Sunday, August 11, 2019

হৃদয়পুর ১

বাস স্ট্যান্ডে দুটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি নেমেছে জোরে। ওদের কাছে ছাতা নেই। ওরা ভিজছে। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই ওরা অপেক্ষা করে আছে বাসের। লাল কুর্তি আর কালো জিন্স পরা মেয়েটা বারবার হাত উল্টে ঘড়ি দেখছে। কালো সালোয়ার আর সবুজ মেরুন জংলা প্রিন্ট কামিজ পরা মেয়েটির ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। ভিজে চুপচুপে হয়ে লাল কুর্তির দিকে তাকিয়ে বলছে, "উফ। কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি এখানে। এদিকে বাসের কোনো দেখা নেই। কী অদ্ভুত খারাপ এই জায়গাটা। কী করতে যে পড়ে আছিস। ভিজে স্নান হয়ে গেলাম। একটা ক্যাব পর্যন্ত নেই। মাই গড। ডিসগাস্টিং।" লাল কুর্তি এবার সঙ্গিনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, "মোহর, আমার ওপর এখন চোটপাট করে লাভ নেই। বলেছিলাম বেরোনোর আগে যে ছাতা নিয়ে বেরো। তা না। ম্যাডামের ফ্যাশন আগে। নিজেও নিলি না। আমায়ও নিতে দিলি না। ভিজতে হবে। কিচ্ছু করার নেই।" মোহর আরো রেগে যায় কথা শুনে। বলে, "আচ্ছা খারাপ টাউন এই হৃদয়পুর। সকাল থেকে হয়রানি হয়ে যাচ্ছে খালি। সৃজনী আমি শুধু তোর কথা শুনে কলেজের পোস্টিং এখানে নিলাম। তুই বলেছিলি, হৃদয়পুরের মতো নাকি জায়গা আর হয় না। এত ভালো। এত ভালো। ছাইয়ের মাথা ভালো। সারা সকাল ঘুরেও একটা ভদ্রস্থ ভাড়া বাড়ি পেলাম না? ইয়ার্কি নাকি? পরশু থেকে কলেজ শুরু হয়ে যাবে। আর এখনো সেটল করতে পারলাম না। ছি। তার ওপর বাসটাও আসে আর না। ট্যাক্সির কোনো কনসেপ্ট নেই। আচ্ছা বাজে জায়গা।" মোহরের কথা শুনে সৃজনী রেগে যায়। বলে, "তা ম্যাডামের ঘর ভাড়া নিয়ে এত প্যাখনা থাকলে কী করে হবে শুনি? সাউথ ফেসিং বাড়ি, মিনিমাম দুইতলায়, সেমি ফার্ণিশড, আবার কলেজ থেকে হাঁটা পথ। চব্বিশ ঘন্টা রানিং ওয়াটার। আবার সব কিছু ওই পাঁচ হাজারের মধ্যে। অত সোজা নাকি?" মোহর রাগে গড়গড় করছে। ফর্সা গোলগাল মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে। হয়রানির শেষ নেই। একেই কলেজ সার্ভিস কমিশনের চাকরিতে কলকাতা বা মফস্বল কোথাও পেলো না। তার ওপর স্কুলের বান্ধবী সৃজনী এখানে আছে শুনে এই হৃদয়পুর এলো। বাড়ি থেকে এত দূরে। এদিকে এখানে এসে একটা ঠিকঠাক বাড়ি পর্যন্ত পাচ্ছে না। কীই বা এমন বেশি আবদার করেছে ও?
সৃজনী বন্ধুর দিকে তাকিয়ে একটু শান্ত হয়ে বলল, "মোহর, তুই একটু শান্ত হ। মাথা ঠান্ডা কর। ঠিক সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর তা ছাড়া তুই তো বানের জলে পড়ে নেই। যতদিন না মনের মতো থাকার জায়গা পাচ্ছিস, আমার বাড়িতেই থাকবি। কোনো অসুবিধে নেই। আমার শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। কিচ্ছু মনে করবেন না। আর তুষার তো আরোই ভালো। ও বরং বন্ধু পেলে খুশিই হবে।" মোহর তাকায় বন্ধুর দিকে। সত্যিই তো, সৃজনী ওর জন্য এত ভাবছে, চেষ্টা করছে। আর এদিকে সমস্ত রাগ অভিমান গিয়ে সেই ওর ওপরেই ফেলছে। লজ্জা লাগে ওর। মাথা নিচু করে অন্যদিকে মুখ ঘোরায়।
ইতিমধ্যে ৭২ নম্বর বাস এসে থামে বাস স্টপে। বাসের চাকার দৌলতে কাদা জল ছিটকে এসে লাগে মোহরের প্যান্টে। গজগজ করতে করতে সৃজনীর পিছন পিছন এসে ওঠে বাসে। কপাল ভালো। বসার জায়গাও পেয়ে যায়। সৃজনী বলে, "চাপ নিস না। মুখার্জি কাকার ওখানে যাই। কাকা ঠিক কিছু না কিছু ব্যবস্থা করেই দেবেন।" বৃষ্টির ছাঁট এড়াতে জানলার কাঁচ নামাতে নামাতে মোহর বলে, "এই মুখার্জি কাকা কে? তখন থেকে তাঁর নাম জপ করে চলেছিস?" সৃজনী মৃদু হেসে বলে, "দেখিস। মুখার্জি কাকা আমাদের মুশকিল আসান। আমার শ্বশুর মশাইয়ের কলিগ ছিলেন এক কালে। সেই সূত্রে আলাপ। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। ক্যাটারিং, ডেকোরেটর সবকিছুর। এখন তো হোম ডেলিভারির ব্যবসাও করেন। ওঁর ছেলে, প্রমিত, তুষারের ক্লাসমেট ছিল কলেজে। দারুণ লেখাপড়ায়। আবার গান বাজনাতেও অসাধারণ। তুষার তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কনসালটেন্সি করে। তাই এই হৃদয়পুরেই থাকে। বাড়িতে বাবা মায়ের দেখাশোনা করে। আবার মাঝে মাঝে মুখার্জি কাকুকে যে সাহায্য করেনা কাজে, ব্যবসায়, তাও না। দিব্যি আছে।" সৃজনীর কথার ঝাঁপি শেষ আর হয় না। মোহর অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। কন্ডাক্টর টিকিট কেটে চলে যায়। মিনিট পনেরো পর ওদের স্টপেজ এলে দুজনে নেমে পড়ে। বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। মোহর সৃজনীর পিছন পিছন হাঁটতে থাকে। বাস রাস্তা থেকে সরে এসে ওরা একটা গলির ভিতর। মিনিট তিনেক হাঁটার পর সৃজনী এসে থামে একটা তিনতলা বাড়ির সামনে। মোহর তাকিয়ে দেখল মুখ তুলে। একদম সাধারণ দেখতে বাড়ি। একতলাতে দোকান। একটা পুরোনো বোর্ডে লেখা "মুখার্জি ডেকোরেটর্স"। কোনো ক্রিয়েটিভিটি নেই, ভাবে মোহর। সৃজনীর পিছন পিছন মোহর এসে ঢুকলো দোকানে। পুরোনো দিনের বাড়ি। উঁচু সিলিং থেকে লম্বা ডাণ্ডা পাখা ঝুলছে। একটা টিউবলাইটের আলোয় ঘরের অন্ধকার কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা। কাঠের আলমারি ঠাসা বাসন পত্র, তোষক বালিশে। বড় টেবিল জুড়ে একগাদা কাগজপত্র। টেবিলের আড়ালে একটা নিচু চেয়ারে বসে ল্যাপটপ খুলে বসে কেউ কাজ করছেন। মুখ দেখা যাচ্ছেনা। এইরকম ব্যবসার পরিবেশে এই ল্যাপটপ হাতে কাজ? মানাচ্ছে না তেমন, মোহর ভাবে।
সৃজনী গলা খাকরি দিয়ে বলে, "প্রমিতদা, কাকা আছেন?" ভদ্রলোক চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। হাত জড়িয়ে ল্যাপটপে লাগানো মাউস মাটিতে পড়ে গেলো। সেটা তুলতে গিয়ে টেবিল থেকে এক দিস্তা কাগজ উল্টে গেল। মোহর স্বভাববশত এগিয়ে গেলো ভদ্রলোককে সাহায্য করতে। উনি এক হাত তুলে থাক, পারবো। লাগবে না বলে নিজে কোনোমতে উঠে বসলেন। এইবারে এতক্ষণে মোহর দেখলো প্রমিতকে। বছর তিরিশ বত্রিশ বয়স। এলোমেলো কোঁকড়া চুল। চোখে কালো সরু ফ্রেমের মোটা কাঁচের চশমা। লম্বা। কালো। পরনে সাদা ফতুয়া আর পাজামা। এই তবে সেই গুণের প্রতিভা? দেখতে শুনতে মন্দ না। নিরীহ গোছের। মোহর হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে বললো, "হাই। আমি মোহর দাশগুপ্ত। হৃদয়পুর গভর্নমেন্ট কলেজে ম্যাথস পড়াতে এসেছি।" প্রমিত নাকের ডগা থেকে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে দুই হাত জোড় করে বললো, "নমস্কার। আমি প্রমিত মুখোপাধ্যায়।" মোহর একটু দমে গেল।

No comments:

Post a Comment