হাসপাতালের একটা কোণে ভিজিটার্স বেঞ্চের একদিকে মোহর আর সৃজনী চুপ করে বসে থাকে। তুষার রিসেপশনে গিয়ে কথাবার্তা বলে ওদের কাছে এসে বলে, " বললো ওকে বেডেই রেখেছে এখনও। কিছু পেপারওয়ার্ক বাকি। সেইসব ফর্মালিটি সেরে তবে ওকে ছাড়বে। সৃজনী মুখ তুলে একবার তুষারের দিকে চাইলো। তুষার মোহরকে বললো, "তুমি কি একবার ওকে দেখবে?" মোহর ডুকরে কেঁদে উঠলো। বললো, "না। কী দেখবো? আমার এইসব একদম ভালো লাগেনা। ভালো স্মৃতিটুকুই থাকুক।" সৃজনী ওর কাঁধটা চেপে ধরে বলে, "মোহর, সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু শেষবারের মতো দেখার এই তো সুযোগ। না গেলে পরে তোর আফসোস হবে দেখিস।" মোহর তবুও রাজি হয় না। সৃজনী যেন একটু বিরক্ত বোধ করে। বলে, "যা বলছি শোন। এতে তোরই ভালো হবে। পরে নইলে হাপিত্যেশ করতে হবে তোকে।" মোহর একটু অবাক হয় বন্ধুর এই ব্যবহারে। কিন্তু কিছুই বলে না। তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে, "ঠিক আছে তুষার। কোথায় রেখেছে প্রমিতকে, বলো। আমি দেখে আসি।" তুষার মোহরকে নিয়ে এগিয়ে যায়। ফার্স্ট ফ্লোরের এমার্জেন্সী করিডোরের শেষ প্রান্তে যেখানে কেবিন শুরু হয়েছে, ওইদিকে। গোটা হাসপাতালে ডিসিনফেকটেন্টের গন্ধ। মোহরের গা গুলিয়ে ওঠে। মাথা হালকা লাগে। দেওয়াল ধরে ধরে ও এগিয়ে যায়। নির্দিষ্ট দরজার সামনে। তুষার আর আসেনি। সৃজনী এক রয়েছে, এই বলে ও নীচে চলে গিয়েছে। কাকু কাকীমাকে ফোনে চেষ্টা করতে হবে আবার। মুহূর্তের জন্য মোহর থমকে দাঁড়ায়। তারপর সাহস করে দরজাটা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।
কনকনে ঠান্ডা ঘর। সাদা দেওয়াল, সাদা মেঝে। ঝকঝকে তকতকে। মধ্যিখানে সাদা বেডের ওপর সাদা চাদর ঢাকা একজন। এই তবে প্রমিত? মোহর আস্তে আস্তে পা ঘষে ঘষে এগিয়ে যায়। বিছানার পাশে রাখা চেয়ার টেনে বসে। একবার তাকায়। কিন্তু ওই দৃশ্য দেখতে পারবেনা বলে চাদরটা তৎক্ষণাৎ টেনে ঢেকে ফেলে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁদতে থাকে। শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে ওর। বারবার মনে পড়তে থাকে প্রমিতের মুখ। বারান্দা থেকে দেখা, শেষবারের মতো। বাইক নিয়ে বেরোচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় মোহর বলতে থাকে, "আই এম সরি প্রমিত। সেদিন তোমার সাথে একটু বেশিই রুড বিহেভ করেছিলাম। ক্ষমাও চাওয়া হয়নি। তার মধ্যে এরকম হলো। কেন করলে এরকম? একটু দেখেশুনে বাইক চালাতে পারো না? দুচক্ষে দেখতে পারিনা আমি এই বাইক। প্রমিত, কাকু কাকীমার কী হবে বলো তো? ঠাকুরের বায়না দিতে গিয়ে বাড়ি ফিরে এই খবর শুনবে? প্রমিত... ভেবেছিলাম সব ভুলে নতুন করে চেষ্টা করবো, বন্ধু হবো। হবো..."
একটা নরম হাতের স্পর্শ কাঁধে টের পেয়ে মোহর চমকে উঠে পাশ ফেরে। এ কী। এ কী দেখছে ও? হলুদ টিশার্টে প্রমিত? চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মুখে এক গাল হাসি। মোহরকে চমকে দিয়ে বললো, "ভয় নেই। আমি ভূত নই। আমি প্রমিতই। জ্যান্ত আছি। মরিনি। অত সহজে রেহাই দেবো না।" মোহরের বিস্ময়ের সীমা ধরে না। চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রমিতের দিকে। বিশ্বাস করতে পারছে না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে, পুরো। ইতিমধ্যে ঘরে প্রবেশ করে তুষার আর সৃজনী। দুজনেই ফিকফিক করে হাসছে। ওদের কথা থেকে মোহর জানতে পারে, পুরোটাই প্রমিতের প্ল্যান। প্ল্যান সাগরেদ সৃজনী। তুষার বলে, "দেখো মোহর। আমি কিন্তু শুরুতে কিচ্ছু জানতাম না। অনেক পরে সৃজনী আমায় বলেছে। আমি বারণ করেছিলাম। এইরকম শক থেরাপি দিতে। ওরা শোনেনি।" সৃজনী তুষারের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, "শোনো, এই দেওর বৌদির শোক থেরাপি না হলে কী আর নায়িকা মচকাতো? মাঝে মাঝে এইসব শোক ও শক, দুইয়েরই দরকার। মনের ভিতরের কথাটা বোঝার জন্য, জানার জন্য। বলো তোমরা, এটা না হলে মোহর রানী কি কখনোই বুঝতে পারত যে মনের ভিতরে একজন কবেই এমন স্থায়ী আসন পেতে নিয়েছে?" মোহর এখনও অপ্রস্তুত হয়েই রয়েছে। কিছু বলছে না। সৃজনী ওকে হালকা টোকা মেরে বলে, "দেখ বাপু, এইসব আইডিয়া মেইনলি প্রমিতের। এর মধ্যে একদিন এসে বললো, তোকে ভালোবাসে। তোর মনের খবর কী করে জানা যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে এই প্ল্যান। নার্সিং হোমের দুজন ডাক্তার ওদের স্কুলের ক্লাসমেট। সব প্ল্যান হলো। আমি অভিনয় করে গেলাম। তুইও ভালোই প্ল্যানমতই চললি, মানে যেমনটা আমরা ভেবেছিলাম। গোটা ব্যাপারটাই স্মুদ।" মোহর আর একটা কথাও না বলে গটগট করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। চোখ মুখ লাল।
অদ্ভুত দোটানায় ভুগছে। নিজের মনের খবর শেষমেশ এরকম ভাবে ওকে পেতে হবে, ভাবতে পারেনি মোহর।
কান্না পাচ্ছে ওর। এরকম ভাবে ওর অনুভূতিকে বাজি ধরে এত সিরিয়াস একটা বিষয়ে এরকম নাটক করতে পারলো ওরা?
হাসপাতালের বাইরে এসে পড়েছে। এইবার একটা অটো নিয়ে ফিরে যাবে বাড়ি। ছেড়ে চলে যাবে ও হৃদয়পুর। ওকে দেখে একটা অটো এসে দাঁড়ায়। "দাদা, নতুন বাজারের মোড় চলুন" বলে ও ভিতরে বসতে যায়, এমন সময় শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে প্রমিত। "প্লিজ, প্লিজ মোহর। যেয়ো না। আই ইনসিস্ট।" মোহর থমকে যায়। এ কী হচ্ছে ওর সাথে। মন চাইছে এক, আর ও করছে আরেক? কেন প্রমিতের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ও চলে যাচ্ছে না? নাকি ওই যেতে চাইছে না? মোহর স্থির হয়ে থাকে। প্রমিত ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলে, "আমি জানি মোহর, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই যে, সৃজনী বললো না? এইটা না হলে আমরা দুজনেই অনেককিছু বুঝতাম না। আই এম এক্সট্রিমলি সরি মৌ। প্লিজ ফরগিভ মি।" মোহরের দু চোখ জ্বালা করছে। যে কোনো মুহূর্তে কুল ছাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। প্রমিতের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, "আর কোনদিনও যদি এরকম করো না, দেখবে, ডিভোর্স দিয়ে দেবো!" প্রমিত হেসে ফেলে। বলে, "বিয়ের প্রস্তাব শোনার আগেই ডিভোর্স?" এইবার মোহর কান্না হাসি মিলিয়ে উত্তর দেয়, "এত কিছুর পর বিয়েটা না করলে আস্ত থাকবে ভেবেছো? জনাব, ইশকবাজি ম্যায় হাম ভি কুছ কম নহি।"
প্রমিত মোহরকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে। আঃ, কী আরাম এই স্পর্শে। কী ভরসার জায়গা।
(ক্যামেরা জুম আউট করতে থাকে। অটোওয়ালা, পেশেন্ট পার্টি, রাস্তার গাড়ি বাস সব ফেড হতে থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ডে শাহরুখ এসে ম্যান্ডলিন বাজিয়ে যায়। শনশনে হাওয়া বইতে থাকে। সেই হাওয়ায় মোহরের চুল উড়তে থাকে। প্রমিত আর মোহর একে অপরের দিকে তাকায়। তারপর গভীর আদরে একে অপরের ঠোঁটের ওপর ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। ঠিক যেন যব উই মেট সিনেমার শেষ দৃশ্য। যাক, সব ভালো যার শেষ ভালো তার।)
No comments:
Post a Comment