Tuesday, April 2, 2019

তাতান ও ম্যাজিক সানগ্লাস

১।

ছ'টার জায়গায় পৌনে সাতটায় যখন দার্জিলিং মেলটা শিয়ালদা ঢুকল, তাতান যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল। যদিও এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে গিয়ে বেশ ভালোই লেগেছে ওর, তবুও এই আজকে ঠিক সময়ে বাড়িতে না পৌঁছলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত তাতানের। তাতান, অর্থাৎ সেন্ট ডমিনিক পাবলিক স্কুলের ক্লাস সিক্সের সৌরদীপ সেনগুপ্ত। আগামীকাল ওর একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচ রয়েছে। সেন্ট ডমিনিক ভার্সেস সানশাইন অ্যাকাডেমি। যদিও স্কুলেরই কাবস দল, অর্থাৎ জুনিয়র দলের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা, তবুও সিনিয়রদের রেষারেষির ছায়া এদের মধ্যেও পড়েছে। কাবসের ইনটার স্কুলে গত বছর সানশাইনকে ফাইনালে পাঁচ উইকেটে হারিয়ে সেন্ট ডমিনিক জিতলেও এইবারে অবস্থা হাড্ডাহাড্ডি। গ্রুপ ম্যাচে এবারে সেন্ট ডমিনিকের পারফর্মেন্স খুব একটা ভালো যায়নি। ওদের স্টার প্লেয়ার, ফাস্ট বোলার চাঁদু, অর্থাৎ চন্দ্রদীপ দ্বিতীয় ম্যাচের দিনেই পা ভেঙ্গে কাহিল। বদলি বোলার হারুণ নতুন। নার্ভাস। তাই নেটে ভালো খেললেও আসল ম্যাচে বলে বলে ওকে অপনেন্টের ব্যাটসম্যানরা পিটিয়ে ছাতু করে দিচ্ছে, রোজ। নেহাত তাতান, অর্ক আর মানিক - তিনজনেই দুর্দান্ত ফর্মে আছে, তাই কোনরকমে ব্যাটিং দিয়ে ম্যানেজ হয়েছে এ যাবৎ। কিন্তু সানশাইন তো আর যে সে টিম নয়। ওদের বিরুদ্ধে জিততে গেলে একেবারে জান প্রাণ লড়িয়ে দিতে হবে।
প্রচণ্ড গরম এবং বেশ কিছু প্লেয়ারদের চোট আঘাতের জন্য গ্রুপ ম্যাচের পর দশদিনের ছুটি ছিল। আগামীকাল থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু। এবং প্রথম ম্যাচেই সেন্ট ডমিনিক খেলবে সানশাইনের বিরুদ্ধে। তাতান সেন্ট ডমিনিকের ক্যাপ্টেন। ওর ওপর তাই বাড়তি দায়িত্ব, বাড়তি চাপ। আজ দুপুরের প্র্যাকটিস সেশনটা তাই ওদের জন্য খুব জরুরি। তাতান মুখিয়ে আছে। হারুণকে চাঙ্গা করতে দার্জিলিং থেকে দুর্ধর্ষ টোটকা নিয়ে এসেছে। এবার তারই পরীক্ষা।

২।

বাড়ি ফিরে ঠামুর কাছে আদর আহ্লাদ পেয়ে, স্নান সেরে, ডাল-ভাত-পোস্ত-মাছের ঝোল খেয়ে তাতান বসল নিজের কিট ব্যাগটা নিয়ে। দেড়টা বেজে গিয়েছে। আড়াইটের মধ্যে স্কুল গ্রাউন্ডে ওদের সবার পৌঁছে যাওয়ার কথা। তার আগে ব্যাগ গুছিয়ে নিতে হবে। দার্জিলিং ট্রিপে ওর যাবতীয় জামা-প্যান্ট সব ছিল বাবার স্যুটকেসে। বাবা তো এখন ঘুমোচ্ছে। ডেকে তোলাও যাবে না। বকা খাবে। কাজেই বন্ধুদের জন্য কেনা উপহারগুলো আজ আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। যাক গে। কীই বা করা যাবে। কিন্তু আসল জিনিসটা তাতান বুদ্ধি করে গতকাল বিকেলেই মায়ের হ্যান্ডব্যাগে রেখে দিয়েছিল। ভাগ্যিস। মা একটু সবে ঘরে ঢুকে বিছানায় গা এলিয়েছে, হাতে মোবাইল নিয়ে, তাতান বলল, "মা, আমার সানগ্লাসটা তোমার হ্যানন্ডব্যাগে দিয়েছিলাম না কাল? ওটা নিয়ে বেরবো এখন। ব্যাগটা কোথায় আছে বলো, আমি বের করে নেবো।" মা চোখ না তুলেই বলল, "দেখ ড্রেসিং টেবিলের পাশে চেয়ারে রাখা আছে। নিয়ে নে সাবধানে।" তাতান গেলো ড্রেসিং টেবিলের কাছে। মায়ের হাল্কা গোলাপী ব্যাগটার চেন খুলে খানিক হাতড়ে খুঁজে পেল সানগ্লাসের কালো পাউচটা। একবার দড়ি খুলে দেখে নিলো, সব ঠিকঠাক আছে তো? এরপর নিজের ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে প্র্যাকটিস জার্সি-ট্রাউজারস পরে চোখে সানগ্লাসটা এঁটে কিটব্যাগ নিয়ে সাইকেল চেপে বেরোল স্কুল গ্রাউন্ডের দিকে।
যতক্ষণে তাতান স্কুলে পৌঁছল, ঘড়িতে তখন বাজে সোয়া দুটো। দেখল, ইতিমধ্যেই সেন্ট ডমিনিকের রত্নরা, অর্থাৎ, অর্ক, মানিক, পল্লব, রজত, আনন্দ, কল্যাণ সবাই এসে গিয়েছে। এখনও আসা বাকি ফারুখ, বিদ্যুৎ, প্রদীপ্ত আর ঋভুর। তাতান মাঠে যেতেই সবাই ওকে ঘিরে ধরল। "কীরে কেমন ঘুরলি?" "মোমো খেলি?" "ঠাণ্ডা পেলি?" সব প্রশ্নের উত্তর একে একে দিয়ে তাতান বলল, "শোন, যে কারণে তোদের আগেভাগে ডাকা। কালকের ম্যাচের জন্য ছোট্ট করে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করবো। আর একটা ছোটো করে নেট প্র্যাকটিস। এ ক'দিন সবাই খেলেছিস তো নিয়মিত?"
বিদ্যুৎ বলল, "সে তো খেলেছি। স্ট্র্যাটেজি করবি, ভেরি গুড। কিন্তু এখনও হারুণ আসেনি কেন?"
"ও আসবে। ওকে আমিই তিনটে নাগাদ আসতে বলেছি। ও আসার আগে আমাদের কিছু আলোচনা আছে।" গম্ভীরস্বরে তাতান কথাগুলো বলে দলের সকলকে নিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে খানিক জটলা পাকিয়ে খেলার স্ট্র্যাটেজি তৈরির আলোচনা শুরু করলো। খানিক ফিসফাস, আস্তে, জোরে সবরকমই গুঞ্জন শোনা গেলো। এরপর তাতান বিদ্যুৎকে বলল, "ভাই, হারুণ যখন তোকে বল করবে, ফুল টস দিলেই ছয় হাঁকিয়ে দিবি। ইয়রকার দিলে ছেড়ে দিয়ে বোল্ড আউট হবি। আর একটু শর্ট লেন্থ দিলেই খোঁচা লাগাবি" তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, "কেউ একটাও ক্যাচ ফেলবি না যেন। আজকের ম্যাচ প্র্যাকটিসটা বুঝতেই পারছিস কতটা ভাইটাল। স্পেশালি আমাদের হারুণের জন্য। চল চল, ও এসে গিয়েছে দেখ। লেটস ওয়ার্ম আপ।"

হারুণ সেন্ট ডমিনিকের ক্লাস ফাইভের ছাত্র। রোগা পাতলা এই ছেলেটি সাধারণত চুপচাপ থাকে, একটু ভীতু প্রকৃতিরই। নেহাৎ গেমসের নিখিলেশ স্যার ওকে গেমস পিরিয়ডে দুর্দান্ত কয়েকটা ইয়রকার দিতে দেখেছিলেন, তাই। এই বছর যখন সেন্ট ডমিনিকের কাবসের দল তৈরি হচ্ছিল, উনি নিজে তাতানের কাছে ওর নাম সুপারিশ করে বলেন, "সৌরদীপ, যদিও হারুণ একটু ছোট, তবুও বলবো। ওকে তোমাদের দলে রেখে দাও। কোন কোন ম্যাচে খেলিয়ো। ওর মধ্যে একটা পোটেনশিয়াল আছে, আমি দেখেছি। দেখো, ভালোই খেলবে।" স্যারের কথা অনুযায়ী তাতান হারুণকে দলে নিলো। চাঁদুর চোটের পর খেলালোও সব ম্যাচ। কিন্তু নেটে যে উইকেটের বাইরে একটাও বল করে না, সে কিনা পরপর তিন ম্যাচে একটাও উইকেট না পেয়ে শুধুই চার আর ছয় খেয়ে গেলো। আগামীকাল সানশাইনের খেলা নিয়ে ও ভীষণ ভয় পেয়ে আছে। তাতানকে তো দার্জিলিঙে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার ফোন করে "দাদা আমি কী করে খেলবো? আমায় বের করে দাও দল থেকে। আমায় সবাই খালি ছয় চার মারে" বলে কাকুতি মিনতি করেছে। তাতান ছোটো হলেও ওর মধ্যে ক্যাপ্টেনসুলভ বিচক্ষণতা আছে। বারবার যথাসাধ্য ও হারুণকে সাহস জুগিয়ে চলেছে। কিন্তু কোথায় কী? আসল ম্যাচে ছেলেটা নার্ভাস হয়ে এত বিচ্ছিরি ভাবে খেলেছে। নেহাৎই নিরুপায়। তাই তাতান ওকে টিমে রাখতে বাধ্য হয়েছে। দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে দাদানের সাথে অনেক গল্প চলাকালীন তাতান হারুণের ব্যাপারে কথা বলতেই দাদানই এই চমৎকার আইডিয়াটি দেয়। এইবার এই চমৎকার আইডিয়া কতদূর খাটে এই ক্ষেত্রে, তা পরখের প্রতীক্ষা। 

"হারুণ, চলে আয়। রেডি তো?" তাতান হাসিমুখে প্রশ্ন করে।
"হ্যাঁ দাদা। রেডি। তবে..." কাচুমুচু মুখে হারুণ আদ্ধেক কথা বলে থেমে যায়।
"কী হলো রে? কী তবে?" তাতান জিজ্ঞেস করে।
"তবে ভয় করছে।" হারুণ একটু নীচু স্বরে বলে।
"তাহলে এক কাজ করি। এদিকে আয় আমার সাথে। তোকে একটা সিক্রেট বলি।" এই বলে তাতান হারুণের কাঁধে হাত রেখে ওকে নিয়ে এগলো গ্যালারির দিকে। বাকিরা কথা মতো ফিল্ডিং প্র্যাকটিস চালু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে।
"এই যে, এই সানগ্লাসটা পরে আছি আমি দেখছিস?" তাতান নিজের নীল সানগ্লাসটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
"হ্যাঁ, বেশ দেখতে কিন্তু! একদম রিকি পন্টিং এর মতো লাগছে দেখতে তোমাকে।" হারুণ বলল, মুগ্ধ হয়ে।
"শুধু দেখতেই না রে। এই সানগ্লাসটা পরলে আমার মধ্যে রিকি পন্টিং খোদ ভর করে রে।" তাতান বলতে থাকে।
হারুণ অবাক হয়ে বলে, "মানে?"
"মানে এই যে এই চশমাটা চোখে থাকলে আমার ক্রিকেটীয় বুদ্ধি দারুণ বেড়ে যায়। এমন কী আমি ম্যাজিকের মতো ঠিক আগে থেকে দেখে বুঝে যাই। দেখতে পাই, বলতে পারিস। কোন বোলার কীরকম বল করবে। কোন ব্যাটসম্যান কীভাবে খেলবে। সব। এমনকি, ফিল্ডার ক্যাচ মিস করবে কি রান আউট করতে পারবে, সব আমি আগাম বলে দিতে পারি। সবকিছু দেখতে পেয়ে যাই এই চশমাটা পরলেই।" তাতানের কথাগুলো শুনে হারুণ খানিক অবাক হয়ে তাকায়। তারপর বলে, "ধ্যাত, কী যে বলো দাদা? এমন আবার হয় নাকি?" তাতান যেন এমন প্রশ্নের জন্য তৈরিই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, "চল তাহলে তোকে ডেমো দেখাই একটা। তবে যদি তুই বিশ্বাস করিস। নেটে চল।"
"চলো" বলে হারুণ আর তাতান এগোয় নেটের দিকে।

নেটে তখন কল্যাণ বল করছিল ঋভুকে। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ। কল্যাণের থেকে বলটা নিয়ে হারুণের হাতে দিল তাতান। আর বিদ্যুতের দিকে তাকিয়ে বলল, "দেখি তো বিদ্যুৎ, কেমন খেলিস হারুণকে।" হারুণের দিকে একবার হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে তাতান বলল, " নে দেখি। উইকেট টিপ করে বল কর। দেখি কেমন ছয় মারে। কল্যাণ ব্যাটাকে তো ছয়ের পর ছয় হাঁকছিল দেখলাম। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। তুই টিপ রেখে বল করছিস। পরপর বেল উড়ছে। নে দেখি, খেল।"
সত্যিই তাই। এরপর পরপর ছয় বল হারুণ এক্কেবারে উইকেট লক্ষ্য করেই করলো। এবং প্রত্যেকটাতেই বিদ্যুতের বিখ্যাত ডিফেন্সকে নড়বড়ে প্রমাণ করে বেল উড়ে গেলো। ছয়ে ছয়।
"সাবাশ হারুণ।" তাতান, মানিক, অর্ক ওর পিঠ চাপড়ে গেলো একে একে। বিদ্যুতের মতো প্লেয়ারের ডিফেন্স পরপর ছ'বার অ্যাটাক করে বেল উড়িয়ে দেওয়া, চারটিখানি কথা না।
আরো ঘণ্টা দেড়েক চলল ওদের প্র্যাকটিস। এই এতক্ষণে তাতানের মনে হল, ওর দল দুর্ধর্ষ ফর্মে রয়েছে। প্রত্যেকে। আত্মবিশ্বাস টগবগ করছে সকলের। কালকে সানশাইনকে দেখিয়ে দেবে ওরা।

৩।

অবশেষে আজ সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের দিন। সকাল ন'টা থেকে সেন্ট ডমিনিকের গ্রাউন্ডেই খেলা। হোম গ্রাউন্ড অ্যাডভান্টেজ নিতে ওরা প্রস্তুত। স্কুলের কমলা খয়েরি জার্সি গায়ে দিয়ে ওরা এগারোজন প্লেয়ার মাঠে নামছে। সবার সামনে রয়েছে ওদের ক্যাপ্টেন, সৌরদীপ। মাথায় সাদা রঙের ক্যাপ। এ যাবৎ টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি রানের প্রতীক। চোখে নীল সানগ্লাস। টসে জিতে সানশাইন ব্যাটিং নিয়েছে। ব্যাটিং এর উপযুক্ত একদম এই পিচ। এমনটা ইচ্ছে করেই করা। কারণ সেন্ট ডমিনিকের ব্যাটসম্যানেরাই সম্বল।
তাতানের ভিতরে উত্তেজনা তুঙ্গে। এই ম্যাচটা বের করতেই হবে। টসে হেরে একটু দমে গেলেও বাকিদের সামনে দেখানোই যাবেনা। বিশেষ করে হারুণ। কল্যাণকে দিয়ে ওপেন করালো ওভার। এবং প্রথম বলেই চার মারল সানশাইনের কপিল। দ্বিতীয় বল, একটু স্লো করলো। ব্যাটে বলে লাগল না। তৃতীয় বল। আবারও ব্যাটে বলে হল না। ডট বল। চতুর্থ বল। ফুল টস। তবুও দুই রানই হল। পঞ্চম বল। গুড লেন্থ। ঠুকে খেলে এক রান নিলো কপিল। এবারে শেষ বল খেলবে রাজীব। ডট বল। প্রথম ওভারের শেষে সানশাইনের রান ৭/০।

দ্বিতীয় ওভার বল করবে হারুণ। তাতান ওর হাতে বল দিয়ে পিঠ চাপড়ে বলল, "হারুণ, আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই কালকের মতো উইকেট টিপ করে বল কর। বোল্ড হবেই।" ফিল্ড সাজানো হল। লম্বা রান-আপ নিয়ে বল করলো হারুণ। এবং এক্কেবারে ফুল-টস। কপিল সুযোগ ছাড়ল না। তুলে ছয়। তাতান দৌড়ে এসে হারুণের কাঁধে হাত রেখে বলল, "ভয় পাস না। বলছি না? তুই উইকেট লক্ষ্য করে বল কর। বোল্ড হবেই। কপিল এই ওভারেই বোল্ড হবে।" দ্বিতীয় বল। ইয়রকার। এবং কপিল বোল্ড। দলের সব ছেলেরা লাফিয়ে এসে হারুণকে জড়িয়ে ধরল। এরপর নামল সূরজ। সানশাইনের এই মুহূর্তের সবচেয়ে ইন-ফরম ব্যাটসম্যান। তাতান জানে, হারুণের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। ওকে সামলাতে হবে। সূরজ লেগের বলগুলো দারুণ খেলে। ওইদিকে তাই ওকে কিছুতেই বল দেওয়া যাবে না। কোনমতে সামলে রাখতে হবে। হারুণকে বলল, "আস্তে করে শর্ট দে একটা। খোঁচা লাগাক। স্লিপে ছেলে রাখছি। আউট হবেই।" হারুণ ওর তাতান দাদার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। এবং অবধারিতভাবে ফলও পেল। স্লিপে পল্লবের হাতে ক্যাচ আউট। পরের তিন বলই ডট। দ্বিতীয় ওভারের শেষে সানশাইন ১৩/২।

এরপর স্পিনার এলো। সানশাইন তুলে তুলে মারল। মারবেই। ব্যাটিং পিচ। দশ ওভারের শেষে ওরা ৮০/২। আর পাঁচ ওভার বাকি। এই স্লগ ওভারগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হারুণের এখনও দু'ওভার বল বাকি। তাতান এবার তাই ওকেই ডেকে বল দিল। ব্যাট করবে প্রদীপ্ত। কুড়ি বলে পঁয়ত্রিশ করে খেলছে। তাতান হারুণকে তাতানোর জন্য এগিয়ে এলো, "আবার সোজা উইকেট দেখে বল কর। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই ওকে বোল্ড করবি। এই ওভারেই। দেখে বল কর ভাই।"

হারুণ বল হাতে ছোটা শুরু করল। সেন্ট ডমিনিকের গ্যালারি থেকে "গো হারুণ, গো হারুণ" চিৎকার। এবং সোজা উইকেটে বল। প্রদীপ্তর ডিফেন্স কোন কাজেই এলো না। বেল উড়ে গিয়ে মিডল স্টাম্প ছিটকে গেলো। সারা মাঠ হইহই করে উঠল। ৮০/৩। এবারে ক্রিজে এলো সায়ন। বিগ হিটার। সানশাইনের ক্রিস গেল। তাতানের সেই এক বুলি। হারুণ বল করলো। এবারে লেগ স্টাম্প উড়ল। ৮০/৪। এই নিয়ে ম্যাচে দ্বিতীয়বার, "হারুণ অন আ হ্যাট্রিক।" তাতান এসে হারুণকে বলল, "দেখ, হ্যাট্রিক করার সুবর্ণ সুযোগ। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুই এই বলেই উইকেট পাবি। শান্ত হয়ে খেল। মাথা ঠাণ্ডা। স্লো বল দে। খোঁচা লাগাক। স্লিপে ঋভু থাকবে।"  সানশাইনের ঝড় এখন হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছে।  নতুন ব্যাটসম্যান দীপু। চূড়ান্ত চাপে আছে। চোখ মুখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মারাত্মক টেনশনে। এদিকে হারুণ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। স্লো বল করলো একটা। এবং ঠিক তাতানের ভবিষ্যৎবাণী মেনেই বলটা না ছেড়ে দিপু খেলতে গেলো, এবং আবার সেই খোঁচা লাগল। স্লিপে ক্যাচ। ঋভুর হাতে এসে বল সহজেই পড়ল। আউট। হারুণের হ্যাট্রিকে গোটা মাঠ উল্লাসে ফেটে পড়েছে। গ্যালারি থেকে ভেঁপু, বাঁশির আওয়াজ। হইহই। চিৎকার। হারুণ নিজে ছুটে গিয়ে তাতানকে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল। "দাদা, আমি পারলাম। তোমার প্রেডিকশন পারফেক্ট।"

সানশাইনের ইনিংস শেষ হল নব্বই রানে। সেন্ট ডমিনিকের ব্যাটসম্যানেরা হেসে হেসে বারো ওভারের আগেই তিন উইকেট হারিয়ে সেই রান তুলেও ফেলল। সানশাইনকে হারিয়ে সেমি ফাইনালে পৌঁছল সেন্ট ডমিনিক। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ স্বাভাবিকভাবেই হারুণ।

প্রাইজ সেরিমনির পর নিজেদের মধ্যে বসে ওরা বারোজন এখনও লাফালাফি করছে। এ ওর কাঁধে চাপছে। হারুণকে তো কেউ ছাড়তেই চাইছে না। ওই তো আজকের হিরো। এরই ফাঁকে তাতান মায়ের পৌঁছে দেওয়া ব্যাগটা নিয়ে এসেছে। এতক্ষণে সময় হয়েছে বন্ধুদের জন্য আনা গিফটগুলো দেওয়ার। প্রথমেই ও ডাকল হারুণকে। একটা কালো পাউচ ওর হাতে দিয়ে বলল, "এই নে। তোর জন্য আমারই মতো একটা ম্যাজিক সানগ্লাস। পরে দেখ দেখি। কী দেখতে পাস।"
হারুণ সোল্লাসে নিলো ওটা। চোখে দিল। খানিক এদিক ওইদিক দেখল। কিন্তু এ কী? আর পাঁচটা সাধারণ সানগ্লাসের চেয়ে তো আলাদা কিছু বুঝছে না।
"কী? দেখতে পেলি কিছু স্পেশাল?" তাতান প্রশ্ন করলো।
"কই না তো তাতান দাদা। আমি তো বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না। এমনিই তোমাদের সবাইকে, এদিক ওদিক সব দেখলাম। শুধু নীল কাঁচ বলে একটু অন্য রঙে।" অবাক হয়েই হারুণ বলল কথাগুলি।
"ওহো হো, তাহলে বোধহয় তোকে অর্করটা দিয়েছি। সরি।" অর্ককে ওই সানগ্লাসটা ধরিয়ে তাতান ব্যাগ থেকে আরো একটা ওইরকম পাউচ বের করলো। হারুণ চোখে দিল চশমা। এবং এবারেও সেই এক। এইটা পেল বিদ্যুৎ। দেখতে দেখতে হারুণের হাত ঘুরে সকলেই পেল একই চশমা। হারুণের স্পেশালটা তাহলে কোথায়?
"আচ্ছা, তুই বরং আমারটা পরে দেখ তো একবার।" তাতান নিজের সানগ্লাসটা খুলে দিল হারুণকে। অবাক কাণ্ড। হারুণ এতেও আর পাঁচটার চেয়ে আলাদা কিচ্ছুটি বুঝল না। অবাক হয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, "কই তাতান দাদা, এটাও তো একই দেখছি।" সানগ্লাসটা তাতানকে ফেরত দিয়ে জানালো ও। এইবারে তাতান মুচকি হেসে বলল, "আসলে হারুণ তোর কোন দোষ নেই। সব সানগ্লাসই এক। আমি সবকটাই তোদের জন্য হং কং মার্কেট থেকে কিনেছি। কোনটার আলাদা করে কিচ্ছু ম্যাজিকাল পাওয়ার নেই। এই ম্যাজিকের গোটা গল্পটাই ছিল প্রি-প্ল্যান্ড। যাতে কিনা তোর ভয় কাটে। কনফিডেন্স বাড়ে। আসলে তুই এমনিই সেরা প্লেয়ার। খুব ট্যালেন্টেডও। কিন্তু তোর যেটা প্রব্লেম, নিজের ওপর কোন বিশ্বাস নেই। তোর মধ্যে ম্যাচের আগে এই ভরসাটা ফেরত আনা খুব দরকার ছিল। তাই আমরা দশজন মিলে তোর সাথে এই গল্পটা প্রেজেন্ট করি। তুই সেটায় বিশ্বাসও করলি। আর দেখ, তাই ভয় ভুলে কেমন নিজের সেরাটা দিলি। দিলি তো? ফলও দেখতে পেলি?"

হারুণ অবাক। নির্বাক। কী বলবে? এমনও হয়? ও সত্যিই তাহলে ভালো বল করে?
"যাক গে, আজ সবাই রেস্ট নে। আবার কাল থেকে প্র্যাকটিস। শুক্রবার সেমি আছে।" তাতান সকলকে বিদায় জানিয়ে স্কুল গ্রাউন্ড থেকে বেরোয়। মা বাইরে অপেক্ষা করছে। মায়ের থেকে মোবাইলটা নিয়ে ফোন করে দাদানকে। গোটা প্ল্যানের মাস্টারমাইন্ডকে রেজাল্টটা জানাতে হবে তো? রিং হচ্ছে। অপর প্রান্তে এইবারে দাদানের গলা শুনেই ও বলে উঠল, "হিপ হিপ হুররে দাদান!" 

No comments:

Post a Comment