Saturday, April 27, 2019

দার্জিলিং

" আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানিয়েছে, আজও সারাদিন শহরে প্রবল দাবদাহ চলবে। তাপমাত্রা দুপুরের দিকে কোন সময়ে চল্লিশ ছুঁতে পারে। কালবৈশাখীর কোন সম্ভাবনা নেই। "

সক্কাল সক্কাল দূরদর্শন সংবাদে পাঠিকার থেকে এই ঘোষণা শোনার পর থেকেই রুমুনের মেজাজ বিগড়ে আছে। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কী। কোথায় এখন মা বাবার সাথে সিলেরিগাঁওয়ের হোমস্টের বাগানে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে গরম গরম দার্জিলিং টিতে চুমুক দেবে আর মাঝে মাঝেই সাপ্লাই আসবে নরম তুলতুলে বাঁধাকপির পাতা ঠাসা মোমো, তা না। একেই এই বিচ্ছিরি গরম শহরে, তার মধ্যে আবার পা ভেঙ্গে প্লাস্টার করে শয্যাশায়ী। মা পইপই করে বলেছিল সেদিন পাকামো করে স্টিলের ল্যাদাড়ে না ছাপতে। কিন্তু না। ওকে যে তক্ষুণি কোন মান্ধাতার আমলে কী না কী ডায়েরিতে হাবিজাবি লিখে রেখেছিল, সেটা চাইই চাই। ইন্সট্যাগ্র্যামে দেবে। মায়ের কথা না শোনার ফল। ধপাস। মটমট। দুধ না খেয়ে খেয়ে ক্যালসিয়ামের অভাব। ফলে ডান পা ভেঙে ছয় সপ্তাহ প্লাস্টার, গৃহবন্দী। মা বাবা তাঁদের যাওয়াটা ক্যান্সেল করবে বলায় রুমুন নিজে থেকেই "না না তোমরা ঘুরেই এসো, ইউ ওয়ের লুকিং ফরওয়ার্ড টু ইট। আমি ম্যানেজ করে নেবো। পরে তিনজনে যাবো নাহয়" বলায় তাঁরা যে সত্যি সত্যিই সেটা মেনে নেবেন, রুমুন ভাবতে পারেনি। রমলাদির হাতে ওর সব দায়িত্ব সঁপে তাঁরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ভাগ্যিস ইন্টারনেটের সিগন্যাল কমজোরি, তাই পরপর অন্তত হোয়াটসঅ্যাপে ছবির পর ছবি আসছে না। এমনিতে যা উৎসাহ। আপাতত ভয়েস কলেই যা মন খারাপ হয়ে আছে রুমুনের। ধুর।
অগ্নিটাকেও সকাল থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করে করেও পাচ্ছে না। সমানে আউট অফ রেঞ্জ বলে চলেছে। নির্ঘাত বন্ধুদের সাথে উইকেন্ডে হুঠ করে কোন প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়েছে। ভাল্লাগেনা। সবাই নিজের নিজের মতো আনন্দ করছে। ওর কথা কেউ ভাবছেই না। ওকে কেউ ভালোইবাসে না। ও বেচারি বসে বসে একটার পর একটা চিপসের প্যাকেটের শ্রাদ্ধ করেই চএলছে। বই পড়তে, সিনেমা দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না। টিভিতেও কিছু নেই। নইলে সকাল সকাল কেউ দূরদর্শন খুলে বসে?
আনমনা হয়ে এইসব উল্টোপাল্টা এলোমেলো চিন্তা করতে করতে কখন কে জানে ঘুম এসে গিয়েছিল রুমুনের। এই হয়। চুপচাপ শুয়ে থাকলে খালি ঘুম আসে। রান্নাঘর থেকে হঠাৎ হইহই শব্দ শুনে ঘুমটা ভাঙল। পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলও, দশটা কুড়ি। তাহলে বোধহয় রান্নার দিদি এসেছে। রমলাদির সাথে গল্প করছে। দুজনেই যা বকবক করে, পারেও এরা। কিন্তু... উহু... পুরুষ কণ্ঠ শুনলো মনে হলো। কে এলো? কারুর তো এখন আসার কথা না। চিমনি পরিষ্কার করতে? তার সাথে হ্যাঁ হ্যাঁ করবে না তো রমলাদি।
"রমলাদি, একবার এ ঘরে এসো" বলে হাঁক পাড়ল রুমুন।
"দিদিমণি, ব্যস্ত আছি একটু। দোষ মিনিট পর আসছি", উত্তর এলো রান্নাঘর থেকে।
ব্যাপারটা ভালো লাগছে না রুমুনের। অচেনা অজানা কেউ এলো নাকি? কী করবে? কাকে ফোন করবে? নিজেও তো উঠে গিয়ে দেখতে পারবে না। ধুস। অস্থির লাগছে। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গিয়েছে। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসা একটু কমেছে। শুধু ওই বাসনের টুকটাক শব্দ। ব্যস। রমলাদিকে আরেকবার ডাকবে কি না ভাবছে ও, এমন সময় সবুজ চেক পর্দাটা  ঠেলে হাতে সাদা প্লাস্টিকের ট্রে নিয়ে যে ঢুকল, তাকে দেখে রুমুন অবাক। এ কী, অগ্নি? ওর তো এখন এখানে থাকার কথা না। সত্যিই ও? হ্যাঁ, তাইই তো। গত জন্মদিনে দেওয়া হলুদ টিশার্ট পরে। চুলগুলো সেই বিচ্ছিরি স্টাইলে সেট করা।
"তুই?" রুমুন চোখগুলো  বড় বড় করে প্রশ্ন করলো।
"কেমন? সারপ্রাইজটা কেমন লাগল বল?" ট্রে হাতে নিয়ে অগ্নি এগিয়ে এলো। এতক্ষণে রুমুন ভালো করে তাকিয়ে দেখল। গরম গরম সাদা ধবধবে মোমো। ধোঁওয়া উঠছে এখনও। আহা!
"খেয়ে বল কেমন", অগ্নি হাসি মুখে বলে।
"বানালি?" জিজ্ঞেস করে রুমুন। ঝপ করে একটা মোমো মুখে পুরতেই যেন স্বর্গসুখ অনুভূতি হয়।
"ওয়াও, দিস ইজ অ্যামেজিং", উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রুমুন বলে।
"দার্জিলিং যেতে পারলি না তো কী হয়েছে? আমি দার্জিলিং নিয়ে আসবো তোর কাছে। দুদিনের জন্য এসেছি। এসিটা চড়া ঠাণ্ডায় সেট করে একটা বেশ দার্জিলিং দার্জিলিং পরিবেশ বানিয়ে ফেলবো। খালি মোমো খাবো। আর চা। ও, মাঝে মাঝে স্টিমিং হট রাইস আর চিলি পর্ক কারি। সাথে দার্জিলিং জমজমাট আর ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দুটোই পড়ে শোনাবো। কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমাটাও স্ট্রিম করবো। অঞ্জন দত্তর গান চলবে। বল আর কী চাই?"
রুমুন খানিক তাকিয়ে থাকে অগ্নির দিকে। তারপর এক ঝাঁপে ওর দিকে এগিয়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে কানে কানে বলে, "এই তো তুইই আমার দার্জিলিং। আমার আর কিচ্ছু চাই না!"
রুমুনের চুলের ভিতর দিয়ে আঙুলগুলো দিয়ে খেলতে খেলতে অগ্নি হাসে। বলে, "পাগলী!"   

No comments:

Post a Comment