চোখের ওপর বারবার চুলের গোছা এসে পড়ছে। পৃথা সমানে সেগুলিকে সরাচ্ছে। হাতের চুড়িগুলো রিনরিন করছে। বিরক্তির মধ্যেও ভালো লাগছে পৃথার। আজ বেশ সেজেগুজেই এসেছে। সাজতে খুবই ভালোবাসে পৃথা। তবে সোম থেকে শুক্র অফিসে বিজনেস ক্যাজ্যুয়ালের চক্করে পড়ে মনের মতো সাজগোজ হয়ে ওঠেনা। তাই আজ সুযোগ ছাড়েনি। একটা কলমকরি কাজের লম্বা হাতা ব্লাউজ দিয়ে সাদা লিনেনের শাড়ি পরেছে, সাথে মানানসই রূপোর গয়না। শ্যাম্পু করা চুলটা আলতো খোঁপায় বাঁধা। কপালে ছোট্ট টিপ। বেরোনোর আগে আয়নায় নিজেকে দেখে ভালোই লেগেছে। টুক করে একটা সেলফি তুলে ইন্সটাগ্রামেও দিয়ে দিয়েছে। সেই ছবিতে ইতিমধ্যেই ঝড়ের গতিতে লাইকের বন্যা বয়ে গিয়েছে। ওয়েটার ইতিমধ্যে চতুর্থ রাউন্ড মাটন বোটি কাবাব পরিবেশন গিয়েছে। পৃথা সর্বভুক হলেও স্বল্পাহারী। খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। উল্টোদিকে উপমন্যু পাক্কা খাদ্যরসিক। বিনা বিরতিতে দিব্যি সাঁটিয়েই চলেছে একের পর এক কাবাব। মেনু দেখে বলেছে এরপর নাকি বিরিয়ানিতে হামলা করবে। পারেও বটে। পৃথা ভাবে। ওই জন্যই একটা নাদুসনুদুস ভুঁড়িও রয়েছে। নীল জিন্স আর কালো শার্টের আড়ালে যাকে লোকানো যায়নি বিশেষ। পৃথা নিজে ছিপছিপে চেহারার। দিনের শুরুই হয় ওর যোগব্যায়াম দিয়ে। আনফিট লোকজন দেখলে খুব রাগ হয় ওর। নিজের শরীর, নিজে যত্ন না নিলে হয়? উপমন্যুকে দেখেও রাগ হওয়ার কথা। গোগ্রাসে খাচ্ছে। ভুঁড়িখানাও রয়েছে। কিন্তু কে জানে, কোন অদ্ভুত কারণে ওকে দেখে পৃথার খারাপ লাগছে না। হয়তো খাওয়াটাকে বড্ড ভালোবেসে খাচ্ছে বলে, নাকি? চোখে মুখের তৃপ্তি বুঝি স্বাস্থ্য অস্বাস্থ্য এইসবকে কয়েক গোলে হারিয়ে দিয়েছে? পৃথা নিজেই নিজের চিন্তায় অবাক হয়। উল্টোদিক থেকে উপমন্যুর কথায় খেয়াল পড়ে, "চুলটা বেঁধে নিন না। খাওয়াতে এত ব্যাঘাত ভালো নাকি?" পৃথা মুহূর্তের জন্য খাওয়া থামিয়ে ফেলে। তারপর মুচকি হেসে ফেলে। এত সেজেগুজে আসা, অন্তত উল্টোদিকের মানুষটি সামান্য কমপ্লিমেন্ট তো দিতে পারতো। কমপ্লিমেন্ট তো দেয়ইনি একবারও। উল্টে এই উপদেশ? সত্যি। এই ছেলে পৃথার পরিচিত অন্য ছেলেদের থেকে একটু হলেও আলাদা। ও পাশে রাখা টিস্যুতে হাতটা মোছে। চুলটা বেঁধেই নেবে টাইট করে। এমন সময় ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ঋষির নাম। পৃথা বিরক্ত হয়। হাতটা নিশপিশ করে লাল আইকনে স্লাইড করতে। নিজেকে সংযত রাখে। ফোনটা ভাইব্রেট হতে হতে থেমে যায়। খোঁপা বাঁধার কথা পৃথা ভুলে যায়। উপমন্যুকে বলে মেন কোর্সের দিকে এগিয়ে যায়।
পাতে এক হাতা ওয়াইট রাইস, ইয়েলো ডাল আর মাংস নিয়ে ফিরে আসে টেবিলে। উপমন্যু ওকে দেখে বলে, "আপনার ফোনটা আবার বাজছিল।" পৃথা থালা রেখে একবার ফোনের দিকে তাকায়। দেখে ঋষির নম্বর। ও কিছু বলে না। খাওয়াতে মন দেয়। উপমন্যু ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। পরিস্থিতি হাল্কা করতে কি কে জানে, বলে, "এত অল্প খেয়ে এই রেস্টুরেন্টগুলোর লাভ বাড়াচ্ছেন কেন?" পৃথা কিছু বলে না। একটু হাসে। উপমন্যু বলতে থাকে, "আমি যাই। ভালো করে ঘুরে ফিরে মেন কোর্স কী আছে দেখি। প্লেটটা ভরে আনি। আপনি বরং ততক্ষণ ফোনটা রিসিভ করুন। নিন। আবার কল করছে ঋষিকুমার। দেখুন দেখুন। এতবার করছে, নিশ্চয়ই খুব দরকারি। কথা বলে নিন। আমি এখানে এক্ষুণি ফিরছি না। আপনি নির্দ্বিধায় কথা বলুন।" এই বলে উপমন্যু এগিয়ে যায় মেন কোর্সের দিকে। পৃথা খাওয়া ছেড়ে তাকিয়ে থাকে পাশে রাখা ফোনটার দিকে। নাহ। ধরবে ও না। যত ইচ্ছে ফোন করুক। শুনবে না। আবার ঠকবে না। ও জানে, ঋষি দুটো মিষ্টি করে কথা বলবে, আর পৃথা আবার গলে যাবে। উঁহু। এ হতে পারে না। পৃথাকে নিজেকে বাঁচাতেই হবে। ফোন ও ধরবে না।
No comments:
Post a Comment