Saturday, August 31, 2019

meeting at beach. vent out. mannat er samne. filmy dialogue. propose. pujoy bari fera

আলোতে আলো ঢাকা ৫

আরো একটা রবিবার। আজ আবার পৃথা আর উপমন্যু দেখা করবে। আজকের এজেন্ডা এমনিই পায়ে হেঁটে একটু বম্বে শহরটা ঘুরে বেড়ানো। তারপর কোথাও একটা ডিনার। এবং এই উদ্যোগটা পৃথারই নেওয়া। সত্যি বলতে কী, গত সপ্তাহে উপমন্যুর সাথে লাঞ্চটা মন্দ লাগেনি। আর পাঁচটা ছেলের থেকে একটু হলেও আলাদা লেগেছে ওকে। কথাবার্তা, হাব ভাব। অ্যাডভারটাইজিং জগত থেকে এসে এখন এক বিখ্যাত ইউটিউব চ্যানেলের স্ক্রিপ্ট রাইটার হয়ে বম্বে এসেছে। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। কাজের ব্যাপারেও বেশ প্যাশোনেট। ভালো লেগেছে পৃথার। নিজে প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। সারাদিন ওই হিসেব নিকেশের মধ্যে কেটে যায়। সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোও কেমন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। এই জন্যই আরো উপমন্যুর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে পৃথার। নিজের ভিতরের সৃজনসত্ত্বাটা যেন একটু সাথী পায়। এই এক সপ্তাহে প্রতিদিনই সন্ধ্যেয় অফিস ফেরতা অনেকক্ষণ চ্যাটে কথা হয়েছে দুজনের। একদিন তো ভয়স কলও হয়েছে। উইকেন্ডের প্ল্যান বানাতে গিয়ে নির্দ্বিধায় পৃথা উপমন্যুকে জিজ্ঞেস করেছে দেখা করার কথা। সেই কথোপকথনটিও ছিল খুব মজার। বৃহস্পতিবার, ক্যাবে বসে বসে পৃথা মেসেজ করছিলো উপমন্যুকে। "বন্ধু বান্ধব হলো অফিসে?" উপমন্যুর উত্তর এলো, " কলিগ কখনও তেমন বন্ধু হতে পারে না। তবে ওই আর কী, মারামারির পর্যায়ে পৌঁছইনি।"
পৃথাঃ মারামারি নাকি? আপনি বুঝি এত ভায়োলেন্ট?
উপমন্যুঃ এত বলতে?
পৃথাঃ এত বলতে, অফিস কলিগদের সাথে বন্ধুত্বের কথা জিজ্ঞেস করতে মারামারির প্রসঙ্গ আনলেন যে...
উপমন্যুঃ ও, তাই বলুন। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার মতো এমন নিরীহ একটা মানুষকে আপনি এরকম দুমদাম ভায়োলেন্ট বলে দিলেন...
পৃথা হাসির ইমোজি পাঠালো।
উপমন্যুঃ হাসলে হবে না। বলুন বলুন।
পৃথাঃ আমিও তো অবাক। আপনার মতো একজন... মনে তো হয় না একটা মশাও মারতে পারেন বলে।
উপমন্যুঃ একসাথে ২৫টা।
পৃথাঃ অ্যাঁ?
উপমন্যুঃ একসাথে ২৫টা মশা মেরেছি। রেকর্ড আছে।
পৃথাঃ ধ্যাত। বললেই হলো?
উপমন্যুঃ রনি বান্টি সাক্ষী।
পৃথাঃ তারা কারা?
উপমন্যুঃ আমার রুমমেট ছিল কলেজে।
পৃথাঃ বাই দ্য ওয়ে, আপনার কোন কলেজ?
উপমন্যুঃ জে এন ইউ। ইংলিশ অনার্স।
পৃথাঃ আই সি।
উপমন্যুঃ আপনি তো সেন্ট জেভিয়ারস। কমার্স।
পৃথাঃ রিসার্চ করে নিয়েছেন?
উপমন্যুঃ মোটামুটি। স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়। নানান মানুষের সাথে পরিচয় হওয়া ভালো। চরিত্রগুলো বানাতে সুবিধে হয়।
পৃথাঃ রিয়েলি?
উপমন্যুঃ আবার কী? এমনি এমনি কি ডেটিং অ্যাপে আছি নাকি?
পৃথাঃ ডেটিঙের জন্য অ্যাপে নেই?
উপমন্যুঃ এই বুড়ো বয়সে ওইসব চক্করে কে যায়? আমি তো স্রেফ রিসার্চ পারপাসে আছি।
পৃথাঃ হুম। বুঝলাম।
উপমন্যুঃ কী বুঝলেন?
পৃথাঃ কিছু না।
উপমন্যুঃ আপনি কি এখানে ডেট ফেটের জন্য এসেছেন নাকি?
পৃথাঃ ঠিক তা না...
উপমন্যুঃ তবে ঠিক কী?
পৃথাঃ উফ, আপনি বড্ড ইন্টারোগেট করেন।
উপমন্যুঃ ওই যে বললাম, রিসার্চ।
পৃথাঃ শুনুন।
উপমন্যুঃ বলুন?
পৃথাঃ রবিবার ফ্রি আছেন? দেখা করবেন? আপনার রিসার্চের সুবিধে হবে হয়তো।
উপমন্যুঃ দোহাই আপনার, আমার রিসার্চের নামে চালাবেন না। বলুন আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হয়েছে।
পৃথাঃ ওয়াট রাবিশ।
উপমন্যুঃ আহা, রাগ করছেন কেন।
পৃথা উত্তর দেয়নি। পরপর উপমন্যুর কয়েকটা মেসেজ আসতে লাগলো ফোনে। "ও কী, গেলেন কই?" "কী হলো? এ বাবা, রাগ করলেন? সরি সরি", ইত্যাদি। পৃথা সব মেসেজই দেখছে, কিন্তু উত্তর দিচ্ছেনা। রাগ কিন্তু মোটেই করেনি ও। বরং ধরা পড়ে যাওয়ায় মনে মনে একটু আনন্দও পাচ্ছে। তবুও উপমন্যুকে একটু মজা করে বিব্রত করতে ভারী আনন্দ হচ্ছে ওর। ও ঠিক করেছে, ঘণ্টা দুই পর রিপ্লাই দেবে। তার আগে না। দেখিই না, কতক্ষণ চেষ্টা করে যায়। ওর দিকটাও তো বুঝতে হবে।
আধ ঘণ্টা ধরে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে সমানে টুং টুং করে মেসেজ এসেই যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ একটা ভয়েস নোট এলো। কৌতূহলবশতই পৃথা প্লে করলো। উপমন্যুর গলা। গান গাইছে। "Jo dil mein hain hothon pe lana bhi mushkil
Magar usko dil mein chhupana bhi mushkil
Nazar ki zubaan se samajh jaiyega
Nazar ki zubaan se samajh jaiyega
Samajh kar zara gaur farmaiyega
Aji rooth kar ab kahan jaiyega
Jahan jaiyega hamein paiyega
Aji rooth kar ab"

এক তো এমন সুন্দর গান, তার ওপর অসামান্য কণ্ঠস্বর... পৃথা আর নিজেকে সামলাতে পারে না। মুচকি হাসি হেসে রিপ্লাই পাঠায় ছোট্ট করে, "জানা রইলো। গোঁসা করলে এমন ভালো গান শোনা যায়। রবিবার বিকেল পাঁচটায় আমায় পিক-আপ করবেন। লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।" 

   

Friday, August 30, 2019

আলোতে আলো ঢাকা ৪


চোখের ওপর বারবার চুলের গোছা এসে পড়ছে। পৃথা সমানে সেগুলিকে সরাচ্ছে। হাতের চুড়িগুলো রিনরিন করছে। বিরক্তির মধ্যেও ভালো লাগছে পৃথার। আজ বেশ সেজেগুজেই এসেছে। সাজতে খুবই ভালোবাসে পৃথা। তবে সোম থেকে শুক্র অফিসে বিজনেস ক্যাজ্যুয়ালের চক্করে পড়ে মনের মতো সাজগোজ হয়ে ওঠেনা। তাই আজ সুযোগ ছাড়েনি। একটা কলমকরি কাজের লম্বা হাতা ব্লাউজ দিয়ে সাদা লিনেনের শাড়ি পরেছে, সাথে মানানসই রূপোর গয়না। শ্যাম্পু করা চুলটা আলতো খোঁপায় বাঁধা। কপালে ছোট্ট টিপ। বেরোনোর আগে আয়নায় নিজেকে দেখে ভালোই লেগেছে। টুক করে একটা সেলফি তুলে ইন্সটাগ্রামেও দিয়ে দিয়েছে। সেই ছবিতে ইতিমধ্যেই ঝড়ের গতিতে লাইকের বন্যা বয়ে গিয়েছে। ওয়েটার ইতিমধ্যে চতুর্থ রাউন্ড মাটন বোটি কাবাব পরিবেশন গিয়েছে। পৃথা সর্বভুক হলেও স্বল্পাহারী। খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। উল্টোদিকে উপমন্যু পাক্কা খাদ্যরসিক। বিনা বিরতিতে দিব্যি সাঁটিয়েই চলেছে একের পর এক কাবাব। মেনু দেখে বলেছে এরপর নাকি বিরিয়ানিতে হামলা করবে। পারেও বটে। পৃথা ভাবে। ওই জন্যই একটা নাদুসনুদুস ভুঁড়িও রয়েছে। নীল জিন্স আর কালো শার্টের আড়ালে যাকে লোকানো যায়নি বিশেষ। পৃথা নিজে ছিপছিপে চেহারার। দিনের শুরুই হয় ওর যোগব্যায়াম দিয়ে। আনফিট লোকজন দেখলে খুব রাগ হয় ওর। নিজের শরীর, নিজে যত্ন না নিলে হয়? উপমন্যুকে দেখেও রাগ হওয়ার কথা। গোগ্রাসে খাচ্ছে। ভুঁড়িখানাও রয়েছে। কিন্তু কে জানে, কোন অদ্ভুত কারণে ওকে দেখে পৃথার খারাপ লাগছে না। হয়তো খাওয়াটাকে বড্ড ভালোবেসে খাচ্ছে বলে, নাকি? চোখে মুখের তৃপ্তি বুঝি স্বাস্থ্য অস্বাস্থ্য এইসবকে কয়েক গোলে হারিয়ে দিয়েছে? পৃথা নিজেই নিজের চিন্তায় অবাক হয়। উল্টোদিক থেকে উপমন্যুর কথায় খেয়াল পড়ে, "চুলটা বেঁধে নিন না। খাওয়াতে এত ব্যাঘাত ভালো নাকি?" পৃথা মুহূর্তের জন্য খাওয়া থামিয়ে ফেলে। তারপর মুচকি হেসে ফেলে। এত সেজেগুজে আসা, অন্তত উল্টোদিকের মানুষটি সামান্য কমপ্লিমেন্ট তো দিতে পারতো। কমপ্লিমেন্ট তো দেয়ইনি একবারও। উল্টে এই উপদেশ? সত্যি। এই ছেলে পৃথার পরিচিত অন্য ছেলেদের থেকে একটু হলেও আলাদা। ও পাশে রাখা টিস্যুতে হাতটা মোছে। চুলটা বেঁধেই নেবে টাইট করে। এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ঋষির নাম। পৃথা বিরক্ত হয়। হাতটা নিশপিশ করে লাল আইকনে স্লাইড করতে। নিজেকে সংযত রাখে। ফোনটা ভাইব্রেট হতে হতে থেমে যায়। খোঁপা বাঁধার কথা পৃথা ভুলে যায়। উপমন্যুকে বলে মেন কোর্সের দিকে এগিয়ে যায়।

পাতে এক হাতা ওয়াইট রাইস, ইয়েলো ডাল আর মাংস নিয়ে ফিরে আসে টেবিলে। উপমন্যু ওকে দেখে বলে, "আপনার ফোনটা আবার বাজছিল।" পৃথা থালা রেখে একবার ফোনের দিকে তাকায়। দেখে ঋষির নম্বর। ও কিছু বলে না। খাওয়াতে মন দেয়। উপমন্যু ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। পরিস্থিতি হাল্কা করতে কি কে জানে, বলে, "এত অল্প খেয়ে এই রেস্টুরেন্টগুলোর লাভ বাড়াচ্ছেন কেন?" পৃথা কিছু বলে না। একটু হাসে। উপমন্যু বলতে থাকে, "আমি যাই। ভালো করে ঘুরে ফিরে মেন কোর্স কী আছে দেখি। প্লেটটা ভরে আনি। আপনি বরং ততক্ষণ ফোনটা রিসিভ করুন। নিন। আবার কল করছে ঋষিকুমার। দেখুন দেখুন। এতবার করছে, নিশ্চয়ই খুব দরকারি। কথা বলে নিন। আমি এখানে এক্ষুণি ফিরছি না। আপনি নির্দ্বিধায় কথা বলুন।" এই বলে উপমন্যু এগিয়ে যায় মেন কোর্সের দিকে। পৃথা খাওয়া ছেড়ে তাকিয়ে থাকে পাশে রাখা ফোনটার দিকে। নাহ। ধরবে ও না। যত ইচ্ছে ফোন করুক। শুনবে না। আবার ঠকবে না। ও জানে, ঋষি দুটো মিষ্টি করে কথা বলবে, আর পৃথা আবার গলে যাবে। উঁহু। এ হতে পারে না। পৃথাকে নিজেকে বাঁচাতেই হবে। ফোন ও ধরবে না।

Thursday, August 29, 2019

আলোতে আলো ঢাকা ৩

"আপনি কি বরাবরই ফোন এলে বা মেসেজ এলে এমন অন্যমনস্ক হয়ে যান?" উপমন্যুর প্রশ্নে অবাক হয়ে ফোন থেকে মুখ তুলে দেখলো পৃথা। বিস্ময় প্রকাশ করেই ও জিজ্ঞেস করলো, "মানে?" উপমন্যু হাসলো। কিছু বললো না। ইতিমধ্যে একজন ওয়েটার এসে ওদের টেবিলে ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে তরমুজের জ্যুস রেখে গেল। আরেকজন এসে স্টার্টারের প্রথম রাউন্ডের মাছ মাংসের কাবাব এনে রাখলো। উপমন্যু জ্যুসের গ্লাসটা তুলে পৃথার দিকে তাকিয়ে বললো, "উল্লাস।" পৃথাও নিজের গ্লাসটা উপমন্যুর গ্লাসে ঠেকিয়ে নামাতে যাচ্ছিল, উপমন্যু বাঁ হাত দিয়ে পৃথার ডান হাতটা চেপে ধরে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো, "আরে আরে। রাখবেন না। রাখবেন না। এক চুমুক খান। তারপর নামিয়ে রাখবেন। উল্লাস বলে গ্লাস নামাতে নেই।" পৃথা এমন অপরিকল্পিত ঘটনায় খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে জ্যুসের গ্লাস থেকে এক চুমুক জ্যুস খেয়ে নামিয়ে রাখলো গ্লাস। উপমন্যু ইতিমধ্যে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। এবং দুই হাতে কাঁটা চামচ ছুরি সব সহযোগে মনের সুখে কাবাবে মন দিয়েছে। পৃথা কী দিয়ে শুরু করবে, বুঝে উঠতে পারে না। একটু এদিক ওদিক করছে দেখে উপমন্যু বলে, "ফিশ দিয়ে শুরু করুন। মেছো বাঙালি আফটার অল। ওটাই বেস্ট লাগলো।" পৃথা উত্তর দেয়না। কিন্তু ফিশ অমৃৎসরী দিয়েই খাওয়া শুরু করে। মুখে এক টুকরো পুরে বোঝে, সত্যিই বড় সুস্বাদু। "কী, ভালো না?" পৃথার হাসিমুখ দেখে উপমন্যু প্রশ্ন করে। পৃথা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। তারপর উপমন্যুকে জিজ্ঞেস করে, "তখন কিছু একটা বলছিলেন। ওয়েটার চলে এলো। কথা থেমে গেলো।" উপমন্যু খাওয়া থামিয়ে খানিক ভাবে। তারপর মাথা নেড়ে বলে, "ও কিছু না। খান খান। নেক্সট আইটেম আনতে বলি? নাকি এটার রিপিট?" পৃথা উত্তর দেয়, "নেক্সটটাই বলুন। কিন্তু কিছু না বললে তো হবে না। বলুন, তখন কী বলছিলেন ফোন নিয়ে।" উপমন্যু বলে, "আরে, বললাম তো। কিছু না। যেই জন্য আজ এখানে আসা, সেটাতেই বরং মন দিই?" পৃথা একটু ক্ষুণ্ন হয়। ফোন মেসেজ অন্যমনস্ক কী বলছিল। কেন। যাক গে, বলতে না চাইলে আর কীই বা করতে পারে, এই ভেবে ও খাওয়াতে মন দেয়। ঠিকই তো। উপমন্যুর সাথে এই লাঞ্চ প্ল্যানটা তো ভালো মন্দ খাবে বলেই। গোড়া থেকেই বলি তাহলে।
সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরেই ফেসবুকে উপমন্যু রায় চৌধুরী নামে সার্চ দেয় পৃথা। তিনটে প্রোফাইল আসে। প্রত্যেকটিতে গিয়ে ঢুঁ মেরে হতাশ হয়। একটাও যে ওর সহযাত্রীর না। কে জানে, হয়তো কোন ট্যাশ নামে আছে। একটু দমে যায় পৃথা। কিন্তু হাজার ব্যস্ততার মধ্যে আর মনে পড়ে না। নতুন শহর। নতুন চাকরি। এইসবের মধ্যেই কেটে যায় এক সপ্তাহ। উইকেন্ডে অফিস নেই। সারাদিন কী করবে, ভেবে পায় না। শনিবার সারা সকাল ঘরদোর গুছিয়ে বাজারহাট করে মোটামুটি কেটে গেলেও সন্ধ্যে থেকে কাঠ বেকার। পৃথা বরাবরই খুব মিশুকে। আর তাই যে কোনো জায়গায় বন্ধু পাতিয়ে ফেলে। সেই জন্যই কখনো একা সময় কাটায়নি স্বেচ্ছাতে। আর এখন তো আরোই কষ্ট হচ্ছে। মন কেমন করছে। কলকাতার জন্য। ঋষির জন্য। বন্ধুও খুব একটা এখনো এত তাড়াতাড়ি হয়নি যে উইকেন্ডে প্ল্যান করবে। প্রিয় বান্ধবী সুদেষ্ণাকে ফোন করলো পৃথা। এদিক ওদিক কথা প্রসঙ্গে শেষমেশ ঋষির কথা সেই উঠলোই। জানতে পারলো, সামনের মাঘেই ঋষির বিয়ে। এতক্ষণে সেদিন ঋষির "প্লিজ একবার ফোন ধরো, কথা আছে" লেখা মেসেজের মানে বোঝে পৃথা। মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। যতই ঋষি ওকে ঠকাক, ভালো তো বেসেছিলো পৃথা ওকে। আর তাই সুদেষ্ণার কাছে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে ও। সুদেষ্ণা বিহ্বল হয়ে যায়। কীভাবে বন্ধুকে সামলাবে, বোঝে না। শনিবার রাতটা ঘুমোতে পারে না পৃথা। সারা রাত ছটফট করতে থাকে। বিছানায় শুয়ে একবার এপাশ একবার ওপাশ। শেষমেশ ভোর রাত্রির দিকে প্লে স্টোর থেকে ডেটিং app নামায়। নিজের প্রোফাইল বানায়। বেশ ঝকঝকে আকর্ষণীয় করে। তারপর এলোমেলো করে একটার পর একটা ছেলের ছবি আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দেখতে থাকে। ধুর। একটা কারুর প্রোফাইলে গিয়ে একটুও মনে ধরলো না। প্রেম তো দূর অস্ত, সামান্য কথোপকথনের যোগ্যও কাউকে লাগলো না। আরো বিরক্তি ধরে গেল ওর। ফোনটা নামিয়ে রাখবে, এমন সময় চোখ আটকে গেলো স্ক্রিনে। আরে, এ যে সহযাত্রী। উপমন্যু রায় চৌধুরী। বয়স একত্রিশ। পেশায় কপিরাইটার। সেপিওসেক্সুয়াল। খাদ্যরসিক। বিড়াল ভালোবাসে। হুম। ইন্টারেস্টিং। মনে মনে ভাবে পৃথা। একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। কিছু না হোক, অজানা শহরে একজন চেনা জানা বাঙালি তো হবে। রাইট সোয়াইপ করেই দেয় পৃথা। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নোটিফিকেশন আসে, "ম্যাচ"। শুরু হয় চ্যাটে কথাবার্তা। আর সেই থেকেই ঠিক হয় পরেরদিন, অর্থাৎ আজকের এই লাঞ্চ প্ল্যান।

Wednesday, August 28, 2019

আলোতে আলো ঢাকা ২

বারবার পৃথার চোখ চলে যাচ্ছিল সহযাত্রীর দিকে। কে এ? এত চেনা, অথচ মনে পড়ছে না। খুব অস্বস্তি হতে থাকে। ট্রেনও না যে নেমে রিজার্ভেশন চার্ট দেখে নেবে। কী মুশকিল। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে পৃথা ভাবতে থাকে। ইনি কি কোনো সেলিব্রিটি? বম্বের ফ্লাইট। হতেই পারে। অভিনেতা? নাঃ। তবে? গায়ক? জার্নালিস্ট? টিভিতে দেখেছে? ক্রিকেট প্লেয়ার? ধুত্তেরি। নির্ঘাত ফেসবুকে কারুর না কারুর প্রোফাইলে দেখেছে। কে জানে? এইসব ভাবছে, এমন সময় শুনতে পেল পাশ থেকে, "কিছু বলবেন?" পৃথা চমকে গেল। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই বললো, "আমায় বলছেন?" সহযাত্রী মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল, "হুম। আপনাকেই। আপনি কি কিছু বলবেন?" পৃথা কোনোমতে মাথা নেড়ে বলে, "না। মানে। কেন বলুন তো?" সহযাত্রী উত্তর দেয়, "মনে হলো। যাক গে। আমার মনের ভুল হতেই পারে। সরি।" পৃথা কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই পাশেরজন ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আচ্ছা লোক তো, কথা শুরু করে শেষ না করেই চুপ। উফ। এই জন্যই বাঙালি পুরুষগুলোকে দেখলেই পৃথার গা পিত্তি জ্বলে আজকাল। ও নিজে ট্যাব খুলে বইয়ে মন দিলো। কিন্তু মন আর লাগে কই? সমানে খচখচ করে যেতে লাগলো। নির্ঘাত সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখেছে। পৃথা এর তার প্রোফাইল ঘাঁটতে ওস্তাদ। সেই করতে গিয়েই দেখেছে হয়তো। প্লেনের ভিতর যে কেন ইন্টারনেট নেই? যতক্ষণ না প্লেন টাচডাউন করছে, এই অস্বস্তি চলতেই থাকবে। ধুর। বিরক্ত হয়ে ও ও ইয়ারফোনে গুঁজে অডিও স্টোরি শুনতে থাকে। শুনতে শুনতে কখন কে জানে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙে ল্যান্ডিংয়ের বার্তা শুনে। বাবাঃ, আড়াই ঘণ্টা কেটে গেল কীরকম।
প্লেন ল্যান্ড করতেই সকলের মধ্যে একটা হুড়মুড় করার প্রবণতা দেখা যায়। যেন এক্ষুণি না উঠলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আজকেও হলো তাই। লোকজন সামনে পিছন থেকে ঠ্যালাঠেলি হুড়োহুড়ি করে ধাক্কাধাক্কি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। পৃথা বিরক্তিসূচক মুখ করে মাথাটা নাড়লো। ফোনে একটার পর একটা মেসেজ ঢুকছে। সবই ওই সার্ভিস প্রোভাইডারের। বাড়িতে একটা মেসেজ করে দিলো পৃথা। 'জাস্ট ল্যান্ডেড'। ভিড়টা এবার কমেছে। লোকজন নাম শুরু করেছে। সহযাত্রীও নিজের লাগেজ নামালো। পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো ওরটা নামিয়ে দেবে কি না। পৃথা 'শিভালরি' দেখে ঈষৎ খুশি হলো। হালকা হাসি মেখে দেখিয়ে দিল নিজের ব্যাকপ্যাক। প্লেনের দরজায় পৌঁছলো ওরা দুজনেই, একসাথে। সহযাত্রী বললো, "তাহলে, বিদায় বন্ধু। ও, আমার নাম বলা হলো না। আপনার নামও জানা হলো না। আমি উপমন্যু। উপমন্যু রায়চৌধুরী। আপনি?" পৃথা উত্তর দিতে যাবে, এমন সময় ফোনে টুংটুং করে মেসেজ ঢুকলো। প্রেরকের নাম দেখে খানিক অবাক হলো ও। ঋষি।

আলোতে আলো ঢাকা ১

প্লেনটা টেক অফ করবে যে কোনো মুহূর্তে। বিমানসেবিকারা যে যার নিজের জায়গায় বসে আছে। জানলার ধারে মাথা এলিয়ে পৃথা বাইরে তাকিয়ে আছে। এই এতদিনের ভালোবাসার শহর, পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব...সকলকে ছেড়ে বম্বে পাড়ি দেওয়া। তাও আবার পুজোর যখন এক মাস বাকি, তখন। একদম ভালো লাগছে না। মনটা বারবার ফিরে যাচ্ছে ওদের হাউজিঙ কমপ্লেক্সে। ইশ, আজ নিশ্চয়ই কোর কমিটির মিটিং রয়েছে। মা হয়তো সেখানে গিয়েওছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট বলে কথা। তা ছাড়া মেয়ে চলে গেল, সেই মন খারাপ কাটাতেও যাবে। এইসব মিটিং পৃথার খুব পছন্দের ছিল। বেশ গুরুগম্ভীর আলাপ আলোচনার পর আসতো মিটিংয়ের আসল আকর্ষণ। ইটিঙ। গরম গরম ফিশ ফ্রাই, ছানার জিলিপি আর কফি। নাঃ, আর ভাববে না। পৃথা ঠিক করে। এই চাকরির সিদ্ধান্ত ও নিজেই নিয়েছে। খানিকটা বাড়ির অমতেই। কাজেই এখন আর ফিরবার কোনো গল্প নেই। আসলে, কলকাতায় বড্ড হাঁপিয়ে উঠছিল পৃথা। যতই পছন্দের চাকরি থাকুক না কেন, মধ্যে মধ্যেই ঋষির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ঋষি, ওর প্রাক্তন। দশ বছরের সম্পর্কের পর যে ছেলের একবারও বাধেনি ওকে চিট করতে, চাকরিক্ষেত্রে সুবিধে পাবে বলে বসের মেয়ের সাথে নতুন সম্পর্কে জড়াতে। পৃথা নিজেকে বারবার বুঝিয়েছে। যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। ঋষি ওর জন্য ঠিক না। সম্পর্কটা নেই, তাতে পৃথাই বেঁচে গিয়েছে। অনেকটা সময় পৃথা মেনেও নেয়। শুধু বাঁধ সাধে কোনো বর্ষার দিনে, সিসিডির সামনে। বা বাস স্টপে ছাতা ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা কোনো যুগলকে দেখে। বা ধর্মতলার রাস্তায় ফুটপাথ।দিয়ে হাত ধরে হেঁটে যাওয়া কোনো দম্পতিকে দেখে। বা ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়ি আটকে আছে। হঠাৎ চোখে পড়ে বাঁদিকে সেই চিরপরিচিত লাল আই টেনে ঋষি। পাশে বসে মেঘনা। আর তখনই পৃথা আরো জোর দিয়ে চাকরি খোঁজে কলকাতার বাইরে।
প্লেনটা টেক অফ করে নিয়েছে। এখন সন্ধ্যের কলকাতার আকাশের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। নীচে জ্বলজ্বল করছে আলোর শহর। তবে আলোগুলো কি একটু বেশিই মিটমিট করছে? কিছু কি সিগনাল দিচ্ছে পৃথাকে? কে জানে। বোঝার চেষ্টা করে পৃথা। সম্বিৎ ফেরে সহযাত্রীর ডাকে। "এক্সকিউজ মি, আপনাকে ডাকছেন।" পৃথা চমকে তাকায়। বিমানসেবিকা ট্রেতে করে ইতিমধ্যেই গরম গরম খাবার এনে রেখেছে। পৃথার দিকে এগিয়ে দেয়। বিমানসেবিকা এগিয়ে যায় সামনের সিটের দিকে। পৃথা সহযাত্রীর দিকে এতক্ষণে তাকায়। মৃদু হেসে থ্যাংক ইউ বলে। বছর তিরিশ বত্রিশের এক ছেলে। চোখে চশমা। হালকা দাড়ি গোঁফ। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগে পৃথার। কিন্তু মনে করতে পারে না। কোথায় দেখেছে, কোথাও কি আদৌ দেখেছে?

Saturday, August 24, 2019

আজও ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঢাকুরিয়া লেকের ধারে মর্নিং ওয়াকারদের ভিড় হয়েছে। মহারাণীর কচুরি জিলিপি আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে সাথে এফ এম রেডিওতে প্রিয় জকির কণ্ঠস্বরের সাথে ঘুম ভেঙ্গেছে হাজার হাজার মানুষের। সকাল নটায় ছাতামাথায় বৃষ্টির জল কাদা কাটিয়ে এইট বি বাস স্ট্যান্ডের লাইনে দাঁড়িয়েছে বহু নিত্যযাত্রী। রাস্তার ধারে ঝুপড়ি হোটেলগুলিতে শাকভাতের ডিমান্ড আজও একইরকম। হাসপাতালের আউটডোরেও সমান ভিড় উপচে পড়ছে। শপিং মল- হাতিবাগান সেজে রয়েছে পুজোর পসরা নিয়ে। সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারের সামনে আজও ব্ল্যাকে বিক্রি হবে বিনোদন। তারপর সন্ধ্যে হবে। বৃষ্টি নামবে শহরে। টানা রিকশাওয়ালা খইনি ডলতে ডলতে অপেক্ষা করবে সওয়ারীর। পাঁচ মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে নেতাজীর সাথে ভিজবে সাদা ট্রাফিক পুলিশ। হলুদ-কালো ট্যাক্সি হর্ন বাজাবে জ্যামের রাস্তায়। রাতজাগা পাখীরা বাসায় ফিরবে না আজও। আরো একটা দিন এমনি করেই কেটে যাবে কলকাতায়। শুধু বলা হবে না প্রিয় শহরকে, "ভালোবাসি তোমায়"।

জন্মদিনে এক রাশ শুভেচ্ছা কল্লোলিনীকে।

Friday, August 23, 2019

হৃদয়পুর ১০

হাসপাতালের একটা কোণে ভিজিটার্স বেঞ্চের একদিকে মোহর আর সৃজনী চুপ করে বসে থাকে। তুষার রিসেপশনে গিয়ে কথাবার্তা বলে ওদের কাছে এসে বলে, " বললো ওকে বেডেই রেখেছে এখনও। কিছু পেপারওয়ার্ক বাকি। সেইসব ফর্মালিটি সেরে তবে ওকে ছাড়বে। সৃজনী মুখ তুলে একবার তুষারের দিকে চাইলো। তুষার মোহরকে বললো, "তুমি কি একবার ওকে দেখবে?" মোহর ডুকরে কেঁদে উঠলো। বললো, "না। কী দেখবো? আমার এইসব একদম ভালো লাগেনা। ভালো স্মৃতিটুকুই থাকুক।" সৃজনী ওর কাঁধটা চেপে ধরে বলে, "মোহর, সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু শেষবারের মতো দেখার এই তো সুযোগ। না গেলে পরে তোর আফসোস হবে দেখিস।" মোহর তবুও রাজি হয় না। সৃজনী যেন একটু বিরক্ত বোধ করে। বলে, "যা বলছি শোন। এতে তোরই ভালো হবে। পরে নইলে হাপিত্যেশ করতে হবে তোকে।" মোহর একটু অবাক হয় বন্ধুর এই ব্যবহারে। কিন্তু কিছুই বলে না। তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে, "ঠিক আছে তুষার। কোথায় রেখেছে প্রমিতকে, বলো। আমি দেখে আসি।" তুষার মোহরকে নিয়ে এগিয়ে যায়। ফার্স্ট ফ্লোরের এমার্জেন্সী করিডোরের শেষ প্রান্তে যেখানে কেবিন শুরু হয়েছে, ওইদিকে। গোটা হাসপাতালে ডিসিনফেকটেন্টের গন্ধ। মোহরের গা গুলিয়ে ওঠে। মাথা হালকা লাগে। দেওয়াল ধরে ধরে ও এগিয়ে যায়। নির্দিষ্ট দরজার সামনে। তুষার আর আসেনি। সৃজনী এক রয়েছে, এই বলে ও নীচে চলে গিয়েছে। কাকু কাকীমাকে ফোনে চেষ্টা করতে হবে আবার। মুহূর্তের জন্য মোহর থমকে দাঁড়ায়। তারপর সাহস করে দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।
কনকনে ঠান্ডা ঘর। সাদা দেওয়াল, সাদা মেঝে। ঝকঝকে তকতকে। মধ্যিখানে সাদা বেডের ওপর সাদা চাদর ঢাকা একজন। এই তবে প্রমিত? মোহর আস্তে আস্তে পা ঘষে ঘষে এগিয়ে যায়। বিছানার পাশে রাখা চেয়ার টেনে বসে। একবার তাকায়। কিন্তু ওই দৃশ্য দেখতে পারবেনা বলে চাদরটা তৎক্ষণাৎ টেনে ঢেকে ফেলে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদতে থাকে। শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে ওর। বারবার মনে পড়তে থাকে প্রমিতের মুখ। বারান্দা থেকে দেখা, শেষবারের মতো। বাইক নিয়ে বেরোচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় মোহর বলতে থাকে, "আই এম সরি প্রমিত। সেদিন তোমার সাথে একটু বেশিই রুড বিহেভ করেছিলাম। ক্ষমাও চাওয়া হয়নি। তার মধ্যে এরকম হলো। কেন করলে এরকম? একটু দেখেশুনে বাইক চালাতে পারো না? দুচক্ষে দেখতে পারিনা আমি এই বাইক। প্রমিত, কাকু কাকীমার কী হবে বলো তো? ঠাকুরের বায়না দিতে গিয়ে বাড়ি ফিরে এই খবর শুনবে? প্রমিত... ভেবেছিলাম সব ভুলে নতুন করে চেষ্টা করবো, বন্ধু হবো। হবো..."
একটা নরম হাতের স্পর্শ কাঁধে টের পেয়ে মোহর চমকে উঠে পাশ ফেরে। এ কী। এ কী দেখছে ও? হলুদ টিশার্টে প্রমিত? চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মুখে এক গাল হাসি। মোহরকে চমকে দিয়ে বললো, "ভয় নেই। আমি ভূত নই। আমি প্রমিতই। জ্যান্ত আছি। মরিনি। অত সহজে রেহাই দেবো না।" মোহরের বিস্ময়ের সীমা ধরে না। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রমিতের দিকে। বিশ্বাস করতে পারছে না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে, পুরো। ইতিমধ্যে ঘরে প্রবেশ করে তুষার আর সৃজনী। দুজনেই ফিকফিক করে হাসছে। ওদের কথা থেকে মোহর জানতে পারে, পুরোটাই প্রমিতের প্ল্যান। প্ল্যান সাগরেদ সৃজনী। তুষার বলে, "দেখো মোহর। আমি কিন্তু শুরুতে কিচ্ছু জানতাম না। অনেক পরে সৃজনী আমায় বলেছে। আমি বারণ করেছিলাম। এইরকম শক থেরাপি দিতে। ওরা শোনেনি।" সৃজনী তুষারের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, "শোনো, এই দেওর বৌদির শোক থেরাপি না হলে কী আর নায়িকা মচকাতো? মাঝে মাঝে এইসব শোক ও শক, দুইয়েরই দরকার। মনের ভিতরের কথাটা বোঝার জন্য, জানার জন্য। বলো তোমরা, এটা না হলে মোহর রানী কি কখনোই বুঝতে পারত যে মনের ভিতরে একজন কবেই এমন স্থায়ী আসন পেতে নিয়েছে?" মোহর এখনও অপ্রস্তুত হয়েই রয়েছে। কিছু বলছে না। সৃজনী ওকে হালকা টোকা মেরে বলে, "দেখ বাপু, এইসব আইডিয়া মেইনলি প্রমিতের। এর মধ্যে একদিন এসে বললো, তোকে ভালোবাসে। তোর মনের খবর কী করে জানা যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে এই প্ল্যান। নার্সিং হোমের দুজন ডাক্তার ওদের স্কুলের ক্লাসমেট। সব প্ল্যান হলো। আমি অভিনয় করে গেলাম। তুইও ভালোই প্ল্যানমতই চললি, মানে যেমনটা আমরা ভেবেছিলাম। গোটা ব্যাপারটাই স্মুদ।" মোহর আর একটা কথাও না বলে গটগট করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চোখ মুখ লাল।
অদ্ভুত দোটানায় ভুগছে। নিজের মনের খবর শেষমেশ এরকম ভাবে ওকে পেতে হবে, ভাবতে পারেনি মোহর।
কান্না পাচ্ছে ওর। এরকম ভাবে ওর অনুভূতিকে বাজি ধরে এত সিরিয়াস একটা বিষয়ে এরকম নাটক করতে পারলো ওরা?
হাসপাতালের বাইরে এসে পড়েছে। এইবার একটা অটো নিয়ে ফিরে যাবে বাড়ি। ছেড়ে চলে যাবে ও হৃদয়পুর। ওকে দেখে একটা অটো এসে দাঁড়ায়। "দাদা, নতুন বাজারের মোড় চলুন" বলে ও ভিতরে বসতে যায়, এমন সময় শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে প্রমিত। "প্লিজ, প্লিজ মোহর। যেয়ো না। আই ইনসিস্ট।" মোহর থমকে যায়। এ কী হচ্ছে ওর সাথে। মন চাইছে এক, আর ও করছে আরেক? কেন প্রমিতের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ও চলে যাচ্ছে না? নাকি ওই যেতে চাইছে না? মোহর স্থির হয়ে থাকে। প্রমিত ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলে, "আমি জানি মোহর, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই যে, সৃজনী বললো না? এইটা না হলে আমরা দুজনেই অনেককিছু বুঝতাম না। আই এম এক্সট্রিমলি সরি মৌ। প্লিজ ফরগিভ মি।" মোহরের দু চোখ জ্বালা করছে। যে কোনো মুহূর্তে কুল ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। প্রমিতের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, "আর কোনদিনও যদি এরকম করো না, দেখবে, ডিভোর্স দিয়ে দেবো!" প্রমিত হেসে ফেলে। বলে, "বিয়ের প্রস্তাব শোনার আগেই ডিভোর্স?" এইবার মোহর কান্না হাসি মিলিয়ে উত্তর দেয়, "এত কিছুর পর বিয়েটা না করলে আস্ত থাকবে ভেবেছো? জনাব, ইশকবাজি ম্যায় হাম ভি কুছ কম নহি।"
প্রমিত মোহরকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে। আঃ, কী আরাম এই স্পর্শে। কী ভরসার জায়গা।

(ক্যামেরা জুম আউট করতে থাকে। অটোওয়ালা, পেশেন্ট পার্টি, রাস্তার গাড়ি বাস সব ফেড হতে থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে শাহরুখ এসে ম্যান্ডলিন বাজিয়ে যায়। শনশনে হাওয়া বইতে থাকে। সেই হাওয়ায় মোহরের চুল উড়তে থাকে। প্রমিত আর মোহর একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর গভীর আদরে একে অপরের ঠোঁটের ওপর ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। ঠিক যেন যব উই মেট সিনেমার শেষ দৃশ্য। যাক, সব ভালো যার শেষ ভালো তার।)

Thursday, August 22, 2019

হৃদয়পুর ৯

ফোন ছেড়ে মোহর খানিক চুপ করে বসে রইলো। এক্সিডেন্ট? এমন কী হলো যে সব শেষ? সৃজনীর কথাটা বিশ্বাস হয়না মোহরের। ও আরো একবার ফোন করে সৃজনীকে। সৃজনী ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, "বললি কাকু কাকীমাকে? আমরা আসছি। দু মিনিটে রওনা দিচ্ছি।" মোহর কিচ্ছু বলতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে ফোনে। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ, এই তো এক্ষুণি বেরোলো বাইক নিয়ে, যাওয়ার আগে চোখাচুখি হলো... আর এই এত অল্প সময়ের মধ্যেই সে আর নেই? হেলমেট পরেছিল। তাও কী করে এমন হলো? এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। বিশ্বাস হয়না মোহরের। এখনো কত কথা বলা বাকি ছিল ওর প্রমিতকে। এরকমভাবে প্রমিত ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারে না। ফোনের অপর প্রান্তে সৃজনীর "হ্যালো, হ্যালো মোহর? দেখ, ব্যাপারটা ভীষণ শকিং। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। শক্ত হ। কাকু আর মাসীমাকে সামলাতে হবে তো তোকেই। আমরা এই দশ পনেরো মিনিটে আসছি।" মোহর কাঁদতে কাঁদতে বলে, "আমি ঘরে আছি। তোরা খবর দিবি। আমি মোটেই পারবো না এই কথাগুলো কাকীমাকে বলতে। অসম্ভব।" সৃজনী নাক টেনে বলে, "আচ্ছা ঠিক আছে। বলতে হবে না। তুষার বলবে। তুই শান্ত হ।" শান্ত কি আর হওয়া যায়? মোহর তবুও কাঁদতেই থাকে। সৃজনী ফোন ছেড়ে দেয়। ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় কলিং বেলের শব্দ শোনে। বার দুয়েক বেল বাজে। কী হলো, গেল কোথায় সব? কেউ দরজা খুলছে না যে। কাকীমা, কাকু, কাজের লোকজন, কেউ কোথাও নেই নাকি? এই তো আধ ঘন্টা আগেও কলকল কলকল শুনছিলো লোকজনের। মোহর তিনতলা থেকে নিচে নেমে দরজা খোলে। দেখে মুখ ভার করে সৃজনী আর তুষার দাঁড়িয়ে। সৃজনী ওকে দেখে জিজ্ঞেস করে, "হ্যাঁ রে, কোথায় সবাই?" মোহর মাথা নাড়ে। বলে, "জানি না। বাড়ি নেই মনে হচ্ছে।" সৃজনী মোহরের দিকে তাকায়। মায়া হয়। এইটুকু সময়েই মেয়েটা কেঁদেকেটে একশা। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে সৃজনী আর তুষার। মোহর ওদের উল্টোদিকে বসে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মোহরের দুই চোখ দিয়ে সমানে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। মাথা নিচু। সৃজনী উঠে গিয়ে মোহরের পাশে বসে ওর কাঁধে হাত দেয়। মোহর মুখ তুলে বন্ধুর দিকে তাকায়। কাঁদতে কাঁদতে মোহরের দু চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। ও বলে, "এটা কী হলো সৃজনী? এরকমভাবে কী করে চলে গেল প্রমিত? সব আমার দোষ। সব।" সৃজনী মোহরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, "অমন বলে না মোহর। তোর কোনো দোষ নেই। তুই কোত্থেকে এলি এতে?" মোহর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, "আমি সেদিন দুর্ব্যবহার করেছিলাম ওর সাথে। ক্ষমাও চাওয়া হয়নি। নির্ঘাত ওই নিয়েই চিন্তা করতে করতে বাইক চালাচ্ছিল। আর তাই এমন হলো। কান্ট ফরগিভ মাইসেলফ সৃজনী। ইটস অল বিকজ অফ মি। হে ডাইড বিকজ অফ মি। কত কথা বলার ছিল ওকে। মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি, আই হ্যাড টু এপলোজাইস।" সৃজনী উত্তরে চুপ থাকে। কিচ্ছু বলতে পারে না। কিছু বলার নেই এই সময়ে। তুষার একবার গলা খাকরি দিয়ে বলে, "আই থিংক উই শুড লিভ নাউ। হসপিটালে গিয়ে ফর্মালিটিজ আছে অনেক। কাকু মাসীমা কোথায় গেছেন, জানি না। ফোনে ট্রাই করছি। তবে যেতে যেতে। মোহর তুমি রেডি হয়ে নাও।" মোহরের ইচ্ছে করে না। তবুও, সৃজনীরা বারবার করে বললো। তাই ও যাবে। আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে আলমারি থেকে জামা বের করে বদলে নেয়। চোখে মুখে একবার জল দেয়। কোনো প্রসাধন না। শুধু চুলটা বেঁধে নেয় ঠিক করে। নিচে নেমে মোহর। ওকে দেখে তুষার আর সৃজনী উঠে দাঁড়ায়। "চল" বলে ও। এগোয় ওরা। তুষার গাড়ি নিয়ে এসেছে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে মোহরের চোখ চলে যায় গ্যারেজে। লাল গাড়িটা দিব্যি দাঁড়িয়ে। এক রাশ স্মৃতি এসে চোখ ভিজিয়ে দেয় মোহরের। তুষার গাড়ি স্টার্ট দেয়। ওরা এগোয় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। কাছেই হসপিটাল। সারা রাস্তা সবাই চুপ। পিছনের সিটে বসে সমানে কেঁদে চলে মোহর। সামনের সীটে বসে সৃজনী। কুড়ি মিনিটের মধ্যে ওরা এসে পৌঁছয় হসপিটালের বাইরে। কী দৃশ্য দেখতে হবে ওকে ভেবে শিউড়ে ওঠে মোহর।

Sunday, August 18, 2019

হৃদয়পুর ৮

রবিবারগুলো একটু আয়েশ করে বেলা করেই সাধারণত ঘুম থেকে ওঠে মোহর। শনিবার অনেক রাত অবধি বই পড়ে। তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়। কাকিমাকেও বলা আছে সেটা। আর তাই সকালের চা ওর জন্য ভোরবেলা আসেনা। বেলা প্রায় এগারোটা। মোহর স্নান করে বারান্দায় কাচা জামাকাপড় মেলছে। এই হৃদয়পুরের জল হাওয়া বেশ ভালো বলতে হয়। দু আড়াই মাসেই ওর কাঁধ অবধি চুল এখন প্রায় কোমর ছুঁই ছুঁই। ভিজে শ্যাম্পু করে মাথায় তোয়ালে বেঁধে আপন মনে গুনগুন করতে করতেই কাজ করছিল বারান্দায়। এমন সময় চোখ চলে গেল নীচে। দেখলো, গ্যারেজ থেকে বাইক বের করছে প্রমিত। নীল জিন্সের শর্টস আর হলুদ টিশার্ট। চোখে রোদচশমা। কে জানে কেন, প্রমিত একবার ওপর দিকে তাকালো। এবং মোহরের সাথে চোখাচুখি হলো। মোহর এক ঝটকায় মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মুহূর্তেই বাইক বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শুনলো। মোহর অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। মনে পড়ে গেলো এক সপ্তাহ আগের কথা।
সবে ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে সার্ভিস এপার্টমেন্টের খোঁজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে কলিগ অর্পিতাদির বরকে ফোনে ধরেছে। ভদ্রলোক সার্কিট হাউজের ক্যাটারিংয়ের কন্ত্র্যাক্টর। প্রচুর জানাশোনা। বিডিও লেভেল টেভেল অবধি। তাই ওঁকে বলছিল মোহর। মা বাবা এলে থাকার জায়গা চাই তো। মায়ের গলস্টোন অপারেশনের পর থেকে খাওয়া নিয়ে খুব সমস্যা। কিচেন না পেলে মুশকিল। তাই এই ব্যবস্থা। ও মা, তক্ষুণি ঘরে প্রবেশ শ্রীমানের। এবং এসেই প্রশ্ন। কেন মোহর এইসব খুঁজছে। মোহরের মুহূর্তেই মাথা গরম হয়ে গেল। বরাবরের স্বাধীনচেতা মেয়ে। মা বাবা তেমনভাবেই মানুষ করেছেন। হঠাৎ করেই তাই কাজের কৈফিয়ৎ চাওয়ায় মোহর স্বাভাবিকভাবেই রেগে গিয়েছিল। ঠান্ডা গলায় তাই জিজ্ঞেসও করে, "আপনি কি আমার কথায় আড়ি পাতছেন?" প্রমিতের মুখটা দেখার মতো ছিল। মুহূর্তেই চুপসে গেল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হকচকিয়ে গিয়ে। মোহর সুযোগ না দিয়েই বললো, "আমি কী করছি না করছি, তার ব্যাপারে কি আপনাকে কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নাকি?" প্রমিত এতক্ষণে মুখে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, "না মানে আমার তখনের ব্যবহারটা খুবই আনকল্ড ফর ছিল। আই এম এক্সট্রিমলি সরি আবাউট ইট। আমি তাই ভাবলাম যে হয়তো আপনি তাই রেগে গিয়ে অন্যত্র যাওয়ার জন্য জায়গা খুঁজছেন। প্লিজ এরকমটা করবেন না। মা বাবা তাহলে..." প্রমিতের কথা মাঝখানেই কেটে দিয়ে মোহর বলে, "নিজেকে এতটা ইম্পরট্যান্ট ভেবে ফেললে তো বড্ড মুশকিল মিস্টার মুখার্জি।" ব্যস। আর একটা কথাও বলতে হয়নি মোহরকে। প্রমিত মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন। তখন মোহরের কিছু মনে না হলেও, পরে কিন্তু বেশ খারাপ লেগেছে। একটু বেশিই কি রূঢ় হয়ে গেল না? প্রমিতকে তো দেখে মন্দ লোক বলে মনে হয়না। হয়তো কোন পাস্ট ইস্যু আছে। সেই জন্যই এমন ব্যবহার করে। মোহর ম্যাথসের স্টুডেন্ট হলেও সাইকোলজি নিয়ে জ্ঞান ছিল অল্পবিস্তর। কলেজে পড়াকালীন একজন সাইকোলজি অনার্সের ছেলের ওপর হালকা চাপ ছিল। তাকে ইমপ্রেস করতে প্রচুর বইপত্র পড়েছে। কলেজ স্ট্রীট গিয়ে পুরোনো বইপত্র ঘেঁটে নেট ঘেঁটে কম রিসার্চ করেনি। নাহয় সম্পর্কটা এগোয়নি। কিন্তু জ্ঞানটা রয়েই গিয়েছে। আর তাই মোহর ভিতরে ভিতরে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। আচ্ছা, ওর এই ব্যবহারের জন্য প্রমিত আরো এফেক্টেড হবে না তো? যদি এতে প্রমিতের ক্ষতি হয়?
সারা সপ্তাহ মোহর অনেক চেষ্টা করেছে প্রমিতের সাথে মিটমাট করে নেওয়ার। কিন্তু পারেনি। সুযোগ আসেনি। প্রমিত একবারের জন্যও ওর মুখোমুখি বা সামনাসামনি হয়নি। বরং বারবার এড়িয়ে গিয়েছে মোহরকে। ওর সাথে যাতে দেখা না হয়, বেশিরভাগ দিনই প্রমিত আগে বা পরে খাচ্ছে। পাশাপাশি ঘর হলেও, ঘরের দরজা বন্ধ সব সময়। গত বুধবার, সকাল সকাল মোহর ব্রেকফাস্ট করছে, এমন সময় প্রমিত ঘুম চোখে মাকে খুঁজতে খুঁজতে এসেছিল, চায়ের সন্ধানে। কাকীমা তখন বললেন, "ও, তুই উঠে গেছিস? দাঁড়া, চা দিচ্ছি। ব্রেকফাস্টও করে নে। সুজি করেছি।" প্রমিত একবার টেবিলের দিকে দেখলো, মোহর মাথা নিচু করে খাচ্ছে। "থাক। পরে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ো। কাজ আছে ঘরে।" এই বলে নিজের ঘরে ফিরে গেল। কথাগুলো শুনে মোহর চমকে উঠলো। কাকীমাও অবাক। "কী যে করে ছেলেটা, কিচ্ছু বুঝিনা আমি", বলতে বলতে রান্নাঘরে ঢুকে যান। মোহর বোঝে। সব বোঝে। বাবু এখনও রেগেই আছেন ওর ওপর। গোঁসা করেছেন। এই অভিমান ভাঙাতেই হবে।
আনমনা হয়েই এসইব ভাবছিল মোহর। সম্বিৎ ফিরলো মোবাইলের শব্দে। ফোন বাজছে। স্ক্রিনে সৃজনীর নাম। হাসি হাসি মুখ করেই ও ফোন তুললো, বললো, "হ্যাঁ রে বল।" তারপর অপরপ্রান্ত থেকে যা শুনলো, তা শোনার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিল না মোহর।

Friday, August 16, 2019

হৃদয়পুর ৭

প্রমিতের মন বলতে থাকে, নাঃ, এইবারে কিছু একটা করতেই হবে। যা হচ্ছে, বা হতে চলেছে, তাকে আটকাতে হবে। একটা পুরোনো আঘাতের রেশ এইভাবে ক্রমশ ও ওর জীবনে প্রভাব ফেলতে দিতে পারে না। আর এটা শুধু ওর জীবন না। এই মোহরের সাথে জড়িয়ে আছে মা বাবা, তুষার সৃজনীরা। ওরা পর্পত্যেকে ওর আপন। নিজের পাস্টের সাথে বোঝাপড়া করতে না পারার মাশুল ও এইভাবে প্রিয়জনদের দুঃখ দিয়ে দিতে পারে না। প্রমিত আরো একটা অমৃতা চায় না জীবনে।
অমৃতা। বাবা মায়ের পীড়াপীড়িতে এক রকম বাধ্য হয়ে দু বছর আগে প্রমিত বিয়ে করতে রাজি হয়। তখন মামাতো বোন টিঙ্কুর ক্লাসমেট অমৃতার সাথে সম্বন্ধটা মামীই আনে। সব ঠিকঠাকই চলছিল। বিয়ের দিনক্ষণ ফাইনাল। কেনাকাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দুই বাড়িতেই। অমৃতার সাথে অবশ্য প্রমিতের ওই এক দুদিনই কথা হয়েছে। মায়ের জোরাজুরিতে আশীর্বাদের এক সপ্তাহ আগে একদিন ও অমৃতার সাথে দেখা করতে যায়। এদিক ওদিক কথা চলতে থাকে। সেই কথার মধ্যে উঠে আসে প্রাক্তন সম্পর্কের কথা। প্রমিত একটু ইতস্তত করে হলেও রাহীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা পুরোটাই বলে। এমনকি শারীরিক সম্পর্কের কথাও। একটু দ্বিধা কাজ করছিল বটে, অমৃতা কীভাবে ব্যাপারটা নেবে। কিন্তু না। প্রমিত দেখলো, অমৃতা দিব্যি শুনে টুনে বললো, "ও ঠিক আছে। ওইটা নিয়ে আর ভেবো না।" প্রমিত অবাক হয়ে বললো, "তোমার খারাপ লাগবে না অমৃতা? তুমি যাকে বিয়ে করবে, সে যে আগেই অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল।" প্রমিতকে অবাক করে দিয়েই অমৃতা উত্তর দেয়, "দেখো, এই বয়সে এসে যদি তুমি বলতে যে তোমার কোন সম্পর্কই হয়নি পাস্টে, সেটাই বরং অস্বস্তিকর লাগতো। আর তা ছাড়া শরীর নিয়ে আমার অত কিছু ব্যাপার নেই।" প্রমিত শুনে যাচ্ছে চুপ করে। সামনে রাখা ভার্জিন মোয়িতোর গ্লাসটা না ছোঁয়া অবস্থাতেই রয়ে আছে। অমৃতা নিজের কোল্ড কফিতে এক চুমুক দিয়ে প্রমিতের দিকে চোখ টিপে বললো, "তা ছাড়া একদিকে কিন্তু ভালোই হলো। দুজনেই আনাড়ি হলে বড্ড মুশকিল হয়। আমার বন্ধুরা বলেছে। তা ছাড়া, তোমার যে কলকব্জা সব ঠিকঠাক আছে, এটাও তো জানা রইলো। জানো তো, আমার এক পিসতুতো দিদি,রুমকিদি, কাগজ টাগজ দেখে বিয়ে হলো। ও মা। আগে থেকে তো আর কেউ বোঝেনি। বিয়ের পর জানা গেল, জামাইবাবু ইম্পোটেন্ট। ভাবো? অন্তত আমার সেই হেডেক থাকলো না!"
প্রমিত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অমৃতার দিকে। এই মেয়ে চিরকাল এই মফঃস্বল শহরে থেকেছে। কোনদিনও হোস্টেলেও থাকেনি। বাড়ির পরিবেশে থেকে এই মেয়ে এত আধুনিক হলো কীভাবে? প্রমিতের ভালো লাগে এই খোলাখুলি আলোচনা। আরো সাধারণ টুকটাক কথাবার্তা চলে। তারপর বিল মিটিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। প্রমিত সঙ্গে গাড়ি নিয়ে এসেছিল। অমৃতাকে ড্রপ করে দেবে বলে ওদের বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরায়। বাড়ির দুটো গলি আগে একটা অন্ধকার কোণে অমৃতা ওকে গাড়ি থামাতে বলে। প্রমিত অবাক হয়। গাড়ি থামায়। অমৃতা ডান হাত দিয়ে প্রমিতের বাঁ হাতটা চেপে ধরে আলতো করে। তারপর আস্তে করে ওর দিকে ফিরে ঘন হয়ে আসে। বলে, "এ কেমন ওয়ার্কশপ গো? শুধুই থিয়োরি পড়ালে। ডেমো দেবে না? বা অন্তত আমার পরীক্ষা নেবে না?" এই বলে অমৃতা বাঁ হাত দিয়ে প্রমিতের শার্টের কলার চেপে ধরে। তারপর প্রচন্ড তীব্র একটা চুমু খায় প্রমিতের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে। প্রমিতও শরীরী আবেদনে সাড়া জানায়। হাত চলতে থাকে। লিপস্টিক শুষে নেয় প্রাণভরে। আর তখনই বিদ্যুৎরেখা খেলে যায় প্রমিতের শরীর দিয়ে। স্ট্রবেরি লিপস্টিক। সেই স্বাদ। রাহী রাহী বলে ডেকে ওঠে প্রমিত। অমৃতা ছিটকে যায়। নিজেকে ধড়ফড় করে ছাড়িয়ে নেয় প্রমিতের আগল থেকে। প্রমিত হকচকিয়ে যায়। এখনো বোঝেনি কী হলো। অমৃতা নিজের চুল জামা ঠিকঠাক করে ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে যায়। দরজা বন্ধ করার আগে প্রমিতের দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি হেনে বলে, "ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু কন্ট্যাক্ট মি এনি মোর মিস্টার প্রমিত মুখার্জি। এন্ড প্লিজ সর্ট আউট ইয়োর পাস্ট। ইউ আর স্টিল স্টাক উইথ রাহী। বাই।" এই বলে গটগট করে মিলিয়ে যায় অন্ধকার রাস্তায়। প্রমিত হতভম্ব হয়ে বসে থাকে। কিচ্ছু বুঝতে পারে না।
সেদিন রাত্রেই অমৃতার বাবা ফোন করে মুখার্জি বাবুকে যা নয় তাই অপমান করেন। ছেলে লম্পট, দুশ্চরিত্র। মেয়ের ওপর জোরজুলুম করতে গিয়েছিল। নেহাৎ মেয়ের কপাল ভালো, তাই পালিয়ে এসেছে। মুখার্জি বাবু হতবাক। তাঁর এমন ভালো ছেলে সম্পর্কে এ কী কথা। শালা বাবুও ফোন করে দিদি জামাইবাবুকে যথেচ্ছ কথা শুনিয়েছেন। ওদের জন্যই নাকি টিঙ্কুর বন্ধুর পরিবারের কাছে অসম্মান হলো। নিজের ছেলেকে আগে সামলাক, তবে তো বিয়ে দেবে,ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ঘটনায় প্রমিত ভেঙে পড়ে প্রচন্ড। মা বাবা জানেন, বোঝেন। কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে কিছু। ওদের ছেলে এমন হতেই পারে না। কিন্তু... প্রমিত চেষ্টা করেছিল অমৃতার সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু পারেনি। অমৃতা ওর নম্বর ব্লক করে দেয়। টিঙ্কুর মারফত খবর পাঠায়। আর একবার ওকে বিরক্ত করার চেষ্টা করলে পুলিশ কমপ্লেন করবে। প্রমিত দমে যায়। টিঙ্কু চেনে ওর বান্ধবীকে। চেনে দাদাকেও। ও বোঝে, অমৃতারা যা বলছে, তাতে নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে। ও আসে একদিন পিসির বাড়ি। আলাদা করে দাদার সাথে কথা বলে। প্রমিত বলবো না বলবো না করেক বোনের কাছে সমস্তটা খুলে বলে। টিঙ্কু খানিক চুপ থাকে। মাথা নেড়ে তারপর বলে, "তাহলে বিপ্লব রুদ্ররা যা বলেছে, তাই ঠিক।" প্রমিত অবাক হয়ে টিঙ্কুর দিকে তাকায়। টিঙ্কু বলতে থাকে, "বিপ্লব আর রুদ্র আমার ক্লাসমেট। এবং খুবই ক্লোজ বন্ধু। ওরা যখন তোর আর অমৃতার বিয়ে ভাঙার খবরটা পায়, আমায় বলেছিল। এ এমন হতেই পারে না। অমৃতা বহুবার কলেজের অনেক ছেলের সাথেই ফিজিক্যাল হয়েছে। এমন কী বিপ্লবকেও এপ্রোচ করে। বিপ্লব না করায় ওর নামে বদনাম করতে যায়। নেহাৎ সাক্ষী ছিল, তাই সে যাত্রা বিপ্লব বেঁচে যায়। অমৃতা পাকাপোক্ত খেলোয়াড় দাদা। এই তো দেখ, একই ডেটে এন আর আই পাত্র জুটিয়ে বিয়ে করছে। আমাদের ধারণা এসব আগে থেকেই ঠিক ছিল। চ্যাট করতে গিয়ে আলাপ। বাড়িতে কনভিন্স করাতে পুরো নাটকটা করলো ও। গেম খেললো পুরো। তুই রাহীর নাম নিয়ে শুধু ওর গেমটা ইজি করে দিলি।" প্রমিত মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মেঝেতে। ধাক্কা। একের পর এক ধাক্কা। রাহী। তারপর অমৃতা। মেয়েদের ওপর ঘেন্না রাগ জন্মে যাচ্ছে ওর।

প্রমিত পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো। "এসব কী হচ্ছে? আপনি সার্ভিস এপার্টমেন্ট হোটেল খুঁজছেন কেন? এখানে কী অসুবিধে আপনার?" হঠাৎ প্রমিতের গলা শুনে মোহর চমকে ওঠে। ক্ষনিকের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে বলে, "আপনি কি আড়ি পাতছেন?"

Thursday, August 15, 2019

হৃদয়পুর ৬

প্রমিত চুপ করে ঘরে বসে আছে। ভারী পর্দা সরায়নি। দরজা জানালা সব বন্ধ। বাইরে আলো হলেও, ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। ঠিক যেন নিজের জীবনের মতো। হ্যাঁ তাইই তো। বাইরে থেকে দেখলে প্রমিতের জীবন ঈর্ষণীয়। ভালো রোজগার, শান্তিপূর্ণ জীবন, মা বাবার সাথে থাকা। বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। শরীর স্বাস্থ্যও দিব্যি ভালো। কিন্তু কেউ বোঝেনা, মনের কষ্টটা। এই যে আজ, আজ যেমন একটু আগে মা আর মোহর কথা বলছিল, কোনো প্রয়োজন ছিল না কিন্তু প্রমিতের তার মধ্যে নাক গলানোর। ফ্রিজ থেকে জল নিতে বেরিয়েছিল, জল নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যেতেই পারতো। তা না। কানে এলো পুজো। শুনলো মা মোহরকে বলছে সাহায্য করতে, তারপর কী যে হলো। কোনো কারণ ছাড়াই কথা শুনিয়ে দিলো মোহরকে। কী ভাবছে কে জানে। নিশ্চয়ই খুবই রুড ভাবছে ওকে। ঠিক কারণ ছাড়া করেছে তাও বলা যায় না। কারণ আছে। জ্বলজ্যান্ত কারণ। কিন্তু সেই কারণ কেউ বুঝবার না। দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা, এতদিন পর মনে রাখাও মুশকিল। এবং অযৌক্তিকও।
কিন্তু প্রমিত কী করবে? ও তো চেষ্টা করলেও ভুলতে পারে না।
ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার। এম বি এ তে চান্স পেয়ে গিয়েছে আহমেদাবাদে। কলেজ কেটে প্রমিত এসেছে গড়িয়াহাট। আনন্দমেলার সামনে। ঠিক আড়াইটা নাগাদ। এই সময়েই আসতে বলেছে ওকে রাহী। রাহী, ওর প্রেমিকা। প্রেমিকা কি আদৌ বলা যায়? তখনও অবধি প্রমিত জানতো, হ্যাঁ। যার সাথে চুটিয়ে তিন বছর প্রেম করেছে, যে প্রেম শরীরী খেলায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, যার সাথে মনের সব কথা ভাগ করে নিতে পারতো, সুখে দুঃখে যার পাশে থাকতো, তাকে তো প্রমিতের সরল মন প্রেমিকা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। রাহী থাকতো প্রমিতের পিজির ঠিক দুটো বাড়ি পরে। ওর রুমমেট না থাকলেই রাহী চলে আসতো পিজিতে। প্রথম প্রথম গল্প, একসাথে বসে সিনেমা দেখা, হালকা হাত ধরাধরি করলেও একদিন সাহসী হলো দুজনে। প্রমিত ভুলতে পারেনি সেই দিনটা। ঈদের ছুটি। লং উইকেন্ড। অভিষেক ট্রেকিং ক্লাবের সাথে গিয়েছে পুরুলিয়া। দুদিনের জন্য। রাহী সক্কাল সক্কাল এসে হাজির। পরনে লাল টুকটুকে সালোয়ার কামিজ। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। বাদামী কালো চুল ঝুঁটি বাঁধা। মুগ্ধ হয়ে প্রমিত দেখছিলো রাহীকে। মুখোমুখি বসে। তারপর কী থেকে যে কী হয়ে গেল, রাহী ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রমিতের বুকে। রাহীর দামি সুগন্ধী আর শ্যাম্পু করে চুলের নরম স্পর্শে প্রমিত পাগল হয়ে গেল। এতদিনের চেপে রাখা সমস্ত ইচ্ছে দিয়ে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরলো রাহীকে। তারপর নিজের কড়া ফাটা ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো রাহীর নরম দুই ঠোঁটের ফাঁকে। মেয়েদের লিপস্টিকে যে এমন সুন্দর স্বাদ আছে, কই, আগে তো কখনো ভাবতে পারেনি প্রমিত। ওই প্রথম। তারপর আরো যত দিন গিয়েছে, প্রমিত আর রাহী হয়েছে আরো সাহসী। ক্রমশ মেতে উঠেছে ওরা শরীরী খেলায়। মনে প্রাণে ভালোবেসেছে প্রমিত রাহীকে। প্রেমিকা বলবে না তো কী বলবে?
কী বলবে? কেন, রাহী তো ওকে সেদিন বুঝিয়েই দিলো। আনন্দমেলার সামনে। সেদিন রাহী এসেছিল প্রায় তিনটে নাগাদ। প্রমিত অপেক্ষা করতে করতে অস্থির। বারবার ফোন করছে রাহীকে। উত্তর নেই। মেসেজেরও কোনো জবাব নেই। কোনো বিপদ অপদ কিছু হলো না তো? কী হলো? রাহী কোথায়? এইসব ভাবতে ভাবতে ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় পায়চারি করছিল প্রমিত। আর ঠিক তখনই ট্রেডার্সের সামনে দেখলো বাস থেকে নামছে রাহী। পরনে কালো জিন্স। সবুজ মেরুন জংলা কুর্তা। চুলটা টেনে উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা। কানে বড় বড় ঝোলা দুল। ঠোঁটে প্রমিতের প্রিয় স্ট্রবেরি লিপবাম। ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়িগুলো যখন অবশেষে দাঁড়ালো, রাহী এসে পৌঁছলো প্রমিতের সামনে। প্রমিত এগিয়ে গিয়ে রাহীকে জিজ্ঞেস করতে গেল, কী হয়েছে। রাহীর মুখ আজ থমথমে। চোখে মুখে সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটুকু লেগে নেই। ডান হাত তুলে প্রমিতকে থামালো ও। প্রমিত খেয়াল করলো। ম্যানিকীয়র করা আঙুলগুলো আজ লাল নেলপলিশে মায়াবী লাগছে। সরু লম্বা এই আঙুলের ফাঁকে কতবার যে নিজের আঙ্গুল ছুঁয়েছে, প্রমিতের আর হিসেব নেই। রাহী কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা মোটা জাবেদা খাম বের করে প্রমিতের হাতে ধরিয়েএ বললো, "প্রমিত, ইট ইজ ওভার বিটুইন আস। সামনের মাসে আমার বিয়ে। তোমার সাথে আর সম্পর্কে থাকতে চাই না। এইগুলো সব তোমার আমায় পাঠানো চিঠি। আমার আর প্রয়োজন নেই। আজ থেকে তুমি মুক্ত। আই হ্যাড আ গুড টাইম উইথ ইউ। থ্যাংকস। বাট নো মোর। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না ভুলেও। আমার উড বির ফ্যামিলি খুবই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল। জানতে পারলে তোমার কলকাতায় থাকাটা ইম্পসিবল করে দেবে। গুড লাক এন্ড গুডবাই।" প্রমিত থ। কোনোভাবে কিছু রিএক্ট করার আগেই রাহী গটগট করে চলে গেল। প্রমিত ওর পিছনে ধাওয়া করার চেষ্টা করলো বটে। দু তিনবার রাহী রাহী বলে ডাকলো, কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। উল্টে রাহী সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিতে চেপে বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে।
প্রমিত আজও জানে না কেন রাহী এমনটা করেছিল ওর সাথে। বন্ধুবান্ধবদের থেকে পরে জেনেছে, বিয়েটা নাকি এক বছর আগে থেকেই ঠিক ছিল। তা সত্ত্বেও, জেনে বুঝে কেন  এমন করলো রাহী? উত্তর অজানা রয়েই গেল। আর সাথে এলো প্রমিতের মধ্যে এই প্রেমের প্রতি বিদ্বেষ। মেয়েদের রীতিমতো এড়িয়ে চলতো। এইভাবেই কাটিয়ে দিয়েছিল এতগুলো বছর। চলেও যাচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে এসে বাঁধ সাধলো মোহর। সেই একই সবুজ মেরুন জংলা কুর্তি। সেই একই লিপবাম। একই চার্লি গোল্ড পারফিউম। এমনও হয়? সেই হেসে হেসে কথা বলা। আলাপের চেষ্টা। কী করে? কী করে এমন হয়? প্রমিত ভাবতে থাকে। অনেক পরে মনে হয় যা করলো আজ, ব্যাপারটা ঠিক করেনি ও। এভাবে কতদিন চলবে? নাঃ।  মোহরের কাছে ক্ষমা চাইবে।
এই ভেবে মোহরের ঘরের দিকে পা বাড়ায় প্রমিত। পাশেই ঘর। দরজার বাইরে নক করতে যাবে, এমন সময়ে কানে আসে কারুর সাথে ফোনে কথা বলছে ও। "আমায় প্লীজ হৃদয়পুরে কোনো ভালো হোটেল বা সার্ভিস এপার্টমেন্টের খোঁজ দিতে পারেন? খুব আর্জেন্ট।" প্রমিত থমকে যায়।

Wednesday, August 14, 2019

হৃদয়পুর ৫

মোহর এর মধ্যে একটা লং উইকেন্ড দেখে কলকাতা থেকে ঘুরে এসেছে। বাড়ি গিয়ে, নিজের চেনা পরিবেশ পেয়ে খুব যে আনন্দ পেয়েছে, তা বলার না। কিন্তু এবার ওই রবিবার রাতে ট্রেন ধরতে হাওড়া স্টেশন যেতেই মন খারাপ। হৃদয়পুর ভালো। লোকজন ভালো। কলেজটাও কপাল করে ভালোই। কোন ঝুটঝামেলা নেই। রাজনীতির ঝঞ্ঝাট বলতে গেলে নেই। ছাত্র ছাত্রীরা ক্লাস টাস করে। থাকা খাওয়ার সমস্যা নেই। তবুও... বাড়ি, বাড়িই। মা বাবার এখনো রিটায়ারমেন্ট হয়নি। তাই ওদের পক্ষে হুট করে ছুটি পাওয়া সমস্যা। তবুও ওরা ঠিক করেছে, পুজোর ছুটি পড়ার আগে ওরা যাবার মোহরের কাছে। কাছে পিঠে ঘুরে মোহরকে নিয়ে কলকাতা ফিরবে। তারপর অষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে সেদিন রাত্রের ফ্লাইট ধরে সোজা লখনৌ। ওখান থেকে কুমায়ুন ঘুরবে। পুজোর আগে যখন মা বাবা হৃদয়পুর আসবে,  তখন অফ সিজন। তবুও, মোহর ঠিক করে। ফিরে গিয়েই কাকার সাথে আলাপ আলোচনা করে মা বাবার জন্য হোটেল বুক করে নিতে হবে।
সোমবার একদম ভোরবেলা মোহর ফিরলো হৃদয়পুর। স্টেশন থেকে একটা অটো পেয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ঢুকতেই কাকীমা ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন, "উফ, মৌ, তুই এলি। আমি বাঁচলাম।" হ্যাঁ, কয়েকটা সিনেমা একসাথে দেখার সাথে সাথে মোহর উষ্ণ মৌ আর তুমি আপনি এখন তুইয়ের পর্যায়ে নেমে গিয়েছে। মোহর অবশ্য এখনো আপনি আজ্ঞে করেই চলে। ও বললো, "কেন কী হয়েছে কাকীমা?" সব ঠিক আছে তো? কাকুর কিছু হয়নি তো? মোহর মনে মনে ভয় পায়। নিশ্চয়ই না। এ বাড়িতে কিছু হলে সৃজনী নিশ্চয়ই জানতো ওকে। ও তাও টেনশনে থাকে। কাকীমা ওকে বসতে বলে ওর জন্য ঝটপট চা করে আনেন। তারপর দুজনে চা খেতে খেতে গল্প জোড়েন। কলকাতার খবর। পুজোর তোড়জোড় কেমন চলছে, ইত্যাদি। এই সুবাদে মোহর ওর মা বাবার আসার কথাটা কাকীমাকে বলে রাখলো। সাথে এও জানালো যে ও মা বাবার সাথে পুজোর ছুটি পড়তেই বাড়ি চলে যাবে। একদম দেড় মাসের ছুটি কাটিয়ে তবে ফিরবে হৃদয়পুর। কথাটা শুনে যেন কাকীমা একটু দমে গেলেন, মোহর লক্ষ্য করলো। ও বললো, "কাকীমা, বলুন তখন কী বলছিলেন। বললেন না তো, আমায় দেখে বাঁচলেন কেন?"
কাকীমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এবার বলতে লাগলেন, " জানিস তো মৌ, তোর কাকাদের পরিবার বিশাল বড়। নানান শরিক। কেউ বর্ধমানে, কেউ বাঁকুড়া, কেউ কুচবিহার, তো কেউ হৃদয়পুর। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। অনেকে তো আবার পশ্চিম বাংলার বাইরে, এমনকি দেশেরও বাইরে আছে। তা হয়েছে কী, এই মুখার্জি পরিবারের একটা দুর্গা পুজো হয়। সেটা একেকবার একেক শরিক করে। এই তো আমরা পাঁচ বছর আগে করেছিলাম। হিসেবমত আগামী বছর আমাদের আবার পালা হওয়ার কথা। কিন্তু আমার ভাসুর অসুস্থ। ট্রিটমেন্টের জন্য এদিক সেদিক চলছে। তাই এইবারে পুজোটা ওরা করতে পারবে না। আমাদের ওপর এসো পড়েছে দায়িত্ব। এমন দুম করে এলো... কিচ্ছু বুঝছিনা কী করে কী হবে।" মোহর কৌতূহল ভরে জিজ্ঞেস করলো, "পুজো কত বড় করে হয়?" কাকীমা বললেন, "খুব বড়, তা না। তবে হ্যাঁ। প্রতিমা গড়ানো হয়। অষ্টমীর দিন প্রচুর লোকজন দুপুরে ভোগ খায়। এ ছাড়া রোজই চেনাজানার মধ্যে অনেকেই আসেন। ভোগ প্রসাদ খান। কাকার তো জানাশোনা লোকের অভাব নেইম জানিসই তুই।"
"হুম" বলে মোহর মাথা নাড়ে। কাকীমা আরো বলতে থাকেন, "তা তোর কাকা তো বলেছে প্যান্ডেল প্রতিমা সবের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। প্রমিতও আছে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। পাঁচ বছর আগে যতটা পারতাম, এখন অটো পারিনা রে। পুজোর কাজে সাহায্য কে করবে। দুর্গা পুজো মানে চারটিখানি কথা না। সে যতই ছোট করে পুজো হোক। তবুও, হাজারটা কাজ থাকে। প্রমিতটা কতটা সামলাতে পারবে, জানি না। এবারে তো মনে হয় ওকেই পুজোয় বসতে হবে। কাকার ডায়াবিটিস। উপোস টুপস পারবে না। তাই পুজোও করতে পারবে না। তাই আর কী, আমি ভাবছিলাম, কী করে কী ম্যানেজ হবে। তারপর ভাবলাম, কেন, এই তো তুই আছিস। তুই পারবি না বল সামলে নিতে? ইয়ং মেয়ে। কত ডাইনামিক। আমি সেই থেকে উচাটন করছি। তুই কখন আসবি। তোর সাথে বসে ঠিক করবো। হাজার হাজার কাজ। প্ল্যান করতে হবে তো। তোকে কত কিছু শেখাতেও হবে। পারবি না, বল?" কাকীমা এক রাশ আশা নিয়ে মোহরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মোহরের এবার মুখ কালো করার পালা। কী হবে এবার? অষ্টমী রাতের লখনৌ যাওয়ার প্ল্যানটা? টিকিটও কাটা হয়ে গিয়েছে যে। কী করবে? কাকীমা আবার ওকে একটু ঠ্যালা দিয়ে বলেন, "কী রে, পারবি তো মা?" মোহর কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই প্রমিতের গলা শোনা যায়। "দেখছ না মা, ওঁর মুখ চোখের অবস্থা? সবাই সব বোঝে না। আটাচমেন্ট বলো আর হেরিটেজ, সবটা সবার বোঝার ক্ষমতা নেই। উনি আদৌ ইন্টারেস্টেড বলে তো মনেই হয় না। কেন জোর করছো? বলেছি তো, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট টিম এনে দেবো। টাকা ফেললে কাজ হয় না, এখনো এ অবস্থা আসেনি দেশে। চিন্তা করো না মা। আর ম্যাডাম, আপনিও খামোখা টেনশন করবেন না। আপনার ওপর কোনো দায়িত্ব পড়বে না।"
কখন যে প্রমিত এসেছে ঘরে, কেউ টের পায়নি। প্রমিতের কথা শুনে গোটা ঘরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। মোহর কী বলবে উত্তরে, বুঝতে পারে না। কাকীমাও বিহ্বল।

Tuesday, August 13, 2019

হৃদয়পুর ৪

মুখার্জি কাকীমাকে মোহরের বেশ ভালোই লেগেছে। ছোট্ট খাটো মানুষ। নরম নীচুস্বরে কথা বলেন। আটপৌরে শাড়ি পরেন। সব সময় মনে হয় পান জর্দা খান, কারণ গা দিয়ে একটা জর্দার গন্ধ মোহর বারবার পাচ্ছিল। ভদ্রমহিলার মধ্যে একটা বেশ মাতৃসুলভ ব্যাপার আছে। মোহরের ভালো লেগেছে ওঁকে। উনিও মোহরকে বেশ আদর যত্ন করেই অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। মুখার্জি কাকা মানুষটাও ভালো। একটু কথা বেশি বলেন ঠিকই, তবে আমুদে মানুষ। মোহরের কথা বলার মুড থাকলে কাকার সাথে বসে গল্প করতে দিব্যি সময় কেটে যায়।
মোহরের থাকার ঘরটাও ওর পছন্দ হয়েছে। তিন তলায়। ভালো মতন বড় ঘর। সামনে টানা বারান্দা। দুটো ইজি চেয়ার পাতা। সামনেই একটা পার্ক। এই পার্কে ভোরবেলা লোকজন মর্নিং ওয়াকে এসব। তাই ভোর হতে না হতেই কথাবার্তা শোনা যায়। বিকেলে পার্কে বাচ্চারা খেলে। তবে সন্ধ্যে হলে পার্ক একদম ফাঁকা। মোহরের কাজের সময় তাই কোনো ব্যাঘাত ঘটেনা। বারান্দাটা আবার দক্ষিণমুখী। হাওয়া বাতাস ভালোই। ঘরটিও পুরোনো আমলের বাড়ি হওয়ার দরুণ, বেশ বড়। এবং উঁচু সিলিং। লম্বা ডাণ্ডা দিয়ে পাখা ঝুলছে দুটো। দেওয়ালে এক দুই জায়গায় চুনকাম খসে পড়লেও, মন্দ নয়। সাধারণ ক্রিম রঙের দেওয়াল। টিউবলাইট দুটো আর একটা নাইটল্যাম্প। এই ঘরের সাথেই লাগোয়া বাথরুম। চব্বিশ ঘন্টা জল থাকে। একটা ইনস্ট্যান্ট গিজারও লাগিয়ে দিয়েছেন মুখার্জি কাকা। দু তিনটে বালতি রাখা। মগ। স্নান সেরে কাচাকাচি করে বারান্দাতে মেলার ব্যবস্থা আছে। নইলে ছাদ। বাড়ির ছাদটা মোহরের খুব পছন্দ হয়েছে। প্রচুর ফুলের গাছ, সারি সারি টবে। জুঁই টগর বেল ক্যাকটাস সবই আছে। মোহর ভেবেছে কাকা কাকীমার অনুমতি নিয়ে বারান্দায় এক দুটো টব রাখা যায় কি না।
খাওয়া দাওয়াটা সকালে আলাদা করে করে মোহর। দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে কলেজের উদ্দেশ্যে। প্রথম এক দুদিন ও ওই ব্রেকফাস্টের রুটি তরকারি খেয়ে বেরিয়ে যেত। টিফিন সেরকক কিছু নিত না। বলতো ক্যান্টিনে খেয়ে নেবে। কিন্তু কয়েকদিন এমন যাওয়ার পর, কাকীমা নিজে রান্নার লোককে বলে সাড়ে নটার মধ্যে ভাত তরকারি সব রেডি করিয়ে রাখেন। মোহরের একটু অস্বস্তি হয়। ওর জন্য এঁদের এতদিনের রুটিনে ব্যাঘাত হচ্ছে, খারাপ লাগে। কিন্তু কাকীমা কোনো কথাই শুনবেন না। নিজে হাতে মোহরকে খাবার বেড়ে দেন। কোনো কোনো দিন মাছের ঝোল রান্না না হয়ে গেলে, কাকীমা মাছ ভেজে দেন।  আর সকালের প্রাপ্য ব্রেকফাস্ট মোহর প্যাক করে নিয়ে যায় কলেজের জন্য।
কলেজটা বাড়ি থেকে নিতান্তই কাছে। নেহাৎ সকালে খুব রোদ থাকে, তাই ও রিকশা নেয়। ফেরার পথে রোজই ও হাঁটে। এই বাড়িতে ভালোই লাগছে মোহরের। সৃজনীরা মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যায়। ও ও যায় ওদের বাড়ি। এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। একটাই শপিং মল এখানে। সেখানে সপ্তাহে একবার যায়। সিনেমা দেখতে। কখনো সৃজনীর সাথে। কখনো একা। বা কখনো কাকীমার সাথে। কাকীমার সাথে যাওয়াটা নিয়েই মজার গল্প আছে। একটা রবিবার মোহর ম্যাটিনি শোতে এক সিনেমা দেখতে বেরোচ্ছে। কাকীমা হঠাৎ বললেন, "মৌ মা, কিছু মনে করো না। তুমি কি এক সিনেমা দেখবে?" এঁরা ওর ডাক নাম মৌ জেনে গিয়েছেন। তাই মৌ নামেই ডাকেন। মোহর একটু মজা পেলো প্রশ্নে। বললো, "না। কেন?" কাকীমা বললেন, "সৃজনী যাচ্ছে?" মৌ মাথা নেড়ে না জানালো। "ও, তাহলে কলেজের বন্ধুরা?" মোহর এবার হেসে বললো, "না কাকীমা। আমি একাই যাচ্ছি। আমার অভ্যেস আছে। তবে হাউজফুল। তাই হলে আরো অনেক লোক থাকবে। সেই জন্যই বললাম।" ব্যাপারটা বুঝতে অল্পক্ষণ সময় লাগলো মুখার্জি গিন্নীর। তারপর উনি হো হো করে হাসতে লাগলেন। একটু থিতু হয়ে বললেন, "কিছু যদি মনে না করো, আমায় কখনো নিয়ে যাবে? আসলে তোমার কাকা নাকি খালি ব্যস্ত। সময় হয় না। আর প্রমিতের বাংলা সিনেমায় অরুচি। ওর শুধুই ওই ইংরেজি মারামারি নয় কার্টুন কমিক্স।"
মোহর হেসে বলে, "আচ্ছা বেশ। এরপর থেকে যেটা দেখতে ইচ্ছে করবে, বলবেন। নিয়ে যাবো।"
মাস দেড়েক হয়ে গিয়েছে মোহর এই বাড়িতে আছে। সব ভালো। বরং খুবই ভালো। শুধু একটাই খচখচ। প্রমিত। এক দুবার মোহর যেচে আলাপ করতে গিয়েছে। কিন্তু নিতান্তই ঠান্ডা অভ্যর্থনা পেয়ে দমে গিয়েছে। কে জানে বাবা, এত কীসের দেমাক? যাক গে। দেখা যাবে।

Monday, August 12, 2019

হৃদয়পুর ৩

- হ্যাঁ কাকা, বলুন।
-
- না না। এখনও অবধি কিছু পাইনি। পেলে জানাবো।
-
- কীরকম?
-
- বাহ, এটা তো খুবই ভালো হয়। তবে...
-
- না, মানে মোহরের অরাজি হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আপনাদের অসুবিধে?
-
- মাসীমার কোন প্রব্লেম নেই তো?
-
- তাহলে তো হয়েই গেলো। একদম পারফেক্ট সেটআপ।
-
- হ্যাঁ ঠিকই। পরে বেটার কিছু পেলে আবার শিফট করে নেওয়া যাবে। লঙ টার্ম ব্যাপার।
-
- ঠিক আছে। আমি বলছি মোহরকে। ও একবার দেখে আসুক।
-
- আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি।
-
- না মানে কাজ তো আছে। কিন্তু অ তো চিনে যেতে পারবে না।
-
- আরে না না। আবার প্রমিতদাকে এর মধ্যে টানা কেন?
-
- শিয়োর? আমাদের একটুও অসুবিধে হত না কিন্তু।
-
- বেশ ঠিক আছে। মোহর দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিছে।
-
- অনেক উপকার করলেন কাকা। এমনি এমনি কি আর মুশকিল আসান বলি আমরা?

সকলেই আগ্রহ সহকারে সৃজনীর দিকে তাকিয়ে আছে। এক তরফা যা কথা শোনা যাচ্ছিলো, তাতে এইটুকুই বোঝা গেলো যে কিছু একটা সমাধান হয়েছে।  ফোন ছাড়তেই সৃজনীর শাশুড়ি ওকে জিজ্ঞেস করলেন, "কী বললেন ঠাকুরপো? কোন বাড়ির ব্যবস্থা হলো?" সৃজনই হাসি মুখ করে উত্তর দিলো, "সমাধান বলে সমাধান? এই জন্যই তো কাকার ওপর ভরসা করি আমরা। কাকা বললেন মাসীমার সাথে কথা বলে ঠিক করেছেন, ওঁদের বাড়ির তিনতলায় একটা ঘর খালি পড়ে আছে। সেইখানেই আপাতত মোহরের থাকার ব্যবস্থা হোক। আর হ্যাঁ, মোহরের সব আবদার মেনে নেওয়া যাবে তাতে। এক্কেবারে সাউথ ফেসিং, তিনতলা। কলেজ থেকে হাঁটা পথ না হলেও রিকশায় মোটে দশ থেকে পনেরো মিনিট। আর ইন্টারনেট পাবে ভালোই। প্রমিতদা নিজেই কাজ করেন, কাজেই ওঁদের কানেকশন আছেই। মোহর ওখানে আরেকটা কানেকশন নিয়ে নিতে পারবে লাগলে। আর কাকার হোম ডেলিভারি থেকেই খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ঘর ভাড়া বাবদ সাড়ে চার হাজার। আর খাবার খরচ সেটা কবেলা খাবার নেবে কী খাবে সেই অনুযায়ী।" মোহর সব শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। সৃজনী তাই দেখে ওকে বললও, "কীরে? অমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন? ঘরের ব্যবস্থা তো হয়ে গেলো। অমন ভালো ব্যবস্থা হতো না কিন্তু। প্রায় নিজেদের বাড়ির মতোই থাকবি। চেনা জানা মানুষ। কোন অসুবিধে হবে না।"
"কিন্তু, তুই আমায় না জিজ্ঞেস করেই ফাইনাল করে দিলি কেন?" মোহর প্রশ্ন করে।
"কারণ আমি মনে করেছি এইখানে এইটার চেয়ে এই মুহূর্তে তোর জন্য অ্যাঁ অন্য কোন অপশন নেই। এটাই বেস্ট অপশন। তুই গিয়ে দেখেই আয় না। দেখ পছন্দ হয় কি না। তা ছাড়া শুনলি তো, এটা টেম্পোরারি ব্যাপার। খোঁজ চলতে থাকবে। বেটার অপশন পেলে তুই চলে যাস।" সৃজনীর উত্তর ঠিক মনোঃপুত হয় না মোহরের। কিন্তু অকাট্য যুক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা উত্তরও খুঁজে পায় না। বান্ধবী তাড়া লাগায়, "নে নে, তৈরি হয়ে নে। প্রমিতদা আসছে। তোকে নিয়ে যাবে ওঁদের বাড়ি। ঘরদোর দেখে নে। সব ঠিকঠাক হলে কাল পরশুর মধ্যেই শিফট করে নিবি। কলেজ শুরুর আগেই।"
প্রমিত? ওই লোকটার সাথে ওকে একা একা যেতে হবে? দুর্ভোগই দুর্ভোগ।
একদম কথা মেনেই  একদম দশ মিনিটের মাথায় ওঁদের বাড়ির কলিং বেল বেজে ওঠে। তুষার ওঠে দরজা খুলতে। মোহর দেখতে পায়, বাইরে হেলমেট মাথায় দাঁড়িয়ে প্রমিত। হাতে আরেকটা হেলমেট। তুষার ওকে ভিতরে আসতে বলে। কিন্তু প্রমিত কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে এই অছিলায় আর ঢোকে না। মোহর বাইরে বেরোয়। হাতে মোবাইল আর পার্স। এই রে। এই এত উঁচু বাইক। এমনিতেই স্কুটিতে চড়তেও অস্বস্তি হয়। এই বাইকে কী করে উঠবে? প্রমিত ওঁর দিকে হেলমেট এগিয়ে দিয়ে বলে, "পরে নিন।" প্রমিত নিজে বাইকে উঠে বসে, মোহরের অপেক্ষা করতে থাকে। মোহর ইতস্তত করতে থাকে। কী করে উঠবে? প্রমিতের কাঁধে ভর না দিয়ে উঠতেই পারবে না। এখনও মোহর কেন উঠলো না, দেখতে গিয়ে প্রমিত দেখে মোহরের মুখ। কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রমিত বাইকটাকে একটু বাঁদিকে এলিয়ে বলে, "উঠে পড়ুন এবার। আমার কাঁধে ভর দিন। পড়বেন না।" মোহর সমস্ত আড়ষ্টতা জলাঞ্জলি দিয়ে কোনমতে উঠে বসে। প্রমিত বলে, "বসেছেন তো ঠিক করে? চেপে ধরে বসুন। আমি একটু স্পীডেই চালাই সাধারণত। তবে আজ না হয় কম করবো। কিন্তু তাও, ভালো করে চেপে বসুন।"
মোহর নিচুস্বরে বলে, "হুম। ঠিক আছে। চলুন। বসেছি।"
প্রমিত বাইক স্টার্ট দেয়। এবং প্রায় ঝড়ের গতিতে চালাতে থাকে। মোহর প্রাণপণে সিট আঁকড়ে চেপে বসে থাকে।  ভয়ে চোখ বন্ধ। এই জন্যই ও একদম বাইক স্কুটি চড়ে না। ভীষণ ভয়। বাইরে হাওয়া দিচ্ছে। বৃষ্টি নামবো নামবো। সেই হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে প্রমিতের বাইক ছুটছে। মোহর কিচ্ছু টের পাচ্ছে না। কোন অনুভূতিই নেই। এমন কী, প্রমিতের দামী পারফিউমের গন্ধও নাকে ঢুকছে না।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই এসে ওরা থামল মুখারজি বাড়ির সামনে। মোহর এই এতক্ষণে চোখ খুললো।
"নামুন। আমি এটা গ্যারেজে রেখে আসছি। বেল বাজাতে হবে না। আমার কাছে চাবি আছে।" প্রমিত বলে। মোহর মাথা নাড়ে। এখনও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
প্রমিত বাইকটা পার্ক করে রেখে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ওকে বলে, "আসুন।" প্রমিত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। মোহর একবার ইতস্তত করে। তারপরে দৃঢ় পায়ে প্রমিতের পিছন পিছন সিঁড়ি ভাঙতে লাগে।

Sunday, August 11, 2019

হৃদয়পুর ২

মোহরের হাবভাব দেখেই সৃজনী বুঝে যায় সব। হতেই হবে। এতদিনের বন্ধু বলে কথা। প্রমিতের এই আচরণে যে মোহর মোটেই খুশি হয়নি, তা ওর মুখ চোখ আর অদ্ভুত ভাবে 'ওহ' বলাতেই সৃজনী বুঝে নিয়েছে। অবস্থার সামাল দিতে তাই ওই আবার ফিল্ডে নামলো। বললো, "কী গো প্রমিতদা, মুখার্জি কাকা আছেন? আমি কি ওপরে যাবো?" সৃজনীর কথায় সম্বিৎ ফেরে প্রমিতের। ওদের ওখানে সোফায় বসতে দিয়ে "আমি এক্ষুণি বাবাকে জানাচ্ছি গিয়ে। তোমরা বসো বৌদি" বলে হড়বড় করে সিঁড়ির দিকে ছুটতে থাকে। এবং একবার হোঁচট খেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে তবে ওপরে ওঠে। মোহর লক্ষ্য করে, অফিস ঘরের লাগোয়া একটা লোহার রেলিং দেওয়া সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশে দেওয়ালে অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর অয়েল পেইন্টিং টাঙানো। মোহর নিজে ভালো নাচ করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই শিল্পের কদর ও করে। সৃজনীকে মৃদু টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "হ্যাঁ রে, এই পেইন্টিং দিয়ে বাড়ি সাজানোর আইডিয়া কার রে?" সৃজনী মুখ টিপে হেসে বলে, "ও ওগুলো? ওগুলো তো সবই মাসিমার কাজ। প্রমিতদার আঁকা যত্ন করে তো মাসীমাই সব বাঁধিয়ে সাজিয়ে রাখে। প্রমিতদা মুখচোরা মানুষ। এইসব লোককে দেখাতে চায় না। মাসীমাই জোর করে রাখেন।" মোহরের অবাক হওয়ার পালা। "এক মিনিট এক মিনিট। এই মাসীমা কে?"
সৃজনী হো হো করে হেসে বলে, "ওই তো। মুখার্জি কাকার স্ত্রী। বেলা মাসীমা।" মোহর ভুরু কুঁচকে বলে, "ওয়াট? কাকার স্ত্রী মাসী?" সৃজনীর হাসি আর থামে না। ও বলতে থাকে, "আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। কাকা হলেন বাপির বন্ধু। আর মাসীমা মায়ের বন্ধু। সেই সূত্র ধরেই এরকম।" মোহর ভাবে, এ কীরকম জায়গা, কীসব মানুষ। উদ্ভট। পরমুহূর্তেই মনে পড়ে যায় পেইন্টিংগুলোর কথা। সৃজনীকে বলে, "ইউ মিন, ওই ভূতটা এঁকেছে অমন সুন্দর পেন্টিং?" সৃজনী উত্তরে চুপ থাকে। শুধু বান্ধবীর অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে। মোহর বলতে থাকে, "যে লোক কিনা একটা সামান্য ল্যাপটপ সামলাতে পারে না, নিজের বাড়ির সিঁড়িতে উঠতে হোঁচট খায়, সে? সে এমন আঁকলো কী করে? এই, তুই নির্ঘাত গুণধরের গুণকীর্তন করতে গিয়ে বানিয়ে বলছিস।" সৃজনী মোহরের দিকে কটমট করে তাকায়। মোহর আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে ওদের কানে এলো এক গম্ভীর গলায় "কী হয়েছে সৃজনী? তোমার বান্ধবী কী বলছে?" সৃজনী উঠে গিয়ে প্রণাম করতে গেল। মোহরও পিছু পিছু উঠলো। ভদ্রলোক দুই হাত ওদের মাথায় রেখে "বেঁচে থাক মা" বলে এসে বসলেন। ওদেরও বসতে দিলেন। মোহর অবাক হয়ে ওঁকে দেখছিল। ইনিই তাহলে মুখার্জি কাকা। কী সৌম্য চেহারা। লম্বা। চুল পেকে গেলেও বয়সের তেমন প্রভাব নেই চেহারায়। মুখটা যেন একদম ছেলের মতো।
ভারী অমায়িক কণ্ঠস্বরে কথা বলছিলেন। ওদের জন্য কাজের লোক শম্ভুকে ডেকে চা জলখাবার আনতে বললেন। সৃজনী আপত্তি করলেও উনি আপত্তি শোনেননি। মোহরের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তা মা, বলো, তোমার কী সমস্যা হচ্ছে?" মোহর একটু হকচকিয়ে যায়। অবস্থার সামাল দিতে সৃজনী কথা শুরু করতে গেলে মুখার্জি কাকা ওকে থামিয়ে বলেন, "দরকার যার, সেই বলুক।"
মোহর একটু নড়েচড়ে বসে বলে, "আসলে ব্যাপারটা হলো আমি হৃদয়পুর গভর্নমেন্ট কলেজে ম্যাথস পড়াতে এসেছি। এসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসেবে।" এইটুকু শুনেই মুখার্জি কাকা "বাহ বাহ। খুব ভালো। খুব ভালো। তা এটা নিশ্চয়ই সমস্যা না। বলো কী চাই।" মোহর ভাবে, বড্ড কথা থামিয়ে দেন তো। আচ্ছা লোক। যাই হোক, ও বলতে থাকে, "তা আমি একটা থাকার জায়গা খুঁজছি। ভাড়া গোছের। পেয়িং গেস্ট হলেও হয়। তবে দক্ষিণ খোলা ঘর। এবং আমার কলেজ থেকে হাঁটা পথ। বাজেটের ব্যাপার আছে। আর হ্যাঁ, আমার পি এইচ ডি চলছে এখনো। তাই লেখাপড়া থাকে। সেই জন্যই একটু শান্ত পরিবেশ খুঁজছি। সাথে সেই এরিয়াতে ভালো ইন্টারনেট চাই। নইলে আমার রিসার্চে অসুবিধে হবে।"
মুখার্জি কাকা খানিক চুপ করে থাকলেন। তারপর মাথা এদিক ওদিক নেড়ে পাশে রাখা ল্যান্ডলাইন ফোন থেকে কাউকে একটা ফোন করলেন। অপর প্রান্তে যিনি আছেন, তিনি সম্ভবত বাড়ির দালাল। কাকা ওঁকে সব বললেন। তারপর খানিক চুকচাক আক্ষেপ করে ফোন কেটে বললেন, "নাঃ। সহদেবকে ফোন করলাম। হৃদয়পুরের সব বাড়ি ভাড়ার হদিস ওঁর কাছে থাকে। ও বললো এমন বাড়ি নেই কোনো। বেশ চিন্তার কথা।"
মোহরের মুখ কালো হয়ে গেল। যাঃ। শুরুতেই এই। কেন যে এখানে চাকরিটা নিলো।
সৃজনীর সাথে ওর বাড়ি ফিরলো ওরা। সারা রাস্তা আর কেউ কথা বলেনি বিশেষ। সৃজনী যেন চুপসে গিয়েছে। মুখার্জি কাকার বাড়ি থেকে সৃজনীর বাড়ি রিকশায় মিনিট সাতেক। বাড়ি ঢুকে সৃজনী সোজা রান্নাঘরে ঢুকলো। কাজের মাসী সোনাদিকে চা বসাতে বলে তবে মোহরের ঘরে এলো। বললো, "মোহর, চিন্তা করিস না। কাকা কিছু না কিছু ব্যবস্থা করবেনই। উনি খুব দায়িত্ববান।" মোহর মাথা নেড়ে জামাকাপড় বদলাতে ঢুকে যায় বাথরুমে।
চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে সোনাদি ওদের ডাকে। তুষারের মা বাবা আর তুষার ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে লিভিং রুমে। মোহর আর সৃজনী এলো একসাথে। সবে চায়ের কাপে চুমুক পড়েছে, তক্ষুনি সৃজনীর মোবাইলে ফোন বাজলো। স্ক্রিনে মুখার্জি কাকার নাম।

হৃদয়পুর ১

বাস স্ট্যান্ডে দুটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি নেমেছে জোরে। ওদের কাছে ছাতা নেই। ওরা ভিজছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই ওরা অপেক্ষা করে আছে বাসের। লাল কুর্তি আর কালো জিন্স পরা মেয়েটা বারবার হাত উল্টে ঘড়ি দেখছে। কালো সালোয়ার আর সবুজ মেরুন জংলা প্রিন্ট কামিজ পরা মেয়েটির ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। ভিজে চুপচুপে হয়ে লাল কুর্তির দিকে তাকিয়ে বলছে, "উফ। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। এদিকে বাসের কোনো দেখা নেই। কী অদ্ভুত খারাপ এই জায়গাটা। কী করতে যে পড়ে আছিস। ভিজে স্নান হয়ে গেলাম। একটা ক্যাব পর্যন্ত নেই। মাই গড। ডিসগাস্টিং।" লাল কুর্তি এবার সঙ্গিনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, "মোহর, আমার ওপর এখন চোটপাট করে লাভ নেই। বলেছিলাম বেরোনোর আগে যে ছাতা নিয়ে বেরো। তা না। ম্যাডামের ফ্যাশন আগে। নিজেও নিলি না। আমায়ও নিতে দিলি না। ভিজতে হবে। কিচ্ছু করার নেই।" মোহর আরো রেগে যায় কথা শুনে। বলে, "আচ্ছা খারাপ টাউন এই হৃদয়পুর। সকাল থেকে হয়রানি হয়ে যাচ্ছে খালি। সৃজনী আমি শুধু তোর কথা শুনে কলেজের পোস্টিং এখানে নিলাম। তুই বলেছিলি, হৃদয়পুরের মতো নাকি জায়গা আর হয় না। এত ভালো। এত ভালো। ছাইয়ের মাথা ভালো। সারা সকাল ঘুরেও একটা ভদ্রস্থ ভাড়া বাড়ি পেলাম না? ইয়ার্কি নাকি? পরশু থেকে কলেজ শুরু হয়ে যাবে। আর এখনো সেটল করতে পারলাম না। ছি। তার ওপর বাসটাও আসে আর না। ট্যাক্সির কোনো কনসেপ্ট নেই। আচ্ছা বাজে জায়গা।" মোহরের কথা শুনে সৃজনী রেগে যায়। বলে, "তা ম্যাডামের ঘর ভাড়া নিয়ে এত প্যাখনা থাকলে কী করে হবে শুনি? সাউথ ফেসিং বাড়ি, মিনিমাম দুইতলায়, সেমি ফার্ণিশড, আবার কলেজ থেকে হাঁটা পথ। চব্বিশ ঘন্টা রানিং ওয়াটার। আবার সব কিছু ওই পাঁচ হাজারের মধ্যে। অত সোজা নাকি?" মোহর রাগে গড়গড় করছে। ফর্সা গোলগাল মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। হয়রানির শেষ নেই। একেই কলেজ সার্ভিস কমিশনের চাকরিতে কলকাতা বা মফস্বল কোথাও পেলো না। তার ওপর স্কুলের বান্ধবী সৃজনী এখানে আছে শুনে এই হৃদয়পুর এলো। বাড়ি থেকে এত দূরে। এদিকে এখানে এসে একটা ঠিকঠাক বাড়ি পর্যন্ত পাচ্ছে না। কীই বা এমন বেশি আবদার করেছে ও?
সৃজনী বন্ধুর দিকে তাকিয়ে একটু শান্ত হয়ে বলল, "মোহর, তুই একটু শান্ত হ। মাথা ঠান্ডা কর। ঠিক সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর তা ছাড়া তুই তো বানের জলে পড়ে নেই। যতদিন না মনের মতো থাকার জায়গা পাচ্ছিস, আমার বাড়িতেই থাকবি। কোনো অসুবিধে নেই। আমার শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। কিচ্ছু মনে করবেন না। আর তুষার তো আরোই ভালো। ও বরং বন্ধু পেলে খুশিই হবে।" মোহর তাকায় বন্ধুর দিকে। সত্যিই তো, সৃজনী ওর জন্য এত ভাবছে, চেষ্টা করছে। আর এদিকে সমস্ত রাগ অভিমান গিয়ে সেই ওর ওপরেই ফেলছে। লজ্জা লাগে ওর। মাথা নিচু করে অন্যদিকে মুখ ঘোরায়।
ইতিমধ্যে ৭২ নম্বর বাস এসে থামে বাস স্টপে। বাসের চাকার দৌলতে কাদা জল ছিটকে এসে লাগে মোহরের প্যান্টে। গজগজ করতে করতে সৃজনীর পিছন পিছন এসে ওঠে বাসে। কপাল ভালো। বসার জায়গাও পেয়ে যায়। সৃজনী বলে, "চাপ নিস না। মুখার্জি কাকার ওখানে যাই। কাকা ঠিক কিছু না কিছু ব্যবস্থা করেই দেবেন।" বৃষ্টির ছাঁট এড়াতে জানলার কাঁচ নামাতে নামাতে মোহর বলে, "এই মুখার্জি কাকা কে? তখন থেকে তাঁর নাম জপ করে চলেছিস?" সৃজনী মৃদু হেসে বলে, "দেখিস। মুখার্জি কাকা আমাদের মুশকিল আসান। আমার শ্বশুর মশাইয়ের কলিগ ছিলেন এক কালে। সেই সূত্রে আলাপ। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। ক্যাটারিং, ডেকোরেটর সবকিছুর। এখন তো হোম ডেলিভারির ব্যবসাও করেন। ওঁর ছেলে, প্রমিত, তুষারের ক্লাসমেট ছিল কলেজে। দারুণ লেখাপড়ায়। আবার গান বাজনাতেও অসাধারণ। তুষার তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কনসালটেন্সি করে। তাই এই হৃদয়পুরেই থাকে। বাড়িতে বাবা মায়ের দেখাশোনা করে। আবার মাঝে মাঝে মুখার্জি কাকুকে যে সাহায্য করেনা কাজে, ব্যবসায়, তাও না। দিব্যি আছে।" সৃজনীর কথার ঝাঁপি শেষ আর হয় না। মোহর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। কন্ডাক্টর টিকিট কেটে চলে যায়। মিনিট পনেরো পর ওদের স্টপেজ এলে দুজনে নেমে পড়ে। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। মোহর সৃজনীর পিছন পিছন হাঁটতে থাকে। বাস রাস্তা থেকে সরে এসে ওরা একটা গলির ভিতর। মিনিট তিনেক হাঁটার পর সৃজনী এসে থামে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে। মোহর তাকিয়ে দেখল মুখ তুলে। একদম সাধারণ দেখতে বাড়ি। একতলাতে দোকান। একটা পুরোনো বোর্ডে লেখা "মুখার্জি ডেকোরেটর্স"। কোনো ক্রিয়েটিভিটি নেই, ভাবে মোহর। সৃজনীর পিছন পিছন মোহর এসে ঢুকলো দোকানে। পুরোনো দিনের বাড়ি। উঁচু সিলিং থেকে লম্বা ডাণ্ডা পাখা ঝুলছে। একটা টিউবলাইটের আলোয় ঘরের অন্ধকার কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা। কাঠের আলমারি ঠাসা বাসন পত্র, তোষক বালিশে। বড় টেবিল জুড়ে একগাদা কাগজপত্র। টেবিলের আড়ালে একটা নিচু চেয়ারে বসে ল্যাপটপ খুলে বসে কেউ কাজ করছেন। মুখ দেখা যাচ্ছেনা। এইরকম ব্যবসার পরিবেশে এই ল্যাপটপ হাতে কাজ? মানাচ্ছে না তেমন, মোহর ভাবে।
সৃজনী গলা খাকরি দিয়ে বলে, "প্রমিতদা, কাকা আছেন?" ভদ্রলোক চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। হাত জড়িয়ে ল্যাপটপে লাগানো মাউস মাটিতে পড়ে গেলো। সেটা তুলতে গিয়ে টেবিল থেকে এক দিস্তা কাগজ উল্টে গেল। মোহর স্বভাববশত এগিয়ে গেলো ভদ্রলোককে সাহায্য করতে। উনি এক হাত তুলে থাক, পারবো। লাগবে না বলে নিজে কোনোমতে উঠে বসলেন। এইবারে এতক্ষণে মোহর দেখলো প্রমিতকে। বছর তিরিশ বত্রিশ বয়স। এলোমেলো কোঁকড়া চুল। চোখে কালো সরু ফ্রেমের মোটা কাঁচের চশমা। লম্বা। কালো। পরনে সাদা ফতুয়া আর পাজামা। এই তবে সেই গুণের প্রতিভা? দেখতে শুনতে মন্দ না। নিরীহ গোছের। মোহর হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে বললো, "হাই। আমি মোহর দাশগুপ্ত। হৃদয়পুর গভর্নমেন্ট কলেজে ম্যাথস পড়াতে এসেছি।" প্রমিত নাকের ডগা থেকে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে দুই হাত জোড় করে বললো, "নমস্কার। আমি প্রমিত মুখোপাধ্যায়।" মোহর একটু দমে গেল।

Thursday, August 1, 2019

"পলিসি"

সন্ধ্যে ছটা। প্রতিদিনের মতোই লেকের ধারে বেড়াতে এসেছেন অনিমেষ বাবু। রিটায়ারমেন্টের পর এইটা একটা নিয়ম করে ফেলেছেন। প্রতিদিন বিকেলে হাঁটা। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে বসে লেকের ধারেই সূর্যাস্ত দেখা। ভালো লাগে। এই লেকের আশেপাশে কত লোক। নানান বয়সের। কেউ তাঁরই মতো ইভনিং ওয়াকে, কেউ আবার প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে একান্তে সময় কাটাতে। আবার কেউ ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বা পোষা কুকুর নিয়ে হাঁটছে। আবার কেউ কেউ চুপচাপ বসে থাকে। অনিমেষের মতোই। এদিক ওদিক তাকিয়ে মানুষ দেখেন, তারপর ঠিক সময়ে বেঞ্চি ছেড়ে উঠে চলে জান, নিজের ডেরায়। অনিমেষবাবু চাকরি করতেন একটি নামকরা সংবাদপত্রের অফিসে। অ্যাকাউন্টস সেকশনে। সারাদিন লোকজন লেগেই থাকতো। উনি মানুষটাও ভালোবাসতেন সেইসব। এখন সারাদিন বাড়িতে একা বসে থাকা। হয় টিভি দেখা, নইলে বই পড়া। একাকীত্ব কাটাতেই তাই এসে পড়েন এই লেকের ধারে, রোজ বিকেলে।
আজও খানিক ঘোরাঘুরির পর উনি বসেছেন বেঞ্চে। চা-ওয়ালার থেকে এক কাপ লেবু চা আর বাদাম ওয়ালার থেকে এক ঠোঙ্গা চীনেবাদাম নিয়ে বসেছেন। হঠাৎ কানে এলো একটি কথোপকথন। অল্পবয়সী ছেলে। কতই বা বয়স হবে, ওই চব্বিশ পঁচিশ। ঠিক দেবুর মতো দেখতে। দেবু, অর্থাৎ দেবেশ। অনিমেষ বাবুর খুড়তুতো ভাই। সেই একই রকম রোগা, লম্বা। টিকলো নাক। কোঁকড়া চুল, উস্কোখুস্কো। গায়ের জামা প্যান্টে গুচ্ছের ভাঁজ। দেবুটা চাকরি করত সেলসে, অথচ কক্ষনো আদবকায়দা, পোশাক আশাকের দিকে নজর দিতো না। অনিমেষ, ওর কাকা, দাদারা বলেও বুঝিয়ে উঠতে পারেনি ওকে। আসলে, চাকরিটা দেবু ভালোইবাসতো না। যে ছেলে সারা স্কুল কলেজ জীবন গান আর কবিতা নিয়ে কাটালো, তাকে হঠাৎ করে মার্কেটিঙের চাকরিতে ফেলে দেওয়া যে কী বড় ভুল, তার প্রমাণ দেবু। সর্বক্ষণ সেলস, টার্গেট এই চক্করে দিনদিন হাঁপিয়ে উঠত দেবু। তারপর একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। হ্যাঁ, হারিয়ে গেলো। এক্কেবারে উধাও। বাড়িতে সদ্য বিয়ে করা বউ। বয়স্ক বাবা মা। সব্বাইকে ফেলে রেখে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো দেবু। ওকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছে সব্বাই। থানা পুলিশ হাসপাতাল মর্গ, কোথাও বাদ যায়নি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন, টিভিতে বিজ্ঞাপন সব পড়েছে। তবু দেবুর খবর পাওয়া যায়নি কোন। শেষ পর্যন্ত কাকুমণি সন্ধানপর্বে ইতি টানলেন এই বলে যে এই এত বড় দেশে কেউ যদি স্বেচ্ছায় লুকিয়ে থাকতে চায়, তাকে খুঁজে বের করা দুষ্কর। অনিমেষ এখনও ভুলতে পারে না দেবুর কথা। বড়ই প্রিয় ছোট ভাই ছিল।
আজ পার্কে এই ছেলেটিকে দেখে বারবার দেবেশের কথা মনে হচ্ছিল। আর তাই মাঝে মাঝেই ছেলেটির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। এমনকী আড়িও পাতছিলেন ওর কথায়। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ফোনে কারুর সাথে কথা বলে গেলো। মনে হয় কোন ইন্স্যোরেন্স কোম্পানির এজেন্ট। খুব চেষ্টা করলো কারুর কাছে একটা পলিসি বিক্রি করার। কিন্তু বিফল। ছেলেটি এখন কপালে হাত চেপে মাথা নীচু করে বসে আছে। অনিমেষ উঠলেন ধীরপায়ে। পৌঁছলেন পাশের বেঞ্চে, বসলেন ছেলেটির পাশে। ছেলেটির কাঁধে আলতো স্পর্শ করে বললেন, "এনি প্রব্লেম?" ছেলেটি ক্লান্ত। বিধ্বস্ত। মুখ না তুলেই বলল, "এই চাকরিটাও গেলো আমার। এই মাসেও টার্গেট ফুলফিল হবে না।" অনিমেষ সস্নেহে প্রশ্ন করলেন, "কীসের টার্গেট?" ছেলেটি এইবারে মাথা তুলে ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল, "পলিসি। ইন্স্যোরেন্স। নেবেন? প্লীজ নিন। আমার অন্তত একটু সুবিধে হয়।" অনিমেষ মৃদু হেসে বলেন, "এই বুড়ো বয়সে? আচ্ছা বেশ। দেখি, বলো দেখি একটা ভালো পলিসি। আমার আবার মেডিক্লেমটা রিনিউ করারও সময় হয়েই এসেছে।" পলিসির কাগজপত্রে সইসাবুদ মিটে যাওয়ার পর ছেলেটি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো ওঁর দিকে। বললো, "জেঠু, আপনি আমার ওপর দয়া করে এটা করলেন, না? আসলে আমার এখন এমন অবস্থা যে দয়া ভিক্ষাও ঠেলতে পারবো না। ই এম আইয়ের বড্ড বোঝা। বাড়িতে নতুন অতিথিও আসছে। আমি নিতান্তই নিরুপায়।" অনিমেষ কিছু বললেন না। শুধু মনে মনে ঈশ্বরের কাছে ছোট্ট করে একটা প্রার্থনা জানালেন, "দেবুর মতো করো না একে।" ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে অনিমেষ বললেন, "তাহলে কাল সকাল সকাল আমার বাড়ি চলে এসো, আমি চেক রেডি করে রাখবো। এখন উঠি। বাড়ি ফিরতে হবে। অনেক কাজ আছে।" কাজই বটে। কালকেই মেডিক্লেমের প্রিমিয়ামের চেক কেটেছেন। চেকবই আর রসিদ, দুটোই টেবিলে পড়ে আছে। আলমারিতে তুলে রাখতে হবে তো।