৪৩/১ গোপাল ব্যানার্জী লেন। ছোট্ট কাঠের খিল দেওয়া দরজা ঠেলে ঢুকলেই উঠোন। উঠোনে চৌবাচ্চায় ঠাণ্ডা কালো জল। দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠেই সেই টানা লম্বা দালান। দালানের একদিকে হাবিজাবি বাতিল জিনিসে ঠাসা একটা পুরনো শুকনো চৌবাচ্চা। পাশেই রান্নাঘর। মইমার রান্নাঘর। উঁকি মারলেই সব-পেয়েছির-দেশ। গরম গরম ঘুগনি, টমেটোর আঁচার, মৌরলা মাছ ভাজা, কুঁচো নিমকি, মিল্কমেইডের টিন... সবুজ মিটসেফের ভিতর রত্ন খনি। মায়ের শাসন, চোখ রাঙানি মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ! এল-শেপের দালানের আরেক প্রান্তে দেওয়ালে পেরেক দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা মা আর মামণির কোন ছোট্টবেলাকার টানা রথ। পাশেই কাঠের তাকে সারি সারি ঠাকুর দেবতার মূর্তি, ছবি। অবশ্য আমার নজর তাঁদের সামনে রাখা পুঁচকি স্টিলের প্লেটে রাখা নকুলদানা আর মিছরিতে। দালানে পাতা কাঠের বেঞ্চিতে খানিক বসতে না বসতেই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা গ্লুকন ডি হাজির। ততক্ষণে অবশ্য আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গলির উল্টোদিকের রান্নাঘর থেকে মইমার পাড়াতুতো ননদেরা "ও বৌদি, নাতনি এলো বুঝি?" শুরু করে দিয়েছে। আমিও এক ছুট্টে দাদাই ঘরে ঢুকে সবুজ লোহার জানলার পাল্লা খুলে গরাদ ধরে ঝুলে পড়েছি। "কেমন আছো দিদা? কী রান্না করছো আজ?"
একটু দুপুর হতেই পোস্ত ডাল তরকারি মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে অ্যাজবেস্টসের ছাদের ঘরে ঢুকে পড়া। প্রচণ্ড গরম। লম্বা ডাণ্ডার ডিসি ফ্যান মাঝে মাঝেই বিরাম নিয়ে ফেলছে। বাঁচতে তখন একটাই উপায়। খাটের তলায় ঢুকে যাও। সিমেন্টের মেঝে। অনেকটাই ঠাণ্ডা। এদিকে ঘুম তো আসে না চোখে। মায়ের পিটুনি খেয়ে তাও চোখ বুজে শুয়ে থাকা। যদি ভুল করে একটু ঘুমিয়ে পড়ি। পাশের বাড়ির অ্যাজবেস্টসের ছাদের নীচে ফাঁকে তখন এক দল পায়রার সুখ-নীড়। মধ্যে মধ্যেই তাই বক-বকম। ঘুমহীন চোখ। হাঁ পিত্যেশ করে তাকিয়ে আছি দেওয়াল ঘড়ির দিকে। কখন ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘরে পৌঁছবে। এই মিছিমিছি ঘুমের প্রহসন থেকে পাবো মুক্তি। গড়াতে গড়াতে কাঁচের আলমারির এক্কেবারে সামনে চলে আসি। নীচের তাকে তখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায় দাদাভাইয়ের সেই মেরুন-সবুজ রঙের কাঠের রেল-ইঞ্জিন, মামণির দেওয়া খেলনাবাটি। আর একটু ওপরের তাক থেকে জুলজুল করে দেখছে আর আমায় বারবার হাতছানি দিচ্ছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার আর শরৎ রচনাবলী।
একটা সময় দালানের এক্কেবারে শেষ প্রান্তে, জামাকাপড় বোঝাই আলনার উল্টোদিকে ছোট ঘরটায় দেওয়ালের পেন্ডুলাম ঘড়িটি ঢং ঢং করে ছুটি ঘোষণা করে। হইহই করে এক ছুটে ঘরে উঠে রাস্তার দিকের দরজাটা খুলে বসে পড়ি খেলনাবাটি নিয়ে। শুরু হয় মনগড়া জগতে অবাধ বিচরণ।
শেষ হয়ে যায় আরেকটা গ্রীষ্মের দুপুর।
এখনও লু বয়। এখনও পায়রাগুলো ডেকে যায়। সেই কাঠের রেল-ইঞ্জিন ধুঁকতে থাকে। তবু ঘরে ফেরা হয় না।
No comments:
Post a Comment