ডক্টর মুন্সীর চেম্বারে প্রায় ঘন্টাখানেক কাটিয়ে তুয়া যখন বাইরে এলো, শ্রীময়ী লক্ষ্য করলেন, এ যেন অন্য তুয়া। হাবেভাবে এই এক ঘন্টায়ই এসেছে অনেকটা সাহস, অনেকটা পরিবর্তন। ঝিমিয়ে থাকা, নিস্তেজ তুয়া যেন ঘুম ভেঙে উঠে এখন সকালের মতোই স্নিগ্ধ। শ্রীময়ী খুশি হন। এগিয়ে এসে তুয়ার কাছে গিয়ে বলেন, "কেমন এক্সপিরিয়েন্স?" তুয়া হেসে মাথা নেড়ে বলে, "ভালো। খুব ভালো। কয়েকটা ওষুধ দিলেন। বলেছেন আমি ঘুমোতে পারবো। ওইটা যদি সত্যিই হয়, আশা করছি হবে, জানেন ম্যাম, আমি নিশ্চিন্ত হই। কতদিন ঘুমোতে পারিনি।" শ্রীময়ী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বলেন, "উনি খুবই ভালো ডাক্তার। আমি নিজে বেনিফিটেড ওঁর চিকিৎসায়। তুমিও উপকার পাবেই। দেখো।" তুয়া একটু অবাক হয়েই তাকে শ্রীময়ীর দিকে। এই ঝকঝকে স্মার্ট, পাওয়ার উওম্যান শ্রীময়ী সরকারও সাইকিয়াট্রিক হেল্প নিয়েছেন, অকল্পনীয় তুয়ার কাছে। শ্রীময়ী তুয়ার চোখে মুখের প্রশ্ন দেখেই বুঝে যান। বলেন, "বলবো। সব বলবো। তা বলে চেম্বারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো না। চলো, লেকের ধারে যাই। যাবে তো? নাকি, চলো গঙ্গার ধারে যাই। হাওয়া খেয়ে আসি।" তুয়া সম্মতি জানায়।
অক্টোবরের শেষ। হেমন্ত কাল। শহর কলকাতায় এখনই ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। গঙ্গার ধারেও ভালোই হাওয়া। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। তুয়া আর শ্রীময়ী প্রায় ঘন্টা দেড়েক বসে আছে এখানে। এদিকটা একটু নিরিবিলি। সূর্য ডুবে গেল খানিক আগে। নৌকোগুলো সব ধীরে ধীরে ফিরে আসছে তীরে। দ্বিতীয় হুগলী সেতুতে আলো জ্বলে উঠেছে। হাওড়া ব্রিজেও গাড়ির ঢল নেমেছে। ব্যস্ত শহর। শুধু তার মধ্যে ঘাটের এই জায়গাটা বড্ড শান্ত। নিস্তরঙ্গ। শ্রীময়ী আজ মন খুলে গল্প করেছেন তুয়ার সাথে। নিজের ছোটবেলার কথা, স্কুলজীবনে মোটা হওয়ার কারণে বডি শেমিং এর কথা, কলেজ জীবনের ব্যর্থ প্রেমের কথা, তারই মধ্যে এমবিশনে অনড় থেকে নিজের পছন্দের সাবজেক্ট পড়া, কেরিয়ার গড়া। তারপর বাবা মায়ের ও পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ভালোবাসার প্রতি অবিচল থেকে বয়সে ছোট প্রেমিকের সাথে বিয়ে, তারপর চুটিয়ে সংসার করার গল্প। ইতিমধ্যে সন্তানলাভে অসুবিধে ও তার থেকে আসা অবসাদের কারণেই ডক্টর মুন্সীর শরণাপন্ন হওয়া। অবশেষে আই ভি এফ করে তিতলির মা হয়ে তবে যেন একটু থিতু হয়েছেন। কেরিয়ার ও ব্যক্তিগত জীবন, দুইয়েই খানিকটা স্টেবল।
শ্রীময়ী সমস্ত কথা তুয়াকে বলে বললেন, "দেখলে তো, সবার জীবনেই কোনো না কোনো ঝড় ঝাপটা আসে। আবার সঠিক প্রিকশন ও চিকিৎসা করলে, সেই অসুখও চলে যায়। জীবনে ঘুরে দাঁড়ানো যায়। আমি তোমায় আমার স্ট্রাগলের কথা বললাম। এরকম অনেক স্ট্রাগল অনেকেই করেন। এর চেয়ে বেশিও করেন। দুঃখ কম বেশি সকলের হয়। হয়তো অনেকে চেপে রেখে দেয়। তারপর তাদের সমস্ত শান্তি আনন্দ কুঁড়ে কুঁড়ে খায় সেই দুঃখ। ইউ আর লাকি তুয়া, সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। দেখবে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ও আদেশ মেনে চললে, ইউ উইল বি ফাইন ভেরি সুন মাই গার্ল। বাড়িতে এখানে আবোল তাবোল আছে?"
তুয়া হ্যাঁ বলে।
শ্রীময়ী বলেন, "আজ ৩০শে অক্টোবর। সুকুমার রায়ের জন্মদিন। আজকের দিনে এই এডভাইস নাও। মন খারাপ হলেই এই বইটা খুলে পড়বে। দেখবে, ইনস্ট্যান্ট মুড ভালো হয়ে যাবে। বুঝলে?"
তুয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
শ্রীময়ী বলতে থাকেন, "আর হ্যাঁ, এই বইটার ওপর একটা লেখা চাই। দেড় হাজার শব্দ। বাই মিড নেক্সট মান্থ। সাথে একটা এপ্লিকেশন দেবে। আমার অফিসে উইন্টার ব্রেকে ইন্টার্নশিপ করতে হবে তো, নাকি? ও হ্যাঁ, সিলেক্টেড হলে কিন্তু দুর্দান্ত একটা সুযোগ আছে। অফিসের পেড ট্রিপ। লন্ডনে। দুদিনের কাজ আর তিনদিন ঘুরে বেড়ানো। সাউন্ডস গুড?"
তুয়ার চোখে মুখে হাসি ফোটে। উত্তর দেয়, "টু গুড!"
শ্রীময়ী অন্য দিকে তাকিয়ে একবার চোখ মোছেন নিজের। মেয়েটাকে আজ অনেকদিন পর একটু যেন রিলিভড দেখছেন। যাক। ভালো থাকলেই ভালো।
No comments:
Post a Comment