সন্ধ্যে ছটা। প্রতিদিনের মতোই লেকের ধারে বেড়াতে এসেছেন অনিমেষ বাবু। রিটায়ারমেন্টের পর এইটা একটা নিয়ম করে ফেলেছেন। প্রতিদিন বিকেলে হাঁটা। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে বসে লেকের ধারেই সূর্যাস্ত দেখা। ভালো লাগে। এই লেকের আশেপাশে কত লোক। নানান বয়সের। কেউ তাঁরই মতো ইভনিং ওয়াকে, কেউ আবার প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে একান্তে সময় কাটাতে। আবার কেউ ছেলে মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ বা পোষা কুকুর নিয়ে হাঁটছে। আবার কেউ কেউ চুপচাপ বসে থাকে। অনিমেষের মতোই। এদিক ওদিক তাকিয়ে মানুষ দেখেন, তারপর ঠিক সময়ে বেঞ্চি ছেড়ে উঠে চলে জান, নিজের ডেরায়। অনিমেষবাবু চাকরি করতেন একটি নামকরা সংবাদপত্রের অফিসে। অ্যাকাউন্টস সেকশনে। সারাদিন লোকজন লেগেই থাকতো। উনি মানুষটাও ভালোবাসতেন সেইসব। এখন সারাদিন বাড়িতে একা বসে থাকা। হয় টিভি দেখা, নইলে বই পড়া। একাকীত্ব কাটাতেই তাই এসে পড়েন এই লেকের ধারে, রোজ বিকেলে।
আজও খানিক ঘোরাঘুরির পর উনি বসেছেন বেঞ্চে। চা-ওয়ালার থেকে এক কাপ লেবু চা আর বাদাম ওয়ালার থেকে এক ঠোঙ্গা চীনেবাদাম নিয়ে বসেছেন। হঠাৎ কানে এলো একটি কথোপকথন। অল্পবয়সী ছেলে। কতই বা বয়স হবে, ওই চব্বিশ পঁচিশ। ঠিক দেবুর মতো দেখতে। দেবু, অর্থাৎ দেবেশ। অনিমেষ বাবুর খুড়তুতো ভাই। সেই একই রকম রোগা, লম্বা। টিকলো নাক। কোঁকড়া চুল, উস্কোখুস্কো। গায়ের জামা প্যান্টে গুচ্ছের ভাঁজ। দেবুটা চাকরি করত সেলসে, অথচ কক্ষনো আদবকায়দা, পোশাক আশাকের দিকে নজর দিতো না। অনিমেষ, ওর কাকা, দাদারা বলেও বুঝিয়ে উঠতে পারেনি ওকে। আসলে, চাকরিটা দেবু ভালোইবাসতো না। যে ছেলে সারা স্কুল কলেজ জীবন গান আর কবিতা নিয়ে কাটালো, তাকে হঠাৎ করে মার্কেটিঙের চাকরিতে ফেলে দেওয়া যে কী বড় ভুল, তার প্রমাণ দেবু। সর্বক্ষণ সেলস, টার্গেট এই চক্করে দিনদিন হাঁপিয়ে উঠত দেবু। তারপর একদিন কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। হ্যাঁ, হারিয়ে গেলো। এক্কেবারে উধাও। বাড়িতে সদ্য বিয়ে করা বউ। বয়স্ক বাবা মা। সব্বাইকে ফেলে রেখে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো দেবু। ওকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছে সব্বাই। থানা পুলিশ হাসপাতাল মর্গ, কোথাও বাদ যায়নি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন, টিভিতে বিজ্ঞাপন সব পড়েছে। তবু দেবুর খবর পাওয়া যায়নি কোন। শেষ পর্যন্ত কাকুমণি সন্ধানপর্বে ইতি টানলেন এই বলে যে এই এত বড় দেশে কেউ যদি স্বেচ্ছায় লুকিয়ে থাকতে চায়, তাকে খুঁজে বের করা দুষ্কর। অনিমেষ এখনও ভুলতে পারে না দেবুর কথা। বড়ই প্রিয় ছোট ভাই ছিল।
আজ পার্কে এই ছেলেটিকে দেখে বারবার দেবেশের কথা মনে হচ্ছিল। আর তাই মাঝে মাঝেই ছেলেটির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। এমনকী আড়িও পাতছিলেন ওর কথায়। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে ফোনে কারুর সাথে কথা বলে গেলো। মনে হয় কোন ইন্স্যোরেন্স কোম্পানির এজেন্ট। খুব চেষ্টা করলো কারুর কাছে একটা পলিসি বিক্রি করার। কিন্তু বিফল। ছেলেটি এখন কপালে হাত চেপে মাথা নীচু করে বসে আছে। অনিমেষ উঠলেন ধীরপায়ে। পৌঁছলেন পাশের বেঞ্চে, বসলেন ছেলেটির পাশে। ছেলেটির কাঁধে আলতো স্পর্শ করে বললেন, "এনি প্রব্লেম?" ছেলেটি ক্লান্ত। বিধ্বস্ত। মুখ না তুলেই বলল, "এই চাকরিটাও গেলো আমার। এই মাসেও টার্গেট ফুলফিল হবে না।" অনিমেষ সস্নেহে প্রশ্ন করলেন, "কীসের টার্গেট?" ছেলেটি এইবারে মাথা তুলে ওঁর দিকে তাকিয়ে বলল, "পলিসি। ইন্স্যোরেন্স। নেবেন? প্লীজ নিন। আমার অন্তত একটু সুবিধে হয়।" অনিমেষ মৃদু হেসে বলেন, "এই বুড়ো বয়সে? আচ্ছা বেশ। দেখি, বলো দেখি একটা ভালো পলিসি। আমার আবার মেডিক্লেমটা রিনিউ করারও সময় হয়েই এসেছে।" পলিসির কাগজপত্রে সইসাবুদ মিটে যাওয়ার পর ছেলেটি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালো ওঁর দিকে। বললো, "জেঠু, আপনি আমার ওপর দয়া করে এটা করলেন, না? আসলে আমার এখন এমন অবস্থা যে দয়া ভিক্ষাও ঠেলতে পারবো না। ই এম আইয়ের বড্ড বোঝা। বাড়িতে নতুন অতিথিও আসছে। আমি নিতান্তই নিরুপায়।" অনিমেষ কিছু বললেন না। শুধু মনে মনে ঈশ্বরের কাছে ছোট্ট করে একটা প্রার্থনা জানালেন, "দেবুর মতো করো না একে।" ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে অনিমেষ বললেন, "তাহলে কাল সকাল সকাল আমার বাড়ি চলে এসো, আমি চেক রেডি করে রাখবো। এখন উঠি। বাড়ি ফিরতে হবে। অনেক কাজ আছে।" কাজই বটে। কালকেই মেডিক্লেমের প্রিমিয়ামের চেক কেটেছেন। চেকবই আর রসিদ, দুটোই টেবিলে পড়ে আছে। আলমারিতে তুলে রাখতে হবে তো।
No comments:
Post a Comment