Sunday, April 7, 2019

আজি ঝড়ের রাতে

শহরের নামকরা একটি ফাইভ স্টার হোটেলের ব্যাংকুয়েট হলে আজ একটা জমাটি গেট টুগেদার চলছে। উপলক্ষ্য সেন্ট জেমস কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যাচ অফ ২০০৯ এর টেন্থ রি-ইউনিয়ন। এই রি-ইউনিয়নের জন্য দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রায় ষাটজন প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা এসেছে ব্যাঙ্গালোর শহরে। ওদের কলেজে। শুক্রবার রাত্রের মধ্যে সবাই এসে পড়েছে। শনিবার সারাদিন হইহই করে আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া দাওয়া। আর রাত্রে এই বিলাসবহুল ডিনার পার্টি। কাল আবার সবাই যে যার ডেরায় ফিরে যাওয়া।
এত বছর পর ব্যাচের সবার সাথে সবার দেখা হয়ে প্রত্যেকেই খুব খুশি। এক কালে যে দুই বন্ধুকে সর্বক্ষণ একসাথে দেখা যেত, রুমমেট ছিল হোস্টেলে, তারাই এখন দুজনে দুই মহাদেশে। কলেজ ছাড়ার পর হয়তো দশ বছরে তিন থেকে চারবার দেখা হয়েছে মেরেকেটে। সেদিনের সেই মানিক জোড়ের আজ এতটা সময় একসাথে কাটিয়ে, আবার আগের মতো করে আনন্দ করে যেন রিভাইটাল টনিকের চেয়েও বেশি কাজ দিয়েছে। একেই আনন্দ, উল্লাস। তারপর কয়েক পেগ উইস্কি। ক্যারাওকেতে যখন পরপর ওদের প্রিয় সমস্ত গান চলতে শুরু হলো, দুজনকে আর দেখতে হয় না। মাইক হাতে হেড়ে গলায় প্রাণ খুলে ওরা একটার পর একটা গান গেয়েই যেতে লাগলো। ঠিক যেমন হতো হোস্টেল নাইটে। ফেস্টে।
মনস্বী কলেজ জীবনেও চুপচাপ থাকত। এখনও একটুও বদলায়নি। ওয়াইন গ্লাস হাতে সুইমিং পুলের ধারে একটা কোণায় বসে অনেকক্ষণ ধরে এদের সকলের নাচ গান আড্ডা শুনছিলো, দেখছিল। ওর এতেই আনন্দ। মাঝে মাঝে এ সে এসে দুটো কথা বলে যাচ্ছিল। ছোট্ট করে হেসে দুটো কথা বলে, ফোন নম্বর ইমেল এড্রেস এক্সচেঞ্জ করে আবার নিজের ছোট্ট জগতে ফেরত। রাধিকা কয়েকবার রিকুয়েস্ট করলো ওকে, ক্যারাওকেতে এসে গাইতে। হেসে বারণ করলো। রাধিকা চলে গেল। মনস্বীর মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। হোস্টেল নাইটে সেবার বন্ধুদের জোরাজুরিতে গানের কম্পিটিশনে নাম দিয়েছিল। তারপর স্টেজে উঠে একেই তো ওই চোখ ধাঁধানো আলো। তারপর প্রথম সারিতে বসা বাঘা বাঘা বিচারক। পিছনে এত ভিড়। এবং সেই ভিড়ের মধ্যে সেই এক জোড়া চোখ। কৃষ্ণনের। যে চোখের দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকিয়ে থাকত ক্লাসে বেশিরভাগ সময়। সেই চোখদুটিও ওর দিকে তাকিয়ে। অধীর আগ্রহে। সব কেমন ঘেঁটে গেল ওর। নার্ভাস হয়ে গলা দিয়ে সুরই বেরোলো না। বেতালা, বেসুরো গান। পুরোটা শেষ করবার সুযোগও পায়নি ও। তার আগেই দর্শকাসন থেকে চিৎকার, হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কোনোমতে কার্টেন ড্রপ। আর ওর পালিয়ে নেমে আসা। কী বিভীষিকা। আর কোনোদিনও এরপর মনস্বী স্টেজে গান করেনি। কারুর সামনেও গায় না।
' হাই! এখানে একা একা বসে? ভিড় ভালো লাগছে না বুঝি?' মনস্বী তাকিয়ে দেখল। ওর পাশে এসে বসেছে কৃষ্ণন। গাঢ় নীল স্যুট। কব্জিতে দামি ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। চোখে সরু চশমা। কিন্তু সেই দশ বারো বছর আগের স্পার্কটা এখনো একইভাবে বর্তমান। বিলাসবহুল ফ্রেঞ্চ পারফিউমের সুগন্ধ। সব মিলিয়ে কৃষ্ণন এখনো একইভাবে আকর্ষণীয়। স্বল্প হেসে মনস্বী বললো, 'হ্যাঁ। এখানে বসে দিব্যি লাগছে। লোকজন কী সুন্দর গাইছে। আমিও দূরে বসে গুনগুন করছি। এই ভালো।'
কৃষ্ণন মাথা নাড়লো।
'তুই এদিকে এলি যে?' মনস্বী ওকে প্রশ্ন করলো।
'একচ্যুয়ালি আমিও খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছি এই ভিড়ে। ওভারডোজ হয়ে গিয়েছে আমার।' কৃষ্ণন হাসলো।
'বাবা, এ যে একেবারে উলটপুরাণ। দ্য হ্যাপেনিং কৃষ্ণন। দ্য কৃষ্ণন হু ইজ দ্য লাইফলাইন অফ অল পার্টিজ, সে টায়ার্ড?' এইবারে একটু জোরেই হেসে কথাগুলি বললো মনস্বী।
'আরে তুইও এরকম বলিস না! তুইও পিছনে লাগলে কী করে হবে?' কৃষ্ণনের এই কাতর কণ্ঠে মনস্বীর হাসি আরো বেড়ে গেলো। ও বললো, 'তাহলে কী করতে ইচ্ছে করছে এখন? চুপচাপ এখানে বসে ওয়াইন খাওয়া?'
কৃষ্ণন ছোট্ট করে হাসলো। তারপর বলল, 'ইচ্ছে তো করছে এখন এখানে আমার বউয়ের পাশে বসে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকাই। আর তারা গুনি। বউ পাশ থেকে গুনগুন করে গান গাক। বউয়ের ফেভারিট। আজি যত তারা তবে আকাশে। কিন্তু...'
'কিন্তু কী কৃষ্ণন?' মনস্বী জিজ্ঞেস করে।
'আকাশে ঘন মেঘ। একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মনে হয় ঝড়টা এলো বলে। বউকে যে এবারে অন্য গান গাইতে হবে?'
মনস্বী তাকায় ওর দিকে।
তারপর খোলা গলায় গান ধরে।
'আজি ঝড়ের রাতে, তোমার অভিসার।
পরাণসখা, বন্ধু হে আমার।'

যতক্ষণে ও পৌঁছয় 'সুদূর কোন নদীর পারে, গহন কোন বনের ধারে
গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার'এ, আইফোনের ওয়েদার app কে সঠিক প্রমাণ করে তখন ব্যাঙ্গালোরে উঠেছে প্রবল ঝড়। কংক্রিটের বনে, সুইমিং পুলের ধার কীভাবে যেন হয়ে গিয়েছে শিলাইদহ।
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা শুরু হলো। চারিদিকে হলের ভিতরে ঘরে ঢোকার জন্য ছোটাছুটি।

ওরা দুজনে ভিজছে। আজ অনেকদিন পর। 

No comments:

Post a Comment