে, তুই প্যাঁচা না। প্যাঁচানি।
- তুই আমায় প্যাঁচা বললি?
- আবার ভুল বলে? বললাম না? প্যাঁচানি। ফিমেল প্যাঁচা। এইসব কনভেন্টে পড়লে এই হয়। প্যাঁচা প্যাঁচানিতে পার্থক্য জানে না।
- তুই চুপ কর। তুই আমায় আউল বললি? উল্লু?
- উফ। তো কী হয়েছে? প্যাঁচা তো কত সুইট।
- সুইট মাই ফুট।
- আহা, এটা শুনিসনি? "তোর গানে পেঁচি রে, সব ভুলে গেছি রে-
চাঁদমুখে মিঠে গান, শুনে ঝরে দু'নয়ান"?
- আবোল তাবোল।
- তাহলে?
- তা বলে তুই আমায় প্যাঁচা বললি?
- উফ। প্যাঁচানি।
-....
-...
- কারণ না জানলে কী ভাবে চ্যুজ করবো?
- মানে?
- না মানে ধর তুই কোনো ফাইট টাইটের বিজ্ঞাপন বানাতে চাইলে এক ধরণের ছবি দেব। লাভি ডাভি কিছু চাইলে আরেক ধরণ।
- লাভি ডাভি চাই। এই দেখ, এইটা দিই? আমায় কী ভালো লাগছে দেখতে।
- না। এটা না। আই লুক টেরিবল হিয়ার। ওই দেখ, ওইটা। জ্যু এর সামনেরটা।
- ইশ। না। আমায় কেমন প্যাঁচার মতো লাগছে।
- তা মন্দ কী? জ্যুয়ের সামনে ঠিকই আছে। বাই দি ওয়ে, তুই প্যাঁচা না। প্যাঁচানি।
- তুই আমায় প্যাঁচা বললি?
- আবার ভুল বলে? বললাম না? প্যাঁচানি। ফিমেল প্যাঁচা। এইসব কনভেন্টে পড়লে এই হয়। প্যাঁচা প্যাঁচানিতে পার্থক্য জানে না।
- তুই চুপ কর। তুই আমায় আউল বললি? উল্লু?
- উফ। তো কী হয়েছে? প্যাঁচা তো কত সুইট।
- সুইট মাই ফুট।
- আহা, এটা শুনিসনি? "তোর গানে পেঁচি রে, সব ভুলে গেছি রে-
চাঁদমুখে মিঠে গান, শুনে ঝরে দু'নয়ান"?
- আবোল তাবোল।
- তাহলে?
- তা বলে তুই আমায় প্যাঁচা বললি?
- উফ। প্যাঁচানি।
-....
-...
Subscribe to:
Posts (Atom)