বাহন
বাবার সাথে কথা শেষ করে ফোনটা ছাড়তে ছাড়তেই একটা অচেনা নম্বর থেকে কল ঢুকলো লাবণ্যর ফোনে। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে শুনতে পেলো "নমস্কার। আপনি লাবণ্যলতা দত্ত কথা বলছেন?" কণ্ঠস্বরটি বেশ শ্রুতিমধুর লাগলো লাবণ্যর। ও উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। বলুন?"
উল্টোদিকে থেকে ভেসে এলো, "আমার নাম অমিত রায়। আপনার গাড়িটি আপনি বিক্রি করেছিলেন রাজু সাহাকে। আমি ওঁর থেকে কিনি এটা।" খানিক আগেই বাবার থেকে আভাস পেয়েছে এই বিষয়ে। তাই কিঞ্চিৎ আন্দাজ করতে পারছেও। তবুও লাবণ্য বললো, " আচ্ছা। বলুন।" উল্টোদিকের ভদ্রলোকটি বললেন, " আসলে মোটর ভেহিকলস থেকে বলছে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন আপনার নাম থেকে আমার নামে করতে গেলে আপনার সই সাবুদ লাগবে।" ভদ্রলোকের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে লাবণ্য বললো, "কিন্তু আমি তো সমস্ত ফর্মে সই করেই দিয়েছি।" অমিত রায় বললেন, " হ্যাঁ তা দিয়েছেন। মোটর ভেহিকেল থেকে তাও কাস্টোমারী চেকিং এর জন্য হয়তো আপনার কাছে ফোন করতে পারে। তাই আমি আপনাকে জানাতে কল করলাম। আমার নাম অমিত রায়। ডিসেম্বর ২০১৮ তে আমি গাড়িটা কিনি।" লাবণ্য বললো, "হ্যাঁ। ঠিক আছে। বলে দেবো।" অমিত বললেন, "আমি কি আপনাকে একটা মেসেজ করে দেবো এই কথাগুলো?" লাবণ্য খানিক বিরক্ত বোধ করলো। একটু কি বেশিই কথা বলেন? হয়তো সেলস টেলসে আছেন। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন। বলিয়ে কইয়ে লোক। তবে এক্ষেত্রেএইটুকু তো একটা কথা। তাও আবার মেসেজের কী দরকার। তবে লাবণ্য রাগ বা বিরক্তি কোনোটাই প্রকাশ করলো না। শুধু একটু মাপা স্বরে বললো, "বেশ। টেক্সট করে দিন।" অমিত বিগলিত কণ্ঠে "অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম" বলে ফোন ছাড়লেন। মুহূর্তেই এস এম এস এলো একটা ওই নম্বর থেকে। নাম ও গাড়িটি কবে কিনেছেন, সেই তারিখ দিয়ে। পরে ফোন নম্বরটা কোনো কাজে লাগতে পারে ভেবে লাবণ্য নম্বরটা সেভ করলো। অমিত রায়। টাইপ করতে গিয়েই এক চোট হাসি পেলো ভারী। লাবণ্য আর অমিত। এবং কী আশ্চর্য, পদবী পর্যন্ত এক। কোইনসিডেন্স বটে!
সারাদিন আজ কাজের প্রেশার সাংঘাতিক ছিলো। মাস খানেক হলো ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে কলকাতায় এই ইনস্টিটিউটে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে জয়েন করেছে লাবণ্য। প্রশাসনিক কাজ, পড়াশোনার কাজ সব মিলিয়ে ভালোই ব্যস্ততা। ইনস্টিটিউট থেকে বাড়ি ফেরার ডাইরেক্ট বাস নেই। রোজ রোজ ওলা উবার চাপলে মাইনে পুরো তাতেই শেষ হয়ে যাবে, যা সার্জ প্রাইসিং। অগত্যা দুবার অটো আর তারপর বাস, এই ভরসা। প্রথম অটোর লাইনে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে লাবণ্য। লাইন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অথচ অটোর দেখা নেই। বাধ্য হয়ে ওলা উবার দেখলো, তাতেও তথৈবচ। মাকে একটা ফোন করে অবস্থা জানিয়ে রাখলো। চিন্তা করবে নইলে। ইয়ারফোনেও রেডিও চলছে, কতক্ষণ ধরে সেখানে শুধুই বিজ্ঞাপন। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে লাবণ্যর। গাড়িটা থাকলে এই অসুবিধে হতোই না। বারবার বাবাকে বলেছিল, গাড়িটা বিক্রি না করতে। কিন্তু ও ব্যাঙ্গালোরে থাকায় কলকাতায় গাড়িটা ব্যবহার না হয়ে শুধু শুধু পড়ে পড়ে মেন্টেনেনসের জন্য মাসে মাসে এত টাকা খরচ হচ্ছিলো। নাহ, এইবারে একটা গাড়ি কিনতেই হবে। ই এম আই দিয়েই নাহয়।
মোড়ের মাথায় বিচ্ছিরি জ্যাম হয়ে আছে। গাড়িগুলো সমানে হর্ন বাজিয়ে চলেছে। বিরক্ত হয়ে লাবণ্য একটু পিছিয়ে গেল। ট্র্যাফিক সিগনাল অনেকক্ষণ ধরে লাল। কখন সবুজ হবে, ঠিক নেই। তাই পিছিয়ে গিয়ে ক্যাবের চেষ্টা করবে। যদি কপাল খোলে। এবং কী আশ্চর্য। কপাল খুললো কি না কে জানে, তবে ওই গাড়ির ভিড়ে চোখে পড়লো ওর প্রিয় সিলভার স্যানট্রো গাড়িটা। হ্যাঁ, ঠিক। নম্বরও তো একই। ওই তো, ১৭৯৬। এই নিয়ে সারাদিনে দ্বিতীয়বার কোইনসিডেন্স কথাটা মাথায় এলো লাবণ্যর। আচ্ছা, গাড়িটা আছে তো কী হয়েছে, লিফট চাওয়া যায় নাকি। তা ছাড়া চেনে না জানে না। হাজার হোক, গাড়িটা এখন আর ওর না। জনৈক মিস্টার অমিত রায়ের। তা বলে তাকে হুট করে গিয়ে বলবে, "শুনুন, আমি লাবণ্য। আপনার সাথে সকালে আমার কথা হয়েছে। আপনি যে গাড়িটা চালাচ্ছেন, সেটা এক কালে আমি চালাতাম। আমায় তাই আপনি লিফট দিন।" ধ্যাৎ, কেমন একটা নিজের কানেই কথাটা লাগলো লাবণ্যর। কী করবে। যাবে? না যাবে না? বড়ই দ্বিধা। প্রিয় স্যানট্রো এদিকে যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে বারবার। মনে পড়ে যাচ্ছে ওতে চড়ার সমস্ত স্মৃতি। প্রথম গাড়ি চালানো। প্রথমবার মায়ের ওপর রাগ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। বাবার সে কী বকুনি ফিরে এসে। দিদির বাড়ি দল বেঁধে যাওয়া, ওই প্রথম ওর ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরোনো। হাতটা নিশপিশ করছে একটু স্টিয়ারিং উইলে ছোঁয়াতে।
সমস্ত দ্বিধা দ্দ্বন্দ্ব কাটিয়ে, লজ্জার মাথা খেয়ে লাবণ্য ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করলো। এখনও ট্র্যাফিক লাইট লাল হয়ে আছে। ২০০সেকেন্ড দেখাচ্ছে। কল লিস্ট থেকে অমিত রায়ের নম্বরটা বের করে সবুজ সিম্বলটা সোয়াইপ করেই ফেললো। অপরপ্রান্তে রিং হচ্ছে। "আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী"। বাবাঃ। বেশ চিজী ব্যাপার। ইশ, ভুল করলো না তো ফোনটা করে, ভাবছিল লাবণ্য। মনে হচ্ছিল কেটে দেয়। কিন্তু না। তাহলে উনি কল ব্যাক করবেন। আবার তখন কেনো ফোন করেছের সাথে সাথে কেনো কেটে দিলো, তার কারণ বলতে হবে। ধুর। কী যে করে ও। নিজের ওপর নিজেরই মাঝে মাঝে রাগ হয় লাবণ্যর। এত হঠকারী।
"বলুন ম্যাডাম।" সকালের সেই সুবক্তার ঝকঝকে কণ্ঠস্বরে লাবণ্য মুহূর্তে হকচকিয়ে গেলো। কী বলবে, ভাবছে। ইতিমধ্যেই ওই দিক থেকে "হ্যালো ম্যাডাম, বলুন" এসে গেলো। এবার তো উত্তর দিতেই হয়। একটু থতকে ও বললো, "আচ্ছা, বাই এনি চান্স আপনি কি এখন কলেজ মোড়ে রয়েছেন?" "হ্যাঁ। কী করে জানলেন? ও, বুঝেছি। আপনিও বুঝি ওখানেই? গাড়িটা দেখতে পেয়েছেন নিশ্চয়ই।" লাবণ্য মনে মনে হাসলো। যাক, বুদ্ধি আছে ভালোই। শুধুই বুকনি না। চোখ পড়ল সিগনালে। আর ৯০সেকেন্ড। বললো, "হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন। আসলে জ্যামের মধ্যে দেখতে পেলাম। ভাবছিলাম কোনদিকে যাচ্ছেন, যদি লিফ্ট..."
"আরে নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আপনার এড্রেস তো দেখেছিলাম গলফ গ্রীন। আমি যাদবপুরে থাকি। রাস্তা এক। কোনো অসুবিধে নেই। আসুন। দাঁড়ান, আপনার লোকেশনটা বলুন। আমি পৌঁছে যাচ্ছি।"
লাবণ্য হেসে বললো, "চায়ের ঝুপড়িটার ঠিক সামনে আছি। সাদা কুর্তি, নীল জিন্স। পিঠে ল্যাপটপ ব্যাগ। ডান হাতে ফোন। কানে লাল ইয়ারফোন।"
"ব্যস ব্যস, বুঝে গিয়েছি। দেখতেও পেয়ে গেলাম। আসছি। সিগ্নালটা খুলুক। চলে আসছি।"
লাবণ্য নিজেই নিজের এরকম প্রগল্ভ আচরণে অবাক। বুকটা কিঞ্চিৎ ধুকপুক করছে। কী বলবে, কীভাবে কথা শুরু করবে। সিগনাল সবুজ হতেই গাড়ির যেন ঢেউ আছড়ে পড়লো রাস্তায়। একের পর এক। সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। এরই মধ্যে ওর সিলভার স্যানট্রো এসে থামলো, ওরই সামনে। কাঁচ নামিয়ে দরজাটা খুলে নীল স্ট্রাইপ ফর্মাল শার্ট, চোখে সরু কালো ফ্রেমের চশমা পরা এক বছর তিরিশের সুদর্শন যুবক বললো, "উঠে পড়ুন দেখি, ঝটপট। আবার না সিগনালে আটকাই। অনেক কষ্টে লাল থেকে সবুজ হলাম।"
লাবণ্য সিটবেল্ট বেঁধে বসতে বসতে গাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে। মিউজিক প্লেয়ারে এফ এমে গান চলছে। প্রিয় স্টেশন। ঠিক যেমন ওর চলতো। আহ। কতদিন পরে যেন নিজের অনেক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলো, এমনটাই মনে হচ্ছিল লাবণ্যর। গাড়ির ইন্টিরিয়র এখনো পাল্টায়নি। এমনকি একই ফ্র্যাগরেন্সের এয়ার পিউরিফায়ার। আহা। তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিল লাবণ্য। দুজনেই চুপ। বাইপাস দিয়ে চলেছে গাড়ি। আনমনা হয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে লাবণ্য। ব্যস্ত শহর। সবাই ঘরে ফিরছে। রুবির মোড়ে পৌঁছে সম্বিৎ ফিরলো অমিতের কথায়, "আপনি কি এই রুটে এই সময়েই যাতায়াত করেন?"
"মোটামুটি। ওই পনেরো মিনিট, আধ ঘন্টা প্লাস মাইনাস। কেনো?" জিজ্ঞেস করে লাবণ্য।
"আসলে ভাবছিলাম যে, আমার অফিস ওই কলেজ মোড়ের সামনেই। আমিও এই রুটেই ফিরি। এই সময়। রোজ। তাই, আর কী। আমি রোজই লিফ্ট দিতেই পারি আপনাকে।" ঝকঝকে স্মার্ট অমিত বললেন। লাবণ্য চুপ। অমিত বলতে থাকলেন, " অবশ্য রোজ হয়তো দেখা হবে না। টাইম কি আর রোজ মেলে?"
লাবণ্য মনে মনে হাসছে। বেশ বুঝতে পারছে ব্যাপারটা। নেহাত মন্দও লাগছে না। তবুও কিছু বলে না। হাসে।
গাড়িটা যাদবপুর থানা কানেক্টরে সিগনালে আটকে আছে আবার। লাবণ্য বলে, "আমায় থানার ওখানে নামালেই হবে। বাস পেয়ে যাবো।"
অমিত বলেন, "আরে না না। তা কী করে হয়। আমি বাড়ি অবধিই পৌঁছে দেবো। ঠিকানাটা মনে নেই অবশ্য। আপনি ডিরেকশন দিন।"
লাবণ্য হেসে বলে "এরকম আরাম পেলে তো দেখছি রোজ টাইম মিলিয়ে নিতে হবে!"
অমিত হাসে। এই প্রথম যেন কী বলবে, বুঝে ওঠে না।
ট্রাফিকের লাল সিগনাল সবুজ হয়। সিলভার স্যানট্রো তার প্রাক্তন ও বর্তমান মালিককে নিয়ে ছুটতে থাকে বাইপাস কানেক্টর দিয়ে।
No comments:
Post a Comment