শুভাদিত্য সান্যাল। বয়স পঁয়ত্রিশ। নামী দামী কলেজের ডিগ্রীর দৌলতে ইতিমধ্যেই একটি বহুজাতিক সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বম্বেতে কর্মরত। সোম থেকে শুক্র অফিসে বারো ঘণ্টা কাটালেও, শনি এবং রবি, পারতপক্ষে কাজেকর্মে থাকতে নারাজ। এই দু'দিন ওর যাকে বলে "মি-টাইম"। সারা সপ্তাহের রসদ জোগায় এই দুদিন।
সক্কাল সক্কাল কমপ্লেক্সের অনতিদূরে অবস্থিত পার্কে খানিক জগিং, তারপর কমপ্লেক্সেরই জিমে খানিক ঘাম ঝরানো। উদ্দেশ্য, এন্ডরফিন সৃষ্টি। এরপর বাড়ি ফিরে খবরের কাগজ। ইতিমধ্যে স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সেও কর্মরত, সারা সপ্তাহে একসাথে বেশিরভাগ দিনই সময় হয় না খাওয়ার। উইকেন্ডে তাই বাড়ির নিয়ম, একই শহরে থাকলে অন্তত দুটো খাওয়া একসাথে বসে খেতেই হবে। শনিবার ব্রেকফাস্ট স্ত্রী মনস্বী বানালে রবিবার বানায় শুভাদিত্য। আজ অবশ্য মনস্বী শহরে নেই। কলেজ রি-ইউনিয়নে ব্যাঙ্গালোরে। তাই নিজের হাতেই ব্রেড টোস্ট আর স্ক্র্যাম্বল্ড এগস, সাথে কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে খেতে হল।
এরপর সারাদিন টুকটাক নিজের স্টাডি রুমটা গুছিয়ে রাখা, বইয়ের আলমারিতে বইগুলো নিয়ে এদিক ওদিক করা। কখনও কখনও আবার এক আধটা বই বের করে উল্টে পাল্টে দেখা। এই আলমারির সংগ্রহ ওদের দুজনের মিলিত প্রয়াস। দুজনেই বই-পোকা। ম্যাট্রিমোনি ওয়েবসাইটে যখন দুজনের প্রথম আলাপ হয়, গান ও সিনেমা ছাড়া আরো যে একটা কমন পছন্দ দুজনের রয়েছে, এটা জেনে শুভাদিত্য যারপরনাই খুশি হয়েছিল। অবশ্য কাজের চাপে ইদানীং পড়া কম হয়ে গিয়েছে আগের তুলনায়, তবুও মাঝে মধ্যেই বইগুলো নেড়েঘেঁটে রাখা হয়।
আজ একা একা লাঞ্চ করতে হবে বলে শুভাদিত্য ক্লাব থেকেই খেয়ে এলো। ওখানে কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব ছিল। খেতে বসে বেশ একটু আড্ডাও হয়ে গেলো। বাড়ি ফেরার পালা।
এই এত বড় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা যেন আজ বড্ড খালি খালি লাগছে। কেউ শুনলে হয়তো বলবে শুভাদিত্য মনস্বীকে চোখে হারায়, কিন্তু ঠিক তা না। তবে মনস্বীর উপস্থিতিটাই এমন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে যে ও না থাকলেই কেমন জানি কী নেই কী নেই মনে হয়।
আজ দুপুরে বারান্দায় ইজিচেয়ারটা নিয়ে বইয়ের আলমারি থেকে কে জানে কী মনে হতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস সমগ্র নিয়ে বসেছিল। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে মনস্বীকে দেওয়া ওর উপহার। পড়তে পড়তে কখন কে জানে দু চোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছে। ঘুম ভাঙল ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝোঁকে। ধুলো উড়ছে। এই রে, হাওয়ার ধাক্কায় ড্রয়িং রুমে মনস্বীর যত্ন করে গুছিয়ে রাখা পোর্সিলিনের শো-পিসগুলি উল্টে গিয়েছে। ভাগ্যিস ভাঙেনি, কেলেঙ্কারি হয়ে যেতো নইলে। দৌড়ে ঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে সেগুলিকে এক এক করে ঠিক করে সযত্নে আগের মতো করেই রাখল শুভাদিত্য। আগের মতো? মনে মনে হাসল শুভাদিত্য। সব কি আগের মতো আদৌ হয়?
ঝড় বৃষ্টি যেন আজকাল শুভাদিত্যর বড্ড ভালো লাগে। কেন জানি না মনে হয়, প্রকৃতি বুঝি ভীষণভাবে ওর জীবনের সাথে মিলে মিশে একাকার। মুহূর্তের একটা থমথমে ভাব। তারপরএই তোলপাড়, আলোড়ন। তারপর সব কিছু ঠাণ্ডা করে দিয়ে নামে বৃষ্টি। মুষলধারায়। মাস দেড়েক আগে যেমন হয়েছিল। অদ্ভুতভাবেই অপ্রত্যাশিত সেই ঘটনা। অত্যন্ত অনভিপ্রেতও বটে। মনস্বীর অনুপস্থিতিতে শুভাদিত্য জানতে পারে ওর জীবনে কৃষ্ণনের কথা। প্রথমে হতবাক হয়। খানিক যেন বিশ্বাসই করতে পারেনা ও। মনস্বী? এমন করলো?
শুভাদিত্য ঠাণ্ডা মাথায় ভাবে। কোথাও হয়তো কোন ভুল হচ্ছে কিছু। সন্দেহের জালে না ফেঁসে সোজাসুজি মনস্বীর সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন যখন ও মনস্বীকে নিয়ে ডিনারের পর গাড়ি পার্ক করে মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটতে বেরোয়, মনস্বী কিন্তু অবাক হয়নি। হয়তো এইসব বিষয়ে আগাম আঁচ সকলেই পেয়ে যায়। তাই শুভাদিত্য যখন কৃষ্ণনের কথা ওকে জিজ্ঞেস করে, মনস্বী একটুও না চমকে দৃপ্ত কণ্ঠে জানায় যে হ্যাঁ, ও কৃষ্ণনকে ভালোবাসে। যেমন বাসত সেই কলেজের দিনগুলি থেকে। তবে কৃষ্ণন ভালোবাসে ওর স্ত্রী সিন্ধুজাকে। তাই মনস্বীরটা এক তরফাই থেকে যায়।
"তাহলে তুমি আমায় ঠকিয়েছিলে বিয়ে করে?" শুভাদিত্য প্রশ্ন করেছিল।
"দেখো, যখন তোমায় বিয়ে করি, আমি তখন অনেকটাই সরে এসেছিলাম ব্যাপারটা থেকে। ভেবেছিলাম তোমায় বিয়ে করে হয়তো পুরোপুরি ভুলে যাবো ওকে। হয়েছিলও তাই। আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম। তুমিই বলো, কোনদিনও তোমার নিজেকে আন-লাভড মনে হয়েছে?" মনস্বী জিজ্ঞেস করেছিল।
শুভাদিত্য চুপ। সত্যিই, এর তো কোন উত্তর নেই ওর কাছে। আজ যদি ও জানতে না পারতো, তাহলে কি কোনভাবে মনস্বীর কোন আচরণে ও বুঝতে পেরেছিল? মনস্বী কি স্ত্রী হওয়ার সমস্ত ধর্ম পালন করেনি? অদ্ভুত এক দোলাচলে ভোগে শুভাদিত্য।
"শোনো, আমি নিজেও খুবই কনফিউজড। আমার মনে হয় আবার কৃষ্ণনের সাথে যোগাযোগটা হওয়ায় আমার মন এমন ঘেঁটে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুকুও কমেনি। এবং সেটা নিখাদ। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, হয়তো কৃষ্ণনকেও আমি সমানভাবে ভালোবাসি। বা হয়তো বাসি না। যা বোধ করছি এই মুহূর্তে, তা হয়তো গোটাটাই সাময়িক মোহ? মায়া? দেখো, সিন্ধুজার ক্যান্সারের খবর পেয়ে কৃষ্ণনের সাথে আমার যোগাযোগটা আবার শুরু হয়। সিম্প্যাথি থেকেই বন্ধুত্বটা গভীর হয়। আগে যেটা হয়তো ইনফ্যাচুয়েশন ছিল, বা ধরে নিলাম ভালোবাসা, আমি ঠিক শিয়োর নই, হয়তো এখনও সেই একই অনুভূতি। শুধুমাত্র বয়স এবং পরিস্থিতি বদলের জন্য অন্যরকম লাগছে।"
মনস্বীর কথা শুনে শুভাদিত্য হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে ও? এরপর আর কীই বা বলার আছে?
"তাহলে আমাদের কী হবে মনস্বী? তুমি আমি আর আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবী?" শুধুমাত্র এইটুকু জিজ্ঞেস করতে পেরেছিল ও।
"যেমন ছিল, তেমন থাক না শুভ?" মনস্বী বলেছিল।
ঝড় থেমে তখন গোটা গোটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ ওরা গাড়িতে ফিরে বসে রইলো। তারপর মনস্বী বলল, "আমায় একটু সময় দেবে শুভ? আমি একটু নিজেকে যাচাই করি? নিজের অনুভূতিগুলি? আগামী মাসে একটা উইকেন্ডে আমাদের কলেজ রি-ইউনিয়ন আছে। আমি ওখানে যাই। কৃষ্ণনও আসবে ওখানে। শুনেছি। আমার মনে হয় ওখানে গেলেই আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি শুভ, ঠকাবো না।" এরপর আর শুভাদিত্য কিচ্ছুটি বলতে পারেনি। তবে ভিতরের তোলপাড় শান্ত হয়েছে।
ঝড় বৃষ্টি চলল অনেক রাত অবধি। শুভাদিত্য চুপচাপ জানালর ধারে বসে বাইরেটা দেখতে লাগল। ব্যস্ত শহর। অগুন্তি লোক। কোলাহল। তাণ্ডব। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে মুহূর্ত।
দশটার দিকে ফোন এলো মনস্বীর।
"শুভ, কাল কিন্তু প্লীজ এয়ারপোর্টে এসো। বলেছিলাম না এখানে এলে আমার মাথাটা পরিষ্কার হবে? হয়েওছে ঠিক তাই। এখন আমি একদম শিয়োর। আমি কী চাই। কাকে চাই। লক্ষ্মীটি, কাল আমায় পিক-আপ করতে এসো। যতক্ষণ না মুখোমুখি কথা হচ্ছে, আমি তর সইতে পারছি না।" কলকল করে বলে গেলো ও।
"বেশ, আসবো। ফ্লাইট ডিটেলস মেসেজ করে দিয়ো।" শুভ মৃদু হেসে বলল।
রাত প্রায় বারোটা। বৃষ্টিটা ধরেছে খানিকক্ষণ হল। চারিদিক ঠাণ্ডা। শান্ত। স্নিগ্ধ। বারান্দার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুলগুলো বৃষ্টির জলে স্নান করে ঝকঝক করছে স্ট্রিটলাইটের আলোয়।
আবারও শুভাদিত্য নিজের জীবনের সাথে প্রকৃতিকে বড্ড একাত্ম বোধ করলো।
No comments:
Post a Comment